পারিবারিক মণ্ডলে দীনের কথা বলার ক্ষেত্রে লক্ষনীয় কিছু দিক-১১

এবার আমরা যে কাজগুলো থেকে বা চারিত্রিক দূর্বলতা থেকে দূরে থাকলে ধৈর্য সহকারে পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দীনের কথা বলা সহায়ক হবে সেই বিষয়ে একটু আলোচনায় আসি। কঠোরতা, উগ্রতা ও মেজাজের ভারসাম্যহীনতা থেকে অবশ্যই নিজেকে দূরে রাখা।

প্রতিটি মানুষের মাঝেই ফিতরাতের কিছু ভালো দিক রয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ার কারনে সেই ভালো বীজ চারায় ও ফলদায়ক গাছে পরিনত হতে পারেনি। আমরা যারা কুর’আন হাদীস অধ্যয়ন করে মহান আল্লাহর পথে চলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, দীনের পথে নিজে ও অন্যকে চালানোর আহবান করার জন্য, অঙ্কুরেই যেন চারা গাছ নষ্ট না হয়ে যায় সেইরকম উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে, আর তা হলো সহজতা, আন্তরিক ভালোবাসা ও মেজাজের শীতলতা।

আমাদের সমাজে দেখা যায় এখন, যারা ইসলামের অনুসরন করতে চান তারা অনেক ক্ষেত্রে যারা অনুসরন করেন না বা মানতে চান না, তাদের সাথে কঠোরভাবে ইসলামের বিধান তুলে ধরেন আবার যারা ইসলামের বিধান অনুসরন করেন না তারাও যারা অনুসরন করেন তাদের সাথে উগ্র ধরনের আচরন করে থাকেন। এই দুটোর কোনটাই ঠিক নয়।

একদিন মসজিদে জুমা পড়তে গিয়ে খুতবার জন্য বসেছিলাম, এমন সময়  ১৪-১৫ বছর বয়সি একটি মেয়ে এসে বসলো, খানিকটা দূরে। আমি লক্ষ্য করলাম, মেয়েটা গাঢ় লাল লিপষ্টিক লাগিয়ে, একটু বেশী সাজ গোজ করে এসেছে, তার পাশের একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা তাকে দেখেই একটু ক্ষেপে বলে ফেললেন, এটা কি সাজগোজের জায়গা। এইভাবে মসজিদে এলে নামাজই হবে না। অন্য আরো ২/১জনকে নিয়ে মেয়েটিকে অনেক কথা বলতে লাগলেন। মেয়েটি খুবই অসহায় হয়ে চুপ করে মাথা নীচু করে রইলো। একটু পরে দেখলাম সেই মধ্য বয়স্ক মহিলা অন্য কাতারে চলে গেলেন। আমি মেয়েটিকে আমার কাছে বসার জন্য ডাকলাম, মেয়েটি মনে হলো একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। তখন আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, তুমি কিছু মনে করো না। সেই মেয়েটি তখন একটো কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, আন্টি! “আমি বিয়ের দাওয়াতে যাবার জন্য বাবার সাথে বের হয়েছি, বাবা মসজিদে জুমার নামাজ পড়বে বলে আমাকেও আসতে হলো। আমি কখনো মসজিদে আসি নি। আম্মু আসেনি আমার সাথে। আমি আসলে নিয়ম কিছু জানি না”। এই অবস্থায় আমারই খুব লজ্জা লাগছিলো যে, আমাদের এই আচরনের জন্যই কত অমুসলিমতো দূরে থাক মুসলিম পরিবারের সদস্যরাও বিমুখ হয়ে যেতে পারে। আমি মেয়েটিকে বুঝিয়ে বললাম, কয়েকটি বই তাকে দিলাম। মসজিদের আদব ও সৌন্দর্য তুলে ধরলাম, তাতে মেয়েটি খুব আশ্বস্ত হলো। আমাকে বললো আন্টি! আপনিও আমাকে বুঝালেন আর উনারাও কিভাবে আমার সাথে আচরন করলেন! আমি তাকে বললাম, এইভাবে বলো না। মুরুব্বী বুঝতে পারেন নাই। আল্লাহ আমাদের মাফ করে বুঝার তাওফিক দান করুন। এইজন্যইতো তোমাদের বয়সি মেয়েদের আরো ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করা ও সুন্দর আচরন দিয়ে ইসলামের শিক্ষা তুলে ধরা প্রয়োজন। জুমার খুতবা শুনতে এসো তাহলে অনেক কিছু শিখতে পারবে। মেয়েটি সানন্দে মাথা নেড়ে আমার পাশে বসে সালাত আদায় করে চলে গেলো।

পরিবারে সন্তানদের সালাত আদায়ের জন্য এমনভাবে বকা ঝকা করে থাকেন অনেকে, ফলে বিরক্ত হয়ে যায় ওরা। সহজ সুন্দর করে নামাজের প্রয়োজন, ও না পড়লে ক্ষতির দিক তুলে ধরি আমরা কয়জন! আল্লাহর সাথে ভালোবাসার কথা আমরা কতজন তুলে ধরি!

উগ্রতা ও মেজাজের ভারসাম্যহীনতার জন্য ক্ষতিকর দিক সমূহ

নিজের ব্যক্তিগত ইবাদাতে মনের স্থিরতার ব্যাঘাত ঘটে।

শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়( মাথা ব্যথা, মাথা ধরা, প্রেসার বেড়ে যাওয়া, হিষ্টামিন রিলিজ হয়..)

পরিবেশে একটি তিক্ত অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়।

দাওয়াতের কথার প্রভাব যা হওয়ার কথা তা ব্যাহত হয়।

ভবিষ্যতে দীনের কথা বলা ও শুনার চাহিদাকে দমন করে দেয়।

একসময় শয়তান দীনের কথা বলার প্রয়োজন নেই, এদের আর বলে লাভ নেই ইত্যাদি বলে ব্যক্তিকে দমিয়ে দেয় তার দায়িত্বপালন থেকে।

হজরত হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন:

“ক্রোধের সময় সহনশীলতার ঢোক এবং মুসিবতের সময় ধৈর্যের ঢোকের চেয়ে বড় ঢোক কেহ গলধকরণ করেনি।”

 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এক লোক আরেক লোককে গালি দিল। যাকে গালি দেয়া হলো সে গালি দেয়া লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : ‘তোমাদের দু’জনের মাঝে একজন ফেরেশতা অবস্থান করছিলেন। যখনি এ লোকটি তোমাকে গালি দিচ্ছিল ফেরেশতা তোমার পক্ষ হয়ে তাকে বলছিলেন বরং এ গালি তোমারই প্রাপ্য। আর যখন তুমি তাকে বললে, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক তখন তিনি (ফেরেশতা) বললেন, না বরং শান্তি তোমারই উপর বর্ষিত হোক। শান্তি তোমারই প্রাপ্য।’(তাফসীরে ইবন কাসীর, খ: ৩, পৃ: ৩২৪-৩২৫)

আল্লাহর বান্দা মূর্খ ও নির্বোধ লোকদের সাথে নিজ থেকে তো কোন ধরনের বাক-বিতন্ডায় জড়াবে না, এমনকি তারা যদি গায়ে পড়ে তার সাথে ঝগড়া করে তার সাথে অশালীন কথা বলে অভদ্র আচরণ করে, তাহলে এ ক্ষেত্রে তার করণীয় হলো তাদেরকে এড়িয়ে চলা। আর এ এড়িয়ে চলা মোটেই দুর্বলতা প্রদর্শন নয়, বরং এর মাধ্যমে সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা পায় আর অনর্থক সময় নষ্ট হয় না। আল্লাহ তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বান্দাহ মুহাম্মদ সা. কে এ হেদায়েতই দিয়েছিলেন :

 ‘তারা (কাফেররা) যা বলে তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সুন্দরভাবে তাদেরকে পরিহার করে চল।’ সূরা মুযযাম্মিল: ১০

রাসূল সা. কে আল্লাহ যে হেদায়েত দিয়েছেন, তা তার অনুসারীদের জন্যও প্রযোজ্য। তাই যারাই আল্লাহর পথে চলে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার মর্যাদা অর্জন করতে চায়, তারা তাদের বিরোধীদের কঠোর সমালোচনা, অপবাদ, নিন্দা, অশালীন কথা, বিদ্রূপ, সাজানো ভিত্তিহীন কথায় ধৈর্য ধারণ করবে ও তাদের এ ধরনের আক্রমণকে এড়িয়ে চলবে।

পরিবার ও আত্মীয়দের মাঝেও এইভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। অনেকে হতাশ হয়ে বলেন,অনেক বলেছি,শুনেই না আমার কথা,পালন করবে দূরের কথা! তাই এখন আর কিছু বলিনা। মনে রাখা দরকার এটাও একটি শয়তানী চক্রান্ত। মহান আল্লাহ আমাদের বলা বা প্রচার করে অহীর দাওয়াত পৌছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন,শুনানো বা আমল করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেননি। তাই মৃত্যু পর্যন্ত এই কাজ করে যেতে হবে। মহান আল্লাহ জানেন যে মানুষের জ্ঞান কতদূর উন্নত হতে পারে এবং দুনিয়ার বিজ্ঞানকে কত উন্নত নিতে পারবে,সেই মহান আল্লাহই এই জ্ঞান ও যোগ্যতা মানুষকে দিয়েছেন,আর এই মহান আল্লাহই কিয়ামত পর্যন্ত জীবন বিধান হিসেবে আল কুর’আনকে নির্ধারন করে দিয়েছেন। সুতরাং এর প্রতিটি নির্দেশিকাই আমাদের সবার জন্য যুগ,কাল নির্বিশেষে প্রযোজ্য।

তাই নিজেরাও এই পথে অটল থেকে ধৈর্য্য সহকারে রাসূলের স. উম্মত হিসেবে কাজ করে যেতে হবে। দীন কায়েম কার জীবনে হবে, কাদের দিয়ে, কোন যমীনে, কোন সময়ে হবে তার ফয়সালাকারী একমাত্র মহান আল্লাহই। তাই হতাশ বা পিছপা হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

দীনের কথা বলার জন্য সহজ সাবলীল পন্থা অনুসরন করার কথা এসেছে। জীবনকে সহজতার মধ্যে রাখলেই তা সম্ভব।

কিন্তু সহজতার মানে কিন্তু তা নয় যারা ভুল করছেন তাদের ভুলের সাথে একাত্ম হয়ে হকের কথা বলাকেউ নোংরা জীবনে অভ্যস্ত,যেমন বাজে মুভি ও গান নেশা নিয়ে থাকেন,তাকে হেদায়েতের কথা বলার জন্য তার সাথে বসে মুভি দেখা ও গান শুনা বা নেশা করা অবশ্যই হিকমাত বলে না, এটাও শয়তানের প্ররোচনা।

অনেকে আবার গায়ের মাহরামকে দীনের দাওয়াত দেবার কাজে খুবই আগ্রহী হয়ে যান এবং শরীয়ার বাইরে ভূমিকা রাখা শুরু করেন, এটাও হিকমাত নয়।

অনেকে আবার দীনের দাওয়াত দেয়ার কাজে এতো বেশী ব্যস্ত হয়ে যান নিজের ব্যক্তিগত আমল কমিয়ে ফেলেন, এটাও হিকমাত নয়।

তথাকথিত আধুনিক মহলে দাওয়াতের কাজের উপযুক্ততা আনার কথা বলে নিজেই শরীয়ার বাইরে চলে যেয়ে তথাকথিত আধুনিক হয়ে যান যা হিকমাত নয়।

দীনের কথাকে অন্যের কাছে আকর্ষনীয় করতে যেয়ে এমন রঙ মেখে ফেলেন দেখা যায় অনেক শরীয়ত বিরোধী যুক্তিকে টেনে নিয়ে আসেন,মূল কথাকে পাশ কাটিয়ে যান। এটাও হিকমাত নয়।

সত্য সুন্দর দীনের আকর্ষন কিভাবে আসবে তা মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল স.এর চরিত্রের মাঝে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই কুর’আনের বাস্তব নমুনা আমাদের প্রিয় রাসূল স.কেই অনুসরন করতে হবে,তাহলে সকল ফেতনা থেকে নিজেদের বাচিয়ে হকের পথে ইস্তিকামাত হতে পারবো ইন শা আল্লাহ।

আমাদের মাঝে এমন অনেক ভাই ও বোন আছেন যারা হকের কথা বলা ও অন্যায় থেকে দূরে থাকার কথা বলার কাজ করে গিয়েছেন অনেক দিন বা বছর। সেই সময়গুলোতে তারুন্যের উদ্দীপনাই হোক বা কেউ তাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে গিয়েছেন অথবা তার পরিবেশে এমন ব্যক্তিদের সাথে উঠা বসা ছিল যারা এই কাজ করে অভ্যস্থ, সেই সময়ে কিছু কুর’আন ও হাদীসের পাঠে নিজেকে সংযুক্ত রেখেছিলেন, কোন মানসিক কষ্ট বা অশান্তি বা না পাওয়ার বেদনা থেকে এই পথে আসার সুযোগ হয়েছিল অথবা নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এটাই সঠিক পথ। কিন্তু সময়ের আবর্তনে, পরিবেশ পরিবর্তন, দীনের সংগী সাথীর অবর্তমানে, বাস্তব জীবনের জীবন সংগ্রামে যুক্ত হওয়াতে, যে কোন কারনকে সামনে দাঁড় করালেও মূল কথা হলো দীর্ঘ সময়ের সঠিক পথ থেকে দূরে যেয়ে এখন নিজ প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ে চলছেন।

এই ভাই ও বোনেরা কিন্তু অকপটে গল্প করেন সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা এবং খুব আত্মতৃপ্তি নিয়েই বলেন, কতকাজ করেছেন দীনের জন্য, কত সময় দিয়েছেন এই পথে, শরীয়ার নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে কত শক্ত মনোবল বা ঈমানীয়াত নিয়ে চলেছেন ইত্যাদি। কতগুলো প্রশ্ন চলে আসে এই অবস্থার ভাই বোনদের প্রতি–

আপনার বর্তমান অবস্থাটা যে, একদম ঈমানের নাজুক অবস্থা- এটা বুঝেও কিসের মোহে বা ঘোড়ে নিজের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে আছেন?

যে কোন সময় মৃত্যুর হাতছানি চলে আসতে পারে, তাহলে কি অতীতের ভালো কাজ দিয়েই জান্নাতের সার্টিফিকেট পেয়ে গিয়েছেন বলে কেউ আশা দিয়েছেন?

একবারও কি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের কারন সমূহকে খুজে বের করার চেষ্টা করেছেন?

অবস্থা পরিবর্তনের কারন সনাক্ত করার পর কি, কোন উদ্যোগ নেয়ার ইচ্ছা মনে এসেছে?

নিজের নাজুক অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য আল্লাহর কাছে পেরেশান হয়ে কি ধর্ণা দিতে মন চেয়েছে?

এই ভাই বোনদের দেখে অন্যরাও যে আরো বেশী বিভ্রান্ত হচ্ছেন সেটা নিয়ে কি ভয় আসে না?

নিজের গুনাহ সহ অন্যদেরকেও বিপথের দরজা দেখানোর দায়ে বিচারের মাঠে পাকড়াও হতে হবে সেটা কি মনে আসে না?

কেউ যদি নদী পার হতে যেয়ে মাঝ নদীতে নৌকার হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন, অনেক কষ্ট করে বাতাসের প্রতিকূলতাকে ছাড়িয়ে নৌকা নিয়ে অনেকদূর পার হয়ে এসেছি,এখন বৈঠা ফেলে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে আছেন,আর ভাবছেন এতক্ষন কত শক্তি দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে কিভাবে হাল ধরে এলাম ইত্যাদি,তাহলে কি নঙ্কা যেখানে যেতে চাছেন সেই তীরে পৌছুতে পারবে? এর মাঝে আবার প্রতিকূল বাতাস আসবে না কিভাবে আস্বস্থ হলেন? এইভাবে কি কেউ তীরে পৌছুতে পারে?

আসলে আজ আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষই দুনিয়ার লোভ লালসায় ও প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়ে চলছে, তাই এই অবস্থা। এই অবস্থা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও অহীর জ্ঞানের সাথে জোড়ালো সম্পর্ক।

খুবই কষ্টদায়ক, খুবই পীড়াদায়ক এই ধরনের জীবন যাত্রায় যখন আমাদের দীনী ভাই বোনদের দেখা যায়। খুবই মায়া লাগে, আফসোস লাগে তাদের এই জীবন যাত্রা দেখে এবং সবচেয়ে বেশী যা লাগে তা হলো ভয় বা আতঙ্ক। আর এই ভয় লাগার কারন হলো, আমার নিজের পরিনতি যেন সেই অবস্থায় না যায় বরং শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত মহান রবের দেখানো পথে নিজেকে যুক্ত রেখে যেতে পারি। আর তাই সব সময় মহান রবের কাছে চাওয়া দরকার যে—

“রসূল (সঃ) প্রায়ই এই দোয়া করতেন—(ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুবি ছাব্বিত ক্বলবি য়ালা দ্বীনিক)

হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী ! আমার অন্তরকে তোমার দীনের উপর মজবুত(দৃঢ়) রাখো।

সাহাবা বললেন, হে আল্লাহর নবী ! আমরা আপনার প্রতি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান এনেছি।আপনি কি আমাদের সম্পর্কে কোনরুপ আশংকা করেন?

তিনি বলেন-হাঁ, কেননা সমস্ত অন্তরই আল্লাহর আংগুলসমূহের মধ্যকার দুটি আংগুলের মাঝখানে রয়েছে। তিনি তা যেভাবে ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। তিরমিযী

«يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغيثُ أَصْلِحْ لِي شَأْنِيَ كُلَّهُ وَلاَ تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ».

 (ইয়া হাইয়্যু ইয়া ক্বাইয়্যূমু বিরহ্‌মাতিকা আস্তাগীসু, আসলিহ্‌ লী শা’নী কুল্লাহু, ওয়ালা তাকিলনী ইলা নাফসী ত্বারফাতা ‘আইন)।

 “হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী! আমি আপনার রহমতের অসীলায় আপনার কাছে উদ্ধার কামনা করি, আপনি আমার সার্বিক অবস্থা সংশোধন করে দিন, আর আমাকে আমার নিজের কাছে নিমেষের জন্যও সোপর্দ করবেন না।” আত তারগিব তারহিব ১/২৭৩

اللَّهُمَّ  إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ أَعْلَمُ».

 (আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযু বিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া ‘আনা আ‘লামু ওয়া আস্তাগফিরুকা লিমা লা আ‘লামু)।

“হে আল্লাহ! আমি জ্ঞাতসারে আপনার সাথে শির্ক করা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই এবং অজ্ঞতাসারে (শির্ক) হয়ে গেলে তার জন্য ক্ষমা চাই।”

আহমাদ ৪/৪০৩, নং ১৯৬০৬; ইমাম বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ, নং ৭১৬।

একটি প্রশ্ন যা আমরা বরাবর সাধারন মুসলিমের কাছ থেকে শুনা যায় তা হলো–

যেকোন পাপকার্য সম্পাদনের ঘটনা কি তাকদিরে লিখিত এবং আল্লাহ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে কেন আল্লাহ তাঁর কিছু বান্দার জন্যে পাপ কার্য সম্পাদনের নিয়তি নির্ধারন করলেন এবং কিছু বান্দার জন্যে ভালো কাজ সম্পাদন নির্ধারণ করলেন, আমরা কি সকলেই সমান মানুষ নই ?

এই উত্তরটি বিশেষ এক ব্যক্তি ইসলামী স্কলার্স এর কাছ থেকে শুনা যাক। আর তিনি হলেন শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

আলহামদুলিল্লাহ, একজন ব্যক্তি অবশ্যই দুটি বিষয়ে বিশ্বাস করবেন:

(১) যে আল্লাহ, তাঁর মর্যাদা সর্বাধিক, তিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং এই সৃষ্টিজগতে কোন কিছুই তাঁর ইচ্ছা ব্যতীরেকে সংঘটিত হয় না। তিনি জানেন অনাগত বিষয় সম্পর্কে , জানেন সামনে কি ঘটতে চলেছে এবং তিনি তাকদীরে সবকিছু নির্ধারিত করেছেন এবং কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন আসমান ও জমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে। একথাটি সহীহ হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ন্যায়বিচারক এবং কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করেন না। কেননা তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে অমুখাপেক্ষী এবং তাদের কাছে তাঁর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। তিনি পরম দয়ালু এবং চিরন্তনভাবে তাদের প্রতি মহান দাতা, কাজেই কিভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতি অবিচার যুলুম করতে পারেন ?

কুরআন ও সুন্নাহর বহু স্থানে তাকদীরের এই নীতিটি বর্ণিত হয়েছে। যেমন এই আয়াতসমূহে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন:

 “আমি প্রত্যেক বস্তুকে পরিমিতরূপে (ক্বাদর সহকারে) সৃষ্টি করেছি। [সূরা কামার ৫৪;৪৯]

পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। [সূরা হাদীদ ২২]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়তি (তাকদীর) লাওহে-মাহফূযে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।(মুসলিমঃ ২৬৫৩)

(২) মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতা রয়েছে যার দ্বারা সে কোন কাজ যেমন করতে পারে তেমনিভাবে কোন কাজ না করে তা থেকে বিরতও থাকতে পারে। সে বিশ্বাস যেমন করতে পারে তেমনি অবিশ্বাসও করতে পারে, সে মান্য করতে পারে কিংবা অমান্য করতে পারে। আর এ স্বাধীনতার কারণেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, দায়ী করা হবে এবং কর্মানুসারে পুরষ্কৃত কিংবা শাস্তি প্রদান করা হবে। যদিও এসব কিছুই আল্লাহ জানেন যে সে কি ধরণের কাজ সম্পাদন করবে, সে মানুষ নিজের জন্য কি নির্বাচন করবে এবং তার শেষ পরিণতি ও গন্তব্যস্থল কি হবে। কিন্তু আল্লাহ তাকে কোন মন্দ কাজ করাতে বাধ্য করেন না, কিংবা কাউকে কুফর নির্বাচন করতে বাধ্য করেন না, বরং তিনি সুস্পষ্টভাবে মানুষকে হেদায়তের পথ দেখিয়ে থাকেন। আর এ কারণে তিনি নবী-রাসূল (তাদের সকলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) প্রেরণ করেছেন এবং আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন এবং সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। যে কেউ ভ্রান্ত পথের অনুসরণ করে সে তা করে নিজের ক্ষতির জন্যেই।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন:

বলুনঃ সত্য তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছা, বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক। ([সূরা কাহাফ:২৯)

আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ হয়, না হয় অকৃতজ্ঞ হয়। (সূরা ইনসান ৩)

অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। (সূরা যিলযাল ৭-৮)

আওয়াজ আসবেঃ এটি জান্নাত। তোমরা এর উত্তরাধিকারী হলে তোমাদের কর্মের প্রতিদানে। (সূরা আরাফ ৪৩)

তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে স্থায়ী আযাব ভোগ কর। (সুরা সাজদা:১৪)

আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তায়ালা বলছেন, মানুষের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ঈমান আনে এবং সৎ কর্ম করে তা করে নিজের ইচ্ছায় এবং স্বাধীনভাবে তা নির্বাচন করে, এরপর সে জান্নাতে প্রবেশ করে অথবা সে অবিশ্বাস করে, মন্দ কাজ করে নিজের ইচ্ছায় এবং স্বাধীনভাবে তা নির্বাচন করে, এরপর সে জাহান্নামে প্রবেশ করে।

প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অন্তর-বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করে কিংবা আশেপাশের মানুষদের দেখে জানে যে আমাদের কোন কাজটি ভাল কিংবা মন্দ, কোনটি আনুগত্য কিংবা অবাধ্যতা পাপ-এগুলো করা কিংবা না করা আমাদের নিজেদের ইচ্ছা, এবং আমরা এমন কোন শক্তিও অনুভব করি না যা জোর করে আমাদের এগুলো করতে বাধ্য করে।

আপনি যেমন অভিশাপ দিতে পারেন, শপথ করতে পারেন, মিথ্যা-গীবত করতে পারেন ঠিক তেমনিভাবে পারেন আল্লাহর প্রশংসা করতে, তার মর্যাদার কথা ঘোষণা করতে, ক্ষমার জন্যে প্রার্থনা করতে, সত্য কথা বলতে এবং ভালো উপদেশ দিতে। আপনি পারেন অলস বিনোদনের স্থানের দিকে অগ্রসর হতে, মন্দ ও মিথ্যার দিকে হেঁটে যেতে আবার আপনি মসজিদ কিংবা আনুগত্য ও ভালো কাজের দিকেও স্বাধীনভাবে অগ্রসর হতে পারেন।

একজন মানুষ তার হাত দিয়ে আঘাত করতে পারে, চুরি করতে পারে, মিথ্যা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে কিংবা সে পারে অভাবী লোকের সাহায্য করতে, ভালো কাজ অনুগ্রহ করতে। প্রত্যেকেই এই কাজগুলোর মধ্যে থেকে কিছু না কিছু করে থাকে এবং কেউ বলতে পারবে না, তাকে তার নিজের স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন একটি অদৃশ্য শক্তি তাকে বাধ্য করিয়েছে কিংবা জোর খাটিয়ে এগুলো করিয়েছে বরং সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পছন্দানুসারে ভালো কিংবা মন্দ কাজ করে এবং এর কারণে এই কাজগুলোর জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে; যদি তার আমল ভালো হয় তাহলে সে এর উত্তম প্রতিদান পাবে আর যদি খারাপ আমল হয় তাহলে সে অনুরুপ মন্দ ফলাফল লাভ করবে।

`আর আল্লাহ যা কিছু নির্ধারিত করেছেন সেগুলো হচ্ছে এমন কিছু বিষয় যা সম্পর্কে মানুষ সেই কাজটি করার আগে জানতে পারে না এবং সে তার উপর ভিত্তি করে তার কাজ করতে পারে না কিংবা এটাকে কোন অজুহাত হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে না। মানুষের জন্যে এটা মানানসই নয় যে সে তার প্রতিপালকের কাছে প্রশ্ন আবেদন করে জানতে চাইবে কেন তিনি কাউকে অভিশপ্ত করেছেন কিংবা কাউকে ভালো কিছু দান করেছেন। আল্লাহ যাকে অভিশপ্ত করেছেন তার প্রতি অবিচার যুলুম করেননি, বরং তিনি তাকে সময়, স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দান করেছেন, উপরন্তু তিনি মানুষের কাছে বার্তাবাহক রাসূল পাঠিয়েছেন, তাদের সাথে তিনি কিতাব নাযিল করেছেন, তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সতর্ক করেছেন সব ধরনের সতর্কতা দিয়ে যেমন বিপর্যয় ও পরীক্ষা দিয়ে, যাতে মানুষ তাঁর নিকট তাওবা করে এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। যদি সে মানুষ ভ্রান্তি ও গোমরাহীর পথ বেছে নেয় এবং অপরাধী পাপীদের পথ অনুসরণ করে তাহলে সে কেবল নিজের ক্ষতি করলো এবং সে নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিলো, অভিশপ্ত করলো, আর একথাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ঘোষণা করছেন,

যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। (সূরা শামস ৯-১০)

বস্তুতঃ আল্লাহ তাদের উপর কোন অন্যায় করেননি, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের উপর অত্যাচার করছিল। (আলে ইমরান ১১৭)

তাদের সংবাদ কি এদের কানে এসে পৌঁছায়নি, যারা ছিল তাদের পূর্বে; নূহের আদের ও সামুদের সম্প্রদায় এবং ইব্রাহীমের সম্প্রদায়ের এবং মাদইয়ানবাসীদের? এবং সেসব জনপদের যেগুলোকে উল্টে দেয়া হয়েছিল? তাদের কাছে এসেছিলেন তাদের নবী পরিষ্কার নির্দেশ নিয়ে। বস্তুতঃ আল্লাহ তো এমন ছিলেন না যে, তাদের উপর জুলুম করতেন, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করতো।([সূরা তাওবা ৭০)

 

পরিশেষে এ কথা বলা যায়, আল্লাহ হলেন ভালো মন্দ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত করেছেন, অভিশপ্ত ও করুণাপ্রাপ্তদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এই বিশ্বাস পোষণ করার মানে এই নয় যে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর জোর খাটিয়ে কাউকে আনুগত্য করান কিংবা কাউকে অবাধ্যতা করান। বরং তিনি তাঁর বান্দাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রদান করেছেন এবং ভালো মন্দ বাছাইয়ের ক্ষমতা প্রদান করেছেন, আর এর উপরেই বান্দারা ইচ্ছানুসারে আমল করে, যার ফলে তাদের আমলের জন্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি যুলুম করেন না।

আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।

 

পরিবার গঠনে সবর

সবরের আলোচনায় এসে আমরা অনেক দিক যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের মুখোমুখি হতে হয় তা উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।

আজ আমাদের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে পরিবার গঠন নিয়ে। অবশ্যই আমি সেই পরিবার গঠন বলছি না, যেখানে একজন ব্যক্তি পুরু পরিবারকে দুনিয়ার ক্যারীয়ার ও খ্যাতি, অর্থ সম্পদ লাভেই সন্তুষ্ট থেকে মরিয়া হয়ে ছুটে চলেছেন। আমি বলছি সেই পরিবার গঠন, যেই পরিবার হবে আখেরাতের জান্নাতের অধিকারী, পরিবারের সবাই এক লক্ষ্য-“ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি” যাকে পূঁজি করে ছুটে চলেছে, পথিমধ্যে দুনিয়ার সম্পদ, ক্যারীয়ার, খ্যাতিকে সাথে নিয়েই সেইভাবে কাজে লাগিয়ে চলেছে। প্রথম গ্রুপের পরিবারে শয়তান খুব একটা গতিশীল ভূমিকা রাখার প্রয়োজন বোধ করে না, কিন্তু ২য় গ্রুপের পরিবারের জন্য শয়তান মরিয়া হয়ে পিছু লেগে যায় কিভাবে একটু হলেও যদি পদস্খলন করানো যায়।

তাই অনেকে যারা শুধু দুনিয়ার পিছনে ছুটতে যেয়ে আখেরাতকে ভুলে গিয়েছে তাদের চাকচিক্য দেখে অস্থির বা কষ্ট পাওয়ার কোন কারন নেই, খাঁটি মুমিনেরা বরং তাদের অবস্থার জন্য আফসোস করে এই ভেবে যে, ইস ওরা যদি সঠিক ভাবে ইসলামকে বুঝতো তবে ওদের জন্য যেমন কল্যান হতো তেমনি সমাজও কিছু ইসলামের আলো পেতো। অনেকে ইসলামের শরীয়ার বাইরে থেকে দুনিয়ার উন্নতি করছে দেখে, নিজেদের লোভ লালসাকে সংযত করতে না পেরে দীনের পথ থেকে সরে যায়। যারা দুনিয়ার লোভে যারা অন্যের চাকচিক্য দেখে সরে যান দেখুন, মহান আল্লাহ কি বলেছেন-

মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদী পশু ও কৃষি ক্ষেতের প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র। প্রকৃতপক্ষে উত্তম আবাস তো রয়েছে আল্লাহর কাছে।

বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো, ওগুলোর চাইতে ভালো জিনিস কি? যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বাগান, তার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরন্তন জীবন লাভ করবে। পবিত্র স্ত্রীরা হবে তাদের সঙ্গিনী এবং তারা লাভ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ তার বান্দাদের কর্মনীতির ওপর গভীর ও প্রখর দৃষ্টি রাখেন। সূরা আলে ইমরান:১৪-১৫

যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের জন্য দুনিয়ার জীবন বড়ই প্রিয় ও মনোমুগ্ধকর করে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের লোকেরা ঈমানের পথ অবলম্বনকারীদেরকে বিদ্রূপ করে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকওয়া অবলম্বনকারীরাই তাদের মোকাবিলায় উন্নত মর্যাদার আসীন হবে। আর দুনিয়ার জীবিকার ক্ষেত্রে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত দান করে থাকেন। সূরা আল বাকারা:২১২

আর এও স্মরণ করো যে, ইবরাহীম দু’আ করেছিলঃ “হে আমার রব! এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দাও। আর এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে মানবে তাদেরকে সব রকমের ফলের আহার্য দান করো।” জবাবে তার রব বললেনঃ “আর যে মানবে না, দুনিয়ার গুটিকয় দিনের জীবনের সামগ্রী আমি তাকেও দেবো। কিন্তু সব শেষে তাকে জাহান্নামের আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করবো এবং সেটি নিকৃষ্টতম আবাস।” সূরা আল বাকারা:১২৬

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন মানবজাতির নেতৃত্ব সম্পর্কে আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন জবাবে তাঁকে বলা হয়েছিল, তোমার সন্তানদের মধ্য থেকে একমাত্র মু’মিন ও সত্যনিষ্ঠরাই এ পদের অধিকারী হবে। জালেমদেরকে এর অধিকারী করা হবে না। অতঃপর হযরত ইবরাহীম যখন রিযিকের জন্য দু’আ করতে লাগলেন তখন আগের ফরমানটিকে সামনে রেখে তিনি কেবলমাত্র নিজের মু’মিন সন্তান ও বংশধরদের জন্য দু’আ করলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ জবাবে সঙ্গে সঙ্গেই তার ভুল ধারণা দূর করে দিলেন এবং তাঁকে জানিয়ে দিলেন, সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব এক কথা আর রিযিক ও আহার্য দান করা অন্য কথা। সত্যনিষ্ঠ ও সৎকর্মশীল মু’মিনরাই একমাত্র সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী হবে। কিন্তু দুনিয়ার রিযিক ও আহার্য মু’মিন ও কাফের নির্বিশেষে সবাইকে দেয়া হবে। এ থেকে একথা স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিভাত হয় যে, কারোর অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য দেখে যেন কেউ এ ধারণা না করে বসেন যে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট আছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সে-ই নেতৃত্ব –যোগ্যতারও অধিকারী।

মহান আল্লাহ আরো বলেছেন-

তাদের ধন-দৌলত ও সন্তানের আধিক্য দেখে তোমরা প্রতারিত হয়ো না। আল্লাহ চান, এ জিনিসগুলোর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনে তাদের শাস্তি দিতে। আর তারা যদি প্রাণও দিয়ে দেয়, তাহলে তখন তারা থাকবে সত্য অস্বীকার করার অবস্থায়। সূরা আত তাওবা:৫৫

এ ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্তুতির মায়ার ডোরে আবদ্ধ হয়ে তারা সে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করেছে, সেজন্য মুসলিম সমাজে তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। এতসব লাঞ্ছনা-গাঞ্জনার মধ্যেও তাদের জন্য আরো বড় বিপদ হবে এই যে, তারা নিজেদের মধ্যে যে মুনাফিকী চরিত্র বৈশিষ্ট্য লালন করছে তার বদৌলতে মরার আগ পর্যন্ত তারা সত্যিকার ঈমান লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থাকবে এবং নিজেদের পার্থিব সুখ-সুবিধা ধ্বংস করার পর দুনিয়া থেকে এমন অবস্থায় বিদায় নেবে যে, তাদের আখেরাত হবে এর চাইতেও অনেক বেশী খারাপ।

অপরদিকে সবর করে হকের পথে টিকে থাকার যে পুরষ্কারের কথা বলা হয়েছে ফেরদাউস সে জান্নাতের নাম, যেখানে প্রত্যেক মানুষ তার কাঙ্খিত বস্তু লাভ করে ধন্য হবে। যার ভেতর প্রাসাদের উপর প্রাসাদ নির্মিত। যার কক্ষসমূহ নূরে শোভিত। তিনি পবিত্র যে এর এর পরিকল্পনা করেছেন, তিনি করুনাময় যে তা স্বহস্তে তৈরি করেছে। এটা রহমতের স্থান, সফলতার স্থান, এর রাজত্ব মহান, এর নেয়ামত স্থায়ী। এরশাদ হচ্ছে :

“যাকে দোযখ থেকে দুরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই সফল। “আলে ইমরান:১৮৫

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

“তোমাদের কারো চাবুক পরিমাণ জান্নাতের জায়গা দুনিয়া এবং তার ভেতর যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।”  সহিহ বুখারী

জান্নাতের নেয়ামতের মোকাবেলায় দুনিয়ার নেয়ামাতের কোন তুলনা হয় না। তবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে তুলনা করেছেন, সেভাবে তুলনা করতে দোষ নেই। এরশাদ হচ্ছে :

“যেমন, তোমাদের কারো আঙ্গুল সমুদ্রে রাখার মতই, অতঃপর দেখ কি পরিমাণ পানি আঙ্গুলে উঠে এসেছে।” সহিহ মুসলিম

এবার চিন্তা কারুন, যে পরিমাণ পানি সমুদ্র থেকে আঙ্গুলের সাথে ওপরে উঠে এসেছে, সে পরিমাণ হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার নেয়ামত। আর যে পরিমাণ পানি মহাসমুদ্রে অবশিষ্ট আছে, তা হচ্ছে জান্নাতের নেয়ামত।

জীবনকে অনেকে মনে করেন, একটিতো মাত্র, কয়েকদিনের জন্য, তাই যেভাবে পারো আনন্দ স্ফূর্তি করেই পার করে নেই, পরে আল্লাহর পথে চলবো, আর তা ছাড়া খারাপ কাজতো আর করছি না!

আবার অনেকে এভাবে বলেন, এতো নিয়ম কানুনের মাঝে থাকার দরকার নেই, আল্লাহতো ক্ষমাশীল, আমার ঈমান আছে, জান্নাতেতো যাবোই একবার না একবার ইত্যাদি।

আবার অনেকে বলেন, সবকাজেই এতো কুর’আন হাদীস টানার দরকার নেই, এই যুগে এতো করা যায় না, এইভাবে শরীয়তের মাঝে থাকা যায় না, ইসলাম সহজ, এতো কঠিন করার কিছু নেই, যতটুকু পারো করলেই চলবে, জীবনকে উপভোগ করতে হবে, আল্লাহতো সব দিয়েছেন ইত্যাদি অনেক রকমের যুক্তি নিজে দাঁড় করিয়ে হোক বা অন্যের দ্বারাই হোক বা শয়তানের ওয়াস ওয়াসাই হোক, যেভাবেই হোক দীনের সঠিক রাস্তায় পুরুপুরি টিকিয়ে রাখতে মনকেই প্রস্তুত করতে পারে না সেখানে কিভাবে বাস্তবে টিকে থাকার অবস্থা আসবে এবং মহান আল্লাহর সাহায্য নিয়ে টিকে থাকতে পারবে!!!

তাই দেখা যায় আমাদের অনেক ভাই ও বোনেরা দুই ধরনের চরিত্রের মাঝে অবস্থান করেন, যখন যেভাবে চলা দরকার। কিন্ত জানা ও বুঝা দরকার ইসলাম Buffet নয় যে যেখান থেকে ভালো লাগে ততটুকু খেলাম আর ভালো না লাগলে খাবো না। ইসলাম পুরু একটি জীবন ব্যবস্থা, জীবনের সবদিকগুলোকে সাজাতে হবে এই বিধানের আলোকেই। আখেরাতের জীবনে যেন না হেরে যাই, যেন অপদস্ত হতে না হয়, চিরস্থায়ী জান্নাত লাভ করার মত আমল ও মহান আল্লাহর ক্ষমা অনুগ্রহ লাভ করতে পারি সেই আলোকে দুনিয়ার জীবনকে সাজাতে হবে।

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমার বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমার কাঁধ ধরে বললেন : ‘দুনিয়াতে তুমি এমনভাবে বসবাস করবে যে তুমি একজন অপরিচিত লোক অথবা পথিক।” ইবনু উমার রা. সর্বদা বলতেন, যখন তুমি রাতে উপনীত হও তখন ভোর হওয়ার অপেক্ষা করবে না। যখন সকালে উঠবে তখন বিকালের অপেক্ষা করবে না। অসুস্থতার জন্য সুস্থ অবস্থায় কিছু করে নাও, মৃত্যুর জন্য জীবন থাকতে কিছু করে নাও।’ বোখারি : ৬৪১৬।

দুনিয়ার জীবনকে ভোগ করতে ইসলাম নিষে্ধ করেনি তবে এই ভোগ বিলাসে লিপ্ত হয়ে মহান আল্লাহকে ভুলে যাওয়া বা আখেরাতের লাভ ক্ষতির হিসেব না করা বা শরীয়তের নিয়মকে অবহেলা করার কথা নিষেধ করা হয়েছে। দুনিয়ার সব জিনিষই দেয়া হয়েছে মানুষের জন্যই। এটাই পরীক্ষা যে, কে মহান আল্লাহর অনুগত হয়ে সেগুলোর ব্যবহার করে এবং শুকরিয়া আদায় করে থাকে।

আল্লাহ তাআলা বলেন : হে মুমিনগন! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করোনা।’ সূরা নিসা : ১০২।

আল্লাহ আরো বলেন, তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের এবাদত কর।’ সূরা আল-হিজর : ৯৯।

ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য হল সর্বদা পাপ থেকে সাবধান থাকবে। কবীরা গুনাহকে বলা হয় মুবিকাত বা ধ্বংসকারী। আর অব্যাহত ছগীরা গুনাহ কবীরা গুনাহতে পরিণত হয়ে থাকে। বার বার সগীরা করলে অন্তরে জং ধরে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

‘তোমরা ছোট ছোট গুনাহ থেকে সাবধান থাকবে। ছোট গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত হল সেই পর্যটক দলের মত যারা একটি উপত্যকায় অবস্থান করল। অত:পর একজন একজন করে তাদের জ্বালানী কাঠগুলো অল্প অল্প করে জালিয়ে তাপ নিতে থাকল, পরিনতিতে তাদের রুটি তৈরী করার জন্য কিছুই অবশিষ্ট রইল না।’ আহমদ : ২২৮০৮।

কখনো কোন ধরণের পাপকে ছোট ভাবা ঠিক নয়। প্রখ্যাত সাহাবী আনাস রা. বলেন,

‘তোমরা অনেক কাজকে নিজেদের চোখে চুলের চেয়েও ছোট দেখ অথচ তা আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ধ্বংসাত্নক কাজ মনে করতাম।’ বোখারি : ৬৪৯২।

আমাদের চিন্তা করা দরকার সাহাবারা রা. কত ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়েই দীনের পথে অটল ছিলেন। মহান আল্লাহ রহমান ও রহীম কিন্তু তিনি যে শাস্তিদাতা ও ন্যায়বিচারক সেটা মনে রাখা দরকার।

দুনিয়াতে একজন কষ্ট না করে ভালো ফল পেলে, আর আপনি কষ্ট করে ভালো ফল না পেলে সেটাকে যেমন অন্যায় মনে করে সহ্য করতে পারেন না, তাহলে আখেরাতের ব্যাপারে কিভাবে আশা করেন আল্লাহ এইরকম করবেন (নাউযুবিল্লাহ)। সময় থাকতে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যুক্তি দিয়ে নিজের মূল্যবান জীবনকে হকের পথ থেকে দূরে রাখার মত বোকামী আর নেই। এই যগেও অনেকেই দীনের পথে সুন্দরভাবে হকের পথে ত্যাগ তিতিক্ষার গুন দিয়েই টিকে আছেন। আল্লাহ আমাদের তাঁর পছন্দনীয় বান্দাদের মাঝে কবুল করুন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই এ দোয়া করতেন,

يا مقلب القلوب ثبت قلبي على دينك.

‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর অটল রাখেন।’ তিরমিজি: ২১৪০,সহিহ আল-জামে: ৭৯৮৮।

ইউসূফ (আ:) দোয়া করতেন :’তুমি আমাকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দাও এবং সৎকর্মপরায়নদের অন্তর্ভূক্ত কর।’ সূরা ইউসূফ : ১০১

যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে লিপ্ত থাকে ও সকল কাজ-কর্ম আল্লাহর স্মরণের সাথে সম্পন্ন হবে তার শেষ পরিণতি শুভ হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন :

‘যার শেষ কথা হবে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ সহিহ আল-হাকেম : ১২৯৯। সহিহ আল-জামে : ৬৪৭৯।

বস্তুত পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো বৃষ্টির মত, যা আমি আসমান হতে বর্ষণ করি। অতঃপর তার দ্বারা উৎপন্ন হয় ভূপৃষ্ঠের উদ্ভিদগুলো অতিশয় ঘন হয়ে, যা হতে মানুষ ও পশুরা ভক্ষণ করে। অতঃপর যখন ভূমি তার শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকরা মনে করে যে, তারা এখন তার পূর্ণ অধিকারী, তখন দিনে অথবা রাতে তার উপর আমার (আযাবের) আদেশ এসে পড়ে, সুতরাং আমি তা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিই, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। এরূপেই আয়াতগুলোকে আমি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য বিশদরূপে বর্ণনা করে থাকি।” (সূরা ইউনুস ২৪ আয়াত)

তাদের কাছে পেশ কর উপমা পার্থিব জীবনের; এটা পানির ন্যায় যা আমি বর্ষণ করি আকাশ হতে, যার দ্বারা ভূমির উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদগ্ত হয়। অতঃপর তা বিশুষ্ক হয়ে এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে, বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা। আর সৎকার্য, যার ফল স্থায়ী, ওটা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা প্রাপ্তির ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট।”

 (সূরা কাহফ ৪৫-৪৬ আয়াত)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘দুনিয়া হচ্ছে সুমিষ্ট ও সবুজ শ্যামল এবং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তাতে প্রতিনিধি করেছেন। অতঃপর তিনি দেখবেন যে, তোমরা কিভাবে কাজ কর। অতএব তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে সাবধান হও এবং সাবধান হও নারীজাতির ব্যাপারে।’’ (মুসলিম)

কিছু মানুষ যারা  হল বেশি ভৎর্সনাকারী আত্মার অধিকারী যারা পাপকাজ করে এবং তজ্জন্য আবার নিজেদের ভৎর্সনাও করে এবং রং-বেরং ধারণ করে। কখনও এরূপ, আবার কখনও বা সেরূপ এবং ভাল কাজসমূহের সাথে খারাপ কাজ মিলিয়ে ফেলে।

কা‘ব ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘ছাগলের পালে দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছেড়ে দিলে ছাগলের যতটা ক্ষতি করে, তার চেয়ে মানুষের সম্পদ ও সম্মানের প্রতি লোভ-লালসা তার দ্বীনের জন্য বেশী ক্ষতিকারক।’’(তিরমিযী)

বিশ্বাসী ব্যক্তির উচিত হল, সে যেন আল্লাহর কাছেই সাহায্য  প্রার্থনা করে এবং তার অন্তরকে ঈমান ও আল্লাহভীতি দ্বারা আবাদ করে, অন্তরকে বক্র না করে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও হিদায়াতের উপর স্থির রাখে এবং সে যেন প্রবৃত্তির অনুসরণ না করে, এ সকল বিষয়ে আল্লাহরই উপর পূর্ণ আস্থা রাখে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-

‘অতএব আপনি সেদিকেই ডাকতে থাকুন এবং আপনাকে যেরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছে(তাতে) দৃঢ় থাকুন আর তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না,  আর বলে দিন আল্লাহ যত কিতাব নাযিল করেছেন আমি তাতে ঈমান আনছি আর আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, তোমাদের মধ্যে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠিত রাখি, আল্লাহ আমাদেরও মালিক এবং তোমাদেরও মালিক।’’ সূরা আশ-শূরা ৪২:১৫

হে মানুষ! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; সুতরাং পার্থিব জীবন যেন কিছুতেই তোমাদেরকে প্রতারিত না করে এবং কোন প্রবঞ্চক যেন কিছুতেই আল্লাহ সস্পর্কে তোমাদেরকে প্রবঞ্চিত না করে।” সূরা  ফাত্বির:৫

অনেক এমন লোক আছে যে সে অন্যকে করতে না দেখা পর্যন্ত কোনও ভাল কাজ বা খারাপ কাজ করে না, তারপর অপরের দেখাদেখি সেটা করে বসে।

আর এজন্যই কোন ভাল বা মন্দ কাজের সূচনাকারী ( তার) অনুকরণকারীদের সকলের সমান পূর্ণ বা পাপের অধিকারী হবে। যেমন- নবী সা এ সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

 ‘‘যে ব্যক্তি কোনও সুন্দর আদর্শের প্রচলণ করবে সে সেটার প্রতিফল (সাওয়াব) তো পাবেই তদুপরি কিয়ামত পর্যন্ত যারা তার অনুসরণে আমল করবে তাদের সকলের সম্মিলিত ‘আমলের সাওয়াবও ঐ প্রচলনকারী পাবে(অথচ) ঐ সকল অনুসরণকারীদের সাওয়াবে কোনরূপ ঘাটতি হবে না। অপরদিকে যে ব্যক্তি কোন খারাপ আদর্শের প্রচলন করবে সে সেটার ফলে পাপী তো হবেই তদুপরি কিয়ামত পর্যন্ত যারা তার অনুসরণে আমল করবে তাদের সকলের সম্মিলিত পাপরাশির পরিমাণ পাপের দায়ীও সে ব্যক্তি হবে, (অথচ) ঐ সকল অনুসরণকারীদের পাপে এতটুকুও ঘাটতি  হবে না। (মুসলিম: কিতাবুল ‘ইলম: ৮/৬১, কিতাবুল যাকাত: ৩/৮৭,

সুতরাং আমাদের সাবধান হয়ে নিজেদের দীনের পথে শক্ত করে টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক বাস্তব প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এমন যেন না হয় আমাদের দূর্বলতার কারনে কোন পাপ কাজ করে ফেললে, সেটা দেখে অন্য কেউ অনুসরন করলো তাতে নিজের গুনাহের সাথে অন্যকে গুনাহের পথ দেখানোর গুনাহ যোগ হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাত্র) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু!’। আর জান্নাতীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে দুখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাত্র একবার) চুবানোর পর বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি।’’ (মুসলিম)

মহান আল্লাহ ভালোবেসে আমাদের এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন কিছু পরিকল্পনা দিয়ে কিছু কাজ দিয়ে। বংশ পরিচয় নিয়ে কত অহমিকা করে থাকেন অনেকে, সন্তানদের বংশের ধারা মুখস্ত করিয়ে দেন কিন্তু আমরা কি আমাদের আসল অস্তিত্বলাভের অবস্থা, জীবনের শুরু, পরিচয়, শেষ প্রান্তে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে ভেবে দেখেছি? মহান আল্লাহ আমাদের কত যত্ন করে কত নিয়ামত দিয়ে এই আজকের আমিতে পরিনত করার সুযোগ দিয়েছেন?

আমাদের ফিরে যেতে হবেই, এই বাস্তব নির্ধারিত সত্যকে উপেক্ষা না করে বরং এই দুনিয়াতে  থাকতে পারবো এই অনিশ্চিতকে উপেক্ষা করে, বর্তমান সময়কে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে কাজে লাগিয়ে যাই। রেখে যাই কিছু কল্যানের বার্তা, কিছু কল্যানের ধারা যা জমিনবাসী উপকৃ্ত হবে। প্রত্যেকেই আমরা মহান আল্লাহর কাছে নিজস্ব সত্তায় গুরুত্বপূর্ণ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘(দুনিয়ার ধন-দৌলত ইত্যাদির দিক দিয়ে) তোমাদের মধ্যে যে নীচে তোমরা তার দিকে তাকাও এবং যে তোমাদের উপরে তার দিকে তাকায়ো না। যেহেতু সেটাই হবে উৎকৃষ্ট পন্থা যে, তোমাদের প্রতি যে আল্লাহর নিয়ামত রয়েছে তা তুচ্ছ মনে করবে না।’’ বুখারী ও মুসলিম,

আবূ ‘আমর ‘উসমান ইবনু আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু (তাকে আবূ ‘আব্দুল্লাহ ও আবূ লাইলাও বলা হয়) হতে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আদম সন্তানের তিনটি বস্তু ব্যতীত কোন বস্তুর অধিকার নেই। তা হলো: তার বসবাস করার জন্য একটি বাড়ি, শরীর আবৃত করার জন্য কিছু কাপড় এবং কিছু রুটি ও পানি।  হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করে বলেন, এটি সহীহ হাদীস

আবুল আব্বাস সাহল ইবনে সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে এমন কর্ম বলে দিন, আমি তা করলে যেন আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালবাসে।’ তিনি বললেন, ‘‘দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা আনো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন। আর লোকদের ধন-সম্পদের প্রতি বিতৃষ্ণা আনো, তাহলে লোকেরা তোমাকে ভালবাসবে।’’ (ইবনে মাজাহ প্রমুখ, হাসান সূত্রে, সিলসিলাহ সহীহাহ ৯৪৪নং)

মহান রবের দাস ও রাসূল স.এর উম্মত এই পরিচয়ের ভারসাম্যতা দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করাই হোক আমাদের জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু।

দীর্ঘ পর্বের আলোচনাটিতে সহায়ক হিসেবে নেট থেকে বিভিন্ন সহিহ আকীদার লেখকদের লেখা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নেয়া হয়েছে। এছাড়া কোর’আন ও হাদীসসহ নিজ অভিজ্ঞতা ও একান্ত নিজের চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে সামগ্রীক আলোচনাতে।

মহান আল্লাহ আমাদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে সংশোধিত হয়ে তাঁর খাস বান্দাহ হওয়ার তাওফিক দান করুন।

 

সহায়ক গ্রন্থঃ

সবরের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা:

মূল: ড. শাইখ সালিহ ফাউযান আল ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ),অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।

তাক্বদীরঃ আল্লাহ্‌র এক গোপন রহস্য,সংকলন: আব্দুল আলীম ইব্‌ন কাওসার,সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

প্রশ্ন ঊত্তর মুফতী: শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ সূত্র: www.islamqa.info