হকের পথে টিকে থাকার কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট-৯

ভালো বা হকের পথে টিকে থাকার যোগ্যতা রাখে এমন কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট রয়েছে যা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স. জানিয়ে দিয়েছেন।

কারা ভালো কাজের পথে টিকে থাকার যোগ্যতা রাখে বা এমন কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট রয়েছে যেগুলোকে পরিচর্যার মাধ্যমে নিজেকে হকের পথে টিকে রাখার ধৈর্য্য আসবে ইন শা আল্লাহ। এবং এই একই শক্তি দিয়ে নাফরমানিমূলক কাজ থেকেও নিজেকে নিবৃত্ত করা সহজ হবে।

১। আল্লাহর পথে টিকে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং এই ব্যাপারে একটি চ্যালেঞ্জ রাখতে হবে। এক সময় এটাই সহজ হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ জানিয়েছেন,

 যারা আমার জন্য চরম চেষ্টা-সাধনা করবে তাদেরকে আমি আমার পথ দেখাবো। আর অবশ্যই আল্লাহ‌ সৎকর্মশালীদেরই সাথে আছেন। সূরা আনকাবুত:৬৯

যারা আল্লাহর পথে টিকে থাকার জন্য আন্তরিকতা সহকারে সারা দুনিয়ার সাথে সকল বিপদ মাথা পেতে নেয়, তাদেরকে পথ দেখান এবং তার দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন। তারা তাঁর সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন। পথের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাদেরকে আলো দেখান। যার ফলে কোনটা সঠিক পথ ও কোনটা ভুল পথ তা তারা দেখতে চায়। তাদের নিয়ত যতই সৎ ও সদিচ্ছা প্রসূত হয় ততই আল্লাহর সাহায্য, সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও হিদায়াতও তাদের সহযোগি হয়।

২। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স. ও তাঁর পথে চলার প্রচেষ্টাকে অধিক প্রিয় ও মূল্যায়ন করা।

এই পৃথিবীতে সবাই  সুখ শান্তি দেয়া নেয়া নিয়ে, চাওয়া পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিন্তু কোনটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন,এই সূত্র ধরে চলার উদ্যোগ নিলেই হকের পথে টিকে থাকা সম্ভব। আল্লাহ বলেছেন-

হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না। সূরা আত তাওবা: ২৪

৩। পরকালের জীবনে জান্নাত পাওয়ার চুক্তিতে যারা দুনিয়ার জীবনে জান ও মালকে মহান আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেয়,অর্থাৎ এমন সিদ্ধান্ত নেয়া যে আল্লাহর দেয়া এই জীবন ও রিযিক সব, মহান আল্লাহ যেভাবে চান সেভাবে ব্যবহার করবে।

প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। সূরা আত তাওবা: ১১১

আল্লাহর পথে তাদের লড়াই করা উচিত যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিকিয়ে দেয়। সূরা আন নিসা: ৭৪

এটা এমন এক ধরনের লোকের কাজ যারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে এবং নিজেদের পার্থিব প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির সমস্ত সম্ভাবনা ও সব ধরনের পার্থিব স্বার্থ একমাত্র আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তাদের রব যেন তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং এই দুনিয়ায় তাদের ত্যাগ কুরবানী আপাত বিফল হয়ে গেলেও আখেরাতে যেন বিফলে না যায়।

৪। কুফরকে ভালোবাসে এমন ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন না করা—

যাদের সাথে চলতে গেলে নিজের ঈমান আখলাক পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে সেখান থেকে দূরে থাকা খুবই জরুরী, তবে যদি কেউ নিজের অবস্থান ঠিক রেখে অন্যদের দীনের দিকে এগিয়ে আনার শক্ত ঈমান আখলাক রাখেন তাদের বরং আরো বেশী করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে যাওয়া প্রয়োজন।

যে ঈমানদারগণ! তোমাদের বাপ ও ভাইয়েরা যদি ঈমানের ওপর কুফরীকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকেও নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই জালেম। সূরা আত তাওবা:২৩

৫। সব সময় তাদের সাথে বেশী বেশী সম্পর্ক ও উঠা বসা করা প্রয়োজন যাদের দেখলেই মহান আল্লাহর কথা ও আখেরাতের কথা মনে পড়ে। মহান আল্লাহ বলেছেন-

আর নিজের অন্তরকে তাদের সঙ্গলাভে নিশ্চিন্ত করো যারা নিজেদের রবের সন্তুষ্টির সন্ধানে সকাল-সাঁঝে তাঁকে ডাকে এবং কখনো তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরাবে না। তুমি কি পার্থিব সৌন্দর্য পছন্দ করো? এমন কোন লোকের আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণ করেছে এবং যার কর্মপদ্ধতি কখনো উগ্র, কখনো উদাসীন।  সূরা কাহাফ:২৮

যে ব্যক্তি সত্যকে পেছনে রেখে এবং নৈতিক সীমারেখা লংঘন করে লাগামহীনভাবে চলে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নিজের নফসের বান্দা হয়ে যায় তার প্রত্যেকটি কাজে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়ে যায় এবং আল্লাহর সীমারেখা সম্পর্কে তার কোন জ্ঞানই থাকে না। এ ধরনের লোকের আনুগত্য করার মানে এ দাঁড়ায় যে, যে আনুগত্য করে সেও আল্লাহর সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ ও অচেতন থেকে যায়, আর যার আনুগত্য করা হয় সে বিভ্রান্ত হয়ে যেখানে যেখানে ঘুরে বেড়ায় আনুগত্যকারীও সেখানে সেখানে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে।

৬। আল্লাহর পথে ধনমাল ব্যয় করে, ভালো উপকারীকে সত্য মানা,নাফরমানি থেকে দূরে থাকার স্বভাবগতভাবে যার মাঝে থাকে। আল্লাহ বলেছেন,

কাজেই যে (আল্লাহর পথে) ধন সম্পদ দান করেছে, (আল্লাহর নাফরমানি থেকে) দূরে থেকেছে এবং সৎবৃত্তিকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তাকে আমি সহজ পথের সুযোগ- সুবিধা দেবো। সূরা আল লাইল: ৫-৭

 তিনটি জিনিসকে এর অংগীভূত করা হয়েছে। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এগুলোর মধ্যে সব গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে।

এর মধ্যে একটি হচ্ছে, মানুষ যেন অর্থ লিপ্সায় ডুবে না যায়। বরং নিজের অর্থ-সম্পদ, যে পরিমাণ আল্লাহ তাকে দিয়েছেন, তা আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের অধিকার আদায়ে, সৎ কাজে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে সাহায্য করার কাজে ব্যয় করে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার মনে যেন আল্লাহর ভয় জাগরুক থাকে। সে যেন নিজের যাবতীয় কর্ম, আচার-আচরণ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি বিভাগে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে এমন প্রত্যেকটি কাজ থেকে দূরে থাকে।

 আর তৃতীয়টি হচ্ছে, সে যেন সৎবৃত্তি ও সৎকাজের সত্যতার স্বীকৃতি দেয়। সৎবৃত্তি ও সৎকাজ অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র ও কর্ম তিনটি সৎবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সৎবৃত্তির স্বীকৃতি হচ্ছে, শিরক, কুফরী ও নাস্তিক্যবাদ পরিত্যাগ করে মানুষ তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতকে সত্য বলে মেনে নেবে।

আর কর্ম ও নৈতিক চরিত্রের ক্ষেত্রে সৎবৃত্তির স্বীকৃতি হচ্ছে, কোন নির্দিষ্ট ব্যবস্থা ও পদ্ধতি ছাড়াই নিছক নিজের অজ্ঞাতসারে কোন সৎকাজ সম্পাদিত হওয়া নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ ও সৎবৃত্তির যে ব্যবস্থা দান করা হয়েছে মানুষ তার সত্যতার স্বীকৃতি দেবে। আল্লাহ শরীয়াত নামক যে ব্যাপকতর ব্যবস্থাটি দান করেছেন এবং যার মধ্যে সব ধরনের ও সকল প্রকার সৎবৃত্তি ও সৎকাজকে সুশৃংখলভাবে একটি ব্যবস্থার আওতাধীন করেছেন, মানুষ তাকে স্বীকার করে নিয়ে সেই অনুযায়ী সৎকাজ করবে।

৭। পবিত্রতা অর্জন, সব সময় আল্লাহর যিকির, সালাত ও পরকালকে অগ্রাধিকার যারা দিয়ে থাকেন।

সে সফলকাম হয়েছে, যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করেছে তারপর নামায পড়েছে। সূরা আল আলা: ১৪-১৫

পবিত্রতা অর্থ কুফর ও শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা, অসৎ আচার-আচরণ ত্যাগ করে সদাচার অবলম্বন করা এবং অসৎ কাজ ত্যাগ করে সৎ কাজ করা। কেবল মহান আল্লাহকে  স্মরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং নিয়মিত নামাযও পড়ে সে প্রমাণ করেছে যে, যে আল্লাহকে সে নিজের ইলাহ বলে মেনে নিয়েছে কার্যত তাঁর আনুগত্য করতেও সে প্রস্তুত এবং তাঁকে সর্বক্ষণ স্মরণ করার জন্য সে ব্যবস্থা অবলম্বন করছে।

৮। সব সময় প্রতিটি দিন ইলমে দীনের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখে।

বৃষ্টি যেমন যমীনকে সিক্ত করে সুজলা সুফলা করে দেয় তেমনি একজন মুমিন ইলমে দীন দ্বারা প্রতিদিনই  নিজেকে ঈমানের সজীবতায় সিক্ত হবে।

এ ব্যক্তির আচরণই সুন্দর না সে ব্যক্তির আচরণ সুন্দর) যে অনুগত, রাতের বেলা দাঁড়ায় ও সিজদা করে, আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজের রবের রহমতের আশা করে? এদের জিজ্ঞেস করো যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি পরস্পর সমান হতে পারে? কেবল বিবেক-বুদ্ধির অধিকারীরাই উপদেশ গ্রহণ করে।  সূরা আয যুমারঃ ৯

এখানে দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ দুঃসময় আসলে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হকের পথে টিকে থাকে না বা সুবিধাবাদী নীতি গ্রহন করে।

আরেক শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর দাসত্বকে তাদের স্থায়ী নীতি বানিয়ে নিয়েছে। রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ইবাদাত করা তাদের একনিষ্ঠ হওয়ার প্রমাণ।

এর মধ্যে প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত লোকদেরকে আল্লাহ তা’আলা জ্ঞানহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে তারা বড় বড় গ্রন্থাগার চষে থাকলেও কিছু এসে যায় না। আর দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত লোকদেরকে জ্ঞানী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে একেবারে নিরক্ষর হলেও কিছু এসে যায় না। কারণ, প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে সত্য সম্পর্কে জ্ঞান ও তদানুযায়ী কাজ। এর ওপরেই মানুষের সাফল্য নির্ভরশীল। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এই দুই শ্রেণীর মানুষ কি করে সমান হতে পারে। কি করে সম্ভব যে, তারা দুনিয়ায় মিলে মিশে একই নিয়ম পন্থায় চলবে এবং আখেরাতেও একই পরিণামের সম্মুখীন হবে।