আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে বিভিন্ন বালা-মুসিবত দেন মহান উদ্দেশ্যে। আর তা হল এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার গুনাহ মোচন করে থাকেন। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আমরা বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হই যা আমাদের মনে আশা-হতাশা, শান্তি-অশান্তি, সুখ-দুঃখ, অস্থিরতা-পেরেশানী-হতাশা, না পাওয়ার বেদনা, প্রিয় জিনিষ হারানোর কষ্ট, জুলুম-নির্যাতনের অসহনীয়তা এনে দিয়ে থাকে।
‘নিঃসন্দেহে আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে।’ সূরা বালাদ: ৪
মূলত মানুষ অতীত নিয়ে দুঃখিত, ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং বর্তমান নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে।
ইবনুল কাইয়ূম র. বলেন, ‘অন্তরসমূহ দুশ্চিন্তা ও পেরেশানীর আধিক্য এবং স্থায়িত্বে ইমান-কুফর, আল্লাহর আনুগত্য ও অবাধ্যতার বিচারে দু’প্রকার।
প্রথম প্রকার অন্তর- রহমানের আরশ : এতে রয়েছে নূর ও হায়াত, আনন্দ ও বিনোদন, ঔজ্জ্বল্য ও কল্যাণের সবকিছু।
দ্বিতীয় প্রকার অন্তর- শয়তানের আরশ : এতে রয়েছে সংকীর্ণতা ও অন্ধকার, মৃত্যু ও পেরেশানী, দুশ্চিন্তা ও বিষন্নতা।’ (সূত্র : ফাওয়ায়েদে ইবনুল কাইয়ূম)
প্রাত্যহিক জীবনে আমরা রোগীকে বা সমস্যায় পতিত ব্যক্তিকে বলে থাকি যে সবর করেন, প্রতিউত্তরে অনেকে বলেন যে, সবরতো করছি কিন্তু আমার জীবনে এতো বিপদ আসে কেনো? আমার এতো অসুস্থতা কেনো? আর ভালো লাগে না। দুনিয়া থেকে আল্লাহ আমাকে নিয়ে গেলেই ভালো। এইভাবে অনেক রকমের আবেগপ্রসূত কথা যা কষ্টের কারনেই বলে থাকেন। বিশেষ করে আপন কেউ দেখতে গেলে এই কথাগুলো বলে ফেলেন। আবার এতোগুলো কথা বলার পর বলেন, আল্লাহ ভাগ্যে রেখেছেন কি আর করা, দু’আ করবেন। একটু হালকা হলাম আপনাকে বলে ইত্যাদি।
অনেকে বলেন, আমি এতো কি গুনাহের কাজ করেছি যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় পরীক্ষায় ফেলেছেন? নামাজ কালাম ঠিক মতো করি, হালাল হারাম বেছে চলার চেষ্টা করি, আর যারা নামাজই পড়ে না তারাতো খুব ভালোই থাকে, তাদেরতো এতো সমস্যা হয় না ইত্যাদি।
অনেকে বলেন এতো মানত করলাম, দোয়া করলাম, এতিম খানায় খাশি জবাই করে খাওয়ালাম, তারপরও সমস্যা দূর হয় না। আমার দু’আ কবুল হয় না। ভালো একজন আলেম, পীর সাহেবকে দিয়ে দু’আ করাবো ভাবছি, দেখি তাতে কাজ হয় কি না?
এই ধরনের অবস্থাগুলোতেই মানুষ শয়তান ও জীন শয়তান টোপ ফেলে ঈমানদার ব্যক্তিদের শিরক বিদয়াতের পথে ধীরে ধীরে নিয়ে যায়। মানুষের অসহায় অবস্থার সুযোগটাকে কাজে লাগায় শয়তান। আর তার সাথে নফস অনেক যুক্তি দিয়ে বুঝাতে থাকে। সঠিক জ্ঞান ও ঈমানের দৃঢ়তা না থাকলে এই অবস্থায় ফাঁদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সবর বা ধৈর্য্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারনে, সবরের প্রতিদান থেকেও বঞ্চিত হয় ব্যক্তি। তাই সবরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যাবো ইন শা’ আল্লাহ যেন আমরা প্রত্যেকেই প্রতিকূল অবস্থায় নিজেদের ঈমানের পথে ইস্তেকামাত রেখে অন্যদেরও সহায়তা করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সঠিক জ্ঞান ও আমল করার তাওফিক দান করুন।
মহান আল্লাহ বলেছেন,
নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধনপ্রাণ এবং ফলের (ফসলের) লোকসান দ্বারা পরীক্ষা করব; আর তুমি ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।” সূরা বাকারাহ: ১৫৫
আবূ মালিক হারিস ইবনে ‘আসেম আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, পবিত্রতা অর্ধেক ঈমান। আর ‘আলহামদু লিল্লাহ’ (কিয়ামতে নেকীর) দাঁড়িপাল্লাকে ভরে দেবে এবং ‘সুবহানাল্লাহ’ ও ‘আলহামদু লিল্লাহ’ আসমান ও যমীনের মধ্যস্থিত শূন্যতা পূর্ণ করে দেয়। নামায হচ্ছে জ্যোতি। সাদকাহ হচ্ছে প্রমাণ। ধৈর্য হল আলো। আর কুরআন তোমার স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে দলীল। প্রত্যেক ব্যক্তি সকাল সকাল স্বকর্মে বের হয় এবং তার আত্মার ব্যবসা করে। অতঃপর সে তাকে (শাস্তি থেকে) মুক্ত করে অথবা তাকে (আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত ক’রে) বিনাশ করে।’’ (সহিহ বুখারী:২২৩, মুসলিম:৩৫১৭)
সমস্যা ও বিপদে কাউকে উপদেশ বা সান্তনা দেয়াটা যত সহজ, ঠিক সেই অবস্থানে যিনি থাকেন তার সেই অবস্থায় নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রেখে সমস্যা মোকাবিলা করা ততটাই কঠিন। মহান আল্লাহ সবরকে উঁচু ধরনের সাহসিকতার ব্যাপার বলেছেন। মহান আল্লাহ সবরের বিনিময়ে অনেক মর্যাদা পুরস্কারের অঙ্গিকার করেছেন এবং আল্লাহ নিজেই সবরকারীর সাথে থাকেন, এই জ্ঞান ও বিশ্বাস দিয়ে আমল করলে, সবরের উপর আমল করা আসলেই অনেক সহজ মনে হয় এবং সহজ হয়ে যায়, কারন মহান আল্লাহ সহজ করে দেন। সুবহানআল্লাহ।
সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পরিপূর্ণ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলা যাকে এই গুণ দেন; সেই এই গুণে সুসজ্জিত হয়। আল্লাহ তা’আলা নবী-রাসূল আলাইহিস সালামদের এই বিরল গুণে বিভূষিত করেছিলেন।
ইমাম আহমদ রহঃ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নব্বই স্থানে সবর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।”
“সবর হল জ্যোতি।” মুসনাদ আহমদ ও মুসলিম
উমর রা. বলেন,
“সবরকে আমরা আমাদের জীবন-জীবিকার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে পেয়েছি।” সহিহ বুখারী
আলী রা. বলেন, “ঈমানের ক্ষেত্রে সবরের উদাহরণ হল দেহের মধ্যে মাথার মত।” এরপর আওয়াজ উঁচু করে বললেন, “যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নাই।”
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ব্যাপকতর দান কাউকে দেন নি।” সুনান আবু দাঊদ
এবার চলুন, জানার চেষ্টা করি সবর কি?
সবরের শাব্দিক অর্থ হলো বাঁধা দেয়া, বিরত রাখা, বেঁধে রাখা।
আভিধানিক অর্থ হলো- ইচ্ছার দৃঢ়তা এবং প্রবৃত্তির (নফস) নিয়ন্ত্রন শক্তি যার সাহায্যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির চাহিদা ও বাহ্যিক বিপদ মুসিবতের মোকাবিলায় সৎ পথে দৃঢ় থেকে সামনে অগ্রসর হতে থাকা।
শরীয়তের পরিভাষায় অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহবাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অংগ প্রত্যংগকে গাল চাপড়ানো বা বুকের কাপড় ছেঁড়া থেকে বিরত থাকাকে সবর বলা হয়।
জুন্নুন মিসরী রহ. বলেন, ‘আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকা, বিপদের সময় শান্ত থাকা এবং জীবনের কুরুক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা।’
সাধারনত মানুষের অভিযোগ করাটা দুই ধরনের।
১। আল্লাহ তা’আলার কাছে অনুযোগ করা। এটি সবর পরিপন্থী নয়। যেমন আল কুর’আন থেকে জানা যায়-
সে(ইয়াকুব আ.) বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’ সূরা ইউসূফ : ৮৬
২। নিজের মুখের বা শরীরের ভাষায় মানুষের কাছে অভিযোগ করা। এটি সবরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তুমি যখন মানুষের কাছে অভিযোগ করো, তখন মূলত সদয়ের বিরুদ্ধে নির্দয়ের কাছেই অভিযোগ করো।’ এটি সবর পরিপন্থী।
মহান আল্লাহই আমাকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন,আমার নিজের শরীর মেধা শক্তি ও দুনিয়ার সব নিয়ামতই মহান আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন আমানত হিসেবে যেন দেখতে পারেন ভালো কাজের দিক দিয়ে কে উত্তম, কে মহান রবের শোকরকারী বান্দাহ, কে মহান রবের পথে অবিচল থাকে?
“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই এবং আমি তোমাদের অবস্থা পরীক্ষা করি।” সূরা মুহাম্মাদ: ৩১
‘আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’ সূরা আল-আম্বিয়া: ৩৫
আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাকে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান কে ধৈর্যশীল, কে মুজাহিদ আর কে সত্যবাদী। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
‘তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেন নি তাদেরকে যারা তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহর পথে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করেছে এবং জানেন নি ধৈর্যশীলদেরকে।’ সূরা আলে-ইমরান: ১৪২
তিনি আরও ইরশাদ করেন,
‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করে দেই তোমাদের মধ্যে কারা আল্লাহর পথে চূড়ান্ত প্রচেষ্টাকারী ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের কথা— কাজ পরীক্ষা করে নেব। সূরা মুহাম্মদ:৩১
কিন্তু এই পরীক্ষা দুনিয়ার কোন পরীক্ষা হলের মত নয় যেখানে ছাত্র/ছাত্রী কোন প্রশ্ন বা সাহায্য চাইতে পারেনা পরীক্ষকের কাছে। এই পরীক্ষায় পরীক্ষক মহান আল্লাহ এটাই দেখতে চান যে, কে তাঁর কাছে সাহায্য চায়? কারন মহান আল্লাহ এমন এক সত্তা, যি্নিই একমাত্র সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারেন। সুতরাং যেই ছাত্রের এই জ্ঞান ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা আছে যে, আমার আল্লাহই একমাত্র ও শুধুমাত্র রক্ষাকর্তা তিনিই আমাকে হেফাজত করতে পারেন, সে অবশ্যই সমস্যাগুলোতে অস্থির না হয়ে রাসূলের স. দেখানো পথে সবরের আমল করবে। আরো বেশী মহান রবের দিকে মুখাপেক্ষী হবে। আর তাই যখনই একটি সমস্যা আসে, সাথে সাথে আবেগে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ইন্না লিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাইহী রাজিউন বলেন এবং সালাতে দাঁড়িয়ে যান। মহান আল্লাহ এটাই পছন্দ করেন।
আমরা যদি সবরের অর্থকে সাজাই তবে দাঁড়ায়-
১। প্রথম ও খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো তাৎক্ষনিকভাবে নিজের আবেগকে সংযত ও নিয়ন্ত্রনে রাখা করা
২। ঘাবড়ে না যাওয়া
৩। উত্তেজিত হয়ে কোন কাজ না করা
৪। ত্বরা প্রবনতা পরিহার করা
৫। কাংখিত ফল পেতে দেরী দেখে অস্থির না হওয়া
৬। অশোভন আচরনে উত্তেজিত না হওয়া
৭। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকা
সবরের প্রকারভেদ
আমরা অনেকেই মনে করি সবর শুধুমাত্র কষ্ট ও বিপদের সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং ভালো ও সত্য পথে চলার ধারা বজায় রাখতে সবরের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশী। কিছুদিন খুব ভালো হয়ে হকের পথে থাকলাম কিন্তু কয়েকদিন যাওয়ার পর এই অবস্থান ধরে রাখতে না পেরে আবার আগের অবস্থায় চলে যায়।
সবর তিন প্রকার। যথা :
প্রথম : আল্লাহ তা’আলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করা।
দ্বিতীয় : আল্লাহ তা’আলার নিষেধ এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অটুট ধৈর্য রাখা। এবং
তৃতীয় : তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে ধৈর্য্য ধরা।
ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাকদীর। ঈমান অপূর্ণ রয়ে যাবে যদি ভাগ্যের ভালো মন্দের উপর বিন্দু পরিমান অনাস্থা থাকে। সবরের উপর ইস্তেকামাত বা সুদৃঢ় থাকার পিছনে যে শর্ত বিরাট ভুমিকা রাখে তা হলো তাকদিরে পূর্ণ আস্থা রাখা। তাই এই বিষয়টিকে তুলে ধরার হলো প্রথমেই।