সফর অবস্থায় সালাত এবং গাড়ির মধ্যে তা পড়ার পদ্ধতি

সফর অবস্থায় সালাত এবং গাড়ির মধ্যে তা পড়ার পদ্ধতি
➤ প্রশ্ন:
ক. গাড়িতে বসে কিভাবে সালাত আদায় করতে হয়?
খ. সফর অবস্থায় নামাযের পদ্ধতি কি?
গ. যদি ওযু না থাকে এবং গাড়ি থেকে নেমে ওযু করা সম্ভব না হয় বা তায়াম্মুম করারও সুযোগ না পাওয়া যায় তাহলে কিভাবে সালাত আদায় করব?
ঘ. কিবালার দিকে ফিরে সালাত আদায় করা সম্ভব না হলে কিভাবে সালাত আদায় করব?
উত্তর:
ক. গাড়িতে বসে সালাত আদায়ের পদ্ধতি:
যদি সালাতের সময় শেষ হওয়ার পূর্বে গাড়ি থেকে নামার সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে গাড়ি থেকে নেমেই সালাত আদায় করতে হবে। কিন্তু যদি গাড়ি থেকে নেমে সালাত আদায়ের সুযোগ না থাকে এবং এ অবস্থায় সালাতের সময় অতিবাহিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে গাড়ির মাধ্যেই সালাত আদায় করতে হবে।
এর পদ্ধতি হল, গাড়ির সিটে বসে কিবলার দিকে মুখ করে সালাত শুরু করার পর ইশারায় রুকু-সেজদা করতে হবে। রুকুর জন্য মাথাটা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকাতে হবে আর সেজদা জন্য তার চেয়ে একটু বেশি ঝুাকাতে হবে। কিবলার দিকে মুখ করে শুরু করার পর গাড়ি অন্য দিকে ঘুরলেও সমস্যা নেই। এতে সালাতের কোন ক্ষতি হবে না ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, উক্ত পদ্ধতিতে কেউ ইচ্ছে করলে, গাড়িতে বসে যতখুশি নফল সালাত আদায় করতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরে চলতি পথে বাহনে বসে নফল সালাত আদায় করতেন কিন্তু ফরজ সালাতগুলো বাহন থেকে নেমে মাটিতে নেমে আদায় করতেন। তাই যথাসম্ভব ফরয নামাযগুলো গাড়ি থেকে নেমে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কোন কারণে নামা সম্ভব না হলে গাড়িতে আদায় করা যাবে ইনশাআল্লাহ।
খ. সফর অবস্থায় দু ওয়াক্তের নামায একত্রিত করে পড়া জায়েজ আছে:
দূরে সফর কালীন সময় যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশার সালাতকে যেমন যথাসময়ে আদায় করা জায়েজ অনুরূপভাবে যোহর+আসর এবং মাগরিব+ইশাকে একত্রিত করে অগ্রিম বা পিছিয়ে আদায় করা জায়েজ রয়েছে। অর্থাৎ যোহরের সময় প্রথমে যোহরের দু রাকআত ফরয কসর করা তারপর আসরের দু রাকআত কসর সালাত অগ্রিম পড়া।

অথবা যোহরের সময় যোহরের সালাত না পড়ে -তা পিছিয়ে আসরের সময় প্রথমে যোহরের দু রাকআত কসর পড়া তারপর আসরের দু রাকআত সালাত কসর পড়া।

অনুরূপভাবে মাগরিবের সময় প্রথমে মাগরিবের ৩ রাকআত আদায় করা তারপর ইশার দু রাকআত সালাত অগ্রিম পড়া

অথবা মাগরিবকে পিছিয়ে ইশার সময় প্রথমে মাগরিবের ৩ রাকআত আদায় করা অত:পর ইশার দু রাকআত ফরয সালাত কসর পড়া।

কিন্তু ফজর সালাতকে যোহরের সাথে অথবা আসরকে মাগরিবের সাথে অথবা ইশাকে ফজরের সাথে একত্রিত করা বৈধ নয়।
❒ সফর অবস্থায় চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয সালাতগুলো কসর তথা দু রাকআত করে পড়া এবং সুন্নত সালাতগুলো না পড়াই সুন্নত:
সফরের ক্ষেত্রে চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয সালাত (যেমন যোহর, আসর ও ইশার সালাত) দু রাকআত দু রাকআত করে কসর করা আর অন্যগুলোতে কসর না করা অর্থাৎ মাগরিব ও ফজর সালাতে যেভাবে আছে সেভাবেই আদায় করা সুন্নত।
সফরে বিতির ও ফজরের দু রাকআত সুন্নত ছাড়া অন্য ওয়াক্তের সুন্নত নামায না পড়াই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত। তবে সুযোগ থাকলে অতিরিক্ত নফল সালাত যত ইচ্ছা পড়া জায়েয রয়েছে।
প্রশ্ন: (গ) যদি গাড়ি থেকে নেমে ওযু করার মত সুযোগ না থাকে অথবা তায়াম্মুমের জন্য মাটি পাওয়া না যায় অপরদিকে ওয়াক্ত শেষ পর্যায়ে তাহলে কিভাবে সালাত আদায় করতে হবে?
উত্তর: যদি ওযু বা তায়াম্মুম করা কোনটাই সম্ভব না হয় তাহলে ওযু/তায়াম্মুম ছাড়াই সালাত আদায় করতে হবে। তারপরও নামায পরিত্যাগ করার কোন সুযোগ নাই।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَا يُكَلِّفُ اللَّـهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
“আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যাতীত কোন কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।” (সূরা বাকারা: ২৮৬)
তিনি আরও বলেন:
فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
“অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যতটুকু তোমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে।” (সূরা তাগাবুন: ১৬)
প্রশ্ন: (ঘ) যদি গাড়িতে কিবলার দিকে ফেরা সম্ভব না হয় তাহলে কিভাবে সালাত আদায় করতে হবে?
উত্তর:
সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে কিবলার দিকে মুখ করে সালাত শুরু করার। তারপর গাড়ি যদি অন্য দিকে ঘুরে তাহলেও তাতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। কিন্তু চেষ্টা করার পরও যদি ফরয সালাতে কিবালার দিকে মুখ ফেরানো সম্ভব না হয় তাহলেও যে দিকে সম্ভব সে দিকে ফিরে সালাত আদায় করলে তা শুদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।

এ ক্ষেত্রেও ওযু ও তায়াম্মুম করার সম্ভব না হলে ওযু/তায়াম্মুম ছাড়াই সালাত আদায় করার দলীলগুলো প্রযোজ্য।

আল্লাহু আলাম।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল (মাদানী)
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
নৌকা, লঞ্চ কিংবা বিমানে কীভাবে সালাত আদায় করবে?
উত্তর: নৌকা লঞ্চ-স্টিমার কিংবা বিমানে যেভাবে মুসল্লির জন্য সহজ হয় সেভাবে সালাত আদায় করতে পারবে। তা মাকরূহ হবে না। কারণ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পানির জাহাজে সালাত আদায় করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন,
( صل فيها قائما إلا أن تخاف الغرق ) رواه الدار قطني والحاكم على شرط الشيخين
“তুমি তাতে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করো, তবে যদি ডুবে যাওয়ার ভয় কর তাহলে ভিন্ন কথা”। দারা-কুতনী ও হাকিম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী তা চয়ন করেছেন।
বিমানে সালাত আদায়ের বিবিধ অবস্থা:
বিমানে সালাত আদায় দু’ প্রকার: নফল সালাত ও ফরয সালাত।
ক) যদি সে সালাতটি হয় নফল, তবে:
আরোহী যেভাবে যে অবস্থায় আছে সেভাবে সে অবস্থায় আদায় করতে পারবে। রুকু ও সাজদা ইঙ্গিত করে আদায় করতে পারবে, সেটা যেদিকেই ফিরে থাকুক না কেন। কিবলার দিকে মুখ করে থাকা শর্ত নয়। অনুরূপ বিধান গাড়ীতে থাকার ব্যপারেও প্রযোজ্য। কারণ আমের ইবন রাবী‘আহ বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
(رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي على راحلته حيث توجهت به) متفق عليه
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার বাহনের উপর যেদিকেই বাহন ফিরছে সেদিকেই সালাত আদায় করতে দেখেছি”। [বুখার ও মুসলিম]
আর বুখারীর বর্ণনায় অতিরিক্ত এসেছে,
(يومئ برأسه ولم يكن يصنعه في المكتوبة)
“তিনি (রুকু ও সাজাদার সময়) তার মাথা দিয়ে ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু তিনি ফরয সালাতের ক্ষেত্রে তা করতেন না”।
আর মুসলিমের বর্ণনায় অতিরিক্ত এসেছে,
(يوتر عليها)
“তিনি বাহনের উপর ওয়িতর সালাতও আদায় করেছেন”।
তবে উত্তম হচ্ছে তাকবীরে তাহরীমার সময় কিবলামুখী হয়ে তা করা।
খ) কিন্তু যদি সালাতটি হয় ফরয কোনো সালাত, তখন তার চারটি অবস্থা থাকতে পারে:
এক. যদি বিমানের আরোহনের পূর্বে বা বিমান থেকে নামার পরে সে ফরয সালাতটিকে তার নির্দিষ্ট ওয়াক্তে বা জমা তাকদীম অগ্রীম আদায় করে বা জমা তা‘খীর বা পিছিয়ে পড়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে তবে তাকে সেভাবেই আদায় করতে হবে।
দুই. যদি সময় হওয়ার পূর্বেই বিমানে প্রবেশ করে ফেলে, এবং যদি সালাতটি এমন হয় যা পরবর্তী সালাতের সাথে জমা করে আদায় করা সম্ভব,  আর তার অধিক ধারণা হয় যে বিমান প্রথম সালাতটির ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পরেই কেবল ভূমিতে অবতরণ করবে, তখন আরোহীর উচিত হবে জমা তা‘খীর বা পিছিয়ে নিয়ে জমা করার নিয়্যত করা। যেমন যোহরকে আসরের সময়ে পিছিয়ে নিয়ে জমা করে আদায় করা, অনুরূপভাবে মাগরিবকে ইশার সময়ে পিছিয়ে নিয়ে জমা করে আদায় করা।
তিন. আর যদি সময় হওয়ার পূর্বেই বিমানে উঠে পড়ে, আর তার প্রবল ধারনা হয় যে দু’ সালাত জমা করা যায় এমন সালাতের পুরো সময় চলে যাওয়ার পর কিংবা সালাতটি যদি এমন হয় যা পরবর্তী সালাতের সাথে জমা করা যায় না যেমন ফজরের সালাত, তাহলে তার উপর ওয়াজিব হবে বিমানের সালাত আদায়ের স্থান যদি পাওয়া যায় তাতে তা আদায় করা যদি তা করতে সম্ভব হয়, যদি না পাওয়া যায় তো চলাচল পথে, যদি তাও সম্ভব না হয় তবে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে কিন্তু রুকু ও সাজদা তার চেয়ারে বসা অবস্থায় ইঙ্গিত করে আদায় করবে। কোনোভাবেই সালাতের সময় চলে যাওয়া পর্যন্ত দেরী করা তার জন্য বৈধ হবে না।
চার. যদি বিমানে সালাত আাদায়ের স্থান থাকে এবং সেখানে যথাযথভাবে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে, রুকু করে ও সিজদা করে সালাত আদায় করা সম্ভব হয় তবে তাকে সেভাবেই সালাত আদায় করতে হবে, যদি তাতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়।
সংকলন: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলামহাউজ