শাফা‘আত

কোরআন-হাদীসের আলোকে শাফাআত

মুহাম্মাদ নাজমুল ইসলাম

সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 

শাফা‘আত

শাফা‘আতের অর্থ:

শাফা‘আত-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, সুপারিশ, মাধ্যম ও দো‘আ বা প্রার্থনা। পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে,

سُؤَالُ الْخَيْرِ لِلْغَيْرِ

“অপরের জন্য কল্যাণ প্রার্থনা করা।”আল-ইরশাদ ইলা সহীহিল ই‘তিক্বাদ: ২৬৭।

কেউ কেউ বলেছেন:

وَهِيَ السُّؤَالُ فِيْ التَّجَاوزِ عَنْ الذُّنُوْبِ وَ الْجَرَائِمِ

“শাফা‘আত হচ্ছে পাপ ও আযাব হতে মুক্তির প্রার্থনা করা”।আল-কাওয়াশিফুল জালিয়্যাহ: ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ৪৯০।

শাফাআতের প্রকারভেদ

আখেরাতে অনুষ্ঠিত শাফা‘আত সম্পর্কে দু’প্রকার আক্বীদাহ বিদ্যমান।

এক. শরী‘আত সম্মত শাফা‘আত,

দুই. শির্কী শাফা‘আত

শরী‘আতসম্মত শাফা‘আত:

যে শাফা‘আতের দো‘আ বা প্রার্থনা আল্লাহ তা‘আলার নিকট করা হয় তাকে শরী‘আতসম্মত শাফা‘আত বলা হয়। একে শাফা‘আতে মুসবাতাহ বা শরী‘আতস্বীকৃত শাফা‘আতও বলা হয়। আবার শাফা‘আতে মাকবুলাও বলা হয়।

শির্কী শাফা‘আত

যে শাফা‘আতের দো‘আ গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নিকট করা হয় তাকে শির্কী শাফা‘আত বলা হয়। এর অপর নাম শাফা‘আতে মানফিয়্যাহ বা নিষিদ্ধ শাফা‘আত। একে শাফা‘আতে মারফুদ্বাহও বলা হয়। মাজমু‘আতুত তাওহীদ পৃ. ২৭৮

শাফাআতের মালিক কে?

মহান আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন শাফা‘আতের একচ্ছত্র মালিক। কেননা শাফা‘আত একমাত্র তাঁরই অধিকারে, তাঁরই ক্ষমতাধীন। সর্বপ্রকার শাফা‘আতের চাবিকাঠি একমাত্র তাঁরই হাতে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗا﴾ [الزمر: ٤٤]

“হে নবী! বলে দিন, সকল শাফা‘আত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই অধিকারে।”আয-যুমার: ৪৪

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍ﴾ [السجدة: ٤]

“আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী আর কেউ নেই।” [সূরা আল-সাজদাহ: ৪]

﴿وَأَنذِرۡ بِهِ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ﴾ [الانعام: ٥١]

“আর এর দ্বারা (কুরআন দ্বারা) আপনি তাদেরকে সতর্ক করে দিন, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রবের দিকে সমবেত করা হবে, (এ অবস্থায় যে) তিনি ছাড়া তাদের জন্য থাকবে না কোনো সাহায্যকারী আর না সুপারিশকারী। হয়ত তারা তাকওয়া অবলম্বন করবে।” [সূরা আল-আন‘আম: ৫১]

﴿وَذَكِّرۡ بِهِۦٓ أَن تُبۡسَلَ نَفۡسُۢ بِمَا كَسَبَتۡ لَيۡسَ لَهَا مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ﴾ [الانعام: ٧٠]

“এবং আপনি এই কুরআন দ্বারা উপদেশ প্রদান করুন যাতে কোনো ব্যক্তি নিজের কর্মকাণ্ডের কারণে ধ্বংসের শিকার না হয়, যখন আল্লাহ ছাড়া তার জন্য কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবে না”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৭০]

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

“কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া।” [সূরা আল-বাকারাহ: ২৫৫]

“আকাশ ও যমীনের সবাই তাঁরই সমীপে প্রার্থনা করে।” [সূরা আর-রহমান: ২৯]

তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لِيَسْأَلْ أَحَدُكُمْ رَبَّهُ حَاجَاتَهِ كُلَّهَا حَتّى يَسْألَ شَسْعَ نَعْلِه اِذَا انْقَطَعَ»

“তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ পালনকর্তা আল্লাহর নিকট যাবতীয় হাজাত ও প্রয়োজনের প্রার্থনা করা কর্তব্য; এমনকি নিজের জুতার ফিতার জন্যেও প্রার্থনা করবে যদি তা ছিড়ে যায়” তিরমিযী, হাকিম, মিশকাত ও সহীহুল আযকার, পৃ. ৫০।

﴿وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا يَوۡمُ ٱلدِّينِ ١٧ ثُمَّ مَآ أَدۡرَىٰكَ مَا يَوۡمُ ٱلدِّينِ ١٨ يَوۡمَ لَا تَمۡلِكُ نَفۡسٞ لِّنَفۡسٖ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَٱلۡأَمۡرُ يَوۡمَئِذٖ لِّلَّهِ ١٩﴾ [الانفطار: ١٧، ١٩]

“হে নবী! বিচার দিবস সম্বন্ধে তুমি কী জান? আবার বলছি, বিচার দিবস সম্বন্ধে তুমি কী জান?” এটা সেদিন, যেদিন কেউ কারো জন্য কিছু করার সামর্থ্য রাখবে না। সেদিন একক কর্তৃত্ব হবে শুধু আল্লাহর।” [সূরা আল-ইনফিতার: ১৭-১৯]

শরীআত সম্মত শাফাআতের প্রকারভেদ

কুরআন-হাদীস স্বীকৃত শাফা‘আত হচ্ছে সর্বমোট আট প্রকার। ইসলামী আক্বীদার কিতাব-পত্রে মোট আট প্রকার শাফা‘আতের উল্লেখ রয়েছে। একে শাফা‘আতে মুছবাতাও বলা হয়। আবার শাফা‘আতে মাকবুলাও বলা হয়।

১ম প্রকার শাফা‘আত

‘আশ-শাফা‘আতুল উজমা’ বা সর্ববৃহৎ শাফা‘আত যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য খাস। আর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘শাফা‘আতে কুবরা’ ও মাকামে মাহমূদের মর্যাদা দান করবেন। হাশরের মাঠে দীর্ঘকাল অবস্থানে ক্লান্ত লোকেরা বিচারের আবেদন জানালে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টিকূলের বিচার কাজ শুরু করার প্রার্থনা জানাবেন রাব্বুল আলামীনের দরবারে।

শাফা‘আত বা সুপারিশ নেই, এ কথার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেউ কারো জন্য সুপারিশ করতে পারবে না, বরং আল্লাহর অনুমতির মাধ্যমে শাফা‘আত অস্তিত্ব লাভ করবে।

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন ‘সায়্যিদুশ শুফা‘আ’ বা শাফা‘আতকারীদের সর্দার হবেন। এ সত্ত্বেও তাঁর পক্ষেও আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো জন্য শাফা‘আত করা সম্ভব হবে না। যতক্ষণ না তাকে বলা হবে, সুপারিশ করার জন্য। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন:

«آتي تَحْتَ الْعَرْشِِ فَأَخِرُّ سَاجِدًا … ثُمَّ يُقَالُ»

“আমি ‘আরশের নিচে আসব আর সাজদায় লুটিয়ে পড়ব, তারপর বলা হবে:

«إرْفَعْ رَأسَكَ, قُلْ تُسْمَعْ, وَسَلْ تُعْطَ, وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ»

“হে মুহাম্মাদ! তোমার মাথা উঠাও, বল, শোনা হবে। প্রার্থনা কর, তোমাকে দেওয়া হবে। সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে”।

লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহ জাল্লা শানুহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শাফা‘আতের অনুমতি দিয়েছেন এবং এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার শাফা‘আত মঞ্জুর করা হবে। অর্থাৎ ক্ষমাকারী বা উদ্ধারকারী হিসেবে আল্লাহই সার্বভৌম কর্তৃত্ববান।

কিয়ামতের দিন মহানবী নিজেই আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে বলবেন:

«يَارَبِّ وَعَدْتَّنِيْ الشَّفَاعَةَ فَشَفِّعْنِي فِي خَلْقِكَ»

“হে আমার রব! আপনি আমাকে শাফা‘আতের ওয়াদা দিয়েছিলেন। অতএব, আমাকে আপনার সৃষ্টির জন্য সুপারিশকারী বনিয়ে দিন”। শরহু আকীদাতিত তাহাবিয়া, পৃ. ২২৬।

তখন তাঁকে সুপারিশকারী বানিয়ে দেওয়া হবে। অতএব, বুঝা গেল যে, কিয়ামত দিবসে অনুষ্ঠিত শাফা‘আত একমাত্র আল্লাহরই অনুমতি সাপেক্ষ। অর্থাৎ যাকে ইচ্ছা সুপারিশের অনুমতি দেওয়া ও যাকে ইচ্ছা না দেওয়া এবং যার জন্য ইচ্ছা করতে দেওয়া আর যার জন্য ইচ্ছা করতে না দেওয়া এবং কারো শাফা‘আত শোনা বা না শোনা আর তা কবুল করা বা না করা সর্বশক্তিমান আল্লাহর একক এখতিয়ারে। তিনি ছাড়া যে-ই হোক না কেন তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ শাফা‘আত করার সাহস করতে পারবে না। তাই যারা আখিরাতের আদালতে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত লাভের উচ্চাকাঙ্খা রাখে তার জন্য উচিৎ, শাফা‘আত ও দো‘আ কবুলের মালিক মহান আল্লাহর দরবারেই শাফা‘আত ও অন্যান্য বিষয়ে দো‘আ করা। যাতে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমাদের জন্য শাফা‘আত করার অনুমতি প্রদান করেন, যেমনিভাবে সমস্ত সৃষ্টিকুল তাঁরই নিকট প্রার্থনা করে থাকে।

২য় প্রকার শাফা‘আত

সৃষ্টির বিচার ও তাদের হিসাব-নিকাশ শেষ হলে জান্নাতীদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতিদানের জন্য রাসূলের শাফা‘আত।

৩য় প্রকার শাফা‘আত

চাচা আবু তালিব-এর শাস্তি হালকা করার জন্য রাসূলের শাফা‘আত। এই তিন প্রকারের শাফা‘আত আমাদের নবীজীর একক বৈশিষ্ট্য। এতে আর কেউ শরীক নন।

৪র্থ প্রকার শাফা‘আত

একত্ববাদে বিশ্বাসী গুনাহগার মুমিনবান্দা, যারা জাহান্নামের উপযুক্ত কিন্তু তাদেরকে জাহান্নামে না পাঠানোর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত।

৫ম প্রকারের শাফা‘আত

যেসব গুনাহগার মুমিন একত্ববাদে বিশ্বাসী হয়েও জাহান্নামে প্রবেশ করবে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাফা‘আত করবেন।

৬ষ্ঠ প্রকার শাফা‘আত

জান্নাতবাসীদের মধ্যে কোনো কোনো জান্নাতীর দরজা ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত।

৭ম প্রকার শাফা‘আত

যাদের নেকী-বদী, পাপ-পূণ্য সমান হবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত। তারা আহলে আ‘রাফ বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।

৮ম প্রকার শাফা‘আত

কোনো কোনো উম্মতকে বিনা হিসাবে ও আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার জন্য রাসূলের শাফা‘আত। যেমন, তিনি উক্কাশা ইবন মিহসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য আল্লাহর দরবারে দো‘আ করেছিলেন যে, তাকে যেন সেই সত্তর হাজার লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদেরকে বিনা হিসাব ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।

বি. দ্র. শেষোক্ত ৫ প্রকার শাফা‘আতের মধ্যে আমাদের নবীজীর সাথে অন্যান্যরা শাফা‘আত করবেন। যেমন, নবীগণ, ফিরিশতাগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, নেককার বান্দাগণ সকলেই শাফা‘আত করবেন, অবশ্য আল্লাহর অনুমতিক্রমে।

শরহুল আকীদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, পৃ. ১৫৭-১৫৮; শরহুল আক্বীদাতিত তাহাবিয়া পৃ. ২২৭-২২৮; আল-কাওয়াশিফুল জালিয়্যাহ, পৃ. ৪৯১, ৪র্থ সংস্কারণ।

 

শাফাআত কখন অনুষ্ঠিত হবে?

শাফা‘আতের একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ তা‘আলা। তাঁর অনুমতিক্রমে কিয়ামতের দিবসে শাফা‘আত অনুষ্ঠিত হবে।

ইমাম ইবন জারীর আত-তাবারী রহ. ﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِ﴾ [البقرة: ٢٥٥] আয়াতের ব্যখ্যায় লিখেছেন:

وَفِي هَذِهِ الْآيَةِ بَيَانٌ أنَّ الشَّفَاعَةَ إِنَّمَا تَقَعُ في الدَّارِ الْآخِرَةِ بِإذْنِه

এ আয়াতে উল্লেখ রয়েছে যে, শাফা‘আত পরকালে কিয়ামত দিবসেই আল্লাহর অনুমতিক্রমে অনুষ্ঠিত হবে।ফাতহুল মাজীদ: ১৭৮।

আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কিয়ামতের ময়দানে কেউ শাফা‘আত করতে পারবে না। কেননা আখিরাতের আদালতে কোনো শ্রেষ্ঠতম নবী-রাসূল এবং কোনো নিকটতম ফিরিশতাও সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে বিনা অনুমতিতে একটি শব্দও উচ্চারণ করার সাহস পাবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

“কে আছে এমন, যে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট শাফা‘আত করতে পারবে”? [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৫]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَوۡمَئِذٖ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَرَضِيَ لَهُۥ قَوۡلٗا ١٠٩﴾ [طه: ١٠٩]

“দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ছাড়া কারো শাফা‘আত সেদিন কোনো কাজে আসবে না।” [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১০৯]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَوۡمَ يَأۡتِ لَا تَكَلَّمُ نَفۡسٌ إِلَّا بِإِذۡنِهِ﴾ [هود: ١٠٥

“এমন একদিন আসবে যেদিন কেউ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারবে না।” [সূরা হূদ, আয়াত: ১০৫]

আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন সম্পর্কে বলেছেন:

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٧﴾ [الزمر: ٦٧]

“এসব লোকেরা তো আল্লাহর কদর যতটুকু করা উচিৎ ছিল তা করলো না অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী তার মুঠোর মধ্যে থাকবে। আর আকাশসমূহ থাকবে তাঁর ডান হাতের মধ্যে পেঁচানো বা ভাজ করা অবস্থায়। এসব লোকেরা যে শির্ক করে তা হতে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র ও বহু ঊর্ধ্বে [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৭]

শাফাআত কারা করবেন?

আখিরাতের আদালতে মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে যারা শাফা‘আত করবেন তারা হচ্ছেন, নবীগণ, ফিরিশতাবৃন্দ, শহীদগণ, আলিম-উলামা, হাফেযে কুরআন এবং নাবালগ সন্তান। তাদের শাফা‘আত কুরআন-হাদীসের অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা প্রমানিত। তাদের মধ্যে সায়্যিদুশ শুফা‘আ বা শাফা‘আতকারীদের সর্দার হলেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যেমন, তিনি বলেছেন:

«أَنَا أَوَّلُ شَافِعٍ وَ أَوَّلُ مُشَفَّعٍ»

“আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার শাফা‘আতই প্রথম গ্রহণ করা হবে।” সহীহ বুখারী ও মুসলিম।

তিনি আরও বলেছেন:

«يَشْفَعُ الشَّهِيْدُ فِي سَبْعِيْنَ مِنْ أَهْلِ بَيْتِه»

“শহীদ তার পরিবারের সত্তর জনের জন্য সুপারিশ করবে”। আবু দাউদ।

তিনি আরও বলেছেন:

«اِقرءوا القرآن فإنه يأتي يوم القيامة شفيعا لأهله»

“তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা এ কুরআন তার পাঠকারীর জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশকারী হয়ে আবির্ভূত হবে। সহীহ মুসলিম।

 

শাফা‘আতের শর্ত

তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, উল্লিখিত সুপারিশকারীগণ আখিরাতের আদালতে স্বেচ্ছায় যার-তার জন্য সুপারিশ করতে পারবে না, বরং তাদের সুপারিশ অস্তিত্ব লাভ করবে দু’টি শর্তে:

প্রথম শর্ত: শাফা‘আতকারীকে শাফা‘আতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে অনুমতি প্রদান করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

“কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত শাফা‘আত করতে পারবে? [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৫]

﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ إِذۡنِهِ﴾ [يونس: ٣]

“তাঁর অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩]

এতে স্পষ্ট যে, সুপারিশকারীকে অবশ্যই সুপারিশের অনুমতি প্রাপ্ত হতে হবে। অর্থাৎ বিনা অনুমতিতে সুপারিশ করার কেউ নেই। সুপারিশ স্বেচ্ছামূলক নয়, বরং তা হবে অনুমতিক্রমে।

দ্বিতীয় শর্ত: যার জন্য সুপারিশ করা হবে তার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ﴾ [الانبياء: ٢٨]

“এবং যার প্রতি তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট, তার জন্য ছাড়া অন্য কারো জন্য তারা শাফা‘আত করে না”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৮]

এতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সুপারিশ তারাই পাবেন যারা আল্লাহর প্রিয়জন হবেন।

আল্লাহর নিকট অপ্রিয় এমন কারো জন্য কোনো সুপারিশ চলবে না। এটি আরো পরিস্কার হয়ে যায় কুরআন বর্ণিত নিম্নোক্ত ঘটনাবলীর দ্বারা যে, আল্লাহ তা‘আলা মহাপ্লাবন থেকে কেনানকে রক্ষা করার ব্যাপারে নবী নূহ আলাইহিস সালামের সুপারিশ গ্রহণ করেন নি। পিতা আযরের জন্যে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ক্ষমা করে দেওয়ার সুপারিশ গ্রহণ করেন নি। আর মুনাফিকদের ব্যাপারে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ أَوۡ لَا تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗ فَلَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡ﴾ [التوبة: ٨٠]

“হে নবী! তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর, অথবা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না কর। যদি তুমি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর তথাপিও আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮০]

এ শর্ত দু’টিকে আল্লাহ তা‘আলা অপর এক আয়াতে একত্রে বলেছেন:

﴿وَكَم مِّن مَّلَكٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ لَا تُغۡنِي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ًٔا إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ أَن يَأۡذَنَ ٱللَّهُ لِمَن يَشَآءُ وَيَرۡضَىٰٓ ٢٦﴾ [النجم: ٢٦]

“আর আসমানসমূহে অনেক ফিরিশতা রয়েছে, তাদের সুপারিশ কোনোই কাজে আসবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট, তার ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার পর। [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬]শরহুল আক্বিদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ, পৃ. ১৫৯; কাওয়াশিফুল জালিয়্যাহ, পৃ. ৪৯০।

মোদ্দাকথা: সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর আদালতে যোগ্য সুপারিশকারী নির্বাচনের কারণে সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না, বরং সুপারিশ করার জন্য আল্লাহর অনুমোদন ও সুপারিশ যার জন্য করা হবে তাকে আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার কারণেই মাত্র সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।

 

সুতরাং উল্লিখিত শর্তদ্বয়ের বর্তমানেই শাফা‘আত অস্তিত্ব লাভ করবে এবং সুপারিশকারীরা সুপারিশ করবেন।

আল্লামা মাহমূদ আলুসী বাগদাদী রহ. বলেন,

“আয়াতের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই গোটা শাফা‘আতের একচ্ছত্র মালিক। সুতরাং অন্য কেই শাফা‘আতের সামান্যতম অধিকারও রাখে না। কিন্তু যদি শাফা‘আতপ্রাপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত হয় এবং শাফা‘আতকারী ব্যক্তি আল্লাহর অনুমতি প্রাপ্ত হয় (তবে সে শাফা‘আত করবে) আর উভয়টি এখানে (দুনিয়ায়) অনুপস্থিত।…আর আল্লাহর বাণী: (আকাশ এবং পৃথিবীর একক আধিপত্য তাঁরই) শাফা‘আতের একচ্ছত্র মালিকানা আল্লাহর হওয়ার এটিও একটি পৃথক কারণ। এখানে যেন বলা হচ্ছে, সমস্ত শাফা‘আত আল্লাহরই অধিকারে কেননা আল্লাহ জাল্লা শানুহু হলেন সমস্ত রাজত্বের নিয়ন্ত্রণকারী । সুতরাং আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ তার অনুমতি ও সন্তুষ্টি ব্যতীত শাফা‘আতের সামন্যতমও অধিকার রাখে না।”

আলোচ্য আয়াতে আকাশ ও পৃথিবীকে উল্লেখ করে আল্লাহ ব্যতীত বাকী সবকিছুকেই বুঝিয়েছেন”।হুল মা‘আনী, ২৪শ পারা, পৃ. ৯-১১।

আল্লামা তাফতাযানী রহ. বলেন, ইমাম মাকদিসী রহ. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বলে যে, কোনো মাখলুক আল্লাহর সমীপে তাঁর অনুমতি ছাড়া শাফা‘আত করবে তবে সে যেন বিশ্ব মুসলিমের ইজমা ও কুরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনাসমূহের বিরোধিতা করল।’শরহু আকাঈদ আন্নাসাফী।

 কারা শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত

১। কিয়ামত দিবসে অনুষ্ঠিত শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে যারা প্রকাশ্য শির্ক ও কুফুরীর গুনাহে লিপ্ত ছিল এবং এরই ওপর মারা গেছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ وَٱلۡمُشۡرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَٰلِدِينَ فِيهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمۡ شَرُّ ٱلۡبَرِيَّةِ ٦﴾ [البينة: ٦]

“আহলে কিতাবের মধ্যে যারা কাফির এবং যারা মুশরিক, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ী ভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম”। [সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৬]

যারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে তাদের কোনো রক্ষাকারী বা সাহায্যকারী নেই।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

﴿أَفَمَنۡ حَقَّ عَلَيۡهِ كَلِمَةُ ٱلۡعَذَابِ أَفَأَنتَ تُنقِذُ مَن فِي ٱلنَّارِ ١٩﴾ [الزمر: ١٩]

“হে নবী, সে ব্যক্তিকে কে বাঁচাতে পারে যার ওপর আযাবের ফয়সালা হয়ে গেছ, তুমি কি তাকে বাঁচাতে পার যে জাহান্নামে রয়েছে”? [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১৯]

এতে বুঝা গেল, এ সব জাহান্নামীদের জন্য কোনো শাফা‘আতকারী নেই। নেই কোনো রক্ষাকারী। তাদের ব্যাপারে কোনো শাফা‘আত গ্রহণও করা হবে না। কারণ, তারা ঈমানশূন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَا تَنفَعُهُمۡ شَفَٰعَةُ ٱلشَّٰفِعِينَ ٤٨﴾ [المدثر: ٤٨]

“সুতরাং সুপারিশকারীদের শাফা‘আত তাদের কোনো উপকারে আসবে না”। [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৪৮]

তিনি আরও বলেন,

﴿مَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ حَمِيمٖ وَلَا شَفِيعٖ يُطَاعُ ١٨﴾ [غافر: ١٨]

“যালিমদের জন্য কোনো বন্ধু নেই এবং এমন কোনো শাফা‘আতকারী নেই যার শাফা‘আত গ্রাহ্য হবে”। [সূরা গাফির, আয়াত: ১৮]

২। এ ছাড়া যারা আল্লাহর দীনের মধ্যে বিকৃতি এনেছে অথবা এর মধ্যে পরিবর্তন করেছে তাদের অবস্থাও সম্পূর্ণ আশংকাজনক। কারণ, তারা হাউজে কাউসারের পানি পান করতে পারবে না। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এই বলে তাড়িয়ে দিবেন:

«سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيّرَ بَعْدي وَ فِي رواية: سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ بَدَّلَ بَعْدِيْ»

“দূর হও, ধ্বংস হও যারা আমার পর (দীনের মধ্যে) পরিবর্তন বা রদবদল করেছ”। সহীহ বুখারী ও মুসলিম।

তাই আমাদের সবাইকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পুরোপুরিভাবে মেনে চলতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর দীনের অপব্যাখ্যা করা যাবে না, সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবেই তা গ্রহণ করতে হবে। বস্তুত: তাওহীদ হচ্ছে মানুষের চিরমুক্তির সুনিশ্চিত সনদ আর শির্ক হচ্ছে ধ্বংসের মূল। তাই তাওহীদবাদী ঈমানদার লোক মহাপাপী হলেও মুক্তি পাবে। আর মুশরিক মহাজ্ঞানী ও গুণধর হলেও অমার্জনীয় অপরাধী। এজন্য ইসলামের নবী বলেছেন:

«فَهِيَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِيْ لاَيُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئاَ»

“আমার উম্মতের মধ্যে এই শাফা‘আত ইনশাআল্লাহ সে ব্যক্তি লাভ করবে যে আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করা অবস্থায় মারা গেছে।”সহীহ বুখারী ও মুসলিম। সূত্র আকীদাতুল মুমিন: ১২৭।

কার নিকট শাফাআতের দোআ করব?

যেহেতু আল্লাহ তা‘আলাই শাফা‘আতের একমাত্র মালিক। শাফা‘আতের চাবিকাঠি একমাত্র তাঁরই হাতে। এতে কারো বিন্দু পরিমাণও অংশ নেই এবং আখিরাতের আদালতে তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ শাফা‘আত করতে সক্ষম হবে না। সেহেতু আমরা শাফা‘আতের দো‘আ মহান আল্লাহর নিকটই করব। অপরদিকে দো‘আ হচ্ছে সালাত, সাওমের মতো একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত, বরং ইবাদতের মগজ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «الدُّعَاءُ هُوَ الْعِباَدَةُ»

“দো‘আই হচ্ছে ইবাদত।” তিরমিযী ২/১৭৫

আর ইবাদত একমাত্র মহান রবের জন্য সুনির্দিষ্ট। ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করার নাম শির্কে আকবর। দো‘আ যেহেতু ইবাদত, তাই দো‘আ একমাত্র আল্লাহর নিকটেই করতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡ﴾ [غافر: ٦٠]

“তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমার নিকট দো‘আ কর, আমি তোমাদের দোআ কবুল করব। [সূরা গাফির, আয়াত: ৬০]

তিনি আরও বলেছেন:

﴿ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ٥٥﴾ [الاعراف: ٥٥]

“তোমরা তোমাদের রবের নিকট সংগোপনে ও বিনয়ের সাথে দো‘আ কর। নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِذَا سأَلْتَ فَاسْئَلِ اللَهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ»

“যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহর নিকট চাইবে। আর যখন সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে।” তিরমিযী ২/১৭৫।

আমরা সূরা আল-ফাতিহায় বলি:

﴿إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥﴾ [الفاتحة: ٥]

“আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার নিকটই সাহায্য চাই।” [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ لَمْ يَسألِ اللهَ يَغْضَب عَلَيْهِ»

“যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না, আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত হন।”তিরমিযী, ইবন মাজাহ, আদাবুল মুফরাদ ও আহমদ।

এতএব, যখন আমরা দো‘আ করব, তখন কেবল আল্লাহর কাছেই করব। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট কখনও কোনো কিছুর জন্য দো‘আ করব না। তাই শাফা‘আতের দো‘আ আল্লাহর দরবারেই করব। কেননা ইসলামের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

«مَنْ لَمْ يَدْعُ اللهَ يَغَضَبْ عليه».

“যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট দো‘আ করে না তার প্রতি আল্লাহর ক্রোধ রয়েছে”। হাকিম, সহীহুল আযকার পৃ. ৪৯

তিনি আরও বলেছেন:

«ادْعُوْا اللهَ وَاَنْتُمْ مُوْقِنُوْنَ بِالْاِجاَبَةِ»

“দো‘আ কবুলের বিশ্বাস নিয়ে তোমরা আল্লাহর নিকট দো‘আ করবে।” তিরমিযী।

তাই প্রত্যেক মুসলিমের ভেবে দেখা উচিৎ যে, কার নিকট তার দো‘আ করা কর্তব্য। যারা গাইরুল্লাহর নিকট দো‘আ করছেন তারা কি কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিতে পারবেন?

 শাফাআতের দোআ কীভাবে করব?

শাফা‘আত প্রার্থনা একমাত্র আল্লাহর কাছেই করব এবং বলব:

اَللهُمَّ شَفِّعْ فِيَّ نَبِيّكَ

“হে আল্লাহ! আপনার নবীকে আমার জন্য সুপারিশকারী বানিয়ে দিন।”

অথবা বলব:

اَللهم ارْزُقْني شَفَاعَةَ نَبِيِّكَ

“হে আল্লাহ! আপনার নবীর শাফা‘আত আমাকে দান করুন।”

অথবা বলব:

يَارَبِّ اجْعَلْنِيْ مِمَّنْ تُشَفٍّعُ فِيْهِمْ نَبِيكَ

“হে আমার রব! আমাকে ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন যাদের জন্য আপনি আপনার নবীর শাফা‘আত কবুল করবেন।”

অথবা বলব:

اَللهم لاَتَحْرِمْنِيْ شَفَاعَةَ نَبِيِّكَ

“হে আল্লাহ! আপনার নবীর শাফা‘আত থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।” আকীদাতুল মুমিন: ১২৯।

কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সাহাবীকে শাফা‘আত প্রার্থনা শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, যে তুমি বল:

«اَللهم شَفِّعْهُ فِيَّ»

“হে আল্লাহ! আপনি তাকে আমার জন্য শাফা‘আতকারী বানিয়ে দিন”। তিরমিযী।

এবং মৃত শিশুর জানাযায় এ দো‘আ পাঠ করতে বলেছেন

«وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَّ مُشَفَّعًا» “হে আল্লাহ! এ শিশুকে আমাদের জন্য শাফা‘আতকারী ও মঞ্জুরযোগ্য শাফা‘আতকারীতে পরিণত করুন”।সহীহ মুসলিম।

শাফা‘আত ব্যতীত কেউ কি জান্নাতে প্রবেশ করবে?

তার জবাবে আকাইদ শাস্ত্রবিদগণ বলেছেন:

نَعَمْ يخْرُجُ اللهُ أقْوَامًا مِنَ النَّارِ بِغَيْرِ شَفَاعَةٍ بَلْ بِفَضْلِه وَرَحْمَتِه وَيَبْقى فِى الْجَنَّةِ

“হ্যাঁ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিছু লোককে শাফা‘আত ছাড়াই তাঁর অশেষ অনুগ্রহ ও করুণাবলে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তারা আল্লাহর অনুগ্রহেই জান্নাতে চিরকাল অবস্থান করবে…।”

شرح العقيدة الطحاوية كذا في مختصر الأسئلة والأجوبة )الأصولية على العقيدة الواسطية /119

কেননা আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দীর্ঘ একটি হাদীসে বলেছেন:

«فَيَقُوْلُ اللهُ شَفَعَتْ الْمَلاَئِكَةُ وَشَفَعَ الْنَبِيُّوْنَ وَ شَفَعَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ لَمْ يَبْقَ إلاَّ اَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ فَيَقْبِضُ قَبْضَةً مِنَ النَّارِ فَيخْرجُ مِنْهَا قَوْمًا لَمْ يَعْمَلُوْا خَيْرًا قَطُّ».

“তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন যে, ফিরিশতারা শাফা‘আত করল, নবীরাও শাফা‘আত করল, মুমিনবৃন্দ শাফা‘আত করল এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ মহা করুণাময় ছাড়া অন্য কেউ অবশিষ্ট থাকল না। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের অগ্নি থেকে একমুষ্টি গ্রহণ করবেন এবং সেখান থেকে এমন একদল লোককে বের করে নিয়ে আসবেন যার কখনো কোনো সৎকর্ম করে নি”।সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও আহমদ।

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِ﴾ [الزمر: ٥٣]

“বল, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর চরম বাড়াবাড়ী করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩]

তিনি অন্যত্র বলেন,

«فَأَقُولُ ياَرَبِّ ائذَن لِي فِيْمَنْ قَالَ:(لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهَ) فَيَقُوْلُ: وَعِزَّتِي وَجَلاَلِيْ وَكِبْرِياَئيِ وَعَظْمَتِيْ لَأخْرِجَنَّ مِنْهَا مَنْ قَالَ: (لاَإِلَهَ إِلاَّ اللهَ)»

“তখন আমি বলব, হে আমার রব! যে ব্যক্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলেছে তার ব্যাপারে আমাকে (শাফা‘আতের) অনুমতি দিন। প্রতি-উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন “আমার শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, মহত্ব, ও ইজ্জতের কসম করে বলছি আমিই সেখান থেকে এদেরকে বের করে নিয়ে আসব যারা বলেছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।

সহীহ মুসলিম, শরহু আকীদাতুত্ তাহাবিয়া: ২৩০।

তাঁর দয়া ও রহমতের একশ ভাগ হতে মাত্র এক ভাগ তিনি গোটা সৃষ্টিকুলের মাঝে বিতরণ করেছেন। আর নিরানব্বই ভাগ দয়া ও রহমত তিনি কিয়ামত দিবসে প্রকাশ করার জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন। সত্যি তিনি ‘আরহামুর রাহিমীন’ সবচেয়ে বড় দয়াশীল। তাই সর্বাবস্থায় তাঁরই ওপর ভরসা করতে হবে। কোনো বিষয়েই গাইরুল্লাহর ওপর ভরসা করা যাবে না। তিনি বলেছেন:

﴿وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٢٣﴾ [المائ‍دة: ٢٣]

“আর আল্লাহর ওপরই ভরসা কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ২৩]

তিনি আরও বলেন,

﴿قَالَ وَمَن يَقۡنَطُ مِن رَّحۡمَةِ رَبِّهِۦٓ إِلَّا ٱلضَّآلُّونَ ٥٦﴾ [الحجر: ٥٦]

“পথভ্রষ্ট লোকেরা ব্যতীত নিজ রবের রহমত থেকে আর কে নিরাশ হতে পারে”? [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৫৬]

“তিনি (আল্লাহ) যদি সূক্ষ্মভাবে হিসেব কষতে শুরু করেন তাহলে কার এমন দুঃসাহস আছে যে নিজ বলে জান্নাত লাভ করার দাবী করতে পারে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাই বলেছেন। তিনি বলেন,

«اعْلَمُوْا وَسَدٍّدُوْا وَقَرٍبُوْا وَاعْلَمُوْا أَنَّ أَحَدًا لَنْ يدْخُلَهُ عَمَلُه الْجَنَّةَ»

“আমল কর এবং নিজের সাধ্যমত সর্বাধিক সঠিক কাজ করার চেষ্টা কর এবং সত্যের কাছাকাছি থাক, জেনে রাখবে, কোনো ব্যক্তিকে শুধু তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না।”

লোকেরা বললো: হে আল্লাহর রাসূল আপনার আমলও কি পারবে না? তিনি বললেন:

«وَلاَ أَنَا إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللهُ بِرَحْمَتِهِ»

“না, আমিও না, তবে আমার রব তাঁর রহমত দ্বারা আমাকে আচ্ছাদিত করে নিয়েছেন।” সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম; আহমদ খ. ৬, পৃ. ১২৫; শরহু আকীদাতুত্ তাহাবিয়া, পৃ. ৫০৬

আল্লাহর ওপর ভরসা করা তাওহীদ ও ঈমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবী। বান্দা তার দীন, দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও নি‘আমত আল্লাহর কাছেই কামনা করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই দো‘আ করতেন:

«اَللَّهُمَّ مَا اَصْبَحَ بِيْ مِنْ نِعْمَةٍ اَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ فَمِنْكَ وَحْدَكَ لاَشَرِيْكَ لَكَ فَلَكَ الْحَمَدُ وَلَكَ الشُكْرُ»

“হে আল্লাহ! আমি অথবা আপনার কোনো সৃষ্টি যে অশেষ নি‘আমতের ভাণ্ডার নিয়ে প্রভাতে উপনীত হয় তা এককভাবে আপনারই পক্ষ থেকে। আপনি এক, আপনার কোনো অংশীদার নেই। সুতরাং সকল প্রকার প্রশংসা আপনারই, আপনার জন্যই সকল কৃতজ্ঞতা”। আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবন হিব্বান

পার্থিব শাফাআত ও আখেরাতের শাফাআতের পার্থক্য

আমরা আখেরাতে অনুষ্ঠিত শাফা‘আত বিষয়ে আলোচনা করছি। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আখেরাতে অনুষ্ঠিত শাফা‘আত। পার্থিব বিষয়ে শাফা‘আত আমাদের

আলোচ্য বিষয় নয়। কারণ, ভালো কাজের জন্য পরস্পরের শাফা‘আত সম্পূর্ণ বৈধ ও জায়েয। এতে কোনো মতভেদ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿مَّن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةً حَسَنَةٗ يَكُن لَّهُۥ نَصِيبٞ مِّنۡهَاۖ وَمَن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةٗ سَيِّئَةٗ يَكُن لَّهُۥ كِفۡلٞ مِّنۡهَا﴾ [النساء: ٨٥]

“যে ব্যক্তি সৎকাজের জন্য কোনো সুপারিশ করবে তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে, আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের জন্য সুপারিশ করবে সেও তার বোঝার একটি অংশ পাবে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«اِشْفَعُوْا تُؤْجَرُوْا»

“তোমরা সুপারিশ কর পুরস্কার পাবে”। সহীহ বুখারী।

তাই পার্থিব বিষয়ে পরস্পরের জন্য সুপারিশ করা জায়েয ও কুরআন-সুন্নাহ সম্মত। তবে শর্ত হচ্ছে বৈধ বিষয়ে হতে হবে।

তবে আকাইদ শাস্ত্রবিদগণ বলেছেন,

اَلشَّفَاعَةُ عِنْدَ اللهِ لَيْسَتْ كَالشَّفَاعَةِ عِنْدَ الْبَشَرِ

“আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার বিষয়টি মানুষের কাছে সুপারিশ করার মতো নয়।” শরহু আকীদাতুত তাহাভী পৃ. ১৩৫।

    পার্থিব শাফাআত                                                                              আখেরাতের শাফাআত

شفاعة المخلوق عند المخلوق

সৃষ্টির নিকট সৃষ্টির শাফাআত

شفاعة المخلوق عند الخالق

সৃষ্টিকর্তা (আল্লাহ)- এর নিকট সৃষ্টির শাফাআত

1- الشفيع غير مخلوق للمشفوع عنده

১। শাফাআতকারী শাফাআত গ্রহণকারীর সৃষ্টি নয়।

1- الشفيع مخلوق للمشفوع عنده

১। শাফাআতকারী শাফাআত গ্রহণকারীর সৃষ্টি।

2-الشفيع غير مأمور بل شريك للمشفوع عنده

২। শাফাআতকারী শাফাআত গ্রহণকারীর আদিষ্ট দাস নয়, বরং শাফাআতকৃত বিষয়ে তার সম অংশীদার।

2- الشفيع مأمور للمشفوع عنده

২। শাফাআতকারী শাফাআত গ্রহণকারীর আদিষ্ট দাস মাত্র।

3- الشفيع غير محتاج إلى الإذن

৩। শাফাআতকারী শাফাআত গ্রহণকারীর অনুমতির মুখাপেক্ষী নয়।

3- الشفيع محتاج إلى الإذن كل الاحتياج

৩।শাফাআতকারী সম্পূর্ণরূপেই শাফাআতগ্রহণকারী র অনুমতির মুখাপেক্ষী ।

4- الشفيع هو الذي يحرك المشفوع عنده حتى يقبل

৪। শাফাআতকারীই শাফাআতগ্রহণকারীকে তা কবুল করতে প্রেরণা যোগায়।

4- المشفوع عنده هو الذي يحرك الشفيع حتى يشفع

৪। শাফাআতগ্রহণকারীই শাফাআতকারীকে তা করতে উৎসাহিত করেন।

 5- الشفيع يشفع لمن ارتضاه المشفوع عنده وقد لايرتضيه فيقبل الشفاعة كرها

৫। শাফাআতকারী শাফাআতগ্রহণকারীর পছন্দনীয় অপছন্দনীয় সকল ব্যক্তির জন্যই তা করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে অপছন্দনীয় ব্যক্তির ব্যাপারে কৃত শাফাআত বাধ্য হয়ে তাকে গ্রহণ করতে হয়।

5 -الشفيع لايشفع إلا لمن ارتضاه المشفوع عنده

৫। শাফাআতকারী শাফাআত গ্রহণকারীর পছন্দনীয় ব্যক্তি ছাড়া আর কারো জন্য শাফাআত করতেই পারেনা।

6- هذه الشفاعة شفاعة الشفيع في الحقيقة لأنه الذي تحرك للشفاعة دون تحريك من المشفوع عنده

৬। শাফাআতকারীই মূলতঃ এ শাফাআতের স্বত্ত্ব ও কৃতিত্বের দাবীদার। কেননা, সে-ই বিনাপ্রেরণায় শাফাআতে উদ্যোগী হয়েছে, শাফাআত গ্রহণকারীর কোন প্রেরণাই এ ক্ষেত্রে ছিল না।

6- هذه الشفاعة في الحقيقة هي شفاعة المشفوع عنده فإنه الذي أذن والذي قبل والذي رضي والذي وفق

৬। শাফাআতগ্রহণকারীই মূলত: এ শাফাআতের মালিক। কেননা, শাফাআতকারীকে তিনিই নির্দেশ দিবেন, তিনিই কবুল করবেন, তিনিই পছন্দ করবেন ও তাওফীক দিবেন।

7- هذه الشفاعة تطلب من الشفيع

৭। প্রয়োজনগ্রস্থ ব্যক্তিকে শাফাআতকারীর নিকটই এ শাফাআত চাইতে হয়।

7- هذه الشفاعة لاتطلب الا من المشفوع عنده ولا تطلب من الشفيع

৭। এ শাফাআত কেবলমাত্র শাফাআত গ্রহণকারীর নিকট চাইতে হবে। শাফাআতকরীর নিকট কিছুতেই চাওয়া যাবে না।

8- هذه الشفاعة تجعل الفرد شفعا لأنهما شريكان في الأمر

৮। শাফাআতকারীর অনুরোধে ও শাফাআত গ্রহণকারীর ব্যবস্থাপনার দ্বারা যেহেতু প্রয়োজন পূরণ হয়ে থাকে তাই এ শাফাআত তাদের প্রত্যেককে অপরের জোড় ও অংশীদারে পরিণত  করেছে। তারা একই বিষয়ে সমানে শরীক।

8- هذه الشفاعة لاتجعل الوتر شفعا لأنه خلق هذه الشفاعة وأذن لها والشفاعة المخلوقة المأذونة هي شفاعته في الحقيقة والمخلوق لايشارك الخالق في شيء فهو لايشارك الخالق في شيء فهو لا يزال وترا

৮। শাফাআতকারীর ভূমিকা শুধু আদেশ পালন করা। তাঁর এ শাফাআত তাকে শাফাআত গ্রহণকারীর জোড় বা অংশীদারে পরিণত করেনা। কেননা, আল্লাহই এ শাফাআতের স্রষ্টা ও নির্দেশ দাতা। তা ছাড়া সৃষ্ট কোন বিষয়েই স্রষ্টার শরীক হতে পারে না। তিনি সর্বদাই বোজাড় ও অংশীদারহীন।

 

নবী করীম (ছাঃ) কসম করে বললেন,

তোমাদের যে কেউ নিজের হক বা অধিকারের দাবীতে কত কঠোর তা তো তোমাদের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু মুমিনগণ তাদের সে সমস্ত ভাইদের মুক্তির জন্য আল্লাহর সাথে আরও অধিক ঝগড়া করবে, যারা তখনও জাহান্নামে পড়ে রয়েছে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! এ সমস্ত লোকেরা আমাদের সাথে ছিয়াম পালন করত, ছালাত আদায় করত এবং হজ্জ পালন করত। সুতরাং তুমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ দাও।

তখন আল্লাহ বলবেন, যাও তোমরা যাদেরকে চিন তাদেরকে জাহান্নাম হ’তে মুক্ত করে আন। তাদের মুখের আকৃতি জাহান্নামের আগুনের প্রতি হারাম করা হয়েছে। এজন্য তারা মুখ দেখে চিনতে পারবে। তখন তারা জাহান্নাম হ’তে অনেক লোক বের করে আনবে।

তারপর বলবেন, হে আমাদের প্রতিপালক! এখন সেখানে আর এমন একজন লোকও নেই যাকে বের করার জন্য আপনি আদেশ করেছেন।

তখন আল্লাহ বলবেন, আবার যাও যাদের অন্তরে এক দীনার পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে বের করে আন। এতেও তারা বহু সংখ্যক লোককে বের করে আনবে। তারপর আল্লাহ বলবেন, পুনরায় যাও যাদের অন্তরে অর্ধ দীনার পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে বের করে আন। সুতরাং তাতেও তারা বহু সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবে।

তারপর আল্লাহ বলবেন, আবার যাও যাদের অন্তরে এক বিন্দু পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকে বের করে আন। এবারও তারা বহুসংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবে এবং বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! ঈমানদার কোন ব্যক্তিকে আমরা জাহান্নামে রেখে আসিনি।

তখন আল্লাহ বলবেন, ফেরেশতাগণ, নবীগণ এবং মুমিনগণ সকলেই শাফা‘আত করেছেন। এখন আমি পরম দয়ালু ব্যতীত আর কেউ বাকী নেই। এ বলে তিনি মুষ্টি ভরে এমন একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করবেন যারা কখনও কোন নেক কাজ করেনি, যারা জ্বলে-পুড়ে কালো কয়লা  হয়ে গেছে। অতঃপর তাদেরকে জান্নাতের সামনে একটি নহরে ঢেলে দেওয়া হবে, যার নাম হ’ল ‘নহরে হায়াত’।

এতে তারা স্রোতের ধারে যেমনভাবে গাছের বীজ গজায়, তেমনিভাবে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সজীব হয়ে উঠবে। তখন তারা সেখান থেকে বের হয়ে আসবে মুক্তার মত চকচকে হয়ে। তাদের কাঁধে সীল মোহর থাকবে। জান্নাতীরা তাদের দেখে বলবে এরা পরম দয়ালু আল্লাহর মুক্তকৃত দাস। আল্লাহ্ তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন, অথচ তারা পূর্বে কোন আমল বা কোন কল্যাণের কাজ করেনি। অতঃপর তাদেরকে বলা হবে, এ জান্নাতে তোমরা যা দেখছ, তা তোমাদেরকে দেওয়া হ’ল এর সঙ্গে অনুরূপ পরিমাণ আরও দেওয়া হ’ল’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৪১)।

https://islamhouse.com/read/bn/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%86%E0%A6%A8-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%80%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%86%E0%A6%A4-320492#ref_20

প্রশ্নঃ জন কুরআনের হাফেয তার পরিবারের মধ্য থেকে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেছে এমন ১০জন ব্যক্তিকে শুপারিশ করার হাদিসটি কি সহীহ?

উত্তর: একজন কুরআনের হাফেয তার পরিবারের মধ্য থেকে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেছে এমন ১০জন ব্যক্তিকে শুপারিশ করার হাদিসটি সহীহ নয়।

নিম্নে এ হাদিসটির মূল আরবী টেক্সট, তরজমা, উৎস এবং মুহাদ্দিসদের বক্তব্য তুলে ধরা হল:

আলী ইবনে আবি তালিব রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

من قرأ القرآن وتلاه وحفظه أدخله الله الجنة وشفعه في عشرة من أهل بيته كل قد وجبت له النار

“যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করল, তিলাওয়াত করলো এবং মুখস্থ করল আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাকে তার বংশধর হতে এমন দশজনকে সুপারিশ করার সুযোগ দান করবেন যাদের উপর জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গিয়েছিল।”

(তিরমীজি খণ্ড ২ হাদিস ১১৪, এ হাদিসটি সম্পর্কে আবু ‘ঈসা তিরমিযী রহ. নিজেই মন্তব্য করে বলেন: “এ হাদীসটি হাসান গারীব। আমরা এই সনদ ছাড়া আর কোন সনদ সম্পর্কে জানি না। ইবনে মাজাহ হাদিস ২১৬-মুহাদ্দিসগণের গবেষণায় উক্ত হাদিসটি যঈফ।

এই হাদিসের সনদ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মন্তব্য দেয়া হল (আরবী):

وفيه كثير بن زاذان قال ابن معين : (( لا أعرفه )) ، وقال الإمامان الرازيان : (( هذا شيخ مجهول لا نعلم احد احدث عنه )) ، قال الحافظ الذهبي في الكاشف : (( لا يثبت حديثه )) ، وقد أعل الحَافظ الذهبي حَديثاً في السير (13/306) : (( قَالَ رَسُوْلُ اللهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-: (قَالَ لِي جِبْرِيْلُ: لَوْ رَأَيْتَنِي يَا مُحَمَّدُ وَأَنَا أَغُطُّهُ بِإِحْدَى يَدَيَّ، وَأَدُسُّ مِنَ الحَالِ فِي فِيْهِ، مَخَافَةَ أَنْ تُدْرِكَهُ رَحْمَةُ رَبِّهِ فَيَغْفِرُ لَهُ) .حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ، وَكَثِيْر فِيْهِ جَهَالَةٌ )) فالحَديث لا يصح لجهالة كثير بن زاذان ، ولهُ عند أبي زرعة وأبي حاتم حديث في فضل القرآن ، قال الترمذي : (( حديث غريب لا نعرفهُ إلا من هذا الوجه )) .

এ হাদিসের সমার্থবোধক আরও দু একটি হাদিস পাওয়া যায় কিন্তু সবগুলোর অবস্থা একই

✅ কুরআন পাঠকারী ও আমলকারী ব্যক্তির পিতামাতাকে কিয়ামতের দিন নূরের মুকুট পরানোর সহিহ হাদিস:

প্রখ্যাত সাহাবী বুরায়দা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

من قرأ القرآن وتعلَّم وعمل به أُلبس والداه يوم القيامة تاجاً من نور ضوؤه مثل ضوء الشمس ، ويكسى والداه حلتين لا تقوم لهما الدنيا فيقولان : بم كسينا هذا ؟ فيقال : بأخذ ولدكما القرآن ” . رواه الحاكم ( 1 / 756 )

“যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে ও এর ওপর আমল করে, তার মাতা-পিতাকে কেয়ামতের দিন এমন একটি করে নূরের মুকুট পরানো হবে, যার জ্যোতি সূর্যের জ্যোতির মত হবে। আর তাদেরকে এমন দুটি পোশাক পরিধান করানো হবে যার মূল্য সারা দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকেও বেশী।

তখন তারা জিজ্ঞেস করবেন, হে আমার প্রতিপালক, কেন আমাদেরকে এই পোশাক পরিধান করানো হল? বলা হবে: “তোমার সন্তানের কুরআন শিক্ষা ও আমলের কারণে।” (হাকিম, ১/৭৫৬। আলবানী রহ. এ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)

আল্লাহু আলাম।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত করার পাশাপাশি তদনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন।

আমীন •••••••••••••••••••

উত্তর প্রদানে:

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার