২। শয়তানের বহুরুপী কাজের ধরন

আসসালামু’আলাইকুম

 

শয়তানের প্রথম চক্রান্তের শিকার হন হযরত আদম আ ও মা হাওয়া আঃ

আদমকে সৃষ্টি করার পর মহান আল্লাহ আদম থেকে বা আদমের পাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করেন তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে। তাদের বসবাস করতে দেন জান্নাতে। পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পূর্বে অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ লাভের উদ্দেশ্যেই তাদের কিছু কাল জান্নাতে রাখা হয়। একটি বৃক্ষের ফল ভক্ষণ ছাড়া জান্নাতে পানাহার ও চলা ফেরার অবাধ স্বাধীনতা তাদের দেয়া হয়।

জান্নাতে এতো এতো গাছ, নি’আমত দিয়ে রেখে শুধুমাত্র একটি গাছ হারাম করা হয়। ইবলিস সেটাই টার্গেট করে নেয়।

শয়তান, তার দৃষ্টিতে যার কারণে সে চিরতরে অভিশপ্ত হলো, সেই আদমকেই সে তার টার্গেট বানায়। সে আদমকে প্রতারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আদমের কাছে গিয়ে হাযির হয়। সে তাঁদের কুমন্ত্রণা দিয়ে বলে :

مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَـٰذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَن تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ

অর্থ : তোমাদের প্রভু যে তোমাদেরকে এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করেছেন, তার কারণ হলো, তোমরা যেনো ফেরেশতা না হয়ে যাও, অথবা চিরদিন যেনো জান্নাতে থাকতে না পারো। (সূরা আ’রাফ : আয়াত ২০)

শয়তান নিজের এই বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে কসম খেয়ে বলে :

وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ

: এবং সে (ইবলিস) কসম খেয়ে তাদের বললো : আমি তোমাদের ভালো চাই, আমি তোমাদের কল্যাণকামী। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২১)

এভাবে প্ররোচনা দিয়ে ধীরে ধীরে সে তাদের দু’জনকে তার প্রতারণার জালে আটকে ফেলে। তাঁরা নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করেন। এভাবে অসতর্ক হয়ে তাঁরা সাময়িকভাবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে বসেন :

فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ

অর্থ : এভাবে সে তাদের দুজনকে প্রতারণার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করলো। ( আরাফ : ২২)

(এখানে দাল্লা শব্দ  বাকেট আকর্ষনীয় খাবার পশুকে আস্তে আস্তে কাছে নিয়ে আসে ট্র্যাপ এ ফেলার জন্য।এখানেও ইবলিস ধীরে ধীরে আদম হাওয়াকে আ ট্র্যাপে ফেলে।।

 

কিন্তু তাঁরা শয়তানের অনুকরণ করলেন না। শয়তান আল্লাহর হুকুম অমান্য করে অহংকার, হঠকারিতা এবং সীমালংঘনের দিকে অগ্রসর হয়। পক্ষান্তরে আদম ও হাওয়া আল্লাহর হুকুম অমান্য করার সাথে সাথে অনুতপ্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা তওবা করেন, নিজেদের ভুল স্বীকার করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন :

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থ : তারা প্রার্থনা করলো : আমাদের প্রভু! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি করূণা না করো, তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো! (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ২৩)

ফলে আল্লাহ পাক তাঁদের ক্ষমা করে দেন। তারা পবিত্র হয়ে যান।

শয়তান কাদের বিপথগামী করে এবং সে কাদের বন্ধু ও অভিভাবক?

আমরা এখানে আল কুরআনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করছি। এ আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার হয়ে যাবে শয়তান কাদেরকে বিপথগামী করে। সে কাদের অভিভাবকত্ব করে এবং কারা তার ভক্ত বন্ধু ও অনুসারী? মহান আল্লাহ বলেন :

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ – تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ – يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ

১।

অর্থ: (হে মানুষ!) আমি কি তোমাদের সংবাদ দেবো, শয়তানরা কাদের উপর নাযিল হয় (কাদের ঘাড়ে চেপে বসে)? -তারা চেপে বসে ঘোরতর মিথ্যাবাদী পাপাসক্তদের ঘাড়ে; যারা কান পেতে থাকে এবং মিথ্যা কথা ছড়ায়। (সূরা আশ্ শোয়ারা : ২২১-২২৩)

أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِينَ عَلَى الْكَافِرِينَ تَؤُزُّهُمْ أَزًّا

২।

অর্থ: তুমি কি দেখোনা, আমি শয়তানদের ছেড়ে রেখেছি; তারা কাফিরদের উপর সওয়ার হয় এবং তাদেরকে মন্দ কর্মে প্রলুব্ধ করে? (সূরা মরিয়ম : ৮৩)

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ – وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَـٰكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ –

৩।

অর্থ: তুমি তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও : যার কাছে আমি আমার আয়াত পাঠিয়েছিলাম; কিন্তু সে তা বর্জন করে। অতএব শয়তান তার পেছনে লাগে এবং সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আমি চাইলে তা (আমার আয়াত) দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতে পারতাম; কিন্তু সে (তা বর্জন করে) দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। (সূরা ৭ : ১৭৫-১৭৬)

 

إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُم بِهِ مُشْرِكُونَ

৪।

অর্থ : শয়তান তো কেবল তাদের উপরই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য করে, যারা তাকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে, আর যারা আল্লাহর সাথে শরিক করে। (সূরা  আন নহল :  ১০০)

وَلِتَصْغَىٰ إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَلِيَرْضَوْهُ وَلِيَقْتَرِفُوا مَا هُم مُّقْتَرِفُونَ

৫।

অর্থ: যারা আখিরাতে বিশ্বাস করেনা, তাদেরকে নিজের প্রতি অনুরক্ত ও পরিতুষ্ট করা এবং নিজেরা যেসব অপকর্ম করে, তাদেরকে দিয়েও সেসব অপকর্ম করানোর উদ্দেশ্যেই শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়। (সূরা আনআম : ১১৩)

لِّيَجْعَلَ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِّلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ وَالْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ

৬।

অর্থ: তিনি এমনটি করেন শয়তানের উদ্ভাবিত সন্দেহকে ঐসব লোকদের জন্যে ফিতনা (পরীক্ষা) বানানোর জন্যে, যাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি এবং যারা পাষন্ড। (সূরা  আল হজ্জ :  ৫৩)

অর্থ: যে কেউ আল্লাহর যিকর (কুরআন এবং আল্লাহর ইবাদত) থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, আমরা তার সাথি-বন্ধু হিসেবে শয়তানকে নিয়োগ করি। তখন তারাই ঐ লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলা থেকে বিরত রাখে; অথচ তারা মনে করে তারা সঠিক পথেই চলছে। অবশেষে যখন (কিয়ামতের দিন) আমার কাছে উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে : ‘হায়, (পৃথিবীতে) আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব থাকতো।’ কতইনা নিকৃষ্ট সাথি এই শয়তান। (তখন তাদের বলা হবে 🙂 আজ তোমাদের অনুতাপ তোমাদের কোনো কাজেই আসবেনা। যেহেতু তোমরা তো যুলুম-সীমালংঘন করে এসেছো, তাই তোমরা সকলেই আযাবের শরিকদার।

(হে নবী!) তুমি কি শুনাতে পারবে বধিরকে? কিংবা পথ দেখাতে পারবে কি অন্ধকে? আর ঐ ব্যক্তিকে যে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত? (সূরা  যুখরুফ :৩৬-৪০)

৭।

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন : “তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করোনি, যারা আল্লাহর গযব প্রাপ্ত লোকদের (ইহুদি ও অন্যান্যদের) বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে? আসলে এরা তাদের দলভুক্তও নয়, তোমাদের দলভুক্তও নয়। তারা জেনে শুনেই মিথ্যা শপথ করে ………….।”

অতপর এ লোকদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :

অর্থ: “শয়তান তাদের উপর প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে। ফলে সে তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। এরাই শয়তানের দল। সাবধান হও, শয়তানের দল অবশ্যি পরাস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (সূরা মুজাদালা :  ১৪-১৯)

 

  ইবলিশের কাজের পদ্ধতি

 

ইবলিসের বিভিন্নমুখি চক্রান্তের সুযোগ কেন দেয়া হলো,এর উত্তরে বলা হয় মহান আল্লাহর উইজডম আছে। আল্লাহই ভালো জানেন। তবে মানুষ ও জ্বীন জাতির জন্য এটাও প্রয়োজন আছে বলেই মহান আল্লাহর পরিকল্পনার একটি অংশ।

মহান আল্লাহ বলেছেন-

তিনি এজন্য এমনটি হতে দেন) যাতে শয়তানের নিক্ষিপ্ত অনিষ্টকে পরীক্ষায় পরিণত করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে (মুনাফিকীর) রোগ রয়েছে এবং যাদের হৃদয়বৃত্তি মিথ্যা-কলূষিত-আসলে এ জালেমরা শত্রুতায় অনেক দূরে পৌঁছে গেছে ।

এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা জেনে নেয় যে, তোমার রবের পক্ষ থেকে এটা সত্য এবং তারা এর প্রতি ঈমান আনে এবং এর সামনে তাদের অন্তর ঝুঁকে পড়ে; যারা ঈমান আনে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ চিরকাল সত্য-সরল পথ দেখিয়ে থাকেন। সূরা হজ্জঃ ৫৩-৫৪

ইবনুল কাইয়্যুম যাদুল মায়াদ বইতে উল্লেখ করেছেন, ইবলিসের এই চক্রান্ত এর পিছনেও মহান আল্লাহর উইজডম আছে। আমরা সকল কিছু বুঝতে পারি না জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে। শয়তানের চক্রান্তের বিরুদ্ধে পূর্ন শক্তি নিয়োগ করে প্রচেষ্টা চালাতে হবে যেন, রবের পথেই টিকে থাকতে পারে। আল্লাহর পথে টিকে থাকার এই প্রচেষ্টা আল্লাহ যাচাই করেন। এর মাধ্যমে বান্দা রবের আরো নিকটে মর্যাদা পেতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ জানিয়েছেন-

 

إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيْفًا- ‘নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল একান্তই দুর্বল’ (নিসা ৪/৭৬)।

২টি কারনে দূর্বলঃ

১। আল্লাহ কৌশল করেন তাদের উপর, কারন আল্লাহ সকল শয়তানী কাজের উপর উত্তম কৌশলী, তাই শয়তান দূর্বল। যখনই কোন শয়তানী চক্রান্ত উঠে আসতে চায় মহান আল্লাহ সেটার বিরুদ্ধে নতুন  কৌশলী এনে দেন যা ইমানদারদের, অনুগত বান্দাদের হেফাজত করে।

তারা নিজেদের কূট -কৌশল প্রয়োগ করে চলছিল, অন্যদিকে আল্লাহ ও তাঁর কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন আর আল্লাহ সবচেয়ে ভাল কৌশল, অবলম্বনকারী৷ আনফালঃ৩০

২। শয়তানের কৌশল দূর্বল কারন সে কারোর উপর জোর করে কর্তৃত্ব করতে পারে না, যে কর্তৃত্ব করতে দেয় সেখানেই সে খাটাতে পারে।

নিশ্চয়ই যারা আমার নিষ্ঠাবান দাস তাদের উপর তোর কোনো আধিপত্য খাটবেনা। তোর কর্তৃত্ব শুধু ঐ সব ভ্রষ্ট লোকদের উপরই চলবে, যারা তোকে মেনে চলে।হিজরঃ৪২

আমার প্রকৃত দাসদের উপর তোর কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবেনা। (হে মুহাম্মদ!) ভরসা করার জন্যে তোমার প্রভুই যথেষ্ট। (সূরা ইসরা :  ৬৫)

যখন আল্লাহর বিচার ফায়সালা শেষ হবে, তখন শয়তান (একটি বিবৃতি দিয়ে) বলবে : আল্লাহ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা-ই ছিলো সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোনো কর্তৃত্ব ছিলনা; আমি তো কেবল তোমাদের আহবান করেছি, আর তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করোনা; বরং তোমরা নিজেদেরকেই তিরস্কার করো। আমি (আল্লাহর শাস্তি থেকে) তোমাদের রক্ষা করতে পারবোনা, আর তোমরাও আমাকে রক্ষা করতে পারবেনা। ইতোপূর্বে তোমরা যে আমাকে আল্লাহর শরিক ও সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিলে আমি সেটা (সে মর্যাদা) অস্বীকার করছি। নিশ্চয়ই যালিমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা  ইবরাহিম :  ২২)

এবার আসি কোন ধরনের চক্রান্ত করে থাকে-

১। পথভ্রষ্ট করা(বিপথগামী)-

শয়তান বললো, সে বলল, আপনার ইযযতের কসম! আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথগামী করব’ (ছোয়াদ ৩৮-৮২)।

শয়তানের প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নে যা করে-

তুমি তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও : যার কাছে আমি আমার আয়াত পাঠিয়েছিলাম; কিন্তু সে তা বর্জন করে। অতএব শয়তান তার পেছনে লাগে এবং সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আমি চাইলে তা (আমার আয়াত) দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতে পারতাম; কিন্তু সে (তা বর্জন করে) দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। (সূরা আরাফ : ১৭৫-১৭৬)

তুমি কি তাদের দেখনি, যারা ধারণা করে যে, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে যা আপনার উপর নাযিল হয়েছে তার উপর এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল হয়েছে তার উপর। তারা ত্বাগূতের নিকট ফায়সালা পেশ করতে চায়। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে অস্বীকার করার জন্য। বস্ত্ততঃ শয়তান তাদেরকে দূরতম ভ্রষ্টতায় নিক্ষেপ করতে চায়’ (নিসা ৪/৬০)

‘জেনে রাখ আমার রব আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের শিক্ষা দেই যা তোমরা জান না, যা তিনি  আমাকে আজকের এই দিনে শিক্ষা দিয়েছেন। আমি আমার বান্দাকে যে সম্পদ দিয়েছি তা হালাল। নিশ্চয়ই আমি আমার সকল বান্দাদেরকে শিরকমুক্ত একনিষ্ঠ করে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদের নিকট শয়তান এসে তাদেরকে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করেছে। তাদের উপর যা হালাল করেছি তা তারা হারাম করেছে’।মুসলিম হা/২৮৬৫।

উদাহরনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, ইহুদী নাসারা

২।  الكيد ছলনা করা, কৌশল করা :

ইবলিস বললো : ‘হে প্রভু! আপনি যেহেতু আমাকে বিপথগামী করলেন, তাই পৃথিবীতে আমি মানুষের কাছে তাদের পাপ কর্মসমূহকে শোভনীয় ও চমৎকার করে তুলবো এবং আমি তাদের সবাইকে বিপথগামী করে ছাড়বো- কেবল তাদের মধ্যকার ঐলোকদের ছাড়া, যারা আপনার মনোনীত নিষ্ঠাবান সুপথ প্রাপ্ত।’ আল্লাহ বললেন : হ্যা, এটাই আমার কাছে পৌছার সরল সঠিক পথ -নিষ্ঠার সাথে সরল সঠিক পথে চলা আমার দাসদের উপর তোর কোনো প্রভাব-কর্তৃত্ব-আধিপত্য চলবেনা; তবে বিপথগামীদের যারা তোর অনুসরণ করবে, তাদের কথা ভিন্ন। জাহান্নামই তাদের সবার প্রতিশ্র“ত আবাস। (সূরা আল হিজর :  ৩৯-৪৩)

কিন্তু মহান আল্লাহ জানিয়েছেন-

إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيْفًا- ‘নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল একান্তই দুর্বল’ (নিসা ৪/৭৬)।

যেমনঃইউসুফ (আঃ) যখন স্বপ্নে তার ভবিষ্যতের সফলতার ইঙ্গিত পেলেন তখন তার পিতা তাকে বললেন, ‘পিতা বললেন, ‘বৎস! তোমার ভাইদের সামনে এ স্বপ্ন বর্ণনা কর না। তাহ’লে ওরা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’ (ইউসুফ ১২/৫)।

৩। الوعد (প্রতিশ্রুতি) :

শয়তান মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও দিক নির্দেশনা দিয়ে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে। আল্লাহ বলেন,

আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেছেন। আর সে বলেছিল যে, অবশ্যই আমি তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশকে আমার দলে টেনে নেব। আমি অবশ্যই তাদের পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেব, তাদেরকে আদেশ দেব যেন তারা পশুর কর্ণ ছেদন করে এবং তাদেরকে আদেশ করব যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করে। বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়। সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় ও মিথ্যা আশ্বাস দেয়। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা প্রতারণা বৈ কিছু নয়। ওদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। সেখান থেকে তারা অন্য কোন আশ্রয়স্থল পাবে না’ (নিসা ৪/১১৮-১২১)।

যেমনঃ    বদরের যুদ্ধের পূর্বে কাফেরদেরকে শয়তান খুব সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু যখন বিপদ ঘনীভূত হয়ে আসল তখন সে তার দলবল নিয়ে কাফের কুরাইশদেরকে মাঠে ফেলে পলায়ন করল।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, বদর যুদ্ধে শয়তান এসেছিল তার এক বাহিনী নিয়ে। ঝান্ডা উঁচিয়ে মুদলিজ গোত্রে মানুষের রুপ ধরে। সেদিন সে নিজে ছিল সারাক্কাহ বিন মালিক বিন আশামের ছদ্দবেশে। মক্কার কাফির বাহিনীর উদ্দেশ্যে সে বলেছিল, আজ মুসলমানদের কেউই তোমাদের উপর জয়ী হতে পারবে না। আজ আমি তোমাদের সাহায্যকারী।

সেই সময় হযরত জীবরাঈল (আ.) শয়তানের দিকে ফিরেন। শয়তান যখন তাঁকে দেখতে পায়, তখন তার হাত ছিল এক মুশরিকের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে শয়তান নিজের হাত টেনে নিয়ে পিছন ফিরে পালাতে লাগে। তার শয়তানী সেনাবাহিনীও পালাতে শুরু করে।

তখন সেই মুশরিক বলল, ওহে সারাক্কাহ! তুমি তো আমাদের সাহায্যকারী। অথচ এখন পালাচ্ছো কোথায়?

শয়তান পালাতে পালাতে বলে, আমি যা কিছু দেখছি, সেসব তোমার দেখতে সক্ষম হবে না। অবশ্যই আমি আল্লাহকে ভয় করি। আল্লাহ বড়ই কঠিন শাস্তি দানকারী।

{দুররুল মানসুর, ৩:১৬৯, দালালিয়ুন নবুওত, বায়হাকী, ৩:৭৮-৭৯}

৪। শত্রুতা ও বিদ্বেষ  (العداوة والبغضاء) :

শয়তান মানুষের মাঝে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টি করে। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ- ‘শয়তান তো কেবল চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত হ’তে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা নিবৃত্ত হবে কি?’ (মায়েদাহ ৫/৯১)।

তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর কলহ করো না। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। -আল আনফাল (৮) : ৪৬

মহান আল্লাহ বলেন,وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُبِينًا- ‘(হে নবী!) তুমি আমার বান্দাদের বল, তারা যেন (পরস্পরে) উত্তম কথা বলে। (কেননা) শয়তান সর্বদা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৫৩)।

এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‘যে আল্লাহ তা‘আলা ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা চুপ থাকে’। বুখারী হা/৬০১৮।

শয়তান যে সকল কূটকৌশল ব্যবহার করে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে পবিত্র কুরআনে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রথম : মুসলমানদের মনে পরোপকারিতা, অন্যের কল্যাণকামিতা ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা দুর্বল হয়ে পড়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের অন্যতম কারণ। ইসলামের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা হৃদয়ে না থাকলে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও ইসলামী ঐক্যের গুরুত্ব মনে না থাকাই স্বাভাবিক। তখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়াকে আর দোষের কিছু মনে হয় না।

দ্বিতীয় : মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে দুর্বল ও নিস্তেজ করে দেওয়ার দ্বিতীয় মৌলিক মাধ্যম হল, এক মুসলমান অপর মুসলমানের প্রতি কুধারণা পোষণ করা। পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে কুধারণা থেকে বেঁচে থাকতে বলা হয়েছে এবং অমূলক ধারণাকে গুনাহ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إِيّاكُمْ وَالظّنّ، فَإِنّ الظّنّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ.

তোমরা কুধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কুধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৪৩

তৃতীয় : কুধারণা থেকে গীবত ও অপবাদের মতো বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধি জন্ম নেয়। কারো প্রতি কুধারণা সৃষ্টি হলে মনের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দোষগুলো মনের আনন্দে বর্ণনা করার একটা পঙ্কিল ধারা তখন শুরু হয়ে যায়। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি আলোচনা করাকে গীবত বলা  হয়। কুরআনের দৃষ্টিতে গীবত মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার নামান্তর। গীবত এত সূক্ষ্ম গুনাহ যে, কোনো কোনো পরহেযগার ব্যক্তিও এ গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। তখন এটা গুনাহ হওয়ার বিষয় তাদের মনে জাগ্রত থাকে না । কারণ অন্যের দোষ বর্ণনা করার মধ্যে মন এক ধরনের মিথ্যা আনন্দ খুঁজে পায়। তাই মধু মনে করে এ বিষ পান করতে থাকে।

চতুর্থ : চতুর্থ বিষয় ভুল ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা। কারো প্রতি ঘৃণা জন্মালে অনেক সময় তা শুধু গীবতের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তখন অলীক সব কল্পকাহিনী বানিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সত্য-মিথ্যা কথা প্রচার করা হয়। কখনো তো মূল ব্যাপারটি একরকম থাকে তবে এর সাথে নিজ থেকে বিভিন্ন কথা জড়িয়ে রং লাগিয়ে বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ দেওয়া হয়। বাস্তবতা তখন পুরোপুরি বদলে যায়। অনেক কবীরা গুনাহের সমন্বয়ে এ পরিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। মিথ্যা, গীবত, অপবাদ, মুসলমানকে লাঞ্ছিত করা, মনে কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি কবীরা গুনাহ এর সাথে জড়িয়ে থাকে। তাই কারো ব্যাপারে কোনো কিছু শুনলে যাচাই-বাছাই ছাড়া তা বিশ্বাস করা এবং সত্য মনে করে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে আদেশ করা হয়েছে। সেইসাথে এমন অবাস্তব সংবাদদাতাদের ফাসিক আখ্যায়িত করে তাদেরকে অবিশ্বাসযোগ্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

একে অন্যের বিরুদ্ধে যখন এমন ভুল ও মিথ্যা সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে তখন পরস্পরের মাঝে শত্রুতার আগুন জ্বলে উঠে। ফলে মুসলমানদের যে সময় ও শক্তি কাফেরদের মোকাবেলায় ব্যয় হওয়া উচিত ছিল তা নিজেদের কোন্দল ও রেষারেষির মাঝেই ব্যয় হয়ে যায়। প্রত্যেকেই অন্যকে দোষী প্রমাণিত করে খাটো করে দেখানোর জন্য নিজের সমস্ত মেধা ও প্রতিভা খরচ করে। এভাবে মুসলমানদের সময় ও শক্তি, যোগ্যতা ও প্রতিভা এবং ধন-সম্পদ নিজেদের মাথা ফাটাফাটিতে শেষ হয়ে যায়। আর ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকে। কারণ, এ অবস্থায় মুসলমানেরা নিজ শত্রুদের প্রতি দৃষ্টি দিতে পারবে না। আফসোস! বর্তমানে পুরো মুসলিম সমাজ এ ভয়াবহ শাস্তির আগুনেই জ্বলছে।

৫। সুসজ্জিত করা  (التزيين) :

শয়তান মানুষের সামনে পাপ, অশালীন ও অশ্লীল কাজকর্মকে সুন্দর ও সুসজ্জিত করে উপস্থাপন করে। ফলে তাকে ভালকাজ মনে করে মানুষ আমল করে জাহান্নামী হয়ে যায়। শয়তানের এই ভাষাকে মহান আল্লাহ উল্লেখ করে বলেন,قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِيْنَ، إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ- ‘সে বলল, হে আমার পালনকর্তা। যেহেতু তুমি আমাকে বিপথগামী করলে, সেহেতু আমিও পৃথিবীতে তাদের নিকট পাপকর্মকে শোভনীয় করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। তবে তাদের মধ্য থেকে তোমার নির্বাচিত বান্দারা ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৩৯-৪০)।

‘যখন শয়তান (বদরের দিন) কাফেরদের নিকট তাদের কাজগুলিকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল এবং বলেছিল, আজ তোমাদের উপর বিজয়ী হবার মত কোন লোক নেই। আর আমি তোমাদের সাথী আছি। কিন্তু যখন দু’দল মুখোমুখী হ’ল, তখন সে পিঠ ফিরে পালালো এবং বলল, আমি তোমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখেছি তোমরা তা দেখনি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/৪৮)।

আয়াতের প্রেক্ষাপট হ’ল, বদর যুদ্ধের সময় শয়তান মুশরিকদেরকে বিজয়ের আশ্বাস দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের কার্যাবলীকে শোভনীয় করে দেখায়। কিন্তু যখন শয়তান ফেরেশতাদের দল তাদের বিপক্ষে দেখতে পায় তখন পলায়ন করে পিছু হটে যায়। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

تَاللهِ لَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى أُمَمٍ مِنْ قَبْلِكَ فَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَهُوَ وَلِيُّهُمُ الْيَوْمَ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ-

‘আল্লাহর কসম! আমরা তোমার পূর্বে বহু জাতির নিকটে রাসূল প্রেরণ করেছি। অতঃপর শয়তান তাদের মন্দ কর্মসমূহকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল। সে আজ তাদের অভিভাবক। আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (নাহল ১৬/৬৩)। এছাড়াও এব্যাপারে সূরা আন‘আমের ৪৩, নামলের ২৪ এবং আনকাবুতের ৩৮নং আয়াতেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে।

৬।কুমন্ত্রণা  (الوسواس):

শয়তান মানুষের মনের মাঝে কুমন্ত্রণা, প্ররোচনা, সংশয়-সংন্দেহ, অবিশ্বাস প্রবেশ করিয়ে পথভ্রষ্ট করার প্রচেষ্টা চালায়। মিথ্যা প্ররোচনার মাধ্যমে আদম ও হাওয়া (আঃ)-কে জান্নাত থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনা পবিত্র কুরআনে সবিস্তার বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِيْنَ- ‘অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা পরস্পর থেকে গোপন ছিল তা প্রকাশ করে দেবার জন্য শয়তান তাদের কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমাদের প্রতিপালক এই বৃক্ষ থেকে তোমাদের নিষেধ করেছেন কেবল এজন্যে যে, তাহ’লে তোমরা দু’জন ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা এখানে চিরস্থায়ী বসবাসকারী হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ ৭/২০)। অন্যত্র এসেছে,

 

فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَى شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَى، فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى-

‘অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনদায়িনী বৃক্ষের কথা এবং এমন রাজত্বের কথা যা ক্ষয় হয় না? অতঃপর তারা উভয়ে উক্ত (নিষিদ্ধ) বৃক্ষ হ’তে (ফল) ভক্ষণ করল। ফলে তাদের সামনে তাদের গুপ্তাঙ্গ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে শুরু করল। এভাবে আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করল এবং পথ হারাল’ (ত্ব-হা ২০/১২০-১২১)।

 

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَأْتِي الشَّيْطَانُ أَحَدَكُمْ فَيَقُوْلُ: مَنْ خَلَقَ كَذَا، مَنْ خَلَقَ كَذَا، حَتَّى يَقُولَ: مَنْ خَلَقَ رَبَّكَ؟ فَإِذَا بَلَغَهُ فَلْيَسْتَعِذْ بِاللهِ وَلْيَنْتَهِ- ‘তোমাদের কারো নিকট শয়তান আসতে পারে এবং বলতে পারে, এ বস্ত্ত কে সৃষ্টি করেছে? ঐ বস্ত্ত কে সৃষ্ট করেছে? এমনকি শেষ পর্যন্ত বলে বসবে, তোমার রবকে কে সৃষ্টি করেছে? যখন ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাবে তখন সে যেন অবশ্যই আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায় এবং সে যেন এমন চিন্তা থেকে বিরত হয়ে যায়’।বুখারী হা/৩২৭৬; মুসলিম হা/১৩৪।

৭। ধোঁকা দেওয়া  (الغرور):

শয়তান মানুষকে নানাভাবে ধোঁকা দেয়। সে মানুষকে ছলনা ও ধোঁকাপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُوْرًا- ‘শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ছলনা মাত্র’ (বাণী ইসরাঈল ১৭/৬৪)।

আদম ও হাওয়া (আঃ) স্বয়ং এমন ধোঁকা ও প্রতারণার শিকার হন। মহান আল্লাহ বলেন,فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ ‘এভাবে তাদের দু’জনকে ধোঁকার মাধ্যমে সে ধীরে ধীরে ধ্বংসে নামিয়ে দিল। অতঃপর যখন তারা উক্ত বৃক্ষের স্বাদ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ল। ফলে তারা জান্নাতের পাতাসমূহ দিয়ে তা ঢাকতে লাগল’ (আ‘রাফ ৭/২২)। অন্যত্র তিনি বলেন,

يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُوْرًا- ‘সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় ও মিথ্যা আশ্বাস দেয়। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা প্রতারণা বৈ কিছু নয়’ (নিসা ৪/১২০)।

 

ধোঁকা দিয়ে শয়তান মানুষের মাঝে ফিতনা সৃষ্টি করে। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে দেয়। জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

‘ইবলীস পানির উপর তার সিংহাসন স্থাপন করতঃ তার বাহিনী প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্য প্রাপ্ত সেই, যে সর্বাধিক ফেতনা সৃষ্টিকারী। তাদের একজন এসে বলে, আমি অমুক অমুক কাজ করেছি। সে বলে তুমি কিছুই করনি। অতঃপর অন্যজন এসে বলে, অমুকের সাথে আমি সকল প্রকার ধোঁকার আচরণই করেছি। অবশেষে তার ও তার স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। অতঃপর শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয় এবং বলে হ্যাঁ, তুমি একটি বড় কাজ করেছ। বর্ণনাকারী আ‘মাশ (রাঃ) বলেন, আমার মনে হয়, রাসূল (সা) বলেছেন, অতঃপর শয়তান তাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়’।মুসলিম  হা/২৮১৩।

কবরবাসীরা কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে না। তাই কবরবাসীদের নিকট কোন কিছু কামনা করা জায়েয নয় বরং শিরক। যদিও কোন কোন কবর থেকে অলৌকিক কিছু প্রকাশ পেয়ে থাকে। যেমন- কবর থেকে আলো বের হওয়া, সুঘ্রান বের হওয়া ইত্যাদি। ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ঈমান  অধ্যায়, পর্ব–৭৯

আমরা অনেক সময় শুনে থাকি কারো কবরের উপর ঐ মৃত ব্যক্তিকেই দাঁড়ানো অবস্থায় বা বসা অবস্থায় অথবা অন্য কোন অচেনা মৃত ব্যক্তিকে দেখেছে। আবার ভাঙ্গা কবরে সাপ পেঁচানো লাশ দেখেছে। এগুলো সবই শয়তানের ধোঁকা মাত্র। মনে রাখতে হবে কবরের কোন শাস্তি নবী ব্যতীত দুনিয়ার মানুষ ও জ্বীনকে দেখানো হবে না। বুখারী হা/১২৭৩।

অতএব কেউ যদি অনুরূপ দেখে তবে বুঝতে হবে এটা শয়তানের কাজ ছাড়া কিছুই নয়।

৮। পরীক্ষা করা, বিপদে ফেলা, গোলযোগ সৃষ্টি করা (الفةنة): যুগে যুগে শয়তান মানুষের মাঝে গোলযোগ সৃষ্টি করে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করেছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘আমরা তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল প্রেরণ করিনি যে, তারা যখনই কিছু পাঠ করেছে, তখনই শয়তান উক্ত পাঠে কিছু মিশিয়ে দিয়েছে। তখন আল্লাহ দূর করে দেন শয়তান যা মিশিয়ে দেয়। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় আয়াত সমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। এটা এ কারণে যে, শয়তান যা মিশ্রণ করে, তিনি তা পরীক্ষা স্বরূপ করে দেন তাদের জন্য, যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা পাষাণ হৃদয়। বস্ত্ততঃ অত্যাচারীরা দূরতম যিদের মধ্যে রয়েছে’ (হজ্জ ২২/৫২-৫৩)।

ফিৎনা মূলতঃ শয়তান দ্বারা প্রসার লাভ করে। যারা বুঝতে পারে তারা ফিৎনা থেকে বাঁচতে পারে। অন্যথায় এমন ফিৎনায় পতিত হ’তে হবে। এমন সকল ফিৎনা থেকে বাঁচার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ

‘কোন পুরুষ যখন কোন স্ত্রী লোকের সঙ্গে নির্জনে সাক্ষাৎ করে তখন এদের সঙ্গে অবশ্যই তৃতীয়জন থাকে শয়তান’। তিরমিযী হা/১১৭১।

একজন মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে এমন ফিৎনা ফাসাদে জড়িয়ে পড়ে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ ‘বস্ত্ততঃ ফিৎনা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও বড় পাপ’ (বাক্বারাহ ২/১৯১)।

একশ্রেণীর লোক কুরআন দ্বারা ফিৎনা সৃষ্টির লক্ষ্যে আয়াতের অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَأَمَّا الَّذِيْنَ فِي قُلُوْبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُوْنَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ- ‘অতঃপর যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, তারা অস্পষ্ট আয়াতগুলির পিছে পড়ে ফিৎনা সৃষ্টির জন্য এবং তাদের মনমত ব্যাখ্যা দেবার জন্য’ (আলে ইমরান ৩/৭)।

যেমন সমাজে দেখতে পাই, মাধ্যম বা অসীলা শব্দের অপব্যখ্যা করে পীর, মাজার,কবর পূজা ইত্যাদির ব্যবসা চলছে।

৯। কু-কর্ম, অশ্লীলতা ও নিন্দনীয় কর্মের আদেশ দেয় (الفحشاء والمنكر) : মহান আল্লাহ বলেন,

‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। যে ব্যক্তি শয়তানের অনুসরণ করে, সে তো তাকে নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়। যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত তাহ’লে তোমাদের কেউ কখনো পবিত্র হ’তে পারতে না। তবে আল্লাহ যাকে চান তাকে পবিত্র করেন এবং আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (নূর ২৪/২১)।

তিনি আরো বলেন,إِنَّمَا يَأْمُرُكُمْ بِالسُّوْءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَنْ تَقُوْلُوْا عَلَى اللهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ- ‘সে তো তোমাদের কেবল মন্দ ও অশ্লীল কাজের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা যা জানো না এমনসব বিষয় তোমাদের বলার নির্দেশ দেয়’ (বাক্বারাহ ২/১৬৯)।

শয়তানের নির্দেশে কখনো অশ্লীল কাজে জড়িত হওয়া যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

‘তুমি বল, নিশ্চয়ই আমার প্রভু প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার অশ্লীলতা হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় বাড়াবাড়ি। আর তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না যে বিষয়ে তিনি কোন প্রমাণ নাযিল করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কথা বল না যে বিষয়ে তোমরা কিছু জান না’ (আ‘রাফ ৭/৩৩)।

একবার হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে ফযল ইবনে আববাস (রাসূলের চাচাত ভাই) উটে আরোহী অবস্থায় ছিলেন। এক যুবতী মহিলা বৃদ্ধ পিতার বদলী হজ্জের ফৎওয়া তলব করতে আসলে তিনি ফযলের ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য দিকে করে দিলেন। আববাস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার চাচাত ভাইয়ের ঘাড় ঘুরিয়ে দিলেন কেন? তিনি বললেন, আমি দেখলাম, এরা দু’জন হ’ল যুবক-যুবতী। আমি তাদেরকে শয়তান থেকে নিরাপদ মনে করিনি।তিরমিযী হা/৮৮৫।

১০। পরাভূত করা, বশীভূত করা (الاستحواذ) : যারা সত্যিকার মিথ্যাবাদী শয়তান তাদেরকে পরাভূত করে নিজেদের দলভুক্ত করে নিয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘যে দিন আল্লাহ তাদের সবাইকে পুনরুত্থিত করবেন তখন তারা আল্লাহর সামনে শপথ করবে। যেমন তারা তোমাদের সামনে শপথ করে এবং তারা ধারণা করে যে, তারা যথেষ্ট হেদায়াতের উপর রয়েছে। সাবধান! ওরাই হ’ল মিথ্যাবাদী। শয়তান তাদের উপর বিজয়ী হয়েছে …’ (মুজাদালা ৫৮/১৮-১৯)।

আবুদ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা-কে বলতে শুনেছি,

‘যখন কোন গ্রামে বা বন-জঙ্গলে তিন জন লোক একত্রিত হয় এবং জামা‘আতে ছালাত আদায় না করে তখন শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। অতএব তোমরা জমা‘আতে ছালাত আদায় কর। কেননা দলচ্যুত বকরীকে নেকড়ে বাঘে ভক্ষণ করে থাকে’। নাসাঈ হা/৮৪৭; মিশকাত হা/১০৬৭; ইবনে কাছীর ৪/৪২১।

হুযায়ফাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে আহার করতে বসলে তিনি খাবারে হাত না রাখা পর্যন্ত আমরা হাত দিতাম না। একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে খাবার খেতে উপস্থিত হ’লাম।

‘হঠাৎ একটি বালিকা এমনভাবে এল, যেন তাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেওয়া হচ্ছিল। সে নিজ হাতে খাবার গ্রহণ করতে উদ্যত হয়েছিল, এমন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা) তার হাত ধরে নিলেন। তারপর এক বেদুঈনও অনুরূপভাবে এসে খাবারে হাত দিতে উদ্যত হ’লে রাসূলুল্লাহ (সা) তার হাত ধরে নিলেন এবং বললেন, যে খাবারে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি শয়তান সে খাদ্যকে হালাল মনে করে। এই মেয়েটিকে এবং বেদুঈনটিকে শয়তানই নিয়ে এসেছে যেন তার দ্বারা নিজের জন্য খাদ্য হালাল করে নিতে পারে। কিন্তু আমি ওদের হাত ধরে ফেললাম। সেই মহান সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে, শয়তানের হাত ঐ দু’জনের হাতের সঙ্গে আমার হাতে ধরা পড়েছিল। অতঃপর তিনি বিসমিল্লাহ বলে আহার করলেন’। বুখারী হা/৩২৮০; মুসলিম হা/২০১৭; আবূদাঊদ হা/৩৭৬৬।

উল্লেখিত হাদীছ থেকে বুঝা যায়, শয়তান তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে পরাভূত করে ফেলেছিল কিন্তু রাসূল (সা)-এর সামনে টিকতে পারেনি।

ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিইয়া (রঃ) বলেন, সাবধান! জেনে রেখ! ইবলীসের প্রথম প্ররোচনা হ’ল মানুষকে ইলম অর্জনে বাধা প্রদান করা। কারণ ইলম হ’ল হেদায়াতের আলো। যদি এই আলো নিভিয়ে দিতে পারে তাহ’লে মানুষকে জাহিলিয়াতের অন্ধকারে যেমন খুশি তেমন ডুবিয়ে দিতে পারে। এমনকি তাদের ভক্তদের বিবাহের মত সুন্নাত পরিত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সংসার বিরাগী করে ছূফী মতবাদের দিকে ঠেলে দেয়। গ্রহণ করে বৈরাগ্য সাধন, ইবাদত করে পাহাড়ে বসে, ত্যাগ করে জুম‘আ ও জামা‘আত। ইগাছাতুল লাহফান ফি মাছায়িদিশ শায়ত্বান ১/১৬।

১১। প্ররোচনা দেওয়া, বার্তা পাঠানো (الايحاء) :

শয়তান ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তার ভক্ত বন্ধুদের লেলিয়ে দেয়

শয়তান তার সমর্থকদের মাঝে প্ররোচনা দেয়, অবহিত করে। ফলে ঝগড়া-বিবাদ ও ফিৎনা-ফাসাদ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর শয়তানরা তাদের বন্ধুদের প্ররোচনা দেয় যেন তারা তোমাদের সাথে বিতন্ডা করে। তবে যদি তোমরা তাদের (শিরকী যুক্তির) আনুগত্য কর, তাহ’লে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/১২১)।

তিনি আরো বলেন, ‘এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি। তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথা দ্বারা প্ররোচনা দেয়’ (আন‘আম ৬/১১২)।

যেসব লোক ইসলামের প্রচলন, অনুসরণ ও বাস্তবায়নকে পছন্দ করেনা, শয়তান তাদের বন্ধু হয়ে যায়। সে তাদেরকে ইসলামের অনুসারীদের শত্র“তা ও বিরুদ্ধাচরণে উস্কে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন :

وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

অর্থ: নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে (**) অহি করে (উস্কে দেয়)। তোমরা যদি তাদের আনুগত্য করো, তবে অবশ্যি তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১২১)

প্রত্যেক নবী ও তাঁর খাঁটি অনুসারীদের বিরুদ্ধেই   জ্বীন শয়তান ও মানুষ শয়তান দুশমনিতে লিপ্ত হয়েছে। তারা পরস্পরকে নবী ও নবীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুশমনি করতে উস্কে দেয়, লেলিয়ে দেয় :

অর্থ:এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর বিরুদ্ধে মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানদের শত্রুতা করার অবকাশ দিয়েছি। তারা পরস্পরকে মনোহরী কথা বলে প্রতারণার উদ্দেশ্যে লেলিয়ে দেয়। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১১২)

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নূহ (আঃ)-এর কওমের ভাল লোকগুলো মৃত্যুবরণ করল তখন শয়তান তাদের নিকট বার্তা পাঠাল যে, ‘তারা যেখানে বসে মজলিস করত, সেখানে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন কর এবং ঐ সমস্ত পুন্যবান লোকের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কাজেই তারা তাই করল, কিন্তু তখনও ঐসব মূর্তির পূজা করা হ’ত না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হ’লে লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দেয়’।বুখারী হা/৪৯২০।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা) বলেছেন, আল্লাহ আসমানে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা জারী করলে ফেরেশতারা বিনয়াবনত হয়ে পাখা ঝাপটাতে থাকে। … ফেরেশতাদের পারস্পরিক আলোচনা শয়তান ওঁৎ পেতে শোনে এবং ভূপৃষ্ঠে অবস্থানকারী তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে তা পৌঁছে দেয়। কখনো তা নিম্নে অবস্থানকারীদের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে তাদের প্রতি উল্কাপিন্ড নিক্ষেপ করা হয়। শ্রুত কথা তারা পৃথিবীতে এসে গণক অথবা যাদুকরের সামনে পেশ করে। আবার কখনো তারা কিছুই শুনতে পায় না বরং নিজেদের পক্ষ থেকে তা গণক ও যাদুকরের মুখে তাদের কথার সাথে সত্য মিথ্যা যোগ করে পেশ করে। তাই কেবল সত্য সেটিই হয় যা তারা আসমান থেকে শোনে’। বুখারী হা/৪৭০১; ইবনে মাজাহ হা/১৯৪; তিরমিযী হা/৩২২৩।

১২. অপচয় করা (التبذير) :

মহান আল্লাহ অপচয় করতে নিষেধ করে বলেন,وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا، إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا- ‘আর তুমি মোটেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭)।

অপচয়রোধে হাদীছে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে, ‘মুগীরা বিন শু‘বাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন, মায়েদের অবাধ্যাচরণ করা, অধিকার প্রদানে বিরত থাকা ও অনধিকার কিছু প্রার্থনা করা এবং জীবন্ত কন্যা প্রোথিত করা। আর তোমাদের জন্য অপসন্দ করেছেন, ভিত্তিহীন বাজে কথা বলা, অধিক প্রশ্ন করা, ধন-সম্পদ অপচয় করা’।বুখারী হা/৫৯৭৫; মুসলিম হা/৫৯৩।

দয়াময় আল্লাহর বান্দাদের গুণাবলী উল্লেখ করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا- ‘তারা যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না বা কৃপণতা করে না। বরং তারা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৭)।

তাহ’লে বুঝা গেল অপচয়কারী শয়তানের ভাই, আর অপচয় না করা হচ্ছে দয়াময় (রহমান) আল্লাহর খাঁটি বান্দা হিসাবে নিজেকে পরিগণিত করা।

১৩. যাদু করা :

যাদু করা শয়তানের কাজ। এটা কবীরা গোনাহ। মহান আল্লাহ বলেন,

‘আর তারা ঐসবের অনুসরণ করল, যা আবৃত্তি করত শয়তানেরা সুলায়মানের রাজত্বকালে। আর সুলায়মান কুফরী করেনি বরং শয়তানেরাই কুফরী করেছিল। যারা মানুষকে জাদু শিক্ষা দিত’ (বাক্বারাহ ২/১০২)।

এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা) যাদুকে ধ্বংসাত্মক সাত বস্ত্তর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেন,

তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্ত্ত থেকে সাবধান থাক। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সেগুলো কী হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, ১. আল্লাহর সাথে শিরক করা ২. যাদু করা।’ ৩. কোন ব্যক্তিকে হত্য করা, যার হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন, তবে হকভাবে হত্যা করা যাবে। ৪. সূদ খাওয়া। ৫. ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা। ৬. যুদ্ধের দিন ময়দান হতে পালিয়ে যাওয়া। ৭. সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোকদের উপর যেনার মিথ্যা অপবাদ দেওয়া যে সম্পর্কে তারা অনবহিত থাকে’। বুখারী হা/২৭৬৬; মুসলিম হা/৮৯; আবূ দাঊদ হা/২৮৭৪।

শয়তান আসমান থেকে আল্লাহ ও ফেরেশতাদের আলাপ গোপনে শ্রবণ করে এসে যাদুকরদের কাছে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে প্রকাশ করে। বুখারী হা/৪৭০১।

এরপর গণক, যাদুকররা তা মানুষের সামনে প্রকাশ করে। সুতরাং যাদু করা শয়তানের কাজ, যা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য।

১৪। لو  (লাও) শব্দের ব্যবহার :

লাও (لو) অর্থ ‘যদি’। ‘যদি’ বলে কোন কথায় সন্দেহ সৃষ্টি অথবা কোন কর্মে ভুল সংশোধন করার জন্য এমন বাক্য ব্যবহার করে যার মধ্যে শির্কী নমুনা পাওয়া যায়। এটা শয়তানের কাজ।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘

তোমার কোন ক্ষতি হ’লে এভাবে বল না, যদি আমি এরূপ এরূপ করতাম, বরং বল আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা চান তাই করেন। কারণ ‘লাও’ (لو) বা ‘যদি’ শব্দটি শয়তানের কর্মকান্ডের দ্বার খুলে দেয়’।মুসলিম হা/২৬৬৪; ইবনে মাজাহ হা/৭৯।

১৫. শয়তানের খোঁচা :

বিভিন্ন সময় শয়তান মানুষকে খোঁচা মারে। যেমন- যয়নব বিনতে জাহাশের বোন হামনা বিনতে জাহাশ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি চরম ইস্তিহাযায় (মাসিক সংক্রান্ত রোগ) আক্রান্ত ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকটে এসে এ বিষয়ে ফৎওয়া জানতে চাইলে তিনি (এক পর্যায়ে) বললেন, إِنَّمَا هِيَ رَكْضَةٌ مِنَ الشَّيْطَانِ ‘নিশ্চয়ই এটা হ’ল শয়তানের খোঁচা’।তিরমিযী হা/১২৮।

আল্লাহ বলেন,الَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ الرِّبَا لَا يَقُوْمُوْنَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ‘যারা সূদ ভক্ষণ করে, তারা (ক্বিয়ামতের দিন) দাঁড়াতে পারবে না জিনে ধরা রোগীর ন্যায় ব্যতীত। এর কারণ এই যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সূদের মতই’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রতি ফেরেশতাদের ১টি স্পর্শ রয়েছে এবং শয়তানের ১টি স্পর্শ রয়েছে। ফেরেশতার স্পর্শ হ’ল কল্যাণ কাজে উৎসাহিত করা এবং সত্যকে স্বীকার করা।

শয়তানের স্পর্শ হ’ল মন্দ কাজের প্ররোচনা দেওয়া ও সত্যকে অস্বীকার করা। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) কুরআনের আয়াত পাঠ করলেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্রে্র ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন’। বাক্বারাহ ২/২৬৮; তিরমিযী হা/২৯৮৮।

অন্যত্র তিনি বলেন,مَا مِنْ بَنِي آدَمَ مَوْلُودٌ إِلَّا يَمَسُّهُ الشَّيْطَانُ حِيْنَ يُولَدُ، فَيَسْتَهِلُّ صَارِخًا مِنْ مَسِّ الشَّيْطَانِ، غَيْرَ مَرْيَمَ وَابْنِهَا- ‘এমন কোন আদম সন্তান নেই, যাকে জন্মের সময় শয়তান স্পর্শ করে না। আর শয়তানের স্পর্শের কারণেই সে চিৎকার করে উঠে। তবে মারইয়াম (আঃ) এবং তার ছেলে ঈসা (আঃ) ব্যতীত’। বুখারী হা/৩৪৩১; বঙ্গানুবাদ বুখারী (ইফাবা) হা/৩০৫৬।

তিনি আর বলেন,إِنَّ اللهَ مَعَ القَاضِي مَا لَمْ يَجُرْ، فَإِذَا جَارَ تَخَلَّى عَنْهُ وَلَزِمَهُ الشَّيْطَانُ، ‘বিচারক যতক্ষণ যুলুমে লিপ্ত না হবে ততক্ষণ আল্লাহ তা‘আলা তার সঙ্গে থাকেন। যখন সে যুলুমে লিপ্ত হয় তখন তিনি তাকে ছেড়ে চলে যান আর শয়তান তাকে আঁকড়ে ধরে’।তিরমিযী হা/১৩৩০।

১৬।শয়তানের পেশাব :

ছালাত আদায় না করে সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকলে শয়তান ঐ ব্যক্তির কানে পেশাব করে দেয়। আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এমন এক লোকের ব্যাপারে উল্লেখ করা হ’ল, যে সারারাত এমনকি ভোর পর্যন্ত ঘুমিয়েছিল। তখন তিনি বললেন, সে এমন লোক যার উভয় কানে অথবা তিনি বলেছেন, তার কানে শয়তান পেশাব করেছে’।বুখারী হা/৩২৭০।

১৭. শয়তানের গিঁট :

ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘাড়ে শয়তান মন্ত্র পড়ে গিঁট দেয়, যাতে সে ছালাতের জন্য না উঠতে পারে। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এই মন্ত্র পড়ে যে, ‘তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি ঘুমাও’। অতঃপর যদি সে জেগে উঠে আল্লাহর যিকির করে, তাহ’লে একটি গিঁট খুলে যায়। তারপর যদি ওযূ করে তবে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। তারপর যদি ছালাত আদায় করে, তাহ’লে সমস্ত গিঁট খুলে যায়। আর তার প্রভাত হয় আনন্দ ফুর্তি ও ভালো মনে। নচেৎ সে সকালে উঠে কলুষিত মনে ও অলসতা নিয়ে’। বুখারী হা/১১৪২; মুসলিম হা/৭৭৬।

১৮। দুঃস্বপ্ন :

শয়তানের পক্ষ থেকে দুঃস্বপ্ন দেখানো হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,الرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ مِنَ اللهِ، وَالحُلْمُ مِنَ الشَّيْطَانِ، فَإِذَا حَلَمَ فَلْيَتَعَوَّذْ مِنْهُ، وَلْيَبْصُقْ عَنْ شِمَالِهِ، فَإِنَّهَا لاَ تَضُرُّهُ ‘ভাল স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে (অন্য বর্ণনায় সুন্দর স্বপ্ন হ’ল আল্লাহর পক্ষ থেকে) এবং দুঃস্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে দেখানো হয়। সুতরাং যে অপ্রীতিকর কিছু দেখবে, সে যেন তার বাম দিকে তিনবার হাল্কাভাবে থুক মারে ও শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। তাহ’লে তা তাকে কোন ক্ষতি করতে পারবে না’। বুখারী হা/৬৯৮৬; মুসলিম হা/২২৬১; তিরমিযী হা/২২৭৭।

১৯. মৃত পিতা-মাতার রূপে শয়তান :

আবু উমামা আল-বাহিলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি ভাষণের এক পর্যায়ে বললেন

‘দাজ্জালের আরেকটি অনাসৃষ্টি এই যে, সে এক বেদুঈনকে বলবে, আমি যদি তোমার পিতা-মাতাকে জীবিত করে দিতে পারি তবে তুমি কি এই সাক্ষ্য দিবে যে, আমি তোমার রব? সে বলবে, হ্যাঁ। তখন দু’টি শয়তান দ্বারা তার পিতা-মাতার আকৃতি ধারণ করে হাযির হয়ে বলবে, হে প্রিয় বৎস! তার অনুগত্য কর। সেই তোমার প্রভু’।ইবনে মাজাহ হা/৪০৭৭।

দাজ্জালের এই ফিৎনা থেকে বাঁচার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আবু দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,  রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,مَنْ حَفِظَ عَشْرَ آيَاتٍ مِنْ أَوَّلِ سُورَةِ الْكَهْفِ عُصِمَ مِنَ الدَّجَّالِ، ‘যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে তাকে দাজ্জালের ফিতনা হ’তে মুক্ত রাখা হবে’। মুসলিম হা/৮০৯; আবু দাঊদ হা/৪৩২৩।

২০। আল্লাহর যিকির ভুলে যাওয়া  (النسيان لذكر الله):

শয়তানের কাজ হ’ল আল্লাহর স্মরণ বা যিকির ভুলিয়ে দিয়ে বিপথগামী করা। যেমন- মহান আল্লাহ বলেন,

‘অতঃপর যে ব্যক্তি সম্পর্কে (স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী) ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে, তাকে ইউসুফ বলে দিল যে, তুমি তোমার মনিবের কাছে (অর্থাৎ বাদশাহর কাছে) আমার বিষয়ে আলোচনা করবে (যাতে তিনি আমাকে মুক্তি দেন)। কিন্তু শয়তান তাকে তার মনিবের কাছে বলার বিষয়টি ভুলিয়ে দেয়। ফলে তাকে কয়েক বছর কারাগারে থাকতে হয়’ (ইউসুফ ১২/৪২)।

মূসা (আঃ) এক যুবককে নিয়ে খিজির (আঃ)-এর সাক্ষাতে বের হ’লেন। একটি মাছ ছিল তাদের গন্তব্যের চিহ্ন। মাছটি যেখানে জীবিত হয়ে সমুদ্রে চলে যাবে সেখানে সে সাক্ষাৎ পাবে বলে নির্দেশনা দেয়া ছিল। কিন্তু যুবক তা বলতে ভুলে যায়। মাছের বিষয়ে মূসা (আঃ) যুবককে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিলقَالَ أَرَأَيْتَ إِذْ أَوَيْنَا إِلَى الصَّخْرَةِ فَإِنِّيْ نَسِيْتُ الْحُوْتَ وَمَا أَنْسَانِيْهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ وَاتَّخَذَ سَبِيْلَهُ فِي الْبَحْرِ عَجَبًا- ‘যুবক বলল, আপনি কি খেয়াল করে দেখেছেন যখন আমরা একটি প্রস্তর খন্ডে বিশ্রাম নিয়েছিলাম, সেখানে আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। শয়তানই আমাকে ওর কথা স্মরণ রাখতে ভুলিয়ে দিয়েছিল। সে বিস্ময়করভাবে নিজের পথ করে সমুদ্রে নেমে গেল (কাহাফ ১৮/৬৩; বুখারী হা/৭৪)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, হে লোক সকল! আমাকে কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল এবং আমি তোমাদের তা জানানোর জন্য বের হয়ে আসলাম। কিন্তু দুই ব্যক্তি ঝগড়া করতে করতে আমার নিকটে উপস্থিত হ’ল এবং তাদের সাথে ছিল শয়তান। তাই আমি তা ভুলে গেছি’।[9]

২২। আল কুরআন : শয়তানের সবচেয়ে বড় জ্বালার কারণ

    মহান আল্লাহ নাযিল করেছেন প্রথম আয়াতই হলো ইক্বরা!  কুর’আন পাঠের মাধ্যমে যেমন জীবনের সঠিক পথ জানা সম্ভব তেমনি শয়তানের বিভিন্ন চক্রান্ত বুঝা ও শয়তানকে চেনা সহজ। তাই শয়তান কুর’আন বুঝতে বাধা দেয় সর্বাত্মক শক্তি বুদ্ধি দিয়ে।

আল কুরআন নাযিল হবার পর কিয়ামত পর্যন্ত একমাত্র কুরআন মজিদই মানবজাতির হিদায়াত ও মুক্তির সন্ধান লাভের মূল উৎস। তাই আল কুরআন থেকে এবং কুরআন অনুধাবন, অনুসরণ ও বাস্তবায়ন থেকে মানব সমাজকে দূরে রাখার জন্যেই নিয়োজিত থাকে শয়তান, তার দলবল ও চেলা চামুন্ডাদের সর্বাধিক চেষ্টা। তাদের ধোকা, প্ররোচনা, প্রলোভন, বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও প্রতারণার জাল বিস্তার প্রধানত মানুষকে কুরআন থেকে দূরে রাখার জন্যেই নিয়োজিত থাকে। সে জন্যেই মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন :

فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

অর্থ: যখনই তুমি আল কুরআন অধ্যয়নের সংকল্প করবে, তখন ধিকৃত অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে নিও। (সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ৯৮)

এ আয়াতের তফসির প্রসঙ্গে বিখ্যাত তফসির তাফহীমুল কুরআনে বলা হয়েছে :

“এর মর্ম কেবল এতটুকুই নয় যে, মুখে শুধুমাত্র اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ উচ্চারণ করলেই হয়ে যাবে। বরং সেই সাথে কুরআন পড়ার সময় যথার্থই শয়তানের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকার বাসনাও পোষণ করতে হবে এবং কার্যত তার প্ররোচনা থেকে নিষ্কৃতি লাভের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভুল ও অনর্থক সন্দেহ-সংশয়ে লিপ্ত হওয়া যাবেনা। কুরআনের প্রত্যেকটি কথাকে তার সঠিক মর্মের আলোকে দেখতে হবে। নিজের মনগড়া মতামত বা বাইরে থেকে আমদানি করা চিন্তার মিশ্রণে কুরআনের শব্দাবলীর এমন অর্থ করা যাবেনা, যা আল্লাহর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থি। সাথে সাথে মানুষের মনে এ চেতনা এবং উপলব্ধিও জাগ্রত থাকতে হবে যে, মানুষ যাতে কুরআন থেকে কোনো পথ নির্দেশনা লাভ করতে না পারে সে জন্যেই শয়তান সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকে। এ কারণে মানুষ যখনই এ কিতাবটির প্রতি মনোনিবেশ করে, তখনি শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করার এবং পথ নির্দেশনা লাভ থেকে বাধা দেবার এবং তাকে ভুল চিন্তার পথে পরিচালিত করার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। তাই এ কিতাবটি অধ্যয়ন করার সময় মানুষকে অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে, যাতে শয়তানের প্ররোচনা ও সূক্ষ্ম অনুপ্রবেশের কারণে সে এ হেদায়েতের উৎসটির কল্যাণকারিতা থেকে বঞ্চিত না হয়ে যায়। কারণ, যে ব্যক্তি এ কিতাব থেকে সঠিক পথের সন্ধান লাভ করতে পারেনি, সে অন্য কোথাও থেকে সৎপথের সন্ধান পাবেনা। আর যে ব্যক্তি এ কিতাব থেকে ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে দুনিয়ার অন্য কোনো জিনিস তাকে বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। এ আয়াতটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে নাযিল করা হয়েছে। সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে এই যে, সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে এমন সব আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে যেগুলো মক্কার মুশরিকরা কুরআন মজিদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করতো। তাই প্রথমে ভূমিকা স্বরূপ বলা হয়েছে, কুরআনকে তার যথার্থ আলোকে একমাত্র সে ব্যক্তিই দেখতে পারে, যে শয়তানের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনা থেকে সজাগ-সতর্ক থাকে এবং তা থেকে নিজেকে সংরক্ষিত রাখার জন্যে আল্লাহর কাছে পানাহ্ চায়। অন্যথায় শয়তান কখনো সোজাসুজি কুরআন ও তার বক্তব্যসমূহ অনুধাবন করার সুযোগ মানুষকে দেয়না।”

২৩।   সালাতে শয়তানের অংশ :

  • আসওয়াদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন,

তোমাদের কেউ যেন স্বীয় ছালাতের কোন কিছু শয়তানের জন্য না করে। তা হ’ল, শুধুমাত্র ডান দিকে ফিরা আবশ্যক মনে করা। আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে অধিকাংশ সময়ই বাম দিকে ফিরতে দেখেছি’। বুখারী হা/৮৫২; মুসলিম হা/৭০৭।

  • ছালাতে মুছল্লীর মনোযোগ বিঘ্ন করার জন্য শয়তান ছোঁ মারে। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ছালাতে এদিক সেদিক তাকানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন,هُوَ اخْتِلاَسٌ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلاَةِ العَبْد ‘এ হ’ল এক ধরনের ছোঁ মারা। এতে শয়তান কারো ছালাত থেকে ছোঁ মেরে কিছু অংশ নিয়ে যায়’। বুখারী হা/৭৫১; তিরমিযী হা/৫৯০।

আবু হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত রাসূল বলেছেন,

যখন নামাজের জন্যে আহ্বান করা হয়, শয়তান পিঠ-পিছে দৌড়ে যতক্ষণ না সে আজান শুনতে পায়। যখন আজান শেষ হয় সে সামনে অগ্রসর হয়। যখন নামাজের কাতার সোজা করা হয় সে পিঠ ফিরে চলে যায়। অত:পর যখন একামাত শেষ হয় সে মানুষকে ও তার প্রবৃত্তিকে ধোঁকা দেয়, সে বলে, তুমি অমুক জিনিস, স্মরণ কর, ওটা মনে কর, যা সে ইতি পূর্বে মনে করতে পার ছিল না। এভাবে মানুষ কত রাকাত নামাজ পড়েছিল তা বলতে পারে না।বোখারী : ৬০৮। মুসলিম : ৩৮৯।

একবার উসমান ইবনে আছ, নবী সা.এর কাছে আসলেন, অত:পর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা. শয়তান আমার তেলাওয়াত, নামাজ এবং আমার মাঝে বসে রয়েছে, সে আমার কাছে এগুলোকে সন্দিহান করে তোলে। রাসূল সা. বললেন,

ঐটা শয়তান। তাকে খাতরাব বলা হয়। যখন তুমি তাকে উপলব্ধি কর আল্লাহর নামে তার কাছ থেকে আশ্রয় চাইবে। এবং বাম দিকে তিন বার থুক ফেলবে। তিনি বলেন, আমি এমনটি করেছি, তারপর আল্লাহ তাআলা তাকে আমার থেকে দূর করে দিয়েছেন।[৪]

শয়তান মুমিনের ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ইবাদত নষ্ট করে দেয়, যাতে সে পুণ্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়।

উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর কাছে আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! শয়তান আমার মধ্যে ও আমার নামাজ ও কিরাতের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাতে জটিলতা সৃষ্টি করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি যখন তার উপস্থিতি অনুভব করবে, তখন তার কুমন্ত্রণা হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তোমার বাম দিকে তিনবার থু থু ফেলবে।’ (সহিহ মুসলিম)

যে গ্রামে বা পল্লিতে তিনজন একত্রে আছে, অথচ তাদের মধ্যে জামাত কায়েম হয় না, শয়তান তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। হে প্রিয় বন্ধু! তুমি কিন্তু জামাতের প্রতি গুরুত্ব দেবে। কারণ, ছাড়া বকরি বাঘে খায়।আবু দাউদ : ৩৪৭। নাসায়ী : ৮৪৭। সহিহ সুনানে আবু দাউদ : ৫১১।