শা’বান মাস ও মধ্য শা’বানের মর্যাদা

শা’বান মাসের মর্যাদা ও করনীয়ঃ

আয়েশা(রাঃ) বলেছেন, নবী(সঃ) শা’বান মাসের ন্যায় এত অধিক (নফল) রোযা আর কোন মাসে রাখতেন না। তিনি শা’বান মাসের প্রায় পুরোটাই রোযা রাখতেন। তিনি সকলকে এই আদেশ দিতেন যে, তোমরা যতদূর আমলের শক্তি রাখ, ঠিক ততটুকুই কর। আল্লাহ(সওয়াব দানে) অপারগ নন যতক্ষন না তোমরা অক্ষম হয়ে পড়। নবী(সঃ)-এর নিকট সর্বাধিক প্রিয় হল এমন নামায-যা অব্যাহতভাবে আদায় করা হয়-পরিমানে তা যত কমই হোক না কেন। নবী(সঃ) এর অভ্যাস ছিল-যখন তিনি কোন (নফল) নামায পড়তেন পরবর্তীতে তা অব্যাহত রাখতেন।–বুখারী

আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত। রসূল(সঃ) বলেছেন—শাবান মাসে অর্ধাংশ যখন অবশিষ্ট থাকে তখন তোমরা আর রোযা রেখনা।–তিরমিযী

আবু সালামা(রাঃ) থেকে বর্নিত তিনি বলেছেন, আমি আয়েশা(রাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ আমার উপর রমযানের কাযা রোযা থাকতো। কিন্তু শাবান মাস আসার পূর্বে আমি তা আদায় করতে পারতাম না।-বুখারী

ইয়াহইয়া বলেছেন, নবী (সঃ)-এর খেদমতে ব্যস্ত থাকার কারনে(তিনি তাঁর রোযা আদায় করার অবকাশ পেতেন না।)

 

রাসুল(স;) বলেছেন-চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ইফতার কর(অর্থাৎ রোযা খতম কর)। আর যদি মেঘের আড়ালের কারনে চাঁদ দেখা না যায় তাহলে শাবান মাসের তিরিশ তারিখ পূর্ণ কর।–তিরমিযী

আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত। আমার পরম বন্ধু (সঃ) আমাকে তিনটি বিষয়ের অসীয়ত করে গেছেন।

১। প্রতি মাসে(আরবী মাসের ১৩,১৪,১৫) তিনটি রোযা রাখা।

২। চাশতের দুই রাকয়াত নামায পড়া এবং

৩। আমি যেন (রাতে) নিদ্রা যাওয়ার আগেই বেতেরের নামায আদায় করে নেই।–বুখারী

রসূল(সঃ) বলেছেন—তোমাদের কেউ যেন কখনও শুধুমাত্র জুমুআর দিন রোযা না রাখে। যদি রাখতে চায় তবে জুমুআর আগের দিন কিংবা পরের দিন যেন একটি রোযা রেখে নেয়।–বুখারী

আমাদের সমাজে অনেকে কোরআনের একটি আয়াতকে শবে-বরাত এর পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করেন।

আর সেই আয়াতটি হলো:

এটি ছিল সেই রাত যাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারের বিজ্ঞতাসূচক ফয়সালা আমাদের নির্দেশে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সূরা আদ দুখান: ৪-৫

এখানে সেই রাত যে রাতে আল্লাহ তা’লা সকলের ভাগ্যের ফয়সালা ফেরেশতাদের কাছে দিয়ে দেন। অনেকে এটা শাবানের ১৫ তারিখের রাতের কথা বলে থাকেন। কিন্তু আমরা যদি একটু সচেতনভাবে কোরআন পাঠ করি তা হলে দেখতে পাব এই সূরার ১-৩ নং আয়াতে কি বলা হয়েছে:

হা-মীম। এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, আমি এটি  এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি। কারণ, আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম।

এখন আমরা একসাথে যদি পড়ি:

হা-মীম। এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, আমি এটি এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি। কারণ, আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম। এটি ছিল সেই রাত যাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারের বিজ্ঞতাসূচক ফয়সালা আমাদের নির্দেশে প্রকাশ করা হয়ে থাকে।            সূরা আদ দুখান: ১-৫

লক্ষ্য করুন এখানে বরকতপূর্ণ রাত হলো সেটা যে রাতে কোরআন নাযিল হয়েছিল। আমরা সুরা ক্বদর থেকে জানি:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ (1) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (2) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (3) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (5)

নিশ্চয়ই আমরা এটি (কোরআন) কদরের রাতে নাযিল করেছি। তুমি কি জান ক্বদরের রাত কি? ক্বদরের রাত্রি হাজার মাস হতে উত্তম।  ফেরেশতা ও রূহ এই রাত্রিতে তাদের আল্লাহর অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়। সেই রাত্রি পুরোপরি শান্তি ও নিরাপত্তার – ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। সূরা আল ক্বদর: ১-৫

সুতরাং আপনারা নিজেরা কোরআন খুলে উক্ত সূরার আয়াত ও তার তাফসীর পরে দেখুন কোরআনের কোথাও শা’বানের রাতের কথা আসে নাই। রামাদান মাস ও ক্বদরের রাত সম্পর্কে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।  বরকতপূর্ণ রাত বলতে ক্বদরের রাতকেই বুঝায়।

সমাজের চিত্র একটু লক্ষ্য করলে বুঝা যায়–

সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য গ্রাম ছেড়ে বাবা মা কে ফেলে পুরু পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা। সেই সময় বাবা-মা বুঝাতে চাইলেন যে তোমরা এখান থেকেই স্কুলে পড়াশুনা করাও। ছেলেকে বাবা মা বুঝায় যে তোকেতো এই স্কুল থেকেই মানুষ করেছি, তাহলে তোর সন্তান কেনো পারবে না? এইক্ষেত্রে ছেলে বাবা মায়ের বা স্ত্রী শশুর শাশুরীর কোন পরামর্শই ভালো চোখে দেখে না।

এই রকম অনেক ইস্যুতেই বাপ-দাদাদের উদাহরন মানতে চায় না কিন্তু ইবাদত বা দ্বীনী বিধানের ব্যপারে ঠিকই সহিহ জিনিষ ছেড়ে বাপ দাদাদের বা এতোদিন হয়ে যাওয়াকে প্রাধান্য দিতে মরিয়া হয়ে যান। কোনভাবেই বিদ’আতকে বুঝতে চান না। এর পিছনে মূল শক্তি কাজ করে শয়তানের দল যারা ভালোর ও সওয়াবের মূলা ঝুলিয়ে মানুষকে গুনাহের দিকে নিতে চায়, আর কিছু মানুষ সেটার পিছনে যাচাই না করেই ছুটতে থাকে। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

মধ্য শা’বানের রাত সম্পর্কে অনেক প্রচলন এখনো রয়েছে, তবে আলহামদুলিল্লাহ যারা মহান রবের সন্তুষ্টি ও আখেরাতের জান্নাতের প্রত্যাশী হয়ে সঠিক পথে চলতে চান, তারা সঠিক পথ পেয়ে যান কারন মহান রব তাদের সাহায্য করেন তাদের চাওয়ার কারনে।ফলে অনেকেই এখন আগের ভুল জানাকে আমলে পরিনত না করে সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতেই আমল করেন। আর এটাই মুমিনের সঠিক কর্তব্য।

এই মাসে রাসূলুল্লাহ স. বেশি বেশি সিয়াম পালন করতে ভালবাসতেন। তিনি সাধারণত এ মাসের অধিকাংশ দিন একটানা সিয়াম পালন করতেন বলে বুখারী ও মুসলিম সংকলিত সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি বুখারী ও মুসলিমের কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি শা’বান মাস পুরোটাই নফল সিয়ামে কাটাতেন। তিনি এ মাসে কিছু সিয়াম পালন করতে সাহাবীগণকে উৎসাহ প্রদান করতেন।বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৯৫, ৭০০;

আহমাদ, নাসাঈ প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলিত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বা হাসান পর্যায়ের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শা’বান মাসে বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়; এজন্য এই মাসে বেশি বেশি নফল সিয়াম পালন করা উচিত। নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৫/২০১।

শা’বান মাসের মধ্যম রজনী বা ১৫ই শা’বানের রাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

মধ্য শাবানের রাত্রির বিশেষ মাগফিরাত। এ বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে:

إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ

 

‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’

এ অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী: আবূ মূসা আশআরী, আউফ ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনু জাবাল, আবু সা’লাবা আল-খুশানী, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে।

শাইখ আলবানী বলেন, ‘‘হাদীসটি সহীহ। তা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।… আলবানী, সাহীহাহ (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ) ৩/১৩৫

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রিটি একটি বরকতময় রাত এবং এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু এ ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো আমল করার প্রয়োজন আছে কি না তা এই হাদীসে উল্লেখ নেই।

তাহলে এই হাদীসের আলোকে যা করনীয় তা হলো—নিজেকে সকল ধরনের শিরক থেকে মুক্ত রাখা ও হিংসা বিদ্বেষ থেকে অন্তরকে পুরুপুরি পরিচ্ছন্ন করা।

এটা করার জন্য নিজের আত্মসমালোচনা করা ও বেশী বেশী তাওবা ইস্তেগফার করে পরিশুদ্ধ করার জন্য মহান রবের পথে ফিরে আসা।

এই রাতে নির্দিষ্ট কোন সালাত নেই, তবে অন্যান্য রাতের মতই যদি কেউ তাহাজ্জুদ বা কিয়ামুল লাইল করেন তাতে সমস্যা নেই।

আর আরবী মাসের আইয়ামে বীদ হিসেবে ১৩,১৪,১৫ তিনটি রোযা রাখলে কোন সমস্যা নেই বরং সাওয়াব হবে এই সাওমে।

শুধুমাত্র এই রাতকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট নফল সালাত আদায় বা এই দিনকে ই বরাত হিসেবে রোযা রাখা বিদ’আতি আমল হিসেবেই গন্য হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।

অন্য মানুষকে খাওয়ানো তা শুধুমাত্র এই দিনকে কেন্দ্র করে করলেো বিদ’আতী আমল হয়ে যেতে পারে। পুরু মাসেই দান সাদাকা অন্যকে খাওয়ানো যেতে পারে। তবে রাসূল স. রোযাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

ভাগ্য রজনী বলতে কদরের রাতকেই বুঝানো হয়েছে যা কুর’আন দিয়েই প্রমানিত।

অন্যকে সঠিক জ্ঞানের কথা জানানো কর্তব্য তবে তাদের দিয়ে কাজ আদায় করা কর্তব্য নয়। কেউ যদি সহিহ হাদীসের আলোকে মানতে না চান তার সাথে তর্কে যাওয়া বা সম্পর্ক খারাপ করারও প্রয়োজন নেই, সেইক্ষেত্রে মহান রবের কাছে হিদায়েতের দু’আ করাটাই কর্তব্য।

মহান আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন ও সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন।