মুসলিম নারীর জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি হওয়া প্রয়োজন?

            মুসলিম নারী জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

প্রথমেই আমাদের জানা প্রয়োজন লক্ষ্য বলতে কি বুঝায় ও উদ্দেশ্য এর সাথে সম্পর্ক কি?

লক্ষ্য হলো চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল আর উদ্দেশ্য হলো সেই গন্তব্যস্থলে পৌছানোর সংক্ষিপ্ত ও নির্দিষ্ট পদক্ষেপসমূহ।

মূলত লক্ষ্যকে চুড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্যই উদ্দেশ্য তৈরী হয়।

যেমন কারো লক্ষ্য তিনি  পরীক্ষাতে A+ পেতে চান অথবা যেকোন ডিগ্রীর সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে চান এখানে উদ্দেশ্য হলো ভালোভাবে পড়ালেখা করা এবং পরীক্ষাতে অংশ নেওয়া।

সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠার ক্ষেত্রে লক্ষ্য হলো ছা্দে অবস্থান, আর সিঁড়ির এক একটি ধাপ হলো উদ্দেশ্য।

  • গুরুত্ব:
  • উদ্দেশ্য ছাড়া, আপনার লক্ষ্যের কাছাকাছি আসতে অসম্ভব।
  • লক্ষ্য নির্ধারণ ছাড়া আপনি উদ্দেশ্যে থাকতে পারবেন না

মুসলিম হিসেবেই নারী পুরুষের লক্ষ্য একই কিন্তু যেহেতু সৃষ্টিগত ভাবে শারিরীক মানসিক ও দায়িত্বের দিকের পার্থক্য হেতু উদ্দেশ্য এর মাঝেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে।

কেউ যদি প্রশ্ন করেন পুরুষ কেনো সন্তান করে না? এই প্রশ্ন যেমন অস্বাভাবিক বা অপ্রকৃতস্থ অর্থাৎ সুস্থ মস্তিস্কে আসতে পারে না তেমনি পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্র পৃথক সেটারও প্রশ্ন থাকার কথা নয়। আলহামদুলিল্লাহ, মহান রবের বিধান অত্যন্ত বলিষ্ঠ হিকমাতে পরিপূর্ণ ও বাস্তব ভিত্তিক।

 জীবনের  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করা যাবে যখন আমরা আমাদের পরিচয় জানতে, বুঝতে পারবো।

তাহলে নিজেদের প্রশ্ন করে দেখি-

 আমি কে?

কেনো এই পৃথিবীতে এসেছি?

আমি কোথা থেকে এসেছি?

সর্বশেষ কি হবে আমার?

মহান আল্লাহ সৃষ্টির কোনকিছুই অযথা সৃষ্টি করেন নাই। প্রতিটি সৃষ্টির পিছনে হিকমাহ রয়েছে।

 আল্লাহ তাআলা বলেন:

أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ

আফাহাসিবতুম আন্নামা খালাক্বনাকুম আবাছাও ওয়া আন্নাকুম ইলাইনা লা তুরজাউন

 “তোমরা কি মনে কর আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি। তোমরা আমার নিকট প্রর্ত্যাবর্তন করবে না।” (মুমিনূন : ১১৫)

 আল্লাহ তাআলা বলেন : “আসমান-জমিন এবং এ দুইটির মাঝে যা কিছু আছে সে সব আমি তামাশা করে সৃষ্টি করিনি।” (আম্বিয়া : ১৬)

 আল্লাহ আরও বলেন: “আমি আসমান-জমিন আর এ দুটির মাঝে যা আছে সে সব তামাশা করে সৃষ্টি করিনি। আমি ও দুটিকে যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। এদের সবার পুনরুজ্জীবনের জন্য নির্ধারিত সময়টিই এদের ফায়সালার দিন। সুরা আদ দুখান : ৩৮-৪০

 তিনি আরও বলেন:

تَنزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ

﴿مَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُّسَمًّى

এই কিতাব পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। নভোমন্ডল, ভূ-মন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু আমি যথাযথভাবেই এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্যেই সৃষ্টি করেছি।”সূরা আহকাফ : ২-৩

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

 যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।     সূরা আলে ইমরানঃ ১৯০-১৯১

প্রতিটি সৃষ্টি মতোই মহান আল্লাহ মানুষকেও বিশেষ পরিকল্পনার আওতায় রেখেছেন। সুবহান আল্লাহ।

প্রথমেই আসি কে আমি?

আমরা নারীরা এই পরিচয় সম্পর্কে সঠিক অবস্থান নেই বলেই জীবনের চলার পথে অনেকেই হতাশা, দুঃখ,অস্থিরতা, উসৃংখলাতেই সময় পার করে ফেলি। নারী যেনো পরিচয় জিজ্ঞেস করলে যে উত্তর সামনে চলে আসে তা হলো- আমি একজন মা/স্ত্রী/কন্য/বোন অথবা প্রফেশনাল কোন পরিচয়। কিন্তু আমরা কি মহান রবের দেয়া পরিচয় কে নিয়ে ভেবেছি! মহান আল্লাহ আমাকে কি পরিচয় দিয়ে ই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তা কি আমি জানি! যদি জেনে থাকি তাহলে সেই পরিচয় কি আমি বহন করছি! আমাদের এইভাবেই প্রশ্ন করে আত্মপর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তাহলেই পথ চলাটা সহজ সুন্দর হবে ইন শা আল্লাহ এবং লক্ষ্যে পৌছাতে পারবো।

মহান রাব্বুল আ’আলামীন আমাদের পরিচয় নির্ধারন করেই দিয়েছেন।

خَلَقَ الْإِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ

মাটির শুকনো ঢিলের মত পচা কাঁদা থেকে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সুরা আর রহমানঃ ১৪

﴿لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ

আমি মানুষকে পয়দা করেছি সর্বোত্তম কাঠামোয় ৷ ত্বীন-৪

আপন তত্ত্বের প্রতি মানুষের লক্ষ্য করা উচিত যে, সে কোন জিনিস থেকে পয়দা হয়েছে,? সে পয়দা হয়েছে সবেগে নির্গত এক পানি থেকে যা পিঠ ও বক্ষ অস্থির মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে”। ( সুরা আত তারিকঃ৫-৭ )

যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তম রূপে সৃষ্টি করেছেন৷ তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে,তারপর তার বংশ উৎপাদন করেছেন এমন সূত্র থেকে যা তুচ্ছ পানির মতো৷ তারপর তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন  এবং তার মধ্যে নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন ,  আর তোমাদের কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছেন, তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো৷ (সাজদাহঃ৭-৯)।

মহান আল্লাহ কত তুচ্ছ এক জিনিষ থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এক উন্নত সর্বোত্তম ভারসাম্য কাঠামোতে। আলহামদুলিল্লাহ। উপলব্ধি করার জন্য যে অংগ প্রয়োজন (কান,চোখ,অন্তর) সেটাকেই তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন যেনো আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে রবের পথে চলতে চাই।

ইরশাদ হয়েছে-

“হে মানুষ! তোমার সেই দয়ালু রব সম্পর্কে কি জিনিস তোমাকে প্রতারিত করেছে? যিনি তোমাকে পয়দা করেছেন তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-গুলো ঠিক করেছেন, তোমার শক্তি ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করেছেন এবং যে আকৃতিতে ইচ্ছা করেছেন তোমার উপাদানসমূহ সংযোজিত করেছেন। [সূরা ইনফিতারঃ৬-৮]

হে মানব জতি ! তোমাদের রবকে ভয় করো৷ তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে ৷ আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া ৷ তারপর তাদের দুজনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী ৷ নিসাঃ১;

‘মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অতঃপর সে হয়ে গেল প্রকাশ্যে বিতন্ডাকারী। সে আমাদের সম্পর্কে নানারূপ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়, আর বলে যে, কে জীবিত করবে এসব হাড়গোড় সমূহকে, যখন সেগুলো পচে গলে যাবে? (ইয়াসীনঃ৭৭-৭৮)।

৫১:৫৬ وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ

আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে কেবল এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। সূরা আয যারিয়াতঃ ৫৬

এই আয়াতসমূহ থেকে একজন মানুষের মূল পরিচয় হলো অত্যন্ত তুচ্ছ একটি জিনিষ থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর একটি উন্নত সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ গঠন দান করেছেন। এর মূল লক্ষ্যই হলো রবের ইবাদাত করা অর্থাৎ একজন মানুষের মূল পরিচয় হলো সে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের দাস।

ইবাদত অর্থ আনুগত্য, দাসত্ব করা, সর্বোচ্চ পর্যায়ের নত হওয়া।

যে ব্যক্তি কারো মালিকানাধীন -স্বাধীন নয়, তাকে বলা হয় আব্দ।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي

আমি-ই আল্লাহ্। আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং তুমি কেবল আমারই ইবাদত করো। ত্বাহা-১৪

 সে আল্লাহ্ই তোমাদের রব! তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তিনি সমুদয় বস্তুর স্রষ্টা। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং তিনি সব জিনিসের যথাযথ খবর রাখেন। আনআম-১০২

মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদত করার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে দু’টি অবস্থা ও ব্যবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছেন :

১. প্রাকৃতিক বা জন্মগতভাবে মানুষ আল্লাহর দাস,

 ২. আল্লাহর দাস হবার ব্যাপারে সে স্বাধীন।

এ দু’টি অবস্থার কারণ হলো, মানুষের মধ্যে আল্লাহ দু’টি সত্তা সৃষ্টি করেছেন :

১. বস্তুগত সত্তা। অর্থাৎ তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও অন্যান্য বস্তুগত উপাদানসমূহ।

২. বুদ্ধিগত ও নৈতিক সত্তা। এর মধ্যে রয়েছে তার:

Intelligence(বুদ্ধিমত্তা), cognition(চেতনা). Perception(উপলব্ধি), sensation, ethics(নীতিশাস্ত্র), judgment, feeling, will, choice, intention, desire, rationality(যৌক্তিকতা), option, opinion, decisive power (সিদ্ধান্তমূলক ক্ষমতা).

মানুষের বস্তুগত সত্তা জন্মগতভাবেই আল্লাহর দাস। মানুষের প্রতিটি অঙ্গ স্রষ্টার একান্ত অনুগত বাধ্যগত দাস। স্রষ্টা যে অঙ্গকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন এবং তার জন্যে যে কর্ম  নির্দেশ করেছেন, সে বিনীতভাবে কেবল সে নির্দেশই পালন করে যাচ্ছে। মানুষের চোখ, কান, নাসিকা, জিহ্বা, দন্ত, রক্ত, মস্তিষ্ক ইত্যাদি প্রতিটি অংগ, বিভিন্ন শরীরবৃত্তিয় পদ্ধতি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে স্রষ্টার হুকুম পালন করে যাচ্ছে। মানুষের এইগুলোর উপর নিয়ন্ত্রন নেই। কেউ রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে দিতে পারবে না। চোখের কাজ দেখা কিন্তু কেউ এটা দিয়ে শুনার কাজ করাতে পারবে না।

মহান আল্লাহ বলেছেন-

কাজেই   ( হে নবী এবং নবীর অনুসারীবৃন্দ ) একনিষ্ঠ হয়ে নিজের চেহারা এ দীনের  দিকে স্থির নিবদ্ধ করে দাও৷ আল্লাহ মানুষকে যে প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করেছেন তাঁর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও৷  আল্লাহ তৈরি সৃষ্টি কাঠামো পরিবর্তন করা যেতে পারে না৷  এটিই পুরোপুরি সঠিক ও যথার্থ দীন৷ কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না  রুম : ৩০)

আল্লাহ বলেছেন যে, আমি আমার বান্দাদের ‘হানীফ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ রূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান তার পিছে লেগে তাকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে নিয়ে গেছে।. মুসলিমঃ২৮৬৫

প্রত্যেক মানবশিশুই ফিৎরাতের উপরে জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী-নাছারা বা মজূসী (অগ্নিউপাসক) বানায়’৷ মুত্তাফাক্ব আলাইহ

 কিন্তু পরম দয়াবান মহান আল্লাহ মানুষকে বস্তুগত সত্তার সাথে সাথে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাও দিয়েছেন এবং সে সত্তাটিকে স্বাধীন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা (Freedom of will & freeom of choice)।

ফলে একজন ব্যক্তি কার বাধ্যগত থাকবে, কার হুকুম বিধান পালন করবে, কার কাছে নত থাকবে, কার কাছে প্রার্থনা করবে, কার আনুগত্য করবে, কার দাসত্ব করবে? কার উপাসনা করবে? -এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

কিন্তু তার এই প্রবণতাগুলো কাউকেও না কাউকেও অর্পণ করতেই হবে। অর্থাৎ কারো না কারো ইবাদত তাকে করতেই হবে। ইবাদত থেকে কোনো অবস্থাতেই সে মুক্ত থাকতে পারে না। কারণ ইবাদত করাই মানুষের প্রবণতাসমূহের স্রষ্টা প্রদত্ত প্রকৃতি।

أَلَمْ نَجْعَل لَّهُ عَيْنَيْنِ

وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ

وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ

 আমি কি তাকে দু’টি চোখ, 

একটি জিহ্বা ও দু’টি ঠোঁট দেইনি ?

 আমি কি তাকে দু’টি সুস্পষ্ট পথ দেখাইনি? সূরা বালাদঃ ৮-১০

মহান রবের সাথে আমাদের সম্পর্কের ধরন  কুর’আনের অনেক আয়াতেই আমরা দেখতে পাই। কুরআনের শেষ সূরা ‘আন্‌ নাস’এ আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক তিন রকমের- রাব্বিন্‌ নাস, মালিকিন্‌ নাস ও ইলাহিন্‌ নাস।

১. তিনি মানুষের রব। ২. তিনি মানুষের বাদশাহ। ৩. তিনি মানুষের ইলাহ।

আল্লাহর প্রতি ইমান ও এই  তাওহীদের শিক্ষা তাওহীদে রবুবিয়্যাত, তাওহীদে উলুয়িহাত, আসমা আস সিফাত সম্পর্কে তাই আমাদের জানতে হবে।

এতটুকু আলোচনাই মানুষের পরিচয় সে আল্লাহর দাস ও তার মূল কাজ রবের দাসত্ব করা.   আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমারও রব তোমাদেরও রব, অতএব একমাত্র তারই দাস হয়ে থাক। এটাই হচ্ছে সিরাতুম মুস্তাকীম-সঠিক ও সুদৃঢ় ঋজু পথ। সূরা মারইয়াম: ৩৬

 কোথা থেকে আমরা এসেছি?

এরপর আমরা আরেকটু ফিরে দেখি মানুষ সৃষ্টির শুরুতে রব কি বলেছিলেন—

 আবার  সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের   বলেছিলেন , “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি  নিযুক্ত করতে চাই ৷” তারা বললো , “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে?  আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি৷ ”  আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না ৷ (বাক্বারাহঃ ৩০)।

সৃষ্টির শুরুতেই রাব্বুল আ’লামীন প্রথম মানব আদম আ এর পরিচয় দিয়েছেন খলিফা বা প্রতিনিধি বলে। সম্মানিত ফেরেশতাবৃন্দ যে কাজটি করে যাচ্ছেন তা হলো রবের যিকর, প্রশংসা, তাসবিহ ও পূর্ন আনুগত্য। মানব জাতিকে শুধুমাত্র তাসবীহ,যিকর করার জন্য পাঠানো হয়নি যা ফেরেশতাবৃন্দের সাথে আল্লাহর কথোপকথনেই বুঝা যাচ্ছে।

আল্লাহ চান এ পৃথিবীতে এমন একটা সৃষ্টির আবাদ করতে, যারা হবে জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করবে ও তাঁর ইবাদত করবে। ফেরেশতাদের মত কেবল হুকুম তামিলকারী জাতি নয়।

خِلاَفَة আরবি শব্দ। এর মূলخَلْف  , আর خَلْف মানে- পেছনে আসা, পরে (next-এ) আসা, উত্তরাধিকারী হওয়া। خَلْف থেকেই গঠিত হয়েছে خِلاَفَة ও خَلِيْفَةٌ (খেলাফত ও খলিফা)। শব্দ দু’টির মৌলিক অর্থ হলো :

১. পেছনে আগত, স্থলাভিষিক্ত।

২. একের পর এক আগত দল।

৩. প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

৪. উত্তরসূরী/পরবর্তী অনুসারী।

৫. প্রতিনিধি/দায়িত্বপ্রাপ্ত।

৬. শাসক/কর্তৃত্বশীল।

পৃথিবীতে সকল নবী রাসূলরাই মহান আল্লাহর খলিফা এবং প্রতি নবী রাসূলদের জাতির অনুসরনকারীরা তাদের প্রতিনিধি।

আমরা সর্বশেষ নবী ও রাসূল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত ও প্রতিনিধি।

মহান আল্লাহ জান্নাতে আদম আ কে সৃষ্টি করে থাকতে দেন, বিচরন ও সুখ আনন্দে অবস্থান করতে দেন কিন্তু এতো কিছু থাকার পরও একাকীত্ব অনুভব করেন আদম আ। মহান আল্লাহ তার একাকীত্ব দূর করে দিলেন মা হাওয়া আ কে সৃষ্টি করে।

আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

 خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا

অতঃপর তিনি তার (আদম) থেকে তার যুগল (হাওয়াকে) সৃষ্টি করেছেন (সূরা যুমার : ৬)

هو الذي خلقكم من نفس واحدة و جعل منها زوجها ليسكن إليها

তিনি ঐ সত্তা যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি ‘নফস’ থেকে এবং বানিয়েছেন তার থেকে তার জোড়া যেন সে তার কাছে স্বস্তি লাভ করে। (সূরা আরাফ : ১৮৯)

﴿وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

ওয়া মিন আইয়াতিহি আন খালাক্বা লাকুম মীন আংফুসাকুম আঝওয়াজাল্লি তাসকুনু ইলাইহা ওয়া জায়ালা বাইনাকুম মাউয়াদ্দাতাও ওয়া রাহমাহ। ইন্না ফি জালিকা লা আইয়াতিল্লি ক্বাউমিই ইয়া তাফাক্কারুন।

আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে , তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই জাতি থেকে সৃষ্টি করেছেন স্ত্রীগণকে,  যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করো   এবং তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন৷ অবশ্যই এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তা- ভাবনা করে৷ (সুরা রুম : ২১)

এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝা যায় নারীর সৃষ্টির অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো স্বামীর প্রশান্তি লাভ। আবার এই আয়াত থেকে এটাও জানা যায় পারস্পরিক এই সম্পর্কের মাঝে মহান আল্লাহ প্রদত্ত সাকীনাত,মাওয়াদ্দাহ ও রাহমাহ ধেলে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। রবের দেখানো পদ্ধতিতে বিয়ের মাধ্যমে এই সম্পর্কেই শুধুমাত্র এইগুলো পাওয়া সম্ভব ইন শা আল্লাহ। সবামী স্ত্রীর এই সম্পর্কের ভিত্তি হবে তাকওয়া যা সূরা নিসায় বলা আছে।

আমরা নারীরা যেনো ভুলে না যাই যে, আমাদের সৃষ্টির পিছনে অন্যতম একটি কারন হলো নিজ স্বামীর স্বস্থি, পরিবার প্রথার সষ্ঠতা। অবশ্যই এটাও স্মরন  রাখতেই হবে যে প্রথম ও মূল পরিচয় হলো সে মহান রবের দাস।

নারী পুরুষ দুজনেই যার যার অবস্থানে এই দাস হিসেবে যা করনীয় তা করলেই ভারসাম্যপূর্ন একটি জীবন দেখা যায়।

 مَوَدَّة       এর অর্থ হল স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুমধুর ভালবাসা যা সাধারণত পরিলক্ষিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেরূপ ভালবাসা সৃষ্টি হয় অনুরূপ ভালবাসা পৃথিবীর অন্য কোন দুই ব্যক্তির মাঝে হয় না।

আর رَحمَة (মায়া-মমতা) হল এই যে, স্বামী নিজ স্ত্রীকে সর্বপ্রকার সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশ দান করে থাকে। অনুরূপ স্ত্রীও নিজের সাধ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী স্বামীর সেবা করে থাকে। মহান আল্লাহ উভয়ের উপরেই সে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। বলা বাহুল্য, মানুষ এই শান্তি ও অগাধ প্রেম-ভালবাসা সেই দাম্পত্যের মাধ্যমেই লাভ করতে পারে যার সম্পর্কের ভিত্তি শরীয়তসম্মত বিবাহের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। পরন্তু ইসলাম একমাত্র বিবাহসূত্রের মাধ্যমেই সম্পৃক্ত দম্পতিকেই জোড়া বলে স্বীকার করে।

এই রাহমা হলো নিঃস্বার্থ একজন অন্যজনকে দেখাশুনা করা ভালোবাসা  দিয়ে।

 আর এর অন্যতম উদাহরন আমরা দেখতে পাই হযরত খাদিজা রা এর চরিত্রের নমুনায়। রাসূল সা প্রশান্তি পেয়েছিলেন এই অন্যতম সংগীকে পেয়ে, আলহামদুলিল্লাহ।

রাসূল সা এর হাদীস-

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখবে সে যেন তার পড়শীকে কষ্ট না দেয়। আর তোমরা মহিলাদের প্রতি কল্যাণকর হওয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে উপদেশ দাও; কেননা তারা বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বাঁকা অংশ হচ্ছে হাড়ের উপরের অংশ। যদি তুমি তাকে সোজা করতে যাও তবে তা ভেঙ্গে ফেলবে। পক্ষান্তরে যদি তুমি ছেড়ে যাও তবে সব সময় বাঁকাই থেকে যাবে। সুতরাং তোমরা মহিলাদের প্রতি কল্যাণকর হওয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে উপদেশ দাও। [বুখারী: ৫১৮৫, ৫১৮৬]

খানে নারীকে কত যত্নের সাথে গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করে সম্পর্কিত করতে হবে তা এই হাদীস থেকে বুঝা যায়। এই হাদীস নিয়ে যদিও আমাদের সমাজে ভূল ব্যখ্যা করে বা নারীর দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তিকর আচরন করে থাকেন অনেক পুরুষরাই। কিন্তু হাদীসের মূল উদ্দেশ্য নারীর মর্যাদাকর অবস্থান ও তার সাথে আচরনের দিক নির্দেশনা দেয়া একজন পুরুষকে।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

আর যে কোন পুরুষ বা নারী নেক আমল করবে, আর সে মুমিন হবে, তাহলে তারা জান্নাতে দাখেল হবে এবং সেখানে তাদেরকে বেলা হিসাব রিযিক দান করা হবে। (সূরা মুমিন : ৪০)

অনন্তর তাদের প্রতিপালক তাদের দু‘আ কবুল করলেন (আর বললেন) যে, আমি তোমাদের কোন আমলকারীর আমল নষ্ট করবো না, সে পুরুষ হোক, বা নারী। তোমরা তো পরস্পরের অংশবিশেষ। (সূরা আলে ইমরান : ১৯৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানে রোজা রাখে, আব্রু(পর্দা) রক্ষা করে, স্বামীর নির্দেশ মান্য করে, তবে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪১৬৩)

তাহলে নারীর জন্য জান্নাতে প্রবেশের রাস্তাটা কত সহজ করে দেয়া হয়েছে তা এইহাদীস থেকে আমরা বুঝে পারি। তবে মনে রাখা দরকার যে মহান আল্লাহ যে উদ্দেশ্য সামনে দিয়েছেন অর্থাৎ মহান আল্লাহর দাসত্ব করা সেটা প্রতি পদক্ষেপেই স্মরন রেখে চলতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিভাবে এই পথচলা দাসের পরিচায়ক হবে রবের দরবারে, কবুল হবে রবের দরবারে!

মহান আল্লাহ আদম আ ও হাওয়া আ কে জান্নাতে থাকতে দিলেন।

তখন আমরা আদমকে বললাম , “তুমি ও তোমার স্ত্রী উভয়েই জান্নাতে থাকো এবং এখানে স্বাচ্ছন্দের সাথে ইচ্ছে মতো খেতে থাকো, তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না ৷  অন্যথায় তোমরা দু’জন যালেমদের  অন্তরভুক্ত হয়ে যাবে ৷ ” বাক্বারাহ ৩৫;

কিন্তু এরপর যখন ইবলিশের ফাঁদে পড়ে দুজনেই ভুল করে ফেললেন,তখন যা হলো–

মহান আল্লাহ বলেছেন-

আমরা বললাম , “ তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও । এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা ৷ 

আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী ৷ সেখানে তারা থাকবে চিরকাল ৷(বাক্বারাহ ৩৮-৩৯)।

‘তোমরা পৃথিবীতেই জীবনযাপন করবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান থেকেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে’ (আ‘রাফ ৭/২০-২৫)।

তাহলে দেখা যাচ্ছে মহান আল্লাহ জান্নাত থেকে দুজন মানবসহ একজন জ্বীন(ইবলিশ) কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন রবের নির্দেশনা।

সবকিছুর উপরে দেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ।

এতো আমার অনুগ্রহ, আমি বনী আদমকে মর্যাদা দিয়েছি এবং তাদেরকে জলে স্থলে সওয়ারী দান করেছি, তাদেরকে পাক-পবিত্র জিনিস থেকে রিযিক দিয়েছি এবং নিজের বহু সৃষ্টির ওপর তাদেরকে সুস্পষ্ট প্রাধান্য দিয়েছি৷(ইসরা -৭০)।

তোমরা কি দেখো না, আল্লাহ যমীন ও আসমানের সমস্ত জিনিস তোমাদের জন্য অনুগত ও বশীভুত করে রেখেছেন   এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও গোপন নিয়ামতসমূহ  সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন ? এরপর অবস্থা হচ্ছে এই যে, মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের নেই কোন প্রকার জ্ঞান, পথনির্দেশনা বা আলোক প্রদর্শনকারী কিতাব৷ লোকমান -২০)

তাহলে মানুষ হলো রবের দাস, দাসত্ব করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে, এরপর পৃথিবীতেও পাঠানো হয়েছে।

মানুষের ঠিকানা হ’ল তিনটি :

১- দারুদ দুনিয়া। অর্থাৎ যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি

২- দারুল বরযখ। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে কবরের জগত।

৩- দারুল ক্বারার। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন শেষ বিচার শেষে জান্নাত বা জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা।

পৃথিবীতে পাঠিয়ে মহান আল্লাহ আবার জানিয়ে দিলেন

الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ

তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, কাজের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য৷ আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীলও৷

সূরা মূলক ২

প্রথম হলো, মৃত্যু এবং জীবন তাঁরই দেয়া৷ আর কেউ জীবনও দান করতে পারে না, মৃত্যুও ন৷

 দ্বিতীয় হলো, মানুষ একটি সৃষ্টি, তাকে ভাল এবং মন্দ উভয় প্রকার কাজ করার শক্তি দেয়া হয়েছে৷ জীবন তার জন্য পরীক্ষার সময় বা অবকাশ মাত্র ৷ মৃত্যুর অর্থ হলো, তার পরীক্ষার সময় ফুরিয়ে গেছে৷

তৃতীয় হলো, এ পরীক্ষার জন্য স্রষ্টা সবাইকে কাজের সুযোগ দিয়েছেন৷ সে ভাল মানুষ না খারাপ মানুষ, এ পৃথিবীতে কাজের মাধ্যমে সে যাতে তার প্রকাশ ঘটাতে পারে সে জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেককে কাজের সুযোগ দিয়েছেন৷

চতুর্থ হলো, কার কাজ ভাল এবং কার কাজ খারাপ প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তাই তার ফায়সালা করবেন৷ কাজের ভাল -মন্দ বিচার করার মানদণ্ড নির্ধারণ করা পরীক্ষার্থীর কাজ নয়, বরং পরীক্ষা গ্রহণকারীর কাজ৷ তাই যারাই পরীক্ষায় সফল হতে চাইবে , তাদেরকে জানতে হবে পরীক্ষা গ্রহণকারীর দৃষ্টিতে ভাল কাজ কি?

পঞ্চম বিষয়টি পরীক্ষা কথাটির মধ্যেই নিহিত৷ তা হলো, যার কাজ যেমন হবে তাকে সে অনুপাতেই প্রতিফল দেয়া হবে৷ কারণ ফলাফলই যদি না থাকে তাহলে পরীক্ষা নেয়ার আদৌ কোন অর্থ হয় না৷

 জান্নাত থেকে নেমে আসা মানুষ এই পরীক্ষাস্থলে পরীক্ষা শেষে সুন্দর ফল লাভে পুনরায় জান্নাতে ফিরে যাবে, অথবা ব্যর্থকাম হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর সেখানেই হবে তাদের সর্বশেষ যাত্রাবিরতি এবং সেটাই হবে তাদের চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ বলেন,

﴿مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَىٰ

‘মাটি থেকেই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি। ঐ মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব। অতঃপর ঐ মাটি থেকেই আমরা তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব,(ত্বোয়াহা ৫৫)।

এই পর্যন্ত আলোচনায় আমরা যা বুঝতে ও জানতে পারলাম তা হলো আমাদের লক্ষ্য হলো মহান রবের সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভ যেনো আখেরাতে আবার জান্নাতে ফিরে যেতে পারি।

উদ্দেশ্য হলো এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য অহীর জ্ঞানের আলোকে যে সিলেবাস দেয়া আছে তার বাস্তব অনুশীলনে নিয়োজিত থাকা।

মুসলিম ও অমুসলিমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এর মাঝে পার্থক্যের রুপ রেখা

শুধুমাত্র অমুসলিম নয় অনেক মুসলমান যারা আল্লাহর অবাধ্য,মুনাফিক, দুনিয়া নিয়েই ব্যস্থ- ভুলে যায় তার রবের কাছে ফিরে যাওয়াকে, সেই ব্যক্তিদের জীবন যাত্রা ও পূর্ন অনুগত মুসলিমের জীবন যা্ত্রা চিন্তা ধারা কোনটাই এক হবে না।

যেখানে একজন ব্যক্তি জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধি লাভের আশায় অনবরত কষ্ট করেই যাচ্ছে সেখানে অপরজন পরকালের সুখের সন্ধানে জীবনভর সংগ্রামে লিপ্ত, কয়েকটি বিষয় ছাড়া এ দুইয়ের মাঝে আসলে কোন তফাৎ  নেই। যদি দু’জনকেই দেখি তবে দেখবো উভয়েই একটি সুন্দর জীবন লাভ করেছেন। কিন্তু কুর’আনে বলা হয়েছে তাদের মাঝে রয়েছে বিস্তর দূরত্বঃ

إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّىٰ

 আসলে তোমাদের প্রচেষ্টা নানা ধরনের৷ সূরা আল লাইলঃ ৪ 

ঈমানদার ব্যক্তি কি অবাধ্যের অনুরূপ? তারা সমান নয়। (সুরা আস সাজদাহ:১৮)

এ কথা সত্য যে একজন অমুসলিম নিজেকে সুনির্দিষ্ট কিছু আকাঙ্ক্ষার জালে জড়িয়ে রাখে তাই সে কোনভাবেই একজন মুমিনের সমকক্ষ হতে পারে না। হয়ত একজন অমুসলিম দেখতে পারে এ দুনিয়ার জীবনে তার কোন কিছুই অপূর্ণ নেই তবুও তার এ সকল আয়োজন ক্ষণস্থায়ী এক সুখের নাম ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

﴿مَّن كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَن نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَّدْحُورًا﴾

﴿وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَٰئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُورًا﴾

﴿كُلًّا نُّمِدُّ هَٰؤُلَاءِ وَهَٰؤُلَاءِ مِنْ عَطَاءِ رَبِّكَ ۚ وَمَا كَانَ عَطَاءُ رَبِّكَ مَحْظُورًا﴾

 যে কেউ আশু লাভের  আকাঙ্ক্ষা করে, তাকে আমি এখানেই যাকিছু দিতে চাই দিয়ে দেই, তারপর তার ভাগে জাহান্নাম লিখে দেই, যার উত্তাপ সে ভুগবে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়ে৷

 আর যে ব্যক্তি আখেরাতের প্রত্যাশী হয় এবং সে জন্য প্রচেষ্টা চালায়, যেমন সে জন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিত এবং সে হয় মুমিন, এ ক্ষেত্রে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির প্রচেষ্টার যথোচিত মর্যাদা দেয়া হবে৷

 এদেরকেও এবং ওদেরকেও, দু দলকেই আমি (দুনিয়ায়) জীবন উপকরণ দিয়ে যাচ্ছি, এ হচ্ছে তোমার রবের দান এবং তোমার রবের দান রুখে দেবার কেউ নেই৷

انظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا﴾

 কিন্তু দেখো, দুনিয়াতেই আমি একটি দলকে অন্য একটির ওপর কেমন শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে রেখেছি এবং আখেরাতে তার মর্যাদা আরো অনেক বেশী হবে এবং তার শ্রেষ্ঠত্বও আরো অধিক হবে।সূরা বনী ইসরাইলঃ ১৭-২১

মহান আল্লাহ জানিয়েছেন-

وَإِنَّ لَنَا لَلْآخِرَةَ وَالْأُولَىٰ

 আর আসলে আমি তো আখেরাত ও দুনিয়া উভয়েরই মালিক। সূরা আল লাইলঃ ১৩

বল, ‘যারা বিভ্রান্তিতে আছে, পরম দয়াময় তাদেরকে প্রচুর ঢিল দেবেন; পরিশেষে যখন তারা যে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করবে; তা শাস্তি হোক অথবা কিয়ামতই হোক; তখন তারা জানতে পারবে, কে মর্যাদায় নিকৃষ্ট ও কে দলবলে দুর্বল। সূরা মরিয়মঃ ৭৫

‘দুনিয়া পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। আর পরকাল সামনে চলে আসছে। (মানুষের অন্তরে) এ দু’টির প্রতিটিরই রয়েছে (প্রবল) আসক্তি। সুতরাং তোমরা পরকালের প্রতি আসক্ত হও। দুনিয়ায় আসক্ত হইও না। কারণ এখন (দুনিয়া) আমলের সময়; কিন্তু (কোনো) হিসাব নেই। আর আগামীকাল (পরকাল) হবে হিসাবের; সেখানে আমল করার (কোনো) সুযোগ নেই।’ (বুখারি)

হান আল্লাহর কাছে মূল্যায়নের জন্য তিনটি জিনিস এখানে বর্ণিত হয়েছে।

 (ক) আখেরাত কামনা। অর্থাৎ, কর্মে ইখলাস থাকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা। (খ) যথাযথ প্রচেষ্টা করা। অর্থাৎ, সুন্নাহ অনুযায়ী কর্ম করা।

 (গ) ঈমান থাকা। কেননা, এ ছাড়া কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না।

অন্যদিকে একজন প্রকৃত মুমিনের ক্ষেত্রে, যদি এ জগতের সুখগুলো হাতে এসে ধরা দেয় সে উপলব্ধি করতে পারে আসলে এগুলো প্রকৃত সুখ নয় বরং পরকালে আল্লাহর দেয়া পুরস্কার জান্নাত হচ্ছে প্রকৃত সুখের স্থান।

নিশ্চয় আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উত্তম তোমাদের জন্যে, যদি তোমরা জ্ঞানী হও। তোমাদের কাছে যা আছে নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, কখনও তা শেষ হবে না। যারা সবর করে, আমি তাদেরকে প্রাপ্য প্রতিদান দেব তাদের উত্তম কর্মের প্রতিদান স্বরূপ যা তারা করত। (সুরা আন নহল:৯৫-৯৬)

জীবন সম্বন্ধে এই যে উপলব্ধি, এ উপলব্ধিই মূলত একজন মুমিনের সর্বাপেক্ষা বড় গোপন শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই শক্তিই তাকে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর করে দুনিয়ার জমিনে চলার শক্তি যোগায়।

আপনার কাছে যা আছে তা দিয়েই পরকালীন জীবনের পাথেয় সংগ্রহ শুরু করুন, তবে মনে রাখবেন পাথেয়ই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়, আল্লাহ আমাদের যে নিয়ামত দান করেছেন, দেহ, মন, শিক্ষা ও সম্পদ সব কিছু দিয়ে পরকালীন পাথেয় উপার্জনের একটিই লক্ষ্য আর তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জান্নাত লাভ। 

মনে রাখবেন আপনার ব্যক্তিগত যত অর্জন ও জীবনের সাধনা সবকিছুর ফলাফল আখেরাতেই পাওয়া যাবে, তবে সেই আখেরাতের সঞ্চয় এ দুনিয়াতেই করতে হবে। এমনকি আমরা যদি রাসূল স. ও তাঁর সাহাবাদের জীবনের বৃহৎ অর্জনের দিকে তাকাই তাহলেও দেখব সব কিছুই এ দুনিয়াতেই অর্জিত হয়েছে।

রাসূল স. এবং তাঁর সাহাবাগণ দুনিয়াকে কেন্দ্র করেই পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন ফলে তাদের নাম চিরঅম্লান হয়ে  রয়েছেন। একই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাড়িয়েও তারা আখেরাতের পুরস্কারকেই বেছে নিয়েছেন। জীবনের চাওয়া পাওয়ার মাঝে কিভাবে সমতা বিধান করতে হয় তারা বাস্তব সাক্ষ্য রেখে গিয়েছেন।

 যখন রাসূল স. এর পাশে বসে আখেরাতের বয়ান শুনতেন, সেই সময় আখেরাত তাদের কাছে বাস্তব হয়ে ধরা দিত। তিনি এমনভাবে বর্ণনা করতেন কখনো মনে হতো তিনি কোন প্রাপ্তি ধরতে যাচ্ছেন আবার অনেক সময় মনে হতো তিনি কোন কিছু থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন

রাসূল স. এর এ অবস্থা দেখে যখন কেউ প্রশ্ন করতেন তখন তিনি রাসূল স. বলতেন, যখন তিনি কথা বলেন  যেন তিনি জান্নাতকে ও তার ফলমূল চোখের সামনে দেখতে পান। যা তিনি দেখতে পান তা থেকে কিছু পেতে তিনি চেষ্টা করেন। তিনি আরও বলেছেন, যদি তিনি তা ধরতে পারতেন তবে তা এ পৃথিবীর সব সময়ের সর্বকালের মানুষদের জন্য যথেষ্ট হতো।  

একই ভাবে যখন তিনি জাহান্নাম নিয়ে আলোচনা করতেন, জাহান্নামকে চোখের সামনে দেখে তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতেন।

এরকম আরও অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাহাবাগণ জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, চেতনা, মূল্যবোধ, চরিত্র, কাজকর্ম সহ সকল ক্ষেত্রেই এক আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিলেন এবং একটি লক্ষ্য সামনে রেখেই পথ চলেছেন, আর তা হল মহান স্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ লাভ।  

এভাবেই আমরা আল্লাহর কোর’আন ও রাসূল স. এর সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করে নিজেদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য স্থির করে তা অর্জনে চেষ্টা করতে পারি।(কিছু কিছু কথা সংগ্রহ করে নোট করা হয়েছে)

জাযাকুমুল্লাহি খাইরান

সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা  আসহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আন্তা আসতাগফিরুকা ওয়া অতুবু ইলাইকা

 

Power point presentation

জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য