যাকাত কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হয়

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে-

যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٦٠﴾ [التوبة: 60]

“নিশ্চয় সদকা হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, (তা আরও বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়”।[সূরা আত-তাওবাহ: ৬]

  1. ফকির (যার কিছুই নেই)
  2. মিসকীন (যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই)
  3. যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী
  4. (অমুসলিমদের) মন জয় করার জন্য
  5. ক্রীতদাস (মুক্তির উদ্দেশ্যে)
  6.  ঋণ মুক্তির জন্য
  7. আল্লাহর পথে জেহাদে রত ব্যক্তি
  8. মুসাফির (যিনি ভ্রমণকালে অভাবে পতিত)
ইসলাম হাউজ.কম থেকে সংগৃহিত নীচের অংশটি
যাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় হকদার:

ফকীর ও মিসকীন: ফকীর ও মিসকীন শব্দ দু’টির পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছন, সংজ্ঞা যাই বলা হোক তারা অর্থাৎ ফকীর ও মিসকীন যাকাতের হকদার।

সারকথা হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীন তাদেরকে বলা হয়, যাদের সম্পদ ও সম্পদ উপার্জন করার উপায় নেই। অনুরূপ কারও সম্পদ ও সম্পদ উপার্জন করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু তা দিয়ে তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জরুরি প্রয়োজন পূরণ হয় না, যেমন খাবার, পোশাক, বাড়ি-ভাড়া, চিকিৎসা খরচ, অপারেশন, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিল ইত্যাদি তার সম্পদ দিয়ে যথেষ্ট হয় না।

শাইখ উসাইমীন রহ. বলেন: “যে নিজেকে পবিত্র রাখার জন্য বিয়ে করতে চায়, কিন্তু তার নিকট মোহর ও বিবাহের খরচ নেই, আমরা তাকে যাকাত দিব, যা দিয়ে সে বিয়ে করবে, যদিও তার পরিমাণ বেশি হয়। অর্থাৎ সে ফকীর ও মিসকীনদের একজন, যাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ, যদিও তার পানাহার, পরিধান ও বসবাসের ব্যবস্থা রয়েছে।আশ-শারহুল মুমতি‘: যাকাত অধ্যায়।

কয়েকটি জরুরি জ্ঞাতব্য:

১.  প্রতিবেশী, নিকট আত্মীয় ও নেককার ফকীররা অন্যান্য ফকীর থেকে যাকাতের বেশি হকদার, কারণ তাদের সম্পর্কে তুমি জান, তাই তারা বেশি হকদার।

২.  ধনীদের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়, কিন্তু আহলে ইলমগণ ধনীদের দু’টি ভাগ করেছেন:

ক. কতক ধনী আছেন, তাদের জন্য সদকা খাওয়া জায়েয নেই।

খ. আবার কতক ধনী আছেন, তাদের নিজের সম্পদ থেকে যাকাত বের করা ওয়াজিব। দ্বিতীয় প্রকার ধনীরা সবার নিকট পরিচিত, অর্থাৎ যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক তাদের ওপর যাকাত ওয়াজিব, আর যেসব ধনী নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ ও জরুরি খরচ বাবদ প্রয়োজনীয় সম্পদ রাখেন, তাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই, তারা নিসাবের মালিক হোক বা না হোক।

৩. কেউ নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মোতাবেক অর্থ উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করছে, যা তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও দীনি অবস্থান মোতাবেক মানানসই, যেমন আলিম বা নিজের কওমের ভেতর মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি, অতঃপর তার আর্থিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে সে উপযুক্ত পেশা না পেয়ে নিম্নমানের হালাল পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়, যে কারণে সে প্রতিবেশীর নিকট লজ্জিত। এ জাতীয় ধনীকে নিম্নমানের পেশা ত্যাগ করার জন্য যাকাত দেওয়া বৈধ, যতক্ষণ না সে নিজের মর্যাদা মোতাবেক পেশায় যোগ দেয়। যদি তার মর্যাদা ও অবস্থান মোতাবেক হালাল কর্মসংস্থান হয় এবং তা দিয়ে তার নিজের ও পরিবারের জরুরি খরচ মিটে যায়, তখন তার বেকারত্বে বসে থাকা ও যাকাত গ্রহণ করা বৈধ নয়।

৪. মনে করুন কারও উপযুক্ত বাড়ি রয়েছে, যে বাড়িতে থাকা তার জন্য সৌখিনতা ও অপচয় নয় অথবা অর্থ উপার্জন করার উপায় কিংবা ভালো বেতনের চাকুরী রয়েছে, তবে এই পেশা বা চাকুরি দিয়ে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের সামাজিক মর্যাদা মোতাবেক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়, যেমন পূর্বে বলেছি, এমন হালতে তাকে যাকাত দেওয়া বৈধ, যেন সে সামাজিক মর্যাদা মোতাবেক দিন-যাপন করতে সক্ষম হয়।

আল-মাজমু‘: (৬/১৯২)।

ইবন হাযম রহ. বলেছেন: “… যার বাড়ি ও খাদিম আছে তাকেও ওয়াজিব সদকা দেওয়া বৈধ যদি সে মুখাপেক্ষী হয়”। আল-মুহাল্লা: (৬/২২৩)

৫. শাইখ ইবন উসাইমীন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা উপস্থাপন করেছেন: কোনও ব্যক্তি উপার্জন সক্ষম, সে ইলম অর্জন করার জন্য অবসর হতে চায়, কিন্তু তার সম্পদ নেই। তিনি বলেন: এরূপ ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া উচিৎ। অতঃপর তিনি বলেন: কোনও ব্যক্তি কাজ করতে সক্ষম, তবে সে ইবাদত করতে পছন্দ করে, এরূপ ব্যক্তিকে শুধু ইবাদত করার জন্য যাকাত দেওয়া বৈধ নয়। কারণ, ইবাদতের ফায়দা ব্যক্তির ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে, পক্ষান্তরে ইলমের ফায়দা অপর পর্যন্ত পৌঁছে। আশ-শারহুল মুমতি‘: (১/২২১-২২২)।

৬. ফকীরকে যাকাত দেওয়ার পরিমাণ: ফকীরকে কী পরিমাণ যাকাত দিবে তার কোনো সীমা শরী‘আত নির্ধারণ করে দেয় নি, তবে যতটুকু প্রদান করলে সে অভাব মুক্ত হয় ও নিজের প্রয়োজন পেয়ে যায়, সে পরিমাণ দেওয়াই শ্রেয়, কম বা বেশি নির্দিষ্ট সীমা নেই। খাত্তাবি রহ. বলেন: “… যাকাতের পরিমাণ যাকাত গ্রহণকারীর অবস্থা ও জীবিকার ওপর নির্ভর করে, সবার জন্য ধার্য করা নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই, কারণ যাকাত গ্রহণকারী সবার অবস্থা সমান নয়। মা‘আলিমুস সুনান: (১/২৩৯)।

বেশ কয়েকজন ইমাম যেমন ইমাম নববি প্রমুখগণ ফকীরকে যাকাত দেওয়ার পরিমাণ বর্ণনা করেছেন, এখানে তার সারসংক্ষেপ উল্লেখ করছি:

ক. ফকিরের যদি কোনও পেশা থাকে, তার পেশা মোতাবেক তাকে যাকাত দিবে, যেন যাকাত দিয়ে সে নিজের পেশায় উন্নতি লাভ করে স্বাবলম্বী হয়, যেমন তার পেশার আসবাব-পত্র কিনে দিবে, মূল্য যাই হোক। অনুরূপ যাকাত গ্রহণকারী ফকিরের যদি ব্যবসা থাকে, তার ব্যবসার মূলধন পরিমাণ তাকে যাকাত দিবে, অর্থাৎ তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করার মত মাল-পত্র কিনে দিবে, যেন ধীরেধীরে সে পুরো জীবনের জন্যে স্বাবলম্বী হয়। এভাবে একজন গরীব ফকীর থেকে ধনীতে পরিণত হবে, অর্থাৎ যাকাতের কারণে সারা জীবনের জন্য সে অভাব মুক্ত হবে।

খ. যাকাত গ্রহণকারী ফকীর যদি কোনও পেশাদার না হয় অথবা হালাল মাল দিয়ে সামাজিক মর্যাদা মোতাবেক পেশা গ্রহণ করার সামর্থ্য তার না থাকে, তাকে তার নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের এক বছরের খাবার দিবে, যেন পূর্ণ বছরের জন্য তারা অভাব মুক্ত হয়। ভাগ করে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকাত দিবে এক বছর পর্যন্ত, বিশেষভাবে যদি এমন হয় যে, পুরো যাকাত একসাথে দিলে সারা বছর ব্যয় নির্বাহ করা তার পক্ষে অসম্ভব হবে। উল্লেখ্য যে, ফকীরকে যদি কোনও জিনিস দেওয়া হয়, যা দিয়ে তার প্রয়োজন মিটে তাতেও কোনো সমস্যা নেই, যেমন একটি ঘর কিনে দিল, তার ভাড়া দিয়ে সে জীবিকা নির্বাহ করবে।

 

যাকাতের তৃতীয় হকদার:

যাকাতের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ: যাকাতের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা উদ্দেশ্য যাকাত উসুলকারীগণ। অর্থাৎ বিত্তশালীদের নিকট থেকে যাকাত উসুল করার জন্য খলিফা বা তার প্রতিনিধি যাদেরকে নিয়োগ দেন তারাই যাকাত উসুলকারী। অনুরূপ যাকাত সংরক্ষণকারী, অর্থাৎ যারা গুদামে সংরক্ষিত যাকাত রক্ষণা-বেক্ষণ করেন। অনুরূপ যারা গরীবদের মাঝে যাকাত বণ্টন করার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদেরকে যাকাত থেকে দেওয়া বৈধ, যদিও তারা ধনী হয়। এটি তাদের বৈধ হক, যা শরী‘আত তাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, তারা যদি এই হক ত্যাগ করে সমস্যা নেই।

কয়েকটি জ্ঞাতব্য:

১. যাকাত উসুল করার কাজে যারা নিয়োগ পাবে, তারা মানুষের নিকট থেকে যাই গ্রহণ করবে বায়তুলমাল এনে জমা দিবে, যাকাত দাতাদের পক্ষ থেকে তাদের নিজের জন্য হাদিয়া বা উপহার গ্রহণ করা বৈধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আযদ’ গোত্রের সদকা উসুল করার জন্য জনৈক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে ছিলেন, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে কতক মাল নিজের কাছে রেখে দিল এবং বলল: এগুলো আপনাদের জন্য আর এগুলো আমার জন্য হাদিয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেগে গিয়ে বললেন:

“তোমার বাবা-মায়ের ঘরে কেন তুমি বসে থাকনি, তোমার হাদিয়া তোমার নিকট চলে আসত, যদি তুমি সত্যবাদী হও? অতঃপর তিনি বললেন: এমন কেন হয়, আমি তোমাদের কাউকে কোনও কাজে পাঠাই আর সে এসে বলে: এগুলো আপনাদের জন্য আর এগুলো আমার জন্য হাদিয়া? কেন সে তার মায়ের ঘরে বসে থাকে নি, যেন তার হাদিয়া তার কাছেই চলে আসে! সে সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার নফস, তোমাদের যে কেউ অবৈধভাবে যাই গ্রহণ করবে, আল্লাহর সমীপে তা নিয়ে উপস্থিত হবে”।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭১৯৭।

অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে অবৈধভাবে গ্রহণ করা সম্পদ নিয়ে হাজির হবে। অপর হাদীসে তিনি বলেন:

«مَن استعملناه على عملٍ، فرزقناه رزقا – يعني مَنحناهُ راتباً – فما أخَذَهُ بعد ذلك فهو غُلول».

“আমরা যাকে কোন কাজের দায়িত্ব দেই এবং তার প্রাপ্যও তাকে প্রদান করি, (অর্থাৎ তাকে তার বেতন দেই), তারপর সে যা গ্রহণ করবে তাই খিয়ানত”। সহিহুল জামে‘ হাদীস নং ৬০২৩। সেটি হারাম সম্পদ।

আমাদের বর্তমান যুগে ক্রেতার পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় দোকানের লেবারকে যে বখশিশ দেওয়া হয়, এই বকশিশের কারণে যদি বিক্রেতা তথা দোকান মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় তবে সেটি গ্রহণ করা বৈধ নয়, অন্যথায় লেবারের জন্য সেটা গ্রহণ করা বৈধ।

২. যাকাত উসুলকারীদের গুণাবলি:

ক. বিশুদ্ধ মত মোতাবেক যাকাত উসুলকারীর মুসলিম হওয়া জরুরি, কারণ মুসলিমদের থেকে যাকাত উসুল করার অর্থ তাদের ওপর একপ্রকার কর্তৃত্ব করা, যেমন এতে প্রভাব খাটানো, কর্তৃত্ব করা ও বল প্রয়োগ করার ইখতিয়ার থাকে। অতএব, কোনও অমুসলিমকে তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ দেওয়া যায় না।

খ. সাবালক ও বিবেকী হওয়া।

গ. আমানতদার হওয়া।

ঘ. যাকাত উসুল করার যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া। যেমন, সত্যবাদী ও নেককার।
ঙ. যাকাতের বিধান সম্পর্কে ইলম থাকা।

যাকাতের চতুর্থ হকদার:

যাদের অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা জরুরি, তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ। যাদেরকে যাকাত দিলে ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা যাদেরকে যাকাত দিলে ঈমান শক্তিশালী হবে অথবা যাদেরকে যাকাত দিলে মুসলিমদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকবে, তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ, তারা সবাই এই খাতের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য যে, ইয়াহূদি-খ্রিস্টান ধর্ম থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তারাও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম যুহরি রহ.কে: وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বললেন: “ইয়াহূদী-খ্রিস্টান ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণকারীগণ। তাকে প্রশ্ন করা হল: যদি তারা ধনী হয়? তিনি বললেন: যদিও ধনী হয়”।ইবন আবি শায়বাহ: (৩/২২৩)

উল্লেখ্য যে, এই খাতের উদ্দেশ্য ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি ও তার মর্যাদা রক্ষা করা। আরেকটি বিষয়, এই খাত থেকে কাকে ও কী পরিমাণ যাকাত দেওয়া হবে সেটি নির্ভর করে খলিফার ওপর, তিনি কখনো এই খাতের প্রয়োজন মনে করতে পারেন, আবার কখনো নাও করতে পারেন। যখন তিনি দেখবেন যে, ইসলামের শক্তি ও সামর্থ্য যথেষ্ট হয়েছে, এখন তোষামোদ করে কাউকে ইসলামে দাখিল করা বা যাকাত দিয়ে কারও অনিষ্ট থেকে সুরক্ষা লাভ করার প্রয়োজন নেই।শাইখ আদিল আয্যাযী বলেন: “এই যুগে যারা ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তাদের অন্তর ধাবিত করার জন্য অথবা মুসলিমদের ওপর থেকে অনিষ্ট দূর করার জন্য অথবা সংখ্যালঘু মুসলিমদের সুরক্ষা ও তাদের দীনকে নিরাপদ রাখার জন্য অথবা এ জাতীয় আরও খাত যাকাতের জন্য খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ, শত্রুরা বর্তমান মুসলিমদের ওপর একযুগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।যাকাতের পঞ্চম হকদার:

গোলাম মুক্ত করা: আরবি رقاب শব্দটি বহুবচন, একবচন رقبة যার অর্থ দাস-দাসী। আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী “وفي الرقاب” দ্বারা উদ্দেশ্য দাস-দাসীকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। আয়াতের উদ্দেশ্য দাস-দাসীকে সম্পদ দেওয়া নয়, বরং তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা উদ্দেশ্য। এই খাত নিম্নের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন,

১. চুক্তিবদ্ধ দাস-দাসী: যেসব দাস-দাসী নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কিস্তি হিসেবে পরিশোধ করার শর্তে নিজেদেরকে তাদের মনিব থেকে খরিদ করে নিয়েছে, তাদের কিস্তি পরিশোধ করার জন্য যাকাত দিয়ে সাহায্য করা বৈধ। যাকাতের অর্থ তাদেরকে অথবা তাদের পক্ষ থেকে মনিবকে সরাসরি দেওয়া বৈধ। তাদের জানা জরুরি নয়, দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়াই যথেষ্ট।

২. দাস-দাসী খরিদ করে মুক্ত করা وفي الرقاب এর অন্তর্ভুক্ত।

৩. বিশুদ্ধ মত মোতাবেক মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করার জন্য যাকাত থেকে ব্যয় করা যাবে, যারা শত্রুদের হাতে বন্দী। কারণ, দাস মুক্ত করার জন্য যদি যাকাত বৈধ হয়, মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করার জন্য যাকাত বৈধ হবে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, তাদের মুসিবত বড়।

যাকাতের ষষ্ঠ হকদার:

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: আরবী غارمون বহুবচন, একবচন হচ্ছে غارم অর্থাৎ ঋণগ্রস্ত মুসলিম। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি দু’প্রকার:

এক. মানুষের মাঝে সুসম্পর্ক পুণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য খরচ করে যিনি ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। যেমন কেউ বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঝগড়া বিবাদের মীমাংসার জন্য নিজের জিম্মাদারীতে কিছু সম্পদের দায়িত্ব গ্রহণ করে যাতে সম্পদ প্রদান করতে হয়। যেমন এক পক্ষকে কিছু টাকা দিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া। অথবা যদি এমন কোনো নগদ টাকা ব্যয় করে খাবারের আয়োজন করে যাতে উভয় বিবদমান পক্ষকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মাঝে মীমাংসা করার ব্যবস্থা করা হয়। অথবা উভয় বিবদমান গোষ্ঠীর জন্য হাদীয়া ক্রয় ও তা প্রদানের মাধ্যমে সম্প্রীতির ব্যবস্থা করে দেওয়া। সুতরাং যারা এ কাজ করার জন্য ঋণ করবে তারা ধনী হলেও তাদেরকে যাকাতের সম্পদ দেওয়া যাবে এ কাজকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়ার জন্য।

দুই. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: অর্থাৎ যে নিজের প্রয়োজনে ঋণ করেছে, যেমন অভাব অথবা চিকিৎসা অথবা পোশাক-পরিচ্ছদ অথবা বিবাহ অথবা ঘরের আসবাব-পত্র কেনার জন্য ঋণ করেছে, (পুরনো ফার্নিচার নতুন করার জন্য ঋণ করলে এই খাতের অন্তর্ভুক্ত হবে না)। অনুরূপ যার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে সেও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত, যেমন অগ্নিকাণ্ড অথবা জলোচ্ছ্বাস অথবা মাটিতে ধসে যাওয়া ইত্যাদি। এই খাতের জন্য কয়েকটি শর্ত:

১. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করতে সামর্থ্য নয়, যদিও তার নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনীয় সম্পদ তার রয়েছে। অথবা তার ব্যবসা রয়েছে, যার উপার্জন দিয়ে তার ও পরিবারের খরচ মিটে, কিন্তু জরুরি প্রয়োজন শেষে ঋণ পরিশোধ করার কোনও অর্থ থাকে না, এরূপ ব্যক্তিদের ঋণ যাকাতের অর্থ থেকে পরিশোধ করা বৈধ। যদি সে ঋণের একাংশ পরিশোধ করতে সক্ষম হয় অবশিষ্টাংশ ঋণ পরিশোধ করার জন্য তাকে যাকাত দিবে।

২. বৈধ কাজে ঋণীরাই যাকাতের হকদার, যে পাপের কাজে ঋণী হবে সে যাকাত পাবে না। যদি সে তওবা করে এবং সত্যিকার তাওবার আলামত তার ভেতর স্পষ্ট হয়, তবে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে। অনুরূপ কেউ যদি বৈধ কাজে ইসরাফ করে অর্থাৎ প্রয়োজনের বেশি খরচ করে ঋণগ্রস্ত হয় তাকেও যাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ وَلَا تُسۡرِفُوٓاْۚ ٣١﴾ [الأعراف: 31]

“খাও এবং পান কর, তবে অপচয় কর না”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩১]

জ্ঞাতব্য যে, ঋণের টাকা ঋণগ্রস্ত অথবা পাওনাদার যাকেই দিবে যাকাত আদায় হবে। যদি আশঙ্কা হয়, ঋণগ্রস্ত ঋণ পরিশোধ না করে যাকাতের টাকা নষ্ট করে ফেলবে, তাহলে সরাসরি পাওনাদারকে দেওয়াই উত্তম।

যাকাতের সপ্তম হকদার:

ফী সাবীল্লিাহ বা আল্লাহর রাস্তার যাত্রীগণ: আল্লাহর রাস্তা দ্বারা উদ্দেশ্য জিহাদ। অতএব, মুজাহিদ ও মুজাহিদদের অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য যাকাত খরচ করবে, যদিও তারা ধনী হয়। অতএব, গোলাবারুদ ও অস্ত্র-শস্ত্র খরিদ করা, যুদ্ধের বিমান ঘাটি তৈরি করা, শত্রুদের সন্ধান দাতার বেতন ইত্যাদি এই খাতের অন্তর্ভুক্ত। এটি শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলীদের মাযহাব, তবে শাফেঈ ও হাম্বলীগণ শর্ত করেছেন: মুজাহিদদের স্বেচ্ছাসেবক হওয়া জরুরি, অর্থাৎ যাদের জন্য সরকারি বেতন-ভাতা বরাদ্দ নেই। আর হানাফীরা في سبيل الله এর ক্ষেত্রে অনেক ব্যাপকতা আরোপ করেছে, তাদের নিকট কল্যাণকর প্রত্যেক খাতে যাকাত ব্যবহার করা বৈধ, তাদের মাযহাবটি খুব দুর্বল। অধিকাংশ আলিমের মাযহাব-ই বিশুদ্ধ।

আরেকটি প্রসঙ্গ: ইবন উমার ও ইবন আব্বাস এবং ইমাম আহমদ, হাসান, ইসহাক ও শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া প্রমুখগণ বলেন: হজ এই খাতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, হজ আল্লাহর রাস্তায় এক প্রকার জিহাদ, যেমন হাদীসে প্রমাণিত:

«أفضلَ الجهاد حَجٌّ مبرور».

“সর্বোত্তম জিহাদ মাবরুর হজ”। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫২০।

ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইসলামের ফরয হজ করে নি অভাবের কারণে, তাকে হজ করার পরিমাণ যাকাত দেওয়া বৈধ”।

‘ফি সাবিলিল্লাহ’ যেহেতু বিশুদ্ধ মতে কেবল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকেই বুঝায়, সেহেতু মসজিদ তৈরি, রাস্তা সংস্কার ও কিতাব ছাপানোর জন্য যাকাত খরচ করা বৈধ নয়, বরং তার জন্য অন্যান্য খাত থেকে খরচ করবে, যেমন ওয়াকফ, হেবা, ওসিয়ত ও সদকা ইত্যাদি।

যাকাতের অষ্টম হকদার:

ইবনুস সাবিল বা মুসাফির: ইবনুস সাবিল অর্থ মুসাফির, অর্থাৎ যার রাহ খরচ নেই। রাহ খরচ হারিয়ে গেছে অথবা ফুরিয়ে গেছে অথবা কোনও বিপদের কারণে তার অর্থ প্রয়োজন। এরূপ ব্যক্তিকে সফর পূর্ণ করে দেশে ফিরার জন্য যাকাত দেওয়া বৈধ, যদিও সে নিজ দেশে ধনী।

নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

১. যাকাতের হকদার হওয়ার জন্য মুসাফিরের সফর শর‘ঈ অথবা বৈধ হওয়া জরুরি, যদি পাপের সফর হয়, যাকাতের হকদার হবে না, যদি তাওবা করে অবশিষ্ট সফরের জন্য প্রয়োজন মোতাবেক তাকে যাকাত দেওয়া বৈধ। কারণ, তাওবা ঘোষণার পর থেকে তার সফর বৈধ।

২. সফরের ইচ্ছা পোষণকারীকে যাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে কি না, আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন। যেমন, কেউ কাজের সন্ধানে অথবা বৈধ কারণে সফর করতে চায়, কিন্তু তার অর্থ নেই। শাফে‘ঈ মতাবলম্বীরা বলেন তাকে যাকাত দেওয়া বৈধ, অন্যান্য আলিমগণ বলেন: তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না, কারণ ‘ইবনে সাবিল’ বা মুসাফির ভিনদেশী ব্যতীত কাউকে বুঝায় না। এটি বিশুদ্ধ মত। এখানে একটি কথা বলা যায়, ফকীর ও মিসকীনদের অংশ থেকে তাকে যাকাত দেওয়া বৈধ, যদি সে গরীব হয়, যা যাকাতের একটি খাত।

৩. বিশুদ্ধ মতে ইবন সাবিল বা মুসাফিরকে যদি ঋণ দেওয়ার মতো লোক থাকে, তবুও তাকে যাকাত দেওয়া বৈধ, তার জন্যও যাকাত নেওয়া বৈধ, যদি আগেই ঋণ নিয়ে নেয়, যাকাত নিয়ে সে তার ঋণ পরিশোধ করবে।

জরুরি জ্ঞাতব্য:

যেসব মুসলিম অত্যাচারী শাসকের ভয় বা কোনও কারণে নিজ দেশ থেকে অপর দেশে শরণার্থী হয়, তাদেরকে যাকাত দিয়ে সাহায্য করা জরুরি, যদি তাদের প্রয়োজন হয়। তারা ফকীর-মিসকিন বা ইবন সাবিল বা ঋণগ্রস্ত ইত্যাদি খাতের অন্তর্ভুক্ত।