“মধ্যপন্থি জাতি” বলতে কি বুঝায়

মধ্যপন্থী’ উম্মাত

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে-

আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মাতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা দুনিয়াবাসীদের ওপর সাক্ষী হতে পারো এবং রসূল হতে পারেন তোমাদের ওপর সাক্ষী ৷সূরা বাকারাঃ১৪৩

মহান আল্লাহতা’আলার এই বানীটিকে অনেকেই অপব্যবহার করে থাকে, যেমন সূরা কাফিরুনের “তোমাদের দীন তোমাদের জন্য এবং আমার দীন আমার জন্য” আয়াতের বেলায় হয়ে থাকে।

 

অনেকে সমাজের পারিপার্শিক অবস্থা, যুগের প্রযুক্তির উন্নয়ন ও অপসাংস্কৃতিক জীবন ধারার মাঝে নিজেদেরকেও মানিয়ে নিতে, স্বাচ্ছন্দবোধ করতে, তথাকথিত শান্তিপূর্ন জীবন যাপনের লেবাসে এই মধ্যপন্থি শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, তাতে যেনো দ্বীনী যিন্দেগীদের সাথেও থাকা যায় ও প্রচলিত তাগুদের পরিবেশেও তাল মিলিয়ে চলা যায়। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

মধ্যপন্থা মানেই যদি তাল মিলিয়ে চলা বা কিছু ছাড় দিয়ে সমঝোতায় নিজেকে উন্নীত করা হতো, তাহলে আল্লাহর রাসুল সা কাফেরদের প্রস্তাবের সাথে একাত্ম হয়ে আরামে দ্বীনী যিন্দেগীটাকে কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু যুগে যুগে নবী রাসুল বা ইমানদারদের যিন্দেগি কিন্তু তা বলে না, কারন মহান আল্লাহর সুন্নাহ এটা নয়।

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«يُدْعَى نُوحٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَقُولُ: لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ يَا رَبِّ, فَيَقُولُ: هَلْ بَلَّغْتَ؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ، فَيُقَالُ لِأُمَّتِهِ: هَلْ بَلَّغَكُمْ؟ فَيَقُولُونَ: مَا أَتَانَا مِنْ نَذِيرٍ، فَيَقُولُ: مَنْ يَشْهَدُ لَكَ؟ فَيَقُولُ: مُحَمَّدٌ وَأُمَّتُهُ, فَتَشْهَدُونَ أَنَّهُ قَدْ بَلَّغَ -وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا- فَذَلِكَ قَوْلُهُ جَلَّ ذِكْرُهُ: ﴿وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ﴾ (وَالْوَسَطُ الْعَدْلُ».

 

“কিয়ামতের দিন নূহ আলাইহিস সালামকে ডাকা হবে, তিনি বলবেন: সদা উপস্থিত, আপনার সন্তুষ্টি বিধানে আমি সদা তৎপর হে আমার রব, তিনি বলবেন: তুমি পৌঁছিয়েছ? তিনি বলবেন: হ্যাঁ, তার উম্মতকে বলা হবে: সে তোমাদের পৌঁছিয়েছে? তারা বলবে: আমাদের নিকট কোনো সতর্ককারী আসে নি। তিনি বলবেন: তোমার জন্য কে সাক্ষী দিবে? তিনি বলবেন: মুহাম্মাদ ও তার উম্মত, অতঃপর তারা সাক্ষ্য দিবে যে, নিশ্চয় তিনি পৌঁছিয়েছেন, আর রাসূল হবেন তোমাদের সাক্ষী। এ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

 

﴿وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ ١٤٣﴾ [البقرة: ١٤٣] ( وَالْوَسَطُ الْعَدْلُ».

“আর এভাবেই আমরা তোমাদেরকে মধ্যপন্থী ‎উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর ‎সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ‎রপর”। [সূরা আল-বাকারাহ: ১৪৩] ওয়াসাত অর্থ ইনসাফপূর্ণ পথ বা মধ্যমপন্থার অনুসারী”। (সহীহ বুখারী, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ) হাদীসটি সহীহ।

কুরআনে আমাদেরকে ‘গুলু’ তথা বাড়াবাড়ি করার ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। এটা উগ্রপন্থার পরিচায়ক। কুরআনে একে চরম মন্দ কাজ হিসেবে বিবেচনা করে বলা হয়েছে,

لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ

“তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না।” (সূরা নিসা ৪:১৭১, সূরা মায়েদা ৫:৭৭)

গোঁড়ামি ও চরমপন্থা শব্দ দু’টি সামনে আসলে বনি ইসরাইল জাতির ইতিহাস হৃদয়পটে ভেসে উঠে। এ জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গোঁড়ামি ও চরমপন্থা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বনি ইসরাইলদের হিদায়াতের জন্য অসংখ্য নবী ও রাসূল পাঠিয়েছিলেন এবং পৃথিবীবাসীর নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করে আল্লাহ তায়ালা তাদের ইতিহাসকে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বনি ইসরাইল! আমার সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদের দান করেছিলাম এবং এ কথাটিও যে আমি দুনিয়ার সমস্ত জাতির ওপর তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম’ (সূরা বাকারা-৪৮)।

পৃথিবীর ইতিহাসের এক দীর্ঘকালব্যাপী তারা এ নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু গোঁড়ামি ও চরমপন্থার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে নেতৃত্বের আসন থেকে অপসারিত করে মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে ‘উম্মতে মুহাম্মদ সা:-এর হাতে নেতৃত্বের দণ্ড তুলে দিলেন। আল কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ইসরাইল জাতির গোঁড়ামির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

কুরআনে ‘ওয়াসাতিয়া’ তথা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। তাই বলে এটা ইসলাম অনুসরণের ব্যাপারে গাফলতি নয়। যদিও কেউ কেউ ভুলবশত এমনটা মনে করতে পারে।আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের চিত্র সামনে রাখলেই এর নমুনা পাওয়া যায়।মনগড়া নীতি বানিয়ে সেটাকে মধ্যম পন্থা বানালেই কুর’আনের আয়াতের বাস্তবায়ন দূরে থাক বরং এটাও হয়ে যাবে চরমপন্থা। আর এটাও একটি কারন, বনী ইসরাইল জাতি নেতৃত্ব হারিয়েছে। কেবলা সংক্রান্ত সূরা বাকারার নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّ‌سُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا

“এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবজাতির জন্যে এবং যাতে রাসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।” (সূরা বাকারা ২:১৪৩)

আমারদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত হিসেবে আল্লাহ পাঠিয়েছেন। এই আয়াতে বর্ণিত ‘ওয়াসাতান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে– যথাযথ ভারসাম্যপূর্ণতা, বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্য প্রদর্শনের মাঝামাঝি অবস্থান, মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ইত্যাদি। নিছক রাজনৈতিক অর্থে মধ্যপন্থা নয়, বরং ওয়াসাতিয়ার আলোকে মধ্যপন্থা। এর পেছনে যথার্থ কারণ রয়েছে। তাহলো আমরা যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়াই, যেভাবে মহানবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের নিকট সাক্ষ্য হিসেবে প্রেরিত। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার।

মধ্যমপন্থী উম্মত’ শব্দটি অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্যের অধিকারী। এর অর্থ হচ্ছে- এমন একটি উৎকৃষ্ট ও উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন দল, যারা নিজেরা ইনসাফ, ন্যায়-নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দুনিয়ার জাতিদের মধ্যে যারা কেন্দ্রীয় আসন লাভের যোগ্যতা রাখে, সত্য ও সততার ভিত্তিতে সবার সাথে যাদের সম্পর্ক সমান এবং কারো সাথে যাদের কোনো অবৈধ ও অন্যায় সম্পর্ক নেই।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

سددوا وقاربوا واغدوا وروحوا وشيء من الدلجة والقصد، القصد تبلغوا

তোমরা আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, বাড়াবাড়ি করো না। সকাল-সন্ধ্যায় (ইবাদতের জন্য) বের হয়ে পড় এবং রাতের কিছু অংশেও। তোমরা অবশ্যই পরিমিতি রক্ষা করো। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৪৬৩)

বিখ্যাত তাবেঈ মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর পুত্রকে লক্ষ করে বলেছিলেন, বাছা! পুণ্য হচ্ছে দুই পাপের মাঝখানে অর্থাৎ শৈথিল্য ও বাড়াবাড়ির মাঝখানে। সবকিছুর মধ্যাবস্থাই সেরা। সেই গতি অতি মন্দ, যার তীব্রতা বাহনকে ধ্বংস করে (উয়ূনুল আখবার, খ. ১,

মধ্যম জাতি হিসেবে মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের কথা আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন-

‘রহমানের (প্রকৃত) বান্দাহ তারা- যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রতার সাথে চলাফেরা করে, আর জাহেল লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে এলে বলে দেয় যে, তোমাদের সালাম।

যারা নিজেদের রবের নিকট সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকে রাত এবং যারা এই বলে দোয়া করে যে, হে আমাদের রব, জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করো। জাহান্নামের আজাব তো প্রাণান্তকর লেগে থাকে। নিশ্চয়ই বিশ্রামস্থল এবং বাসস্থান হিসেবে তা অত্যন্ত জঘন্য এবং যারা খরচের বেলায় বেহুদা খরচ কিংবা কার্পণ্য করে না; বরং দু’সীমার মাঝামাঝি মধ্যম নীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে’ (সূরা ফুরকান- ৬৩-৬৭)।

‘তোমার চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর খাটো করো (সূরা লোকমান-১৯)।

লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না, আর গর্বভরে জমিনে হাঁটাচলা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো আত্ম-অহঙ্কারী, দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না’ (সূরা লোকমান- ১৮)।

সুতরাং মুসলমান কখনো গোঁড়ামি ও চরমপন্থা অথবা অতি উদার নীতি কখনো গ্রহণ করতে পারে না। তাই মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে আমাদের কথা ও কাজে গোঁড়ামি ও চরমপন্থা ও অতি উদারতাকেও পরিহার করতে হবে এবং ন্যায় ও ইনসাফের জন্য অগ্রসর হতে হবে।

আলাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোনো দলের শত্রুতা তোমাদের যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয়, যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো। এটি আল্লাহভীতির সাথে বেশি সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার খবর রাখেন’ (সূরা মায়েদা-৮)।

আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপ্স মধ্যপন্থি সম্পর্কে বলেছেন-

এই মধ্যপন্থী বা ন্যায়পরায়ণ জাতির ধারণাটি আমরা কুরআনের সর্বত্র দেখতে পাই: যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে ন্যায়বিচারের আদেশ দেন; যখন ধর্মের ক্ষেত্রে চরমপন্থা বর্জনের, ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাহুল্য বর্জনের কিংবা জীবনের কোন ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেন।

নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে৷  বনী ইসরাইল:২৯

হে নবী ! এদেরকে বলে দাও, আল্লাহ বা রহমান যে নামেই ডাকো না কেন, তাঁর জন্য সবই ভালো নাম৷  আর নিজের নামায খুব বেশী উচ্চ কণ্ঠেও পড়বে না, বেশী ক্ষীণ কণ্ঠেও না, বরং এ দুয়ের মাঝামাঝি মধ্যম পর্যায়ের কণ্ঠস্বর অবলম্বন করবে৷ বনী ইসরাইল:১১০

তাই মুসলিম উম্মাহর পথকে অন্যান্যদের থেকে পার্থক্য করা যায়। এই পথ ডানে বা বামে ঝুঁকে পড়েনা, কোন চরম অবস্থানে চলে যায়না।

ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বালুতে একটি সরলরেখা টানলেন এবং এর ডানে ও বামেও রেখা টানলেন। তিনি প্রথম রেখার দিকে নির্দেশ করে বললেন, এটি তাঁর পথ, সরল পথ। ডানের ও বামের পথ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। ডান ও বামের পথের প্রতিটির মাথায় অবস্থিত শয়তান, লোকদের সেসব পথের দিকে ডাকে।

এই যে পথ বেছে নেওয়া হলো যাতে কোন বাড়াবাড়ি নেই, তা এই উম্মাহর জন্য বিশিষ্ট। বিশিষ্ট এই জন্য যে, ইসলামের বাণী সর্ম্পকে যারা জানতে চায়, তাদের জন্য এখনও তা সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। এজন্য একে বিশিষ্ট বলা হয়নি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কেবল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই এই পথে চলতে আদশে করেছিলেন, এই পথে মানুষকে ডাকতে বলেছিলেন; প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সকল নবীই এ পথের প্রতি আহবান করেছেন। কিন্তু তাদের (পূর্ববর্তী নবীদের) বাণীর বিকৃতির কারণে, বর্তমানে কেবল চরমপন্থাই অবশিষ্ট রয়েছে যেমন ইহুদী ও খ্রীস্টান ধর্ম।

মূসা ও ঈসা (আ) যে মধ্যপথ শিখিয়ে গেছেন, তা এখন বিলুপ্ত হয়েছে। তাই শুধুমাত্র এই শেষ উম্মতই মধ্যপথ অবলম্বন করে রয়েছে। খ্রীস্টানরা বিশ্বাস করে ঈসা (আ.) ঈশ্বর। তারা ঈসাকে (আ.) স্বর্গীয় মর্যাদায় উন্নীত করেছে, তাঁকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছে। ইহুদীরা তাকে অবৈধ সন্তানের কাতারে নামিয়েছে। এই দুটোই চরম অবস্থান। ইসলামই ঈসার (আ.) প্রকৃত পরিচয় রক্ষা করেছে – তিনি আল্লাহর একজন মহান নবী, কুমারী মাতা থেকে তাঁর জন্ম, তিনি ঈশ্বর নন, তাঁর কোন ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিলনা। সন্দেহাতীতভাবে এই শিক্ষাই তিনি দিয়েছিলেন। অন্যরা এর পরিবর্তন করে বিকৃতিতে পৌঁছে গেছে।

তাদের অন্যান্য বিশ্বাসের বেলাও এরকম দেখা যায়। ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে খ্রীস্টানরা জিব্রাইলকে (আ.) আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছে, তাকে তারা বলে ”পবিত্র আত্মা”। অপরদিকে ইহুদীরা কিছু ফেরেশতাকে শয়তানের পর্যায়ে অবনমিত করেছে। তাদের মতে শয়তানরা অধঃপতিত ফেরেশতা, যারা আল্লাহকে অমান্য করেছিল। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরেশতারা আল্লাহকে অমান্য করেনা, আবার তাদের কোন ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতাও নেই।

তাফসিরে যাকারিয়া ব্যাখ্যাঃ

وَسَطًا শব্দের অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়। আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম عدل শব্দ দ্বারা وسط এর ব্যাখ্যা করেছেন। [বুখারী: ৭৩৪৯] এর অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট। আবার وسط অর্থ হয় মধ্যবর্তী, মধ্যপন্থী। সে হিসাবে এ আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করা হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী, ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে যে, মানবীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। যে উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের যাবতীয় কর্মধারা অব্যাহত রয়েছে এবং নবী ও আসমানী গ্রন্থসমূহ প্রেরিত হয়েছে, তাতে এ সম্প্রদায় অপরাপর সম্প্রদায় থেকে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ও শ্রেষ্ঠ। কুরআন বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করেছে।

বলা হয়েছে, আর আমরা যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় রয়েছে, যারা সৎপথ প্রদর্শন করে এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। [সূরা আল-আরাফ: ১৮১] এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্য আলোচিত হয়েছে যে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আসমানী গ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী নিজেরাও চলে এবং অন্যদেরকেও চালাবার চেষ্টা করে। কোন ব্যাপারে কলহ-বিবাধ সৃষ্টি হলে তার মীমাংসাও তারা গ্রন্থের সাহায্যেই করে, যাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের স্বার্থপরতার কোন আশংকা নেই। অন্য সূরায় মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ভারসাম্য এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ তোমরাই সে কাজের আদেশ করবে, মন্দকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে। [সূরা আলে-ইমরান: ১১০] অর্থাৎ মুসলিমরা যেমন সব নবীর শ্রেষ্ঠতম নবীপ্রাপ্ত হয়েছে, সব গ্রন্থের সর্বাধিক পরিব্যপ্ত ও পূর্ণতর গ্রন্থ লাভ করেছে, তেমনি সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুস্থ মেজাজ এবং ভারসাম্যও সর্বাধিক পরিমাণে প্রাপ্ত হয়েছে।

ফলে তারাই সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় সাব্যস্ত হয়েছে। তাদের সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তত্ত্ব-রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ঈমান, আমল ও আল্লাহ ভীতির সমস্ত শাখাপ্রশাখা ত্যাগের বদৌলতে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠবে। তারা কোন বিশেষ দেশ ও ভৌগলিক সীমার বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে না। তাদের কর্মক্ষেত্র হবে সমগ্র বিশ্ব এবং জীবনের সকল শাখায় পরিব্যপ্ত। তাদের অস্তিত্বই অন্যের হিতাকাংখা ও তাদেরকে জান্নাতের দ্বারে উপনীত করার কাজে নিবেদিত। এ সম্প্রদায়টি গণমানুষের হিতাকাংখা ও উপকারের নিমিত্তই সৃষ্ট। তাদের অভীষ্ট কর্তব্য ও জাতীয় পরিচয় এই যে, তারা মানুষকে সৎকাজের দিকে পথ দেখাবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকেও মুসলিম জাতি এক ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে রয়েছে, ঈমানের ভারসাম্য। পূর্ববতী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা নবীগণকে আল্লাহর পুত্ৰ মনে করে তাদের উপাসনা ও আরাধনা করতে শুরু করেছে। যেমন, এক আয়াতে রয়েছেঃ ইয়াহুদীরা বলেছে, ওযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলেছে, মসীহ আল্লাহর পুত্র। [সূরা আত-তাওবাহঃ ৩০]

অপরদিকে এসব সম্প্রদায়েরই অনেকে নবীর উপর্যুপরি মু’জিযা দেখা সত্বেও তাদের নবী যখন তাদেরকে কোন ন্যায়যুদ্ধে আহবান করেছেন, তখন তারা পরিস্কার বলে দিয়েছে, আপনি এবং আপনার পালনকর্তাই যান এবং শক্রদের সাথে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব সূরা আল-মায়েদাহ: ২৪] আবার কোথাও নবীগণকে স্বয়ং তাদের অনুসারীদেরই হাতে নির্যাতিত হতে দেখা গেছে। পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা তা নয়। তারা একদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এমন আনুগত্য ও ভালবাসা পোষণ করে যে, এর সামনে জান-মাল, সন্তান-সন্ততি, ইজ্জত-আব্রু সবকিছু বিসর্জন দিতেও কুষ্ঠিত হয় না। অপরদিকে রাসূলকে রাসূল এবং আল্লাহকে আল্লাহই মনে করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা আল্লাহর দাস ও রাসূল বলেই বিশ্বাস করে এবং মুখে প্রকাশ করে। তার প্রশংসা এবং গুণগান করতে গিয়েও তারা একটা সীমার ভেতর থাকে।

তাছাড়া মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে, কর্ম ও ইবাদাতের ভারসাম্য। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা শরীআতের বিধি-বিধানগুলোকে কানাকড়ির বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, ঘুষ-উৎকোচ নিয়ে আসমানী গ্রন্থকে পরিবর্তন করে অথবা মিথ্যা ফতোয়া দেয়, বাহানা ও অপকৌশলের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পরিবর্তন করে এবং ইবাদাত থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। অপরদিকে তাদের উপাসনালয়সমূহে এমন লোকও দেখা যায়, যারা সংসারধর্ম ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বন করেছে। তারা আল্লাহ প্রদত্ত হালাল নেয়ামত থেকেও নিজেদের বঞ্চিত রাখে এবং কষ্ট সহ্য করাকেই সওয়াব ও ইবাদাত বলে মনে করে। পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায় একদিকে বৈরাগ্যকে মানবতার প্রতি যুলুম বলে মনে করে এবং অপরদিকে আল্লাহ ও রাসূলের বিধি-বিধানের জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও কুন্ঠা বোধ করে না। অনুরূপভাবে তাদের মধ্যে রয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য।

পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা মানবাধিকারের প্রতি পরোয়াও করেনি; ন্যায়-অন্যায়ের তো কোন কথাই নেই। মহিলাদের অধিকার দান করা তো দূরের কথা, তাদের জীবিত থাকার অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হত না। কোথাও প্রচলিত ছিল শৈশবেই তাদের জীবন্ত সমাহিত করার প্রথা এবং কোথাও মৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীকে দাহ করার প্রথা। অপরদিকে এমন নির্বোধ দয়াদ্রতারও প্রচলন ছিল যে, পোকামাকড় হত্যা করাকেও অবৈধ জ্ঞান করা হত। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীআত এসব ভারসাম্যহীনতার অবসান ঘটিয়েছে। তারা একদিকে মানুষের সামনে মানবাধিকারকে তুলে ধরেছে। শুধু শান্তি ও সন্ধির সময়ই নয়, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও শক্রর অধিকার সংরক্ষণে সচেতনতা শিক্ষা দিয়েছে। অপরদিকে প্রত্যেক কাজের একটা সীমা নির্ধারণ করেছে, যা লংঘন করাকে অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। তদ্রুপভাবে তাদের মধ্যে রয়েছে, অর্থনৈতিক ভারসাম্য।

অর্থনীতিতে অপরাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তর ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা। এতে হালাল-হারাম এবং অপরের সুখ-শান্তি ও দুঃখদুরাবস্থা থেকে চক্ষু বন্ধ করে অধিকতর ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকেই সর্ববৃহৎ মানবিক সাফল্য গণ্য করা হয়। অপরদিকে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। এতে ব্যক্তি মালিকানাকেই অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীআত এক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ অভিনব অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। ইসলামী শরীআত একদিকে ধন-সম্পদকে জীবনের লক্ষ্য মনে করতে বারণ করেছে এবং সম্মান, ইজ্জত ও পদমর্যাদা লাভকে এর উপর নির্ভরশীল রাখেনি; অপরদিকে সম্পদ বন্টনের নিষ্কলুষ নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছে যাতে কোন মানুষ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত না থাকে এবং কেউ সমগ্র সম্পদ কুক্ষিগত করে না বসে। এছাড়া সম্মিলিত মালিকানাভুক্ত বিষয়-সম্পত্তিকে যৌথ ও সাধারণ ওয়াকফের আওতায় রেখেছে। বিশেষ বস্তুর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। হালাল মালের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছে এবং তা রাখার ও ব্যবহার করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।

 

(২) এ আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় জানা গেল, ১. মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারসাম্যপূর্ণ তথা ন্যায়ানুগ করা হয়েছে যাতে তারা সাক্ষাদানের যোগ্য হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি আদেল বা ন্যায়ানুগ নয়, সে সাক্ষ্যদানেরও যোগ্য নয়। আদেলের অর্থ সাধারণতঃ নির্ভরযোগ্য করা হয়। ২. ইজমা শরীআতের দলীল। ইমাম কুরতুবী বলেনঃ ইজমা (মুসলিম আলেমদের ঐক্যমত) যে শরীআতের একটি দলীল, আলোচ্য আয়াতটি তার প্রমাণ। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা এ সম্প্রদায়কে সাক্ষ্যদাতা সাব্যস্ত করে অপরাপর সম্প্রদায়ের বিপক্ষে তাদের বক্তব্যকে দলীল করে দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ সম্প্রদায়ের ইজমা বা ঐকমত্যও একটি দলীল এবং তা পালন করা ওয়াজিব।

(৩) এ উম্মাত হাশরের ময়দানে একটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে। সকল নবীর উম্মতরা তাদের হিদায়াত ও প্রচারকার্য অস্বীকার করে বলতে থাকবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী গ্রন্থ পৌছেনি এবং কোন নবীও আমাদের হেদায়াত করেননি। তখন মুসলিম সম্প্রদায় নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে উপস্থিত হবে এবং সাক্ষ্য দেবে যে, নবীগণ সর্বযুগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আনীত হিদায়াত তাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন। একাধিক হাদীসে সংক্ষেপে ও সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা নূহ আলাইহিস সালাম-কে ডেকে বলবেন, হে নূহ আপনি কি আমার বাণী লোকদের কাছে পৌছিয়েছেন? তিনি বলবেন, হ্যাঁ।

তখন তার উম্মতকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমাদের কাছে কি তিনি কিছু পৌছিয়েছেন? তারা বলবে, আমাদের কাছে কোন সাবধানকারী আসেনি। তখন আল্লাহ বলবেনঃ হে নূহ আপনার পক্ষে কে সাক্ষ্য দেবে? তিনি বলবেন, মুহাম্মাদ ও তার উম্মত। তখন তারা সাক্ষ্য দেবে যে, নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর বাণী লোকদের কাছে পৌছিয়েছেন। আর রাসূল তখন তোমাদের সত্যতার উপর সাক্ষ্য দেবেন। এটাই হলো আল্লাহর বাণীঃ “এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর স্বাক্ষী হও এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারেন।” [বুখারীঃ ৪৪৮৭]

তাফহিমুল কুর’আন ব্যাখ্যাঃ

টি হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের নেতৃত্বের ঘোষণাবানী৷ ‘এভাবেই’শব্দটি সাহায্যে দু’দিকে ইংগিত করা হয়েছে ৷ এক:আল্লাহর পথপ্রদর্শনের দিকে ইংগিত করা হয়েছে৷ যার ফলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগত্যকারীরা সত্য-সরল পথের সন্ধান পেয়েছে এবং তারা উন্নতি করতে করতে এমন একটি মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে যেখানে তাদেরকে ‘মধ্যপন্থী উম্মাত’ গণ্য করা হয়েছে ৷ দুই: এ সাথে কিব্‌লাহ পরিবর্তনের দিকেও ইংগিত করা হয়েছে ৷ অর্থাৎ নির্বোধরা একদিক থেকে আর একদিকে মুখ ফিরানো মনে করছে ৷ অথচ বাইতুল মাকদিস থেকে কা’বার দিকে মুখ ফিরানোর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে বিশ্ববাসীর নেতৃত্ব পদ থেকে যথানিয়মে হটিয়ে উম্মাতে মুহাম্মাদীয়াকে সে পদে বসিয়ে দিলেন ৷

‘মধ্যপন্থী উম্মাত’ শব্দটি অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্যের অধিকারী ৷ এর অর্থ হচ্ছে, এমন একটি উৎকৃষ্ট ও উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন দল, যারা নিজেরা ইনসাফ, ন্যায়-নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত , দুনিয়ার জাতিদের মধ্যে যারা কেন্দ্রীয় আসন লাভের যোগ্যতা রাখে , সত্য ও সততার ভিত্তিতে সবার সাথে যাদের সম্পর্ক সমান এবং কারোর সাথে যাদের কোন অবৈধ ও অন্যায় সম্পর্ক নেই ৷

বলা হয়েছে, তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মাতে পরিণত করার কারণ হচ্ছে এই যে, “তোমরা লোকদের ওপর সাক্ষী হবে এবং রসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হবেন ৷ ” এ বক্তব্যের অর্থ কি?

এর অর্থ হচ্ছে , আখেরাতে যখন সমগ্র মানবজাতিকে একত্র করে তাদের হিসেব নেয়া হবে তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হিসেবে রসূল তোমাদের ব্যাপারে এ মর্মে সাক্ষ্য দেবেন যে, সুস্থ ও সঠিক চিন্তা এবং সৎকাজ ও সুবিচারের যে শিক্ষা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল তা তিনি তোমাদের কাছে হুবহু এবং পুরোপুরি পৌছিয়ে দিয়েছিন আর বাস্তবে সেই অনুযায়ী নিজে কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছেন৷ এরপর রসূলের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সাধারণ মানুষদের ব্যাপারে তোমাদের এই মর্মে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, রসূল তোমাদের কাছে যা কিছু কার্যকর করে দেখিয়ে ছিলেন তা তাদের কাছে কার্যকর করে দেখিয়ে ছিলেন তা তাদের কাছে কার্যকর করে দেখাবার ব্যাপার তোমরা মোটেই গড়িমসি করোনি৷

এভাবে কোন ব্যক্তি বা দলের এ দুনিয়ায় আল্লাহর পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দানের দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়াটাই মূলত তাকে নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার নামান্তর ৷ এর মধ্যে যেমন একদিকে মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির প্রশ্ন রয়েছে তেমনি অন্যদিকে রয়েছে দায়িত্বের বিরাট বোঝা ৷ এর সোজা অর্থ হচ্ছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে এ উম্মাতের জন্য আল্লাহভীতি , সত্য-সঠিক পথ অবলম্বন, সুবিচার, ন্যায়-নিষ্ঠা ও সত্যপ্রীতির জীবন্ত সাক্ষী হয়েছেন তেমনিভাবে এ উম্মাতকেও সারা দুনিয়াবাসীদের জন্য জীবন্ত সাক্ষীতে পরিণত হতে হবে ৷ এমন কি তাদের কথা, কর্ম, আচরণ ইত্যাদি প্রত্যেকটি বিষয় দেখে দুনিয়াবাসী আল্লাহভীতি, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও সত্যপ্রীতির শিক্ষা গ্রহণ করবে ৷ এর আর একটি অর্থ হচ্ছে , আল্লাহর হিদায়াত আমাদের কাছে পৌছাবার ব্যাপারে যেমন রসূলের দায়িত্ব ছিল বড়ই সুকঠিন, এমনকি এ ব্যাপারে সামান্য ত্রুটি বা গাফলতি হলে আল্লাহর দরবারে তিনি পাকড়াও হতেন, অনুরূপভাবে এ হিদায়াতকে দুনিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে পৌছাবার ব্যাপারেও আমাদের ওপর কঠিন দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে৷ যদি আমরা আল্লাহর আদালতে যথার্থই এ মর্মে সাক্ষ্য দিতে ব্যর্থ হই যে, “তোমার রসূলের মাধ্যমে তোমার যে হিদায়াত আমরা পেয়েছিলাম তা তোমার বান্দাদের কাছে পৌছাবার ব্যাপারে আমরা কোন প্রকার ত্রুটি করিনি “, তাহলে আমরা সেদিন মারাত্মকভাবে পাকড়াও হয়ে যাবো ৷ সেদিন এ নেতৃত্বের অহংকার সেখানে আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে ৷ আমাদের নেতৃত্বের যুগে আমাদের যথার্থ ত্রুটির কারণে মানুষের চিন্তায় ও কর্মে যে সমস্ত গলদ দেখা দেবে , তার ফলে দুনিয়ায় যেসব গোমরাহী ছড়িয়ে পড়বে এবং যত বিপর্যয় ও বিশৃংখলার রাজত্ব বিস্তৃত হবে — সে সবের জন্য অসৎ নেতৃবর্গ এবং মানুষ ও জিন শয়তানদের সাথে সাথে আমরাও পাকড়াও হবো ৷ আমাদের জিজ্ঞেস করা হবে , পৃথিবীতে যখন জুলুম, নির্যাতন, অন্যায়, অত্যাচার, পাপ ও ভ্রষ্টতার রাজত্ব বিস্তৃত হয়েছিল তখন তোমরা কোথায় ছিলে ?