মন কি বলে ও প্রবৃত্তি কি চায়?-৯

প্রবৃত্তির প্রতি অধিক আকর্ষনে অনুগত হয়ে যাবার কারণসমূহ

 

প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণসমূহ জানা থাকা অতীব জরুরি। যে কোন কিছুর কারণ জানা থাকলে তা করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সহজ হয়। কারণ, যখন কোন কিছুর কারণ অস্বচ্ছ বা অসৎ হয় তার পরিণতিও হবে খারাপ ও অস্বচ্ছ। আর যখন কারণ ভালো ও স্বচ্ছ হবে তখন তার ফলাফল হবে মধুর ও আনন্দদায়ক।

যে সব কারণসমূহ মানুষকে প্রবৃত্তির অনুসরণের দিকে ডাকে সেগুলো অনেক। কেন মানুষ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তারা কেন সত্য ও সঠিক পথের অনুসরণ থেকে বিরত থাকে? তা নিম্নে আলোচনা করা হল। মনে রাখতে হবে, প্রবৃত্তির অনুসরনের অনেকগুলো কারণ আছে।

প্রথমত: বাল্যকাল থেকে প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণের উপর অভ্যস্ত না হওয়া:

অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চারা মাতা-পিতার অধিক আদর-স্নেহে মানুষ হয় এবং বড় হতে থাকে। তারা যখন যা চায় মাতা-পিতা তাদের তাই দিয়ে থাকে এবং তাদের যে কোন চাহিদা পূরণ করে তাদের খুশি রাখতে চেষ্টা করে। কোনটি হারাম আর কোনটি হালাল তার মধ্যে কোন প্রকার তারতম্য করে না।

জন্মের পরই মিউজিক সম্বলিত খেলনা ও পুতুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে শিশুটিকে হারাম বাজনাতে অভ্যস্থ করে ফেলে পিতা মাতা এবং খাবার খাওয়াতে যেয়ে মন ভুলানোর জন্যো বিভিন্ন মিউজিক সম্বলিত ডিভাইস গান ছেড়ে দেন ফলে প্রবৃত্তি ধীরে ধীরে সেইদিকেই শক্তি নিয়ে বড় হতে থাকে, একসময় কুর’আন বা শান্ত পরিবেশ ভালো লাগে না সেই শিশুটির।

ছেলে মেয়ে যখন ফজরের সালাতের সময় ঘুমায়, তখন মাতা-পিতা তাকে ঘুম থেকে জাগায় না, তারা বলে তাদের উপর এখনো সালাত ফরজ হয়নি। আর যখন সে কোন খেলা-ধুলা করতে চায়, মাতা-পিতা তাকে সুযোগ দেয়। তাকে বিরত রাখতে কোন প্রকার চেষ্টা তারা করে না। এমনকি তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঘরের মধ্যে তাদের জন্য গান-বাজনা, সিনেমা, নাটক ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দেয়।

অনেক সময় দেখা যায় ছেলের  মেয়ের জন্য আলাদা রুম আলাদা ড্রাইভার   ইত্যাদি উচ্চ বিলাস ও বিলাসবহুল জীবন ব্যবস্থা  করে দেয়া হয়। তাদের মতের বিরুদ্ধে কোন কিছুই করা হয় না, তারা যখন যা চায় তাই করে এবং তাদের খুশি রাখতে মাতা-পিতা উভয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টাকা-পয়সা যখন যা লাগে তাদের তা দিয়ে দেয়, তারা যা চায় তাই তাদের মাতা-পিতা থেকে তা পায়। ফলে তারা তাদের ইচ্ছা মত যেখানে মনে চায় সেখানে যেতে পারে, যা ইচ্ছা তা করতে পারে।

স্মার্ট ফোনের জন্য ৬-৭ বছরের শিশুটিও যখন বায়না ধরে তখন বাবা-মা দেরী না করে হাতের নাগালে দিয়ে দেন। আবার ২-৩ বছরের শিশুটিও টেব নিয়ে টিপে টিপে মিউজিক শুনতে ভালোবাসে, আর কান্না করলেই তার জন্য টেব এর ব্যবস্থা করে দেন বাবা মা।

এভাবে চলতে চলতে একটা সময় এমন আসে, ছেলে মেয়েরা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণে অভ্যস্ত হয়ে গড়ে উঠে। কোন কিছু চাওয়া মাত্রই সে তা পায় এবং যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তখন সে কারো কথা শোনে না। মাতা-পিতার কথাও তার কাছে আর ভালো লাগে না। কোন উপদেশকারীর উপদেশ তার কাছে তিক্ত মনে হয়। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলতে পারে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা বললে, সে তাকে তার শত্রু মনে করে। সে যা করতে চায় তা থেকে কেউ তাকে বিরত রাখতে পারে না এবং বাধা দিতে পারে না।

এরপর যখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তার চাহিদাও আকাশচুম্বী হয়। তার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তার প্রবৃত্তির পিছনে দৌঁড়তে থাকে। বিশেষ করে যখন ছেলে মেয়েরা তাদের বাল্যকাল অতিক্রম করে কৈশোরে পৌঁছে। তখন তাদের প্রবৃত্তি পাগলা হাতির মত লাফালাফি করতে থাকে। তখন তারা বড় বড় অন্যায়, অপকর্ম ও অপরাধ করতে কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করে না। তাদের এ ধরনের অপকর্ম ও অপরাধ করা থেকে বিরত রাখার কোন উপায় থাকে না।

এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীরা ছোট বেলা থেকেই তাদের বাচ্চাদের সু-শিক্ষা দিতেন এবং তাদের চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা তাদের বাচ্চাদের সাওম, নামায, হজ ইত্যাদি শরিয়তের বিধান পালনে ছোট বেলা থেকেই অভ্যাস করাতেন। যার ফলে তাদের সন্তানেরাও তাদের মতই বিখ্যাত ও বড় বড় জ্ঞানী।

রবি বিনতে মুয়াওয়াজ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন দুপুর বেলায় একটি জামাতকে আনসারীদের এলাকায় প্রেরণ করেন। তারা সেখানে গিয়ে তাদের এ কথার দাওয়াত দেয় যে, যে ব্যক্তি সাওম না রেখে সকাল উদযাপন করল, সে যেন বাকি সময়টুকু কোন কিছু না খেয়ে দিন অতিবাহিত করে, আর যে ব্যক্তি সাওম রাখা অবস্থায় সকাল করল, সে যেন সাওম রাখে। তার কথা শোনে একজন মহিলা বলল, তারপর থেকে আমরা আশুরার দিন সাওম রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদের সাওমের নির্দেশ দিতাম। আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য গাছের ডাল দিয়ে খেলা-ধুলার সামগ্রী বানাতাম। তারা যদি ক্ষুধার কারণে কান্না-কাটি করত, তাদের এসব খেলা-ধুলার সামগ্রী দিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখতাম”। বুখারি: ১৯৬০, মুসলিম: ১১৩৬।

বাচ্চাদেরকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী লালন-পালন করা  শুধু দ্বীনি ক্ষতি তাই নয়, বরং এর দ্বারা তাদের দুনিয়াও নষ্ট হয় এবং তাদের জীবন ধ্বংস হয়। দুনিয়ার জীবনে তারা বিভিন্ন ধরনের মুসিবত ও বিপদ-আপদের সম্মুখীন হয়, অর্থের অপচয় হয়, সাংসারিক জীবন সংকীর্ণ হয় এবং তাদের পরিবারের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়।

সুতরাং বর্তমান সময়ে আমাদের উচিত হল, বাচ্চাদের নিয়ে খুব সতর্ক থাকা, যেন তারা নিশ্চিত ধ্বংস হতে মুক্তি পায়। মনে রাখতে হবে, তারা যা চায় তা করা যাবে না, তাদেরকে খেয়াল খুশি মত চলতে দেয়া যাবে না। তাদের চাহিদাকে ছোট থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং ইচ্ছা আকাঙ্খাকে ছোট বেলা থেকেই যাঁচাই বাছাই করতে হবে। সামর্থ থাকলেই অত্যধিক খরচ করতে হবে এই নীতি থেকে সরে দান সাদাকা,মানুষের কল্যানে ব্যয় করার শিক্ষাতে অভ্যস্থ করা প্রয়োজন। তা না হলে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে।

 এক সময় আসবে যখন ব্যক্তি জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, তখন দেখতে পাবে, তার পরিবার তার চাহিদাগুলো ইচ্ছা থাকলেও পূরণ করতে সক্ষম নয়। বিশেষ করে যখন সে নিজেই স্বয়ং সম্পন্ন হবে, বৈবাহিক জীবনে পদার্পণ করবে এবং কর্ম জীবনে পা বাড়াবে, তখন  বলবে আমাকে এ কাজ করতে দাও, আমাকে এ কাজ করার জন্য টাকা দাও ইত্যাদি। তখন  তার চাহিদা মোতাবেক যদি তাকে সাপোর্ট দিতে না পারলে, শুরু হবে অশান্তি, ঝগড়া-বিবাদ, দু:সম্পর্ক।

অনুরূপভাবে মেয়েরা যখন বিলাস-বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়, তখন তারাও তাদের ব্যক্তি ও সাংসারিক জীবনে অশান্তিতে পড়বে। অনেক সময় দেখা যাবে, সে এমন এক স্বামীর সংসারে আবদ্ধ হয়েছে, যে আর্থিকভাবে তার থেকে দুর্বল বা সমকক্ষ নয়, তখন সে তার স্বামীকে বাড়তি চাপ দিতে থাকবে, তাকে সার্বক্ষণিক বিরক্ত করবে এবং এটা-সেটা এনে দেয়ার জন্য বলতে থাকবে। যখন সে এনে দিতে পারবে না তখন সে তার স্বামীর উপর চড়াও হবে, স্বামীর থেকে নাক ছিটকাবে। আবার অনেক সময় দেখা যাবে সে তার স্বামীকে ফকির বলে গালি দেবে। এভাবে দেখা যাবে তাদের সংসারে সব সময় ঝগড়া-বিবাদ, মান-অভিমান ও অশান্তি লেগে থাকবে। ফলে তাদের আত্মার শান্তি ও পারিবারিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে এবং স্বামীর সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। এ ধরনের ঘটনা বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। সুতরাং, আমরা যদি শুরু থেকে সতর্ক না হই তবে আমাদের আরো দুভোর্গ পোহাতে হবে।

দ্বিতীয়ত: প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠাবসা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা:

আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে সংগী বা বন্ধু নির্বাচন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যারা বন্ধু নির্বাচন করতে ভূল করে, তারা তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারায় ফেলে। যার বন্ধু খারাপ বা চরিত্রহীন হয়, তাকে ভালো রাখার জন্য কোন কৌশলই উপকারে আসে না। কারণ, প্রবাদে আছে, মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। তার বন্ধুর দ্বীন যা হবে তার দ্বীনও একই দ্বীন হবে। সুতরাং, আমরা সবসময় সৎ সঙ্গী নির্বাচন করবো, কখনোই অসৎ বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করবো না, তাদের এড়িয়ে চলবো। কারণ, কিয়ামতের ভয়াবহ বিপদের দিন আমার বন্ধু আমার কোন উপকারে আসবে না। সেদিন আমার বন্ধু আমার দুশমণে পরিণত হবে। তারা আমাকে চিনতে পারবে না, একমাত্র মুত্তাকী ছাড়া। যারা মুত্তাকী এবং একমাত্র দ্বীনের স্বার্থে একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের বন্ধুত্ব কিয়ামতের দিনও কাজে লাগবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যারা দ্বীনের কারণে একে অপরকে ভালোবাসতো তাদের ক্ষমা করে দেবেন। এখানে প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেই যে, সকলের সাথে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাধারন একটি সম্পর্ক রাখা আর বন্ধু বা সংগী বানানোর মাঝে অনেক বিরাট পার্থক্য। ইসলাম শিক্ষা দেয় সকলের সাথে ভালো আচরন করতে, মানুষ হিসেবে অন্যের সাথে ভালো ব্যবহার ও অধিকারের ব্যপারে সচেতন থাকতে কিন্তু নিজের ঈমান আমল আখলাকের ক্ষতি হয়, সেই সম্পর্কে যেতে নিষেধ করে।

আবু হুরাইরা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআ’লা বলবেনঃ আমার মর্যাদার (আনুগত্বের) কারণে পরস্পরে বন্ধুত্বকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদের আমার ছায়াতলে ছায়া দিব, যেদিন আমার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া নেই।” (মুসলিম, অধ্যায়, বির ওয়াস্ সিলা, নং ২৫৬৬)

এ ছাড়াও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সত্যবাদীদের সাথে উঠবস করার নির্দেশ দেন। কারণ, কথায় আছে, সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ।

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। (সূরা তাওবাহ, আয়াত: ২৩)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,

 “যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে, তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে, বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম”। (সূরা মুজাদালাহ,: ২)

মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও তাদের সাথে উঠবস করার ফলে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যারা প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারা অবশ্যই তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে যখন সে তাদের চেয়ে দুর্বল হয় এবং তার মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করার মত যোগ্যতা থাকে না, তখন সে কোন প্রকার হিসাব-নিকাশ ছাড়াই তার বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে থাকে। এই অবস্থা একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের চরিত্রেও দেখা যায়।

কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করার পূর্বে  তার সম্পর্কে জানা উচিৎ, যে আমরা কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চলেছি। সাধারণত: জুয়াড়ির বন্ধু জুয়াড়ী হয়, চোরের বন্ধু চোর হয়, আর নামাযীর বন্ধু হয় নামাযী । তাই বন্ধু নির্বচনের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

 “মানুষ তার বন্ধু স্বভাবী হয়, তাই তাকে লক্ষ্য করা উচিৎ যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে।” তিরমিযী,নং ২৪৮৪)

একদা এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করেঃ কিয়ামত কবে হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলেনঃ তার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছো? লোকটি বলেঃ (নফল) নামায, রোযা, সাদাকা হিসাবে বেশী কিছু আমার নেই কিন্তু আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে ভালবাসি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “তাহলে তুমি তার সাথে হবে যাকে তুমি ভালবাসো। (মুসলিম, নং ২৬৩৯)

প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেশ করেছেন, যেন আমরা জানতে পারি যে আমাদের কী ধরণের বন্ধু নির্বাচন করা প্রয়োজন। নবী স. বলেন:

 ‘‘সৎ সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে আতর বিক্রয়কারী এবং কামারের হাপরের ন্যায়। আতর ওয়ালা তোমাকে নীরাশ করবে না; হয় তুমি তার কাছ থেকে ক্রয় করবে কিংবা তার নিকট সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের হাপর, হয় তোমার বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে, নচেৎ তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে আর নাহলে দুর্গন্ধ পাবে।” বুখারী, অধ্যায়, ক্রয়-বিক্রয়, নং২১০১

আলকামাহ (রহঃ) বলেনঃ “বন্ধুত্ব কর তার সাথে, যার সাহচর্য তোমাকে সুন্দর করে, তুমি অভাব গ্রস্থ হলে তোমাকে সাহায্য করে, ভুল বললে তোমার ভুল সংশোধন করে, যদি তোমার মধ্যে কোন মঙ্গল দেখে, তো গুণে গুণে রাখে, যদি তোমার মধ্যে কোন ত্রুটি দেখে তো শুধরে দেয়, যদি তার কাছে চাও তো সে দেয়, কঠিন সময়ে তোমাকে সান্তনা দেয়।”

আউযায়ী (রাহঃ) বলেনঃ ‘ বন্ধু বন্ধুর জন্য তালির (কাপড়ের টুকরার) ন্যায়, যদি আসল কাপড়ের মত না হয়, তো অশোভনীয় করে দেয়’।

কতিপয় আলেম বলেনঃ বন্ধুত্ব কর কেবল নিম্নোক্ত দু শ্রেণীর মানুষের সাথে।

এক: তার সাথে যে তোমাকে দ্বীনের শিক্ষা দেয়, যার দ্বারা তুমি উপকৃত হও।

দুই: তার সাথে যাকে তুমি দ্বীনের শিক্ষা দাও আর সে তা গ্রহণ করে।

 উক্ত প্রকার ছাড়া তৃতীয় প্রকার হতে দূরে থাক।”

এ কারণেই আমাদের মনীষীরা আমাদেরকে প্রবৃত্তির অনুসারী ও বিদআতিদের সাথে উঠবস করতে নিষেধ করেন এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকতে বলেন। আল্লামা আবু কালাবাহ রহ. বলেন,

 “তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারিদের সাথে উঠবস করো না (আব্দুলা আহমদের আস-সুন্নাহ: ৯১) এবং তাদের সাথে কোন প্রকার বিতর্কে জড়াবে না। কারণ, আমরা তোমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারছি না যে, তারা তোমাদেরকে গোমরাহীতে ডুবাবে না অথবা দ্বীনের বিষয়ে তাদের নিকট যে অস্পষ্টতা রয়েছে তাতে তোমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলবে না”।

আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেন, “তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস করো না।

আজ আমাদের সমাজে ছেলে মেয়েরা তথাকথিত স্মার্টকে প্রাধান্য দিয়ে সঙ্গী নির্বাচন করে থাকে, আবার অনেকে ধনী ও সুন্দর দেখেও নির্বাচন করে থাকে, কিন্তু একবারও চিন্তা করে দেখে না তাদের নৈতিক অবস্থান কোথায়। এমনকি মা বাবারাও খুব সহজেই এই দৃষ্টি ভঙ্গিটাকে মেনে নিচ্ছেন। ফলে দেখা যায় বাসায় হয়তো কোন পরিবারে আখলাক সুন্দর ও ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার পরিবেশ থাকে কিন্তু সঙ্গীর বাসায় গিয়ে ভালো অনুশাসনের বিপরীত পরিবেশে প্রবৃত্তির খায়েশ পূরন করার সুযোগ হয়ে উঠে, এইভাবে আস্তে আস্তে সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। এইভাবেই বন্ধুর আদর্শে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। নেশাগ্রস্ত হয়ে যাওয়া, পর্ণগ্রাফী দেখায় আসক্ত হওয়া, অবৈধ প্রেমে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদির মাঝে জড়িয়ে যায়।

অনেক পিতা মাতা নিজ সন্তানকে ধার্মিক ছেলে মেয়ে থেকে পরিকল্পিতভাবে দূরে রাখেন, যেন সন্তানেরা ইসলামের দিকে ঝুকে না পড়ে বেশী, কারন নিজেরাও দুই নৌকায় পা দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাত নষ্ট করছেন-ছেলেমেয়েদের জীবনেও তাই চান। ইসলামের রাস্তা একটা সহজ সুন্দর সোজা, এখানে কম বেশী বলে কিছু নেই। এই পিতা মাতাই বুড়ো বয়সে যখন সন্তানদের কাছে পান না তখনই বোধোদয় হয় যে, কি ভুল করেছেন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গী নির্বাচনে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের   বাণী- “যদি তোমরা মুশরিকদের থেকে আলাদা না থাক এবং মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব না কর, তখন মানুষের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি হবে”। আর তা হল, বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি হবে, (সমাজের নিয়ম কানুন ঠিক থাকবে না), মুমিনরা কাফেরদের সাথে মিশে যাবে। ফলে মুমিনদের স্বকীয়তা বজায় থাকবে না। তখন সমাজে অনেক ফিতনা ফ্যাসাদ দেখা দেবে, সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে—”।  বর্তমানে সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আল্লাহ আমাদের সহযোগিতা করুন।

তৃতীয়: আখিরাত ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে সত্যিকার জ্ঞানের অভাব:

যে ব্যক্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সত্যিকার মান-মর্যাদা সম্পর্কে অবগত নয় বা তাকে যথাযথ সম্মান দেখাতে পারে না, সে আল্লাহকে তার বিপক্ষে দাঁড় করাতে, আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নাফরমানি করতে এবং তাঁর আদেশ নিষেধকে অমান্য করতে সে তেমন কোন পরওয়া করে না; তার অন্তরে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের বড়ত্ব ও তা‘জীম অবশিষ্ট থাকে না।

 একজন মানুষের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ক্বদর ও মান-মর্যাদা সম্পর্কে জানা থাকা অতীব জরুরি। তার উপর আল্লাহর পক্ষ হতে কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং তাকে কখন কি পালন করতে হবে তা অবশ্যই জানা থাকতে হবে। এ গুলো জানা না থাকলে সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশ নিষেধ কিভাবে পালন করবে এবং তার হুকুমের আনুগত্য কিভাবে করবে?

মহান আল্লাহ ও আখেরাত সম্পর্কে সঠিক ধারনাই পারে দুনিয়ার জীবনে নিজের প্রবৃত্তির লাগাম নিয়ন্ত্রণ করতে। আর তাই কুর’আনে ঈমানের সবগুলো বিষয়ের সাথে বিশ্বাস রাখার কথা থাকলেও আখেরাতের ব্যাপারে বলা হয়েছে দৃঢ় বিশ্বাস রাখার কথা। কারন এই বিষয়টির উপর বিশ্বাসের ধরনের উপরই দুনিয়ার জীবন যাত্রার ধরনে প্রতিফলিত রুপ দেখা যায়। আবার মহান আল্লাহ যেমন রাহমানুর রাহীম ও তেমনি শাস্তিদাতা ও ন্যায়বিচারক, এই জ্ঞানের উপর আমল করা দিয়েও জীবনের রাস্তা সহজে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে চলতে পারে ও অন্যায় থেকে দূরে থাকাটাও সহজ হয়ে যায়।

সমাজে একশ্রেনীর ঈমানদার আছেন যারা মহান রবের রহমতকেই প্রাধান্য দেন, ভুলে যান ন্যায়বিচারক আল্লাহ অন্যায়ের শাস্তি দান করবেন। ফলে নির্বিবাদে অন্যায় করেই চলেন, তওবাও করেন,আবার একই অন্যায় করে প্রবৃত্তিকে খুশি রেখেই চলেন—এটা যেমন ঠিক না আবার একশ্রেনীর ঈমানদার আছেন যারা খুব সহজেই অন্য একজন আমলদারনা কিন্তু ঈমানের ঘোষনা দেন তাকে জাহান্নামের সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন-এটাও ঠিক না।

আজ সমাজে ছেলে-মেয়ে স্বা্মী-স্ত্রী একজন একজনকে পাহাড়ায় রাখতে চান, কখন কি করে তা নিয়ে পেরেশান থাকতে হয়-অথচ আখেরাত ও আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান ও বিশ্বাসের আমল দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। পরিবারেও বিশ্বাস ও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে, প্রত্যেকেই সময়ের সুন্দর ব্যবহার করতে পারেন এবং যার যার প্রতিভার বিকাশ করতে পারেন শরীয়াতের মাঝে থেকে।

যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মান-মর্যাদা সম্পর্কে অবগত আছে আর যারা অবগত নয়, তারা কখনোই সমান হতে পারে না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, যে ব্যক্তি তার রবের পক্ষ থেকে আগত সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত সে কি তার মত, যার মন্দ আমল তার জন্য চাকচিক্যময় করে দেয়া হয়েছে এবং যারা তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে?

(সূরা যুমার, আয়াত: ৬৭)

“আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন।” (আলে ইমরান ২৮ আয়াত)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 “সেদিন মানুষ পলায়ন করবে আপন ভ্রাতা হতে এবং তার মাতা ও তার পিতা হতে, তার পত্নী ও তার সন্তান হতে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন গুরুতর অবস্থা হবে, যা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে।” (সূরা আবাসা ৩৪-৩৭ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

“হে মানবমণ্ডলী! তোমরা ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে; (আর জেনে রেখো যে,) নিঃসন্দেহে কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ানক ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী নিজ দুগ্ধপোষ্য শিশুকে বিস্মৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করে ফেলবে। আর মানুষকে দেখবে মাতাল সদৃশ, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বস্তুত আল্লাহর শাস্তি বড় কঠিন।” (সূরা হজ্জ্ব ১-২ আয়াত)

তিনি অন্যত্র বলেন,

অর্থাৎ “আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দু’টি (জান্নাতের) বাগান।” (সূরা আর-রাহমান ৪৬ আয়াত)

তিনি আরো বলেন, “তারা একে অপরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করবে এবং বলবে, নিশ্চয় আমরা পূর্বে পরিবার-পরিজনের মধ্যে শংকিত অবস্থায় ছিলাম। অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে উত্তপ্ত ঝড়ো হাওয়ার শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন। নিশ্চয় আমরা পূর্বেও আল্লাহকে আহবান করতাম। নিশ্চয় তিনি কৃপাময়, পরম দয়ালু।” (সূরা ত্বূর ২৫-২৮ আয়াত)

আবূ হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, ‘আল্লাহ যখন সৃষ্টিজগত তৈরী সম্পন্ন করলেন, তখন একটি কিতাবে লিখে রাখলেন, যা তাঁরই কাছে তাঁর আরশের উপর রয়েছে, ‘‘অবশ্যই আমার রহমত আমার গযব অপেক্ষা অগ্রগামী।’’ সহীহুল বুখারী: ৩১৯৪,

‘‘নিশ্চয় আল্লাহর একশটি রহমত আছে, যার মধ্য হতে একটি মাত্র রহমত তিনি মানব-দানব, পশু ও কীটপতঙ্গের মধ্যে অবতীর্ণ করেছেন। ঐ এক ভাগের কারণেই (সৃষ্টজীব) একে অপরকে মায়া করে, তার কারণেই একে অন্যকে দয়া করে এবং তার কারণেই হিংস্র জন্তুরা তাদের সন্তানকে মায়া করে থাকে। বাকী নিরানববইটি আল্লাহ আখেরাতের জন্য রেখে দিয়েছেন, যার দ্বারা তিনি কিয়ামতের দিন আপন বান্দাদের উপর রহম করবেন।’’  সহীহ বুখারী: ৬০০০

বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, নবী স. বলেছেন, ‘‘মুসলিমকে যখন কবরে প্রশ্ন করা হয়, তখন সে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া (সত্য) কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল। এই অর্থ রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীতে, ‘যারা মু’মিন তাদেরকে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত বাণী দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে প্রতিষ্ঠা দান করেন।’’ (সূরা ইব্রাহীম: ১৭ -বুখারী ও মুসলিম)

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কাফের যখন দুনিয়াতে কোনো পুণ্য কাজ করে, তখন বিনিময়ে তাকে দুনিয়ার (কিছু আনন্দ/খাবার জাতীয়) উপভোগ করতে দেওয়া হয়। (আর আখেরাতে সে এর কিছুই প্রতিদান পাবে না)। কিন্তু মু’মিনের জন্য আল্লাহ তা’আলা আখেরাতে তার প্রতিদানকে সঞ্চিত করে রাখেন এবং দুনিয়াতে তিনি তাকে জীবিকা দেন তাঁর আনুগত্যের বিনিময়ে।’’

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘মহান আল্লাহ কোন মু’মিনের উপর তার নেকীর ব্যাপারে যুলুম করেন না। তাকে তার প্রতিদান দুনিয়াতেও দেওয়া হয় এবং আখেরাতেও দেওয়া হবে। কিন্তু কাফেরকে ভাল কাজের বিনিময়–যা সে আল্লাহর জন্য করে–দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হয়। এমন কি যখন সে আখেরাতে পাড়ি দেবে, তখন তার এমন কোনো পুণ্য থাকবে না যে, তার বিনিময়ে তাকে কিছু (পুরস্কার) দেওয়া যাবে।’’ (মুসলিম) 

মিক্বদাদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘কিয়ামতের দিন সূর্যকে সৃষ্টজীবের এত কাছে করে দেওয়া হবে যে, তার মধ্যে এবং সৃষ্টজীবের মধ্যে মাত্র এক মাইলের ব্যবধান থাকবে।’’ মিক্বদাদ থেকে বর্ণনাকারী সুলাইম ইবন আমের বলেন, আল্লাহর কসম! আমি জানিনা যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘মীল’ শব্দের কী অর্থ নিয়েছেন, যমীনের দূরত্ব (মাইল), নাকি (সুরমাদানীর) শলাকা যার দ্বারা চোখে সুরমা লাগানো হয়? ‘‘সুতরাং মানুষ নিজ নিজ আমল অনুযায়ী ঘামে ডুবতে থাকবে। তাদের মধ্যে কারো তার পায়ের গাঁট পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত (ঘাম হবে) এবং তাদের মধ্যে কিছু এমন লোকও হবে যাদেরকে ঘাম লাগাম লাগিয়ে দেবে।’’ (অর্থাৎ নাক পর্যন্ত ঘামে ডুববে।) এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মুখের দিকে ইশারা করলেন।  মুসলিম ২৮৬৪, তিরমিযী ২৪২১,

আদী ইবনে হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তার প্রতিপালক কথা বলবেন; তার ও তাঁর মাঝে কোন আনুবাদক থাকবে না। (সেখানে) সে তার ডানদিকে তাকাবে, সুতরাং সেদিকে তা-ই দেখতে পাবে যা সে অগ্রিম পাঠিয়েছিল। বামদিকে তাকাবে, সুতরাং সেদিকেও নিজের কৃতকর্ম দেখতে পাবে। আর সামনে তাকাবে, সুতরাং তার চেহারার সামনে জাহান্নাম দেখতে পাবে। অতএব তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো; যদিও খেজুরের এক টুকরো সাদকাহ করে হয়।’’  সহীহ বুখারী ১৪১৩

এই জ্ঞানের অভাবেই প্রবৃত্তি তার জ্ঞানের বহর নিয়ে এসে দাঁড়ায় ও শয়তান আরো যুক্তি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা শুরু করে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের অন্তরে অহীর জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করে দিন।

আজ আমাদের অনেক বেশী সচেতন হওয়া প্রয়োজন যেন নিজেকে সঠিক পথে রেখে স্থায়ী জীবনে যেতে পারি।

চতুর্থঃ প্রবৃত্তির পূজারীদের সাথে যে ধরনের আচরণ করা দরকার তা পালন করা হতে বিরত থাকার কারনে প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে যায়

যারা প্রবৃত্তির পূজা করে ঘুরে বেড়ায়, তাদের প্রতি সমাজের মানুষের একটি বড় দায়িত্ব হল, তারা তাদেরকে ভালো পথে আনার চেষ্টা করবে এবং বিপথগামী হতে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে। কারণ, ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে নিষেধ করার দায়িত্ব পালনে অবহেলা মানুষকে প্রবৃত্তির পূজারি বানিয়ে দেয়। আর মানুষ যখন ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে নিষেধ করার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখন প্রবৃত্তির পূজারীদের শয়তানি, হঠকারিতা ও অপরাধ প্রবণতা আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। তারা কোন অপরাধকে আর অপরাধ মনে করে না। যে কোন ধরনের অপরাধ করতে তারা কাউকে পরওয়া বা ভয় করে না। তারা অন্যায় অপরাধ করতে করতে তাদের স্বভাব নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি ধীরে ধীরে তাদের প্রবৃত্তি তাদের অন্তরে স্থান করে নেয় এবং তাদের চলা ফেরা ও যাবতীয় কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ তাদের প্রবৃত্তিই করতে থাকে। মানবিক কোন গুণ তাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট থাকে না। তাদের মধ্যে পাশবিক চরিত্র ও জীব-জন্তুর চরিত্রই প্রভাব বিস্তার করে।

আমাদের সমাজে অনেক মুসলিম আছেন যারা ব্যক্তিজীবনে কিছু আমল করলেও সামাজিক জীবনের অনেক আমল থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখেন। অনেক কারনের মাঝে একটা কারন হলো প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত রাখা।

বিশেষ করে আত্মীয়দের সাথে বা কলিগদের মাঝে এই অবস্থা দেখা যায়। যেমন, উত্তরাধিকার আইন একটি আল্লাহ প্রদত্ত আইন। অথচ এই ব্যাপারে আত্মীয়দের মাঝে অন্যায় দেখেও প্রতিবাদ করতে বা সুন্দর করে আল্লাহর আইনের কথা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করেন, কিন্তু অন্যায়কারীর সামনেই খুব প্রশংসা সহকারেই কথা বলে প্রবৃত্তিকেই প্রকারান্তে উৎসাহিত করে থাকে।

আজ এই সমাজে যে ধরনের অন্যায় ঘটাচ্ছে, এরা আপনার আমার কারো না কারো আত্মীয়। কতজন এই অন্যায়কারীকে সুন্দর করে সংশোধন করার উদ্যোগ নিচ্ছেন? নিজের চোখের সামনেই সন্তান অশ্লীল কাপড় পড়ে বের হয়ে যাচ্ছে অথচ মা বা বাবা কিছুই বলছেন না। অথবা ছেলেটি মারামারিতে জড়িয়ে যাচ্ছে জেনেও কোন প্রতিকার করছেন না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় বরং এটাকে বাহবা দিচ্ছেন।

 কোন আত্মীয় খুব সুন্দর করে নিজের কোন ঘটনা বলছেন যা শরীয়তে কোন গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা, কিন্তু দেখা যায় যিনি শুনছেন, তিনি খুব আনন্দ লাভ করেই যাচ্ছেন। তিনি সেই ভুলটি তখনই বুঝিয়ে দিবেন, তা না করে তাল মিলিয়ে গল্প করেই যাচ্ছেন, ফলে সেই ব্যক্তিটি মনে করে তার সেই অন্যায় কাজটি ঠিকই আছে। অনেকে ভাবেন পরে বলবো, আবার পরে সংশোধনের চিন্তা করাটাও ঠিক নয় এই জন্য যে, হতে পারে আমার সেই সুযোগ নাও আসতে পারে এবং এর মাঝে সে আরো অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। হাশরের মাঠে ঠিকই এই ব্যক্তি পাওকড়াও করবে যে, কেন তাকে সংশোধনের কথা বলা হয় নাই, যদিও দুনিয়ার জীবনে একটু বিরক্ত হলে হতেও পারতো।

 ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ কাজ কলিগ বা আত্মীয়রা করলেও নিজেকে তথাকথিত ভালো মানুষ (অন্যায়কারীর কাছে) থাকার জন্য প্রবৃত্তি পূজারীকে সংশোধন করার চেষ্টা করে না। আর এইভাবেই সমাজে অন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে। এবং একসময় ব্যক্তিজীবনে আমলকারী ব্যক্তিটিও সেই প্রবৃত্তি পূজারীদের দলে ভিড়ে যায়।

 এ কারণেই ইসলাম মানুষকে ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা নির্দেশ দেন। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,

“আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম”। (আল-ইমরান: ১০৪)

আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, সমাজে একটি দল থাকতে হবে যারা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে বারণ করার দায়িত্ব পালন করে। আর যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারাই হল, সফল। সমাজে যখন এ ধরনের দায়িত্বশীল লোক থাকবে তখন সমাজিক অপরাধ কমে যাবে এবং প্রবৃত্তির অনুসারীরা ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে যাবে। তবে যারা মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করবে তাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কিভাবে তারা মানুষকে অন্যায় অনাচার থেকে ফিরাবে। মানুষের অন্তরে খারাপ বা মন্দ কাজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষকে ওয়াজ নসিহত ও সুন্দর কথা বলে এবং উত্তম বিতর্ক দ্বারা বুঝাতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করার মূলনীতি আলোচনা করে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আরও বলেন,

“তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন”।

           (সূরা নাহল: ১২৫)

আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আরও বলেন,

 ওরা হল সে সব লোক, যাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও। আর তাদেরকে তাদের নিজদের ব্যাপারে মর্মস্পর্শী কথা বল। (সূরা নিসা: ৬৩)

আর যখন মানুষ অন্যায় ও অপরাধকে প্রতিহত করতে অভ্যস্ত হয়, তখন তাদের দ্বারা কোন প্রকার অন্যায় সংঘটিত হয় না এবং যারা প্রবৃত্তির পূজারী তাদের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় না। আর তাদের চলার পথে কোন প্রকার হোঁচট খেতে হয় না।

পঞ্চমঃ. দুনিয়ার মহব্বত এবং দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়া:

যে ব্যক্তি দুনিয়াকে অধিক মহব্বত করে এবং দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে, তার অন্তর সর্বদা দুনিয়ার মহব্বতের দাবি পূরণ ও তার জন্য যা করনীয় তা বাস্তবায়নেই লিপ্ত থাকে। অন্য কোন চিন্তা তার মাথায় প্রবেশ করে না। যদিও তার কার্যক্রম আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের বিধানের পরিপন্থী হয়। আর একেই বলে প্রবৃত্তির পূজা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে এ ধরনের অভ্যাস ও কারণের প্রতি সতর্ক করে বলেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ لَا يَرۡجُونَ لِقَآءَنَا وَرَضُواْ بِٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَٱطۡمَأَنُّواْ بِهَا وَٱلَّذِينَ هُمۡ عَنۡ ءَايَٰتِنَا غَٰفِلُونَ ٧ أُوْلَٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمُ ٱلنَّارُ بِمَا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ ٨﴾ [ سورة يونس : 7-8 [.

“নিশ্চয় যারা আমার সাক্ষাতের আশা রাখে না এবং দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছে ও তা নিয়ে পরিতৃপ্ত রয়েছে। আর যারা আমার নিদর্শনাবলী হতে গাফেল তারা যা উপার্জন করত, তার কারণে আগুনই হবে তাদের ঠিকানা”।

সূরা ইউনুস, আয়াত: ৭-৮

আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, যারা আখেরাত দিবসের আশা করে না এবং দুনিয়ার জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে তাদের ঠিকানা হল, জাহান্নাম। আর এটি তাদের কর্মেরই ফলাফল। তারা দুনিয়াতে আখেরাতকে ভূলে গিয়েছিল এবং তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে যখন যা ইচ্ছা তাই করছিল।

ষষ্ঠ. প্রবৃত্তির অনুসরণ করার যে পরিণতি সে সম্পর্কে জানা না থাকা:

জ্ঞানই হল মানুষের একমাত্র শক্তি। জ্ঞান মানুষকে যাবতীয় অধ:পতন থেকে রক্ষা করে। যে কোন কাজের পরিণতি সম্পর্কে জানা থাকলে, মানুষ সে কাজ করা না করা বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারে। কোন কিছুর পরিণতি সম্পর্কে অজানা থাকা মানুষকে তার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রবৃত্তির অনুসরণ করার অনেক ক্ষতি ও ধ্বংস রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এসব সম্পর্কে বেখবর। যখন প্রবৃত্তির অনুসারীরা এ সব ক্ষতিসমূহ জানতে পারবে, তখন সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকবে।

আহমদ ইব্ন কাসেম তিবরানি রহ. কিছু কাব্য পড়েন এবং তাতে তিনি বলেন,

 “যে কাজ করাকে আমি আমার বিপক্ষে বিপদ সংকুল মনে করি তা করা হতে আমি অবশ্যই বিরত থাকব। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ভয়ে আমার মন যা চায় তা করার অভ্যাসকে ছেড়ে দেব”।