প্রবৃত্তির বা নফসের অন্ধ আনুগত্যে ক্ষতির দিক সমূহ
প্রবৃত্তির বা নফসের চাওয়াকে না বুঝে আনুগত্য করলে যে ধরনের ক্ষতি হতে পারে তা মহান আল্লাহ কুর’আনে বলে দিয়েছেন।
লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন যে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা যত কষ্টসাধ্য তেমনি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামা ততটুকু বা তার চেয়েও অনেক সহজসাধ্য কাজ। আর তাই মানুষ উন্নত মর্যাদায় উঠতে যত কষ্ট-পরিশ্রম ও সচেতন থাকাটা প্রয়োজন, ঠিক নীচু স্তরের দিকে চলে যাওয়ার জন্য তেমন চিন্তা করতে হয় না শুধুমাত্র নফস ও শয়তানের প্ররোচনায় নিজেকে ছেড়ে দিলেই হয়ে যায়।
একজন মানুষ তার মর্যাদা থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার জন্য আর কিছু লাগে না। ইবলিশ কিন্তু মহান রবকে বিশ্বাস করে ইবাদাতে মশগুল ছিল কিন্তু যখনই নফসের বিপরীত আনুগত্যের প্রশ্ন এসেছে সে নফসের অনুগত হয়ে মহান রবের অবাধ্য হয়েছিল এবং নফসের খুশির জন্যই মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত থেকে নিজের অন্যায় আচরনের উপর অটল ছিল। আর পরিনতিতে সে চিরবঞ্চিত, ধিকৃত ও জাহান্নামী হয়ে গেলো।
মহান আল্লাহ বলেছেন,
কখনো কি তুমি সেই ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছো, যে তার নিজের প্রবৃত্তির কামনাকে প্রভু রূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি এহেন ব্যক্তিকে সঠিক পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে পার৷ তুমি কি মনে করো তাদের অধিকাংশ লোক শোনে ও বোঝে? তারা পশুর মতো বরং তারও অধম৷ সূরা আল ফুরকান:৪৩-৪৪
আবু উমামাহ রেওয়ায়াত করেছেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
“এ আকাশের নীচে যতগুলো উপাস্যের উপাসনা করা হয়ে থাকে , তাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপাস্য হচ্ছে এমন প্রবৃত্তির কামনা করা যার অনুসরণ করা হয়।” (তাবরানী)
যে ব্যক্তি নিজের কামনাকে বুদ্ধির অধীনে রাখে এবং বুদ্ধি ব্যবহার করে নিজের জন্য ন্যায় ও অন্যায়ের পথের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, সে যদি কোন ধরনের শির্কী বা কুফরী কর্মে লিপ্ত হয়েও পড়ে তাহলে তাকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনা যেতে পারে এবং সে সঠিক পথ অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর তার উপর অবিচল থাকবে এ আস্থাও পোষণ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রবৃত্তির দাস হচ্ছে একটি লাগামহীম উট। তার কামনা তাকে যেদিকে নিয়ে যাবে সে পথহারা হয়ে সেদিকেই দৌড়াতে থাকবে। তার মনে ন্যায় ও অন্যায় এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করার এবং একটিকে ত্যাগ করে অন্যটিকে গ্রহণ করার কোন চিন্তা আদৌ সক্রিয় থাকে না। তাহলে কে তাকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনতে পারে! মহান আল্লাহ জানিয়েছেন,
আর কে তার চেয়ে বড় জালেম, যাকে তার রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেয়ার পর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সেই খারাপ পরিণতির কথা ভুলে যায় যার সাজ-সরঞ্জাম সে নিজের জন্য নিজের হাতে তৈরি করেছে ? (যারা এ কর্মনীতি অবলম্বন করেছে) তাদের অন্তরের ওপর আমি আবরণ টেনে দিয়েছি, যা তাদেরকে কুরআনের কথা বুঝতে দেয় না এবং তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছি৷ তুমি তাদেরকে সৎপথের দিকে যতই আহবান কর না কেন তারা এ অবস্থায় কখনো সৎপথে আসবে না৷ সূরা কাহফ:৫৭
ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহ বলেন, “দ্বীনের জন্য সবচেয়ে সাহায্যকারী চরিত্র হলো: আল্লাহমুখী হওয়া এবং ধ্বংসের জন্য হলো প্রবৃত্তির গোলামী। প্রবৃত্তির গোলামীর মধ্যে হচ্ছে দুনিয়ামুখী হওয়া। দুনিয়ামুখী হওয়ার মধ্যে হলো সম্পদ ও পদের ভালবাসা। আর এই ভালবাসা এক পর্যায়ে হারামকে হালাল করে আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে নিয়ে যায়। আর আল্লাহর অসন্তুষ্টি এমন একটি রোগ যার ঔষধ আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া নিরাময় করা যায় না। আল্লাহর সন্তুষ্টি এমন একটি ঔষধ যার পরে আর কোন রোগ আক্রমণ করতে পারে না। অতএব যে তার আল্লাহকে সন্তুষ্টি করতে চাবে, তাকে তার প্রবৃত্তিকে নারাজ করাতেই হবে, কারন যে তার প্রবৃত্তিকে নারাজ করাতে পারবে না, সে তার প্রতিপালককে খুশি বা সন্তুষ্ট করতে পারবে না। আর মানুষ যখন তার প্রতি দ্বীনের কোন কাজ ভারী মনে করে ছেড়ে দিতে থাকবে, একদিন এমন হবে যে তার সাথে দ্বীনের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না”।
আলী ইবনে আবি তালিব বলেন, “আমি দুটি জিনিষকে বেশী ভয় পাই, বড় আশা ও প্রবৃত্তির গোলামী। কারন বড় আশা আখেরাতকে ভুলিয়ে দেয় এবং প্রবৃত্তির গোলামী সত্যকে গ্রহন করা থেকে বিরত রাখে। জেনে রেখো দুনিয়া পিছনে যাচ্ছে আর আখেরাত সামনে এগিয়ে আসছে। আর প্রতিটির সন্তান রয়েছে। তাই আখেরাতের সন্তান হওয়ার চেষ্টা করো, দুনিয়ার সন্তান হওয়ার চেষ্টা করোনা। এই দুনিয়াতে আমল আছে হিসেব নেই আর আখেরাতে হিসেব আছে আমল নেই”।
প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন মানুষের উপর ফরয এবং তাকে প্রতিহত করা একজন মানুষের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আবু হাযেম রহ. বলেন, তুমি তোমার দুশমনের সাথে যেভাবে যুদ্ধ কর, তার চেয়ে আরও বেশি যুদ্ধ কর তোমার প্রবৃত্তির সাথে। হুলিয়্যাতুল আওলিয়াহ ২৩১/৩
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“অক্ষম সে ব্যক্তি যে তার নফসকে তার প্রবৃত্তির অনুসারী বানায়” ইবনে মাযাহ: ৪২৬০ হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
এ হাদিসে যে ব্যক্তি নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তাকে অক্ষম বলা হয়েছে। বাস্তবে সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে যখন তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তার চেয়ে দূর্বল ব্যক্তি দুনিয়াতে আর কেউ হতেই পারে না।
আজ আমরা অনেকেই নিজেদের এই অবস্থানে দূর্বলতার পরিচয় দিচ্ছি। ফলে অধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের মন শতদিকে শতভাবে বিচরন করতেই থাকে। এই মনকে একান্তে প্রশ্ন করে করে যদি এগুনো যায়, তাহলে নিজের কাছেই প্রবৃত্তির আসল রুপ ধরা পরে যাবে, ফলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে কোন পথে যাবো।
ঈমান একটি কাল্পনিক অবস্থা যা ধরে দেখানো যায় না। তবে অন্তরে এর অবস্থান থাকলে বাস্তব কাজ ও ব্যবহারের সাথে ঈমানের সম্পর্ক টের পাওয়া যায়। এই কাল্পনিক অবস্থার মাধ্যমে বুঝ শক্তিরও প্রকাশ ঘটে। এর কারন হচ্ছে জীবন্ত সত্তা অর্থাৎ মানুষের বিবেকের মাঝে ঈমানের অবস্থান। আর এই অবস্থাকে দিয়েই মুমিন ব্যক্তি তার পথ চলাকে সিরাতুল মুস্তাকীমের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
আল্লামা ইব্ন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, মানবজাতিকে শুধু তার নফস বা প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে কখনোই শাস্তি দেয়া হবে না, তাকে শাস্তি দেয়া হবে, প্রবৃত্তি ও নফসের অনুকরণ ও অনুসরণ করার উপর। যখন মানবাত্মা কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু সে তা না করে মানবাত্মাকে তা থেকে বিরত রাখে, তাহলে তাকে কোন প্রকার শাস্তি পেতে হবে না, বরং তার জন্য এ বিরত থাকা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত ও ইসলামী শরীয়তের নেক আমল বলে পরিগণিত হবে।
মাজমুয়ায়ে ফাতওয়া ৬৩৫/১০
এ হল একজন সত্যিকার মুসলিমের অবস্থা। সর্বদা তার নফস তাকে বিভিন্ন খারাপ ও মন্দ কাজের নির্দেশ দিতে থাকে। আর সে তার নফসের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে এবং নফসের নির্দেশ অমান্য ও বিরোধিতা করে আল্লাহকে ভয় করতে থাকে, যার মধ্যে এ ধরনের গুণ পাওয়া যাবে সে ব্যক্তিই হল সত্যিকার ঈমানদার ও প্রকৃত মুমিন। আর এ ধরনের ঈমানদারের জন্য রয়েছে জান্নাত ও উত্তম প্রতিদান।
আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল। সূরা নাযিয়াত: ৪০-৪১
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুটি জিনিষকে স্পষ্ট করেন,
প্রথমত-যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করে তার প্রবৃত্তির অবস্থান অনুযায়ী। শুধু ভয় করা যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহকে ভয় করতে হবে তার শান ও অবস্থান হিসেবে।
দ্বিতীয়ত- প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো হতে তাকে বিরত থাকতে হবে; মনে যা চায় তা করা হতে বিরত থাকতে হবে। নিজের নফস বা নফসের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হতে হবে। তখন তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা হল জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।
মোট কথা, প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী আমল করা ব্যতীত কাউকে কোন প্রকার শাস্তি দেয়া হবে না। কোন মানুষ যখন কোন গুনাহ করার ইচ্ছা করে বা তার গুনাহ করতে মনে চায়, শুধুমাত্র এর উপর তাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। তবে যদি লোকটি তার ইচ্ছা ও আকাঙ্খা অনুযায়ী আমল করে, তখন তাকে তার আমল ও প্রবৃত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
আদম সন্তানদের জন্য ব্যভিচারের একটি অংশ অবশ্যই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সে তার জীবদ্দশায় তা অবশ্যই অর্জন করবে। তার চক্ষুদ্বয়ের ব্যভিচার হল, খারাপ বস্তুর প্রতি দৃষ্টি, কর্ণদ্বয়ে ব্যভিচার হল, কোন খারাপ বা অশ্লীল কথার শ্রবণ, মুখের ব্যভিচার হল, শরীয়তের পরিপন্থী কথা, হাতের ব্যভিচার হল, নিষিদ্ধ কোন বস্তুকে স্পর্শ করা আর পায়ের ব্যভিচার হল কোন নিষিদ্ধ কাজের প্রতি অগ্রসর হওয়া। অন্তর আশা করে এবং ধাবিত হয়, লজ্জাস্থান তা সত্যে পরিণত করে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে। সহিহ মুসলিম:২৬৫৭
হাদিস দ্বারা একটি কথা প্রমাণ হয়, মানুষের অন্তরে যখন কোন খারাপ বা নিষিদ্ধ কাজের উদ্রেক হয়, তার জন্য তাকে কোন প্রকার শাস্তি পেতে হবে না এবং তাকে তার জন্য ভালো বা খারাপ বলে মন্তব্য করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার অন্তরের চাওয়াকে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা বাস্তবায়ন না করে। তার হাত পা মুখ যখন তার অন্তরের কোন চাওয়াকে বাস্তবায়ন করবে তখন তার উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিধান চালু হবে।
মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন,
হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তাঁর পথে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না। । সূরা আত তাওবা:২৪
মূলত মহান আল্লাহ এই প্রেম ভালোবাসা মানুষের অন্তরে দিয়ে আবার এর একটা শ্রেনীবিন্যাস দিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন যেন একটি সুন্দর পবিত্র নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য মণ্ডিত হতে পারে, সে জন্য এই শ্রেনী বিন্যাস অত্যাবশ্যক। সূরা তাওবার আয়াত থেকে সেই শ্রেনীবিন্যাসের ধারা জানা যায়, আর তা হলো-
১। মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা
২। প্রিয় রাসূল স.এর প্রতি ভালোবাসা
৩। মহান আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূলের স. প্রদর্শিত পথে টিকে থাকার চূড়ান্ত প্রচেষ্টার ভালোবাসা
এরপর আসবে পিতা মাতা, স্ত্রী, সন্তান সন্ততি, ভাই বোন ও আত্মীয় স্বজন ইত্যাদি অন্যান্য ।
আমাদের পরিবারগুলোতে জন্মের পর শুরুতেই এই ভালোবাসার স্তর শেখালে অনেক ধরনের ফেতনা থেকে নিজে, পরিবার ও সমাজকে হেফাজত করা যেতো।
কিন্তু আমরা প্রথমেই সন্তানকে শিখাই,
তুমি কাকে ভালোবাসো? আম্মুকে না আব্বুকে?
আমরা শিখাই না যে, তুমি আম্মু আব্বুকে চতুর্থ স্থানে এসে ভালোবাসবে। প্রথম তিনটি স্থানের ভালোবাসা কে পাবে? ঐ আয়াতের কথা শিখিয়ে দেই কি? ফলে সঠিক শিক্ষার অভাবে ভালোবাসার ভিত্তিটি হয়ে যায় ভেজালযুক্ত বা নড়বড়ে।
আজ আমাদের সমাজে তরুন তরুনী হওয়ার আগেই বাল্যাবস্থায়ই দেখা যাচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসায় জড়িয়ে পিতা মাতার ভালোবাসাকেই গৌণ করে ফেলছে, সেখানে প্রথম তিন স্তরের চিন্তাতো তাদের শিক্ষাতেই নাই। আর এরই ফলাফলে দেখা যায় মানসিক ও শারিরীক দুইভাবেই সন্তানটি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গান বাজনা, রাত জাগা বিভিন্নভাবে সময়ের অপ্রয়োজনীয় ও অপব্যবহার করে জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষতি জানার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এটা হলো হৃদয়ের বন্দিদশা।
হৃদয় যখন আল্লাহর মহব্বত ও স্মরণ থেকে শূন্য হয়ে যায়, আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় ও আল্লাহর কালামের স্বাদ গ্রহণ করা থেকে যখন শূন্য হয়ে যায়, তখন অবৈধ নারীর ভালোবাসা, ছবির প্রতি আগ্রহ, গান-বাজনা শোনার আগ্রহ তার জায়গা দখল করে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন
ইশক বা প্রেম একটি মানসিক ব্যাধি। আর যখন তা প্রকট আকার ধারণ করে শরীরকেও তা প্রভাবিত করে। সে হিসেবে তা শরীরের পক্ষেও ব্যাধি। মস্তিষ্কের জন্যও তা ব্যাধি। এ-জন্যই বলা হয়েছে, এটা একটা হৃদয়জাত ব্যাধি। শরীরের ক্ষেত্রে এ ব্যাধির প্রকাশ ঘটে দুর্বলতা ও শরীর শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, পরনারীর প্রেমে এমন সব ফাসাদ রয়েছে যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গুনে শেষ করতে পারবে না। এটা এমন ব্যাধির একটি, যা মানুষের দীনকে নষ্ট করে দেয়। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে নষ্ট করে দেয়, অতঃপর শরীরকেও নষ্ট করে।
শূন্য, দুর্বল, পরাস্ত হৃদয়েই শুধুমাত্র অনৈতিক ও অযৌক্তিক ভালোবাসা স্থান পায়। আর বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা ঐ হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না, যে হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসা ভর্তি রয়েছে ।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, পানাহার, পোশাক-আশাক, অবৈধ ভালবাসা ও গান-বাজনায় মগ্নতা মানুষকে উন্মাদ বানিয়ে দেয়। কারো অন্তরে যখন তার ভালবাসার বস্তুটির চিত্র ফুটে উঠে, তখন সে তাতেই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, এগুলো একাকার হয়ে যায় তার সত্তার সঙ্গে, যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় না তার পক্ষে। এমন হয় কখনো লোভের কারণে, যেমন সম্পদ, সম্মান ইত্যাদির জন্য। কখনো হয় ভয়ের কারণে, যেমন দুশমন বা অন্য কারো আতঙ্কে আতঙ্কিত ব্যক্তির অন্তর। প্রবৃত্তির অনুসারীরা আরো অনেক কারণে পানিতে নিমজ্জিত ব্যক্তির ন্যায় প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে আপাদ-মস্তক নিমজ্জিত হয়ে থাকে। (মাজমুআতুল ফতওয়া : ১০ / ৫৯৪)
যা কিছু মানুষের মনোজগৎ ও বিচার-বিবেচনা শক্তিকে নষ্ট করে দেয়ার মাধ্যম- তা বন্ধ করার জন্য শরিয়ত সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছে। আর প্রেম-ভালোবাসা, নরনারীর সম্পর্ক, সব থেকে বড় ব্যাধি ও মারাত্মক আপদ।
শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ র. বলেন: হৃদয় যদি একমাত্র আল্লাহকে ভালবাসে, দীনকে একমাত্র তার জন্য একনিষ্ঠ করে, তাহলে অন্য কারও ভালোবাসার মুসীবত তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রেম-ভালোবাসার কথা তো বহু দূরে। প্রেম-ভালোবাসায় লিপ্ত হওয়ার অর্থ, হৃদয়ে আল্লাহর মহব্বতের অপূর্ণতা। এ-কারণে ইউসুফ আলাইহিস সালাম, যিনি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে মহব্বত করতেন, তিনি এই মানবীয় মহব্বত থেকে বেঁচে গেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
এমনি ভাবেই হয়েছে যাতে আমি তার থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয় সে আমার মনোনীত বান্দাদের মধ্যে একজন ছিল। সূরা ইউসূফ: ২৪
ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন: পুরুষের হৃদয় যদি কোনো নারীর সাথে এঁটে যায়, যদিও সে নারী তার জন্য বৈধ হয়, তাহলেও তার হৃদয় থাকে ঐ নারীর কাছে বন্দি। নারী তার অধিপতি হয়ে বসে, পুরুষ তার ক্রীড়নকে পরিণত হয়, যদিও সে প্রকাশ্যে তার অভিভাবক; কেননা সে তার স্বামী। তবে বাস্তবে সে নারীর কাছে বন্দি, তার দাস। বিশেষত নারী যদি জানতে পারে যে পুরুষ তার প্রেমে মুগ্ধ। এমতাবস্থায় নারী তার উপর আধিপত্য চালায়, জালেম ও স্বৈরাচারী শাসক যেমন তার মাজলুম, নিষ্কৃতি পেতে অপারগ দাসের উপর শাসন চালায়, ঠিক সেভাবেই নারী তার প্রেমে হাবুডুবু-খাওয়া পুরুষের উপর শাসন চালায়। বরং এর থেকেও বেশি চালায়। আর হৃদয়ের বন্দিদশা শরীরের বন্দিদশা থেকে মারাত্মক। হৃদয়ের দাসত্ব শরীরে দাসত্বের চেয়েও কঠিনতর।
আর এটা যখন শক্তিশালী পর্যায়ে পৌঁছে, প্রকট আকার ধারণ করে তখন কখনো আল্লাহর ভালোবাসাকেও অতিক্রম করে যায় এবং ব্যক্তিকে শিরকের দিকে ঠেলে দেয়।
এই অবস্থাটা যেকোন নারী বা পুরুষের বেলায়ই হতে পারে। অনেক নারীও এইভাবে স্বামীর প্রতি ভালোবাসার বন্দিনী হয়ে একই ধরনের অবস্থায় চলে যেতে পারে।
আজ আমাদের সমাজে মহান আল্লাহর দেয়া ভালোবাসার মাপকাঠি সম্পর্কে অনেকে জানেই না, অনেকে এটাকে জেনেও মূল্যায়ন করে না, আবার অনেকে নিজের প্রবৃত্তির কাছে হেরে যায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। ফলে দেখা যায় পিতা মাতার ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে থাকে, স্বামী, স্ত্রীর ভালোবাসায়/ স্ত্রী, স্বামীর ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে শরীয়তের বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে, পুরুষ কর্তাটি প্রবৃত্তির দাসত্বের শৃন্খলে থেকে মা-বাবা ও স্ত্রীর হক আদায়ে সমণ্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়ে পরিবারে অশান্তি নিয়ে আসে,আর তরুন তরুনীরা অবৈধ প্রেম ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে নিজের জীবনসহ পরিবার তথা সমাজ জীবনকে কলুসিত করে ফেলে।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয় আজ মিডিয়াগুলোতে নাটক, সিনেমা, মুভি, গান সবকিছুরই যেন একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হলো জীবনের জন্য শুধুই প্রেম যা বৈধ বা অবৈধ কোন নিয়ম নীতির প্রয়োজনীয়তা নেই। জীবনের মূল উদ্দেশ্য থেকে সবাইকে সরিয়ে শয়তানের পথে চালিত করাই এর মূল কারন। আখেরাতের জীবনে যেতে হবে ও দুনিয়ার প্রতিটি সময় কাজ ও নিয়ামতের জবাবদিহী করতে মহান রবের সামনে দাঁড়াতে হবে, বিভিন্নভাবে শয়তান তা ভুলিয়ে রাখে।
পরকালের প্রতিদান হলো, যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ করবে, তার স্থান জান্নাত আর যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুকরণ করবে, তার স্থান জাহান্নাম।’
অন্তরে যখন ইমানের উপস্থিতি কম হয়, তখনই প্রবৃত্তি ও কু-কামনা বৃদ্ধি পায়, বরং তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।