প্রবৃত্তির অন্ধ অনুসরন থেকে দূরে থাকার নির্দেশ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী রাসূলদেরকেও প্রবৃত্তির অনুসরন করা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। সাবধানবানী উচ্চারন করেছেন। প্রবৃত্তির লাগামহীন অনুসরন করার পরিনতি সম্পর্কেও ধারনা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ কুর’আনে বলেছেন,
হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য সহকারে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করো এবং প্রবৃত্তির কামনার অনুসরণ করো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করবে। যারা আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হয় অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি, যেহেতু তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে। সূরা সাদ:২৬
হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য যাদেরকে ডাকো তাদের বন্দেগী করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। বলো, আমি তোমাদের ইচ্ছা-বাসনার অনুসরণ করবো না। এমনটি করলে আমি বিপথগামী হবো এবং সরল-সত্য পথ লাভকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকবো না। সূরা আন’আম:৫৬
ইহুদি ও খৃস্টানরা তোমার প্রতি কখনোই সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের পথে চলতে থাকো। পরিষ্কার বলে দাও, পথ মাত্র একটিই, যা আল্লাহ বাতলে দিয়েছেন। অন্যথায় তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তারপরও যদি তুমি তাদের ইচ্ছা ও বাসনা অনুযায়ী চলতে থাকো, তাহলে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষাকারী তোমার কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী থাকবে না। সূরা বাকারা:১২০
মহান রবের এই কথাগুলো থেকে বুঝা যাচ্ছে নিজের ইচ্ছা বাসনার তথা প্রবৃত্তির অনুকূলে চললে একজন ব্যক্তি বিপদগ্রস্ত হবে এবং সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে এবং সর্বোপরী মহান রবের পক্ষ থেকে কোন সাহায্য পাওয়াতো দূরের কথা বরং আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচা যাবে না।
আজকের সমাজে আমাদের অবস্থান অনেকটাই এইরুপ। মনের চাওয়া পাওয়ার এমন অনুসরন করা হয় যে শরীয়তের বিধান রচয়িতা মহান আল্লাহর দেয়া শরীয়তকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিজেদের প্রবৃত্তির আলোকে চলে অনেকেই।
যেমন পড়ালেখার উন্নত শিখরে যাওয়ার জন্য ছোটবেলা থেকেই ভালো স্কুলের নামে সহশিক্ষা, সালাত সাওমকে ঐচ্ছিক হিসেবে নেয়া, হিজাব সমস্যা হলে- যে কোন সময় ছেড়ে দেয়া, প্রয়োজনে ঘুস দিয়ে কাজ উদ্ধার করা, নিজের জন্ম তারিখকে পরিবর্তন করে নেয়া, পারফরমেন্স এর জন্য অপসংস্কৃতির অনুসরন করা ইত্যাদি যারা ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন বা জ্ঞান দান করেন সেই পরিবারগুলোতেও ইদানিং এই অবস্থা দেখা যায়। তথাকথিত স্ট্যাটাস দেখাতে যেয়ে অন্যদের প্রবৃত্তির সাথে তাল মিলিয়ে হারাম গান বাজনা বা শরীয়ত বিরোধী আড্ডায় সময় নষ্ট করতে দ্বিধা করে না। কোন কোন অনুষ্ঠানে দেখা যায় মাথায় একটি হিজাবের স্কার্ফ বা ওড়না পড়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে খুব তালে তালে গান গাচ্ছেন।
আবার সামাজিকতায় নিজের সুনাম সুখ্যাতি ও কিছু মানুষের খুশি রাখার জন্য দেখা যায় পরিবারে শরীয়তের পর্দার বিধান উপেক্ষা করে একসাথে নারী পুরুষ গল্পে মশগুল, অবৈধ পথে উপার্জন করে হলেও ইউরোপ, আমেরিকা বেড়াতে যাওয়া, দাওয়াত, পার্টি, উপহার দেয়া, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী ও বিয়ের অনুষ্ঠান জাকজমক করে আয়োজন করেন নারী পুরুষ একসাথে।
আবার বিভিন্ন দিবসে অংশ নেয়া যেমন, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, বৈশাখী মেলার নামে উশৃংখলতা, নববর্ষ উদযাপন, পূজায় যাওয়া, বড়দিনের শুভেচ্ছা জানানো ইত্যাদি।
আজ আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোও দেখা যায় সেই প্রবৃত্তির অনুসরনে কে কত নবরুপে উন্মোচিত করতে পারে তার প্রতিযোগীতা চলছে। প্রবৃত্তি খুব সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে তাকে বলে, আল্লাহ যে সৌন্দর্য্য দিয়েছে, যে আভিজাত্য দিয়েছে তাকে কেন অন্যকে দেখাবে না, অন্যের চোখকে আকর্ষিত করার অনেক উপাদান আছে, সেগুলো কেন ব্যবহার করবে না। আবার বর কনে ও উভয় পরিবারের ব্যক্তিদের প্রবৃত্তি বুঝায়, জীবনেতো একবারই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, একটু অন্যরকম করে সমাজের স্রোতের মাঝে নিজেদের ভাসিয়ে দিলে কি আর সমস্যা, পরে আবার পর্দা ও শরিয়তের মাঝে চললেই হলো। যেভাবেই হোক সব ধরনের সমাজে প্রচলিত অনুষ্ঠানের খরচ করতে হবে তা না হলে মানুষ কি বলবে?
অথচ এরাই অন্য সময় ইসলামের বিধান পালন করার চেষ্টা করেন ও অন্যদের বলেন। সুবিধামত সময়ে প্রবৃত্তি যখন যা চায় সেভাবেই চলে। আমাদের সমাজে এই ধরনের চরিত্র বেশী। দু নৌকায় পা দিয়ে নদী পার হওয়া যেমন অসম্ভব, প্রবৃত্তির দাসত্ব ও কিছু সময় আল্লাহর বিধান সুবিধা মত করে পালন করে চললে জান্নাতে যাওয়া তেমনি অসম্ভব। আর যারা ইসলামের বিধানের ধারেই ঘেসতে চায় না তাদের কথা তো নাই বা বললাম। প্রবৃত্তিই তাদের হুকুম দাতা এবং তখন শয়তান হয়ে যায় তাদের সেক্রেটারী।
আজ ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমেও নিজেকে উপস্থাপন করতে যেয়ে শরীয়তের নিয়ম বাদ দিয়ে প্রবৃত্তির নব নব টেকনিকে নিজেকে আসক্ত করে ফেলছে। যদিও অনেকেই জানেন মহান আল্লাহ প্রত্যেককেই প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। প্রবৃত্তি তাকে প্রবোধ দেয়, ইন্টারনেটের সামাজিক মাধ্যমেই ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দাও, এটার মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দেয়া যায়, নতুন প্রযুক্তির সাথে আপডেট থাকা যায়, মানুষ তা না হলে বলবে তুমিতো বোকা বা বেকডেটেড। অথচ সালাতে সময় দেয়া, কুর’আন তেলাওয়াত, পরিবারে সময় দান, আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ, কোন কিছুই ভারসাম্যভাবে আদায় করতে পারে না। সুন্দর সুন্দর কথা বিভিন্ন কমেণ্ট ইত্যাদি দেখলে বুঝাই যাবে না এই ব্যক্তিটির আসল আচার আচরন কি? প্রবৃত্তি তাকে এতো বেশী তৃপ্ত করে রাখে যে, সে তার আল্লাহ ও পরিবারের লোকদের সাথে লেন দেন যেমনই হোক তাতে আসে যায় না।
আজ সমাজে ছেলে মেয়ের মাঝে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ককে সংস্কৃতির অংশ বানিয়ে নেয়া হয়েছে যেন! তুই তুই করে সম্বোধন ও পিঠে গালে চড় থাপ্পর, পাশাপাশি বসে আড্ডা দেয়া, হাত ধরে চলা, রাতে মোবাইলে চ্যাট করে সময় পার করা ইত্যাদি ছাড়া যুব সমাজ যেন অচল বা আধুনিকতা বহির্ভূত। আবার জিজ্ঞেস করলে বলবে, সেতো আমার বন্ধু বা বান্ধবি, প্রেমিক বা প্রেমিকা না, এটা আরেক লাগামহীন যৌনতার ভাষা। এইক্ষেত্রেও আমাদের অনেক অভিভাবক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার কথা বলে সহজেই প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন হারাম এই কাজগুলোকে। আর সমাজে যা হবার তা একটু সচেতন ও বিবেক দিয়ে রংগীন চশমা খুলে তাকালে ও চিন্তা করলেই সত্যটা বুঝতে সকলেই সক্ষম হতেন।
অনেক নারী পুরুষ বিয়ের পরও এইধরনের হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পরিবার ও সমাজকে কলুষিত করে জাহান্নামের রাস্তাতো সুগম করছে পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনে নিজের ও অন্যের জীবনকেও নষ্ট করছে। ফলে পরিবারের ভালোবাসার বন্ধনের পবিত্রতার যে আকর্ষন তা অনেকটাই শিথিল হয়ে যেতে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভেংগেই যায়।
চাকরীজীবিরাও তথাকথিত কলিগ ও বসদের খুশি রাখার জন্য অনেক অন্যায় ও শরীয়তের বাইরের কাজ নিজেও করেন বা নিজে না করলেও অন্যের কাজের সংশোধন না করে অনুমোদন করে থাকেন বাহবা বা মৌনতা দিয়ে।
আজ প্রতিটি মহলেই অনেকেই নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করা থেকে নিজেকে মুক্ত করার ঈমানী শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। উপরের যে উদাহরনগুলো দিয়েছি তার পিছনে এটাই বড় কারন। মহান রবের দাসত্ব যেখানে গৌন হয়ে যায় ও প্রবৃত্তির দাসত্ব যেখানে মূখ্য সেখানে ব্যক্তির জীবন, পরিবার ও সমাজ জীবনেও বিশৃংখলা দেখা যাবেই।
মহান আল্লাহ বলেছেন আল কুর’আনে,
আর সত্য যদি কখনো তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতো তাহলে আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যের সবকিছুর ব্যবস্থাপনা ওলট-পালট হয়ে যেতো। সূরা আল মুমিনূন:৭১
আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হিদায়াত ছাড়াই নিছক নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে হবে? আল্লাহ এ ধরনের জালেমদেরকে কখনো হিদায়াত দান করেন না। সূরা কাসাস:৫০
রাসূল স.বলেছেন, তিনটি নাজাতকারী জিনিষ:
১। প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহর ভয়
২। সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে ইনসাফ ও
৩। স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায় মিতব্যয়ীতা
আর তিনটি জিনিষ ধ্বংসকারী:
১। কু প্রবৃত্তির অনুসরন
২। মান্য কৃপণতা এবং
৩। মানুষের আত্মমুগ্ধতা
সহীহুল জামে আলবানী:৩০৩৯