প্রবৃত্তির প্রকারভেদ
মনের চাওয়ার মাঝে কিছু আছে কল্যানকর যা মহান রবের নির্দেশিত পথে চলতে চায় আর কিছু অকল্যানকর যা মহান রবের পথ থেকে উল্টোদিকে শয়তানের পথে চলতে চায়। তাই এদের একটি হলো প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি এবং অপরটি নিন্দনীয় প্রবৃত্তি
প্রবৃত্তিকে ঢালাওভাবে খারাপ বা ভালো কোনটিই বলা চলে না। তবে যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজে লিপ্ত হয়, এবং এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে তাদেরই খারাপ বলা যাবে। প্রক্ষান্তরে যে প্রবৃত্তি মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি মোতাবেক চলতে সাহায্য করে, তা কোনদিন খারাপ হতে পারে না। তাকে অবশ্যই ভালো প্রবৃত্তি বলতে হবে। আর যে প্রবৃত্তি দ্বারা উপকার লাভ ও ক্ষতি দূর করা সম্ভব নয় তা অবশ্যই খারাপ। এ ছাড়া যে প্রবৃত্তি মানুষকে খারাপের দিকে নিয়ে যায় এবং মানবাত্মার উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, তা অবশ্যই খারাপ ও নিন্দনীয়।
প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি হল, যে প্রবৃত্তিকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল পছন্দ করে। এ ধরনের প্রবৃত্তি শরীয়তের বিধানের পরিপন্থী হয় না। বরং, তা মানুষকে আল্লাহর মর্জি মোতাবেক চলতে সাহায্য করে। এ ধরনের প্রবৃত্তির দৃষ্টান্ত হাদিস কুরআন দ্বারাও প্রমাণিত।
কোন কোন বিষয় ছিল, যেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিজের জন্য পছন্দ করতেন বা তার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগ্রহ ছিল, তখন আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তাঁর চাহিদা মোতাবেক কুরআনে নাযিল করেছেন; ফলে এর দ্বারা প্রমাণিত হত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কামনা করেছেন বা তাঁর মন যা চেয়েছে তা ছিল প্রশংসনীয় ও ভালো চাহিদা বা ভালো প্রবৃত্তি। এখানে যে কথাটি প্রমাণিত হয়, তা হল প্রবৃত্তি বা চাহিদা মানেই কোন খারাপ বা মন্দ কিছু নয়; তা ভালোও হতে পারে আবার মন্দও হতে পারে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিষয়গুলো কামনা করতেন, তার মধ্যে একটি বিষয় ছিল, তিনি কিবলাকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে ফিরিয়ে ক্বাবার দিক করাকে পছন্দ করেন। এর কারণ সম্পর্কে ওলামারা বলেন, তিনি ইবরাহীম আ. এর কিবলার অনুসরণ করাকে পছন্দ করেতেন বলেই, কিবলার পরিবর্তন চাইতেন। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনের চাহিদা ছিল, কিন্তু মনের চাহিদা হওয়ার কারণে একে খারাপ বলা যাবে না। কেননা, এর পিছনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়ত সৎ ও ভালো ছিল। তিনি ইবরাহীম আ. এর নির্মিত কাবার অনুকরণ করাকে পছন্দ করছেন। আর ইবরাহীম আ. এর নির্মিত কাবাকে পছন্দ করার কামনা করা হল, প্রসংশনীয় কামনা ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
আবি বারযা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“আমি তোমাদের উপর যে জিনিষটি অধিক ভয় করি তা হল, তোমাদের পেট, লজ্জাস্থান ও গোমরাহ প্রবৃত্তির চাহিদা।
আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমি যে বিধান নিয়ে এসেছি তার অনুকরণ না করে”।
এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, প্রবৃত্তির একটি প্রকার আছে, যেটি প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি আর তা হল, যে প্রবৃত্তি ইসলামী শরিয়ত যে বিধান নিয়ে আসছে তার অনুগত ও মোতাবেক হয়। আর যে প্রবৃত্তি ইসলামী শরিয়তের সাথে সংঘর্ষিক হয়, তা হল কু-প্রবৃত্তি বা শয়তানি-প্রবৃত্তি।
ওমর ইব্ন খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“বদরের যুদ্ধে যুদ্ধ-বন্দীদের বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ চেয়ে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু ও ওমর রাদিআল্লাহু আনহু উভয়কে জিজ্ঞাসা করে বললেন, তোমরা তাদের ব্যাপারে কি মতামত দাও? উত্তরে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর নবী! তারা আমাদের বাপ-চাচাদের বংশধর এবং আমরা একই বংশের লোক। আপনি তাদের থেকে কিছু ফিদিয়া গ্রহণ করে তাদের ছেড়ে দিন। এতে তারা খুশি হয়ে আমাদের বিরোধিতা করবে না, আমাদের পক্ষের লোক হয়ে যাবে, যা পরবর্তী্তে আমাদের জন্য কাফেরদের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে উপকারে আসবে। আশা করি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের ইসলামের প্রতি পথ দেখাবেন। আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওমর ইবনুল খাত্তাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, হে ওমর! তোমার মতামত কি? ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বলল, না আমি আবু বকর যে মতামত দিয়েছে তার সাথে মোটেও একমত নই। তবে আমার কথা হল, আপনি আমাদের সুযোগ দেবেন আমরা তাদের সকলকে হত্যা করে কারণ, এরা সবাই হল কুফরের লিডার ও ইমাম। এদের হত্যার কোন বিকল্প হতে পারে না। তাদের উভয়ের মতামত শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু এর মতামতকে প্রাধান্য দেন।
এ হল, আমাদের নবী যিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। তিনি প্রথমে আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু এর কথার প্রতি আকৃষ্ট হন। কারণ, তিনি বাহ্যিকভাবে দেখতে পেলেন যে এ মতের মধ্যে রয়েছে ইসলামের কল্যাণ এবং এটি হল প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি। কারণ, সে যে চিন্তা করেছিল তা ছিল ইলমের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত।
মনে রাখতে হবে নফসের বিরোধিতা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, আত্মার জন্য তা অতি কষ্টদায়ক এবং শরীরের উপর অনেক চাপ। কিন্তু এর পরিণতি অত্যন্ত ভালো এবং ফলাফল খুবই মধুর। নফসের বিরোধিতা করার ফলাফল লাভ হতে একমাত্র তারাই বঞ্চিত হয়, যাদের সাহস দুর্বল ও মানসিকতা কলুসিত। আবুল আতাহিয়া রহ. বলেন,
“সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হল নফসের সাথে যুদ্ধ করা। আর তাকওয়া ছাড়া একজন মানুষকে আর কিছুই সম্মান দিতে পারে না”।
অপর একজন কবি বলেন,
“আমি যুগের মুসিবতের উপর ধৈর্যধারণ করি, ফলে তা আমাকে পৃষ্ট পদর্শন করে। আর আমি আমার আত্মার উপর ধৈর্য ধারণ করাকে চাপিয়ে দেই, ফলে তার কখনো বিচ্যুতি ঘটেনি। আর হে যুবক তুমি মনে রাখবে, নফসের বৈশিষ্ট্য হল, তুমি তাকে যেখানে লাগাবে সে সেখানেই ব্যবহৃত হবে। যখন তুমি তাকে প্রলোভন বা যোগান দিবে তখন সে শক্তিশালী হবে, অন্যথায় সে নিস্তেজ হয়ে থাকবে”।
প্রবৃত্তির অনুসরণ করা শুধু মূর্খ-জাহেল বা বাচ্চাদের বৈশিষ্ট্য নয় যা তাদের পথহারা করে বরং প্রবৃত্তির অনুসরণ সব ধরনের মানুষের বৈশিষ্ট্য। এমনকি আলেম-ওলামা, জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শক সব ধরনের লোকের অন্তরে প্রবৃত্তি বা খারাপ আত্মা বিদ্যমান থাকে। নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, আবাল-বৃদ্ধা কেউ নফস বা প্রবৃত্তির চাহিদা হতে নিরাপদ নয়।
সুতরাং, কেউ এ কথা বলতে পারবে না যে, প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে যে নিষেধ করা হয়েছে, আমি তার আওতার বাহিরে। কারণ, আমিতো প্রবৃত্তির অনুসরণ করি না।
মনসুর আল-ফকীহ রহ. বলেন,
তোমার চেহারায় যে সব দাগ রয়েছে তা তুমি প্রত্যক্ষ করতে পারবে না। (বরং তোমার চেহারার দাগগুলো অপরের চোখে প্রদর্শিত হবে।) অনুরূপভাবে তুমি তোমার নফসের দোষ-ত্রুটিগুলো কখনোই দেখতে পারবে না। (অপরের নিকট তা অবশ্যই ধরা পড়বে।)
অনেক সময় দেখা যায় আমরা যাদের সবচেয়ে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও দ্বীনদার বলে বিবেচনা করি সেও তার নফসের ধোঁকায় পড়ে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে বিরত থাকতে পারে না।
আমরা আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের দরবারে কামনা করি আল্লাহ রাব্বূল আলামীন যেন আমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণের উপকরণ থেকে রক্ষা করে, আর আমাদের থেকে গোমরাহিকে দূর করে এবং আমাদের যেন তিনি ভালো ও সৎ কাজ করার তাওফিক দান করে।