মন কি বলে ও প্রবৃত্তি কি চায়?-৩

নফস ও রুহ

নাফস ও রুহ মূলত একই বস্তু। তবে পারিভাষিক ভাবে ভিন্ন ভিন্ন অর্থেও ব্যবহার হয়। এর অর্থ আত্মা বা প্রান।

 আবু হুরায়রাহ  রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীছে প্রমাণিত হয়, রূহ (روح) এবং নাফ্‌স (نفس) একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাসূল সা. বলেন,

তোমরা কি দেখনি, মরনের সময় মানুষ অপলক দৃষ্টিতে এবং চোখ মোটা করে তাকায়?’ সাহাবিগণ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) বললেন, নিশ্চয়ই। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘মানুষের নাফ্‌স বের হওয়ার সময় তার চোখ সেদিকে তাকিয়ে থাকে বলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়’।  সহিহ মুসলিম: ৯২১

 উম্মে সালামাহ রা. বর্ণিত অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যখন রূহ ছিনিয়ে নেয়া হয়, তখন চোখ সেদিকে দেখতে থাকে’।     সহিহ মুসলিম: ৯২০

নাফস আরবী শব্দ নাফীস থেকে উদ্ভূত।

নাফীস অর্থ সুন্দর ও আকর্ষনীয় বস্তু।

আরেকটি অর্থ বলা হয়। আরবী তানাফফুস থেকে উদ্ধৃত।

তানাফফুস অর্থ শ্বাস গ্রহন। শ্বাস যেমন দেহ থেকে বের হয় এবং দেহে ফিরে আসে ঠিক তেমনি রুহও একবার দেহ থেকে বের হয় আবার ফিরে আসে। যেমন –ঘুম ও কবরে।

গুনগত ও অবস্থানগত দিক দিয়ে নফসের ৩ অবস্থা।

১। নফসে মুতমায়িন্নাহ ২। নফসে আম্মারাহ ৩। নফসে লাওয়ামাহ

 

 নফসে মুতমায়িন্নাহ

যখন নফস আপন প্রভু আল্লাহর প্রতি ভালবাসায়, ইবাদত, ক্ষমা-প্রার্থনায়, তাঁর অভিমূখী হওয়া, সব কাজে সন্তুষ্ট থাকার মাধ্যমে প্রশান্ত হয়ে উঠে।

প্রকৃ্তপক্ষে ইতমিনান বা প্রশান্তি আল্লাহর পক্ষ থেকেই মানুষের অন্তরে অবতীর্ণ হয়। চিত্তের প্রশান্তি এমন এক জিনিষ যা দ্বারা মনের যাবতীয় দুশ্চিন্তা ও দুঃখ ব্যথা দূর হয়ে যায়।

মহান আল্লাহ জানিয়েছেন,

তাদের চিত্ত আল্লাহর স্মরনের কারনে পরম শান্তি ও স্বস্থি লাভ করে। জেনে রেখো আল্লাহর যিকরের মাধ্যমেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।    সূরা রাদ:২৮

আল্লাহ তাঁর নামসমূহ ও গুনাবলী সম্পর্কে পবিত্র কুর’আনে যা বলেছেন বান্দা সেগুলোর প্রতি মনে প্রানে বিশ্বাস স্থাপন করে আনুগত্য প্রকাশ করে, ওযর-আপত্তি ছাড়াই মেনে নেয়—এ থেকেই তার অন্তরে আনন্দের ধারা নামে।

দুনিয়ার প্রতিকূল অবস্থায় এই প্রশান্তির সামান্যতম বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। এটাই প্রশান্তির প্রথম স্তর। এরপর যতই কুর’আন শুনবে ততই প্রশান্তি বৃদ্ধি পাবে। এ প্রশান্তি হলো ঈমানের মুল শিকর বা ভিত্তি যার উপর ঈমানের প্রাসাদ গড়ে উঠে।

প্রশান্তি দু প্রকার।—

১। আল্লাহর উপর ঈমান ও ইতিকাদ সূদৃঢ় হবে এবং তার চাহিদা অনুযায়ী বন্দেগীর প্রভাবসমূহ দ্বারা চিত্তের প্রশান্তি অর্জিত হবে।

২। ইহসান বিষয়ক আন্তরিক প্রশান্তি-অর্থাৎ আন্তরিক ও নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহতায়ালার নির্দেশাবলী পালনের মাধ্যমে শান্তি।

আত্মার প্রশান্তি দুটি জিনিষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত।

১। জ্ঞান ও বিশ্বাসের মধ্যে

 ২। ইরাদা (সংকল্প) ও আমলের মধ্যে।

এইরুপ ব্যক্তি বুঝতে পারে যে নফস সব খারাপের উৎস। সে বলে-

হায়! আল্লাহর প্রতি আমার কর্তব্যে আমি যে শৈথিল্য করেছি তার জন্য আফসোস, আমি তো ঠাট্টাকারীদের মধ্যে ছিলাম।      সূরা যুমার:৫৬

অতঃপর এ ভাবে বাকী জীবন সে সুন্দর সংশোধনে এগিয়ে চলে। প্রকৃতপক্ষে তার যাবতীয় পূন্যাদি অর্জনের ক্ষমতা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ ভাবেই সে আসহাবে ইয়ামীনে উন্নিত হতে পারে। যেমন মহান আল্লাহ জানিয়েছেন,

আর যদি সে ডানদিকের একজন হয় তাকে বলা হবে, হে দক্ষিন পার্শ্ববর্তী, তোমার প্রতি শান্তি।   সূরা ওয়াকিয়া: ৯০-৯১

আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে আমার নিকটবর্তী হতে পারে। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ভালোবাসতে শুরু করি। আর আমি যখন ভালোবেসে ফেলি, তখন আমি তার সেই কান হই যা দিয়ে সে শুনে, আমি তার চোখ হই যা দিয়ে সে দেখে, আমি তার মুখ হই যা দিয়ে সে কথা বলে।  (হাদীসে কুদসী)

এইভাবে বান্দা আল্লাহর এত প্রিয় হয়, তখন সে(বান্দা), আল্লাহ যা পছন্দ করেন তা ই করে।

এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন-

হে প্রশান্ত আত্মা। তোমার আল্লাহর দিকে চল, এরুপ অবস্থায় যে, তুমি (তোমার ভালো পরিনতির) সন্তষ্ট এবং (তোমার আল্লাহর নিকট ) প্রিয়পাত্র। আমার বান্দাহদের মধ্যে শামিল হও এবং প্রবেশ কর জান্নাতে।       সূরা ফজর:২৭-৩০

যে লোক নিজের নফসের খাহেশকে নিজের আল্লাহ বানিয়ে নিয়েছে এবং আল্লাহর ইলম থাকা সত্ত্বেও তাকে গোমরাহীতে ফেলে রেখেছে, তার দিল ও কানের উপর মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তাদের চোখের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছেন। আল্লাহ ছাড়া তাদিগকে হেদায়াত দেয়ার আর কে-ই –বা আছে? তোমরা কি শিক্ষা গ্রহন করবে না ?         সূরা জাসিয়াঃ২৩

এমনটা কি কখনও হতে পারে যে, যে লোক তার আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত এক সুস্পষ্ট পরিচ্ছন্ন হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে সেই লোকদের মত হয়ে যাবে, যাদের জন্য খারাপ কাজ সমূহ মনোহর বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তারা নিজেদের কামনা বাসনার অনুসারী হয়ে গিয়েছে ?       সূরা মুহাম্মদঃ১৪

 

নাফসে লাওয়ামাহ

তালাওউম শব্দ থেকে নির্গত যার অর্থ খুব বেশী ইতস্তত করা, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগা।

কারো মতে লাউম(সালামত) ধাতু থেকে নির্গত। যার অর্থ ধিক্কার দেয়া।

কাফির ও মুমিন উভয়ের নাফস এই লাওয়ামার অন্তর্ভূক্ত। এটা মুমিনকে গুনাহে লিপ্ত করে, কিন্তু ধিক্কার দেয় আবার। কাফিরদিগকে কামনা-বাসনা চরিতার্থ না করার কারনে ধিক্কার দেয়।

এই নফসের শক্তি যাদের অন্তরে বেশী, তারা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে চায় কিন্তু আবার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে না পেরে গুনাহ করে ফেলে এবং গুনাহ করার পর অনুশোচনাও করে। আবার ভালো কাজের আগ্রহ থাকলেও এই নফসের সাথে শয়তানের ওসওয়াসা একত্র হয়ে ভালো কাজ থেকে দূরে রাখে। এইভাবেই জীবনের মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে চলে।

আল্লাহ বলেছেন-

আমি আরও শপথ করছি নাফসে লাওয়ামার। মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারবো না? বস্তত আমি তার অংগুলির অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।   সূরা কিয়ামাহ:২-৪

 

নাফসে আম্মারাহ

খারাপ ও ধিকৃত নাফস। এই নাফসই মানুষকে যাবতীয় অসৎকর্মের দিকে প্ররোচিত করে।

সে(ইউসুফ) বললো, আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না, মানুষের মন অবশ্যই মন্দপ্রবন (আম্মারা বিস সূ) কিন্তু সে নয় যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন। সূরা ইউসুফ: ৫৩

 আলাহ’তায়ালা যাকে সাহায্য করেন একমাত্র সেই নাফসের প্ররোচনা থেকে বাঁচতে পারে। তাই সব সময় মহান রবের কাছে সাহায্য চাইতে থাকতে হবে নফসে মুতমায়িন্নাহ লাভের জন্য।

হে বিশ্বাসীগন, তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরন করোনা। কেউ শয়তানের পদাংক অনুসরন করলে শয়তানতো অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়। আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হতে পারতোনা, তবে আলাহ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করে থাকেন এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।    সূরা নূরঃ২১

আল্লাহতা’আলা এই দু প্রকার নাফস আম্মারা ও লাওয়ামাহ দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করেন।

আম্মারাহ>>লাওয়ামাহ>> মুতমায়িন্নাহ

ইতমিনান ও প্রশান্তিই হল নাফসের পরিপূর্ণতা ও পরিপক্কতা।

আল্লাহতা’আলা তাঁর বাহিনী দ্বারা মুতমায়ীন্ন কে সহায়তা দান করেন। সে ঈমান-ইয়াকীন দ্বারা আম্মারার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

মুতমায়ীন্ন নফসকে উদ্বুদ্ধ করে যে ধরনের কার্যাবলী—-

আল্লাহমুখী হওয়া

আল্লাহর উপর ভরসা করা

সত্যপরায়নতা

বিশুদ্ধচিত্ততা ও বিশ্বস্ততা

তাওবা ও নিজের নফসের হিসেব নেয়া।

নফসে আম্মারা ঐগুলোর বিপরীত কাজের দিকে নিয়ে যেতে চায়-

সংশয়, নিফাক, শিরক, গায়রুল্লাহ প্রীতি ও ভীতি।

প্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তির মাঝে পরিষ্কার রেখা একে নিতে হবে যেন একটা আরেকটার সাথে মিশে না যায়, আবার একেবারে সবটুকুই নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়। কারন মনের চাহিদার যুক্তিযুক্ত ও সঠিক প্রতিফলন সুস্থ্য জীবনের জন্য প্রয়োজন।