মন কি বলে ও প্রবৃত্তি কি চায়?-২

 

মানব সত্তা

রসূল স. আমাদের উদ্দেশ্যে বর্গাকৃ্তির একটি চতুর্ভুজ আঁকলেন, অত:পর এর মাঝ বরাবর একটি সরলরেখা টানলেন, অতঃপর চতুর্ভুজের বাইরে দিয়ে একটি সরল রেখা টানলেন, অতঃপর মাঝের সরলরেখার চতুর্দিকে অনেকগুলো রেখা টানলেন এবং বলেন — এটি হলো আদম-সন্তান এবং বেষ্টনি হল তার জীবনকালের সীমারেখা, যা তাকে বেষ্টন করে রেখেছে। মধ্যখানের সরল রেখাটি হল মানুষ, এর চারপাশের রেখা সমূহ হল তার বিপদাপদ। সে এর একটি থেকে মুক্তি পেলে অপরটি তাকে দংশন করে। আর বাইরের রেখাটি হল তার কামনা-বাসনা। সহিহ বুখারী

রসূল (সঃ) বলেছেন-আদম সন্তান বৃদ্ধ হয়ে গেলেও তার দু’টি স্বভাব যুবকই থাকে: সম্পদের লোভ ও বেঁচে থাকার লালসা। সহিহ বুখারী

প্রতিটি কাজের পেছনে থাকে প্রেরনা ও উদ্দীপনা, আর উদ্দীপনার পেছনেই লুকিয়ে থাকে অলসতা ও কর্মবিমুখতা। কাজেই যে ব্যক্তি সোজা পথে চলে এবং মাঝামাঝি পর্যায়ে নিজেকে সোজাভাবে কাজে অটল রাখতে পারে তার সাফল্য লাভের আশা করতে পার। আর যদি তার দিকে আংগুলে ইশারা করা হয় (লোক দেখানো আমল করে) তাহলে তাকে সফলকাম লোকদের মধ্যে গন্য করোনা। সহিহ জামে আত তিরমিযী

তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর। আমরা বললাম, হে আল্লাহর নবী ! আমরাতো নিশ্চয়ই লজ্জা করি, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তিনি বলেন- তা নয়, বরং আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, তুমি তোমার মাথা এবং এতে যা কিছু আছে তা সংরক্ষন করবে এবং পেট ও এতে যা কিছু আছে তা হেফাযত করবে, মৃত্যুকে এবং এরপর পঁচে-গলে যাবার কথা স্মরন করবে। আর যে ব্যক্তি পরকালের আশা করে, সে যেন পার্থিব আড়ম্বর পরিত্যাগ করে। যে ব্যক্তি এসব কাজ করতে পারে সে-ই আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করে। সহিহ জামে আত তিরমিযী

মানব-সত্তা বিচিত্র। মানুষের দুটো সত্তা রয়েছে।

১। দেহ সত্তা ২। নৈতিক সত্তা

দেহ সত্তা হলো বস্তু সত্তা এবং দুনিয়াটাও বস্তু সত্তা, তাই দুনিয়ার প্রতি প্রবল আকর্ষন।

পৃথিবীতে ভোগের যা কিছু আছে সবই দেহ ভোগ করতে চায়। দেহের মুখপাত্র হলো মন। মন যা চায় তা দেহেরই দাবী। কুর’আনে দেহের দাবীকে নাফস নামে আখ্যায়িত করেছে।

মানুষের বিবেক বা নৈতিক সত্তাই দেহের দাবী সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করে। এ বিবেকই হলো আসল মানুষ। কুর’আনের ভাষায় একে বলে রুহ।

দেহ হাজারো দাবী করতে পারে কিন্তু রুহ বা বিবেকের যোগ্যতা থাকলে তা নিয়ন্ত্রন সম্ভব।

মনের উপর লাগাম ধরতে হবে রসূল স. এর দেখানো পথে।

সব সময় মহান আল্লাহকে স্মরনে রাখলেই মনের লাগাম ধরা সহজ হতে পারে।

মন এমন একটা ঘোড়া যার পিঠ কখনো খালি থাকে না, কেউ না কেউ সওয়ার হয়।

আপনার পিঠে কে সওয়ার আছে একটু দেখুন তো?

  • নফস
  • সমাজ স্রোতধারা যা আল্লাহর ও রাসূলের স. বিপরীতমুখী
  • প্রতিষ্ঠালাভের মোহ যদিও আল্লাহর আদেশের বাইরে হয়
  • পাছে লোকে কিছু বলে ভেবে সত্য থেকে দূরে থাকা

* শয়তান ও তাগুত

  • আখেরাতমুখী যা আল্লাহর ও রাসূলের স. প্রদর্শিত

যে ব্যক্তি নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রন করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কুপ্রবৃত্তির গোলাম বানায় অথচ আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা করে সেই অক্ষম। জামে আত তিরমিযী

তাই রসূলের স. দেখানো পদ্ধতিতে মানুষ এ বস্তুজগত ও দেহযন্ত্রকে আল্লাহর পছন্দনীয় পন্থায় ব্যবহার করে সাফল্যমন্ডিত হতে পারে।

“রসূল স. প্রায়ই এই দু’আ করতেন—(ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুবি ছাব্বিত ক্বলবি য়ালা দ্বীনিক) হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী ! আমার অন্তরকে তোমার দীনের উপর মজবুত(দৃঢ়) রাখো।

সাহাবা রা. বললেন, হে আল্লাহর নবী ! আমরা আপনার প্রতি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান এনেছি। আপনি কি আমাদের সম্পর্কে কোনরুপ আশংকা করেন?

তিনি বলেন-হাঁ, কেননা সমস্ত অন্তরই আল্লাহর আংগুলসমূহের মধ্যকার দুটি আংগুলের মাঝখানে রয়েছে। তিনি তা যেভাবে ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। জামে আত তিরমিযী

মহান আল্লাহ বলেছেন-

“ কিন্তু তা সত্ত্বেও তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেলো। তা হয়ে গেলো পাথরের মতো, বরং তার চেয়েও কঠিন! অথচ এমন পাথরও আছে, যা থেকে প্রবাহিত হয় ঝরণাধারা; আর এমনও (পাথর) আছে, যা ফেটে গেলে তা থেকে বের হয়ে আসে পানি! আবার অবশ্যই এমনও (পাথর) আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে যায়! আর আল্লাহ তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে মোটেই অনবহিত নন।” সূরা আল বাকারা:৭৪

ঊপমাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। পাথর আপাতঃ দৃষ্টিতে এক নির্জীব প্রাকৃতিক কঠিন বস্তু। কিন্তু তার মাঝেও রয়েছে কোমলতা, যার অনুপম বর্ণনা করেছেন স্বয়ং তার সৃষ্টিকর্তা। এই বস্তুটির সাথে মানুষের হৃদয়ের তুলনা করেছেন রাব্বুল আ’লামীন।

এখানে ৩ ধরণের পাথরের উল্লেখ করা হয়েছে:

ক. যা থেকে প্রবাহিত হয় ঝরণাধারা তথা নদী-নালা – সৃষ্ট জীবের উপকারে আসে।

খ. যা ফেটে গলে বের হয়ে আসে পানি, অর্থাৎ বাইরে কঠিন হলেও অন্তঃস্থল সুকোমল; আর

গ. কিছু পাথর, আরো সংবেদনশীল, যা যমীনে ধ্বসে পড়ে মহান আল্লাহর ভয়ে!

কিন্তু মানুষের মাঝে এমনও কিছু হৃদয় আছে, সৃষ্ট-জীবের দুঃখ-দুর্দশায়ও ঐ পাষানদের চোখ অশ্রুসজল হয় না, আল্লাহর আক্রোশের ভয়ে হৃদয়গুলো এতটুকু প্রকম্পিত হয় না, অন্তরগুলো বিগলিত হয় না আল্লাহর কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন দেখেও।

আদম সন্তানের হৃদয়, সে তো বুকের মধ্যে। কিন্তু তার সকল তৎপরতা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সক্রিয় করে কর্মরুপে প্রকাশ পেয়ে দৃশ্যজগতে চলে আসে। মানুষের হৃদয়-মন আল্লাহতা’আলার এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি। যখন বুকের সেই হৃদয় অন্ধ হয়ে যায় তখন সবকিছু দেখতে পেলেও চোখের উপর পর্দা পড়ে যায়। তাই জানা যায় কুর’আন থেকে-

এই লোকেরা কি যমীনে চলাফেরা করে নাই যে, তাদের দিল বুঝতে পারতো এবং তাদের কান শুনতে পারতো? আসল কথা এই যে, চক্ষু কখনো অন্ধ হয় না কিন্তু সেই হৃদয় অন্ধ হয়, যা বুকের মধ্যে নিহিত রয়েছে। সূরা আল হজ্জ্ব: ৪৬

কুর’আনের ভাষা উন্নত সাহিত্যের ভাষা। এখানে সাহিত্যের ভাষায় আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনাসহ প্রায় সবরকমের কাজকেই মস্তিষ্ক, বক্ষদেশ ও হৃদয়ের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। এমনকি কোন কথা মনে থাকার ব্যপারটিও এভাবে বলা হয়,“সেটা তো আমার বুকে সংরক্ষিত আছে।

আবূ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনু মোহাম্মদ বলেছেন (৫১৭ হিজরীতে মারা যান)-

“হে ঐ ব্যক্তি ! “যে পাপরাশির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে আনন্দ উপভোগ করছো, তুমি তোমার বার্ধক্য ও অচলাবস্থা হতে কি বে-খবর রয়েছো?

তোমার জন্য উপদেশ যদি ক্রিয়াশীল না হয় তবে তুমি দেখে শুনেও কি শিক্ষা গ্রহন করতে পারো না ? জেনে রেখো যে, চক্ষু ও কর্ণ কাজ না করলে এটা ততো দোষনীয় নয় যতো দোষনীয় হলো ঘটনাবলীর মাধ্যমে উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহন না করা।

 স্মরণ রেখো যে, যামানা, দুনিয়া, আসমান, সূর্য ও চন্দ্র কিছুই বাকী থাকবে না। মন না চাইলেও তোমাকে একদিন দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহন করতেই হবে, তুমি আমীরই হও বা ফকীরই হও এবং শহরবাসীই বা পল্লীবাসীই হও”।

সম্ভবত সারা জীবনে যতোবার এই হৃদয় স্পন্দন করে ততোবারই মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের তোলপাড় হতে থাকে। আজ পর্যন্ত কোন কিছুই এই মনে স্থায়ী আসন করে নিতে পারে নি শুধু একটি জিনিষ ছাড়া- আর তা হল আল্লাহর স্মরন।

আল্লাহতা’লা বলেন- তাদের দিল আল্লাহর স্মরনের কারনে পরম শান্তি ও স্বস্তি লাভ করে। সাবধান থেকো, আল্লাহর স্মরন আসলে সেই জিনিস যার দ্বারা দিল পরম শান্তি ও স্বস্তি লাভ করে থাকে।   সূরা রা’দ:২৮

এ অবস্থায় মানুষ সকল অস্থিরতা থেকে চিরতরে মুক্ত হয়ে যায়।

“ ঈমানদারদের জন্য এখনও কি সেই সময় আসেনি যে, তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরনে বিগলিত হবে এবং তাঁর নাযিল করা মহাসত্যের সম্মখে অবনত হবে এবং তারা সেই লোকদের মতো হয়ে যাবে না, যাদেরকে ইতিপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। পরে একটা দীর্ঘকাল তাদের উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে, তাতে তাদের হৃদয় শক্ত হয়ে গিয়েছে এবং আজ তাদের অনেকেই ফাসিক হয়ে রয়েছে। সূরা আল হাদীদ:১৬

আল্লাহর কালাম এবং নবীর স.এর  শিক্ষা পেলে যদি অন্তর বিগলিত হয় তবে তাকেই ঈমান বলে।