মন কি বলে ও প্রবৃত্তি কি চায়?-১১

প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রন করাই সহজ

প্রবৃত্তির পিছনে ছুটে ছুটে কখনোই মানুষ পরিতৃপ্ত হতে পারে না। দুনিয়া ও আখেরাতে কোনভাবেই সফলতায় উন্নীত হতে পারে না। আর তাই সবচেয়ে উত্তম ও সহজ হলো নফস বা প্রবৃত্তিকে লাগাম দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা।

ইবনুল কাইয়ূম রহ. বলেন, প্রবৃত্তির প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করার চেয়ে প্রবৃত্তি দমন করাই সহজ। কারণ, প্রবৃত্তির প্রায়শ্চিত্ত খুবই নির্মম ও বেদনাদায়ক। হয়তো অফসোস, হয়তো হতাশা কিংবা অসম্মান। কখনো সম্পদ বঞ্চিত হওয়া, কখনো পদচ্যুতি কিংবা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। আবার অধস্তন ব্যক্তিদের তিরস্কার বা নিন্দার পাত্রে পরিণত হওয়াও কম কিসের!? যা কল্পনাতেও স্থান পায়নি কখনো। অধিকন্তু অন্তরের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, বিষাদ-দুশ্চিন্তা আর ভয় ও শঙ্কা তো রয়েছেই। ন্যূনতম পক্ষে প্রবৃত্তির ফলে তুলনামূলক বিনোদন থেকে মাহরুম হওয়া, শত্রুর খুশির কারণ হওয়া, শুভাকাঙ্খীদের দুশ্চিন্তায় লিপ্ত হওয়া, অথবা কলঙ্কের চাপ মাথায় নিয়ে বেচে থাকায় মঙ্গল কোথায়! কারণ, কর্মের দ্বারাই মানুষ সৎ-অসৎ ও ভাল-মন্দ হিসেবে বিবেচিত হয়, বরং কর্মই তার ফল নির্ধারণ করে দেয়, তাই প্রবৃত্তি তাড়িত কর্মের ফলাফল চিন্তা করে প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া না দেয়াই হচ্ছে বিবেকবান কাজ।

আজকের যুব সমাজের অবস্থা দেখলে খুবই কষ্ট অনুভূত হয়। কত মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতাকে প্রবৃত্তির নিকট নত করে অবলীলায় নষ্ট করে ফেলছে, ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। এটার পিছনে যেমন আমাদের অসচেতনতা (ছোটবেলা থেকেই  প্রবৃত্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার নীতি শেখানো) দায়ী তেমনি একটি অপশক্তি পরিকল্পিতভাবে আমাদের সমাজকে মেধাশূন্য করে উন্নত জাতি না হওয়ার চক্রান্তে কাজ করছে। তাই দেখা যায় বিভিন্ন গান, নাচের প্রতিযোগীতা, সুন্দরী প্রতিযোগীতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগীতার নামে যুবক-যুবতিকে ঘরের বাইরে একান্তে সান্নিধ্যে নিয়ে যাচ্ছে, ফলে যা হবার তা আজ সমাজের চিত্র দেখলেই বুঝা যায়।

ইবনে কাইয়ূম রহ. বলেন, একটি প্রবাদ রয়েছে : মেয়েদের যখন ছেলেরা ফাঁদে ফেলতে না পারে, তখন তাদের গান শোনায়, যার ফলে তাদের অন্তরে এক ধরণের দুর্বলতার সৃষ্টি হয়। কারণ, মেয়েরা আওয়াজ শোনে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল হয়, আর সে আওয়াজ গানের হলে তাদের অন্তরে দু’ভাবে বিশেষ ক্রিয়ার সৃষ্টি করে : আওয়াজের দ্বারা, গানের অর্থের দ্বারা। এ জন্যই রাসূল সা. আনজাসা হাদিয়াকে বলেছেন,

‘হে আনজাসা, নারীদের সঙ্গে ধীরে চল নীতি গ্রহণ কর।’ (বুখারী, মুসলিম)

ইবনুল কাইয়ূম রহ বলেন, ‘চোখ অন্তরের আয়না স্বরূপ, চোখ বন্ধ করলে অন্তরও তার প্রবৃত্তির ওপর পর্দা টেনে দেয়। আর চোখ উন্মুক্ত রাখলে অন্তরও তার প্রবৃত্তি উন্মুক্ত করে রাখে।’ তিনি আরো বলেন, অন্তরের মধ্যে কু-দৃষ্টির প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার পর, ব্যক্তি যদি দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করে এবং সাথে সাথে তার মূল উপড়ে ফেলে, তবে এর প্রতিকার করা খুব সহজ। এর বিপরীতে যদি সে বারবার তাকাতে থাকে, তার ছবি অন্তরে বারবার স্মরণ করতে থাকে, তবে তার ভালবাসা অন্তরে প্রোথিত হয়ে যাবে। কারণ, বারবার দৃষ্টি দেয়ার অর্থ হচ্ছে কু-প্রবৃত্তির গাছটি পানি দ্বারা সিঞ্চন করা। আর এভাবেই প্রবৃত্তির গাছটি ক্রমশ বড় হয়ে একদিন তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, ভুলিয়ে দিবে তাকে নিজ দায়িত্ব। অধিকন্তু সে এর কারণে বিভিন্ন পরীক্ষা ও কষ্টের সম্মুখিন হবে, নানা অপকর্মে লিপ্ত হবে।’

কতক আলেমগণ বলেন, চারটি জিনিষের মধ্যে কুফরি নিহিত থাকে।

এক- অতিরিক্ত রাগ,

দুই-  প্রবৃত্তি,

 তিন- অধিক আগ্রহ,

 চার-  ভীতি।

এক ব্যক্তি খুব রাগান্বিত হল, অতঃপর সে তার মাকে হত্যা করল। আর এক ব্যক্তি একজন মেয়ের প্রেমে পড়ে খৃষ্টান হয়ে গেল। কারণ, তার প্রতি তার আগ্রহ এত প্রবল ছিল, সে তার ঈমান আমল সবকিছু ভূলে গেল।

এক লোক বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা অবস্থায় একজন সুন্দর নারীকে দেখে তার পাশে গিয়ে তাওয়াফ করতে আরম্ভ করে। তারপর সে বলল,

 “আমি দ্বীনকে মহব্বত করি। কিন্তু প্রবৃত্তির সাধ আমাকে অভিভুত করল। আমি বুঝতে পারছিনা প্রবৃত্তির সাধ আর দ্বীনের সাধ হতে কোনটিকে প্রাধান্য দেব”।

তার কথা শোনে রমণীটি বলল, তুমি যে কোন একটি ছাড়, তাহলে অপরটি অবশ্যই পাবে। প্রবৃত্তি ও দ্বীন একসাথে একত্র করতে পারবে না।

[যার প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে, তার কাছে আল্লাহর ঘরও তুচ্ছ হয়ে যায়। সে আল্লাহর ঘরের সামনে গিয়েও অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না।] আল্লাহ আমাদের এ ধরনের পরিণতি হতে হেফাজত করুন! আমীন!

মানুষ কখনো প্রবৃত্তি থেকে আলাদা হতে পারবে না, যতদিন সে আছে ততদিন তার প্রবৃত্তিও আছে, এর থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব, তাই ইসলাম তাকে প্রবৃত্তি থেকে আলাদা হতে বলেনি বরং তা নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

যেমন তাকে নারীর প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে বলেনি, বরং তাকে বিবাহের নির্দেশ দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তার চাহিদা পূরণ করার বিধান দিয়েছে। প্রেম ভালোবাসাকে যথাবিধি স্তরে খাটাতে হবে। লোভ ও হিংসাকে লুপ্ত করতে বলেনি, বলেছে সেই সম্পদের লোভ যা দিয়ে আল্লাহর নির্দেশিত পথে খরচ হবে, হিংসা সেই জ্ঞানের যা অহীর মাধ্যমে এসেছে, যা দিয়ে মানবতার কল্যান হয়। এভাবেই ইসলাম মানুষের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানব জাতিকে নৈতিক পদস্খলন, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করা।’

প্রত্যেক ব্যক্তির একটি শুরু আছে, আরেকটি আছে শেষ। যার শুরু প্রবৃত্তি দিয়ে তার শেষ হবে লাঞ্ছনা, অপমান, নৈরাশ্য ও মুসিবতের মাধ্যমে। প্রবৃত্তির অনুসরণ অনুপাতে এর আকারও বেশী হতে থাকবে, অবশেষে এটি শাস্তিতে পরিণত হবে এবং তাকে ভেতরে ভেতরে পুড়ে মারবে। যেমন

‘যৌবনে অনেক স্বপ্ন ও অনেক আশা ছিলো, যা বার্ধক্যে হতাশা ও অশান্তিতে পরিণত হয়েছে।’

মুসিবত ও পতিত অবস্থার লোকদের পরখ করলে দেখা যাবে যে, তাদের শুরুটা হয়েছে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও বিবেককে বর্জন করার মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে যার শুরুটা হবে প্রবৃত্তির বিরোধিতা ও বিবেকচালিত, তার শেষটাও হবে সম্মান ও মর্যাদার। আল্লাহর নিকটে সে সম্মানিত, মানুষের নিকটও সে সম্মানিত।

     

প্রবৃত্তির আনুগত্যে আচ্ছন্ন অন্তরের চিকিৎসা

 যে অন্তর প্রবৃত্তির কাছে নত হয়ে গিয়েছে, সেই অন্তরের প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন হৃদয়ের চিকিৎসার।

ব্যক্তিকে চেষ্টা করে যেতে হবে প্রবৃত্তি উৎফুল্ল হয় এই ধরনের সকল স্মৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং  আল্লাহর মহব্বত দিয়ে নিজ হৃদয়কে ভরপুর করা, আল্লাহর মহব্বত আঁকড়ে ধরে নিজেকে প্রবৃত্তি থেকে অমুখাপেক্ষী করা এবং আল্লাহমুখী হওয়া।

আর যারা বুদ্ধিমান ও আমানতদার নসিহতকারী এমন ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতেও সঙ্কোচবোধ করবে না, অথবা মনোচিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতেও ভুলবে না। 

এর পাশাপাশি সে হবে ধৈর্যশীল, আল্লাহর কাছে সাওয়াব প্রার্থী, পবিত্রতা অবলম্বনকারী, গোপনকারী। এরূপ করলে আল্লাহ তার জন্য সাওয়াব লিখবেন ইন শা আল্লাহ।

ইবনে কাইয়ূম রহ. এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন, তার কয়েকটি আমরা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, এ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে,

যেমন ‘এ কথা চিন্তা করা যে, আমাকে প্রবৃত্তির গোলাম হওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, আমাকে আরো বড় কাজ ও দায়িত্বের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রবৃত্তির বিরোধিতা ভিন্ন সম্পাদন করা সম্ভব নয়। যেমন কেউ বলেছে,

‘সে তোমাকে এমন এক মহৎ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছে, যদি তুমি জানতে! তুমি নিজের ওপর রহম কর, অনর্থের পিছু নিয়ো না।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭২)

‘প্রবৃত্তির অনুসরণ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করা। কারণ, যে কেউ স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে, সে নিজের মধ্যে অপমান বোধ করেছে।

‘ জেনে রাখা জরুরি যে, যে স্থানেই প্রবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সে স্থানেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ইলমের সঙ্গে প্রবৃত্তির সংমিশ্রন হওয়ার ফলে বেদআত ও গোমরাহীর জন্ম হয়েছে,

এ প্রবৃত্তি দুনিয়ার মোহ ত্যাগকারীদের মধ্যে প্রবেশ করে, তাদেরকে সুন্নতপরিপন্থী করে দিয়েছে। বাদশাদের দরবারে প্রবেশ করে, তাদেরকে অত্যাচারী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বানিয়েছে, নিয়োগ কমিটিতে প্রবেশ করে, তাদেরকে আল্লাহ ও মুসলমানদের সঙ্গে খেয়ানতকারী বানিয়ে দিয়েছে, ‘প্রবৃত্তির সঙ্গে যুদ্ধ করা যদিও কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সমান নয়, তবু ছোটও নয়।

 জনৈক ব্যক্তি হাসান বসরি রহ.-কে জিজ্ঞাসা করে ছিল, ‘হে আবু সাইদের বাপ! কোন্ জিহাদ সব চেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, প্রবৃত্তির সঙ্গে যুদ্ধ করা।  শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-কে বলতে শুনেছি, ‘কাফের, মুনাফেকদের সাথে জিহাদ করার মূলেও প্রবৃত্তির সঙ্গে জিহাদ করা। কারণ, তাদের সাথে জিহাদ করার আগে নিজের নফস ও প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ না হলে, জিহাদের জন্য বের হওয়াও সম্ভব হতো না।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : ৪৭৮)

‘প্রবৃত্ত ও তওহিদ হচ্ছে দু’মেরুর দু’টি জিনিস। প্রবৃত্তি একটি মূর্তির ন্যায়, যার অন্তরে প্রবৃত্তির পরিমাণ বেশী, তার অন্তরে এ মূর্তির অস্তিত্বও শক্তিশালী। আল্লাহ তাআলা রাসূলদের মাটির তৈরি মূর্তি ভাঙ্গার জন্য ও এক আল্লাহর এবাদত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরণ করেছেন। এর অর্থ এ নয় যে, মাটির তৈরী মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলো আর অন্তরের মূর্তি গুলো রেখে দাও। বরং অন্তর থেকে মূর্তি দূর করার নির্দেশই প্রথম। লক্ষ্য করুন ইবরাহীমের আ. বাণীর প্রতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“যখন সে তার পিতা ও কওমকে বলল, ‘এ মূর্তিগুলো কী, যেগুলোর পূজায় তোমরা রত রয়েছ’? (আম্বিয়া : ৫২) কি চমৎকার মিল! অন্তরে বিদ্যমান মূর্তি ও আল্লাহকে দিয়ে যেসব মূর্তির এবাদত করা হয় তার মাঝে।’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ :৪৮১-৪৮২)

 

মানুষ যখন তার প্রবৃত্তির ধোঁকায় পড়ে যাবে তাকে অবশ্যই পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। সে যখন তার প্রবৃত্তির চিকিৎসার প্রতি মনোযোগ দেবে, তখন হতে পারে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার প্রতি অনুগ্রহ করবে এবং তাকে নেককার লোকদের সাথে সম্পৃক্ত করবে।  

নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী কিছু চিকিৎসার কথা তুলে ধরা হলো।

এক. তাওবা ও দুআ করা:

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট তাওবা ও প্রার্থনা করা যাতে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তাকে প্রবৃত্তির অনিষ্ঠতা থেকে হেফাজত করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পূর্ব মনীষীদের আদর্শ ছিল, তারা আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নিকট তাওবা করত এবং আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের দরবারে দু‘আ করতেন। গুণাহ হতে তাওবা করা প্রবৃত্তির অনিষ্ঠতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সা. নিজে দৈনিক অসংখ্য বার আল্লাহর দরবারে তাওবা করতেন এবং উম্মতদের তাওবা করার প্রতি উৎসাহিত করেন। রাসূল সা. বলেন, যারা গুণাহ হতে তাওবা করেন, তারা যেন কোন গুণাহ করেন নাই। 

কুতবা ইব্ন মালেক রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

« اللَّهُمَّ إنِي أَعُوذُ بكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأخْلَا قِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ »

 

“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট খারাপ চরিত্র হতে আশ্রয় প্রার্থণা করছি এবং খারাপ আমল ও প্রবৃত্তি হতে আশ্রয় প্রার্থণা করছি”।

ইব্রাহীম তাইমী রহ. স্বীয় দু‘আয় বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার কিতাব এবং তোমার নবীর সুন্নত দ্বারা আমাদেরকে হক সম্পর্কে মতবিরোধ করা থেকে হেফাজত কর। হে আল্লাহ! তোমার পথ নির্দেশকে আমাদের জীবনে পাথেয় বানিয়ে দাও। আর তোমার অনুকরণ ছাড়া প্রবৃত্তির অনুকরণ হতে আমাদের রক্ষা কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের আরও রক্ষা কর গোমরাহি ও পথভ্রষ্টটা হতে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের যাবতীয় কর্মে সন্দেহ পোষণ করা, হঠকারীতা, ঝগড়া-বিবাদ ও উল্টা-পাল্টা করা হতে রক্ষা কর।

দুই. প্রবৃত্তির পরিপন্থী বস্তু দ্বারা অন্তর পূর্ণ থাকা:

মনে রাখতে হবে মানবাত্মা কখনোই খালি থাকে না; তাকে যদি আমরা ঈমান ও আমলের নুর দিয়ে পরিপূর্ণ না করি, তাহলে তা অবশ্যই শিরক ও কুফরের অন্ধকারে পরিপূর্ণ হবে। তাতে কুফর শিরক ও বিদআত স্থান করে নেবে। আমাদের অবশ্যই অন্তরকে পরিপূর্ণ রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আর তা হল আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের উপর ঈমান আনার মাধ্যমে অন্তরকে ঈমানের নুরের দ্বারা পরিপূর্ণ রাখা এবং অন্তর থেকে গাইরুল্লাহ মহব্বতকে দূর করা। আর গাইরুল্লাহর মহব্বতকে অন্তরে কোন প্রকার স্থান না দেয়া। নি:সন্দেহে একটি কথা যায় যে, আল্লাহর মহব্বতকে অন্তরে স্থান দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নৈকট্য লাভে ধন্য হওয়া যায়। আর যখন মানবাত্মা আল্লাহর মহব্বতে পরিপূর্ণ হবে, তখন মানুষের অন্তর থেকে যাবতীয় খারাপ চাহিদা দূর হয়ে যাবে।

তিন. আলেম ওলামা ও সালে-হীনদের সাথে উঠা-বসা করা:

আল্লামা ইব্ন আব্দুল কাবী রহ. বলেন,

যখন তুমি কারো সাথে উঠবস করতে চাও, তবে তুমি আলেম ওলামা, মুত্তাকী, পরহেজগার এবং আল্লাহ যাদের কবুল করেছেন তাদের সাথে উঠবস কর।  তাদের ইলম তোমার উপকার করবে এবং তোমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা হতে নিষেধ করবে। আর তুমি খারাপ ও গোমরাহ লোকদের অনুসরণ করা হতে বিরত থাক। কারণ, মানুষ মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তুমি যখন খারাপ ও গোমরাহ লোকদের সাথে উঠবস করবে তখন তোমাদের মধ্যে তাদের গোমরাহী ও খারাপ প্রভাব বিস্তার করবে। আর তুমি কোন জাহেল, অজ্ঞ ও আহমক লোকের সাথে মিশবে না। তাদের সাথে মিশলে তুমি তাদের মতই হবে। কারণ, একজন জাহেলের কাজ হল, তুমি যখন কোন বিষয়ে সংশোধন চাইবে তখন সে তা ধ্বংস করে দেবে, তোমাকে সংশোধন হতে দেবে না।

আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাহায্যের পর এসব বিষয়গুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির কু-মন্ত্রণা হতে মুক্তি পেতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাওফিক ও তার সাহায্য থাকলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। নিম্নে আমরা বিষয়গুলো আলোচনা করব:

এক.              একজন স্বাধীন ও সাহসী লোকের সাহস ও প্রত্যয় যা তার আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নফসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ধরনের সাহসী লোক দ্বারা প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকা সম্ভব।

দুই.               ধৈর্য ধারণে সাহসিকতার পরিচয় দেয়া। যখন তার নফস কোন খারাপ কিছু চায়, তখন তা থেকে বিরত থাকার তিক্ততার উপর ধৈর্যধারণ করা।

তিন.              আত্মার শক্তি একজন মানুষকে সাহসিকতার যোগান দেয় এবং তাকে সঠিক পথে চলার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। আর সাহসিকতা পুরোই হল, প্রতিকুল মুহূর্তের সাময়িক ধৈর্য। আর সবচেয়ে উত্তম জীবন যা একজন বান্দা লাভ করে তা 

                       হল,  ধৈর্যের দ্বারা জীবন লাভ করা। ধৈর্যের মাধ্যমে যে জীবন লাভ করা যায় তাকে সমৃদ্ধ জীবন লাভ করা বলা চলে।

চার.              উত্তম পরিণতির জায়গা কোনটি তা পর্যবেক্ষণ করা এবং সৎ সাহসের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা।

পাঁচ.              প্রবৃত্তির অনুসরণ করার শাস্তি নিয়ে চিন্তা করা:

                      প্রবৃত্তির পূজা করার কারণে ভীষণ যন্ত্রণা ও শাস্তি কি তা পর্যবেক্ষণ করা। যখন সে তার শাস্তি সম্পর্কে জানতে পারবে তখন সে প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে অবশ্যই বিরত থাকবে।

ছয়.               প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করা:

                      আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট বিশেষ মর্যাদার স্থানে তাকে নিয়ে যাওয়া এবং মানুষের অন্তরে তার সম্মান ও মর্যাদা প্রতিস্থাপন করা। আর এটি তার জন্য অধিক উত্তম ও প্রশান্তি প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করার মজা হতে।

সাত.              পাপাচার বা গুনাহের মজার উপর পাক-পবিত্র থাকা, সম্মান বজায় রাখার যে মজা তাকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে।

আট.               দুশমনের উপর বিজয় লাভ, দুশমনকে প্রতিহত করা ও তাকে অপমান অপদস্থ করে ক্ষোভ, রাগ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়ার আনন্দ উপভোগ করা। কারণ, শয়তান যখন তার আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে না পারে, তখন সে 

                        বিক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত হয়। আর আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার বান্দা থেকে পছন্দ করে যেন সে তার দুশমন শয়তানকে অপমান অপদস্থ করে। যেমন- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার মহা কিতাব আল-কুরআনে এরশাদ করেন-

                           মদীনার অধিবাসী ও তার আশপাশের মরুবাসীদের জন্য সংগত নয় যে, রাসূলুল্লাহ থেকে পেছনে থেকে যাবে এবং রাসূলের জীবন অপেক্ষা নিজদের জীবনকে অধিক প্রিয় মনে করবে। এটা এ কারণে যে, তাদেরকে আল্লাহর পথে তৃষ্ণা, 

                            ক্লান্তি ও ক্ষুধায় আক্রান্ত করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধ জন্মায় এবং শত্রুদেরকে তারা ক্ষতিসাধন করে, তার বিনিময়ে তাদের জন্য সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন 

                          না।  সূরা তাওবা: ১২০

নয়.                 এ কথা বিশ্বাস করা যে, প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা দুনিয়া ও আখিরাতের সম্মানকে বৃদ্ধি করে। অপরদিকে যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সম্মানহানি ঘটে এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে তারা অপমান, অপদস্থ ও

                       লাঞ্ছিত হয়।

 

 

সহায়ক গ্রন্থ

অন্তর বিধ্বংসী বিষয়: প্রবৃত্তির অনুসরণ

মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্জিদ/অনুবাদ : জাকের উল্লাহ্ আবুল খায়ের সম্পাদনা : মো: আবদুল কাদের

সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব