নফস বা প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার উপকারিতা
নফসের বিরোধিতা করা দ্বারা একজন মানুষ কি কি উপকার লাভ করে তা নিম্নে আলোচনা করা হল।
১। প্রবৃত্তির বিরোধিতা দ্বারা জান্নাত লাভ হয়:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
সুতরাং যে সীমালঙ্ঘন করে আর দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়, নিশ্চয় জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল। আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল।
সূরা আন-নাযিয়াত: ৩৭-৪১
যে ব্যক্তি নফসের বিরোধিতা করে এবং প্রবৃত্তির চাহিদাকে প্রতিহত করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করে, কিয়ামতের দিন তাকে উত্তম বিনিময় দেয়া হবে। তাদের জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে এবং জান্নাতে তাদের দেয়া হবে সুন্দর ও আনন্দদায়ক জীবন। আর তা হল, তারা যে দুনিয়াতে ধৈর্য ধারণ করেছিল তার বিনিময়। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
আর তারা যে ধৈর্যধারণ করেছিল তার পরিণামে তিনি তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী বস্ত্রের পুরস্কার প্রদান করবেন। সূরা আল-ইনসান: ১২
২। একজন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির জন্য বড় বিপদ হল, তার প্রবৃত্তি। যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির উপর বিজয়ী হবে, কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ পরিণতি হতে নাজাত লাভ:
কিয়ামতের দিন মানুষের যে ভয়াবহ অবস্থা হবে তার থেকে মুক্তি পাবে। আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সাত ব্যক্তিকে তার আরশের ছায়ার তলে আশ্রয় দেবেন। সেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না।
তারা হলেন,
- ন্যায় পরায়ন বাদশা,
- যুবক যে তার যৌবনকে আল্লাহর রাহে ব্যয় করে,
- যে ব্যক্তির অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত,
- দুই ব্যক্তি যারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে। আল্লাহর ভালোবাসার ভিত্তি করে তারা একত্র হয় এবং তার উপর ভিত্তি করে তারা পৃথক হয়,
- এক ব্যক্তি যাকে কোন সুন্দর ও সম্ভ্রান্ত রমণী তার সাথে অপকর্মের জন্য ডাকলে, সে বলে আমিতো আল্লাহকে ভয় করি।
- গোপনে সাদকাকারি ব্যক্তি যার বাম হাত জানে না ডান হাতে কি দান করল।
- যে নির্জনে বসে আল্লাহর জিকির করল এবং তার উভয় চোখ অশ্রু বিসর্জন দিল”।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন যাদের আরশের ছায়ার তলে স্হান দেয়া হবে, তাদের বিষয়ে চিন্তা করল দেখতে পাবে, তাদের এত বড় মর্যাদা লাভের কারণ হল, তারা তাদের নফসের বিরোধিতা করত এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে বিরত থাকত। কারণ, এখানে যে সাতজনের কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই নফসের বিরোধিতা করত।
যেমন- ক্ষমতাশীল ও শক্তিশালী বাদশা, ইনসাফ করতে সক্ষম হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার নফসের বিরোধিতা না করবে। তার নফস তাকে ন্যায় বিচার না করতে আদেশ দেয়। কিন্তু সে তার নফসের যা চায় তার বিরোধিতা করে এবং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ন্যায় বিচার করে। সুতরাং বলা বাহুল্য যে, তাকে ইনসাফ করতে হলে অবশ্যই তার নফসের বিরোধিতা করতে হবে। আর যে যুবক আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ভয়ে অপকর্ম হতে বিরত থাকল, তাকেও তার নফসের বিরোধিতা করতে হয়েছে। কারণ, তার নফসের বিরোধিতা ছাড়া সে তার যৌবনকে আল্লাহর রাহে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে না। অনুরূপভাবে যে লোকটির অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত তাকে আজীবন তার নফসের বিরোধিতা করেই এ অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়েছে। অন্যথায় সে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের সাথে সম্পৃক্ত থেকে প্রবৃত্তির স্রোতে ঘুরে বেড়াত।
আর যে ব্যক্তি গোপনে সদকা করে এবং তার ডান হাত কি দান করল তা বাম হাত জানে না ইত্যাদি তখন সম্ভব হয় যখন সে তার প্রবৃত্তির সাথে অনবরত যুদ্ধ করে।
কারণ, মানবাত্মার স্বভাব হল সে সব সময় তার নিজের গুনাগুণ ও প্রশংসা শুনতে চায়। তখন প্রবৃত্তিও তাকে আরো ব্যতিব্যস্থ করে তুলে সেই সব কাজে যা দিয়ে মানুষের প্রশংসা কুড়ানো যায়। দেখা যায় ভালো একটি কাজ শুধুমাত্র নিয়্যতের পরিশুদ্ধির অভাবে বরবাদ হয়ে যেতে পারে। আর এইভাবে মানুষ নিজ ও পারিবারিক জীবনে ভারসাম্যতা হারিয়ে ফেলে। প্রবৃত্তির বিরোধীতা দিয়েই কেবল সম্ভব শয়তানকে পরাজিত করা এবং নিয়্যতের পরিশুদ্ধিতায় ভারসাম্য জীবনে চলার মাধ্যমে জান্নাত লাভ করতে পারে।
আর গোপনে সাদকাকারীকে অবশ্যই তার আত্মার চাহিদার সাথে সংগ্রাম করতে হয়। আর যাকে সুন্দর রমণী অপকর্মের দিকে ডাকার পর সে তা হতে একমাত্র আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ভয়ে বিরত থাকল এবং যে লোকটি একান্তে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের স্মরণে দু-চোখ হতে অশ্রু বিসর্জন দিল এবং নির্জনে বসে বসে কেবল আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ভয়ে কাঁদল, একমাত্র নফসের বিরোধিতা ও প্রবৃত্তির প্রতি অবিচার করাই তাদের এ অবস্থায় পৌঁছিয়েছে। তারা তাদের জীবনে দুনিয়াতে নফসের বিরোধিতা করেন বলেই কিয়ামতের দিন কিয়ামতের ভয়াবহতা হতে নাজাত পাবে। কিয়ামতের দিনের প্রচণ্ড উত্তাপ, গরম ও ঘাম তাদের কোন প্রকার স্পর্শ করতে পারবে না।
অন্যদিকে প্রবৃত্তির পূজারীরা সেদিন অত্যন্ত অসহনীয় বিপদের মুখোমুখি হবে। প্রচণ্ড গরম ও সূর্যের তাপের কারণে তাদের ঘাম তাদের গলদেশ পর্যন্ত পৌছবে। তারা তাদের ঘামের মধ্যে সাঁতরাতে থাকবে। তারপর তারা এ ভয়াবহ শাস্তির বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। তারপর তাদের প্রবৃত্তির শাস্তি জেলখানায়-জাহান্নামে-তাদের প্রবেশ করানো হবে।
৩। প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার কারণে ইজ্জত, সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা লাভ হবে:
মুয়াবিয়া রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, মানবিকতা হল, প্রবৃত্তির অনুকরণ হতে বিরত থাকা এবং নফসের বিরোধিতা করা। প্রবৃত্তির অনুসরণ মানবিকতাকে কুলসিত করে আর প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা মানবতাকে পুনরুজ্জীবিত করে।
আবু আলী আদ-দাকাক বলেন, যৌবনে যে তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বুড়ো বয়সে তাকে সম্মান দেবেন।
আল্লামা ইব্ন আব্দুল কাবী রহ. বলেন,
“যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ করা ছেড়ে দেবে সে অবশ্যই তার উদ্দেশ্যে হাসিলে সফল হবে। আর যে ব্যক্তি তার শয়তানীর উপর অটল থাকবে, সে অবশ্যই একদিন তার ভুল বুঝতে পারবে এবং আফসোস করতে করতে আঙ্গুল কাটতে থাকবে। নফসের চাহিদাকে প্রতিহত করার মধ্যে রয়েছে তোমার ইজ্জত ও সম্মান। আর নফস যা চায় তার অনুকরণ করার মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য আমরণ অশান্তি। এমন কোন কাজে ব্যস্ত হইওনা যা তোমার সম্মানহানি ঘটায়, তবে তুমি কিছু নিয়ে ব্যস্ত হও যা তোমার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে। আর ভালো আত্মা কখনোই খারাপ ও নিকৃষ্ট বস্তুর উপর সন্তুষ্ট থাকে না।
যখন একজন মানুষ একা হয়, তখন তার জ্ঞানই হবে তার সঙ্গী। একজন মানুষের দ্বীন তখন নিরাপদ হবে যখন তার মধ্যে তাওহীদ থাকবে। মানুষের সমালোচনা ও সহপাঠীদের কষ্ট হতে নিরাপদ থাকবে এবং হিংসুক, নিন্দুক ও দুশমন থেকে নিরাপদ থাকবে। একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে উত্তম সাথী হল তার বই পুস্তুক, যা তার উপকারে আসে। কিতাবসমূহ তাকে স্থায়ী ইলম আদব ও জ্ঞানের সন্ধান দেয়”।
৪। বিবেককে শক্তিশালী করা:
প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষের আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়কে দুর্বল ও নড়-বড় করে। আর প্রবৃত্তির বিরোধিতা মানুষের আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়কে শক্তিশালী ও সবল করে। আর বান্দার আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা হল, আখিরাত ও আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র মাধ্যম ও বাহন। আর যখন একজন বান্দার বাহন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন আরোহীর অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়।
৫। প্রবৃত্তির বিরোধিতা দ্বারা দেহের হেফাজত করা হয়:
যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা তাদের দেহ ও মন উভয়েরই ক্ষতি করে। প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের দিকে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজ করতে বাধ্য করে। এ সব অপকর্ম দ্বারা যেমনিভাবে তার আত্মা দূর্বল হয়, অনুরূপভাবে তার শরীর বা দেহও ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে।
আল্লামা ইব্ন রজব রহ. বলেন, অনেক আলেমদের দেখা যায় সে একশত বছর অতিবাহিত করার পরও সে তার শক্তি, সামর্থ্য ও জ্ঞান-বুদ্ধিতে পরিপূর্ণ।
৬। প্রবৃত্তির বিরোধিতা দ্বারা দুনিয়াতে যাবতীয় বিপদ থেকে নিরাপদ থাকে:
যারা প্রবৃত্তির বিরোধিতা করে তারা দুনিয়াতে বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা হতে মুক্ত থাকে। কোন প্রকার বিপদ তাদের স্পর্শ করে না। ইবরাহীম ইব্ন আদহম রহ. বলেন, সবচেয়ে কঠিন জেহাদ হল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা। যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে খারাপ ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখতে সক্ষম হল, সে অবশ্যই দুনিয়া ও দুনিয়ার মুসিবত হতে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হবে। আর দুনিয়ার জীবনে সে আরাম পাবে এবং দুনিয়ার কষ্ট হতে সে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকবে।