হযরত আদম আঃ ২ (আদম আ এর শ্রেষ্ঠত্ব)

আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

আদম আ এর পাঁচটি শ্রেষ্ঠত্ব

 (১) আল্লাহ তাকে নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করেছেন ।

রব বললেন, “ হে ইবলিস! আমি আমার দু’হাত দিয়ে যাকে তৈরি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে?  তুমি কি বড়াই করছো, না তুমি কিছু উচ্চ মর্যাদার অধিকারী?” ছোয়াদ -৭৫)।

(২) আল্লাহ নিজে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন ।

যখন তোমার রব ফেরশ্‌তাদেরকে বললো, “আমি মাটি দিয়ে একটি মানুষ তৈরি করবো৷তারপর যখন অমিতাকে পুরোপুরি তৈরি করে ফেলবো এবং তার মধ্যে নিজের প্রাণ ফুঁকে দেবো৷ তখন তোমরা তার সামনে সিজদানত হয়ে যেয়ো৷ছোয়াদ ৭১-৭২

যখন আমি তাকে পূর্ণ অবয়ব দান করবো এবং তার মধ্যে আমার রূহ থেকে কিছু ফুঁক দেবো৷ তখন তোমরা সবাই তার সামনে সিজদাবনত হয়ো৷ হিজরঃ২৯

এ থেকে জানা যায় , মানুষের মধ্যে যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয় অর্থাৎ প্রাণ সঞ্চার করা হয় তা মূলত আল্লাহর গুণাবলীর একটি প্রতিচ্ছায়া ৷ জীবন , জ্ঞান , শক্তি , সামর্থ সংকল্প এবং অন্যান্য যতগুলো গুণ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় , যেগুলোর সমষ্টির নাম প্রাণ —- সেসবই আসলে আল্লাহরই গুণাবলীর একটি প্রতিচ্ছায়া ৷ মানুষের মাটির দেহ-কাঠামোটির ওপর এ প্রতিচ্ছায়া ফেলা হয় ৷ আর এ প্রতিচ্ছায়ার কারণেই মানুষ এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং ফেরেশতাগণসহ পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি তাকে সিজদা করেছে ৷

আসলে তো সৃষ্টির মধ্যে যেসব গুণের সন্ধান পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটিরই উৎস ও উৎপত্তিস্থল আল্লাহরই কোন না কোন গুণ ৷ যেমন হাদীসে বলা হয়েছে :

“মহান আল্লাহ রহমতকে একশো ভাগ বিভক্ত করেছেন ৷ তারপর এর মধ্য থেকে ৯৯ টি অংশ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন এবং মাত্র একটি অংশ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন ৷ এই একটি মাত্র অংশের বরকতেই সমুদয় সৃষ্টি পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহশীল হয় ৷ এমনকি যদি একটি প্রাণী তার নিজের সন্তান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ জন্য তার ওপর থেকে নিজের নখর উঠিয়ে নেয় তাহলে এটিও আসলে এ রহমত গুণের প্রভাবেরই ফলশ্রুতি ৷ ” — ( বুখারী ও মুসলিম )

কিন্তু আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিচ্ছায়া যে ধরনের পূর্ণতার সাথে মানুষের ওপর ফেলা হয় অন্য কোন প্রাণীর ওপর তেমনভাবে ফেলা হয়নি ৷ এ জন্যই অন্যান্য সৃষ্টির ওপর মানুষের এ প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ৷

এটি একটি সূক্ষ্ম বিষয় ৷ এটি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সামান্যতম ভ্রান্তি মানুষকে এমন বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে যার ফলে সে আল্লাহর গুণাবলীর একটি অংশ লাভ করাকে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার কোন অংশ লাভ করার সমার্থক মনে করতে পারে ৷ অথচ আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার সামন্যতম অংশ লাভ করার কথাও কোন সৃষ্টির জন্য কল্পনাই করা যায় না ৷

(৩) আল্লাহ তাকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিয়েছেন ।

অতপর আল্লাহ আদমকে সমস্ত জিনিসের নাম শেখালেন  তারপর সেগুলো পেশ করলেন ফেরেশতাদের সামনে এবং বললেন , “যদি তোমাদের ধারণা সঠিক হয় (অর্থাৎ কোন প্রতিনিধি নিযুক্ত করলে ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হবে ) তাহলে একটু বলতো দেখি এই জিনিসগুলোর নাম? ” বাক্বারাহ ২/৩১

 (৪) তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন ।

তারপর যখন ফেরেশতাদের হুকুম দিলাম , আদমের সামনে নত হও, তখন সবাই অবনত হলো, কিন্তু ইবলিস  অস্বীকার করলো ৷ সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মেতে উঠলো এবং নাফরমানদের অন্তরভুক্ত হলো ৷ বাক্বারাহ ২/৩৪)।

(৫) আদম একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট ।

যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তম রূপে সৃষ্টি করেছেন৷ তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে,তারপর তার বংশ উৎপাদন করেছেন এমন সূত্র থেকে যা তুচ্ছ পানির মতো৷ তারপর তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন  এবং তার মধ্যে নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন ,  আর তোমাদের কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছেন, তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো৷ (সাজদাহ ৩২/৭-৯)।

 

প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আঃ)-কে আল্লাহ সর্ব বিষয়ের জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেন এবং বিশ্বে আল্লাহর খেলাফত পরিচালনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সাথে সাথে সকল সৃষ্ট বস্ত্তকে করে দেন মানুষের অনুগত।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

তোমরা কি দেখো না, আল্লাহ যমীন ও আসমানের সমস্ত জিনিস তোমাদের জন্য অনুগত ও বশীভুত করে রেখেছেন   এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও গোপন নিয়ামতসমূহ  সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন ? এরপর অবস্থা হচ্ছে এই যে, মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের নেই কোন প্রকার জ্ঞান, পথনির্দেশনা বা আলোক প্রদর্শনকারী কিতাব৷ লোকমান ৩১/২০)

সবকিছুর উপরে দেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ।

এতো আমার অনুগ্রহ, আমি বনী আদমকে মর্যাদা দিয়েছি এবং তাদেরকে জলে স্থলে সওয়ারী দান করেছি, তাদেরকে পাক-পবিত্র জিনিস থেকে রিযিক দিয়েছি এবং নিজের বহু সৃষ্টির ওপর তাদেরকে সুস্পষ্ট প্রাধান্য দিয়েছি৷(ইসরা ১৭/৭০)।

আর সেকারণেই জ্বীন-ফিরিশতা সবাইকে মানুষের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আদমকে সিজদা করার আদেশ দেন। সবাই সে নির্দেশ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইবলীস অহংকার বশে সে নির্দেশ অমান্য করায় চিরকালের মত অভিশপ্ত হয়ে যায়

তারপর যখন ফেরেশতাদের হুকুম দিলাম, আদমের সামনে নত হও, তখন সবাই  অবনত হলো, কিন্তু ইবলিস  অস্বীকার করলো ৷ সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মেতে উঠলো এবং নাফরমানদের অন্তরভুক্ত হলো ৷(বাক্বারাহ ২/৩৪)।

অথচ ইবলিশ সে ছিল বড় আলেম ও ইবাদতগুযার। সেকারনে  জ্বীন জাতির হওয়া সত্ত্বেও সে ফিরিশতাদের সঙ্গে বসবাস করার অনুমতি পেয়েছিল ও তাদের নেতা হয়েছিল। ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরুত:দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৬৭।

আবার  সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের   বলেছিলেন , “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি  নিযুক্ত করতে চাই ৷” তারা বললো , “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে?  আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি৷ ”  আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না ৷ (বাক্বারাহ ২/৩০)।

অর্থাৎ আল্লাহ চান এ পৃথিবীতে এমন একটা সৃষ্টির আবাদ করতে, যারা হবে জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করবে ও তাঁর ইবাদত করবে। ফেরেশতাদের মত কেবল হুকুম তামিলকারী জাতি নয়।

আল্লাহ ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি পৃথিবীতে ‘খলীফা’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। বল, এ বিষয়ে তোমাদের বক্তব্য কি? তারা (সম্ভবতঃ ইতিপূর্বে সৃষ্ট জিন জাতির তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে) বলল, হে আল্লাহ! আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে আবাদ করতে চান, যারা গিয়ে সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদা আপনার হুকুম পালনে এবং আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনায় রত আছি। এখানে ফেরেশতাদের উক্ত বক্তব্য আপত্তির জন্য ছিল না, বরং জানার জন্য ছিল। আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না

পৃথিবীতে খলিফা পাঠানোর অর্থ কিঃ

এখানে ‘খলীফা’ বা প্রতিনিধি বলে জিনদের পরবর্তী প্রতিনিধি হিসাবে বনু আদমকে বুঝানো হয়েছে, যারা পৃথিবীতে একে অপরের প্রতিনিধি হবে (ইবনু কাছীর)।

অথবা এর দ্বারা আদম ও পরবর্তী ন্যায়নিষ্ঠ শাসকদের বুঝানো হয়েছে, যারা জনগণের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য ও ইনছাফপূর্ণ শাসক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করবে। কেননা ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও অন্যায় রক্তপাতকারী ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতিনিধি নয় (ইবনু জারীর)।

তবে প্রথম ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য, যা ফেরেশতাদের জবাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন প্রতিনিধি আপনি সৃষ্টি করবেন, যারা পূর্ববর্তী জিন জাতির মত পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ ও রক্তপাত ঘটাবে। বস্ত্ততঃ ‘জিন জাতির উপর ক্বিয়াস করেই তারা এরূপ কথা বলে থাকতে পারে’ (ইবনু কাছীর)।

অতঃপর আল্লাহ আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। ‘সবকিছুর নাম’ বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে লয় পর্যন্ত ছোট-বড় সকল সৃষ্টবস্ত্তর ইল্ম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দিয়ে দেওয়া হ’ল।  ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/৬৫।

যা দিয়ে সৃষ্টবস্ত্ত সমূহকে আদম ও বনু আদম নিজেদের অনুগত করতে পারে এবং তা থেকে ফায়েদা হাছিল করতে পারে। যদিও আল্লাহর অসীম জ্ঞানরাশির সাথে মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞানের তুলনা মহাসাগরের অথৈ জলরাশির বুক থেকে পাখির ছোঁ মারা এক ফোঁটা পানির সমতুল্য মাত্র।বুখারী হা/৪৭২৭ ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা কাহফ।

বলা চলে যে, আদম আ কে দেওয়া সেই যোগ্যতা ও জ্ঞান ভান্ডার যুগে যুগে তাঁর জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী সন্তানদের মাধ্যমে বিতরিত হচ্ছে ও তার দ্বারা জগত সংসার উপকৃত হচ্ছে। আদম আ কে  সবকিছুর নাম শিক্ষা দেওয়ার পর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন। কুরআনে কেবল ফেরেশতাদের কথা উল্লেখিত হ’লেও সেখানে জিনদের সদস্য ইবলীসও উপস্থিত ছিল (কাহফ ১৮/৫০)। অর্থাৎ আল্লাহ চেয়েছিলেন, জিন ও ফেরেশতা উভয় সম্প্রদায়ের উপরে আদম-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হৌক এবং বাস্তবে সেটাই হ’ল। তবে যেহেতু ফেরেশতাগণ জিনদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, সেজন্য কেবল তাদের নাম নেওয়া হয়েছে। আর দুনিয়াতে জিনদের ইতিপূর্বেকার উৎপাত ও অনাচার সম্বন্ধে ফেরেশতারা আগে থেকেই অবহিত ছিল, সেকারণ তারা মানুষ সম্বন্ধেও একইরূপ ধারণা পোষণ করেছিল এবং প্রশ্নের জবাবে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ‘আল্লাহ জিন জাতিকে আগেই সৃষ্টি করেন গনগনে আগুন থেকে’ (হিজর ১৫/২৭)। কিন্তু তারা অবাধ্যতার চূড়ান্ত করে।

আদম আ কে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করার পর আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে ঐসব বস্ত্তর নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তারা তা বলতে পারল না। তখন আল্লাহ আদম আ কে নির্দেশ দিলেন এবং তিনি সবকিছুর নাম বলে দিলেন। ফলে ফেরেশতারা অকপটে তাদের পরাজয় মেনে নিল এবং আল্লাহর মহত্ত্ব ও পবিত্রতা ঘোষণা করে বলল, হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যতটুকু শিখিয়েছেন, তার বাইরে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি সর্বজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিময়’ (বাক্বারাহ ২/৩২)। অতঃপর আল্লাহ তাদের সবাইকে আদমের সম্মুখে সম্মানের সিজদা করতে বললেন। সবাই সিজদা করল, ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল ও অহংকারে স্ফীত হয়ে প্রত্যাখ্যান করল। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল (বাক্বারাহ ২/৩৪)। ইবলীস ঐ সময় নিজের পক্ষে যুক্তি পেশ করে বলল, ‘আমি ওর চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন আর ওকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে’। আল্লাহ বললেন, তুই বের হয়ে যা। তুই অভিশপ্ত, তোর উপরে আমার অভিশাপ রইল পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬-৭৮; আ‘রাফ ৭/১২)।

খিলাফত কী?

خِلاَفَة আরবি শব্দ। এর মূলخَلْف  , আর خَلْف মানে- পেছনে আসা, পরে (next-এ) আসা, উত্তরাধিকারী হওয়া। خَلْف থেকেই গঠিত হয়েছে خِلاَفَة ও خَلِيْفَةٌ (খেলাফত ও খলিফা)। শব্দ দু’টির মৌলিক অর্থ হলো :

১. পেছনে আগত, স্থলাভিষিক্ত।

২. একের পর এক আগত দল।

৩. প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

৪. উত্তরসূরী/পরবর্তী অনুসারী।

৫. প্রতিনিধি/দায়িত্বপ্রাপ্ত।

৬. শাসক/কর্তৃত্বশীল।

. খলিফার কাজ কী?

খলিফা বা প্রতিনিধির কাজ কী? খলিফা বা প্রতিনিধির কার্যাবলী (Functions) সাধারণভাবে সকলেই জ্ঞাত ও অবহিত। মূলত খলিফার কার্যাবলী নিম্নরূপ :

১. মূল মালিকের বার্তা/আদেশ/নিষেধ/বিধান পৌঁছে দেয়া, জানিয়ে দেয়া এবং বুঝিয়ে দেয়া।

২. মূল মালিকের আনুগত্য করা, হুকুম পালন করা এবং তাঁর বাধ্যতা স্বীকার করার জন্য আহ্বান করা।

৩. মূল মালিকের বিরুদ্ধাচরণ না করার আহ্বান করা।

৪. মূল মালিকের অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সকলকে সর্বপ্রকারে সতর্ক করা।

৫. মূল মালিকের ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি বিধান করলে পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করা।

৬. মূল মালিকের হুকুম-বিধান কার্যকর করা।

৭. মূল মালিকের ইচ্ছা ও আইন মোতাবেক শাসন পরিচালনা করা।

আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে খলিফা বানিয়েছেন।

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

অর্থ : স্মরণ করো, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন : আমি পৃথিবীতে খলিফা বানাতে/নিযুক্ত করতে চাই। -সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩০।

প্রশ্ন হলো, এখানে ‘খলিফা’ মানে কি? এ আয়াতে উপরোক্ত ছয়টি অর্থের কোন্ অর্থটি গ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে মুফাসসিরদের মধ্যে মত পার্থক্য হয়েছে। তবে নিম্নোক্ত দু’টি মত অধিকতর যুক্তিসংগত ও অগ্রাধিকারযোগ্য :

১. এখানে ‘খলিফা’ শব্দটি সবগুলো অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

২. এখানে ‘খলিফা’ শব্দটি প্রতিনিধি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

বিশ শতকের সবচাইতে প্রাজ্ঞ তিনজন মুফাস্সির শহীদ সাইয়েদ কুতুব তাঁর তফসির ফী যিলালিল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর তফসির তাফহীমুল কুরআন এবং মুফতি মুহাম্মদ শফি তাঁর তফসির মা’আরিফুল কুরআনে শেষোক্ত দু’টি অর্থ অর্থাৎ প্রতিনিধি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থই গ্রহণ করেছেন।

  মানুষ কার খলিফা?

কুরআন মজিদ অধ্যয়ন করলে জানা যায়, মানুষ দায়িত্ব পালন করে-

১. আল্লাহর খলিফা হিসেবে, অথবা

২. শয়তানের খলিফা হিসেবে।

শয়তানের খলিফারা দাসত্ব, ইবাদত বন্দেগি ও তাবেদারি করে—-

১. স্বয়ং শয়তানের,

২. নফসের (কামনা বাসনার),

৩. শয়তানি (অর্থাৎ পাপিষ্ঠ ও দুস্কৃতিকারী) নেতৃত্বের এবং

৪. রসম-রেওয়াজ, প্রথা প্রচলন ও পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের।

আল্লাহর খলিফা হবার শর্ত

আল্লাহর খলিফা হবার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত পূরণ করতে হবে। এ তিনটি শর্ত পূরণ করা ছাড়া আল্লাহর খলিফা হওয়া যায় না। শর্ত তিনটি হলো :

১. আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা,

২. আল্লাহর দাসত্ব (ইবাদত) করা এবং

৩. ঈমান ও ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে কাউকেও শরিক না করা।

الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ

অর্থ : যারা ঈমান আনে গায়েব-এর প্রতি। -সূরা ০২ বাকারা : আয়াত ০৩।

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا

অর্থ : তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকেও শরিক করো না। -সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৩৬।

 আল্লাহর খলিফার কাজ

যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে এবং তাঁর বাধ্যতা ও দাসত্ব মেনে নিয়ে তাঁর খলিফা হয়, তাদের মূল কাজ হলো :

১. মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানানো:

فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنزَلْنَا

অর্থ : তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রসূলের প্রতি এবং আমার অবতীর্ণ নূর (আল কুরআন)-এর প্রতি। -সূরা ৬৪ আত তাগাবুন : আয়াত ৮।

২. মানব সমাজকে অন্যদের ইবাদত বর্জন করে শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান করা :

أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

অর্থ : তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। -সূরা ১৬ নহল : আয়াত ৩৬।

৩. আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরীক না করার আহ্বান জানানো :

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا

অর্থ : তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর ইবাদতে কাউকেও শরিক করো না। -সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৩৬।

৪. আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার দাওয়াত দেয়া :

اُدْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ

অর্থ : মানুষকে তোমার প্রভুর পথে (চলার) দাওয়াত দাও হিকমত ও মর্মস্পর্শী উপদেশের মাধ্যমে। -সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ১২৫।

৫. ভালো কাজের আদেশ দেয়া এবং মন্দ কাজে বাধা প্রদান করা:

كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ

অর্থ : তোমরা শ্রেষ্ঠ মানবদল, মানবজাতির কল্যাণে তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করো, মন্দ কাজে বাধা দাও। -সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ১১০।

৬. আল্লাহর দীন কায়েমের কাজ করা :

أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

অর্থ : তোমরা দীনকে (ইসলামকে) কায়েম করো, আর এ ব্যাপারে একে অপর থেকে আলাদা হয়ো না। -সূরা ৪২ আশ শুরা, আতায়াংশ : ১৩।

৭. সত্য গ্রহণের উপদেশ দান এবং সত্যের উপর অটল থাকার নসিহত করা:

وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ

অর্থ : (তারা) একে অপরকে সত্য গ্রহণের উপদেশ দেয় এবং (সত্যের উপর) অটল থাকার উপদেশ দেয়। -সূরা ১০৩ আল আসর, আয়াতাংশ : ০৩।

৮. আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে শাসন কার্য ও বিচার ফায়সালা পরিচালনা করা :

يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ

 

অর্থ : হে দাউদ! আমি তোমাকে ভু-খণ্ডে খলিফা বানিয়েছি। কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করো এবং হাওয়া (নফস)     -এর অনুসরণ করো না। -সূরা ৩৮ ছোয়াদ : আয়াত ২৬।

৯. ন্যায়পরায়ণ হওয়া ও মানব কল্যাণ করা :

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ

অর্থ : আল্লাহ ন্যায়বিচার ও মানব কল্যাণের আদেশ দিচ্ছেন। -সূরা ১৬ : ৯০।

وَأَحْسِن كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ

অর্থ : মানুষের প্রতি ইহসান করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি ইহসান করেছেন। -সূরা ২৮ আল কাসাস, আয়াতাংশ : ৭৭।

১০. দীনি আদর্শের বাস্তব নমুনা উপস্থাপন করা:

وَكَذَ‌ٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِّتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ

অর্থ : এমনি করে আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাহ বানিয়েছি, যাতে করে তোমরা সকল মানুষের উপর সাক্ষী (নমুনা) হও। -সূরা ০২ : আয়াত ১৪৩।

ইবাদত ও খিলাফত : সারকথা

মূলতঃ ইবাদত হলো নিজে আল্লাহর দাসত্ব করা, আর খিলাফত হলো মানুষকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহ্বান করা। সংক্ষেপে ইবাদত ও খিলাফত হলো :

ক্রম                            ইবাদত                                     খিলাফত
নিজে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। মানুষকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানানো।
নিজে আল্লাহর সাথে কাউকেও অংশীদার না করা। আল্লাহর সাথে কাউকেও অংশীদার না করতে মানুষকে আহ্বান জানানো।
নিজে একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করা।       মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের আহ্বান                     জানানো।
নিজে আল্লাহর দাস হওয়া। মানুষকে আল্লাহর দাস বানানো।
নিজে আল্লাহর দাস থাকা। মানুষকে আল্লাহর দাস রাখা।
নিজে আল্লাহর পথে চলা। মানুষকে আল্লাহর পথে চলার আহ্বান জানানো।
নিজে ভালো কাজ করা এবং মন্দ কাজ বর্জন করা। মানুষকে ভালো কাজ করার এবং মন্দ কাজ না করার আদেশ দেয়া।
নিজে আল্লাহর দীন কায়েমের কাজ করা। মানুষকে আল্লাহর দীন কায়েমের আহ্বান করা।
নিজে দীনের জ্ঞানার্জন করা। মানুষকে দীনের জ্ঞান দান করা।
১০ নিজে ন্যায়পরায়ণ হওয়া এবং সুবিচার করা। মানুষকে ন্যায় পরায়ন হতে এবং সুবিচার করতে আহ্বান জানানো।
১১ নিজে মানব কল্যাণ করা। মানুষকে মানব কল্যাণের আহ্বান জানানো।
১২ নিজে ন্যায় ও সত্যের উপর অটল থাকা। মানুষকে ন্যায় ও সত্যের উপর অটল থাকার উপদেশ দেয়া।
১৩ নিজে জান্নাতের পথে চলা। মানুষকে জান্নাতের পথে চলতে বলা।
১৪ নিজে জাহান্নামের পথ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর কাজ করা।
১৫ নিজে কুরআন সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। মানুষকে কুরআন সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার আহ্বান জানানো।

 

ইবাদত ও খিলাফতের মর্মবাণী অতীব সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে সূরা আল আসরে : 

وَالْعَصْرِ – إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ – إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ .

অর্থ : সময়ের শপথ! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা নয়, যারা : ঈমান আনে, আমলে সালেহ করে এবং পরস্পরকে উপদেশ-পরামর্শ দেয় সত্যকে আঁকড়ে ধরতে এবং ধৈর্যধারণ করতে।” এখানে ক্ষতি থেকে বাঁচার শর্ত হিসেবে ইবাদত ও খিলাফতের কথা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।

 

আদম (আঃ) এর জীবনী (Baseera)