আসসালামু’আলাইকুম
সিজদা অনুষ্ঠানের পর আল্লাহ আদমের জুড়ি হিসাবে তার অবয়ব হ’তে একাংশ নিয়ে অর্থাৎ তার পাঁজর হ’তে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন। নিসা ৪/১; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩২৩৮ ‘বিবাহ’ অধ্যায় ১০ম অনুচ্ছেদ।
“হে মানব জতি ! তোমাদের রবকে ভয় করো৷ তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে ৷ আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া ৷ তারপর তাদের দুজনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী ৷ সেই আল্লাহকে ভয় করো যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাকো এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো৷ নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন”৷ নিসাঃ১
জান্নাতে হযরত আদম (আ.)কে যখন সৃষ্টি করা হলো, তখন নিজের মধ্যে তিনি একটি শূন্যতা, একটি অভাব এবং অশান্তি অনুভব করছিলেন। তিনি যখন ঘুমুলেন তখন তাঁর বামপার্শ্বের অস্থির ঊর্ধ্ব-অংশ থেকে প্রথম নারী হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করা হলো। কেন?
আদম যেন তাঁর সঙ্গ দ্বারা সুখ-শান্তি এবং স্বস্তি ও প্রশান্তি লাভ করেন। বস্ত্তত পৃথিবীর প্রথম নারী ছিলেন প্রথম পুরুষের জন্য স্রষ্টার পক্ষ হতে জান্নাতের চেয়েও মূল্যবান উপহার। কারণ জান্নাত তার অফুরন্ত নায-নেয়ামত সত্ত্বেও আদমের অন্তরের শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা, অভাব ও অশান্তি দূর করতে পারেনি। একা একা জান্নাত ভোগ করে আদমের অন্তরে শান্তি আসেনি। হযরত হাওয়াকে জীবনসঙ্গিনীরূপে পাওয়ার পরই আদমের কাছে জান্নাত জান্নাত মনে হয়েছিলো।
মাটি থেকে সৃষ্ট হওয়া আদমের নাম হ’ল ‘আদম’ এবং জীবন্ত আদমের পাঁজর হ’তে সৃষ্ট হওয়ায় তাঁর স্ত্রীর নাম হ’ল ‘হাওয়া’ (কুরতুবী)। অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা দু’জন জান্নাতে বসবাস কর ও সেখান থেকে যা খুশী খেয়ে বেড়াও। তবে সাবধান! এই গাছটির নিকটে যেয়ো না। তাহ’লে তোমরা সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৫)।
এতে বুঝা যায় যে, ফেরেশতাগণের সিজদা কেবল আদমের জন্য ছিল, হাওয়ার জন্য নয়।
দ্বিতীয়তঃ সিজদা অনুষ্ঠানের পরে আদমের অবয়ব থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, পূর্বে নয়। তিনি পৃথক কোন সৃষ্টি ছিলেন না। এতে পুরুষের প্রতি নারীর অনুগামী হওয়া প্রমাণিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৪/৩৪)।
জান্নাতের বাগানে দু’জনের এই যে শান্তির সম্পর্ক, এটা শুধু ঐ দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উভয়ের সন্তানসন্তুতির ক্ষেত্রেও সমান সত্য। তাই আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
هو الذي خلقكم من نفس واحدة و جعل منها زوجها ليسكن إليها
তিনি ঐ সত্তা যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি ‘নফস’ থেকে এবং বানিয়েছেন তার থেকে তার জোড়া যেন সে তার কাছে স্বস্তি লাভ করে। (সূরা আরাফ : ১৮৯)
অতঃপর তিনি তার (আদম) থেকে তার যুগল (হাওয়াকে) সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৬)
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে , তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই জাতি থেকে সৃষ্টি করেছেন স্ত্রীগণকে, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করো এবং তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন৷ অবশ্যই এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তা- ভাবনা করে৷ (সুরা রুম, আয়াত : ২১)
এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝা যায় নারীর সৃষ্টির অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো স্বামীর প্রশান্তি লাভ। আর এর অন্যতম উদাহরন আমরা দেখতে পাই হযরত খাদিজা রা এর চরিত্রের নমুনায়। রাসূল সা প্রশান্তি পেয়েছিলেন এই অন্যতম সংগীকে পেয়ে, আলহামদুলিল্লাহ।
মহান আল্লাহ আদম (আ.)-এর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নারী জাতিকে পাঁজরের বাঁকা হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে একেবারে ওপরের হাড়টি অধিক বাঁকা। যদি তা সোজা করতে যাও, ভেঙে ফেলবে। আর যদি তা ছেড়ে দাও, তবে সব সময় বাঁকাই থাকবে। সুতরাং তোমরা নারীর সঙ্গে উত্তম ও উপদেশমূলক কথাবার্তা বলবে।’ (বুখারি হাদিস : ৩০৮৫)
পৃথিবীতে প্রথম মানব আদম (আ.) মাটি থেকে এবং প্রথম মানবী হাওয়া (আ.) আদমের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি। এতদ্ব্যতীত সকল মানব-মানবী এক ফোঁটা অপবিত্র তরল পদার্থ (বীর্য) থেকে অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণ আকৃতি ও অপূর্ণ আকৃতি বিশিষ্ট গোশতপিণ্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করি।’ (সুরা হজ্জ, আয়াত : ৫)
সুতরাং বোঝা গেলো, পৃথিবীর প্রতিটি স্ত্রী তার স্বামীর জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে একটি পবিত্র উপহার। এজন্যই আল্লাহর নামকে মাধ্যম করে এবং মোহর আদায় করে একটি জান্নাতি উপহাররূপেই নারীকে গ্রহণ করতে হয়। আর এজন্যই বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক মুহূর্তে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
و إنكم إنما أخذتموهن بأمانة الله واستحللتم فروجهن بكلمات الله
আর তোমরা তাদের গ্রহণ করেছো আল্লাহর আমানতরূপে, আর তোমরা তাদের ‘লজ্জাস্থান’কে হালাল করেছো আল্লাহর কালিমাকে মাধ্যম করে।’ (সহীহ বুখারী ১/৩৯৭)
এবং নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের। তবে তাদের উপর পুরুষদের এক পর্যায়ের প্রাধান্য রয়েছে। আল্লাহ পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ২২৮)
আর যে কোন পুরুষ বা নারী নেক আমল করবে, আর সে মুমিন হবে, তাহলে তারা জান্নাতে দাখেল হবে এবং সেখানে তাদেরকে বেলা হিসাব রিযিক দান করা হবে। (সূরা মুমিন : ৪০)
অনন্তর তাদের প্রতিপালক তাদের দু‘আ কবুল করলেন (আর বললেন) যে, আমি তোমাদের কোন আমলকারীর আমল নষ্ট করবো না, সে পুরুষ হোক, বা নারী। তোমরা তো পরস্পরের অংশবিশেষ। (সূরা আলে ইমরান : ১৯৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানে রোজা রাখে, আব্রু(পর্দা) রক্ষা করে, স্বামীর নির্দেশ মান্য করে, তবে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪১৬৩)
ইবলিসের ফাঁদে আদম ও হাওয়া
অতঃপর বহিষ্কৃত ইবলীস তার প্রথম টার্গেট হিসাবে আদম ও হাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণার জাল নিক্ষেপ করল। সেমতে সে প্রথমে তাদের খুব আপনজন বনে গেল এবং নানা কথায় তাদের ভুলাতে লাগল। প্রতি নিয়্যত সে ওয়াসওয়াসা দিতেই থাকলো। ভালো বন্ধু সেজে অনেক সবরের সাথে নিজের উদ্দেশ্য পূর্ন করার জন্য লেগেই থাকলো, কারন নিজে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে কোনভাবেই আদম আ ও হাওয়া আ কে জান্নাতে দেখতে চায় না।
এক পর্যায়ে সে বলল, ‘আল্লাহ যে তোমাদেরকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে নিষেধ করেছেন, তার কারণ হ’ল এই যে, তোমরা তাহ’লে ফেরেশতা হয়ে যাবে কিংবা তোমরা এখানে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ ২০)।
সে অতঃপর কসম খেয়ে বলল যে, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাংখী’ (আরাফ ২১)। ‘এভাবেই সে আদম ও হাওয়াকে সম্মত করে ফেলল এবং তার প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে তারা উক্ত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আস্বাদন করল। ফলে সাথে সাথে তাদের গুপ্তাঙ্গ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং তারা তড়িঘড়ি গাছের পাতা সমূহ দিয়ে তা ঢাকতে লাগল।
আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? (আরাফ, ২২)
শেষ পর্যন্ত শয়তান তাদেরকে সেই গাছটির লোভ দেখিয়ে আমার হুকুমের আনুগত্য থেকে সরিয়ে দিল এবং যে অবস্থার মধ্যে তারা ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে ছাড়লো ৷ আমি আদেশ করলাম, “ এখন তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ তোমরা একে অপরের শত্রু৷ তোমাদের একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করতে ও জীবন অতিবাহিত করতে হবে ৷বাকারাঃ ৩৬
তখন আদম তার রবের কাছ থেকে কয়েকটি বাক্য শিখে নিয়ে তাওবা করলো ৷ তার রব তার এই তাওবা কবুল করে নিলেন ৷ কারণ তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী ৷বাকারাঃ৩৭
তখন তারা অনুতপ্ত হ’য়ে বলল, قَالاَ رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ ( আারাফ২৩)।
‘আল্লাহ তখন বললেন, তোমরা (জান্নাত থেকে) নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের অবস্থান হবে পৃথিবীতে এবং সেখানেই তোমরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সম্পদরাজি ভোগ করবে’ ( আরাফ২৪)।
আমরা বললাম , “ তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা ৷
আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী ৷ সেখানে তারা থাকবে চিরকাল ৷বাকারাঃ৩৮-৩৯
তিনি আরও বললেন যে, ‘তোমরা পৃথিবীতেই জীবনযাপন করবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান থেকেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে’ (আ‘রাফ ৭/২০-২৫)।
ভুল অপনোদনঃ এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইবলীসের কথায় সর্বপ্রথম হাওয়া প্রতারিত হন। অতঃপর তার মাধ্যমে আদম প্রতারিত হন বলে যে কথা চালু আছে কুরআনে এর কোন সমর্থন নেই। ছহীহ হাদীছেও স্পষ্ট কিছু নেই। এ বিষয়ে তাফসীরে ইবনু জারীরে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ।
তাফসীর ইবনে জারীর (বৈরুত: ১৪০৬/১৯৮৬) ৮/১০৯ পৃঃ, সূরা আ‘রাফ ৭/ ২২।
দ্বিতীয়তঃ জান্নাত থেকে অবতরণের নির্দেশ তাদের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ ছিলনা। কেননা এটা ছিল তওবা কবুলের পরের ঘটনা। অতএব এটা ছিল হয়তবা তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দানের জন্য। বরং সঠিক কথা এই যে, এটা ছিল আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত ও দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। কেননা জান্নাত হ’ল কর্মফল লাভের স্থান, কর্মের স্থান নয়। তাছাড়া জান্নাতে মানুষের বংশ বৃদ্ধির সুযোগ নেই। এজন্য দুনিয়ায় নামিয়ে দেওয়া জরূরী ছিল।
প্রথম বার আদেশ দানের পরে পুনরায় স্নেহ ও অনুগ্রহ মিশ্রিত আদেশ দিয়ে বললেন, ‘তোমরা সবাই নেমে যাও’।
অতঃপর পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হয়ে দায়িত্ব পালন করে যাবে।
তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন৷এখন যে কেউ কুফরী করবে তার কুফরীর দায়ভার তার ওপরই পড়বে এবং কাফেরদের কুফরী তাদেরকে এ ছাড়া আর কোন উন্নতি দান করে না যে, তাদের রবের ক্রোধ তাদের ওপর বেশী বেশী করে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং কাফেরদের জন্য ক্ষতিবৃদ্ধি ছাড়া আর কোন উন্নতি নেই৷ ফাত্বির ৩৫/৩৯)
মহান আল্লাহ মর্যাদা প্রদান করে বললেন, ‘তোমাদের নিকটে আমার পক্ষ থেকে হেদায়াত অবতীর্ণ হবে। যারা তার অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন ভয় বা চিন্তার কারণ থাকবে না। কিন্তু যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)।
উল্লেখ্য যে, নবীগণ ছিলেন নিষ্পাপ এবং হযরত আদম (আঃ) ছিলেন নিঃসন্দেহে নিষ্পাপ। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল করেননি। বরং শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত হয়ে তিনি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিকটবর্তী হওয়ার নিষেধাজ্ঞার কথাটি ভুলে গিয়েছিলেন। যেমন অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا- ‘অতঃপর আদম ভুলে গেল এবং আমি তার মধ্যে (সংকল্পের) দৃঢ়তা পাইনি’ (ত্বোয়াহা ২০/১১৫)।
তাছাড়া উক্ত ঘটনার সময় তিনি নবী হননি বরং পদস্খলনের ঘটনার পরে আল্লাহ তাকে নবী মনোনীত করে দুনিয়ায় পাঠান ও হেদায়াত প্রদান করেন’
শেষ পর্যন্ত দু’জন (স্বামী-স্ত্রী) সে গাছের ফল খেয়ে বসলো৷ ফলে তখনই তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়লো এবং দু’জনাই জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেকে ঢাকতে লাগলো৷ আদম নিজের রবের নাফরমানী করলো এবং সে সঠিক পথ থেকে সরে গেল৷ তারপর তার রব তাকে নির্বাচিত করলেন, তার তাওবা কবুল করলেন এবং তাকে পথ নির্দেশনা দান করলেন৷ ত্বোয়াহা ২০/১২১-১২২)।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইবলীসের ক্ষেত্রে আল্লাহ বললেন, قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ- ‘তুমি জান্নাত থেকে বেরিয়ে যাও। নিশ্চয়ই তুমি অভিশপ্ত’ (হিজরঃ৩৪;
আল্লাহ বললেনঃ “বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও ধিকৃত অবস্থায়৷ নিশ্চিতভাবে জেনে রাখিস ,এদের মধ্য থেকে যারাই তোর অনুসরণ করবে তাদেরকে এবং তোকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভরে দেবো৷আ‘রাফঃ১৮)।
অন্যদিকে আদম ও হাওয়ার ক্ষেত্রে বললেন,قُلْنَا اهْبِطُواْ مِنْهَا- ‘ তোমরা নেমে যাও’
শেষ পর্যন্ত শয়তান তাদেরকে সেই গাছটির লোভ দেখিয়ে আমার হুকুমের আনুগত্য থেকে সরিয়ে দিল এবং যে অবস্থার মধ্যে তারা ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে ছাড়লো ৷ আমি আদেশ করলাম, “ এখন তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ তোমরা একে অপরের শত্রু৷ তোমাদের একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করতে ও জীবন অতিবাহিত করতে হবে ৷বাকারাঃ৩৬
আমরা বললাম , “ তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা। আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী ৷ সেখানে তারা থাকবে চিরকাল ৷ ”বাকারাঃ৩৮
তিনি বললেনঃ “নেমে যাও, তোমরা পরষ্পরের শত্রু এবং তোমাদের জন্য একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত পৃথিবীতেই রয়েছে বসবাসের জায়গা ও জীবন যাপনের উপকরণ৷ আর বললেনঃ “সেখানেই তোমাদের জীবন যাপন করতে এবং সেখানেই মরতে হবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের সবশেষে আবার বের করে আনা হবে৷আ‘রাফঃ২৪-২৫)।
এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইবলীস কখনোই আর জান্নাতে ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু বনু আদমের ঈমানদারগণ পুনরায় ফিরে আসতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
নগ্নতা শয়তানের প্রথম কাজ
মানুষের উপরে শয়তানের প্রথম হামলা ছিল তার দেহ থেকে কাপড় খসিয়ে তাকে উলঙ্গ করে দেওয়া। আজও পৃথিবীতে শয়তানের পদাংক অনুসারী ও ইবলীসের শিখন্ডীদের প্রথম কাজ হ’ল তথাকথিত ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার নামে নারীকে উলঙ্গ করে ঘরের বাইরে আনা ও তার সৌন্দর্য উপভোগ করা। অথচ পৃথিবীর বিগত সভ্যতাগুলি ধ্বংস হয়েছে মূলতঃ নারী ও মদের সহজলভ্যতার কারণেই। অতএব সভ্য-ভদ্র ও আল্লাহভীরু বান্দাদের নিকটে ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরয হ’ল স্ব স্ব লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও ইযযত-আবরূর হেফাযত করা। অন্যান্য ফরয সবই এর পরে। নারীর পর্দা কেবল পোষাকে হবে না, বরং তা হবে তার ভিতরে, তার কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে ও চাল-চলনে সর্ব বিষয়ে। পরনারীর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ও মিষ্ট কণ্ঠস্বর পরপুরুষের হৃদয়ে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে। অতএব লজ্জাশীলতাই মুমিন নর-নারীর অঙ্গভূষণ ও পারস্পরিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে একে অপরের থেকে স্ব স্ব দৃষ্টিকে অবনত রাখবে (নূর ২৪/৩০-৩১)
এবং পরস্পরে সার্বিক পর্দা বজায় রেখে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কথাটুকু স্বাভাবিকভাবে সংক্ষেপে বলবে। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও পর্দা বজায় রেখে স্ব স্ব কর্মস্থলে ও কর্মপরিধির মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং সংসার ও সমাজের কল্যাণে সাধ্যমত অবদান রাখবে। নেগেটিভ ও পজেটিভ পাশাপাশি বিদ্যুৎবাহী দু’টি ক্যাবলের মাঝে প্লাষ্টিকের আবরণ যেমন পর্দার কাজ করে এবং অপরিহার্য এক্সিডেন্ট ও অগ্নিকান্ড থেকে রক্ষা করে, অনুরূপভাবে পরনারী ও পরপুরুষের মধ্যকার পর্দা উভয়ের মাঝে ঘটিতব্য যেকোন অনাকাংখিত বিষয় থেকে পরস্পরকে হেফাযত করে। অতএব শয়তানের প্ররোচনায় জান্নাতের পবিত্র পরিবেশে আদি পিতা-মাতার জীবনে ঘটিত উক্ত অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা থেকে দুনিয়ার এই পঙ্কিল পরিবেশে বসবাসরত মানব জাতিকে আরও বেশী সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত। কুরআন ও হাদীস আমাদেরকে সেদিকেই হুঁশিয়ার করেছে।
ইবনে জারীর (র) ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে , আল্লাহ তাআলা বলেন, হে আদম ! আমার আরশ বরাবর পৃথিবীতে আমার একটি সম্মানিত স্থান আছে ৷ তুমি গিয়ে তথায় আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে তা তাওয়াফ কর, যেমনটি ফেরেশতারা আমার আরশ তাওয়াফ করে ৷ অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তার কাছে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন ৷ তিনি আদম (আ)-কে জায়গাটি দেখিয়ে দেন এবং তাকে হজ্জেরর করণীয় কাজসমুহ শিখিয়ে দেন ৷
ইবনে জারীর (র) আরো উল্লেখ করেন যে, দুনিয়ার যেখানে সেখানে আদম (আ)-এর
পদচারণা হয়, পরবর্তীতে সেখানেই এক একটি জনবসতি গড়ে ওঠে ৷
ইবনে আব্বাস (রা) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, পৃথিবীত আদম (আ)-এর প্রথম খাদ্য ছিল গম ৷ জিবরাঈল (আ) তার কাছে সাতটি গমের বীজ নিয়ে উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো কি? জিবরাঈল (আ) বললেন, এই তো আপনার সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল,যা আপনি থেয়েছিলেন ৷ আদম (আ) জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো আমি কি করব? জিবরাঈল (আ) বললেন, যমীনে বপন করবেন ৷ উল্লেখ্য যে, তার প্রতিটি বীজের ওজন ছিল দুনিয়ার এক লক্ষ দানা অপেক্ষা বেশি ৷ বীজগুলো বোপণ করার পর ফসল উৎপন্ন হলে আদম (আ) তা কেটে মাড়িয়ে পিষে আটা বানিয়ে খামির করে রুটি বানিয়ে বহু ক্লেশ ও শ্রমের পর তা আহার করেন ৷
এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ্ তাআলা বলেন : সুতরাং সে যেন তোমাদের কিছুতেই জান্নাত থেকে বের করে না দেয় ৷ দিলে তোমরা দুঃখ পাবে ৷ ’ ( ২০- ১১৭ )
আদম ও হাওয়া (আ) সর্বপ্রথম যে পেশোক পরিধান করেন, তা ছিল ভেড়ার পশমের
তৈরি ৷ প্রথমে চামড়া থেকে পশমগুলা খসিয়ে তা দিয়ে সুতা তৈরি করেন ৷ তারপর আদম(আ) নিজের জন্য একটি জুব্বা আর হাওয়ার জন্য একটি কামীজ ও একটি ওড়না তৈরি করে নেন ৷(আল বিদায় আন নিহায়া)