৬। আখেরাতের ময়দানের চিত্র ৩য় পর্ব

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

“নিশ্চয় আমারই নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর নিশ্চয় তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই দায়িত্বে”। [সূরা আল-গাশিয়া, আয়াত: ২৫-২৬]

সেদিন গোপন অজানা তত্ত্ব ও রহস্য সমূহের যাচাই পরখ করা হবে। তখন মানুষের কাছে না নিজের কোন শক্তি থাকবে না কোন সাহায্যকারী তার জন্য আসবে। (আত-তারিক-  ৯-১০)

আজ তোমার চোখের পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। যা তুমি বিশ্বাস করতে চাওনি, অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাওনি, তা আজ দেখো এ সত্য দেখার জন্যে আজ তোমার দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে দিয়েছি। (সূরা কাফ-২২)

 

﴿وُجُوهٞ يَوۡمَئِذٖ نَّاضِرَةٌ ٢٢ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٞ ٢٣ وَوُجُوهٞ يَوۡمَئِذِۢ بَاسِرَةٞ ٢٤ تَظُنُّ أَن يُفۡعَلَ بِهَا فَاقِرَةٞ ٢٥﴾ [القيامة: ٢٢، ٢٥]

“সেদিন কতক মুখমণ্ডল হবে হাস্যোজ্জল। তাদের রবের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপকারী। আর সেদিন অনেক মুখমণ্ডল হবে বিবর্ণ-বিষন্ন। তারা ধারণা করবে যে, এক বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত করা হবে”। [সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত: ২২-২৫]

 

বিচার কার্য যেভাবে শুরুঃ

আমলনামা পেশঃ

আর আল্লাহ বলবেনঃ) ‘‘ দেখো এবার তোমরা ঠিক তেমনি নিসংগ ও একাকী আমার সামনে হাযির হয়ে গেছো যেমনটি তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, যা কিছু তোমাদের দুনিয়ায় দিয়েছিলাম তা সব তোমরা পেছনে রেখে এসেছো এবং এখন তোমাদের সাথে তোমাদের সে সব সুপারিশকারীদেরকেও দেখছি না যাদের সম্পর্কে তোমরা মনে করতে তোমাদের কার্য সম্পাদন করার ব্যাপারে তাদেরও কিছুটা অবদান আছে৷ তোমাদের মধ্যকার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমরা যেসব ধারণা করতে তা সবই তোমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে৷আন’আমঃ ৯৪

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাবো অন্ধকার। এর মাঝেই দেখা যাবে আমলনামা যার যার রেকর্ড। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

وَإِذَا الصُّحُفُ نُشِرَتْ

ওয়া ইযাছ ছুহুফু নুসিরাত

যখন আমলনামাসহ খুলে ধরা হবে৷ সূরা তাকভীরঃ১০

আকাশ থেকে এই আমলনামা পড়া শুরু করবে অথবা ফেরেশতারা নাম ধরে ধরে যার যার আমলনামা হাতে দিতে চাইবেন। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন–

প্রত্যেক দলকেই সেদিন বলা হবে- এসো, তোমাদের আমলনামা বা রেকর্ড নিয়ে যাও। আজ তোমাদেরকে সে সব আমলের বিনিময়ে দেয়া হবে, যা তোমরা করেছো। এটা আমাদের তৈরী করা আমলনামা। তোমাদের ব্যাপারে সঠিক ও যথাযথ সাক্ষ্য দেবে। তোমরা (পৃথিবীতে) যা কিছু করছিলে তা সঠিকভাবে লিখে রাখা হতো। (আল-জাসিয়া-  ২৮-২৯)

সেদিন আল্লাহ সবাইকে পুনরায় জীবিত করে উঠাবেন। তারা (পৃথিবীতে) যা কিছু করে এসেছে তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। তারা (তাদের কর্মসমূহ) ভুলে গিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ যাবতীয় কর্মসমূহ গুনে গুনে সংরক্ষিত করে রেখেছেন। (আল-মুজাদালা-  ৫)

‘প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্ম আমি তার গলায় লাগিয়ে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য বের করব এক কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত।

পড়ো, নিজের ‘আমলনামা’ রেকর্ড। আজ নিজের হিসাব নেয়ার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট। (বনী-ইসরাঈল-  ১৩-১৪

যেকোন ভাষার লোক হোক না কেনো বা শিক্ষিত অশিক্ষিত হোক সকলেই পড়তে পারবে নিজ নিজ আমলনামা। সেদিন অপরাধীরা বলে উঠবে-

 

‘‘আর সেদিন আমলনামা উপস্থিত করা হবে। তাতে যা আছে, তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয় নি; সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি যুলুম করবেন না। (সূরা কাহ্ফঃ ৪৯)

কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে সে তাও দেখবে।’ (সুরা ঝিলঝাল, আয়াত : ৭-৮)

অপরাধীরা ছোট গুনাহই দেখবে প্রথমে তখনই এইভাবে বলে উঠবে। তারা ছোট গুনাহকে গুরুত্ব দিতো না, হালকা করে দেখতো।

আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: হে ‘আয়িশাহ! তুমি ঐ সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাক যেগুলোকে ছোট বলে ধারণা করা হবে। কেননা এ সমস্ত ছোট ছোট গুনাহগুলোর খোঁজ রাখার জন্য আল্লাহ পক্ষ থেকে (ফেরেশতা) নিয়োজিত রয়েছে। (ইবনু মাজাহ, দারিমী, বায়হাক্বীর শুআবূল ঈমান) (সহীহ হাদিস) সহীহ ইবনু মাজাহ ৪২৪৩, সিলসিলাতুস সহীহাহ ৫১৩, ২৭৩১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব ২৪৭২, সিলসিলাতুস সহীহাহ্ ৫১৩

আনাস (রা.) বলেন, ‘তোমরা এমন সব কাজ করে থাকো যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুল থেকেও চিকন। কিন্তু নবী (সা.)-এর সময়ে আমরা এগুলোকে ধ্বংসকারী মনে করতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস :  ৬৪৯২)

কোনো সম্প্রদায় উপত্যকার পাদদেশে উপনীত হলো। অতঃপর ছোট ছোট জ্বালানি একত্র করে রুটি তৈরি করে। নিশ্চয়ই ছোট ছোট পাপ যখন কাউকে পেয়ে বসে তখন তা তাকে ধ্বংস করে ছাড়ে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫/৩৩১)

ছোট নেক কাজ বা ভালো কাজগুলোকেও আমরা হালকা করে দেখি অথচ ভালো কাজ ছোট হলেও গুরুত্ব দিয়েই করা প্রয়োজন।

সুব্‌হানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আক্‌বার পাঠ করা, যা কিছুর উপর সূর্য উদিত হয়েছে সবকিছু থেকে আমার কাছে অধিক প্রিয়। ’ (মুসলিম, হাদিস নং: ২৬৯৫)

ইস্তেগফার করা।

তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ক্রটি-বিচ্যূতির জন্য (সুরা মুহাম্মদ, ১৯)

আর তুমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালূ (সুরা নিসা, ১০৬)

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা করো-বিশুদ্ধ তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের প্রভু তোমাদের পাপগুলো মুছে দেবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে নদীসমূহ বয়ে যায়। -সূরা তাহরীম (৬৬) : ৮

নবী করিম (সাঃ) নারীদের কাছে এসে বলেনঃ “হে নারীগন, তোমরা সদকা কর, বেশী বেশী ইস্তেগফার কর। কারন তোমাদের অধিকাংশকেই আমি জাহান্নামের অধিবাসী দেখেছি। তাদের মধ্যে বাকপটু এক নারী বলে উঠলঃ আমাদের অধিকাংশ জাহান্নামী হওয়ার কারন কি? তিনি বললেনঃ তোমরা বেশী লানত কর এবং স্বামীদের নাশুকরি কর। (মুসলিম)

অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে সে বলবেঃ এসো! তোমরাও আমার আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। অতঃপর সে সুখী জীবন যাপন করবে সুউচ্চ জান্নাতে। তার ফলসমূহ অবনমিত থাকবে। বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে তার প্রতিদান স্বরূপ তোমরা খাও এবং পান কর তৃপ্তি সহকারে। আর যার আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে হায় আমায় যদি আমলনামা না দেয়া হতো! আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায় আমার মৃত্যুই যদি শেষ পরিণতি হত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে আসলনা। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল। ফেরেশতাদেরকে বলা হবেঃ একে ধর। অতঃপর গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও। অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতঃপর তাকে এমন শিকল দিয়ে বাঁধ যার দৈর্ঘ হবে সত্তর গজ। নিশ্চয়ই সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না এবং মিসকীনকে খাদ্য দিতে উৎসাহিত করত না। অতএব আজকের দিনে এখানে তার কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু থাকবে না এবং কোন খাদ্য নেই ক্ষতমিশ্রিত পুঁজ ব্যতীত। গুনাহগার ব্যতীত কেউ এটা খাবে না। (সূরা আল-হাক্কাহঃ ১৯- ৩৭)

এরপর যার ‘আমল নামা’ ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব সহজভাবে গ্রহণ করা হবে এবং সে আনন্দ চিত্তে আপনজনের নিকট ফিরে যাবে। আর ‘আমলনামা’ যার পিছন দিক হতে দেয়া হবে সে মৃত্যুকে ডাকবে। (অবশেষে) সে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবে। (ইনশিকাক-  ৭-১২)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের থেকে হিসাব নিতে শুরু করবেন। যার হিসাবে কঠোরতা করবেন সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

 

ইমাম তিরমিযি হযরত হাসান সূত্রে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন – আল্লাহর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ

করেছেন- “হাশরের দিনে তিন ধরণের মানুষকে আল্লাহর কাছে পেশ করা হবে। (১) প্রথম পেশ করা হবে যারা আল্লাহর সাথে ঝগড়া-বিবাদ করবে।

(২) নবীগণের পক্ষে  আপত্তি পেশ করার উদ্দেশ্যে নবীগণকে হাযির করা হবে।

(৩) আর ঐ সময়ই তৃতীয় প্রকারের উপস্থিতি হবে তাদের আমলনামা ডানহাতে বা বামহাতে উড়ে আসবে”।

এক প্রকার লোক হবে নিরেট কাফের।

তারা আল্লাহর সাথে ঝগড়া ও প্রতারণা করে পার হয়ে

যেতে চাইবে। দ্বিতীয় প্রকার লোক হবে- যারা নবীগণের

আগমনকে অস্বীকার করবে- কিন্তু আল্লাহপাক নবীগণের

পক্ষে সাক্ষী প্রমাণ পেশ করে কাফেরদের পরাস্ত

করবেন। আর তৃতীয় প্রকার লোক হবে গুনাহগার ও

নেককার। এদেরই হিসাব নিকাশ হবে। প্রথম দু দল বিনা

হিসাবে জাহান্নামে যাবে। নেক্কার ও বদকারের

আমলনামা দেখে হিসাব নিকাশ করা হবে।

আমলনামায় কি দেখতে পাবে?

আমলনামায় যা দেখতে পাবে, তার মাঝে ভয়াবহ হলো শিরক ।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে থাক। তার মধ্যে অন্যতম আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা। আবূ হুরাইরা (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত তিনি বলেন, সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে। সহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী? তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা। (২) যাদু। (৩) আল্লাহ তাআলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করা। (৪) সুদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের মাল গ্রাস করা। (৬) রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং (৭) সরল স্বভাবা সতী-সাধ্বী মু’মিনাদের অপবাদ দেয়া। (সহীহ বুখারীঃ ২৭৬৬ মুসলিমঃ ৮৯, আ প্র ২৫৬৩, ই ফা ২৫৭৫

আমলনামায় ভালো কাজ যা দেখতে পাবে-

মানুষের প্রতি ভালো আচরন বা ইহসান, তার মাঝে উত্তম হলো স্ত্রীর সাথে আচরন, সন্তানদের সাথে, পিতা মাতার সাথে( জান্নাতের দরজা দুটো)।

ফরয কাজ সমূহ, নফল ইবাদাত সমূহ। অন্যের কষ্ট বা সমস্যা দূর করা, ইত্যাদি

 

হিসাব নিকাশ শুরু সম্পর্কে হাদীসে এসেছে: আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«لاَ تَزُولُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ، عَنْ عُمُرِهِ فِيمَ أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَ أَبْلاَهُ، وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ».

“পাঁচটি প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আগে কোনো মানব সন্তান কিয়ামতের দিন পা নাড়াতে পারবে না। তাকে

প্রশ্ন করা হবে জীবন সম্পর্কে; সে কি কাজে আয়ু শেষ করেছে?

প্রশ্ন করা হবে তার যৌবন সম্পর্কে ; কি কাজে সে তাকে বার্ধক্যে পৌঁছে দিয়েছে?

প্রশ্ন করা হবে তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে; কীভাবে সে তা আয় করেছে আর কি কাজে তা ব্যয় করেছে?

প্রশ্ন করা হবে সে যা জ্ঞান অর্জন করেছে সে মোতাবেক কাজ করেছে কি না?”

তিরিমিজী, হাদীস নং ২৪১৬, তিনি হাদীসটিকে গরীব বলেছেন, আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন,  সহীহ আল জামে

     উম্মতে মুহাম্মাদীর হিসাব হবে সর্বপ্রথম

কিয়ামতের এ দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী মুসলিমদের বিশেষভাবে সম্মানিত করবেন। সকল পূর্ববর্তী জাতিগুলোকে দাঁড় করিয়ে রেখে মুসলিম জাতির হিসাব-নিকাশ বিচার ফয়সালা করে দিবেন। যদিও মুসলিম জাতি দুনিয়াতে আভির্ভাবের দিক দিয়ে অন্যান্য জাতিগুলোর পরে এসেছে কিন্তু কিয়ামতের দিন তাদের নিষ্পত্তি আগে করা হবে। এটি উম্মতে এক বিশাল সম্মান ও পুরস্কার।

হাদীসে এসেছে: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«نَحْنُ الآخِرُونَ السَّابِقُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، بَيْدَ أَنَّهُمْ أُوتُوا الكِتَابَ مِنْ قَبْلِنَا، ثُمَّ هَذَا يَوْمُهُمُ الَّذِي فُرِضَ عَلَيْهِمْ، فَاخْتَلَفُوا فِيهِ، فَهَدَانَا اللَّهُ، فَالنَّاسُ لَنَا فِيهِ تَبَعٌ اليَهُودُ غَدًا، وَالنَّصَارَى بَعْدَ غَدٍ»

“আমরা শেষে এসেছি কিন্তু কিয়ামতের দিন সকলের আগে থাকবো। যদিও অন্য সকল জাতিগুলো (ইয়াহূদী ও খৃষ্টান) কে গ্রন্থ দেওয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে, আমাদের গ্রন্থ দেওয়া হয়েছে তাদের পরে। অতঃপর জেনে রাখো এই (জুমু‘আর) দিনটি আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথে দিশা দিয়েছেন। আর অন্য লোকেরা এ ব্যাপারে আমাদের পিছনে আছে। ইয়াহূদীরা জুমার পরের দিন (শনিবার) উদযাপন করে আর খৃষ্টানেরা তার পরের দিন (রবিবার) উদযাপন করে”। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৭৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৫৫।

আবু হুরায়রা ও হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরেকটি বর্ণনায় এসেছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«نَحْنُ الْآخِرُونَ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا، وَالْأَوَّلُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، الْمَقْضِيُّ لَهُمْ قَبْلَ الْخَلَائِقِ».

“পৃথিবীতে বসবাসকারী জাতিগুলোর মধ্যে আমাদের আগমন সর্বশেষে আর কিয়ামতের দিনে আমাদের ফয়সালা করা হবে সকল সৃষ্টি জীবের পূর্বে”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৫৬।

হাদীসে আরো এসেছে: ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«نَحْنُ آخِرُ الْأُمَمِ، وَأَوَّلُ مَنْ يُحَاسَبُ، يُقَالُ: أَيْنَ الْأُمَّةُ الْأُمِّيَّةُ، وَنَبِيُّهَا؟ فَنَحْنُ الْآخِرُونَ الْأَوَّلُونَ »

“আমরা হলাম জাতিসমূহের সর্বশেষ। কিন্তু কেয়ামতে আমাদের হিসাব সর্ব প্রথম করা হবে। তখন বলা হবে: উম্মী (আসল) জাতি ও তাদের নবী কোথায়? তাই আমরা সর্বশেষ অথচ (মর্যাদায়) প্রথম”। ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪২৯০, আলবানী রহ. সহীহ আল জামে গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।

সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসিত বিষয়

পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ভোগ সম্পর্কে বান্দাকে সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসা করা হবে। সুস্থতা, ফলমূল ভক্ষণ, সুপেয় পানি পান, গাছের শীতল ছায়া ও ঘুমের তৃপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন বান্দা যেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে তার ভেতর সর্বপ্রথম হচ্ছে পৃথিবীতে উপভোগকৃত নেয়ামতসমূহ। বান্দাকে সেদিন বলা হবে আমি কি তোমাকে সুস্থ সবল শরীর দান করিনি? আমি কি তোমাকে শীতল সুপেয় পানি পান করাইনি?’ (তিরমিজি : ৩৩৫৮)

    হিসাব-নিকাশের প্রকৃতি

সেদিন তোমাদের জন্য কোন আশ্রয়স্থল থাকবে না এবং তোমাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টাকারীও কেউ থাকবে না। (সূরা আশ শূরা-৪৭)

“সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে দেখতে পাবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “আচ্ছা দুপুর বেলা যখন মেঘ না থাকে তখন সূর্যকে দেখার জন্য কি তোমাদের ভীর করতে হয়? সাহাবায়ে কেরাম উত্তরে বললেন, না। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশ্ন করলেন: পূর্ণিমার রাতে যখন আকাশে মেঘ না থাকে তখন চাঁদ দেখার জন্য কি তোমাদের ভীর করতে হয়? সাহাবায়ে কেরাম উত্তরে বললেন: না। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! তোমাদের প্রতিপালককে দেখার জন্য সেদিন তোমাদের কোনো কষ্ট করতে হবে না। যেমন সূর্য ও চন্দ্র দেখার জন্য তোমাদের কোনো কষ্ট করতে হয় না। আল্লাহ এক বান্দার সাথে সাক্ষাত দিবেন। আল্লাহ বলবেন: হে ব্যক্তি আমি কি তোমাকে সম্মানিত করি নি? আমি কি তোমাকে নেতা বানাইনি? আমি কি তোমাকে বিবাহ করাইনি। আমি কি তোমার জন্য বাহনের ব্যবস্থা করি নি? সে ব্যক্তি উত্তর দিবে অবশ্যই আপনি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি কি আমার সাথে সাক্ষাতের বিশ্বাস রাখতে? সে বলবে, না। আল্লাহ তখন বলবেন: আজ আমি তোমাকে ভুলে গেলাম যেমন তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। এরপর দ্বিতীয় এ ব্যক্তিকে আনা হবে। আল্লাহ বলবেন: হে ব্যক্তি আমি কি তোমাকে সম্মানিত করি নি? আমি কি তোমাকে নেতা বানাই নি? আমি কি তোমাকে বিবাহ করাই নি। আমি কি তোমার জন্য বাহনের ব্যবস্থা করি নি? সে ব্যক্তি উত্তর দিবে অবশ্যই আপনি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি কি আমার সাথে সাক্ষাতের বিশ্বাস রাখতে? সে বলবে, না। আল্লাহ তখন বলবেন: আজ আমি তোমাকে ভুলে গেলাম যেমন তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। এরপর তৃতীয় এক ব্যক্তিকে সাক্ষাত দিবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে অপর দুজনের মত করেই প্রশ্ন করবেন। সে বলবে, আমি আপনার প্রতি বিশ্বাস রেখেছি। আপনার কিতাব, আপনার রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস রেখেছি। সালাত পড়েছি, রোযা রেখেছি, দান-সদকা করেছি। সাধ্যমত আপনার প্রশংসা করেছি। তার উত্তর শুনে আল্লাহ বলবেন, তাই নাকি? তাহলে এখনই তোমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী উপস্থিত করি। তারপর (তোমার উত্তর সম্পর্কে) তুমি ভেবে দেখবে। বলা হবে, কে আছে তার সম্পর্কে স্বাক্ষ্য দিবে? এরপর তার মুখ সীল করে দেওয়া হবে। তার রান, তার গোশত, তার হাড্ডিকে বলা হবে, তোমরা কথা বলো। এরা তাদের জানা মতে তথ্য দিতে শুরু করবে। এভাবে আল্লাহ নিজে স্বাক্ষ্য দেওয়ার দায় থেকে মুক্ত থাকবেন। আসলে এ ব্যক্তিটি ছিল দুনিয়ার জীবনে মুনাফিক। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন”। সহীহ মুসলিমঃ ২৯৬৮।

আর সেদিন আপনি অপরাধীদেরকে দেখেবেন পরস্পর শৃংখলিত অবস্থায়। ইবরাহীমঃ ৪৯

হাশরের মাঠে আল্লাহর সামনে মিথ্যা শপথ করে বলবে,

{وَاللهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِينَ}  অর্থাৎ, আল্লাহর শপথ! আমরা মুশরিক ছিলাম না। (সূরা আনআম ২৩)

যেদিন আল্লাহ তাদের পুনরুত্থিত করবেন, সেদিন তারা আল্লাহর সামনে সেই ভাবেই মিথ্যা শপথ করবে, যেভাবে তোমার সামনে করে। (মুজাদালাহ ১৮)

 

তিরমিযী ২৪২৮। আবূ হুরাইরা (রাঃ) ও আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তারা দুজনেই বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন কোন বান্দাকে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তা’আলা তাকে প্রশ্ন করবেন, আমি কি তোমাকে কান, চোখ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দেইনি এবং তোমার অধীনে জীব-জন্তু ও খেত-খামার দেইনি? তোমাকে তো স্বাধীনভাবে ছেড়ে রেখেছিলাম সর্দারী করতে এবং মানুষের নিকট হতে এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করতে (জাহিলী যুগের একটি রীতি)। তুমি কি ধারণা করতে যে, এই দিনে আমার সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে? সে বলবে, না। তিনি তাকে বলবেন, তুমি যেভাবে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে, আমিও আজ তোমাকে ভুলে গেলাম।সহীহ মুসলিম।

  হিসাবঃ

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) উল্লেখ করেছেন যে, হিসাব দুই প্রকার।

(১) মুমিনের হিসাবঃ মুমিনের হিসাবের ব্যাপারে তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দার সাথে নিবৃত্তে মিলিত হবেন এবং পাপরাশির কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। যেমন এ বিষয়ে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا وَيَنقَلِبُ إِلَىٰ أَهْلِهِ مَسْرُورًا وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ فَسَوْفَ يَدْعُو ثُبُورًا وَيَصْلَىٰ سَعِيرًا إِنَّهُ كَانَ فِي أَهْلِهِ مَسْرُورًا إِنَّهُ ظَنَّ أَن لَّن يَحُورَ بَلَىٰ إِنَّ رَبَّهُ كَانَ بِهِ بَصِيرًا﴾

‘অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার কাছ থেকে হালকা হিসাব নেয়া হবে এবং সে হাসিমুখে নিজের লোকজনের কাছে ফিরে যাবে’। (সূরা ইনশিকাকঃ ৭-৯)

বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,

«إِنَّ اللَّهَ يُدْنِي الْمُؤْمِنَ فَيَضَعُ عَلَيْهِ كَنَفَهُ وَيَسْتُرُهُ من الناس ويقرره بذنوبه وَيَقُولُ له: أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا؟ أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا؟ أتعرف ذنب كذا؟ حَتَّى إِذَا قَرَّرَهُ بِذُنُوبِهِ، وَرَأَى فِي نَفْسِهِ أَن قد هَلَكَ، قَالَ: فإني سَتَرْتُهَا عَلَيْكَ فِي الدُّنْيَا وَأَنَا أَغْفِرُهَا لَكَ الْيَوْمَ ثم يعطى كِتَابَ حَسَنَاتِهِ»

‘আল্লাহ তাআলা মুমিনকে নিকটবর্তী করে তার উপর স্বীয় (সম্মানের) পর্দা স্থাপন করে তাকে মানুষ থেকে আড়াল করবেন এবং তাকে দিয়েই তার গুনাহসমূহের স্বীকারোক্তি আদায় করবেন। আল্লাহ তাকে বলবেনঃ তুমি কি অমুক অমুক অপরাধ স্বীকার করো? তুমি কি অমুক অমুক অপরাধ স্বীকার করো? তুমি কি অমুক অমুক অপরাধ স্বীকার করো? এমনকি আল্লাহ যখন তার কাছ থেকে সকল গুনাহর স্বীকৃতি আদায় করবেন এবং বান্দা যখন দেখবে যে, সে ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে তখন আল্লাহ বলবেনঃ আমি দুনিয়াতে তোমার এ সমস্ত গুনাহ গোপন রেখেছি। আজ তোমার এ সমস্ত গুনাহ আমি ক্ষমা করে দিবো। তখন তার ভাল কাজগুলোর আমলনামা (ডান হাতে) প্রদান করা হবে

ويقرره بذنوبه তাকে দিয়েই তার গুনাহসমূহের স্বীকারোক্তি আদায় করবেনঃ অর্থাৎ তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবেন, যাতে সে তার গুনাহসমূহ স্বীকার করতে বাধ্য হবে। যেমন হাদীছে উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তাকে একাধিকবার জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি এই গুনাহ স্বীকার করো? তুমি কি এই গুনাহ স্বীকার করো?

মুমিনদের মধ্যে এমন বহু সংখ্যক থাকবে, যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেমন সত্তর হাজারের হাদীছে এসেছে যে, তারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিরমিযী,

সত্তর হাজার লোক, বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাত্রিতে যখন উর্ধারোহণ করলেন, তখন তিনি নবী ও নবীগণের দলের পাশ দিয়ে যান। তিনি তখন দেখতে পেলেন তাদের সাথে আছে তাদের উম্মাতগণ। কোথাও বা একজন নবী ও তার সাথে আছে ছোট একটি দল। আর কোন কোন নবীর সাথে কেউ নেই।

অবশেষে তিনি একটি বিরাট দলের পাশদিয়ে এগিয়ে গেলেন। তিনি বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম, এ বিরাট দলটি কারা? বলা হলো, মূসা (আঃ) ও তার উন্মাতগণ। আপনি আপনার মাথা তুলে দেখুন। তিনি বলেন, তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম, অসংখ্য মানুষের একদল যারা আকাশের এই দিগন্ত ও সেই দিগন্ত পূর্ণ করে আছে। বলা হলো, এরা আপনার উম্মাত। আপনার উম্মাতের মধ্যে এরা ছাড়াও সত্তরহাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

একথা বলার পর তিনি ঘরের ভিতর ঢুকলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে তারা তাকে প্রশ্ন করেনি এবং তিনিও এর ব্যাখ্যা করে বলেননি। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করলেন। কেউ বলেন, আমরাই সেই দলের, যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেউ বলেন, তারা আমাদের সন্তান যারা ইসলামী ফিতরাতে জন্মগ্রহণ করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসে বলেন, যারা গায়ে গরম লোহার দাগ দেয় না, ঝাড়ফুঁক করে না, ফাল অর্থাৎ শুভাশুভ লক্ষণ নির্ণয় করে না এবং তাদের প্রভুর উপর পূর্ণ নির্ভরশীল থাকে, তারা হবে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারী দল। একথা শুনার পর উক্কাশা ইবনু মিহসান (রাঃ) দাড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। আমি কি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারপর আরেকজন এসে বলল, আমিও কি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন, উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে।

সহীহ, বুখারী, মুসলিম।

আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। ইবনু মাসউদ ও আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে।

ইবনে মাজাহ ও বাইহাকীতে সহীহ সনদ দ্বারা অপর হাদীছে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার প্রতিপালকের নিকট চাওয়ার ভিত্তিতে তিনি আমাকে উক্ত প্রতি হাজারে আরো সত্তর হাজারের ওয়াদা দিয়েছেন। সেই সাথে থাকবে আমার প্রতিপালকের আরো তিন অঞ্জলি।

হিসাব হবে বিভিন্ন রকম। কারো হিসাব হবে একদম সহজ। আর এটি হলো কেবল আমলগুলো পেশ করা। আরেক প্রকার হিসাব হবে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে।

 

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : يُغْفَرُ لِلشَّهِيدِ كُلُّ ذَنْبٍ إِلَّا الدَّيْنَ

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তাআলা ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” (সহীহ মুসলিম, হা/ ১৮৮৬)

হাদিসে এসেছে, শহীদ কবরের ফেতনা থেকে রক্ষা পাবে এবং কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকেও মুক্তি লাভ করবে।

এভাবে কুরআন-হাদিসে শহীদের মর্যাদার কথা উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, তার কোনই হিসাব হবে না।

সুতরাং ‘শহীদ বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে’ এমন কথা বলা যাবে না দলীল ছাড়া। তবে আশা করা যায়, আল্লাহ তার হিসেব সহজ করবেন।

         সহজ হিসাবঃ

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

আইশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ পুঙ্খানুপঙ্খভাবে যার হিসাব গ্রহণ করা হবে সে তো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ্ তা’আলা তো বলেছেন, “যে ব্যক্তির ডানহাতে তার আমলনামা প্রদান করা হবে, খুব সহজেই তার হিসাব-নিকাশ হবে” (সূরাঃ ইনশিকাক- ৭-৮)। তিনি বললেনঃ সেটা তো শুধু নামমাত্র উপস্থাপন করা। আর কেয়ামতের দিন যার হিসাব জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নেওয়া হবে, তাকে অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে। সহীহ বুখারী:৬৫৩৭, মুসলিম। আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। তিরমিযিঃ ২৪২৬

কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশ লাভ করে সবচেয়ে বেশি ধন্য কে হবে?

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশ লাভ করে সবচেয়ে বেশি ধন্য কে হবে? তিনি বললেন:

«لَقَدْ ظَنَنْتُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ، أَنْ لَا يَسْأَلَنِي عَنْ هَذَا الْحَدِيثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الْحَدِيثِ، أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ»

“হে আবু হুরায়রা, আমি ধারণা করেছি, এ হাদীস সম্পর্কে তোমার চেয়ে আগে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। কারণ, হাদীসের ওপর আমি তোমার আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ লাভ করে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান সে হবে, যে নিজের অন্তর অথবা নফস থেকে খালিসভাবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে”। সহীহ বুখারী: ৯৯

অত্র হাদীসে তিনি বলেছেন: «مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ» এ কথা প্রমাণ করে, মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা যথেষ্ট নয়, বরং কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত কালেমার শর্তসমূহ ও তার জরুরি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা আবশ্যক, অন্যথায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মূল্যহীন।

সর্বপ্রথম বিচার হবে যারঃ    

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে শহীদ হয়েছিল। তাকে হাজির করা হবে এবং আল্লাহ তার নিয়ামতের কথা তাকে বলবেন। এবং সে তার প্রতি সকল নিয়ামত চিনতে পারবে। তখন আল্লাহ তাকে বলবেন তুমি কি কাজ করে এসেছ? সে বলবে, আমি তোমার পথে যুদ্ধ করেছি, শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন : তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি তো যুদ্ধ করেছ লোকে তোমাকে বীর বলবে এ উদ্দেশ্যে। আর তা বলা হয়েছে। অত:পর নির্দেশ দেয়া হবে, এবং তাকে টেনে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তারপর এমন ব্যক্তির বিচার করা হবে, যে নিজে জ্ঞান অর্জন করেছে ও অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন তেলাওয়াত করেছে। তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে তার নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে স্বীকার করবে। তাকে জিজ্ঞেস করবেন কি কাজ করে এসেছ? সে বলবে আমি জ্ঞান অর্জন করেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তেলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি জ্ঞান অর্জন করেছ এ জন্য যে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলবে। কুরআন তেলাওয়াত করেছ এ উদ্দেশ্যে যে, লোকে তোমাকে কারী বলবে। আর তা বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেয়া হবে তাকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার জন্য।

তারপর বিচার করা হবে এমন ব্যক্তির, যাকে আল্লাহ দুনিয়াতে সকল ধরণের সম্পদ দান করেছিলেন। তাকে হাজির করে আল্লাহ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে সকল নেয়ামত স্মরণ করবে। আল্লাহ বলবেন, কি করে এসেছ? সে বলবে, আপনি যে সকল খাতে খরচ করা পছন্দ করেন আমি তার সকল খাতে সম্পদ ব্যয় করেছি, কেবল আপনারই জন্য। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি সম্পদ এ উদ্দেশ্যে খরচ করেছ যে, লোকে তোমাকে দানশীল বলবে। আর তা বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেয়া হবে, এবং তাকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (বর্ণনায় : মুসলিম)

 

হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম তুমি আমার সেবা করোনি

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে মানব সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমার সেবা করোনি। মানব সন্তান বলবে, হে আমার প্রভূ! কিভাবে আমি আপনার সেবা করব, আপনিতো সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন: তুমি কি জানতে না যে আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো? তুমি তো তাকে সেবা করোনি। তুমি কি জানতে না, যদি তার সেবা করতে তাহলে তার কাছে আমাকে পেতে?

হে মানব সন্তান! আমি খাবার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি। মানব সন্তান বলবে, হে আমার প্রভূ! কিভাবে আমি আপনাকে খাদ্য দেব, আপনিতো সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন: তুমি কি জানতে না যে আমার অমুক বান্দা খাবার চেয়েছিলো? তুমি তো খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না, যদি তাকে খাবার দিতে তাহলে তা আমার কাছে পেতে?

হে মানব সন্তান! আমি পানি পান করতে চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। মানব সন্তান বলবে, হে আমার প্রভূ! কিভাবে আমি আপনাকে পানী পান করাবো, আপনিতো সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন: তুমি কি জানতে না যে আমার অমুক বান্দা পিপাসিত ছিল? তুমি তো তাকে পানী পান করাওনি। তুমি কি জানতে না, যদি তাকে পানী পান করাতে তাহলে তা আমার কাছে পেতে?  (মুসলিম)

সর্বপ্রথম হিসাবের বিষয়   

পৃথিবীতে মানুষের আমলের গ্রহণযোগ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যেসব আমল করার কথা ছিল কিন্তু করেনি সেসব নিয়েও জিজ্ঞাসা করা হবে। হাশরের মাঠে সর্বপ্রথম নামাজের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় হাশরের মাঠে বান্দার যে আমলের হিসাব সর্বপ্রথম নেওয়া হবে তা হচ্ছে তার নামাজ। সুতরাং যদি কারও নামাজ সঠিক হয়, তবে সে পরিত্রাণ পাবে। আর যদি নামাজের হিসাবে ত্রুটি পাওয়া যায়, তবে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য যদি তার ফরজ ইবাদতে কিছু ঘাটতি থাকে, তাহলে আল্লাহ বলবেন, দেখ আমার বান্দার কিছু নফল ইবাদত আছে কি না, যা দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূরণ করে দেওয়া হবে? অতঃপর এভাবে অন্য সব ইবাদতের হিসাব নেওয়া হবে।’ (আবু দাউদ : ৮৬৪; তিরমিজি : ৪১৩; ইবনে মাজা : ১৪২৫)

সর্বপ্রথম ফয়সালার বিষয়

হাশরের মাঠে সর্বপ্রথম রক্তপাতের ফয়সালা হবে। পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে কেউ কাউকে হত্যা করলে তার ফয়সালা দ্রুত হয়ে যাবে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হাশরের ময়দানে বিচারের দিন মানুষের মাঝে সর্বপ্রথম রক্তপাতের (হত্যার) ফয়সালা প্রদান করা হবে। (বুখারি : ৪৮৬৪; মুসলিম : ১৬৭৮)

সর্বপ্রথম যে বিষয়ের নিষ্পত্তি

হাশরের মাঠে সর্বপ্রথম দুই প্রতিবেশীর ঝগড়ার মামলা নিষ্পত্তি হবে। হজরত উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বিচারের দিন সর্বপ্রথম আল্লাহর আদালতে যে মামলার বিচার হবে, তা হলো দুই প্রতিবেশীর ঝগড়ার মামলা।’ (মুসনাদে আহমাদ: ১৭৩৭২; আল-মুজামুল কাবির লিতাবরানি : ১৪২৫২; সহিহুল জামে : ২৫৬৩)।

 

কিয়ামতের দিন নবী রাসূলদের ডাকা হবে জিজ্ঞাসিত করার জন্য।

“সুতরাং আমরা অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করব যাদের নিকট রাসূল প্রেরিত হয়েছিল এবং অবশ্যই আমি রাসূলদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। অতঃপর অবশ্যই আমি তাদের নিকট জেনে- শুনে বর্ণনা করব। আর আমি তো অনুপস্থিত ছিলাম না”। [সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৬-৭]

আর আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“কিয়ামতের দিন নবীদের ডাকা হবে। কারো সাথে একজন অনুসারী থাকবে কারো সাথে থাকবে দুজন আবার কারো সাথে থাকবে তিন জন বা এর বেশি। তাদের জাতিকে ডাকা হবে। তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, এ ব্যক্তি কি তোমাদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দিয়েছিল? তারা উত্তর দিবে, না, আমাদের কাছে আপনার বাণী পৌঁছে দেয়নি। তখন নবীকে প্রশ্ন করা হবে তুমি কি আমার বাণী পৌঁছে দিয়েছো? সে বলবে, হ্যা, দিয়েছি। তখন তাকে বলা হবে তোমার পক্ষে কে আছে স্বাক্ষী? তখন নবী বলবেন, আমার পক্ষে স্বাক্ষী আছে মুহাম্মাদ ও তাঁর উম্মত। তখন মুহাম্মাদ ও তার অনুসারীদের ডাকা হবে। তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এ ব্যক্তি কি তার জাতির কাছে আমার বাণী পৌঁছে দিয়েছে? তখন তারা বলবে, হ্যাঁ, সে তার জাতির কাছে আপনার বাণী পৌঁছে দিয়েছে। তখন তাদের প্রশ্ন করা হবে তোমরা এটা কীভাবে জানলে? তারা উত্তর দিবে, আমাদের কাছে আমাদের নবী এসেছিলেন, তিনি আমাদের বলেছেন, এ নবী তার জাতির কাছে আপনার বাণী পৌঁছে দিয়েছে। এটা হলো আল্লাহ তা‘আলার সেই বাণীর প্রতিফলন: আর এমনি ভাবে তোমাদের আমি মধ্যবর্তী (ন্যায়পরায়ণ) জাতি হিসাবে সৃষ্টি করেছি। যাতে তোমরা মানুষের ওপর স্বাক্ষী হতে পারো আর রাসূল তোমাদের ওপর স্বাক্ষী হবেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৩] মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১১৫৫৮।  আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

উম্মতে মুহাম্মদী কিয়ামতের দিন অন্য সকল জাতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে

এটা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিশেষ মর্যাদা। কিয়ামত দিবসে তারা সকল জাতির মিথ্যাচারের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে। কিয়ামতের দিন যখন সকল নবী রাসূল ও তাদের সম্প্রদায়কে একত্র করা হবে তখন ঐ সকল জাতিরা নবী রাসূলদের আহবানের বিষয়টি অস্বীকার করবে। তারা বলবে আমাদের কাছে আপনার বাণী পৌঁছে দেয়নি। এভাবে তারা তাদের নবী রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে নিজেদের বাঁচার তাগিদে। তখন উম্মতে মুহাম্মাদী সকল নবীদের পক্ষে আর তাদের মিথ্যাবাদী উম্মতদের বিপক্ষে স্বাক্ষী দিবে।

হাদীসে এসেছে: আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«يُجَاءُ بِنُوحٍ يَوْمَ القِيَامَةِ، فَيُقَالُ لَهُ: هَلْ بَلَّغْتَ؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ، يَا رَبِّ، فَتُسْأَلُ أُمَّتُهُ: هَلْ بَلَّغَكُمْ؟ فَيَقُولُونَ: مَا جَاءَنَا مِنْ نَذِيرٍ، فَيَقُولُ: مَنْ شُهُودُكَ؟ فَيَقُولُ: مُحَمَّدٌ وَأُمَّتُهُ، فَيُجَاءُ بِكُمْ، فَتَشْهَدُونَ “، ثُمَّ قَرَأَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ {وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا} [البقرة: 143]- قَالَ: عَدْلًا – {لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ، وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا} [البقرة: 143]

“কিয়ামতের দিন নূহ কে ডাকা হবে। তাকে প্রশ্ন করা হবে, তুমি কি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো? সে বলবে, হ্যাঁ, হে প্রভূ। এরপর তার জাতিকে প্রশ্ন করা হবে, সে কি তোমাদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দিয়েছে? তখন তারা বলবে না, আমাদের কাছে কোন সতর্ককারী আসেনি। তখন আল্লাহ নূহকে বলবেন, তোমার স্বাক্ষী কারা? সে উত্তর দিবে, মুহাম্মাদ ও তার উম্মত। তখন তোমাদের ডাকা হবে আর তোমরা তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করলেন: আর এমনি ভাবে তোমাদের আমি মধ্যবর্তী (ন্যায় পরায়ণ) জাতি হিসাবে সৃষ্টি করেছি। যাতে তোমরা মানুষের উপর স্বাক্ষী হতে পারো আর রাসূল তোমাদের উপর স্বাক্ষী হবেন”।সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৩৪৯।

আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—

আর আল্লাহ যখন বলবেন, হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা, তুমি কি মানুষদেরকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর? সে বলবে, আপনি পবিত্র মহান, যার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার জন্য সম্ভব নয়। যদি আমি তা বলতাম তাহলে অবশ্যই আপনি তা জানতেন। আমার অন্তরে যা আছে তা আপনি জানেন, আর আপনার অন্তরে যা আছে তা আমি জানি না; নিশ্চয় আপনি গায়েবী বিষয়সমূহে সর্বজ্ঞাত। আমি তাদেরকে কেবল তাই বলেছি, যা আপনি আমাকে আদেশ করেছেন যে, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদাত কর। আর যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি তাদের উপর সাক্ষী ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিলেন তখন আপনি ছিলেন তাদের পর্যবেক্ষণকারী। আর আপনি সব কিছুর উপর সাক্ষী। (সূরা আল মায়েদা, আয়াত ১১৬-১১৭)

“হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসুল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন-

“আমার উম্মতের মনে যেসব কুখেয়াল বা পাপের উদ্ভব হয়- আল্লাহ্পাক তা ক্ষমা করে দিবেন-যে পর্যন্ত না তা বাস্তবায়ন করা হয় অথবা মুখে তা উচ্চারণ করা হয়”। (বুখারী ও মুসলিম)।

হে রাসূল! এদেরকে বলো, আমি কি তোমাদের বলবো নিজেদের কর্মের ব্যাপারে বেশী ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্থ কারা ? সে লোকগুলো তারা, যারা পৃথিবীর জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম সব সময় সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত থাকতো এবং যারা মনে করতো যে, তারা সব কিছু সঠিক করে যাচ্ছে। এরা এমন সব লোক যারা নিজেদের রব-এর নিদর্শনাবলী মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর সামনে উপস্থিত হবার ব্যাপারটি বিশ্বাস করেনি। তাই তাদের সমস্ত কর্ম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কোন গুরুত্ব দেয়া হবে না। (কাহ্‌ফ- ১০৩-১০৫)

আদম আ কে প্রথম ডাক দিবেন আল্লাহঃ

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কেয়ামতের দিন যাকে প্রথম ডাকা হবে তিনি হলেন আদম আলাইহিস সালাম। তিনি তার সন্তানদের দেখবেন। বলা হবে এ হল তোমাদের পিতা আদম। তিনি তখন বলবেন, উপস্থিত হয়েছি হে প্রভূ! আপনার কাছেই কল্যাণ। আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেন, তোমার সন্তানদের মধ্যে জাহান্নাম বাসীদের নিয়ে আসো। আদম বলবেন, হে প্রভূ, কত জনকে নিয়ে আসবো? আল্লাহ বলবেন, শত করা নিরানব্বই জনকে নিয়ে আসো। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যখন আমাদের একশ জনের মধ্য হতে নিরানব্বই জনকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে তাহলে বাকী থাকবে কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন অন্যান্য উম্মতের সংখ্যার তুলনায় আমার উম্মত হবে এমন অল্প যেমন একটি কালো ষাড়ের গায়ে সাদা পশম থাকে। (বর্ণনায় : বুখারী)

আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ বলবেন হে আদম! তখন আদম বলবেন, হে প্রভূ আমি উপস্থিত। আপনার হাতেই সৌভাগ্য ও সকল কল্যাণ। আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামীদের আমার কাছে উপস্থিত করো। আদম বলবেন, কত জন জাহান্নামী? আল্লাহ বলবেন প্রতি হাজারে নয় শত নিরানব্বই জন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন এটা হল সেই সময় যখন ভয়াবহ অবস্থার কারণে বাচ্চারাও বুড়ো হয়ে যাবে। প্রসব কারীনিরা প্রসব করে দেবে। আর তুমি মানুষকে দেখবে নেশাগ্রস্ত অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়। কিন্তু আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। সাহাবায়ের কেরামের কাছে বিষয়টা কঠিন মনে হল। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি সে, যে মুক্তি পাবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, আমি আশা করি জান্নাতীদের চার ভাগের একভাগ হবে তোমরা। এ কথা শুনে আমরা আলহামদুলিল্লাহ বললাম ও আল্লাহ আকবর বললাম। তিনি বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, আমি আশা করি জান্নাতীদের তিন ভাগের একভাগ হবে তোমরা। এ কথা শুনে আমরা আলহামদুলিল্লাহ বললাম ও আল্লাহ আকবর বললাম। তিনি বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, আমি আশা করি জান্নাতীদের অর্ধেক হবে তোমরা। এ কথা শুনে আমরা আলহামদুলিল্লাহ বললাম ও আল্লাহ আকবর বললাম। তিনি বললেন, অন্যান্য জাতির তুলনায় তোমাদের সংখ্যা হবে এমন যেন একটি কালো ষাড়ের গায়ে কিছু সাদা লোম থাকে। অথবা গাধার পায়ের গোছার সাদা অংশের মত। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)

 

power point presentation

৬। মৃত ব্যক্তি ও আমরা-পর্ব-৬