৫। আখেরাতের ময়দানের চিত্র ২য় পর্ব

দুনিয়াটা তখন স্বপন মনে হবে এবং আখেরাতের অবস্থাটাই বাস্তব।

যখন আমি পাহাড়-পর্বতগুলোকে চালিত করবো তখন তোমরা যমীনকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখতে পাবে। আর আমি সমস্ত মানুষকে এমনভাবে একত্রিত করবো যে (পূর্বের ও পরের) কেউ বাকী থাকবে না। (সূরা কাহাফ-৪৭)

সেদিন সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে। তারপর (সেদিন) যা কিছু ঘটবে তা সকলের চোখের সামনেই ঘটবে। (সূরা হুদ- ১০৩)

জ্ঞানপাপীদের লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেছেন এরা প্রকৃত অন্ধদের চেয়েও অন্ধ ব্যর্থকাম। মহান আল্লাহ বলেন- আমি তাদেরকে কিয়ামতের দিন অন্ধ, বোবা ও কালা (বধির) করে উল্টো করে টেনে নিয়ে আসবো। এদের শেষ পরিণতি জাহান্নাম। (সূরা বনী-ইসরাইল-৯৭)

আর যারা পৃথিবীতে (সত্য দেখার ব্যাপারে) অন্ধ হয়ে থাকবে, তারা আখেরাতেও অন্ধ হয়েই থাকবে। বরং পথ লাভ করার ব্যাপারে তারা অন্ধদের চেয়েও ব্যর্থকাম। (বনী-ইসরাইল-৭২)

 

যারা সে দিন আল্লাহ তা‘আলার আরশের ছায়াতে আশ্রয় পাবে

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ اللهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: «أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلَالِي، الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِي ظِلِّي يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلِّي»

“আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন বলবেন, যারা আমারই জন্য পরস্পরকে ভালোবেসেছে তারা আজ কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার ছায়ায় ছায়া দান করবো। আজ এমন দিন আমার ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া নেই”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৬৬।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ، يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ: الإِمَامُ العَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي المَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ: إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ، أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ»

“কিয়ামত দিবসে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ‘আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত ভিন্ন কোনো ছায়া থাকবে না- ন্যায়পরায়ন বাদশাহ, এমন যুবক যে তার যৌবন ব্যয় করেছে আল্লাহর ইবাদতে, ঐ ব্যক্তি যার হৃদয় সর্বদা সংশি­ষ্ট থাকে মসজিদের সাথে, এমন দু ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছে এবং বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারই জন্য, এমন ব্যক্তি যাকে কোনো সুন্দরী নেতৃস্থানীয়া এক রমণী আহ্বান করল অশ্লীল কর্মের প্রতি, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করে সে বলল, আমি আল্লাহকে ভয় করি, এমন ব্যক্তি, যে এরূপ গোপনে দান করে যে, তার বাম হাত ডান হাতের দান সম্পর্কে অবগত হয় না। আর এমন ব্যক্তি, নির্জনে যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দু-চোখ বেয়ে বয়ে যায় অশ্রুধারা”।সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৩১।

আবু ইয়াসার কা‘আব ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا أَوْ وَضَعَ عَنْهُ، أَظَلَّهُ اللهُ فِي ظِلِّهِ»

“যে কোনো ঋণগ্রস্ত বা অভাবী ব্যক্তিকে সুযোগ দিবে অথবা তাকে ঋণ আদায় থেকে অব্যাহতি দিবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে নিজ ছায়ায় আশ্রয় দিবেন”। সহীহ মুসলিম:২৩০২।

হাউজে কাউসার

রসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সেগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন : কাউসার বলতে দু’টি জিনিস বুঝানো হয়েছে৷ একটি হচ্ছে ” হাউজে কাউসার ” এটি কিয়ামতের ময়দানে তাঁকে দান করা হবে৷ আর দ্বিতীয়টি ” কাউসার ঝরণাধারা৷ ” এটি জান্নাতে তাঁকে দান করা হবে৷

তবে এখানে এটা জানা আবশ্যক যে, কাউসার ও হাউয একই বস্তু নয়।

হাউযের অবস্থান হাশরের মাঠে, যার পানি কাউসার থেকে সরবরাহ করা হবে। আর কাউসারের অবস্থান হলো জান্নাতে। হাশরের ময়দানের হাউয সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জান্নাতের কাউসার ঝর্ণাধারা থেকে পানি এনে হাউযে ঢালা হবে।

এক হাদীসে বলা হয়েছে, “জান্নাত থেকে দুটি খাল কেটে এনে তাতে ফেলা হবে এবং এর সাহায্যে সেখান থেকে তাতে পানি সরবরাহ হবে।” [মুসলিম: ২৩০০, মুসনাদে আহমাদ: ৪/৪২৪, ৫/১৫৯, ২৮০, ২৮১, ২৮২, ২৮৩]

সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক নবীর জন্য একটি করে হাওয হবে। আর এ নিয়ে তারা পরস্পর গর্ববোধ করবেন যে, কার হাওযে কত বেশি লোক অবতরণ করবে। আমি দৃঢ়ভাবে আশা করি যে, আমার হাওযেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক আসবে। তিরমিযীঃ ২৪৪৩

সহীহ, তাখরীজু তাহাতীয়া (১৯৭), মিশকাত (৫৫৯৪), সহীহাহ (১৫৮৯)।

হাউয হলো এমন এক বিরাট পানির ধারা যা আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হাশরের মাঠে দান করেছেন। যা দুধের চেয়েও শুভ্র, বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা, মধুর চেয়েও মিষ্টি, মিসকের চেয়েও অধিক সুস্ৰাণ সম্পন্ন। যা অনেক প্রশস্ত, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সমান, তার কোণ সমূহের প্রত্যেক কোণ এক মাসের রাস্তা, তার পানির মূল উৎস হলো জান্নাত।

জান্নাত থেকে এমন দুটি নলের মাধ্যমে তার সরবরাহ কাজ সমাধা হয়ে থাকে যার একটি স্বর্ণের অপরটি রৌপ্যের। তার পেয়ালা সমূহের সংখ্যা আকাশের তারকারাজীর মত। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার হাউযের আয়তন হচ্ছে ‘আইলা’ (বায়তুল মুকাদ্দাস) থেকে সান’আ পর্যন্ত, আর সেখানে পেয়ালার সংখ্যা আকাশের তারকার মত এত বেশী”। [বুখারী: ৬৫৮০, মুসলিম: ২৩০৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, “আমার হাউয এক মাসের রাস্তা, তার কোণসমূহ একই সমান, তার পানি দুধের চেয়েও সাদা, তার ঘাণ মিসকের চেয়েও বেশী উত্তম, তার পেয়ালাসমূহ আকাশের তারকা মত বেশী ও উজ্জ্বল, যে তা থেকে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবেনা”। [বুখারী: ৬৫৭৯, মুসলিম: ২২৯২]

সাহ্ল ইবনে সা’দ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :অর্থঃ আমি তোমাদের আগেই হাউজে কাউসারে থাকব। যে পানি পান করতে চাইবে আমি তাকে পান করাব, আর যে পান করবে সে কখনো পিপাসিত হবে না। আমার সামনে এক জামাতকে আনা হবে তারা আমাকে চিনবে আমিও তাদের চিনব কিন্তু পরক্ষণেই তাদের মাঝে ও আমার মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি হয়ে যাবে। বুখারী : ৭/২৬৪ ও মুসলিম : ২২৯০

 

কারা এই পানি পান করতে পারবে নাঃ

আসমা বিনতে আবি বকর (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

إِنِّي عَلَى الْحَوْضِ حَتَّى أَنْظُرَ مَنْ يَرِدُ عَلَيَّ مِنْكُمْ وَسَيُؤْخَذُ نَاسٌ دُونِي فَأَقُولُ يَا رَبِّ مِنِّي وَمِنْ أُمَّتِي فَيُقَالُ هَلْ شَعَرْتَ مَا عَمِلُوا بَعْدَكَ وَاللَّهِ مَا بَرِحُوا يَرْجِعُونَ عَلَى أَعْقَابِهِمْ فَكَانَ ابْنُ أَبِي مُلَيْكَةَ يَقُولُ اللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ أَنْ نَرْجِعَ عَلَى أَعْقَابِنَا أَوْ نُفْتَنَ عَنْ دِينِنَا. (متفق عليه)

অর্থঃ আমি হাউজে কাউছারের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখব তোমাদের থেকে কারা কারা আসছে। কিন্তু একদল লোককে আমার কাছে আসতে দেয়া হচ্ছে না, তখন আমি বলবঃ হে রব! তারা আমার দলের, তারা আমার উম্মত। তখন বলা হবেঃ আপনি কি জানেন তারা আপনার পর কোন নতুন জিনিস এর উপর আমল করেছে? আল্লাহর কসম! তারা আপনার দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এজন্যে ইবনু আবি মুলাইকা রহ. দুআ করতেন, হে আল্লাহ! পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া ও দ্বীনের মাঝে ফিতনা সৃষ্টি করা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। বুখারী : ৬৫৯৩ ও মুসলিম : ২২৯৩

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত(বিচার কার্য শুরু করার জন্য)

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন ‘সায়্যিদুশ শুফা‘আ’ বা শাফা‘আতকারীদের সর্দার হবেন। এ সত্ত্বেও তাঁর পক্ষেও আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো জন্য শাফা‘আত করা সম্ভব হবে না। যতক্ষণ না তাকে বলা হবে, সুপারিশ করার জন্য। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন:

«آتي تَحْتَ الْعَرْشِِ فَأَخِرُّ سَاجِدًا … ثُمَّ يُقَالُ»

“আমি ‘আরশের নিচে আসব আর সাজদায় লুটিয়ে পড়ব, তারপর বলা হবে:

«إرْفَعْ رَأسَكَ, قُلْ تُسْمَعْ, وَسَلْ تُعْطَ, وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ»

“হে মুহাম্মাদ! তোমার মাথা উঠাও, বল, শোনা হবে। প্রার্থনা কর, তোমাকে দেওয়া হবে। সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে”।

লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহ জাল্লা শানুহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শাফা‘আতের অনুমতি দিয়েছেন এবং এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার

শাফা‘আত মঞ্জুর করা হবে। অর্থাৎ ক্ষমাকারী বা উদ্ধারকারী হিসেবে আল্লাহই সার্বভৌম কর্তৃত্ববান।

কিয়ামতের দিন মহানবী নিজেই আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে বলবেন:

«يَارَبِّ وَعَدْتَّنِيْ الشَّفَاعَةَ فَشَفِّعْنِي فِي خَلْقِكَ»

“হে আমার রব! আপনি আমাকে শাফা‘আতের ওয়াদা দিয়েছিলেন। অতএব, আমাকে আপনার সৃষ্টির জন্য সুপারিশকারী বনিয়ে দিন”। শরহু আকীদাতিত তাহাবিয়া, পৃ. ২২৬।

তখন তাঁকে সুপারিশকারী বানিয়ে দেওয়া হবে

কিয়ামতের পর জান্নাতকে ঈমানদারদের নিকটে নিয়ে আসা হবে।

আর জান্নাতকে মুত্তাকীদের অদূরে কাছেই আনা হবে। (সূরা কাফ, আয়াত ৩১)

তিনি আরো বলেন:

وَإِذَا الْجَنَّةُ أُزْلِفَتْ

আর যখন জান্নাতকে নিকটকর্তী করা হবে। (সূরা আত তাকবীর, আয়াত ১৩)

তারা তাতে প্রবেশ করার জন্য অস্থির হয়ে যাবে। অপরদিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিচার, হিসাব নিকাশে দেরী করবেন। তখন মানুষেরা নবী ও রাসূলদের কাছে যাবে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার জন্য। তখন প্রত্যেক নবীই বলবে, আমি আমার জন্য চিন্তিত তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও।

 

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহুআনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একদিন বকরীর ডানার গোশত পরিবেশন করা হলো। তিনি এটা পছন্দ করতেন। তিনি এটি দাতের কিনারা দিয়ে চিবাতে লাগলেন। তখন তিনি বললেন, কিয়ামতের দিন আমি হব সকল মানুষের নেতা। তোমরা কি জান এটা কীভাবে হবে? কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আমার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষকে একত্র করবেন একটি প্রান্তরে। তারা সকলকে শুনবে ও দেখবে। সূর্য মানুষের নিকটবর্তী হবে। মানুষেরা এমন দুঃচিন্তা অস্থিরতায় বন্দি হবে, যা তারা সহ্য করতে পারবে না আবার এর থেকে বাঁচতেও পারবে না। তখন মানুষেরা একে অপরকে বলবে, দেখছো আমরা কি দুরবস্থায় পতিত হয়েছি? আমাদের জন্য আমাদের প্রতিপালকের কাছে কে সুপারিশ করবে আমরা কি সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করবো না? চলো আমরা আদম আলাইহিস সালামের কাছে যাই। তারা আদম আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, হে আদম! আপনি মানুষের পিতা। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজে আপনার মধ্যে আত্মা ফুকে দিয়েছেন। তিনি আপনাকে সাজদাহ করার জন্য ফিরিশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্য আমাদের প্রতিপালকের কাছে শুপরিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি দুরাবস্থায় আছি? আপনি কি দেখছেন না আমরা কি বিপদে পতিত হয়েছি? আদম আলাইহিস সালাম বলবেন, আমার প্রতিপালক আজ এমন রাগ করেছেন যা পূর্বে কখনো করেন নি। এরপরেও এ রকম রাগ করবেন না। তিনি তো আমাকে সেই গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু আমি তা অমান্য করেছি। তোমরা অন্যের কাছে যাও। নূহের কাছে যাও। তারা নূহ আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে হে নূহ! আপনি পৃথিবীতে প্রথম রাসূল। আল্লাহ আপনাকে কৃতজ্ঞ বান্দা বলে অভিহিত করেছেন। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি বিপদে পড়েছি? তিনি বলবেন, আমার প্রতিপালক আজ এমন রাগ করেছেন যা পূর্বে কখনো করেন নি। এরপরেও এ রকম রাগ করবেন না। আমি আমার জাতির বিরুদ্ধে দো‘আ করেছিলাম। আমি আমার চিন্তা করছি। তোমরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে আসবে। তারা বলবে, আপনি আল্লাহর নবী ও পৃথিবী বাসীর মধ্যে তার খলীল (বন্ধু)। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি বিপদে পড়েছি? তিনি বলবেন, আমার রব আজ এমন রাগ করেছেন যা পূর্বে কখনো করেন নি। এরপরেও এ রকম রাগ করবেন না। আমি কিছু মিথ্যা বলেছিলাম। তাই আমি আমার চিন্তা করছি। তোমরা অন্যের কাছে যাও। তোমরা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তারা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, হে মূছা আপনি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল। আল্লাহ আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে ধন্য করেছেন। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি বিপদে পড়েছি? তিনি বলবেন, আমার রব আজ এমন রাগ করেছেন যা পূর্বে কখনো করেন নি। এরপরেও এ রকম রাগ করবেন না। আমি একজন মানুষকে হত্যা করেছিলাম। অথচ আমি এ ব্যাপারে আদিষ্ট ছিলাম না। এখন আমার চিন্তা আমি করছি। তোমরা ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তারা ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে হে ঈসা! আপনি আল্লাহর রাসূল, আপনি দোলনাতে থাকাকালেই মানুষের সাথে কথা বলেছেন। আপনাকে আল্লাহর বাক্য ও তার পক্ষ থেকে রূহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যা মারইয়ামের কাছে পাঠানো হয়েছে। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি বিপদে পড়েছি? তিনি বলবেন, আমার প্রতিপালক আজ এমন রাগ করেছেন যা পূর্বে কখনো করেন নি। আমার চিন্তা আমি করছি। তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও। তারা আমার কাছে এসে বলবে, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি আল্লাহ রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ তা‘আলা আপনার পূর্বের ও পরের সকল পাপ ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি বিপদে পড়েছি? আমি চলে আসবো তখন ‘আরশের নিচে। আর আমার রবের জন্য সাজদাহ করবো। তখন আল্লাহ আমার জন্য তার রহমত উম্মুক্ত করবেন। আমাকের এমন প্রশংসা ও গুণাগুণ বর্ণনার বাণী অন্তরে গেথে দিবেন যা আমার পূর্বে কাউকে দেওয়া হয় নি। অতঃপর আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! তোমার মাথা উঠাও। তুমি প্রার্থনা করো, তোমার প্রার্থনা কবুল করা হবে। তুমি সুপারিশ করো তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে। তখন আমি বলবো, হে রব! আমার উম্মত নিয়ে আমি চিন্তিত! আমার উম্মত নিয়ে আমি চিন্তিত! আমার উম্মত নিয়ে আমি চিন্তিত!! তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মতদের জান্নাতে প্রবেশ করাও। তবে তাদেরকে যাদের কোনো হিসাব-নিকাশ হবে না। তাদের জান্নাতের ডান পাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করাও। অবশ্য অন্যসব দরজা দিয়েও তারা প্রবেশ করতে পারবে। যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তার শপথ, জান্নাতের গেটের দু পাটের মধ্যে প্রশস্ততা হবে মক্কা ও বসরার মধ্যে দূরত্বের সমান”।  সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৭১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৪।

উম্মতের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসার কথা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন,

‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল এসেছেন, যিনি তোমাদের বিপন্নে কষ্ট পান, তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২৮)

উম্মতের অনাগতদের প্রতি রাসুল (সা.)-এর ছিল তীব্র ভালোবাসা। কেননা তারা না দেখেই রাসুলের জন্য সাক্ষ্য দেবে। তাই তাদের দেখার বাসনা ছিল তাঁর। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছা করছে।’ সাহাবিরা বলল, আমরা কি আপনার ভাই নই? রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা তো আমার সাহাবি তথা সঙ্গী। আমার ভাই হলো, যারা আমার ওপর ঈমান আনবে; কিন্তু আমাকে দেখবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৭১৮)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সব নবীর এমন কিছু দোয়া আছে, যা আল্লাহর কাছে কবুল হয়। সব নবী দ্রুত নিজেদের জন্য দোয়া করেছে। আমি তা কিয়ামতের দিন উম্মতের সুপারিশের জন্য গোপন করে রেখেছি। আমার উম্মতের মধ্যে যে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে ইনশাআল্লাহ আমার সুপারিশ লাভ করবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯৯)

****আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইবরাহিম (আ.)-এর কথা তিলাওয়াত করলেন, ‘হে আমার রব, তারা অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে, তাই যারা আমার অনুসরণ করবে তারা আমার দলভুক্ত, আর যারা আমার অবাধ্য হবে (তাদের ব্যাপারে) আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩৬ )

আর ঈসা (আ.) বলেছেন, আপনি তাদের আজাব দিলে তারা আপনার বান্দা, আর ক্ষমা করলে আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১১৮)

অতঃপর রাসুল (সা.) দুই হাত তুলে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!’ আল্লাহ তাআলা বললেন, ‘হে জিবরাইল, মুহাম্মদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আপনি কাঁদছেন কেন?’ মহান আল্লাহ সব কিছুই অবগত আছেন। জিবরাইল (আ.) এসে জিজ্ঞেস করল। রাসুল (সা.) তাকে নিজের কথা বললেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে জিবরাইল, তুমি মুহাম্মদের কাছে গিয়ে বলো, আমি শিগগির আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব এবং আমি আপনাকে কষ্ট দেব না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০২)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার ও মানুষের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালিয়েছে। আগুন চারপাশ আলোকিত করলে কীট-পতঙ্গ এসে ভিড় জমাতে থাকে। পতঙ্গগুলো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর ওই লোক তাদের সেখান থেকে তুলে ছুড়ে ফেলে। আবার তারা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করেন। আমি তোমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাধা দিই। আর মানুষ সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৮৩)

 

মহান অধিপতি আহকামুল হাকিমীন রবের আগমনঃ আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “ইয়াহুদি আলিমদের থেকে এক আলিম রাসূলুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে বললো, ‘হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে) পাই যে, আল্লাহ তা’আলা আকাশসমূহকে এক আঙুলের উপর স্থাপন করবেন। জমিনকে এক আঙুলের উপর, বৃক্ষসমূহকে এক আঙুলের উপর, পানি এক আঙুলের উপর, মাটি এক আঙুলের উপর এবং অন্যান্য সৃষ্টিজগত এক আঙুলের উপর স্থাপন করবেন। তারপর বলবেন, আমিই বাদশাহ।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তা সমর্থনে হেসে ফেললেন, এমনকি তাঁর সামনের দাঁত প্রকাশ হয়ে পড়ে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাঠ করলেন, ‘তারা আল্লাহ্‌র যথার্থ মর্যাদা নিরুপণ করতে পারেনি।’” [বুখারী, ৪৮৫৯]

“তারা আল্লাহ্‌র যথার্থ মর্যাদা নিরুপণ করতে পারেনি। কিয়ামতের দিন সমগ্র পৃথিবী তাঁর হাতের মুঠোতে থাকবে, আর আকাশমণ্ডলী থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে। মাহাত্ম্য তাঁরই, তারা যাদেরকে তাঁর শরিক করে, তিনি তার বহু উর্ধ্বে।” [সূরা যুমার (৩৯): ৬৭]

“সেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে ও বিক্ষিপ্ত হবে। এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আট জন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের উর্ধ্বে বহন করবে।” [সূরা আল-হাক্বক্বাহ: ১৬-১৭]

“তারা কি সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে যে, মেঘের আড়ালে তাদের সামনে আসবেন আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ? আর তাতেই সব মীমাংসা হয়ে যাবে? বস্তুতঃ সব কার্যকলাপই আল্লাহর নিকট গিয়ে পৌঁছবে।” [সূরা বাক্বারাহ : ২১০]

উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসিরে  উল্লেখ করা হয়েছে:  ইমাম ইবনে জারীর (রহ) এখানে একটি দীর্ঘ হাদীস এনেছেন যার মধ্যে শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এর বর্ণনাকারী হচ্ছেন আবু হুরাইরা (রাঃ)। মুসনাদ ইত্যাদির মধ্যে এই হাদীসটি রয়েছে। এর মধ্যে বর্ণিত আছে যে, মানুষ যখন ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন তারা নবীদের (আঃ) নিকট সুপারিশের প্রার্থনা জানাবে। আদম (আঃ) থেকে নিয়ে এক একজন নবীর কাছে তারা যাবে এবং প্রত্যেকের কাছে পরিষ্কার জবাব পেয়ে ফিরে আসবে। অবশেষে তারা আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছবে। তিনি উত্তর দেবেন, ‘আমি প্রস্তুত আছি। আমিই তার অধিকারী।’ অতঃপর তিনি যাবেন এবং আরশের নিচে সিজদায় পড়ে যাবেন। তিনি আল্লাহ তা’আলার নিকট সুপারিশ করবেন যে, তিনি যেন বান্দাদের ফায়সালার জন্য আগমন করেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সুপারিশ কবুল করবেন এবং মেঘমালার ছত্রতলে সমাগত হবেন। দুনিয়ার আকাশও ফেটে যাবে এবং তাঁর সমস্ত ফেরেশতা এসে যাবে। দ্বিতীয় আকাশও ফেটে যাবে এবং তাঁর সমস্ত ফেরেশতা এসে যাবে। এভাবে সাতটি আকাশই ফেটে যাবে এবং সেগুলোর সমস্ত ফেরেশতা এসে যাবে। এরপর আল্লাহর আরশ নেমে আসবে এবং সম্মানিত ফেরেশতাগণ অবতরণ করবেন এবং স্বয়ং মহাশক্তিশালী আল্লাহ আগমন করবেন। সমস্ত ফেরেশতা তাসবীহ পাঠে লিপ্ত হয়ে পড়বেন।

আবু সাইয়ীদ আল-খুদরী (রাঃ) বলেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, “আমাদের প্রতিপালক (আল্লাহ্‌) কিয়ামতের দিনে তাঁর হাঁটুর নিম্নাংশ প্রকাশ করে দেবেন, প্রত্যেক মুমিন, মুমিনা তাতে সিজদা করবেন এবং যে ব্যক্তি দুনিয়াতে লোক দেখানো ও সম্মানের জন্য তা করতো, সে সাজদা করতে গেলে তার পিঠ সমান হয়ে ফিরে আসবে।” [বুখারী, ৪৯৬৮]

আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে কতিপয় সাহাবী তাঁকে বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামত দিবসে আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবো?” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “হ্যাঁ।” তিনি আরো বললেন, “দুপুরে মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য অবলোকন করতে কি তোমাদের ধাক্কাধাক্কির সৃষ্টি হয়?” সকলে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! না, তা হয় না।” নাবী (সাঃ) বললেন, “ঠিক তদ্রুপ কিয়ামত দিবসে তোমাদের প্রতিপালককে অবলোকন করতে কোনোই বাধার সৃষ্টি হবে না। সেদিন এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিবে, ‘যে যার উপাসনা করতে, সে আজ তার অনুসরণ করুক।’ তখন আল্লাহ ব্যতীত যারা অন্য দেব-দেবী ও বেদীর উপাসনা করতো, তাদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না; সকলেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। সৎ হোক বা অসৎ, যারা আল্লাহর ইবাদাত করতো, তারাই কেবল অবশিষ্ট থাকবে এবং কিতাবীদের যারা দেব-দেবী ও বেদীর উপাসক ছিলো না, তারাও বাকি থাকবে। এরপর ইহুদীদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘তোমরা কার ইবাদাত করতে?’ তারা বলবে, ‘আল্লাহর পুত্র উযায়েরের।’ তাদেরকে বলা হবে, ‘মিথ্যা বলছো। আল্লাহ কোনো পত্নী বা সন্তান গ্রহণ করেননি। তোমরা কী চাও?’ তারা বলবে, ‘হে আল্লাহ! আমাদের খুবই পিপাসা পেয়েছে। আমাদের পিপাসা নিবারণ রুকন।’ প্রার্থনা শুনে তাদেরকে ইঙ্গিত করে মরীচিকাময় জাহান্নামের দিকে জমায়েত করা হবে। এর একাংশ আরেক অংশকে গ্রাস করতে থাকবে। তারা এতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরপর খ্রীষ্টানদেরকে ডাকা হবে। বলা হবে, ‘তোমরা কার ইবাদাত করতে?’ তারা বলবে, ‘আল্লাহর পুত্র মসীহের উপাসনা করতাম।’ বলা হবে, ‘মিথ্যা বলছো। আল্লাহ কোনো পত্নী বা সন্তান গ্রহণ করেননি।’ জিজ্ঞেস করা হরে, ‘এখন কী চাও?’ তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের দারুণ তৃষ্ণা পেয়েছে, আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করুন।’ তখন তাদেরকেও পানির ঘাটে যাবার ইঙ্গিত করে জাহান্নামের দিকে জমায়েত করা হবে। একে মরীচিকার মতো মনে হবে। এর এক অংশ অপর অংশকে গ্রাস করে নিবে। তারা তখন জাহান্নামে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকবে।

শেষে মুমিন হউক বা গোনাহগার, এক আল্লাহর উপাসক ব্যতীত আর কেউ (ময়দানে) অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আল্লাহ তাদের কাছে আসবেন। বলবেন, ‘সবাই তাদের স্ব স্ব উপাস্যের অনুসরণ করে চলে গেছে, আর তোমরা কার অপেক্ষা করছো?’ তারা বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! যেখানে আমরা বেশি মুখাপেক্ষী ছিলাম, সেই দুনিয়াতে আমরা অপরাপর মানুষ থেকে পৃথক থেকেছি এবং তাদের সঙ্গী হইনি।’ তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমিই তো তোমাদের প্রভু।’

মুমিনরা বলবে, ‘আমরা তোমার থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহর সঙ্গে আমরা কিছুই শরীক করি না।’ এই কথা তারা দুই বা তিনবার বলবে। এমন কি কেউ কেউ অবাধ্যতা প্রদর্শনেও অবতীর্ণ হয়ে যাবে।

আল্লাহ বলবেন, ‘আচ্ছা, তোমাদের কাছে এমন কোনো নিদর্শন আছে যা দ্বারা তাঁকে তোমরা চিনতে পারো?’ তারা বলবে, ‘অবশ্যই আছে।’ এরপর ‘সাক’ (পায়ের গোছা)  উন্মোচিত হবে। তখন পৃথিবীতে যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করতো, তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা সিজদা করার অনুমতি দিবেন। আর যারা লোক দেখানো বা লোকভয়ে আল্লাহকে সিজদা করতো, সে মুহূর্তে তাদের মেরুদন্ড শক্ত ও অনমনীয় করে দেওয়া হবে। যখনই তারা সিজদা করতে ইচ্ছা করবে, তখনই তারা চিত হয়ে পড়ে যাবে। তারপর তারা মাথা তুলবে। ইত্যবসরে তারা আল্লাহকে প্রথমে যে আকৃতিতে দেখেছিলো তাতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে (তিনি তাঁর আসল রুপে আবির্তূত হবেন)। অনন্তর বলবেন, ‘আমি তোমাদের রব। তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, আপনি আমাদের প্রতিপালক। [মুসলিম, ১৮৩]

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীসমূহ মুষ্ঠিবদ্ধ করা

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা এরপর আকাশসমূহকে ডান হাতে আর পৃথিবীগুলোকে অন্য হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করবেন। অতঃপর বলবেন, কোথায় শক্তিধর স্বৈরাচারীরা? কোথায় অহংকারীরা?

আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন,

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٧﴾ [الزمر: ٦٦]

“আর তারা আল্লাহ-কে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তাঁর মুষ্ঠিতে এবং আকাশসমূহ তাঁর ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। তিনি পবিত্র, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের ঊর্ধ্বে”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৭]

﴿يَوۡمَ نَطۡوِي ٱلسَّمَآءَ كَطَيِّ ٱلسِّجِلِّ لِلۡكُتُبِۚ كَمَا بَدَأۡنَآ أَوَّلَ خَلۡقٖ نُّعِيدُهُۥۚ وَعۡدًا عَلَيۡنَآۚ إِنَّا كُنَّا فَٰعِلِينَ ١٠٤﴾ [الانبياء: ١٠٤]

“সে দিন আমরা আসমানসমূহকে গুটিয়ে নেব, যেভাবে গুটিয়ে রাখা হয় লিখিত দলীল-পত্রাদি। যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবেই পুনরায় সৃষ্টি করব। ওয়াদা পালন করা আমার কর্তব্য। নিশ্চয় আমি তা পালন করব”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৪]

হাদীসে এসেছে: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

 

«يَقْبِضُ اللَّهُ الأَرْضَ، وَيَطْوِي السَّمَوَاتِ بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا المَلِكُ، أَيْنَ مُلُوكُ الأَرْضِ »

“আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী মুষ্ঠিবদ্ধ করবেন আর আকাশকে নিজ ডান হাতে ভাজ করে ধরবেন অতঃপর বলবেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় আজ পৃথিবীর রাজা-বাদশাগণ?” সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৮৭।

আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«يَطْوِي اللهُ عَزَّ وَجَلَّ السَّمَاوَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُهُنَّ بِيَدِهِ الْيُمْنَى، ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا الْمَلِكُ، أَيْنَ الْجَبَّارُونَ؟ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ. ثُمَّ يَطْوِي الْأَرَضِينَ بِشِمَالِهِ، ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ الْجَبَّارُونَ؟ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ؟ »

“কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আকাশসমূহকে ভাঁজ করে ফেলবেন। অতঃপর তা ডান হাতে ধারণ করবেন আর বলবেন, আমি বাদশা। কোথায় আজ স্বৈরাচরীরা? কোথায় আজ অহংকারীরা? এরপর পৃথিবীগুলোকে বাম হাতে ভাঁজ করে ধরবেন। অতঃপর বলবেন, কোথায় আজ স্বৈরাচরীরা? কোথায় আজ অহংকারীরা?” সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৮৮।

একদা আয়েশা (রাঃ)  জিজ্ঞাসা করলেন, যখন এই আকাশ ও পৃথিবী পরিবর্তন হবে, তখন সেই দিন লোকেরা কোথায় অবস্থান করবে? উত্তরে নবী (সাঃ) বললেন, পুল সিরাতের উপর। (সাবেক উদ্ধৃতি) এক ইহুদীর প্রশ্নের উত্তরে নবী (সাঃ) বলেছিলেন, ‘‘সেই দিন লোকেরা পুলের নিকট অন্ধকারে অবস্থান করবে। (মুসলিম ৩১৫, কিতাবুল হায়য)

মহান রব কথা বলবেন—

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের প্রতিটি মানুষের সাথে আল্লাহ তা’য়ালা কোন মাধ্যম ছাড়াই কথা বলবেন, (অর্থাৎ হিসাব নেবেন) সেখানে আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে কোন উকিল বা দো-ভাষী থাকবে না। আর তাকে লুকিয়ে রাখার কোন আড়াল থাকবে না। সে যখন ডান দিকে তাকাবে তখন নিজের কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। আবার যখন বাম দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে সেদিকেও নিজের কর্মসমূহ ছাড়া আর কিছুই দেখবেনা। যখন সামনের দিকে তাকাবে তখন জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই দেখবেনা। অতএব অবস্থা যখন এই তখন তোমরা একটি খেজুরের অর্ধেক দিয়ে হলেও জাহান্নামের আগুন হতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করো। (বোখারী, মুসলিম)

 

জাহান্নামকে আনা হবেঃ

আমলনামা দেখানোর আগেই জাহান্নামকে আনার শব্দ শুনা যাবে যা ভয়াবহ। কঠিন অবস্থা। মুসা আ যিনি হাটু গেড়ে আল্লাহর আরশ খুঁটি ধরে আছেন তিনিও বলে উঠবেন- হে আল্লাহ শান্তি দাও।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

كَلَّا إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكًّا دَكًّا ﴿21﴾ وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا ﴿22﴾ وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى ﴿23﴾ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي ﴿24﴾

কখনো নয়, যখন পৃথিবীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে পরিপূর্ণভাবে। আর তোমার রব ও ফেরেশতাগণ উপস্থিত হবেন সারিবদ্ধভাবে। আর সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু সেই স্মরণ তার কী উপকারে আসবে? সে বলবে, হায়! যদি আমি কিছু আগে পাঠাতাম আমার এ জীবনের জন্য!’(সূরা আল ফাজর, আয়াত ২১-২৪)

আর সেদিন আমরা জাহান্নামকে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত করব কাফেরদের কাছে, কাহফঃ ১০০

জাহান্নামকে টেনে আনা হবে

জাহান্নাম এত বিশাল হবে যে, হাশরের মাঠে তাকে টেনে আনতে বিপুল পরিমাণ ফেরেশতার প্রয়োজন হবে। হাজার হাজার ফেরেশতা টেনে টেনে জাহান্নামকে হাশরের মাঠে উপস্থিত করবেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সেদিন হাশরের মাঠে জাহান্নামকে এমন অবস্থায় নিয়ে আসা হবে যে, তার সত্তরটি শেকল থাকবে। প্রত্যেকটি শেকলে সত্তর হাজার করে ফেরেশতা থাকবেন। তারা শেকল ধরে টেনে টেনে তাকে উপস্থিত করবেন।’(মুসলিম : ৭৩৪৩; ২৮৪২)

জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আওয়াজঃ

হাশরের মাঠে জাহান্নাম প্রচণ্ড আওয়াজে হুঙ্কার দিতে থাকবে আর ফনা তুলে মানুষের ওপর দিয়ে ঘুরাতে থাকবে। বিশেষত অপরাধী ও পাপাচারীদের সে খুঁজতে থাকবে। হযরত আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন যখন সব মানবজাতিকে একই সমতল জমিনে (হাশরের মাঠে) সমবেত করা হবে, তখন সেখানে জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে। জাহান্নামের আগুনের লেলিহান শিখাসমূহের একটি আরেকটির ওপর উঠে যেতে থাকবে এবং ভেতরের উত্তপ্ত লাভা উদ্গীরিত হয়ে অন্য অংশকে গর্ভে চালান করে দিতে থাকবে। আর বলতে থাকবে আমার রবের পরাক্রমের কসম! আমার আর আমার সঙ্গীর মাঝখানে এমন কিছু মানুষ বাঁধা হয়ে আছে, যাদের একেকটা করে গর্দান আমি চাই। হাশরের মাঠের সবাই তখন জিজ্ঞাসা করবে, কে তোমার সঙ্গী? জাহান্নাম বলবে, (পৃথিবীতে থাকা অবস্থায়) প্রত্যেক অহঙ্কারী ও ক্ষমতার বাহাদুরেরা!’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা : ২/১১৪৫)

মানুষের মতো কথা বলবে জাহান্নাম

জাহান্নামকে সেদিন মানুষের মতোই কথা বলার শক্তি দেওয়া হবে। এ সম্পর্কে হাদিসে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন হাশরবাসী সবার ওপর জাহান্নামের দীর্ঘ ও লম্বা ঘাড় বের হয়ে আসবে। তার দুটো চোখ থাকবে ঘূর্ণায়মান, দুটো শ্রবণেন্দ্রিয় থাকবে যা দিয়ে সব শুনবে, জবান থাকবে যা দ্বারা সে সুস্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলবে। সেদিন জাহান্নাম বলতে থাকবে আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে ওই সব লোকদের ব্যাপারে যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য উপাসক হিসেবে গ্রহণ করেছিল, যারা অহঙ্কার ও প্রতাপ প্রদর্শন করেছিল, যারা অন্যকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল। (তিরমিজি: ২৫৭৪; মুসনাদে আহমাদ : ২/৩৩৬)।

আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেছেন, রাসুল (সা.)-এর বক্তব্য ‘জাহান্নাম সেদিন তার রবের কাছে অভিযোগ করবে’-এর ব্যাখ্যায় গবেষক আলেমগণ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা হাশরের মাঠে জাহান্নামকে উপস্থিত করবেন এবং প্রকৃত অর্থেই জাহান্নামের জবান খুলে দেবেন, কথা বলার সুযোগ করে দেবেন; যেমনিভাবে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেও কথা বলার সুযোগ করে দেবেন।’ (ফাতহুল বারি : ৩/৭০)

জান্নাত-জাহান্নামের স্বাদ আস্বাদন

জাহান্নামের ভয়বহতা ও জান্নাতের সুখময়তা কেমন হবে তা হাশরবাসীকে চোখে দেখার সুযোগ দেওয়া হবে। একজন জাহান্নামী ও একজন জান্নাতিকে সামান্য সময়ের জন্য জাহান্নামে ও জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে স্বাদ চাখিয়ে পুনরায় হাশরের মাঠে ফিরিয়ে আনা হবে।

হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন হাশরের মাঠে এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, যে পৃথিবীর জীবন অনেক আরাম-আয়েশ ও প্রাচুর্যের সঙ্গে অতিবাহিত করেছে এবং জাহান্নামের ফয়সালা হয়েছে। তাকে কিছুক্ষণের জন্য জাহান্নামের দরজায় রেখে ফিরিয়ে আনা হবে। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, হে আদমের সন্তান! তুমি কি পৃথিবীর জীবনে কখনও ভালো অবস্থা দেখেছ? কখনও সুখ লাভ করেছ? সে আল্লাহর কসম করে বলবে, হে রব! না, কখনও না! আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এত কষ্ট ও বেদনা অনুপ্রবেশ করেছে যে, কোনো শান্তি-সুখের কথা আমার স্মরণেই আসছে না। অনুরূপভাবে আরেকজন ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, যে পৃথিবীর জীবন অনেক কষ্টে-ক্লেশে অতিবাহিত হয়েছে এবং জান্নাতের ফয়সালা হয়েছে। তাকে জান্নাতের দরজায় কিছুক্ষণের জন্য রেখে ফিরিয়ে আনা হবে। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, হে আদমের সন্তান! পৃথিবীতে তুমি কি কখনও কষ্ট দেখেছ? কখনও কষ্টকর সময় তোমার ওপর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে? সে আল্লাহর কসম করে বলবে, হে আমার রব! না, কখনও না! কখনও কোনো কষ্ট আমার পৃথিবীর জীবনে আসেনি, আমি কখনও কোনো কষ্ট দেখিনি। আমার শরীরে-হৃদয়ে এত সুখময়তা ছড়িয়ে পড়েছে যে, কোনো দুঃখ-দুর্দশার কথা আমার স্মরণেই আসছে না। (মুসলিম : ৭০৮৮)

কিয়ামতের দিন মানুষ ৭টি বিষয়ে আফসোস করবে——–

১। ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম; সেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে এবং অবিশ্বাসী বলবে, হায় আফসোস! যদি আমি মাটি হয়ে যেতাম।’ (সুরা নাবা : ৩০)।

২। ‘আর সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে; ওই দিন মানুষ স্মরণ করবে। কিন্তু সেই স্মরণ তা কী উপকারে আসবে? সে বলবে, হায়! আমি যদি আগে আমার এ জীবনের জন্য কিছু পাঠাতাম! সেদিন আল্লাহর আজাবের মতো আজাব কেউ দিতে পারবে না।’ (সুরা ফাজর, ২৩-২৪-২৫)।

৩। ‘কিন্তু যার আমলনামা তার বাম হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে, হায়! আমাকে যদি দেওয়াই না হতো আমার আমলনামা; আর আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়! আমার মৃত্যুই যদি আমার শেষ হতো! আমার ধন-সম্পদ আমার কোনো উপকারেই এলো না। (সুরা হাক্কা : ২৫-২৮)।

৪। ‘জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের দুহাত দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি রাসুলের সঙ্গে কোনো পথ অবলম্বন করতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে তো সে পথভ্রষ্ট করেছিল, আমার কাছে উপদেশ পৌঁছার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।’ (সুরা ফুরকান : ২৭-২৯)।

৫। ‘যেদিন তাদের মুখম-ল আগুনে উলটপালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম আর রাসুলকে মানতাম! তারা আরও বলবে, হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নেতা ও বড়লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল; হে আমাদের রব! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের বেশি করে অভিশম্পাত করুন।’ (সুরা আহজাব : ৬৬-৬৮)।

৬। জান্নাতিদের দেখে জাহান্নামিরা আফসোস করে বলবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকলে তাদের মতো ঈমান ও আমল করলে তো আজকে আমরাও তাদের মতো সফল হতাম। জাহান্নামে যেতে হতো না। এরশাদ হচ্ছে : ‘আর যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ হয়, তাহলে সে অবশ্যই বলবে, হায়! যদি আমি তাদের সঙ্গে থাকতাম, তাহলে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম।’ (সুরা নিসা : ৭৩)।

৭। ‘তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদের দোজখের পাশে দাঁড় করানো হবে এবং তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন ঘটত, তাহলে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে মিথ্যা বলতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। (সুরা আনআম : ২৭)।

 

তারাই সেসব লোক, যারা তাদের রব-এর নিদর্শনাবলী ও তার সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যাপারে কুফরি করেছে। ফলে তাদের সকল আমল নিস্ফল হয়ে গেছে; সুতরাং আমরা তাদের জন্য কেয়ামতের দিন কোন ওজনের ব্যবস্থা রাখব না। কাহফঃ১০৫

আর যেদিন আমি তাদের সকলকে একত্র করব, অতঃপর যারা শির্‌ক করেছে, তাদেরকে বলব, থাম, তোমরা ও তোমাদের শরীকরা। অতঃপর আমি তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাব। আর তাদের শরীকরা বলবে, তোমরা তো আমাদের ইবাদাত করতে না। (সূরা ইউনূস, আয়াত ২৮)

যখন অনুসরনীয় ব্যক্তিরা অনুসারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে এবং তারা আযাব দেখতে পাবে। আর তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। আর যারা অনুসরণ করেছে, তারা বলবে, যদি আমাদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ হত, তাহলে আমরা তাদের থেকে আলাদা হয়ে যেতাম, যেভাবে তারা আলাদা হয়ে গিয়েছে। এভাবে আল্লাহ তাদেরকে তাদের আমলসমূহ দেখাবেন তাদের আক্ষেপের জন্য, আর তারা আগুন থেকে বের হতে পারবে না। (সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৬৬-১৬৭)

আর তুমি যদি দেখতে যালিমদেরকে, যখন তাদের রবের কাছে দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে তখন তারা পরস্পর বাদানুবাদ করতে থাকবে। যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তারা অহঙ্কারীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে অবশ্যই আমরা মুমিন হতাম। যারা অহঙ্কারী ছিল তারা, তাদেরকে বলবে, যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, তোমাদের কাছে হেদায়েত আসার পর আমরা কি তোমাদেরকে তা থেকে বাধা দিয়েছিলাম? বরং তোমরাই ছিলে অপরাধী। আর যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তারা, যারা অহঙ্কারী ছিল তাদেরকে বলবে, বরং এ ছিল তোমাদের দিন-রাতের চক্রান্ত, যখন তোমরা আমাদেরকে আদেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অস্বীকার করি এবং তাঁর সমকক্ষ স্থির করি। আর তারা যখন আযাব দেখবে তখন তারা অনুতাপ গোপন করবে। আর আমি কাফিরদের গলায় শৃঙ্খল পরিয়ে দিব। তারা যা করত কেবল তারই প্রতিফল তাদেরকে দেয়া হবে। (সূরা সাবা, আয়াত ৩১-৩৩)

power point presentation

৫।মৃত ব্যক্তি ও আমরা-৫ম পর্ব