আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
প্রশ্ন: আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম দিয়ে কোন মানুষ কে সম্বোধন করলে শিরক হবে কি?
উত্তর:
জানা প্রয়োজন যে, আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম গুলো দু প্রকার। এগুলোর মধ্যে কিছু নাম কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট পক্ষান্তরে কিছু গুণবাচক নাম আছে যেগুলো বান্দার জন্যও প্রযোজ্য।
নিম্নে উভয় প্রকার নামের কতিপয় উদাহরণ পেশ করা হল।
♻ যে সকল গুণবাচক নাম কেবল আল্লাহ তাআলার শানেই প্রযোজ্য। এ সকল নাম দ্বারা বান্দার নাম করণ করা বৈধ নয়। যেমন:
১) আল্লাহ (মাবুদ বা উপাস্য)
২) আল ইলাহ (উপাস্য)
৩) আর রহমান (পরম করুণাময়),
৪) আল খালিক (স্রষ্টা/সৃষ্টিকর্তা)
৫) আল বারী (উদ্ভাবক/স্রষ্টা )
৬) আল-কুদ্দুস (মহা পবিত্র)।
৭) আল আওয়াল (সর্ব প্রথম)
৮) আল আখির (সর্ব শেষ)
৯) আল মুহয়ী (জীবন দাতা)
১০) আল মুমীত (মৃত্যু দাতা)
১১) আল আহাদ (একক ও অদ্বিতীয়)
১২) আস সামাদ (মুখাপেক্ষী হীন বা স্বয়ং সম্পন্ন)
১৩) রাযযাক (রিজিক বা জীবিকা দান কারী)
১৪) আল্লামুল গুয়ুব (অদৃশ্য বিষয়ে সম্যক অবগত)
এ নামগুলো কেবল মহান আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। তাই এ সকল নাম দ্বারা কোন ব্যক্তির নাম রাখা বা কাউকে ডাকা বৈধ নয়। সুতরাং কোন মানুষকে কেবল রহমান, রাযযাক, খালেক, কুদ্দূস ইত্যাদি বলে ডাকা হারাম। বরং এ শব্দগুলো দ্বারা মানুষের নাম রাখা বা নাম ধরে ডাকার ক্ষেত্রে এগুলোর শুরুতে আব্দ (দাস বা গোলাম) শব্দ ব্যবহার করা আবশ্যক। যেমন আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান, আব্দুল কুদ্দুস, আব্দুল খালেক ইত্যাদি।
🔹 পক্ষান্তরে কিছু গুণবাচক নাম আছে যেগুলো নাম অথবা গুণ হিসেবে বান্দার জন্যও প্রযোজ্য।
নিম্নে এ জাতীয় কিছু নামের তালিকা প্রদান করা হল (দলীল সহকারে):
✪ ১) রউফ (মমতাময়ী)
✪ ২) রাহীম (দয়ালু)
কুরআনে আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রঊফ (স্নেহ ও মমতাময়ী) এবং রহিম (দয়ালু) শব্দ দ্বারা সম্বোধন করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
“তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।” (সূরা তওবা: ১২৮)
✪ ৩) হালীম (সহনশীল)
✪ ৪) রাশীদ (সঠিকপথ প্রাপ্ত বা সুবুদ্ধি সম্পন্ন)
আল্লাহ তাআলা নবী শুআইব আ. কে উদ্দেশ্য করে উক্ত দুটি গুণ বাচক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন আল্লাহ তআলা বলেন:
إِنَّكَ لَأَنتَ الْحَلِيمُ الرَّشِيدُ
“তুমি তো অত্যন্ত সহনশীল, সৎপথের পথিক।” (সূরা হুদ: ৮৭)
✪ ৫) ক্বাবী (শক্তিশালী)
আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামকে ক্বাবী বা শক্তিশালী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ
“কর্মচারী হিসেবে তাকেই নিয়োগ দেয়া উত্তম যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।” (সূরা কাসাস: ২৬)
✪ ৬) আল মালিক (রাজা/বাদশাহ)
আল্লাহ মিসরের শাসককে ‘রাজা/বাদশাহ’ বলেছেন। যেমন:
وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ
“আর বাদশাহ বলল: তাকে (ইউসুফ আ. কে) আমার কাছে নিয়ে এসো।” (সূরা ইউসুফ: ৫৪)
✪ ৭) আযীয (প্রতাপশালী বাদশাহ)
আল্লাহ তাআলা মিসরের শাসককে আযীয হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
قَالَتِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ
“আযীয-পত্মি বলল..:” (সূরা ইউসুফ: ৫১)
✪ ৮) হাফিয (রক্ষক)
✪ ৯) আলীম (অধিক জ্ঞানবান)
قَالَ اجْعَلْنِي عَلَىٰ خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ
“ইউসুফ বলল: আমাকে দেশের ধন-ভাণ্ডারে নিযুক্ত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান।”
✪ ১০) হাই (জীবিত)
আল্লাহ বলেন:
وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ
“আর তিনি জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন।” (সূরা আনআম: ৯৫)
✪ ১১) সামী’ (শ্রবণ শক্তি সম্পন্ন)
✪ ১২) বাসীর (দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন)
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে উদ্দেশ্য করে এই দুটি শব্দ উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا
“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্র বিন্দু থেকে, এভাবে যে, তাকে পরীক্ষা করব অতঃপর তাকে করে দিয়েছি শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তিসম্পন্ন।”সূরা দাহার/ইনসান ২য় আয়াত)
✪ ১৩) আলী (সুউচ্চ)। সাহাবী আলী বিন আবি তালিব রা.
✪ ১৪) হাকীম (জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান): সাহাবী হাকীম বিন হিযাম রা.
এই সকল নাম দ্বারা বান্দার নাম রাখা জায়েজ রয়েছে। শুরুতে আব্দ (দাস বা গোলাম) যুক্ত করা আবশ্যক নয় তবে উত্তম।সুতরাং কাউকে কেবল রহীম, করীম, আলী, হাকীম, হালীম, রশীদ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা নাম করণ করা হলেও তাতে কোন আপত্তি নেই। কোন আলেমই এগুলোকে শিরক বা কুফুর বলেন নি।
তবে আব্দুর রহিম, আব্দুল করিম, আব্দুল হালিম, আব্দুল হাকিম এভাবে বলাই অধিক উত্তম।
♻ তবে মনে রাখা আবশ্যক যে, উপরোক্ত নামগুলো নাম ও গুণ হিসেবে বান্দার ব্যাপারে প্রযোজ্য হলেও এই বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহর সিফাত বা গুণের সাথে বান্দার গুণের কোন তুলনা চলে না। আল্লাহর প্রতিটি গুণ অপার, অসীম, অবিনশ্বর ও তুলনা বিহীন। পক্ষান্তরে বান্দার গুণাবলী নিতান্তই দুর্বল, সীমিত ও ক্ষণস্থায়ী। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তার সৃষ্টি জগতের কোন কিছুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
ّকোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।” (সূরা শুরা: ১১)
আল্লাহু আলাম-আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী।
▬▬▬✪✪✪▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব
(হযরত মাওলানা মুফতী আবুল কাসেম নোমানী লেখা থেকে সংগৃহিত নিচের অংশটুকু)
আল্লাহর জন্য নির্ধারিত নাম অন্য কোনো লোকের জন্য ব্যবহার করা। তবে এখানে ব্যাখ্যা আছে। আসমায়ে হুসনার মধ্যে কিছু নাম এমন আছে, যেগুলো স্বয়ং কুরআন ও হাদীসে অন্যান্য লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। আর কিছু নাম রয়েছে, যেগুলো আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য ব্যবহার করা প্রমাণিত। সেসব নাম অন্যের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- রাহীম, রাশীদ, আলী, কারীম, আযীয প্রভৃতি।
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য যেসব নামের ব্যবহার কুরআন-হাদীসে প্রমাণিত নয় সেগুলো একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য ব্যবহার করাই ‘ইলহাদ ফী ইসমিল্লাহ’ তথা আল্লাহর নামে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত এবং নাজায়েয ও হারাম। যেমন-, রহমান, সুবহান, রাযযাক, খালেক, গাফফার, কুদ্দুস ইত্যাদি। এই নির্দিষ্ট নামগুলো যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে হয় যে, যাকে এসব শব্দের দ্বারা সম্বোধন করা হচ্ছে তাকেই যদি খালেক (সৃষ্টিকর্তা) কিংবা রাযযাক (রিযিকদাতা) মনে করা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ কুফর। আর যদি ভ্রান্তবিশ্বাসের বশীভূত না হয়ে শুধুমাত্র অসচেতনতা কিংবা না বোঝার দরুন কাউকে খালেক, রাযযাক, রহমান কিংবা সুবহান বলে ডাকে তাহলে তা কুফরী না হলেও শিরকসুলভ শব্দ হওয়ার কারণে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আফসোসের বিষয়, বর্তমানে অনেক মুসলিম এ গুনাহে লিপ্ত। কিছু কিছু লোক তো ইসলামী নাম রাখাও ছেড়ে দিয়েছে। আকার ও অবয়বে এবং স্বভাব ও চরিত্রে তাদেরকে মুসলমান বলে বোঝা এমনিতেই কঠিন ছিল। যাও নামের বদৌলতে চেনা যেত তাও ইংরেজি কায়দায় নাম রাখায় কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
আরো আফসোসের বিষয় হল, যাদের নাম আবদুর রহমান, আবদুর রাযযাক, আবদুল গাফফার, আবদুল কুদ্দুস প্রভৃতি রাখা হয়েছে বা হচ্ছে তাদের নামকে সংক্ষেপ করে বলা হচ্ছে- রহমান, রাযযাক, গাফফার, কুদ্দুস ইত্যাদি। এ সবই নাজায়েয, হারাম ও কবীরা গুনাহ। যতবার এগুলো উচ্চারণ করা হয় ততবারই কবীরা গুনাহ হয়। এবং শ্রোতাও পাপমুক্ত থাকে না। এ সমস্ত অহেতুক গুনাহে আজ অধিকাংশ মুসলমান লিপ্ত। অথচ চিন্তাও করছে না যে, এ সামান্য বিষয়টির পরিণতি কত ভয়াবহ।
পবিত্র কুরআনে সংখ্যা উল্লেখ করা ছাড়াই আসমায়ে হুসনার আলোচনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ لِلهِ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰی فَادْعُوْهُ بِهَا وَ ذَرُوا الَّذِیْنَ یُلْحِدُوْنَ فِیْۤ اَسْمَآىِٕهٖ سَیُجْزَوْنَ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْن.
আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। তোমরা এগুলোর মাধ্যমে তাঁকে ডাক এবং যারা তাঁর নামের মাঝে বক্রতা সৃষ্টি করে তাদেরকে পরিত্যাগ কর। তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দেয়া হবে। -সূরা আ‘রাফ (৭) : ১৮০
বাক্যের দ্বারা সতর্ক করা হয়েছে। এখানে শাস্তির বিষয়টি অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। যা কঠিন আযাবের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।” (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন ৪/১৩১)
বর্তমান সমাজে যে ভুলটা ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে তা হল, অনেকের নামের প্রথম অংশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র দ্বিতীয় অংশটি উচ্চারণ করা। যেমন আবদুর রহমান, হাবীবুর রহমান, মুজীবুর রহমান নামের প্রথম অংশ ফেলে দিয়ে শুধু রহমান বলে ডাকা এবং কোনো সংকোচ ছাড়াই মিস্টার রহমান বলে একে অন্যকে সম্বোধন করা। এমনিভাবে আবদুস সাত্তার, আবদুর রাযযাক ইত্যাদি নামের মধ্যে ‘আবদ’ শব্দটি ফেলে দিয়ে শুধু সাত্তার, জাব্বার, রাযযাক, কুদ্দুস, কাইউম বলে ডাকে।
একটু ভাবা দরকার, যদি আবদুল্লাহকে সংক্ষেপ করে আল্লাহ ডাকা না যায় তাহলে আবদুর রহমানকে কীভাবে রহমান ডাকা যাবে। অথচ আল্লাহ ও রাহমান উভয় নামই এমন, যা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা জায়েয নেই। এমনিভাবে রাযযাক, খালেক, কাইয়ূম, কুদ্দূস, গাফফার, মুহয়ী, মুমিত, রব, গফুর ইত্যাদি গুণবাচক নামও শুধু আল্লাহ তাআলার সাথেই বিশেষিত। আবদিয়্যাতের প্রকাশ ছাড়া এ নামগুলো সরাসরি অন্য কোনো বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বৈধ নয়। তাই এসকল নামের ক্ষেত্রে সবার সতর্কতা কাম্য।