দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
১ আল্লাহ اللَّـهُ উপাস্য, মাবুদ
ব্যাখ্যা: আল্লাহ শব্দের অর্থ মা’বুদ বা উপাস্য। তিনি সেই সত্বা যার কাছে সমগ্র সৃষ্টিলোক তাদের সকল অভাব-অনটন ও বিপদাপদে পরম ভালবাসা,ভয়ভীতি ও বিনম্র ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে ছুটে যায়।
এ নামের মধ্যেই তাঁর সকল সুন্দর নাম ও গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছে।
কুরআনে এ নামটি মোট ২৭২৪/ প্রায় ৩৫০০বার উল্লেখিত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, إِنَّنِي أَنَا اللَّـهُ لَا إِلـهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
“আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সলাত কায়েম কর।”(সূরা ত্বাহা:১৪)
সহজে সংক্ষেপে বলা যায়ঃ
- আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট আপনি সাহায্যের জন্য ছুটে আসেন।
- আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার জ্ঞান মানুষের মন মানসকে বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে ফেলে।
- আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার স্মরণে মানুষের মন প্রশান্তি লাভ করে।
- “আল্লাহ” হলেন এমন সত্তা যাঁর উপাসনা করা হয়।
- “আল্লাহ” শব্দটি দ্বারা এমন এক সত্তার কথা বোঝায় যিনি উপাসনা পাওয়ার যোগ্য।
وَمَا بِكُم مِّن نِّعۡمَةٖ فَمِنَ ٱللَّهِۖ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ ٱلضُّرُّ فَإِلَيۡهِ تَجَۡٔرُونَ٥٣﴾ [النحل: ٥٣]
“আর তোমাদের কাছ যে সব নি’আমত আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। অতঃপর দুঃখ-দুর্দশা যখন তোমাদের স্পর্শ করে তখন তোমরা শুধু তার কাছেই ফরিয়াদ কর।” [সূরা আন-নাহাল: ৫৩]শ
সৃষ্টিকর্তার প্রধান এবং সর্বাধিক পরিচিত নামটি হলো ‘আল্লাহ।’ আমাদের মালিক এবং সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে পরিচিত এবং কমন নাম হলো আল্লাহ
কুরআন শুরু করা হয়েছে এই নামটি দিয়ে। …. বিসমিল্লাহির রাহ মানির রাহিম। আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রাচীনতম যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় তাতে এমন এক ঈশ্বরের কথা উল্লেখ আছে যার উচ্চারণ “আল্লাহ” শব্দের উচ্চারণের কাছাকাছি। এই নামটি আমরা ওল্ড এবং নিউ টেষ্টামেন্টেও পাই ‘ইলো এবং ইলোহিম’ হিসেবে।
কুরাইশদের নিকটও এই নামটি পরিচিত ছিল। বিস্ময়কর একটা ব্যাপার হলো, প্রাচীন ব্যাবিলন এবং কুরাইশদের নিকট “আল্লাহ” ছিলেন সকল ঈশ্বরের ঈশ্বর। তিনি ছিলেন প্রধান ঈশ্বর। তারা কখনো আল্লাহর জন্য কোনো মূর্তি তৈরী করেনি। কুরাইশরা আল্লাহকে চিনতো; তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ – (৪৩: ৮৭) আপনি যদি কুরাইশদের জিজ্ঞেস করেন কে তোমাদের সৃষ্টি করেছে, তারা বলবে আল্লাহ। সুতরাং তারা আল্লাহ নামটি সম্পর্কে জানতো। কখনো কখনো তারা আল্লাহর উপাসনাও করতো। কিন্তু তারা আল্লাহকে অনেক বেশি পবিত্র মনে করতো। মোটকথা আল্লাহ নামটি তাদের নিকট জানা ছিল।
আল্লাহ নামটি কোথাও থেকে উদ্গত (non-derived) হয়নি, এটি একটি প্রপার নাউন যার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু এই মতটি খুবই দুর্বল মত
আরবি ভাষার অধিকাংশ ভাষাবিদ এবং তাফসীরকারকের মতে, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ শব্দের অর্থ আছে। এই বিষয়ে ছয়টির অধিক মতামত পাওয়া যায়।
কিছু কিছু অভিমত হচ্ছে –
১। “আল্লাহ” নামটি এসেছে ‘আলাহা’ ক্রিয়াবাচক শব্দ থেকে। আর ‘আলাহা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছুটে আসা, সাহায্য পাওয়ার জন্য আসা, কোথাও আশ্রয় পাওয়া, কোথাও অবলম্বন পাওয়া।
তাই এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট সবাই সাহায্যের জন্য ছুটে আসে। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট অন্তর প্রশান্তি পায়। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট সমস্ত সৃষ্টি জগৎকে অবশ্যই চাইতে হবে। আর এই অর্থটি সম্পূর্ণরূপে একটি বৈধ অর্থ।
يَسْأَلُهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ – নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সবাই তাঁর কাছে প্রার্থী। তিনি সর্বদাই কোন না কোন কাজে রত আছেন।
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ – اللَّهُ الصَّمَدُ – এখানে “الصَّمَدُ” শব্দের অর্থ হলো – যার নিকট ফেরা হয় এবং কোনো কিছু চাওয়া হয়। সুতরাং “আল্লাহ” শব্দের অর্থ হলো – এমন সত্তা সবাই যার মুখাপেক্ষী।
২। আল্লাহ নামের আরো অর্থ হলো….কিছু ওলামা বলেন, “আল্লাহ” শব্দটি এমন একটি ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে যার অর্থ হলো – উন্নত করা, ঊর্ধ্বে ওঠানো। আল্লাহ হলেন সর্বোচ্চ সত্তা। আর এটা সঠিক অভিমত। যেমন আমরা বলি, আল্লাহু আকবার। আল্লাহর আরেকটি নাম হলো, আল আ’লা। যেমন কুরআনে এসেছে – “সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা।” (আপনার সর্বোচ্চ প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা বর্ণনা করুন।)
আর তাই যারা আল্লাহর ইবাদাত করে তাদেরও মর্যাদা উন্নত করা হয়। يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ۚ – “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দিবেন।” আর তাই “আল্লাহ” শব্দের এই ব্যাখ্যা টিও একটি সঠিক ব্যাখ্যা।
৩। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার স্মরণে আপনার মন প্রশান্তি লাভ করে। أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ – “আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।” এই সবগুলো মতই যুক্তিসিদ্ধ।
৪।“আল্লাহ” শব্দের আরেকটি যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা হলো – আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যিনি আমাদের মনকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলেন, এমন সত্তা যাঁকে আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধির পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অন্য কথায়, আল্লাহ সম্পর্কে যত জানবেন তত বেশি অবাক হবেন। এই সবগুলো ব্যাখ্যাই যুক্তিসিদ্ধ।
৫। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী মতামত হলো – “আল্লাহ” শব্দটি “আলিহা – ইয়া’লাহু” থেকে এসেছে। আর ‘আলিহা’ শব্দের অর্থ হলো – ইবাদাত করা। সুতরাং আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যাঁর উপাসনা করা হয়। এটাই সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা।
৬। সবচেয়ে শক্তিশালী মত যা আরবি ভাষার অধিকাংশ ভাষাবিদ ব্যক্ত করেছেন তা হলো – “আল্লাহ” শব্দটি দ্বারা এমন এক সত্তার কথা বোঝায় যিনি উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। কেউই আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালার মত উপাসনা পাওয়ার যোগ্য নয়। এটাই অধিকাংশ আলেমের মত।
এই ব্যাখ্যার ফলে আমরা বুঝতে পারি কেন “আল্লাহ” নামটি আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রধানতম নাম।
ইবনুল কায়্যিম (রহ) আরও বলেন,
এটা আল্লাহ’র সেই নাম যার মাধ্যমে বিপদ দূর হয়, যার মাধ্যমে বরকত-বৃদ্ধির খোঁজ মেলে, যার মাধ্যমে দু’আর জবাব মেলে, যার মাধ্যমে ভয় ও অসহায়ত্ব একাকার হয়ে যায়, এটা সেই নাম যার মাধ্যমে খারাপ থেকে বেঁচে থাকা যায় আর ভালোর করা হয়। আর এটা হলো আল্লাহ’র সেই নাম যার ওপরই আসমান ও যমীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার ওপর কিতাবসমূহ নাযিল হয়েছে, আর সমস্ত নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। এটাই তো আল্লাহ’র সেই নাম যার মাধ্যমে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটা সেই নাম বিশ্বাসীদের পৃথক করে দেয় অবিশ্বাসীদের থেকে। যারা আল্লাহ’র এই নাম মেনে নেয় তারাই বিশ্বাসী আর যারা মানে না তারা অবিশ্বাসী। আর এটাই আল্লাহ’র সেই নাম যা বিচারের নিক্তিতে ভারী, যা পুলসিরাত নিমিষেই পার করে দেবে, আর যা বেহেশতের দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দেয়। আর তাই যে এই নামটি জানবে ও বিশ্বাস স্থাপন করবে সেই সফলকাম, আর যে আল্লাহ’র এই নামটিকে অগ্রাহ্য করবে, পরিত্যাগ করবে সে ধ্বংস হবে।