Power point Presentation
১৫। মৃত ব্যক্তি ও আমরা-১৪তম পর্ব জাহান্নাম-৩
জাহান্নাম- ৩
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
فَأَمَّا مَن طَغَىٰ
وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا
فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَىٰ
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ
فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ
তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছিল
এবং দুনিয়ার জীবনকে বেশী ভালো মনে করে বেছে নিয়েছিল ,
জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা৷
আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিল। তার ঠিকানা হবে জান্নাত ৷ সূরা নাযিয়াতঃ ৩৭-৪১
আল্লাহ তা‘আলা ভাল নারীর গুণাবলী উল্লেখ করে বলেন,
فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهَ
‘অতএব যারা সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোক তারা তাদের স্বামীদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম পালনকারীণী এবং স্বামীদের অনুপস্থিতিতে গোপনীয় বিষয়গুলির হেফাযতকারীণী হয়ে থাকে। কেননা আল্লাহ নিজেই তার হেফাযত করেন (নিসা ৩৪)।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ভাল নারীর পরিচয় দিতে গিয়ে তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন-
(১) সতী-সাধবীঃ ঐ স্ত্রী লোককে সতী-সাধবী বলা হয় যার মধ্যে ইসলামের দৃষ্টিতে অসাধু ও দৃষ্টিকটু কোন আচরণ পরিলক্ষিত হয় না।
(২) আল্লাহর হুকুম পালনকারীণী অর্থাৎ আল্লাহর আইন-বিধান স্বতঃস্ফূর্ত ও সার্বিকভাবে মেনে চলা।
(৩) স্বামীর অনুপস্থিতিতে গোপনীয়তা রক্ষা করা। এগুলি হচ্ছে ভাল নারীর বিশেষ গুণাবলী, যা অর্জনের জন্য প্রত্যেক মুসলিম রমনীর সচেষ্ট হওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে যত বাধা আসুক না কেন তা উপেক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে। কেননা তিনি নিজেই তাদের হেফাযতের অঙ্গীকার করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সবচেয়ে উত্তম নারী হল ঐ স্ত্রী যার দিকে তুমি তাকালে তোমাকে সে খুশী করে। তাকে নির্দেশ দিলে আনুগত্য করে। তুমি তার থেকে অনুপস্থিত থাকলে সে তার নিজেকে এবং তোমার সম্পদকে হেফাযত করে। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/২৫১, ৪৩২, ৪৩৮, মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/১৬১]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
عَسَى رَبُّهُ إِنْ طَلَّقَكُنَّ أَنْ يُبْدِلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِنْكُنَّ مُسْلِمَاتٍ مُؤْمِنَاتٍ قَانِتَاتٍ تَائِبَاتٍ عَابِدَاتٍ سَائِحَاتٍ ثَيِّبَاتٍ وَأَبْكَارًا
‘নবী যদি আপনাদের সবাইকে তালাক দেন তাহলে অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ নবীকে তোমাদের পরিবর্তে এমনসব স্ত্রী দিবেন যারা তোমাদের চেয়ে উত্তম হবে। যারা হবে সত্যিকার মুসলিম অনুগত, তওবাকারী, ইবাদতকারী, ছিয়াম পালনকারী কুমারী কিংবা অকুমারী’ (তাহরীম ৫)।
এ আয়াতে আল্লাহ ভাল নারীর ছয়টি গুণ উল্লেখ করেছেন। যথা-
(১) মুসলিম- এমন স্ত্রী লোক যারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করতে সর্বদা প্রস্ত্তত থাকবে।
(২) মুমিন- যে অকৃত্রিম নিষ্ঠা সহকারে ঈমান এনেছে। অর্থাৎ যাবতীয় বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে।
(৩) আনুগত্যশীল- আনুগত্য বলতে কোন পীর-দরবেশের আনুগত্য নয় বরং আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং স্বামীর আনুগত্যকে বুঝানো হয়েছে।
(৪) তওবাকারী- এমন স্ত্রী লোক যারা সর্বক্ষণ আল্লাহর নিকট নিজের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়। নিজের পাপ কর্মের জন্য সদা-সর্বদা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়। এ ধরনের স্ত্রীদের মধ্যে কোন সময়ই অহংকার, গৌরব ও আত্মম্ভরিতার ভাবধারা জাগ্রত হ’তে পারে না। এমন রমণীগণ হয় নরম প্রকৃতির।
(৫) ইবাদতকারীণী- একজন নারীকে সর্বোত্তম হওয়ার জন্য ইবাদতগুযার হওয়া একান্তই জরূরী।
(৬) সিয়াম পালনকারী- ফরয বা নফল ছিয়াম পালন করা অতীতের নবী ও সৎলোকদের কাজ। সিয়াম পালন করলে প্রবৃত্তি দমন হয়। তাই সিয়াম পালন করা ভাল নারীদের এক বিশেষ গুণ।
ভাল মহিলাদের ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেন, ‘তোমাদের মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে এমন নারী যে, বন্ধুভাবাপন্ন, ঘন ঘন সন্তান প্রসবকারিণী, সমব্যথী, সান্ত্বনা প্রদানকারিণী, সহযোগিনী’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৪৯, ১৯৫২)। এ হাদীছে ভাল নারীর চারটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। যথা-
(১) স্বামীর প্রতি গভীর অনুরাগী ও বন্ধুভাবাপন্ন হওয়া।
(২) অধিক সন্তান প্রসব করা। দারিদ্রের ভয়ে সন্তান নেয়া বন্ধ করা যাবে না। কেননা রিযিকের মালিক আল্লাহ। তিনি সবার রিযিক দান করেন।
(৩) স্বামীর কাজে সহযোগিতা করা। অর্থাৎ স্বামীর ইবাদত-বন্দেগী হ’তে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক সব কাজে তাকে সহযোগিতা করা।
(৪) স্বামীর দুঃখে দুঃখী হওয়া ও তার ব্যথায় সমব্যথী হওয়া।
উপরোক্ত চারটি গুণ লাভ করার জন্য প্রত্যেক মুসলিম মহিলাকে যত্নবান হওয়া অতীব যরূরী।
আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল সা বলেছেন, ‘যখন কোন স্ত্রীলোক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে, রামাযান মাসের সিয়াম পালন করবে এবং নিজের লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে ও স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে বলা হবে’ (আহমাদ, আবূ নু‘আইম, মিশকাত হা/৩২৫৪, বাংলা মিশকাত হা/৩১১৫, হাদীছ সহীহ)।
অত্র হাদীছে নারীদের ইচ্ছামতো জান্নাতে যাওয়ার চারটি মাধ্যম উল্লেখ করা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে স্বামীর অনুগত হওয়া। স্ত্রীদের জন্য স্বামীর সেবাই হচ্ছে প্রধান কাজ। স্বামীর সেবার বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। স্ত্রীলোকের জন্য সাংসারিক দায়িত্ব খুবই কম।
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ لاَ تُؤْذِي امْرَأَةٌ زَوْجَهَا فِي الدُّنْيَا إِلاَّ قَالَتْ زَوْجَتُهُ مِنَ الْحُورِ الْعِينِ لاَ تُؤْذِيهِ قَاتَلَكِ اللهُ فَإِنَّمَا هُوَ عِنْدَكِ دَخِيلٌ يُوشِكُ أَنْ يُفَارِقَكِ إِلَيْنَا
মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, নবী (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন কোন নারী তার স্বামীকে দুনিয়াতে কষ্ট দেয়, তখন জান্নাতের হূরদের মধ্যে যে তার স্ত্রী হবে সে বলে, হে (অভাগিনী)! তুমি তাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন। তিনি তোমার কাছে পরবাসী। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবেন’ (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৩২৫৮, বাংলা মিশকাত হা/৩১১৯, হাদীছ সহীহ, আলবানী,
জাহান্নামীদের মুখমণ্ডল মাটিতে রেখে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ
আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামীদের কঠিন শাস্তি দেয়ার জন্য তাদের মুখমণ্ডল মাটিতে রেখে এবং পাঁ উপর দিকে উঠিয়ে তাদের গলায় বেড়ি ও শৃংখলিত করে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যারা অস্বীকার করে কিতাব ও যা সহ আমার রাসূলকে প্রেরণ করেছি তা, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে যখন তাদের গলদেশে বেড়ি ও শৃংখলিত থাকবে, তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে’ {সূরা মু’মিন: ৭০-৭২}।
তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় অন্ধ, মুক ও বধির করে। আর তাদের আবাস স্থল জাহান্নাম, যখনই উহা স্তিমিত হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নিশিখা বৃদ্ধি করে দেব’ {সূরা বানী ইসরাইল: ৯৭}।
তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘অপরাধীরা বিভ্রান্ত ও বিকারগ্রস্ত, যেদিন তাদেরকে উপুড় করে মুখের উপর ভর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে, সে দিন বলা হবে, জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন কর’ {সূরা ক্বামার: ৪৭-৪৮}।
হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, (রাসূলুল্লাহ বললেন, কাফিরদেরকে হাশরের মাঠে মুখের মাধ্যমে হাঁটিয়ে উপস্থিত করা হবে) তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল! মুখের ভরে কাফিরদেরকে কিভাবে হাশরের ময়দানে উঠনো হবে? তিনি বললেন, দুনিয়াতে যে সত্তা দু’পায়ের উপর হাঁটান, তিনি কি ক্বিয়ামতের দিন মুখের ভরে হাঁটাতে পারবেন না? তখন ক্বাতাদাহ (রা.) বললেন, আমাদের প্রতিপালকের ইয্যতের কসম! অবশ্যই পারবেন। বুখারী, ‘হাশরের অবস্থা কেমন হবে’ অধ্যায়, হা/৬৫২৩,
জাহান্নামীদের কুৎসিত চেহারা
আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামীদের এমন কালো কুৎসিত চেহারায় পরিণত করবেন, যেন তা অন্ধকার রাত্রি সমতুল্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘সেদিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে এবং কতক মুখ কালো হবে, যাদের মুখ কালো হবে তাদেরকে বলা হবে, ঈমান আনয়নের পর কি তোমরা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিলে? সুতরাং তোমরা শাস্তি ভোগ কর, যেহেতু তোমরা সত্য প্রত্যাখ্যান করতে’ {সূরা আল-ইমরান: ১০৬}।
তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘যারা মন্দ কাজ করে তাদের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং তাদেরকে হীনতা আচ্ছন্ন করবে, আল্লাহ হতে তাদেরকে রক্ষা করার মত কেউ নাই, তাদের মুখমণ্ডল যেন রাত্রির অন্ধকার আস্তরণে আচ্ছাদিত। তারা অগ্নির অধিবাসী, সেথায় তারা স্থায়ী হবে’ {সূরা ইউনুস: ২৭}।
জাহান্নামীরা তাদের নাড়িভুঁড়ির চারপাশে গাধার ন্যায় ঘুরতে থাকবে
জাহান্নামীদেরকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তখন তাদের পেট হতে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। আর তারা তাদের নাড়িভুঁড়ির চারপার্শ্বে গাধার ন্যায় ঘুরতে থাকবে, যেমন- গাধা চাকা ঘুরিয়ে গম পিষে থাকে।
হাদীছে এসেছে, উসামাহ ইবনে যাইদ রাসূলুল্লাহ (ছা.) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তখন আগুনে পুড়ে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। এ সময় সে ঘুরতে থাকবে যেমন- গাধা তার চাকা নিয়ে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। তখন জাহান্নামবাসীরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে বলবে, হে অমুক ব্যক্তি! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না আমাদেরকে সৎ কাজের আদেশ করতে আর অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতে? সে বলবে, আমি তোমাদেরকে সৎ কাজের আদেশ করতাম বটে, কিন্তু আমি তা করতাম না আর আমি তোমাদেরকে অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতাম, অথচ আমিই তা করতাম। বুখারী, ‘জাহান্নামের বিবরণ আর তা হচ্ছে সৃষ্ট বস্তু’ অধ্যায়, হা/৩২৬৭, বাংলা অনুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ৩/৩৪৬।
আর যারা জাহান্নামের মধ্যে তাদের নাড়িভুঁড়ির চারপাশে ঘুরতে থাকবে তাদের মধ্যে একজন হল আমর ইবনু লুহাই, যে সর্বপ্রথম আরবে দ্বীনের পরিবর্তন ঘটিয়েছিল।
এ সম্পর্কে হাদীছে উল্লেখিত হয়েছে, আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, আমি আমর ইবনু আমির ইবনে লুহাই খুযআহ্কে তার বহির্গত নাড়িভুঁড়ি নিয়ে জাহান্নামের আগুনে চলাফেরা করতে দেখেছি। সেই প্রথম ব্যক্তি যে সা-য়্যিবাহ্ উৎসর্গ করার প্রথা প্রচলন করে। বুখারী, ‘খুযা’আহ গোত্রের কাহিনী’ অধ্যায়, হা/৩৫২১, বাংলা অনুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ৩/৪৭৬।
জাহান্নামীদেরকে গলায় লোহার শিকল দিয়ে আগুনের মধ্যে বেঁধে রাখা হবে
আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামবাসীদেরকে তাদের গলায় লোহার শিকল দিয়ে এমনভাবে বেঁধে রাখবেন, যেখান থেকে তারা পালাতে পারবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি শৃংখল, বেড়ী ও লেলিহান অগ্নি’ {সূরা দাহার: ৪}। তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘আমার নিকট আছে শৃংখল, প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, আর আছে এমন খাদ্য যা গলায় আটকিয়ে যায় এবং মর্মন্তুদ শাস্তি’ {সূরা মুযযাম্মিল: ১২-১৩}।
আয়াতে বর্ণিত হয়েছে বেড়ীর কথা, যা গলায় পরানো হয়। যেমন- পশুর গলায় বেড়ি পরানো হয়। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমি কাফিরদের গলদেশে শৃংখল পরাব। তাদেরকে তারা যা করত তারই প্রতিফল দেয়া হবে’ {সূরা সাবা: ৩৩}।
তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘যখন তাদের (জাহান্নামীদের) গলদেশে বেড়ি ও শৃংখল থাকবে, আর উহাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে’ {সূরা মু’মিন: ৭১}।
উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে শৃংখলিত করা বা বেঁধে রাখা সম্পর্কে। যেমন- পশুকে বেঁধে রাখা হয়।
আর জাহান্নামীদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা প্রস্তুত রেখেছেন লোহার আকড়শি। জাহান্নামের কঠিন যন্ত্রণা-কাতর হয়ে যখন জাহান্নামীগণ তা হতে বের হওয়ার চেষ্টা করবে তখন এই আকড়শিগুলো তাদেরকে টেনে জাহান্নামের তলদেশে নিক্ষেপ করবে
আল্লাহতা‘আলা বলেছেন, ‘এবং উহাদের জন্য থাকবে লোহার মুদগর। যখনই উহারা যন্ত্রণা-কাতর হয়ে জাহান্নাম হতে বের হতে চাইবে তখনই তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে উহাতে, আর তাদেরকে বলা হবে, আস্বাদন কর দহন যন্ত্রণা’ {সূরা হজ্জ: ২১-২২}।
বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছুর দংশন :
জাহান্নামে অসংখ্য বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছু থাকবে। সেখানের সাপ ও বিচ্ছুর আকৃতি হবে উট ও খচ্চরের সমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ فِي النَّارِ حَيَّاتٍ كَأَمْثَالِ أَعْنَاقِ الْبُخْتِ تَلْسَعُ إِحْدَاهُنَّ اللَّسْعَةَ فَيَجِدُ حَمْوَتَهَا أَرْبَعِيْنَ خَرِيْفًا وَإِنَّ فِي النَّارِ عَقَارِبَ كَأَمْثَالِ الْبِغَالِ الْمُوْكَفَةِ تَلْسَعُ إِحْدَاهُنَّ اللَّسْعَةَ فَيَجِدُ حَمْوَتَهَا أَرْبَعِيْنَ سَنَةً.‘জাহান্নামের সাপগুলো বুখতী নামক উটের ন্যায় হবে। এর একটি সাপের দংশনের বিষক্রিয়া জাহান্নামী চল্লিশ বছর পর্যন্ত অনুভব করবে। আর জাহান্নামের বিচ্ছু খচ্চরের সমান হবে। এর একটি বিচ্ছুর দংশনের বিষক্রিয়া জাহান্নামী চল্লিশ বছর অনুভব করবে’। মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৭৪৯; মিশকাত হা/৫৬৯১; ইবনু হিববান হা/৭৪৭১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৪২৯।
জাহান্নামীরা এবং তাদের মা‘বুদরা একত্রে জাহান্নামে অবস্থান করবে
কাফির-মুশরিকগণ আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যেই মা‘বুদদের সম্মান করে, তাদের ইবাদত করে এবং তাদের পথেই নিজেদের জান-মাল বিলিয়ে দেয়। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এবং তাদের ইবাদতকারীদেরক এক সঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে তাদের অপমানিত ও লাঞ্চিত করবেন এবং তাদের অক্ষমতা প্রমাণ করবেন। তখন তারা জানতে পারবে যে, তারা দুনিয়াতে ছিল পথভ্রষ্ট এবং তারা এমন কিছুর ইবাদত করত যারা কোন উপকার বা ক্ষতি কিছুই করতে সক্ষম নয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তোমরা এবং আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর সেগুলি তো জাহান্নামের ইন্ধন, তোমরা সকলেই উহাতে প্রবেশ করবে, যদি উহারা ইলাহ হতো তাহলে উহারা জাহান্নামে প্রবেশ করতনা, তাদের সকলেই উহাতে স্থায়ী হবে’ {সূরা আম্বিয়া: ৯৮-৯৯}।
ইবনে রজব (রহ.) বলেছেন, কাফিরগণ যখন আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন মা’বুদের ইবাদত করে, আর বিশ্বাস করে তারা তাদের জন্য আল্লাহর নিকট শাফা’আত করবে এবং তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা কাফির এবং তাদের মা‘বুদগণকে এক সঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে তাদের অপমানিত ও লাঞ্চিত করবেন। আর তারা যাদের কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে তারা পরষ্পরে জাহান্নামের শাস্তির সঙ্গী হয়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব করবে এবং আফসোস করতে থাকবে।
আর এই কারণেই আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন চন্দ্র এবং সূর্য-এর ইবাদতকারীদের ভর্ৎসনা করার জন্য এতদ্ব উভয়কে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। হাদীছে এসেছে, হাসান বাছরী (রহ.) বলেন, আবু হুরায়রাহ (রা.) আমাদেরকে রাসূল (ছা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন সূর্য ও চন্দ্রকে দুটি পনিরের আকৃতি বানিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তখন হাসান বাছরী জিজ্ঞেস করলেন, তাদের অপরাধ কি? জবাবে আবু হুরায়রাহ বললেন, আমি রাসূল (ছা.) হতে এ ব্যাপারে যাকিছু শুনেছি, তাই বর্ণনা করলাম, এই কথা শুনে হাসান বাছরী নীরব হয়ে গেলেন। সিলসিলাতুল আহাদীছিছ ছহীহাহ, ১/৩২, হা/১২৪, মিশকাত, হা/৫৪৪৮, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয়া, ১০/১৬৯।
অতএব, জাহান্নামীদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন শয়তানগণ অর্থাৎ তারা যাদের ইবাদত করত তাদের সাথে এক সঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, অতঃপর সেই হয় তার সহচর। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথ হতে বিরত রাখে, অথচ মানুষ মনে করে তারা সৎপথে পরিচালিত হচ্ছে। অবশেষে যখন সে আমার নিকট উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে, হায়! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত। কত নিকৃষ্ট সহচর সে। আর আজ তোমাদের এই অনুতাপ তোমাদের কোন কাজে আসবে না, যেহেতু তোমরা সীমালংঘন করেছিলে, তোমরা তো সকলেই শাস্তিতে শরীক’ {সূরা যুখরুফ: ৩৬-৩৯}।
জাহান্নামে কাফেরদের আযাব চিরস্থায়ী
জাহান্নামে জাহান্নামীরা চিরস্থায়ী বসবাস করবে। অবশ্য যদি কোন পাপের কারণে কোন মু’মিন জাহান্নামে যায়, তাহলে এক দিন না একদিন আল্লাহর দয়া ও ক্ষমায় অথবা কারো সুপারিশে অথবা পাপফল ভোগ করার শেষে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যাবে। হৃদয়ে তওহীদ থাকলে অর্থাৎ, শির্ক না করে থাকলে পাপী মুসলিমকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “(পরকালে) আল্লাহ বলবেন, সেই ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে বের কর, যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার হৃদয়ে যবের দানা পরিমাণ মঙ্গল (ঈমান) আছে। সেই ব্যক্তিকেও জাহান্নাম থেকে বের কর, যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার হৃদয়ে গমের দানা পরিমাণ মঙ্গল (ঈমান) আছে। আর সেই ব্যক্তিকেও জাহান্নাম থেকে বের কর, যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার হৃদয়ে অণু পরিমাণ মঙ্গল। (ঈমান) আছে।” (আহমাদ ৩/২৭৬, তিরমিযী ২৫৯৩নং, এ হাদীসের মুল রয়েছে সহীহায়নে)
বাকী যাদের ঈমান নেই, সেই বেঈমানরা চিরদিন সেখানে আযাবের মধ্যে বসবাস করবে। তাদের শাস্তি ক্ষমা করা হবে না, লাঘব করা হবে না এবং তারা বা জাহান্নাম ধ্বংস হয়ে যাবে না। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
অর্থাৎ, যারা (কাফের) অবিশ্বাস করে ও আমার নিদর্শনকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তারাই অগ্নিবাসী সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (বাক্বারাহঃ ৩৯)
وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
অর্থাৎ, যারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করেছে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (আরাফঃ ৩৬)
إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ
অর্থাৎ, অবশ্যই যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা বেহেশ্তেও প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করে। এরূপে আমি অপরাধীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (আরাফঃ ৪০)
إِنَّ الْمُجْرِمِينَ فِي عَذَابِ جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (74) لَا يُفَتَّرُ عَنْهُمْ وَهُمْ فِيهِ مُبْلِسُونَ (75)
অর্থাৎ, নিশ্চয় অপরাধীরা স্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। ওদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং ওরা তাতে (শাস্তি ভোগ করতে করতে) হতাশ হয়ে পড়বে। (যুখরুফঃ ৭৪-৭৫)
وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَىٰ عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُم مِّنْ عَذَابِهَا ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي كُلَّ كَفُورٍ
অর্থাৎ, যারা অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। ওদের মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হবে না যে, ওরা মরবে এবং ওদের জন্য জাহান্নামের শাস্তিও লাঘব করা হবে না। এভাবে আমি প্রত্যেক অবিশ্বাসীকে শাস্তি দিয়ে থাকি। (ফাত্বিরঃ ৩৬)
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَٰئِكَ عَلَيْهِمْ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (161) خَالِدِينَ فِيهَا ۖ لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنظَرُونَ (162)
নিশ্চয় যারা অবিশ্বাস করে (কাফের) এবং অবিশ্বাসী (কাফের) থাকা অবস্থায় মারা যায়, তাদের উপর আল্লাহ, ফিরিশ্তাগণ এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত। তারা চিরকাল তাতে (অভিসম্পাত ও দোযখে) অবস্থান করবে, তাদের শাস্তিকে লঘু করা হবে না এবং তারা কোন অবকাশও পাবে না। (বাক্বারাহঃ ১৬১-১৬২)
يُرِيدُونَ أَن يَخْرُجُوا مِنَ النَّارِ وَمَا هُم بِخَارِجِينَ مِنْهَا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيمٌ
অর্থাৎ, তারা আগুন থেকে বের হতে চাইবে, কিন্তু তারা তা থেকে বের হতেই পারবে না এবং তাদের জন্য স্থায়ী শাস্তি রয়েছে। (মাইদাহঃ ৩৭)।
ثُمَّ قِيلَ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا ذُوقُوا عَذَابَ الْخُلْدِ هَلْ تُجْزَوْنَ إِلَّا بِمَا كُنتُمْ تَكْسِبُون
, অতঃপর যালেমদেরকে বলা হবে, চিরস্থায়ী শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করতে থাকো, তোমাদেরকে তো তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিফলই দেওয়া হচ্ছে।’ (ইউনুসঃ ৫২)।
মৃত্যুকে দুম্বার আকারে নিয়ে এসে যবেহ করা হবে এবং বলা হবে, হে জান্নাতীগণ! তোমরা চিরকাল বাস কর, আর কোন মৃত্যু নেই। হে জাহান্নামীগণ! তোমরা চিরকাল বাস কর, আর কোন মৃত্যু নেই।” (বুখারী, মুসলিম)। মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَنذِرْهُمْ يَوْمَ الْحَسْرَةِ إِذْ قُضِيَ الْأَمْرُ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ وَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ
(হে রসূল!) তুমি তাদেরকে সতর্ক করে দাও পরিতাপের দিন সম্বন্ধে, যেদিন সকল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাবে; অথচ (এখন) তারা উদাসীন আছে এবং তারা বিশ্বাস করে না। (মারয়্যামঃ ৩৯)
চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার প্রধান প্রধান কারণ
প্রত্যেক শাস্তির একটা সীমা আছে। কিন্তু সে কোন্ অপরাধ যার শাস্তি অসীম? কুরআন কারীম যারা (অর্থসহ) পড়েন, তাঁরা অবশ্যই সেই সকল অপরাধ সম্বন্ধে অবহিত হবেন। এখানে কতিপয় অপরাধের কথা উল্লেখ করা হলঃ
১। কুফরী ও শির্কঃ
প্রত্যেক কাফের মুশরিক নাও হতে পারে। তবে প্রত্যেক মুশরিক অবশ্যই কাফের। সুতরাং আমভাবে কুফরী এমন এক অপরাধ, যার জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম ভোগ করতে হবে। কুফরী মানে অস্বীকার, অবিশ্বাস; আল্লাহকে অবিশ্বাস অথবা আল্লাহর কিছুকে অবিশ্বাস। কপটতা বা মুনাফিকীর কুফরী, সন্দেহ পোষণের কুফরী, কিছুতে বিশ্বাস ও কিছুতে অবিশ্বাসের কুফরী, আদেশ-নিষেধ অমান্য করার কুফরী ইত্যাদি। মহান আল্লাহ বলেন,
قَالُوا رَبَّنَا أَمَتَّنَا اثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا اثْنَتَيْنِ فَاعْتَرَفْنَا بِذُنُوبِنَا فَهَلْ إِلَىٰ خُرُوجٍ مِّن سَبِيلٍ (11) ذَٰلِكُم بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ ۖ وَإِن يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا ۚ فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ (12)
ওরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের দু’বার মৃত্যু দিয়েছ এবং দু’বার আমাদেরকে জীবিত করেছ। আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করলাম। এখন নিষ্কৃতির কোন পথ মিলবে কি?’ ওদেরকে বলা হবে, তোমাদের এ শাস্তি তো এ জন্যে যে, যখন এককভাবে আল্লাহকে আহবান করা হত, তখন তোমরা তাঁকে অস্বীকার করতে। আর তার শরীক স্থির করা হলে তোমরা বিশ্বাস করতে। সুতরাং সুউচ্চ, মহান আল্লাহরই সমস্ত কর্তৃত্ব।” (মু’মিনঃ ১১-১২)।
قَالُوا أَوَلَمْ تَكُ تَأْتِيكُمْ رُسُلُكُم بِالْبَيِّنَاتِ ۖ قَالُوا بَلَىٰ ۚ قَالُوا فَادْعُوا ۗ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ
তারা বলবে, তোমাদের নিকট কি স্পষ্ট নিদর্শনাবলী সহ তোমাদের রসূলগণ আসেনি?’ (জাহান্নামীরা) বলবে, অবশ্যই এসেছিল। (প্রহরীরা) বলবে, তবে তোমরা প্রার্থনা করতে থাক। আর সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের প্রার্থনা ব্যর্থই হয়।’ (মু’মিনঃ ৫০)
ওরা গ্রন্থ ও আমার রসূলদেরকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছিলাম, তা মিথ্যাজ্ঞান করে। সুতরাং শীঘ্রই ওরা জানতে পারবে। যখন ওদের গলদেশে বেড়ি ও শিকল থাকবে, ওদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর ওদেরকে অগ্নিতে দগ্ধ করা হবে; পরে ওদেরকে বলা হবে, কোথায় তারা, যাদেরকে তোমরা শরীক করতে—আল্লাহকে ছেড়ে?’ ওরা বলবে, ওরা তো আমাদের নিকট থেকে অদৃশ্য হয়েছে; বরং পূর্বে আমরা এমন কিছুকে আহবান করিনি, যার কোন সত্তা ছিল। এভাবে আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে বিভ্রান্ত করে থাকেন। এটা এ কারণে যে, তোমরা পৃথিবীতে অযথা আনন্দ করতে ও দম্ভ করতে। ওদেরকে বলা হবে, জাহান্নামে চিরকাল বসবাসের জন্য ওতে প্রবেশ কর, কত নিকৃষ্ট উদ্ধতদের আবাসস্থল। (মু’মিনঃ ৭০-৭৬)।
مَّنْ أَعْرَضَ عَنْهُ فَإِنَّهُ يَحْمِلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وِزْرًا (100) خَالِدِينَ فِيهِ ۖ وَسَاءَ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِمْلًا (101)
যে কেউ এ হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ফলতঃ সে কিয়ামতের দিন (মহাপাপের) বোঝা বহন করবে। ঐ (পাপের শাস্তি)তে ওরা স্থায়ী হবে এবং কিয়ামতের দিন এই বোঝা ওদের জন্য কত মন্দ হবে। (ত্বহাঃ ১০০- ১০১)।
وَقِيلَ لَهُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ تَعْبُدُونَ (92) مِن دُونِ اللَّهِ هَلْ يَنصُرُونَكُمْ أَوْ يَنتَصِرُونَ (93) فَكُبْكِبُوا فِيهَا هُمْ وَالْغَاوُونَ (94) وَجُنُودُ إِبْلِيسَ أَجْمَعُونَ (95) قَالُوا وَهُمْ فِيهَا يَخْتَصِمُونَ (96) تَاللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ (97) إِذْ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ الْعَالَمِينَ (98)
ওদের বলা হবে, তারা কোথায় যাদের তোমরা উপাসনা করতে; আল্লাহর পরিবর্তে? ওরা কি তোমাদের সাহায্য করতে আসবে? না ওরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম? অতঃপর ওদের এবং পথভ্রষ্টদের অধােমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং ইবলীসের বাহিনীর সকলকেও। ওরা সেখানে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে বলবে, আল্লাহর শপথ! আমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সমকক্ষ গণ্য করতাম।’ (শুআরাঃ ৯২-৯৮)।
بَلْ كَذَّبُوا بِالسَّاعَةِ ۖ وَأَعْتَدْنَا لِمَن كَذَّبَ بِالسَّاعَةِ سَعِيرًا
বরং ওরা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে। আর যারা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে, তাদের জন্য আমি জ্বলন্ত জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছি। (ফুরকানঃ ১১)।
وَإِن تَعْجَبْ فَعَجَبٌ قَوْلُهُمْ أَإِذَا كُنَّا تُرَابًا أَإِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ ۗ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
যদি তুমি বিস্মিত হও, তাহলে বিস্ময়ের বিষয় তাদের কথা, (মৃত্যুর পর) মাটিতে পরিণত হওয়ার পরও কি আমরা নতুন জীবন লাভ করব?’ ওরাই ওদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে এবং ওদেরই গলদেশে থাকবে বেড়ি। ওরাই হবে দোযখবাসী, সেখানে ওরা চিরস্থায়ীভাবে বাস করবে। (রাদঃ ৫)।
২। কিয়ামত মিথ্যা মনে করার সাথে শরীয়তের আহকাম পালন না করা।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
فِي جَنَّاتٍ يَتَسَاءَلُونَ (40) عَنِ الْمُجْرِمِينَ (41) مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ (42) قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ (43) وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ (44) وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ (45) وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ (46) حَتَّىٰ أَتَانَا الْيَقِينُ (47) فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ (48)
তারা থাকবে জান্নাতে এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে— অপরাধীদের সম্পর্কে, তোমাদেরকে কিসে সাক্বার (জাহান্নাম)এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে অন্নদান করতাম না এবং আমরা সমালোচনাকারীদের সাথে সমালোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা মনে করতাম। পরিশেষে আমাদের নিকট মৃত্যু আগমন করল। ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। (মুদ্দাস্সিরঃ ৪০- ৪৮)
৩। ভ্রষ্ট নেতা-বুযুর্গদের অনুসরণ করাঃ
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
فَإِن يَصْبِرُوا فَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ ۖ وَإِن يَسْتَعْتِبُوا فَمَا هُم مِّنَ الْمُعْتَبِينَ (24) وَقَيَّضْنَا لَهُمْ قُرَنَاءَ فَزَيَّنُوا لَهُم مَّا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَحَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِم مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ ۖ إِنَّهُمْ كَانُوا خَاسِرِينَ (25)
এখন ওরা ধৈর্যশীল হলেও জাহান্নামই হবে ওদের আবাস এবং ওরা ক্ষমাপ্রার্থী হলেও ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না। আমি ওদের সঙ্গী দিয়েছিলাম, যারা ওদের অতীত ও ভবিষ্যৎকে ওদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দেখিয়েছিল। ওদের ব্যাপারে ওদের পূর্ববর্তী জ্বিন এবং মানুষদের ন্যায় শাস্তির কথা বাস্তব হয়েছে। নিশ্চয় ওরা ছিল ক্ষতিগ্রস্ত। (হা-মীম সাজদাহঃ ২৪-২৫)
يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا (66) وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا (67) رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا (68)
যেদিন অগ্নিতে ওদের মুখমন্ডল উল্টেপাল্টে দগ্ধ করা হবে সেদিন ওরা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রসূল (ﷺ) কে মান্য করতাম!’ তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় বড় লোক (বুযুর্গদের আনুগত্য করেছিলাম, সুতরাং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! ওদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং মহা অভিসম্পাত কর।” (আহযাবঃ ৬৬-৬৮)
৪৷ মুনাফিকী, কপটতাঃ
অপরাধের দিক থেকে কুফরীর চাইতে মুনাফিকী অধিকতর সাংঘাতিক। তাই তার শাস্তিও অধিক। মহান আল্লাহ বলেন,
وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ هِيَ حَسْبُهُمْ ۚ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيمٌ
আল্লাহ মুনাফিক্ পুরুষ, মুনাফিক্ নারী ও কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটা তাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি। (তাওবাহঃ ৬৮)
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا
মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা অবশ্যই দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনও কোন সাহায্যকারী পাবে না। (নিসাঃ ১৪৫)
৫। অহংকারঃ
স্বৈরাচারী অহংকারীদের জন্য জাহান্নাম। এই অহংকারের ফলে মানুষ সত্য প্রত্যাখ্যান করে। ঈমান আনতে নাক সিঁটকায়, মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করে। অহংকারী জাহান্নামীদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
আর যারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করেছে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (আরাফঃ ৩৬)
وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَى الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى اللَّهِ وُجُوهُهُم مُّسْوَدَّةٌ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْمُتَكَبِّرِينَ
যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তুমি কিয়ামতের দিন তাদের মুখ কালো দেখবে। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি? (যুমারঃ ৬০)।
وَيَوْمَ يُعْرَضُ الَّذِينَ كَفَرُوا عَلَى النَّارِ أَذْهَبْتُمْ طَيِّبَاتِكُمْ فِي حَيَاتِكُمُ الدُّنْيَا وَاسْتَمْتَعْتُم بِهَا فَالْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَبِمَا كُنتُمْ تَفْسُقُونَ
যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তুমি কিয়ামতের দিন তাদের মুখ কালো দেখবে। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি? (আহক্বাফঃ ২০)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “জান্নাত ও জাহান্নামের বিবাদ হল। জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে উদ্ধত ও অহংকারী লোকেরা থাকবে। আর জান্নাত বলল, ‘দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা আমার ভিতরে বসবাস করবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে ফায়সালা করলেন যে, তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। এবং তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেব। আর তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব।” (মুসলিম)।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “আমি তোমাদেরকে দোযখবাসী কারা তা বলে দেব না কি? প্রত্যেক রূঢ়-স্বভাব, দাম্ভিক, অহংকারী ব্যক্তি।” (বুখারী ৪৯১৮, মুসলিম ২৮৫৩নং)।
একদা নবী (ﷺ) বললেন, “যার হৃদয়ে অণু পরিমাণও অহংকার থাকবে সে জান্নাতে যাবে না।” এক ব্যক্তি বলল, লোকে তো পছন্দ করে যে, তার পোশাক ও জুতা সুন্দর হােক (তাহলে সে ব্যক্তির কি হবে?) নবী (ﷺ) বললেন, “অবশ্যই আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। (সুতরাং সুন্দর জামা-পোষাক পরায় অহংকার নেই।) অহংকার হল, হক (সত্য) প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে ঘৃণা করার নাম।” (মুসলিম ৯১নং, তিরমিযী, হাকেম ১/২৬)।
প্রকাশ থাকে যে, কুফরী ছাড়া কাবীরা গোনাহর জন্য কোন মুমিন জাহান্নামে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে না। যার বুকে সরিষার দানা পরিমান ঈমান থাকবে, সে একদিন না একদিন জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে। যদিও খুনীর ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا
, যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন। (নিসাঃ ৯৩)
আর সুদখোরের ব্যাপারে বলেছেন,
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতে) সেই ব্যক্তির মত দন্ডায়মান হবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে দিয়েছে। তা এ জন্য যে তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন। অতএব যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে, তারপর সে (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়েছে, সুতরাং (নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে) যা অতীত হয়েছে, তা তার (জন্য ক্ষমার্হ হবে), আর তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু যারা পুনরায় (সুদ খেতে) আরম্ভ করবে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (বাক্বারাহঃ ২৭৫)
তবুও অন্যান্য আয়াত ও হাদীসের ভিত্তিতে উক্ত শাস্তির ঘোষণাকে ধমক বলে মানতে হবে। অর্থাৎ, কোন মুসলিমের বুকে যদি তাওহীদ থাকে, তাহলে সে একদিন না একদিন মুক্তি পাবে; যদিও শাস্তি ভোগার পরে। যেহেতুঃ
একদা জিবরীল (আঃ) নবী (ﷺ)-কে বললেন, “আপনার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (নবী (ﷺ) বলেন, আমি বললাম, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে তবুও কি?” তিনি বললেন, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে।” (বুখারী ও মুসলিম)।
মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে (কলেমা) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।” (বুখারী, মুসলিম)
উপর্যুক্ত আয়াত দু’টিতে শাস্তি হিসাবে চিরস্থায়ী জাহান্নামের কথা যে বর্ণিত হয়েছে, তার অর্থ হল, সে যদি তওবা না করে, তাহলে তার শাস্তি এটাই হবে, যা মহান আল্লাহ তার অপরাধের দরুন তাকে দিতে পারেন। অনুরূপ তওবা না করা অবস্থায় চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার অর্থ হল, তাতে সুদীর্ঘ কাল অবস্থান করতে হবে। কারণ, কাফের ও মুশরিকরাই কেবল জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। তাছাড়া সুদ ও হত্যার সম্পর্ক যদিও বান্দার অধিকারের সাথে, যা থেকে তওবার মাধ্যমেও দায়িত্বমুক্ত হওয়া যায় না, তবুও আল্লাহ তাআলা স্বীয় কৃপা ও অনুগ্রহে তার এমনভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেন যে, নিহিত ব্যক্তিও প্রতিদান পেয়ে যাবে এবং সুদখোর ও হত্যাকারীরও মাফ হয়ে যাবে। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল কাদীর)
নির্দিষ্ট কতিপয় জাহান্নামী ব্যক্তি
কেউ জান্নাতের কাজ করলেই তাকে জান্নাতী এবং জাহান্নামের কাজ করলেই তাকে জাহান্নামী মনে করা ঠিক নয়। কারণ হতে পারে, সে মরণের পূর্বে অথবা আল্লাহর কাছে তার বিপরীত হতে পারে। তবে শরীয়ত নির্দিষ্টভাবে যাকে জাহান্নামী বলে উল্লেখ করেছে, তাকে জাহান্নামী মনে করতে হবে। যেমনঃ ফিরআউন। মহান আল্লাহ তার সম্বন্ধে বলেছেন,
يَقْدُمُ قَوْمَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَوْرَدَهُمُ النَّارَ ۖ وَبِئْسَ الْوِرْدُ الْمَوْرُودُ
কিয়ামতের দিন সে নিজ সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকবে, অতঃপর তাদেরকে উপনীত করবে দোযখে। আর তা অতি নিকৃষ্ট স্থান যাতে তারা উপনীত হবে। (হূদঃ ৯৮)
নূহ ও লূত (আলাইহিমাস সালাম)-এর স্ত্রী ও মহান আল্লাহ তাদের সম্বন্ধে বলেন,
ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ كَفَرُوا امْرَأَتَ نُوحٍ وَامْرَأَتَ لُوطٍ ۖ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ
, আল্লাহ অবিশ্বাসীদের জন্য নূহ ও লুতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছেন; তারা ছিল আমার দাসদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ দাসের অধীন। কিন্তু তারা তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ফলে তারা (নূহ ও লূত) তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হল, ‘জাহান্নামে প্রবেশকারীদের সাথে তোমরাও তাতে প্রবেশ কর। (তাহরীমঃ ১০)
এখানে খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা বলতে দাম্পত্যের খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, কোন নবীর স্ত্রী ব্যভিচারিণী ছিলেন না। (ফাতহুল কাদীর) খিয়ানত বলতে বুঝানো হয়েছে, এরা তাদের স্বামীদের উপর ঈমান আনেনি। তারা মুনাফিক্বী ও কপটতায় লিপ্ত ছিল এবং নিজেদের কাফের জাতির প্রতি তারা সমবেদনা পোষণ করত। যেমন, নূহ (আঃ)-এর স্ত্রী নূহ (আঃ)-এর ব্যাপারে লোকদেরকে বলে বেড়াত যে, এ একজন পাগল। আর লূত (আঃ)-এর স্ত্রী তার গোত্রের লোকদেরকে নিজ বাড়ীতে আগত অতিথির সংবাদ পৌছে দিত। কেউ কেউ বলেন, এরা উভয়ই তাদের জাতির লোকদের মাঝে নিজ নিজ স্বামীর চুগলি করে বেড়াত।
নূহ (আঃ) এবং লূত (আঃ) তাঁরা উভয়েই ছিলেন আল্লাহর পয়গম্বর, আর পয়গম্বররা আল্লাহর অতি নিকটতম বান্দাদের মধ্যে গণ্য হন, তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের স্ত্রীদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবেন না।
আবু লাহাব ও তার স্ত্রী ও তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ (1) مَا أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ (2) سَيَصْلَىٰ نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ (3) وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ (4) فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ (5)
অর্থাৎ, ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন উপকারে আসবে না। অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট (জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে এবং তার স্ত্রীও; যে ইন্ধন বহন করে। তার গলদেশে থাকবে খেজুর আঁশের পাকানো রশি। (সূরাঃ লাহাব)
আমর বিন আমের আল-খুযায়ীঃ মহানবী (ﷺ) তাকে জাহান্নামে নিজেরনাড়িভুড়ি টেনে নিয়ে বেড়াতে দেখেছেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ)
আম্মার (রাঃ)-এর ঘাতক ও তার ব্যাপারে মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “সে জাহান্নামী।” (সঃ জামে’ ৪১৭০নং)
কাফের জ্বিনরাও জাহান্নামী
মানুষের মতই জ্বিনদেরও ভাল-মন্দ উভয়ই আছে। ভাল জ্বিনরা যেমন জান্নাতে যাবে, তেমনি খারাপ জ্বিনরা যাবে জাহান্নামে৷ মহান আল্লাহ উভয় জাতিকেই ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে কেবল এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। (যারিয়াতঃ ৫৬)
সুতরাং ইবাদত না করলে জাহান্নামে যেতে হবে। জ্বিনকেও হাশরের ময়দানে জমায়েত করা হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন
وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ قَدِ اسْتَكْثَرْتُم مِّنَ الْإِنسِ ۖ وَقَالَ أَوْلِيَاؤُهُم مِّنَ الْإِنسِ رَبَّنَا اسْتَمْتَعَ بَعْضُنَا بِبَعْضٍ وَبَلَغْنَا أَجَلَنَا الَّذِي أَجَّلْتَ لَنَا ۚ قَالَ النَّارُ مَثْوَاكُمْ خَالِدِينَ فِيهَا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۗ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ
যেদিন তিনি তাদের সকলকে একত্র করবেন (এবং বলবেন,) ‘হে জিন সম্প্রদায়! তোমরা অনেক মানুষকে তোমাদের অনুগত করেছিলে। আর মানব-সমাজের মধ্যে তাদের বন্ধুগণ বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক। আমরা পরস্পর পরস্পর দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং তুমি আমাদের জন্য যে সময় নির্ধারিত করেছিলে এখন আমরা তাতে উপনীত হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামই তোমাদের বাসস্থান, সেখানে তোমরা চিরদিন থাকবে; যদি না আল্লাহ অন্য রকম ইচ্ছা করেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত। (আনআমঃ ১২৮)
فَوَرَبِّكَ لَنَحْشُرَنَّهُمْ وَالشَّيَاطِينَ ثُمَّ لَنُحْضِرَنَّهُمْ حَوْلَ جَهَنَّمَ جِثِيًّا (68) ثُمَّ لَنَنزِعَنَّ مِن كُلِّ شِيعَةٍ أَيُّهُمْ أَشَدُّ عَلَى الرَّحْمَٰنِ عِتِيًّا (69) ثُمَّ لَنَحْنُ أَعْلَمُ بِالَّذِينَ هُمْ أَوْلَىٰ بِهَا صِلِيًّا (70)
সুতরাং শপথ তোমার প্রতিপালকের! আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে সমবেত করব। অতঃপর আমি অবশ্যই তাদেরকে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চতুর্দিকে উপস্থিত করব। অতঃপর প্রত্যেক দলের মধ্যে যে পরম দয়াময়ের প্রতি সর্বাধিক অবাধ্য আমি তাকে টেনে অবশ্যই বের করব। তারপর আমি অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা জাহান্নাম প্রবেশের অধিকতর যোগ্য তাদের বিষয়ে অধিক অবগত। (মারয়ামঃ ৬৮-৭০)
জাহান্নামে প্রবেশ করতে আদেশ দিয়ে বলা হবে,
ادْخُلُوا فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُم مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ فِي النَّارِ ۖ كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَّعَنَتْ أُخْتَهَا ۖ حَتَّىٰ إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَٰؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِّنَ النَّارِ ۖ قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَٰكِن لَّا تَعْلَمُونَ
তোমাদের পূর্বে যে জ্বিন ও মানবদল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা দোযখে প্রবেশ কর। যখনই কোন দল তাতে প্রবেশ করবে, তখনই অপর দলকে তারা অভিসম্পাত করবে। পরিশেষে যখন সকলে। ওতে একত্র হবে, তখন তাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! ওরাই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল, সুতরাং তুমি ওদেরকে দোযখের দ্বিগুণ শাস্তি দাও। আল্লাহ বলবেন, প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে; কিন্তু তোমরা জান না।’ (আ’রাফ ৩৮) সুতরাং জ্বিনরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَكُبْكِبُوا فِيهَا هُمْ وَالْغَاوُونَ (94) وَجُنُودُ إِبْلِيسَ أَجْمَعُونَ (95)
অতঃপর ওদের এবং পথভ্রষ্টদের অধােমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং ইবলীসের বাহিনীর সকলকেও। (শুআরাঃ ৯৪-৯৫)
মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, তিনি জ্বিন-ইনসান দিয়ে জাহান্নাম পরিপূর্ণ করবেন। তিনি বলেছেন,
وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই’ তোমার প্রতিপালকের এই বাণী পূর্ণ হবেই। (হূদঃ ১১৯)
জাহান্নামের আযাবের ভয়াবহতা
জাহান্নামের আযাব এত কঠিন ও ভয়ানক হবে যে, তার মুক্তিপণ হিসাবে দুনিয়ার সবকিছু দিতে পারলে তা দিয়ে জাহান্নামী মুক্তি কামনা করবে। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ أَنَّ لَهُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لِيَفْتَدُوا بِهِ مِنْ عَذَابِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
যারা অবিশ্বাস করেছে পৃথিবীতে যা কিছু আছে, যদি তাদের তার সমস্ত থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরো থাকে এবং কিয়ামতের দিন শাস্তি হতে মুক্তির জন্য পণস্বরূপ তা দিতে চায়, তবুও তাদের নিকট হতে তা গৃহীত হবে না এবং তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি বর্তমান। (মাইদাহঃ ৩৬)
يَوَدُّ الْمُجْرِمُ لَوْ يَفْتَدِي مِنْ عَذَابِ يَوْمِئِذٍ بِبَنِيهِ (11) وَصَاحِبَتِهِ وَأَخِيهِ (12) وَفَصِيلَتِهِ الَّتِي تُؤْوِيهِ (13) وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ يُنجِيهِ (14)
অপরাধী সেই দিনে শাস্তির বদলে দিতে চাইবে নিজ সন্তানসন্ততিকে। তার স্ত্রী ও ভাইকে। তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে, যারা তাকে আশ্রয় দিত। এবং পৃথিবীর সকলকে, যাতে এই মুক্তিপণ তাকে মুক্তি দেয়। (মাআরিজঃ ১১-১৪)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “জাহান্নামের সবচেয়ে কম আযাবের একটি লোককে আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা জিজ্ঞাসা করবেন, তোমার যদি দুনিয়া ও তন্মধ্যস্থিত সব কিছু হতো, তাহলে মুক্তিপণ হিসাবে তা দিয়ে কি মুক্তি নিতে?” সে বলবে, হ্যাঁ। আল্লাহ বলবেন, তুমি যখন আদমের পিঠে ছিলে, তখন আমি তোমার নিকট থেকে এর চাইতে সহজ জিনিস চেয়েছিলাম যে, তুমি শির্ক করো না, তোমাকে জাহান্নামে দেব না। কিন্তু তুমি শির্কই করেছ। (বুখারী, মুসলিম)।
জান্নাতের অবর্ণনীয় সুখ দেখে জান্নাতী যেমন দুনিয়ার সকল দুঃখ-ব্যথা ভুলে যাবে, তেমনি জাহান্নামের কঠিন আযাব দেখে জাহান্নামী দুনিয়ার সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিস্মৃত হবে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাত্র) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে? সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু! আর জান্নাতীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাত্র একবার) চুবানোর পর বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে?” সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি।” (মুসলিম)
জাহান্নামী কারা? তাদের বৈশিষ্ঠ্য কি?
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন;
لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلاَ اللَّعَّانِ وَلاَ الْفَاحِشِ وَلاَ الْبَذِيءِ
মুমিন কখনো দোষারোপকারী হয় না, অভিসম্পাত করে না, অশ্লীল কাজ করে না এবং কটুভাষীও হয় না। (তিরমিজী ১৯৭৭; সহীহাহ ৩২০; সহীহ)
الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيمٌ، وَالْفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيمٌ
মুমিন হয় সরল ও ভদ্র, পক্ষান্তরে পাপীষ্ঠ হয় ধূর্ত ও দুশ্চরিত্রের। (আবূ দাঊদ ৪৭৯০, সনদ হাসান)
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ
আমি কি তোমাদের জাহান্নামীদের সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারা হলো রুঢ় স্বভাবের, কঠিন হৃদয়ের ও অহংকারী। (সহীহুল বুখারী: ৬০৭১, ৪৯১৮; সহিহ মুসলিম: ৭০৭৯)
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ جَوَّاظٍ زَنِيمٍ مُتَكَبِّرٍ
আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারা হলো বদমেজাজী, কুখ্যাত এবং অহংকারী। (সহিহ মুসলিম: ৭০৮১)
وَأَهْلِ النَّارِ كُلُّ جَوَّاظٍ عُتُلٍّ مُسْتَكْبِرٍ
জাহান্নামীরা হলো অবাধ্য, বদমেজাজী ও অহংকারী। (সহীহুল বুখারী: ৬৬৫৭)
تَحَاجَّتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ فَقَالَتِ النَّارُ أُوثِرْتُ بِالْمُتَكَبِّرِينَ وَالْمُتَجَبِّرِينَ
জান্নাত ও জাহান্নাম পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হলে, জাহান্নাম বলল; প্রতাবশালী ও দাম্ভিকদের দ্বারা আমাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। (সহীহুল বুখারী: ৪৮৫০; সহিহ মুসলিম: ৭০৬৫, ৭০৬৭)
لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ الجَّوَّاظَ وَلاَ الْجَعْظَرِىُّ
‘দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। (আবূ দাঊদ ৪৮০১, সনদ ছহীহ)
لايَدْخُلُ الجَّنَّةَ قَتَّاتٌ
‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। (সহীহুল বুখারী: ৬০৫৬, সহিহ মুসলিম: ১৯২,১৯৩)
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ
‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহীহ মুসলিম: ৬৪১৫)
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ
যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না (সহীহ মুসলিম, ৭৬)
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ
যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ মুসলিম: ১৬৬)
ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ – وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ – وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ شَيْخٌ زَانٍ وَمَلِكٌ كَذَّابٌ وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ
তিন ব্যক্তির সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়াআলা কথা বলবেন না, তাদের (গুনাহ থেকে) পবিত্র করবেন না, তাদের প্রতি তাকাবেনও না আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। বৃদ্ধ যিনাকারী , মিথ্যাবাদী বাদশাহ ও অহংকারী দরিদ্র ব্যক্তি। (সহিহ মুসলিম; ১৯৬)
وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَىَّ وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الثَّرْثَارُونَ وَالْمُتَشَدِّقُونَ وَالْمُتَفَيْهِقُونَ ” . قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَدْ عَلِمْنَا الثَّرْثَارُونَ وَالْمُتَشَدِّقُونَ فَمَا الْمُتَفَيْهِقُونَ قَالَ ”الْمُتَكَبِّرُونَ ”
তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিরা আমার নিকট ঘৃণ্য ও ক্বিয়ামতের দিন আমার নিকট থেকে দূরে অবস্থান করবে যারা বাচাল, নির্লজ্জ ও মুতাফাইহিকুন। ছাহাবীগণ বললেন, বাচাল ও নির্লজ্জ তো বুঝলাম। কিন্তু মুতাফাইহিকুন কারা, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, অহংকারীরা। (তিরমিযী ২০১৮, সনদ ছহীহ)
إِنَّ شَرَّ النَّاسِ مَنْزِلَةً عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ وَدَعَهُ أَوْ تَرَكَهُ النَّاسُ اتِّقَاءَ فُحْشِهِ
কিয়ামতের দিনে আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তি নিকৃষ্ট স্তরের বলে গণ্য হবে, যাকে লোকজন তার দুর্ব্যবহারের জন্য পরিত্যাগ করে। (মুসলিম: ৬৪৯০; বুখারী: ৬০৩২; আবূ দাউদ; ৪৭৯১)
إِنَّ شَرَّ النَّاسِ مَنْ تَرَكَهُ النَّاسُ ـ أَوْ وَدَعَهُ النَّاسُ ـ اتِّقَاءَ فُحْشِهِ
নিশ্চয় সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক সে-ই যার অশালীনতা থেকে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ তার সংশ্রব ত্যাগ করে। (বুখারী: ৬০৫৪)
মন্দ স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তি তার লালিত মন্দ স্বভাবের কারণে জান্নাতে প্রবেশে অন্যতম বাধা হবে। হাদীছে এসেছে;
عن ابى هريرة رضي الله ان رسول الله صلى الله عليه وصلم قال اَتَدْرُوْنَ مَا لْمُفْلِسُ قَالُوْا الْمُفْلِسُ قِيْنَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ فَقَالَ اِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ اُمَّتِىْ مَنْ يَأْةِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بصَّلَوةٍ وَّصِيَامٍ وَزَكَاَةٍ وَّيَأْتِىْ قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَف هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَ سَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فاِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ اَنْ يَقْضَى مَا عَلَيْهِ اُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِمْ … طُرِحَ فِى النَّار
আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা কি জান অভাবী কে? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী যার টাকা-পয়সা ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে সলাত, সিয়াম, যাকাত আদায় করে আসবে এবং সাথে সাথে সেই লোকেরাও আসবে, কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল-সম্পদ আত্মসাত করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এই হক্বদারকে তার নেকী দেয়া হবে।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي كَفَانِي وَآوَانِي، وَأَطْعَمَنِي وَسَقَانِي، وَالَّذِي مَنَّ عَلَيَّ فَأَفْضَلَ، وَالَّذِي أَعْطَانِي فَأَجْزَلَ، الْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ اللَّهُمَّ رَبَّ كُلِّ شَيْءٍ وَمَلِيكَهُ وَإِلَهَ كُلِّ شَيْءٍ، أَعُوذُ بِكَ مِنَ النَّارِ
‘সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি আমার প্রতি অসীম দয়াবান এবং আমাকে দান করলেন। সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা। হে আল্লাহ! প্রত্যেক বস্তুর রব ও অধিকারী এবং প্রত্যেক জিনিসের ইলাহ! আমি আপনার নিকট জাহান্নামের শাস্তি থেকে আশ্রয় চাই।
আবুদাঊদ হা/৫০৬০; মিশকাত হা/২৪১০; মুসনাদে আহমাদ হা/৫৯৮৩; ইবনু হিববান হা/৫৫৩৮; মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/৫৭৫৮। হাদীছ ছহীহ।
জাযাকুমুল্লাহি খাইরান
সংগ্রহঃ ও সহায়কঃ
জান্নাত জাহান্নামের বর্ননা
আবদুল হামীদ ফাইযী
Islamic online media