১০ম পর্ব- জান্নাত-৩
Power point Presentation
১০। মৃত ব্যক্তি ও আমরা-১০ম পর্ব, জান্নাত-৩
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
জান্নাতের হকদার কারা?
জান্নাতের হকদার সেই মুমিনগণ, যারা কোনদিন কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করেনি। অর্থাৎ, শির্ক করেনি। অথবা শির্ক করার পর তওবা না করে শির্ক নিয়ে মারা যায়নি।
পক্ষান্তরে যারা শির্ক করে, শির্ক নিয়ে মারা যায়, কুফরী করে, ঈমানের কোন বিষয়কে অস্বীকার বা মিথ্যাজ্ঞান করে, তাদের জন্য জান্নাত হারাম। কুরআন-কারীমে যেখানেই জান্নাতের হকদারদের কথা বলা হয়েছে, সেখানেই কারণ স্বরূপ ঈমান ও নেক আমলকে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সেই নেক আমলের বিস্তারিত বিবরণও এসেছে। তার কিছু নিম্নরূপঃ
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস করেছে (মু’মিন হয়েছে) এবং সৎকাজ করেছে, তারাই হবে জান্নাতের অধিবাসী; তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। (বাক্বারাঃ ৮২)
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَخْبَتُوا إِلَى رَبِّهِمْ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করেছে এবং সৎকার্যাবলী সম্পন্ন করেছে, আর নিজেদের প্রতিপালকের কাছে বিনত হয়েছে, তারাই হবে জান্নাতবাসী; তাতে তারা অনন্তকাল থাকবে। (হুদঃ ২৩)
হে আমার দাসগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিতও হবে না। যারা আমার আয়াতে বিশ্বাস করেছিলে এবং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) ছিলে। তোমরা এবং তোমাদের সহধর্মিণীগণ সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর। (যুখরূফঃ ৬৮-৭০)
কেবল তারাই আমার আয়াতসমূহ বিশ্বাস করে, যাদেরকে ওর দ্বারা উপদেশ দেওয়া হলে তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং অহংকার করে না। তারা শয্যা ত্যাগ করে আকাঙ্ক্ষা ও আশংকার সাথে তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী প্রদান করেছি, তা হতে তারা দান করে। কেউই জানে না তার জন্য তার কৃতকর্মের বিনিময় স্বরূপ নয়ন-প্রীতিকর কি (পুরস্কার) লুকিয়ে রাখা হয়েছে। (সাজদাঃ ১৫-১৭)
যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে জান্নাতের সুউচ্চ প্রাসাদসমূহে স্থান দান করব; যার নিচে নদীমালা প্রবাহিত থাকবে, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কার কত উত্তম! যারা ধৈর্য অবলম্বন করে ও তাদের প্রতিপালকের ওপর নির্ভর করে। (আনকাবুতঃ ৫৮-৫৯)
নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’ তারপর তাতে অবিচলিত থাকে, তাদের নিকট ফিরিশতা অবতীর্ণ হয় (এবং বলে), ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার সুসংবাদ নাও। ইহকালে আমরা তোমাদের বন্ধু এবং পরকালেও; সেখানে তোমাদের জন্য সমস্ত কিছু রয়েছে যা তোমাদের মন চায়, যা তোমরা আকাঙ্ক্ষা কর। চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লার পক্ষ হতে এ হবে আপ্যায়ন। (হা-মীম সাজদাহঃ ৩০-৩২)।
নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’ অতঃপর এই বিশ্বাসে অবিচলিত থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারাই জান্নাতের অধিবাসী; সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। –এটাই তাদের কর্মফল। (আহক্বাফঃ ১৩-১৪)
وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ
আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দু’টি (জান্নাতের) বাগান। (রাহমানঃ ৪৬)
হাদীসেও স্পষ্টভাবে কোন কোন কাজের কাজীকে জান্নাতী বলা হয়েছে। অবশ্য প্রত্যেক কাজের সাথে ঈমান হল পূর্বশর্ত। উদাহরণ স্বরূপ যেমনঃ
“হে মানুষ! তোমরা সালাম প্রচার কর, অন্নদান কর, জ্ঞাতি-বন্ধন অক্ষুন্ন রাখ এবং লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা নামায পড়। তাহলে তোমরা নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১০নং)
“জান্নাতী হল তিন প্রকার ব্যক্তি; ন্যায়পরায়ণ দানশীল তওফীকপ্রাপ্ত শাসক, দয়াবান এবং প্রত্যেক আত্মীয় তথা মুসলিমের প্রতি কোমল-হৃদয়। আর (অশ্লীলতা ও যাচ্ঞা) থেকে পবিত্র সন্তানবান ব্যক্তি।” (মুসলিম)
“আল্লাহ সুবহানাহু অতাআলা ঐ দুটি লোককে দেখে হাসেন, যাদের মধ্যে একজন অপরজনকে হত্যা করে এবং দুজনই জান্নাতে প্রবেশ করবে। নিহত ব্যক্তিকে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা অবস্থায় কোন কাফের কর্তৃক) হত্যা করে দেওয়া হল। পরে আল্লাহ তাআলা হত্যাকারী কাফেরকে তওবা করার তাওফীক প্রদান করেন। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে যায়।” (বুখারী-মুসলিম)
আমি এক ব্যক্তিকে জান্নাতে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম। যে (পৃথিবীতে) রাস্তার মধ্য হতে একটি গাছ কেটে সরিয়ে দিয়েছিল, যেটি মুসলিমদেরকে কষ্ট দিচ্ছিল।” (মুসলিম)।
“যে ব্যক্তি দুই ঠাণ্ডা (অর্থাৎ, ফজর ও আসরের নামায পড়বে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (বুখারী-মুসলিম)।
যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তার দুই চোয়ালের মধ্যস্থিত অঙ্গ (জিহ্বা) ও দুপায়ের মাঝখানের অঙ্গ (লজ্জাস্থান)এর ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখবেন, সে জান্নাত প্রবেশ করবে।” (তিরমিযী হাসান)।
যে ব্যক্তির শেষ কথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হবে (অর্থাৎ এই কলেমা পড়তে পড়তে যার মৃত্যু হবে), সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (আবু দাউদ, হাকেম)।
“যে ব্যক্তি নিয়মনিষ্ঠভাবে দিরাত্রে বারো রাকআত নামায পড়বে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; যোহরের (ফরয নামাযের) পুর্বে (এক সালামে) চার রাকআত ও পরে দুই রাকআত, মাগরেবের পর দুই রাকআত, এশার পর দুই রাকআত এবং ফজরের (ফরযের) পূর্বে দুই রাকআত।” (নাসাঈ, এবং শব্দগুলি তারই, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহ তারগীব ৫৭৭নং
জান্নাতীরা জাহান্নামীদের ওয়ারেস হবে
কুরআন কারীমে বলা হয়েছে, জান্নাতীরা জান্নাতের ওয়ারেস হবে।
أُولَٰئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ (10) الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (11)
তারাই হবে উত্তরাধিকারী। উত্তরাধিকারী হবে ফিরদাউসের; যাতে তারা চিরস্থায়ী হবে। (মু’মিনুনঃ ১০-১১)
وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
অর্থাৎ, এটিই জান্নাত, তোমরা তোমাদের কর্মের ফলস্বরূপ যার অধিকারী হয়েছ। (যুখরুফঃ ৭২)
تِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي نُورِثُ مِنْ عِبَادِنَا مَن كَانَ تَقِيًّا
অর্থাৎ, এ হল সেই জান্নাত যার অধিকারী করব আমি আমার দাসদের মধ্যে সংযমশীলকে। (মারয়ামঃ ৬৩)।
وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي صَدَقَنَا وَعْدَهُ وَأَوْرَثَنَا الْأَرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَاءُ ۖ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ
অর্থাৎ, তারা (প্রবেশ করে) বলবে, প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির অধিকারী করেছেন; আমরা জান্নাতে যথা ইচ্ছা বসবাস করব। সদাচারীদের পুরস্কার কত উত্তম!’ (যুমারঃ ৭৪)।
কিন্তু ওয়ারেস মানেই মুওয়ারিস আছে। আর সেই মুওয়ারিস হল কাফেরদল। যেহেতু তারা জান্নাতের হকদার হতে পারত, কিন্তু নিজেদের দোষে সেই হক থেকে বঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে যাবে। আর তাদের জায়গার উত্তরাধিকারী বানানো হবে মুসলিমগণকে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন আল্লাহ প্রত্যেক মুসলমানকে একজন ইয়াহুদী অথবা খৃষ্টানকে দিয়ে বলবেন, এই তোমার জাহান্নাম থেকে বাঁচার মুক্তিপণ।” (মুসলিম)
এ কথার অর্থ অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, প্রত্যেকের জন্য বেহেস্তে একটি নির্দিষ্ট স্থান আছে এবং দোযখেও আছে। সুতরাং মু’মিন যখন বেহেশ্তে প্রবেশ করবে, তখন দোযখে তার স্থলাভিষিক্ত হবে কাফের। (ইবনে মাজাহ)
যেহেতু সে তার কুফরীর কারণে তার উপযুক্ত। আর ‘মুক্তিপণ’ অর্থ এই যে, তুমি দোযখের সম্মুখীন ছিলে; কিন্তু এটি হল তোমার মুক্তির বিনিময়। যেহেতু মহান আল্লাহ দোযখ ভরতি করার জন্য একটি সংখ্যা নির্ধারিত রেখেছেন। সুতরাং তারা যখন তাদের কুফরী ও পাপের কারণে সেখানে প্রবেশ করবে, তখন তারা হবে মুমিনদের মুক্তিপণ। আর মুমিনরা হবে কাফেরদের ওয়ারেস।
জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসী কারা?
জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসী হবে দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষ। মানুষের কাছে দুর্বল। মানুষ যাকে তার বিয়ের কারণে ছোট ভাববে, গরীবির কারণে ক্ষুদ্র ভাববে, তার ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করবে, তার উপর অত্যাচার করবে।
নবী (ﷺ) বলেছেন, “আমি জান্নাতের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশ অধিবাসীই গরীবদের দল। আর দোযখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশ অধিবাসীই মহিলা।” (বুখারী ও মুসলিম)
“আমি তোমাদেরকে জান্নাতীদের সম্পর্কে অবহিত করব না কি? (তারা হল) প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি এবং এমন ব্যক্তি যাকে দুর্বল মনে করা হয়। সে যদি আল্লাহর নামে কসম খায়, তাহলে তা তিনি নিশ্চয়ই পুরা করে দেন। আমি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সম্পর্কে অবহিত করব না কি? (তারা হল) প্রত্যেক রূঢ় স্বভাব, কঠিন হৃদয় দাম্ভিক ব্যক্তি।” (বুখারী, মুসলিম)
“একদা জান্নাত ও জাহান্নামের বিবাদ হল। জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে উদ্ধত ও অহংকারী লোকেরা থাকবে। আর জান্নাত বলল, দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা আমার ভিতরে বসবাস করবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে ফায়সালা করলেন যে, তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। এবং তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেব। আর তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব।” (মুসলিম)
“জান্নাতে এমন লোক প্রবেশ করবে যাদের অন্তর হবে পাখীর অন্তরের মত।” (মুসলিম)
জান্নাতে পুরুষের সংখ্যা বেশী হবে, না নারীর সংখ্যা?
উপরোল্লিখিত আলোচনায় বুঝা যায়, নারীরা অধিকাংশ জাহান্নামী হবে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, জান্নাতে নারীর সংখ্যা কম হবে। আসলে জান্নাতে জান্নাতী হুরীদেরকে নিয়ে নারীর সংখ্যাই অধিক হবে। অবশ্য এ কথাও সত্য যে, দুনিয়ার মহিলাদের অধিকাংশ জাহান্নামী হবে।
মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “(জান্নাতে) জান্নাতীদের পাত্র হবে স্বর্ণের, তাদের গায়ের ঘাম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের প্রত্যেকের জন্য এমন দু’জন স্ত্রী থাকবে, যাদের সৌন্দর্যের দরুন মাংস ভেদ করে পায়ের নলার হাড়ের মজ্জা দেখা যাবে।” (বুখারী-মুসলিম)
সুতরাং পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হবে জান্নাতে। আর জাহান্নামেও পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশী হবে। তবে তারা সবাই হবে দুনিয়ার মেয়ে।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের সবচেয়ে খারাপ মেয়ে তারা, যারা বেপর্দা, অহংকারী, তারা কপট নারী, তাদের মধ্যে লাল রঙের ঠোট ও পা বিশিষ্ট কাকের মত (বিরল) সংখ্যক বেহেশ্তে যাবে।” (বাইহাকী)
ভাববার বিষয় যে, দুনিয়াতে এই শ্রেণীর মহিলাই বেশী। আরো যে কারণে মহিলারা অধিকাংশ জাহান্নামে যাবে, তাও তাদের মাঝে কম নয়।
একদা নবী (ﷺ) (মহিলাদেরকে সম্বোধন করে) বললেন, “হে মহিলা সকল! তোমরা সাদকাহ-খয়রাত করতে থাক ও অধিকমাত্রায় ইস্তিগফার কর। কারণ আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসীরূপে দেখলাম।” একজন মহিলা নিবেদন করল, আমাদের অধিকাংশ জাহান্নামী হওয়ার কারণ কী? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “তোমরা অভিশাপ বেশি কর এবং নিজ স্বামীর অকৃতজ্ঞতা কর। বুদ্ধি ও ধর্মে অপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বিচক্ষণ ব্যক্তির উপর তোমাদের চাইতে আর কাউকে বেশি প্রভাব খাটাতে দেখিনি।” মহিলাটি আবার নিবেদন করল, বুদ্ধি ও ধর্মের ক্ষেত্রে অপূর্ণতা কী? তিনি বললেন, “দু’জন নারীর সাক্ষ্য একটি পুরুষের সাক্ষ্য সমতুল্য। (প্রসবোত্তর খুন ও মাসিক আসার) দিনগুলিতে মহিলা নামায পড়া বন্ধ রাখে।” (মুসলিম)।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি দেখলাম, জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসিনীহল মহিলা।” সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, তা কী জন্য হে আল্লাহর রসূল?’ বললেন, “তাদের কুফরীর জন্য।” তাঁরা বললেন, ‘আল্লাহর সাথে কুফরী? তিনি বললেন, “(না, তারা স্বামীর কুফরী (অকৃতজ্ঞতা) ও নিমকহারামি করে। তাদের কারো প্রতি যদি সারা জীবন এহসানী কর, অতঃপর সে যদি তোমার নিকট সামান্য ত্রুটি লক্ষ্য করে, তাহলে বলে বসে, তোমার নিকট কোন মঙ্গল দেখলাম না আমি!” (বুখারী, মুসলিম)
মৃত শিশুদের জান্নাত-জাহান্নাম
কাফের কুফরীর কারণে জাহান্নামে যাবে, আর মুমিন ঈমানের কারণে যাবে জান্নাতে। কিন্তু তাদের অবস্থা কী হবে, যাদের কুফরী শু ঈমান নেই। শিশু, পাগল ও এমন মানুষ, যার কাছে ইসলামের দাওয়াত আদৌ পৌছেনি, তার অবস্থা পরকালে কী হবে? মুমিনদের শিশু জান্নাতী পিতা-মাতার সাথে জান্নাতে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُم مِّنْ عَمَلِهِم مِّن شَيْءٍ ۚ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ
অর্থাৎ, যারা বিশ্বাস করে আর তাদের সন্তান-সন্ততি বিশ্বাসে তাদের অনুগামী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং তাদের কর্মফল আমি কিছুমাত্র হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ। (তুরঃ ২১)।
ঐ শিশুরা শুধু জান্নাতে যাবে তাই নয়, বরং পিতা-মাতা দোযখ যাওয়ার হকদার হলে, মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদেরকে বেহেশতে আনার চেষ্টা করবে।
নবী (ﷺ) বলেন, “সেই সত্তার শপথ; যার হাতে আমার প্রাণ আছে! গভচ্যুত (মৃত) শিশু তার নাভির নাড়ী ধরে নিজের মাতাকে জান্নাতের দিকে টেনে নিয়ে যাবে—যদি ঐ মা (তার গর্ভপাত হওয়ার সময়) ঐ সওয়াবের আশা রাখে তবে।” (সহীহ ইবনে মাজাহ ১৩০৫নং)।
অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী, সে তার পিতা-মাতার কাপড় ধরে জান্নাতে নিয়ে যাবে। ( সিঃ সহীহাহ ৪৩২নং)
তিনি আরো বলেছেন, “যে মহিলার তিনটি শিশু মারা যাবে, সেই মহিলার জন্য ঐ শিশুরা জাহান্নাম থেকে পর্দা স্বরূপ হবে।” এক মহিলা বলল, আর দুটি মারা গেলে?” তিনি বললেন, “দুটি মারা গেলেও। (তারাতার মায়ের জন্য জাহান্নাম থেকে পর্দা হবে।)” (বুখারী ১০ ১ নং, মুসলিম ২৬৩৩ নং)
বলাই বাহুল্য যে, যে অপরের জন্য জাহান্নামের পর্দা হবে, সে কি জাহান্নামে যাবে? বরং উভয়েই জান্নাতে যাবে। আর এ কথা স্পষ্টভাবে একাধিক হাদীসেও এসেছে যে, মুমিনদের শিশু-সন্তানরাও জান্নাতে যাবে। (দঃ ফাতহুল বারী ৩/২৪৫)।
এই শিশুরা পিতামাতার জন্য জান্নাতে পূর্ব-প্রেরিত ব্যবস্থাপকের মত হবে। তারা ইব্রাহীম নবী (আঃ) এর তত্ত্বাবধানে মধ্যজগতে বাস করবে।
সহীহ বুখারীর ১৩৮৬ নং বর্ণনায় একটি দীর্ঘ হাদীস এসেছে। যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। দীর্ঘ হাদীসের এক পর্যায়ে এসেছেঃ “আমরা চলতে চলতে একটি সবুজ বাগানে উপস্থিত হলাম। এতে একটি বড় গাছ ছিল। গাছটির গোড়ায় একজন বয়ঃবৃদ্ধ লোক ও বেশ কিছু বালক বালিকা ছিল।……..”।
এর ব্যাখ্যায় পরে এসেছে-“গাছের গোড়ায় যে বৃদ্ধ ছিলেন, তিনি ইবরাহীম আলাইহি সালাম এবং তাঁর চারপাশের বালক-বালিকারা মানুষের সন্তান”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৩৮৬, ইফাবা-১৩০৩]
তবে নির্দিষ্টভাবে কোন শিশুকে জান্নাতী বলে আখ্যায়ন করা যাবে না। যেমন জান্নাতের কাজ করলেও নির্দিষ্ট করে কোন মুসলিমকে জান্নাতী বলে বিশ্বাস করা যাবে না। (মাজমূউ ফাতাওয়া ৪/২৮১)।
আখেরাতে আল্লাহা তায়ালা তাদের সাথে কি আচারণ করবেন এটি তার বিষয়। কেননা এসম্পর্কে রাসূল (স) কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: الله أعلم بما كانوا عاملين “তাদের কর্মের ব্যপারে আল্লাহই ভালো জানেন।” (বুখারী:৬৫৯৭, মুসলিম:২৬৬০)
অমুসলিমরা অমুসলিম হলেও তাদের শিশু সন্তানরা অমুসলিম নয়। সুতরাং তারা যে জাহান্নামে যাবে না, তা নিশ্চিত। কারণ আল্লাহ কারো প্রতি অনু পরিমাণও অবিচার করবেন না।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ، كَمَثَلِ البَهِيمَةِ تُنْتَجُ البَهِيمَةَ هَلْ تَرَى فِيهَا جَدْعَاءَ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার মাতাপিতা তাকে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান অথবা অগ্নি উপাসকরূপে রূপান্তরিত করে। যেমন চতুষ্পদ জন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে [জন্মগত] কানকাটা দেখেছ? [বুখারী, হাদীস নং-১৩৮৫]
পক্ষান্তরে কাফেরদের শিশু-সন্তান, অনুরূপ যারা প্রকৃতই ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানেনি, শুনেনি তাদের কাছে এবং পাগলদের কাছে কিয়ামতে আল্লাহর আনুগত্যের উপর এক পরীক্ষা নেওয়া হবে। তাতে যারা উত্তীর্ণ হবে, তারা জান্নাতবাসী এবং অবশিষ্ট দোযখবাসী হবে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ৩/২৯-৩২)।
আল্লাহ তায়লা কেয়ামতের দিন তাদের সকলের সামনে উপস্থাপন করবেন এবং তাদের সময়কার লোকদের যে পরিক্ষা করা হয়েছে তাদেরও তেমন পরিক্ষা করা হবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের নিকট একজন রাসূল পাঠাবেন। যারা তার আনুগত্য করবে তারা জান্নাতী আর যারা তার অবাধ্য হবে তারা জাহান্নামী। ( মাজমুউল ফতোয়া: ইবনে বায)।
অপরদিকে মুসলিম সন্তানরা যদি শিরক করে এবং এই অবস্থায় মারা যায় তবে তাদেরও কাফির বলা যাবেনা। কেননা রাসূল (স:)
رُفِع القَلمُ عن ثلاثةٍ: عن النَّائمِ حتَّى يستيقظَ، وعن الصَّبي حتَّى يحتلِمَ، وعن المجنونِ حتَّى يَعقِلَ
“ তিন ব্যক্তির উপর থেকে (শরীয়তের ) কলম তুলে নেওয়া হয়েছে। ১. ঘুমন্ত ব্যক্তি যথক্ষণ পর্যন্ত সে জাগ্রত না হবে। ২. শিশু থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত সে বালেগ না হবে। ৩. পাগলের উপর থেকে যথক্ষণ পর্যন্ত সে জ্ঞান ফিরে পাবে। ( মুসনাদে আহমাদ: ২৪১৪৫)।
জান্নাতের সর্দারগণ
জান্নাতে সবাই যুবক-যুবতী। তবুও পার্থিব জীবনের প্রতি লক্ষ্য রেখে জান্নাতে বৃদ্ধদের সর্দার থাকবেন এবং যুবকদেরও সর্দার থাকবেন, যেমন সর্দার থাকবেন মহিলাদেরও।
বৃদ্ধদের সর্দার হবেন আবু বাকর ও উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)। (সিঃ সহীহাহ ৮২৪নং)
যুবকদের সর্দার হবেন হাসান ও হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)। ( তিরমিযী, হাকেম, তাবারানী, আহমাদ)
মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জান্নাতবাসিনী হবেন খাদীজা, ফাতেমা, মারয়াম ও আসিয়া। (সিঃ সহীহাহ ১৫০৮নং)
মহানবী (ﷺ) মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন, “হে ফাতেমা! তুমি কি এটা পছন্দ কর না যে, মুমিন নারীদের তুমি সর্দার হবে অথবা এই উম্মতের নারীদের সর্দার হবে?” (বুখারী, শব্দাবলী মুসলিমের)
অবশ্য মারয়ামই তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী। যেহেতু তিনি একজন নবীর মা। আর তার জন্য মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَإِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاكِ وَطَهَّرَكِ وَاصْطَفَاكِ عَلَىٰ نِسَاءِ الْعَالَمِينَ
অর্থাৎ, (স্মরণ কর) যখন ফিরিশ্তাগণ বলেছিল, ‘হে মারয়াম! আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বের নারীদের মধ্যে তোমাকে নির্বাচিত করেছেন। (আলে ইমরানঃ ৪২)
জান্নাতীদের আকৃতি-প্রকৃতি
মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ (22) عَلَى الْأَرَائِكِ يَنظُرُونَ (23) تَعْرِفُ فِي وُجُوهِهِمْ نَضْرَةَ النَّعِيمِ (24)
অর্থাৎ, পুণ্যবানগণ তো থাকবে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে। তারা সুসজ্জিত আসনে বসে দেখতে থাকবে। তুমি তাদের মুখমন্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের সজীবতা দেখতে পাবে। (মুতাফফিফীনঃ ২২-২৪)।
জান্নাতীগণ জান্নাতে পরিপূর্ণ নেয়ামত লাভ করবে। নিজ দেহ ও আকৃতি-প্রকৃতিতেও পরিপূর্ণ শক্তি ও সৌন্দর্য লাভ করবে। সকলেই আদি পিতা আদম (আঃ)-এর মত দীর্ঘ দেহী হবে ষাট হাত। তাদের হৃদয়ও হবে একটি মানুষের হৃদয়ের মতো, পবিত্র ও নির্মল।
জান্নাতে জান্নাতীরা অসীম রূপবান ও রূপবতী হবে। তাদের অপ্রয়োজনীয় কোন লোম থাকবে না। পুরুষদের গোঁফ-দাড়িও থাকবে না। চক্ষুযুগল হবে কাজলবরণ। সকলেই হবে ৩৩ বছরের যুবক।
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “জান্নাতের প্রথম প্রবেশকারী দলটির আকৃতি পূর্ণিমা রাতের চাঁদের মত হবে। অতঃপর তাদের পরবর্তী দলটি আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় জ্যোতির্ময় হবে। তারা (জান্নাতে) পেশাব করবে না, পায়খানা করবে না, থুথু ফেলবে না, নাক ঝাড়বে না। তাদের চিরুণী হবে স্বর্ণের। তাদের ঘাম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধ কাঠ। তাদের স্ত্রী হবে আয়তলোচনা হুরগণ। তারা সকলেই একটি মানব কাঠামো, আদি পিতা আদমের আকৃতিতে হবে (যাদের উচ্চতা হবে) ষাট হাত পর্যন্ত।” (বুখারী-মুসলিম)
বুখারী-মুসলিমের আর এক বর্ণনায় আছে, “(জান্নাতে) তাদের পাত্র হবে স্বর্ণের, তাদের গায়ের ঘাম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের প্রত্যেকের জন্য এমন দু’জন স্ত্রী থাকবে, যাদের সৌন্দর্যের দরুন মাংস ভেদ করে পায়ের নলার হাড়ের মজ্জা দেখা যাবে। তাদের মধ্যে কোন মতভেদ থাকবে না। পারস্পরিক বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের সকলের অন্তর একটি অন্তরের মত হবে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় তাসবীহ পাঠে রত থাকবে।”
রাসুলল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “জান্নাতবাসীরা জান্নাতের মধ্যে পানাহার করবে; কিন্তু পায়খানা করবে না, তারা নাক ঝাড়বে না, পেশাবও করবে না। বরং তাদের ঐ খাবার ঢেকুর ও কস্তুরীবৎ সুগন্ধময় ঘাম (হয়ে দেহ থেকে বের হয়ে যাবে)। তাদের মধ্যে তাসবীহ ও তাকবীর পড়ার স্বয়ংক্রিয় শক্তি প্রক্ষিপ্ত হবে, যেমন শ্বাসক্রিয়ার শক্তি স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে।” (মুসলিম)
তিনি আরো বলেন, “জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন তারা লোম ও শুশ্রুবিহীন হবে। যেন তাদের চোখে সুরমা লাগানো হয়েছে। তাদের বয়স হবে (ত্রিশ অথবা) তেত্রিশ।” (আহমাদ, তিরমিযী)
দুনিয়াতে বিশ্রাম গ্রহণকারীরা বিশ্রাম নেয়। কোন ক্লান্তি থেকে আরাম নেয় ও গভীরভাবে নিদ্রা যায়। জান্নাতে কোন ক্লান্তি নেই, নিদ্রা নেই। নিদ্রা হলে যে আরাম ও আনন্দ চলে যাবে। তাছাড়া নিদ্রা হল এক প্রকার মৃত্যু। জান্নাতে কোন প্রকার মৃত্যু নেই। (সিঃ সহীহাহ ১০৮৭নং)
মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “যদি জান্নাতী কোন মহিলা পৃথিবীর দিকে উকি মারে, তাহলে আকাশ-পৃথিবীর মধ্যবর্তী সকল স্থান উজ্জ্বল করে দেবে! উভয়ের মাঝে সৌরভে পরিপূর্ণ করে দেবে! আর তার মাথায় ওড়নাখানি পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থিত সকল বস্তু হতে শ্রেষ্ঠ।” (বুখারী)।