দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
গোসল
Power point Presentation
গোসল এর আভিধানিক অর্থ-ধৌত করা।পারিভাষিক অর্থ- ইবাদতের উদ্দেশ্যে, নির্দিষ্ট নিয়মে, পবিত্র পানি দ্বারা সর্ব শরীর ধৌত করার নাম গোসল। (ফিকহুল মুয়াস্সার, মুজাম্মা মালিক ফাহ্দ, পৃঃ ২৮) গোসল সাধারণত দু’প্রকার। যথা:
(১) ফরয: ঐ গোসলকে বলা হয়, যা করা অপরিহার্য। বালেগ বয়সে নাপাক হ’লে গোসল ফরয হয়। যেমন- আল্লাহ বলেন, وَ إِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوْا ‘যদি তোমরা নাপাক হয়ে থাক, তবে গোসল কর।’ (মায়েদাহ ৬)।
(২) মুস্তাহাব: ঐ গোসলকে বলা হয়, যা অপরিহার্য নয়। কিন্তু করলে নেকী আছে। যেমন- জুম‘আর দিনে বা দুই ঈদের দিনে গোসল করা। সাধারণ গোসলের পূর্বে ওযু করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। সাইয়িদ সাবিক্ব একে ‘মানদূব’ (পছন্দনীয়) বলেছেন। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪১)
যে সকল কারণে গোসল করা সুন্নাত:
(ক) সহবাসের পরে পুনরায় সহবাসে লিপ্ত হ’তে চাইলে ওযু গোসল করা সুন্নাহ করা। (আবূ দাঊদ ২১৯, আহমাদ ২৩৩৫০ মিশকাত ৪৭০)।
(খ) জুম‘আর সালাতের জন্য গোসল করা সুন্নত (সহীহ: বুখারী ৮৭৭, মুসলিম ৮৪৪, নাসায়ী ১৩৭৬, সহীহ আল জামি‘ ৪৫৮ মিশকাত, ৫৩৭)।
(গ) দুই ঈদের দিনে গোসল করা সুন্নত। (সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী, ‘দুই ঈদের ছালাত’ অনুচ্ছেদ, হা/৬৩৪৩ ইরওয়া হা/১৪৬)।
(ঘ) হজ্জ ও ওমরার ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোসল করা সুন্নত। (তিরমিয়ী ৮৩০, দারেমী ১৭৯৪ বুলুগুল মারাম,৭৩০)।
(ঙ) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার পরে গোসল করা সুন্নত। (সহীহ আবূ দাঊদ ৩১৬১, তিরমিযী ৯৯৩, ইবনু মাজাহ্ ১৪৬৩, ইরওয়া ১৪৪, আহমাদ ৯৮৬২, মিশকাত, ৫৪১)।
(চ) কোন অমুসলিম ইসলাম কবুল করলে গোসল করা সুন্নত (আবু দাউদ,৩৫৫ মিশকাত হা/৫৪৩)।
গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ সমূহ:
(ক) মসজিদে অবস্থান করা। তবে মসজিদে অবস্থান না করে তা অতিক্রম করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ جُنُبًا إِلاَّ عَابِرِيْ سَبِيْلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوْا ‘আর অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।’ (নিসা ৪৩)।
(খ) কুরআন স্পর্শ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَ يَمَسُّهُ إِلاَّ الْمُطَهَّرُوْنَ ‘কেউ তা (কুরআন) স্পর্শ করে না পবিত্রগণ ব্যতীত’ (ওয়াকিয়া ৭৯)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلا طَاهِرٌ. ‘কুরআন স্পর্শ করে না পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত’। (তিরমিযী ১/১৪৬; আহমাদ হা/৬৩৯, ৮৭২;বুখারী, মিশকাত হা/৪৫১)।
(গ) সালাত আদায় করা। সালাত সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত হলো,ছোট ও বড় উভয় প্রকার নাপাকী হ’তে পবিত্রতা অর্জন করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُوْرٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُوْلٍ. ‘পবিত্রতা ব্যতীত সালাত এবং হারাম মালের দ্বারা দান কবুল হয় না’। (সহীহ মুসলিম ২২৪ বুখারী হা/৩৩১)।
(ঘ) পবিত্র কা‘বা গৃহ তাওয়াফ করা। বিনা ওযুতে কাবাঘর তওয়াফ করা নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে,
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কাবাঘরে তাওয়াফ করা নামাযতুল্য।” (সূনানে নাসাঈ: ২৯২০)। অপর এক হাদীসে আয়েশা (রা) কে সম্বােধন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,“পবিত্র না হয়ে আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করো না।” (সহীহ বুখারী: ২৯৪ ও ৩০৫ সহীহ মুসলিম, ২৯৭৭)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
উপস্থাপনায়, জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
গোসলের ফরয তিনটি।
যথা:
(ক) নিয়ত করা।
(খ) নাক ও মুখে পানি দেয়া
(গ) সমস্ত শরীরে পানি প্রবাহিত করা।
ফরয গোসলের পদ্ধতি:
১) প্রথমে নিয়ত করবে
২) অতঃপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলে দু’হাত কব্জি পর্যন্ত তিন বার ধৌত করবে।
৩) লজ্জাস্থানে পানি ঢেলে তা পরিস্কার করবে।
৪) অতঃপর পূর্ণরূপে ওযু করবে।
৫) মাথায় পানি ঢেলে আঙ্গুল চালিয়ে চুল খিলাল করবে।
৬) যখন বুঝবে চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছে গেছে তখন মাথায় তিন বার পানি ঢালবে
৭) এবং সমস্ত শরীরে পানি ঢালবে।
– এ ক্ষেত্রে ডান সাইড থেকে কাজ আরম্ভ করবে।
মা আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর গোসলের বর্ণনা এরূপই এসেছে। (বুখারী ও মুসলিম)
উপরোক্ত পদ্ধতি হল পরিপূর্ণ ও সুন্নতী পদ্ধতি। তবে কেউ যদি সুন্নতী পদ্ধতি ফলো না করে কেবল ফরজগুলো আদায় করে তাহলে তা পবিত্র হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে সুন্নত অনুসরণ করে গোসল করা উত্তম তাতে কোন সন্দেহ নাই।
▪ মহিলাদের মাথার চুলে যদি ঝুঁটি বাধা থাকে তাহলে তা খোলা জরুরি নয়। বরং চুলের গোড়ায় গোড়ায় পানি পৌঁছলেই যথেষ্ট ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু আলাম।
রোগ-জনিত কারণে যদি কারো লাগাতার বীর্য, মযী, স্রাব বা ইস্তিহাযার খুন ঝরে তবে তার জন্য গোসল ফরয নয়; প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযুই যথেষ্ট। এই সকল অবস্থায় নামায মাফ নয়। (আবূদাঊদ, মিশকাত ৫৬০-৫৬১)। সতর্কতার বিষয় যে, নাপাকী দূর করার জন্য কেবল গা-ধোয়া বা গা ডুবিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। পূর্বে ওযু করে যথানিয়মে গোসল করলে তবেই পূর্ণ গোসল হয়। নচেৎ অনেকের মতে কুল্লি না করলে এবং নাকে পানি না নিলে গোসলই শুদ্ধ হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ১/৩০৪)।
নিম্নে কেবল মুস্তাহাব এবং মুবাহ (সাধারণ) গোসলের পদ্ধতি ও ইসলামি আদব (শিষ্টাচার) সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
১) মুস্তাহাব (উত্তম) গোসল হোক বা মুবাহ (বৈধ) হোক- সওয়াবের নিয়ত করা। ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব এসেছে। তাই গোসলের সময় কেউ যদি সওয়াবের নিয়ত করে তাহলে মহান আল্লাহ তাকে তা দান করবেন ইনশাআল্লাহ। (দুনিয়াবি কাজও কেউ যদি সৎ নিয়তে সম্পাদন করে তাতেও সওয়াব হয়-আল হামদুলিল্লাহ।
২) গোসলের পূর্বে বিসমিল্লাহ বলা। (গোসলখানায় থাকা অবস্থায় মনে মনে বিসমিল্লাহ বলবে এবং অন্যান্য জিকির-আজকার মুখে উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকবে)।
৩) পবিত্র পানি দ্বারা গোসল করা।
৪) শরীরে কমপক্ষে তিন বার পানি ঢালা অথবা নদী-পুকুরে গোসল করলে কম পক্ষে তিন বার ডুব দেয়া উত্তম। তবে এর চেয়ে কম বা বেশি হলেও কোন আপত্তি নাই।
৫) প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অপচয় না করা।
৬) শরীরে পানি ঢালার ক্ষেত্রে ডান দিক থেকে শুরু করা উত্তম।
৭) এমনভাবে শরীর ধৌত করা যেন, শরীর থেকে ময়লা ও দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়।
৮) যথাসম্ভব গোসলখানা বা ঘেরা স্থানে গোসল করা। (মহিলাদের পর্দা সহকারে গোসল করা আবশ্যক-যেন গোসল অবস্থায় তার দিকে কোনভাবে পরপুরুষের দৃষ্টি না যায়)।
৯) বাইরে গোসল করার প্রয়োজন হলে লজ্জাস্থান যেন প্রকাশিত না হয় অথবা ভেজা কাপড়ের উপর দিয়ে শরীরের গোপনাঙ্গ ফুটে না উঠে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা।
১০) গোসলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় অপচয় না করা (যা কিছু মানুষের বদ অভ্যাস)। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
কিছু সাধারন প্রশ্নের সমাধানঃ
১। নীচের দুটো আলামতের কোন একটির মাধ্যমে হায়েয থেকে পবিত্র হওয়া জানা যায়:
১। সাদা স্রাব নির্গত হওয়া। সেটা হচ্ছে স্বচ্ছ পানি; নারীরা যে পানিটা চিনে থাকে।
২। স্থানটি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ স্থানটির ভেতরে যদি কটন বা এ জাতীয় অন্য কিছু রাখা হয় তাহলে পরিষ্কার বেরিয়ে আসে। কটনের মধ্যে রক্তের দাগ, হলেদেটে বা লালচে দাগ থাকে না।
নারীর উচিত গোসল করার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করা; যাতে করে পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন:
হায়েযের আগমন ও প্রস্থান শীর্ষক পরিচ্ছেদ। নারীরা আয়েশা (রাঃ) এর কাছে ন্যাকড়ার থলেটি পাঠাত; যে ন্যাকড়াতে হলদেটে পানি থাকত। তখন তিনি বলতেন: তোমরা তাড়াহুড়া করো না; যতক্ষণ পর্যন্ত না সাদা স্রাব দেখতে পাও। তিনি এর দ্বারা উদ্দেশ্য করেছেন: হায়েয থেকে পবিত্রতা। যায়েদ বিন ছাবেতের মেয়ের কাছে খবর পৌঁছেছে যে, নারীরা রাতের বেলায় পবিত্রতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য চেরাগ চেয়ে পাঠাত। তখন তিনি বললেন: আগের নারীরা তো এভাবে করতেন না। তিনি তাদের এ কর্মের সমালোচনা করলেন।”[সমাপ্ত]
দুই:
যদি কোন নারী ফজরের আগে তার পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় তাহলে তার উপর রোযা রাখা আবশ্যক হবে
আর যদি পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হন তাহলে তার রোযা সহিহ হবে না; এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে, সারাদিনে তার থেকে কোন কিছু নির্গত হয়নি তবুও। কেননা হায়েয বন্ধ হয়ে গেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া ছাড়া রোযার নিয়ত করা শুদ্ধ নয়।
তিন:
যদি কোন নারী পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে প্রথম রাত্রিতে গোসল করে ফেলেন; এরপর ফজরের আগে পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত হন এবং পুনরায় গোসল না করে রোযা রাখেন ও নামায পড়েন তাহলে তার রোযা সহিহ হবে; কিন্তু নামায সহিহ হবে না। কারণ রোযার জন্য কেবল হায়েযের রক্ত বন্ধ হওয়া শর্ত; যদি গোসল নাও করে। কিন্তু নামাযের জন্য অবশ্যই গোসল করতে হবে। আর হায়েযের রক্ত বন্ধ হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যাওয়ার কারণে তার প্রথম গোসল শুদ্ধ নয়।
“মুনতাহাল ইরাদাত” গ্রন্থে (১/৫২) বলেন: “‘হায়েয ও নিফাসের গোসল করার জন্য শর্ত হল এ দুটো থেকে অবসর হওয়া।’ অর্থাৎ হায়েয ও নিফাস বন্ধ হওয়া। যেহেতু এ দুটো চলমান থাকাটা গোসলের সাথে সাংঘর্ষিক”।[সমাপ্ত]
“কাশ্শাফুল ক্বিনা” গ্রন্থে (১/১৪৬) গোসল ফরয হওয়ার কারণগুলো সম্পর্কে বলেন: “পঞ্চম কারণ হল: হায়েয নির্গত হওয়া”। দলিল হচ্ছে ফাতিমা বিনতে আবি হুবাইশ (রাঃ)কে লক্ষ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “(হায়েয) যখন চলে যাবে তখন গোসল করে নামায পড়বে”।[মুত্তাফাকুন আলাইহি]
এবং তিনি উম্মে হাবিবা (রাঃ), সাহলা বিনতে সুহাইল (রাঃ) ও হামনা (রাঃ) প্রমুখ নারীদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এর পক্ষে সমর্থন রয়েছে আল্লাহ্তাআলার এই বাণীতে: “তারপর তারা যখন প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে তখন তাদের কাছে যাও।” [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২২] অর্থাৎ তারা যখন গোসল করবে। এখানে স্ত্রী গোসল করার আগে স্বামীকে সহবাস করতে বারণ করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, গোসল করা ওয়াজিব। কারণের সাথে বিধানকে সম্পৃক্ত করার হেতুবশতঃ রক্তপাত শুরু হওয়ার মাধ্যমেই গোসল ফরয হয়েছে। আর রক্তপাত বন্ধ হওয়া গোসল শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত।[সমাপ্ত]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
আমার নখ যদি লম্বা থাকে ও অপ রিচ্ছন্ন থাকে তাহলে কি আমার গোসল বাতিল হয়ে যাবে? গোসলকালীন সময়ে যা কিছু গোসলকে বাতিল করে দেয় আমি ঐ বিষয়গুলো জানতে চাই। উদাহরণতঃ গোসলকালীন সময়ে পানি ফ্লোরে পড়ে ছিটা আসা। এতে করে কি গোসল বাতিল হবে?
উত্তর
আলহামদু লিল্লাহ।.
গোসল সহিহ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে। যদি এ শর্তগুলো পূরণ না হয় তাহলে গোসল বাতিল হয়ে যাবে। শর্তগুলো হচ্ছে:
প্রথম শর্ত: নিয়ত
রাসূলুল্লাহ্সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক আমল নিয়ত অনুযায়ী (ধর্তব্য) হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে সেটাই তার প্রাপ্য।”[সহিহ বুখারী (১) ও সহিহ মুসলিম (১৯০৭)]
তাই তার গোসলের শুরুতে এ গোসলের মাধ্যমে জানাবাত (অপবিত্রতা) উত্তোলন করার নিয়ত করতে হবে।
শাইখ ইয্যুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম (রহঃ) বলেন:
নিয়তের উদ্দেশ্য হচ্ছে— ইবাদতগুলোকে অভ্যাসসমূহ থেকে পৃথক করা কিংবা ইবাদতগুলো থেকে অভ্যাসগুলোকে পৃথক করার সময় ইবাদতগুলোর স্তরভেদ নির্ধারণ করা। এর কিছু উদাহরণ হল
১। আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে যেমন গোসল করা হয়; সেটা হল নাপাকি থেকে; আবার মানুষের বিভিন্ন উদ্দেশ্য যেমন- ঠাণ্ডা লাভ, পরিচ্ছ্ন্নতা অর্জন, চিকিৎসা কেন্দ্রিক কিংবা ময়লা-আবর্জনা দূর করা ইত্যাদি উদ্দেশ্য থেকেও গোসল করা হয়। এই উদ্দেশ্যগুলোর প্রেক্ষিতে যেহেতু গোসল করা হয়ে থাকে তাই কোনটি আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিলের জন্য করা হয় আর কোনটি মানুষের নানা উদ্দেশ্য থেকে করা হয় সেটা পৃথক করা আবশ্যকীয়।[কাওয়ায়েদুল আহকাম (১/২০) থেকে সমাপ্ত]
গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
আমি পবিত্র অব্স্থায় গোসল করেছি বিধায় বড় অপবিত্রতা দূর করার নিয়ত করিনি। গোসল করার শেষে আমার মনে পড়ল যে, গোসল করার আগে আমি জুনুব (অপবিত্র) ছিলাম। তাই আমার উপর কি পুনরায় গোসল করা আবশ্যকীয়; নাকি আমি ঐ গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা লাভ করেছি?
জবাবে তারা বলেন: যদি আপনি পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও ঠাণ্ডা লাভের নিয়তে গোসল করে থাকেন তাহলে আপনার উপর আবশ্যক পুনরায় বড় পবিত্রতা উত্তোলন করার নিয়তে গোসল করা। কেননা আপনি প্রথম গোসলের মাধ্যমে নিয়ত করেননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমলগুলো নিয়ত দ্বারা হয়ে থাকে”।
[আল-লাজনাদ দায়িমা লিল বুহুছি ওয়াল ইফতা: সালেহ আল-ফাওযান, আব্দুল আযিয আলে শাইখ, আব্দুল্লাহ্বিন গাদইয়ান, আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ্বিন বায। [ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা (৪/১৩৩) থেকে সমাপ্ত]
দ্বিতীয় শর্ত: গোসলের পানি পবিত্র হওয়
ইবনে আব্দুল বার (রহঃ) বলেন: পানি হয়তো নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হবে কিংবা অন্য কিছু দ্বারা পরিবর্তিত হবে। যদি নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হয় তাহলে আলেমগণ ইজমা করেছেন যে, সেই পানি অপবিত্র ও অ-পবিত্রকারী।[আত্-তামহীদ (১৯/১৬)
তাই কেউ যদি গোসল শুরু করে, এরপর খেয়াল করে যে, পানি নাপাক তাহলে তার কর্তব্য হল: পবিত্র পানি দিয়ে পুনরায় গোসল করা।
পক্ষান্তরে যে পানির ছিটা এসে পড়ে ও গোসলকারীর শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ে সেই পানি পবিত্র।
ইবনুল মুনযির (রহঃ) বলেন:
আলেমগণ এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, যে অপবিত্র ব্যক্তির শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নাপাকি নাই সে যদি তার মুখে ও হাতে পানি ঢালে এবং সে পানি তার উপর দিয়ে, তার কাপড়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে সে পানি পবিত্র। কারণ সেটা পবিত্র পানি পবিত্র শরীরে লেগেছে…।
আলেমদের ইজমার মধ্যে রয়েছে যে, ওযুকারী ও গোসলকারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেগে থাকা পানি ও ফোঁটা ফোঁটা করে কাপড়ের উপর পড়া পানি পবিত্র: এটি ব্যবহৃত পানি পবিত্র হওয়ার দলিল।[আল-আওসাত (১/২৮৮) থেকে সমাপ্ত]
যদি কোন মুসলিম পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করে এবং সেই পানি পবিত্র ফ্লোরের উপর পড়ে অতঃপর সেই পানির ছিটা পুনরায় শরীরে পড়ে তাহলে সেটা গোসলের শুদ্ধতার উপর বা শরীরের পবিত্রতার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না।
বর্তমান যুগের গোসলখানাগুলো: মলত্যাগের স্থান গোসলের স্থান থেকে আলাদা। তাই গোসলের স্থান নাপাক হয় না। গোসলের ফ্লোরের ব্যাপারে নিছক সন্দেহ ধর্তব্য নয়; যাতে করে ওয়াসওয়াসার পথ উন্মুক্ত না হয় এবং ফ্লোরে পড়া পানিকে কিংবা গোসলকালে গায়ে পড়া পানির ছিটাকে নাপাক বলে হুকুম দেয়া যায় না। হ্যাঁ; যে ফ্লোরে গোসল করা হচ্ছে সেই ফ্লোরে নাপাকি আছে মর্মে যদি জানা যায় তাহলে ভিন্ন কথা।
তৃতীয় শর্ত: গোটা দেহে পানি পৌঁছা। যাতে করে শরীরে এমন কিছু না থাকে যা পানি চামড়ায় পৌঁছা বা চুলে পৌঁছাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ জানাবাত বা অপবিত্রতা গোটা দেহের সাথে সম্পৃক্ত।
ইমাম নববী বলেন: “তারা এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, জানাবাত গোটা দেহে আপতিত হয়।”[আল-মাজমু (১/৪৬৭) থেকে সমাপ্ত]
তাই চামড়ার উপরে যদি কোন ডাক্তারি প্লাস্টার থাকে কিংবা চুলের উপর এমন কোন পদার্থ থাকে বা চমড়ার উপর থাকে যা পানি পৌঁছতে বাধা দেয় তাহলে এমতাবস্থায় গোসল শুদ্ধ হবে না। অবশ্যই এ জিনিসগুলো দূর করতে হবে যাতে করে গোসল শুদ্ধ হয়।
লম্বা নখের নীচে ময়লা থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির তারল্যের কারণে সেটি নখের নীচে পানি পৌঁছতে বাধা সৃষ্টি করে না। যদি বাধা সৃষ্টি করে তাহলে সেটি যৎসামান্য বিধায় ক্ষমার্হ। তাছাড়া যেহেতু এটি মানুষের মাঝে ঘটাটা প্রসিদ্ধ; কিন্তু শরিয়ত ওযু বা গোসলকালে নখের নীচে পানি পৌঁছানো নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়নি।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন:
যদি নখের নীচে ময়লা থাকে: যদি তা কম হওয়ায় নখের নীচে পানি পৌঁছতে বাধা না দেয় তাহলে ওযু শুদ্ধ। আর যদি বাধা দেয়: সেক্ষেত্রে মুতাওয়াল্লি অকাট্যভাবে বলেছেন যে, যথেষ্ট হবে না এবং অপবিত্রতা দূর করবে না। যেমনিভাবে শরীরের অন্য জায়গায় ময়লা থাকলেও অপবিত্রতা দূর হত না।
আল-গাজালি “আল-ইহইয়া” গ্রন্থে নিশ্চিত করেন যে, যথেষ্ট হবে এবং ওযু-গোসল শুদ্ধ হবে এবং প্রয়োজনের কারণে এটি ক্ষমার্হ। তিনি বলেন: যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নখ কাটার নির্দেশ দিতেন, নখের নীচের ময়লাকে অপছন্দ করতেন; কিন্তু পুনরায় নামায পড়ার নির্দেশ দেননি।[আল-মাজমু (১/২৮৭) থেকে সমাপ্ত]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:
যদি যৎসামান্য নখের ময়লা পানি পৌঁছতে বাধা দেয় তাহলেও পবিত্রতা অর্জন শুদ্ধ হবে।[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (৫/৩০৩) থেকে সমাপ্ত]
এই পয়েন্টে আরও বেশি জানতে 265777 নং ও 27070 নং প্রশ্নোত্তরটি দেখুন।
চতুর্থ শর্ত: এটি আলেমদের মাঝে মতভেদপূর্ণ বিষয়। সেটি হচ্ছে— গোসলের অঙ্গগুলোর মাঝে পরম্পরা রক্ষা করা এবং দীর্ঘ সময়ের বিরতি না ঘটা।
ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন
“অধিকাংশ আলেম গোসলের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে গোসল বাতিলকারী হিসেবে মনে করেন না। তবে রবিআ বলেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তা করবে আমি মনে করি তার উপর পুনরায় গোসল করা আবশ্যক। লাইছও এ কথা বলেছেন। মালেক থেকে একাধিক অভিমত এসেছে। ইমাম শাফেয়ির ছাত্রদেরও এক অভিমত হচ্ছে এটি।
তবে জমহুর আলেম যে মতের উপর আছেন সেটাই উত্তম। গোসলে তারতীব বা ক্রমবিন্যাসই ওয়াজিব নয় সুতরাং পরম্পরাও ওয়াজিব নয়।[আল-মুগনী (১/২৯১-২৯২) সমাপ্ত]
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) “যাদুল মুসতাকনি” গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন:
গ্রন্থাকারের কথার সরাসরি ভাব হল: গোসলে পরম্পরা শর্ত নয়। অতএব কেউ যদি তার শরীরের কিছু অংশ ধৌত করে এরপর দীর্ঘ সময় পর অবশিষ্ট অংশ ধৌত করে তাহলে তার গোসল সহিহ। এটাই মাযহাবের অভিমত।
কেউ কেউ বলেছেন: পরম্পরা রক্ষা করা শর্ত। এটি ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত। বর্ণিত আছে: এটি ছাত্রদের অভিমত…।
এটি -অর্থাৎ পরম্পরা শর্ত হওয়াটা- অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ অভিমত। কারণ গোসল গোটাটাই একটি ইবাদত। তাই গোসলের একাংশ অপরাংশের উপর পরম্পরার ভিত্তিতে সংঘটিত হওয়া অনিবার্য।
তবে, কেউ যদি ওযরের কারণে বিক্ষিপ্ত ভাগে গোসল করে; যেমন পানি শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে এরপর যদি পানি পায় তাহলে প্রথমে যে অংশ ধুয়েছে পুনরায় সে অংশ ধোয়া আবশ্যক হবে না। বরঞ্চ অবশিষ্টাংশ পরিপূর্ণ করবে।[আল-শারহুল মুমতি (১/৩৬৫) থেকে সমাপ্ত]
তাই একজন মুসলিমের কর্তব্য নিজের গোসলের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা। গোসলের অংশগুলোর মাঝে লম্বা সময়ের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি না করা; যাতে করে মতভেদের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন এবং নামাযের শুদ্ধতার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব