কুরবানীর বিধি বিধান-৩(কুরবানী বিশুদ্ধতার শর্ত)

কুরবানী বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। (ফতহুল বারী, ১০/৩)

তবে, কুরবানীর হুকুম কি? ওয়জিব না সুন্নাত ? এ বিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে দুটো মত রয়েছে।

প্রথম মত: কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা রহ. প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ রহ. থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে তারাও ওয়াজিব বলেছেন।

দ্বিতীয় মত: কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এটা অধিকাংশ উলামাদের মত। ইমাম মালেক ও শাফেয়ী (রহ.) এর প্রসিদ্ধ মত।

কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরূহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সমর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভবে কুরবানী পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানী হলো ইসলামের একটি মহান নিদর্শন।

(মুহাম্মদ বিন উসাইমীন, আহকামুল উযহিয়্যাহ, পৃ. ২৬)

যারা কুরবানী ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল:

১। আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন-

তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর ।

সূরা কাওসার: ২

আর আল্লাহ রাববুল আলামিনের নির্দেশ পালন ওয়াজিব হয়ে থাকে।

২। রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।’

(মুসনাদ আহমাদ: ২/৩২১, ইবনে মাজাহ: ৩১২, হাদিসটি হাসান)

যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্কবাণী। তাই কুরবানী ওয়াজিব।

৩। রাসূলে কারীম সা. বলেছেন-

হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হলো প্রতি বছর কুরবানী দেয়া।

(মুসনাদ আহমাদ, ইবনে মাজাহ: ৩১২৫, হাদিসটি হাসান)

যারা কুরবানী সুন্নাত বলেন তাদের দলিল:

১। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-

তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়, যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানী সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে।

সহিহ মুসলিম: ১৯৭৭

এ হাদিসে রাসূল (সা.) এর ‘যে কুরবানী করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝা যায় এটা ওয়াজিব নয়।

২। রাসূল সা. তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে, কুরবানী ওয়াজিব নয়।

 

শাইখ ইবনে উসাইমীন রহ. উভয় পক্ষের দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করার পর বলেন, এ সকল দলিল প্রমান পরস্পর বিরোধী নয় বরং একটা অন্যটার সম্পূরক। তাছাড়া, দু-মতেরই দলীল প্রায় সমানভাবে বলিষ্ঠ। যাতে কোন একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। এ কারণে কিছু সস্কারক ও চিন্তাবিদ উলামা কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। তাদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ অন্যতম। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবা, তাবেঈন এবং ফকীহগণের মতে কুরবানী সুন্নাতে মুআক্কাদাহ (তাকীদপ্রাপ্ত সুন্নাত)। অবশ্য মুসলিমের জন্য মধ্যপন্হা হচ্ছে, সামর্থ্য থাকতে কুরবানী ত্যাগ না করাই উচিত। উচিত নিজের ও পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে কুরবানী করা। যাতে আল্লাহর আদেশ পালনে এবং মহানবী সা. এর অনুকরণে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হতে পারে।

 

কুরবানীর ফযীলত

১। কুরবানী দাতা নবী হযরত ইব্রাহীম আ. ও মুহাম্মদ সা. এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

২।  পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাববুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,

আল্লাহর নিকট পৌছায় না উহার গোশত এবং রক্ত, বরং পৌছায় তোমাদের তাক্বওয়া। এ ভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন, সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়নদেরকে। সূরা আল হজ্জ্ব: ৩৭

৩। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরনের আনন্দ যা কুরবাণীর গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হত না। কুরবানী না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কুরবানী আদায় হবে না।

কুরবানীর ফজীলত সম্পর্কে বর্ণিত কোন হাদীসই বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়; বরং এ সম্পর্কে বর্ণিত সবগুলো হাদীসই যঈফ ও জাল। কেউ সেগুলি জুম‘আর খুৎবায় মধুর সুরে পাঠ করেন, কেউ তা নিজ প্রবন্ধে পরিবেশন করে প্রবন্ধের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। এর একমাত্র কারণ হলো চরম উদাসীনতা ও অজ্ঞতা। ইমাম মুসলিম রহ. এর ভাষায়, যারা যঈফ ও জাল হাদীস জেনে শুনে (সতর্কীকরণ ছাড়াই) বলে বেড়ান তারা আলেম উপাধি পাবার চেয়ে জাহেল উপাধি পাবার অধিক হক্বদার এবং তারা সাধারণ মুসলিম সমাজকে ধোঁকাদানকারী বলে গণ্য হরে। (সহিহ মুসলিম শরীফের ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।

 

যে কুরবানী করতে চায় সে কোন কাজ থেকে বিরত থাকবে?

যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার মাধ্যমে বা জিলকদ মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হওয়ার মাধ্যমে যিলহজ্জ মাসে প্রবেশ করল এবং কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করল তার জন্য কুরবানীর পশু জবাই করা পর্যন্ত নখ, চুল বা শরীর থেকে চামড়া উঠানো থেকে বিরত থাকবে।

উম্মু সালামাহ রা. বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করার ইচ্ছে করে সে যেন যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।

ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।

তার অন্য একটি বর্ণনায় আছে, সে যেন চুল ও চামড়া থেকে কোন কিছু স্পর্শ না করে। অন্য বর্ণনায় আছে, কুরবানীর পশু যবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে। সহিহ মুসলিম: ১৯৭৭, মিশকাত: ১৪৫৯

যিলহজ্জের দশ দিন শুরু হওয়ার পর যদি নিয়ত করে তবে নিয়ত করার সময় থেকেই নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকবে। নিয়্যত করার আগে কেটে থাকলে তাতে গুনাহ হবে না।

এর পেছনে হেকমত হল, হাজীদের সাথে কুরবানী কারীর কিছু ক্ষেত্রে বৈশিষ্টগত মিল থাকা। অর্থাৎ হাজীগণ যেমন কুরবানী করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকে তেমনি কুরবানীকারীও কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকে। ঠিক তদ্রূপ হাজী সাহেবগণ যেমন এহরাম অবস্থায় নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকে কুরবানীকারীগণও নখ-চুল ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থেকে তাদের এই অবস্থার সাথে শামিল হয়।

এই ভিত্তিতে মাসয়ালা হল, কুরবানী কারীর পরিবারের জন্য নখ-চুল ইত্যাদি কাটা জায়েয। নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকার হুকুম কেবল কুরবানী কারীর জন্য প্রযোজ্য। যাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা হচ্ছে তাদের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কুরবানী করতে ইচ্ছুক, তিনি বলেন নি যে, যাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা হচ্ছে তারাও বিরত থাকবে। তাছাড়া তিনি তাঁর পরিবারের কাউকে নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকতে আদেশ করেছেন এমন কিছু বর্ণিত হয় নি।

 

কুরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি

কুরবানী করা আল্লাহর এক ইবাদত। আর কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমল নেক, সালেহ বা ভাল হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যদানকারী হয় না যতক্ষণ না তাতে প্রাথমিকভাবে ( যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত) দুটি শর্ত পূরণ হয়েছে:

 

প্রথমত:

ইখলাস অর্থাৎ তা যেন খাটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর নিকটে কবূল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন যা আল কুর’আনে উল্লেখ হয়েছে,

আল্লাহ তো মুত্তাক্বীদের (পরহেযগার ও সংযমী) কুরবানীই কবূল করে থাকেন।  সূরা আল মায়িদা: ২৭

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। সূরা আল হাজ্জ: ৩৭

দ্বিতীয়ত:

তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। সূরা কাহফ: ১১০

সুতরাং যারা কেবল বেশী করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয়- তা বলাই বাহুল্য।

গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে বলেই অনেকে একই মূল্যের একটি পূর্ণ পশু কুরবানী না করে একটি ভাগ দিয়ে থাকে। ফলে, একটি ছাগল দিলে দুদিনেই শেষ হয়ে যাবে। লোকের ছেলে-মেয়েরা খাবে, আর আমার ছেলে-মেয়েরা তাকিয়ে দেখবে? উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট।

 

তৃতীয়ত:

হালাল আয়ের অর্থ দিয়ে কুরবানী দিতে হবে।

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের। আল্লাহ তা’আলা বলেন : হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি। অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে: হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে? . সহিহ মুসলিম:১০১৫

ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একদা এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হল। হে মানবমন্ডলী ! পৃথিরীর হালাল ও পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী ভক্ষন কর। তখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রা. দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লহর কাছে দু’আ করুন যেন আমার দু’আ কবুল হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে সা‘দ, তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবে তোমার দুআ কবুল হবে।

ইমাম তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত, খ. ৬, পৃ. ৩১০

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আল্লাহ তা‘আলা পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত কবুল করেন না, আর হারাম উপার্জনের দানও  আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না। সহিহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১০

 

অনেকে শরীকি মালিকানায় কুরবানী দিয়ে থাকেন, সেইক্ষেত্রে শরীকের মালিকানায় যারা আছেন তাদের প্রত্যেকের হালাল আয় থাকা প্রয়োজন কুরবানী সহীহ হওয়ার জন্য।

বাহ্যিকভাবে কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে:

 

১। এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে।

অর্থাৎ কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেনী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় বাহীমাতুল আনআম। আল কুরআনে এসেছে,

প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদেরকে দিয়েছেন। (এ বিভিন্ন নিয়মের উদ্দেশ্য একই) কাজেই তোমাদের ইলাহও সে একজনই এবং তোমরা তাঁরই ফরমানের অনুগত হয়ে যাও। আর হে নবী, সুসংবাদ দিয়ে দাও বিনয়ের নীতি অবলম্বন কারীদেরকে। সূরা আল হজ্জ্ব: ৩৪

তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার। সহিহ মুসলিম: ১৯৬৩

আর আল্লাহর রাসূল সা. উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য লোক জন্তু কুরবানী করেননি ও কুরবানী করতে বলেননি। তাই কুরবানী শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে।

ইমাম মালিক রহ. এর মতে কুরবানীর জন্য সর্বোত্তম জন্তু হলো শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে কারীম সা. এ ধরনের দুম্বা কুরবানী করেছেন বলে সহিহ বুখারী ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানীর পশু হলো উট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, ৫/৬৩৪)।

একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে। সহিহ মুসলিম: ১৩১৮

অন্য এক বর্ণনামতে, উট কুরবানীতেও দশ ব্যক্তি শরীক হতে পারে। ইমাম শাওকানী বলেন, হজ্জের কুরবানীতে দশ এবং সাধারণ কুরবানীতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক। (নায়লুল আওত্বার: ৮/১২৬) যেমন হাদিসে এসেছে- আমরা হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি। (ইবনে মাজা: ৩১৩২, হাদিসটি সহিহ)।

কিন্তু মেষ বা ছাগলে ভাগাভাগি বৈধ নয়। তবে সওয়াবে একাধিক ব্যক্তিকে শরীক করা যাবে। সুতরাং একটি পরিবারের তরফ থেকে মাত্র একটি মেষ বা ছাগল যথেষ্ট হবে। তাতে সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। এ বিধানটি সফর অবষ্থায় প্রযোজ্য।

গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হলো কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।

 

২। শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি।

উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু‘বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়।

প্রিয় নবী সা. বলেন, দাতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্বল হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর। সহিহ মুসলিম: ১৯৬৩

কিন্তু উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছয়মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে, তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক। অধিকাংশ উলামাগণ ঐ হাদীসের আদেশকে ‘ইস্তিহবাব’ (উত্তম) বলে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন যে, ঐ হাদীসের মর্মার্থ এটা নয় যে, অন্য কুরবানীর পশু পাওয়া গেলে তবেই ছ‘মাস বয়সের মেশশাবকের কুরবানী বৈধ। যেহেতু এমন অন্যান্য দলীলও রয়েছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ বয়সী মেষেরও কুরবানী বৈধ; প্রকাশ থাকে যে, যদিও কুরবানীদাতা অন্য দাতালো পশু পেয়ে থাকে।

রাসূল সা. বলেন, ছ‘মাস বয়সী মেষশাবক উত্তম কুরবানী। (মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৪৫, তিরমিযী)

উক্ববা বিন আমের রা. বলেন, (একদা) নবী সা. কুরবানীর পশু বিতরণ করলেন। উক্ববার ভাগে পড়ল এক ছ‘মাসের মেষ। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ভাগে ছ‘মাসের মেষ হলো? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, এটা দিয়েই তুমি কুরবানী কর।

সহিহ বুখারী: ২১৭৮, সহিহ মুসলিম:১৯৬৫

৩। কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। 

সাহাবী বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন, চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না-

অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট; রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত, যার কোন অংগ ভেংগে গেছে। নাসাঈ‘র বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে।

তিরমিজি: ১৫৪৬; নাসাঈ: ৪৩৭১; আবূ দাউদ, হাদিসটি সহিহ

অতএব এ চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে কোন মতভেদ আছে কিনা তা আমরা জানি না।’ (মুগনী, ১৩/৩৬৯)

 

কুরবানীর ওয়াক্ত বা সময়

কুরবানী নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানী আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না।

যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন তাদের জন্য কুরবানীর সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে কুরবানীর পশু যবেহ করা হয় তাহলে কুরবানী আদায় হবে না। যেমন হাদিসে এসেছে-

আল-বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ সা. খুতবাতে বলেছেন,

এ দিনটি আমরা শুরু করব সালাত দিয়ে। অত:পর সালাত থেকে ফিরে আমরা কুরবানী করব। যে এমন আমল করবে সে আমাদের আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করল। আর যে এর পূর্বে যবেহ করল সে তার পরিবারবর্গের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করল। কুরবানীর কিছু আদায় হলো না।সহিহ বুখারী: ৯৬৫, ৫২২৬

সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে কুরবানীর পশু যবেহ না করে সালাতের খুতবা দুটি শেষ হওয়ার পর যবেহ করা ভাল। কেননা, রাসূলুল্লাহ সা. এ রকম করেছেন। হাদিসে এসেছে-

সাহাবি জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালী রা. বলেছেন, নবী কারীম সা. কুরবানীর দিন সালাত আদায় করলেন অত:পর খুতবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন। সহিহ বুখারী:  ৯৮৫

জুনদাব ইবনে সুফিয়ান বলেন, আমি কুরবানীর দিন নবী কারীম সা. এর সাথে ছিলাম । তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সালাতের পূর্বে যবেহ করেছে সে যেন আবার অন্য স্থানে যবেহ করে। আর যে যবেহ করেনি সে যেন যবেহ করে।সহিহ বুখারী: ৫৫৬২

আর কুরবনীর সময় শেষ হবে যিলহজ্জ মাসের তেরো তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএর কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় হলো চার দিন। যিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো, বারো ও তেরো তারিখে। এটাই উলামায়ে কেরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ,

প্রথমত: আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন-

যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযিক হিসেবে দান কারেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।সূরা আল হজ্জ্ব: ২৮

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী রহ. বলেন, ইবনে আববাস রা. বলেছেন: এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে বুঝায় কুরবানীর দিন ও তার পরবর্তী তিনদিন। (ফাতহুল বারী, ২/৫৬১)

অতএব এ দিনগুলো আল্লাহ তাআলা কুরবানীর পশু যবেহ করার জন্য নির্ধারণ করেছেন।

দ্বিতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-

আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিন যবেহ করা যায়।  (আহমদ: ৪/৪২, হাদিসটি সহিহ)।

আইয়ামে তাশরীক বলতে কুরবানীর পরবর্তী তিন দিনকে বুঝায় (১১, ১২, ১৩ই যিলহজ্জ)।

তৃতীয়ত: কুরবানীর পরবর্তী তিন দিনে সওম পালন জায়েয নয়। এ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে এ তিন দিনে কুরবানী করা যাবে।

চতুর্থত: রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,

আইয়ামে তাশরীক হলো খাওয়া, পান করা ও আল্লাহর যিকর করার দিন।

এ দ্বারা বুঝে নিতে পারি যে, যে দিনগুলো আল্লাহ খাওয়ার জন্য নির্ধারণ করেছেন সে দিনগুলোতে কুরবানীর পশু যবেহ করা যেতে পারে।

পঞ্চমত:

সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কুরবানীর পরবর্তী তিনদিন কুরবানীর পশু যবেহ করা যায়।

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, আলী ইবনে আবি তালেব রা. বলেছেন, কুরবানীর দিন হলো ঈদুল আযহার দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন। অধিকাংশ ইমাম ও আলেমদের এটাই মত। যারা বলেন, কুরবানীর দিন হলো মোট তিন দিন-যিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো ও বার তারিখ এবং বার তারিখের পর যবেহ করলে কুরবানী হবে না, তাদের কথার সমর্থনে কোন প্রমাণ নেই ও মুসলিমদের ঐক্যমত (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়নি। (যাদুল মা‘আদ, ২/৩১৯)

 

https://islamqa.info/bn/256227

কোরবানী শরিয়তের বিধান হওয়ার দলিল-প্রমাণ এবং এ দলিলগুলো কোরবানি ওয়াজিব হওয়া নির্দেশ করে; নাকি মুস্তাহাব হওয়া?