কুরবানীর বিধি বিধান-১ (কুরবানীর অর্থ ও তার প্রচলন)

 

কুরবানীর অর্থ ও তার প্রচলন

আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে কুরবানী রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ নৈকট্য। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে উৎপন্ন। উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা প্রভৃতি।

ইসলামী পরিভাষায় কুরবানী ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য পশু যবেহ করা হয়।

মুফরাদাত লি ইমাম রাগিব ৩/২৮৭; তাফসীরে কাশশাফ, ১/৩৩৩; রায়যাবী, ১/২২২

আরবীতে ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় না। তাই কুরআনে কুরবানীর বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি মোট তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে যেমন,

১. নং সূরা আলে ইমরানের ১৮৩ নং আয়াত             –الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ عَهِدَ إِلَيْنَا أَلَّا نُؤْمِنَ لِرَسُولٍ حَتَّىٰ يَأْتِيَنَا بِقُرْبَانٍ تَأْكُلُهُ النَّارُ (  যারা বলেঃ আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা কাউকে রসূল বলে স্বীকার করবো না যতক্ষণ না তিনি আমাদের সামনে এমন কুরবানী করবেন যাকে আগুন ( অদৃশ্য থেকে এসে) খেয়ে ফেলবে৷

২. নং সূরা আল মায়িদার ২৭ নং আয়াত———

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ ۖ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

 আর তাদেরকে আদমের দু-ছেলের সঠিক কাহিনী ও শুনিয়ে দাও৷ তারা দুজন কুরবানী করলে তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না৷ সে বললো, আমি তোমাকে মেরে ফেলবো৷ সে জবাব দিল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকে ৷

৩. নং সূরা আহক্বাফের ২৮ নং আয়াত।–         فَلَوْلَا نَصَرَهُمُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ قُرْبَانًا آلِهَةً ۖ بَلْ ضَلُّوا عَنْهُمْ     (কিন্তু আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব সত্তাকে কারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিলো ৩২ তারা কেন তাদেরকে সাহায্য করলো না৷

অনুরূপভাবে হাদীসেও ‘কুরবানী’ শন্দটি ব্যবহৃত না হয়ে তার পরিবর্তে ‘উযহিয়্যাহ’ এবং ‘যাহিয়্যাহ’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। উযহিয়্যাহ কুরবানীর দিনসমূহে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহ যোগ্য উট, গরু, ছাগল বা ভেড়াকে বলা হয়। এ শব্দটি ‘যুহা’ শব্দ থেকে গৃহীত যার অর্থ ‘পূর্বাহ্ণ’।

যেহেতু কুরবানী যরেহ করার উত্তম সময় হলো ১০ যিলহজ্জের (ঈদের দিনের) পূর্বাহ্ণকাল, তাই ঐ সামঞ্জস্যের জন্য তাকে ‘উযহিয়্যাহ’ বলা হয়েছে। এটিকে আবার ‘যাহিয়্যাহ’ বা ‘আযহা’ও বলা হয়। আর আযহাহ এর বহুবচন হলো আযহা, যার সাথে সম্পর্ক জুড়ে ঈদের নাম হয়েছে ঈদুল আযহা। মূলত ফারসী, হিন্দী, উর্দূ ও বাংলা ভাষায় আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবানী’ অর্থে ব্যহৃত হয়। বাংলার মুসলিমরাও ‘কুরবানী’ শব্দটির সাথে বেশ পরিচিত।

 

পরিশেষে ঐ যবেহকৃত পশুকেই ‘কুরবান’ বলা হয়, যা লোকেরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পেশ করে থাকে (তাফসীরে মাযহারী, ২/১৮৮)।

ভারতীয় উপমাহাদেশ তথা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কুরবানী বলতে বোঝায় যিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ বা ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে উট, গরু, বকরী ও ভেড়া প্রভৃতির মধ্য হতে কোনো এক পশুকে যবেহ করা।

 

কুরবানীর প্রকারভেদ

আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করা তিন প্রকার হতে পারে:

১. হাদী

২. কুরবানী

৩. আক্বীকাহ

তাই ঈদুল আযহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য যবেহ করাকে কুরবানী বলা হয়।

ইসলামী শরীয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কুরআন, হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমানিত। কুরআন মজীদে যেমন এসেছে,

তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।সূরা আল কাওসার: ২

বল, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নেই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।সূরা আনআম: ১৬২-১৬৩

আল্লাহর রাসূল সা. সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। সুতরাং তিনি সা. ছিলেন অধিক সালাত ক্বায়েমকারী ও অধিক কুরবানীদাতা।

বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ঈদের সালাতের পর কুরবানীর পশু যবেহ করল তার কুরবানী পরিপূর্ণ হলো ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।বুখারী: ৫৫৪৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৬১

আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা. নিজ হতে দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানী করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন। বুখারী: ৫৫৬৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৬৬

তবে বুখারীতে ‘সাদা-কালো’ শব্দের পূর্বে ‘শিংওয়ালা’ কথাটি উল্লেখ আছে।

ইবনু উমর রা. বলেন, নবী সা. দশ বছর মদীনায় অবস্থানকলে কুরবানী করেছেন। মুসনাদ আহমাদ, তিরমিযী

যেমন তিনি তার কর্ম দ্বারা কুরবান করতে উম্মতকে অনুপ্রাণীত করেছেন, তেমনি তিনি তার বাক দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছেন।