আইয়ামুত-তাশরীক বলা হয় কুরবানির পরবর্তী তিন দিনকে। অর্থাৎ যিলহজ মাসের এগারো, বারো ও তেরো তারিখকে আইয়ামুত-তাশরীক বলা হয়। তাশরীক শব্দের অর্থ শুকানো। মানুষ এ দিনগুলোতে গোশত শুকাতে দিয়ে থাকে বলে এ দিনগুলোর নাম আইয়ামুত-তাশরীক বা গোশত শুকানোর দিন নামে নামকরণ করা হয়েছে।
আইয়ামুত তাশরীক এর ফযিলত
এ দিনগুলোর ফযিলত সম্পর্কে যে সকল বিষয় এসেছে তা নীচে আলোচনা করা হল:—
১। এ দিনগুলো ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকির ও তার শুকরিয়া আদায়ের দিন। আল্লাহ তাআলা বলেন—
তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে। সূরা আল বাকারাঃ২০৩
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী রহ. বলেন-
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে আইয়ামুত-তাশরীককে বুঝানো হয়েছে।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন: ইবনে আব্বাসের এ ব্যাখ্যা গ্রহণে কারো কোনো দ্বি-মত নেই। আর মূলত এ দিনগুলো হজের মওসুমে মিনাতে অবস্থানের দিন। কেননা হাদিসে এসেছে—
মিনায় অবস্থানের দিন হল তিন দিন। যদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দু দিনে চলে আসে তবে তার কোনো পাপ নেই। আর যদি কেউ বিলম্ব করে তবে তারও কোনো পাপ নেই।
হাদিসে এসেছে—
নাবীশা হাজালী থেকে বর্ণিত যে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘আইয়ামুত-তাশরীক হল খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যিকিরের দিন।’
ইমাম ইবনে রজব রহ. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেন: আইয়ামুত-তাশরীক এমন কতগুলো দিন যাতে ঈমানদারদের দেহের নেয়ামত ও স্বাচ্ছন্দ্য এবং মনের নেয়ামত তথা স্বাচ্ছন্দ্য একত্র করা হয়েছে। খাওয়া- দাওয়া হল দেহের খোরাক আর আল্লাহর যিকির ও শুকরিয়া হল হৃদয়ের খোরাক। আর এভাবেই নেয়ামতের পূর্ণতা লাভ করল এ দিনসমূহে।
২। আইয়ামুত-তাশরীকের দিনগুলো ঈদের দিন হিসেবে গণ্য। হাদিসে এসেছে—
সাহাবী উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আরাফাহ দিবস, কুরবানির দিন ও মিনার দিনসমূহ (কুরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলাম অনুসারীদের ঈদের দিন।
৩। এ দিনসমূহ যিলহজ মাসের প্রথম দশকের সাথে লাগানো। যে দশক খুবই ফযিলতপূর্ণ। তাই এ কারণেও এর যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে।
৪। এ দিনগুলোতে হজ্জের কতিপয় আমল সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এ কারণেও এ দিনগুলো ফযিলতের অধিকারী।
আইয়ামুত তাশরীকে করণীয়
এ দিনসমূহ যেমনি ইবাদত-বন্দেগি, যিকির-আযকারের দিন তেমনি আনন্দ-ফুর্তি করার দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আইয়ামুত-তাশরীক হল খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহর যিকিরের দিন।
এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দেয়া নেয়ামত নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করার মাধ্যমে তার শুকরিয়া ও যিকির আদায় করা উচিৎ। যিকির আদায়ের কয়েকটি পদ্ধতি হাদিসে এসেছে।
১। সালাতের পর তাকবীর পাঠ করা। এবং সালাত ছাড়াও সর্বদা তাকবীর পাঠ করা। এ তাকবীর আদায়ের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ দিতে পারি যে এ দিনগুলো আল্লাহর যিকিরের দিন। আর এ যিকিরের নির্দেশ যেমন হাজীদের জন্য তেমনই যারা হজ পালন রত নন তাদের জন্যও।
২। কুরবানি ও হজ্জের পশু যবেহ করার সময় আল্লাহ তাআলার নাম ও তাকবীর উচ্চারণ করা।
৩। খাওয়া-দাওয়ার শুরু ও শেষে আল্লাহ তাআলার যিকির করা। আর এটা তো সর্বদা করার নির্দেশ রয়েছে তথাপি এ দিনগুলোতে এর গুরুত্ব বেশি দেয়া। এমনিভাবে সকল কাজ ও সকাল-সন্ধ্যার যিকিরগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া।
৪। হজ্জ পালন অবস্থায় কঙ্কর নিক্ষেপের সময় আল্লাহ তাআলার তাকবীর পাঠ করা।
৫। এগুলো ছাড়াও যে কোনো সময় ও যে কোনো অবস্থায় আল্লাহর যিকির করা।
এ দিনগুলোতে সাধারণ ঘটে যাওয়া কিছু বিদআত ও ভুল ভ্রান্তি থেকে সকলের সতর্ক থাকা জরুরী:
১. সম্মিলিত তাকবীর বলা
এক আওয়াজে অথবা একজনের বলার পর সকলে সমস্বরে বলা থেকে বিরত থাকা।
২. ঈদের দিন হারাম-নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হওয়া
গান শোনা, ফিল্ম দেখা, বেগানা নারী-পুরুষের সাথে মেলামেশা করা ইত্যাদি পরিত্যাগ করা।
৩. কুরবানির পশু যবেহ করার পূর্বে চুল, নখ ইত্যাদি কর্তন করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানি দাতাকে যিলহজ মাসের আরম্ভ থেকে কুরবানি করা পর্যন্ত তা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
৪. ঈদের দিনে কবর যিয়ারত করা
কবর যিয়ারত করা শরিয়ত সমর্থিত একটি নেক আমল। কিন্তু ঈদের দিনে কবর যিয়ারত করার কোনো বিশেষত্ব নেই। ঈদের দিন কবর যিয়ারত করাতে বিশেষ সাওয়াব আছে বলে বিশ্বাস করা বা ঈদের দিনে কবর যিয়ারতকে অভ্যাসে পরিণত করা বা একটা প্রথা বানিয়ে নেয়া শরিয়তসম্মত নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
তোমরা আমার কবরে ঈদ উদযাপন করবে না বা ঈদের স্থান বানাবে না।
আবু দাউদ: ২০৪২
৫. গান-বাদ্য:
ঈদের দিনে এ গুনাহের কাজটাও বেশি হতে দেখা যায়। গান ও বাদ্যযন্ত্র যে শরিয়তে নিষিদ্ধ এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আবার যদি হয় অশ্লীল গান তাহলে তো তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোনো ভিন্নমত নেই। হাদিসে এসেছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে।
বুখারি: ৫৫৯০
৬. পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ-ধারণ করা ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ
পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলা পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদিসে এসেছে,
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সকল মহিলাকে অভিসম্পাত করেছেন যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং ঐ সকল পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন যারা মহিলার বেশ ধারণ করে।
আবু দাউদ: ৪০৯৭
৭. অপচয় ও সীমালঙ্ঘন করা
এমন খরচ করা, যার পিছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই, যার কোনো ফায়দা নেই, আর না আছে যার কোনো উপকার।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের ভালবাসেন না। সূরা আনআম: ১৪১।
উপরে বর্ণিত নেক আমল ছাড়াও অন্যান্য নেক আমলের প্রতি যত্নশীল হোন। যেমন, আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা, একে অপরকে মহব্বত করা এবং গরীব ও ফকীরদের উপর মেহেরবান হওয়া এবং আনন্দ উৎসবকে তাদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া ইত্যাদি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি আমাদেরকে তাঁর পছন্দনীয় কথা, কাজ ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
সহায়ক গ্রন্থঃ
তাফসীরে ইবনে কাসীর
কুরবানী ও ঈদের বিধি-বিধান, মূল: শাইখ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমীন রহ.
কুরবানীর ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও কতিপয় বিধান, সংকলন : ড. মোঃ আবদুল কাদের
নবী স. এর ঘরে ঈদ – খালেদ বিন আব্দুর রহমান আশ-শায়ে
যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন, ঈদ, কুরবানি ও আইয়ামে তাশরীকের দিনসমূহ– লেখক : জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের