ঈদুল আযহা

 

ঈদের তাৎপর্য ও করণীয়

ঈদ আরবি শব্দ। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বার বার ফিরে আসে। এটা আরবি শব্দ عاد يعود থেকে উৎপন্ন হয়েছে। অনেকে বলেন এটা আরবি শব্দ العادة আদত বা অভ্যাস থেকে উৎপন্ন কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। সে যাই হোক, যেহেতু এ দিনটি বার বার ফিরে আসে তাই এর নাম ঈদ।

 

এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তার বান্দাদেরকে নেয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বার বার ধন্য করেন ও তার এহসানের দৃষ্টি বার বার দান করেন। যেমন রামাদানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। সদকায়ে ফিতর, হজ্জ-জিয়ারত, কোরবানির গোশত ইত্যাদি নেয়ামত তিনি বার বার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নেয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগত ভাবেই মানুষ আনন্দ-স্ফুর্তি করে থাকে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদিসে এসেছে,

রাসূলুল্লাহ সা. যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনাবাসীদের দুটো দিবস ছিল যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ স. জিজ্ঞেস করলেন এ দু দিনের কি তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন: আমরা মূর্খতার যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে কারীম সা. বললেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর। আবু দাউদ: ১১৩৪, হাদিসটি সহিহ

শুধু খেলা-ধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দুটো দিন ছিল আল্লাহ তাআলা তা পরিবর্তন করে এমন দুটো দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, যিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে।

ইসলামী শরীয়তে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর ব্যতিরেকে তৃতীয় কোন ঈদ বা উৎসব পালন করার সুযোগ নেই। অথচ আমাদের মুসলিম সমাজে বর্তমানে কত ধরণের ঈদ ও ঊৎসব জমজমাট ভাবে পালন করা হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। যেমন, ঈদে মিলাদুন-নবী বা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্ম উৎসব। বরং এটাকে ‘সকল ঈদের শ্রেষ্ঠ ঈদ’ বলে জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছে। যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধী। অনুরূপভাবে তথাকথিত পহেলা বৈশাখ, খৃষ্ট নববর্ষ, বড় দিন (Christmas Day), ইত্যাদি অগণিত উৎসব আমাদের মুসলমানগণ অবলীলায় পালন করে যাচ্ছে। এসব মূলত: হিন্দু ও খৃষ্টানদের থেকে আমদানিকৃত সংষ্কৃতি যার সাথে মুসলমানের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। রাসূলূল্লাহ সা.বলে গেছেন,

যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করল সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আবূ দাউদ: ৩৫১২, সনদ-সহিহ, আলবানী

ইসলাম স্বীকৃত দুটি ঈদ ছাড়া অন্য কোন ঈদ বা উৎসব পালন করা, তাতে অংশগ্রহণ করা বা সে উপলক্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় করা মুসলমানদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের সরল-সোজা, সুন্দর ও আলোকময় পথ ধরে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন!

 

নবী সা. এর পরিবারে ঈদ

 

মদীনার ইতিহাসে একটি আলোকোজ্জল দিন তথা ঈদের দিন সকাল বেলায় নবীঘর ও আশে পাশের সবকয়টি জায়গায় ঈদ উৎসবের আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। আর এ সব কিছুই হচ্ছিল মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চোখের সামনে। প্রত্যেকে ঈদ উৎসবে নিজ নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করছিল। তারা সকলেই চাইত তাদের নিজ নিজ অনুষ্ঠান সম্পর্কে যাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবগত হন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসা ও সম্মানের খাতিরেই তারা এসব করেছিল।

এদিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরের অবস্থা সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বর্ণনা হলো :

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান গাচ্ছিল। তাদের দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন।

ইতোমধ্যে আবু বকর রা. ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির কাছে শয়তানের বাঁশি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথা শুনে বললেন : মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও। অতঃপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য মনস্ক হলেন তখন আমি মেয়ে দুটিকে ইশারা করলে তারা বের হয়ে গেল।

হুজরা শরিফের খুবই নিকটে আরেকটি অনুষ্ঠান চলছিল, যেটির বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং আয়েশা রা.। তিনি বলেন: ঈদের দিন আবিসিনিয়ার কিছু লোকজন লাঠি-শোঠা নিয়ে খেলা-ধুলা করছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রা. কে ডেকে বললেন : আয়েশা তুমি কী দেখতে চাও? আমি বললাম: হ্যাঁ। তিনি আমাকে তাঁর পিছনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, আমার গাল তাঁর গালের উপর রাখলাম। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন: হে বনি আরফেদা, তোমরা শক্ত করে ধর।

এরপর আমি যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন তিনি বললেন, তোমার দেখা হয়েছে তো? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন: তাহলে এবার যাও। (বুখারী, মুসলিম)

নবীজির হুজরার সন্নিকটে আরেকটি স্পটে ঈদ উপলক্ষে আরেকটি অনুষ্ঠান শুরু হল। কতগুলো বালক নবীর শানে উচ্চাঙ্গের ও মানসম্পন্ন কবিতা আবৃতি করতে লাগল।

আয়েশা রা. বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা ছিলেন, ইত্যবসরে আমরা বাচ্চাদের চেচামেচি শুনতে পেলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দেখলেন হাবশীরা খেলাধুলা করছে আর ছোট ছোট শিশুরা তাদের চারদিকে হৈ চৈ করতেছে। তিনি বললেন: আয়েশা এদিকে এসে দেখে যাও। অতঃপর আমি এসে আমার থুতনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গর্দানের উপর রেখে তার পিছনে থেকে তাকাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন: তুমি পরিতৃপ্ত হওনি? তুমি কী এখনও পরিতৃপ্ত হওনি? আমি তখন তার নিকট আমার অবস্থান পরীক্ষা করার জন্য বলতেছিলাম না এখনও হয়নি। হঠাৎ ওমর রা. এর আগমন ঘটল। সাথে সাথে লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করলেন: আমি দেখলাম জিন ও মানুষ শয়তানগুলো ওমরকে দেখে পালিয়ে গেল। জামে আত তিরমিযী

ওরা যে কবিতাগুলো আবৃতি করছিল সেগুলোর অর্থ বুঝা যাচ্ছিলনা, কেননা সেগুলো ছিল তাদের নিজস্ব ভাষায়। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কবিতাগুলোর অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। মুসনাদ ও সহিহ ইবনে হিব্বানে আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, হাবশীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এমন কিছু পাঠ করছিল যা তিনি বুঝছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কী বলছে? সাহাবাগণ বললেন, ওরা বলছে : মুহাম্মদ সৎ ও নেককার বান্দা।

 

উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে আলেমগণ কয়েকটি বিষয় উদঘাটন করেছেনঃ

১. পরিবারের দেহ ও মন যেভাবে উৎফুল্ল হয়, ঈদ মৌসুমে উদারতার সাথে তার আয়োজন করা শরীয়তসম্মত। পরিবারের যে সব সদস্যের বয়স কম তারা স্বভাবগতভাবেই খেল-তামাশার দিকে ধাবিত হয়।. তাদের জন্য শরীয়তের সীমার ভিতর থেকে খেলা-ধুলা ও আনন্দ-ফুর্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

 

২. ঈদ উৎসবে আনন্দ প্রকাশ করা দ্বীনের একটি প্রতীক। এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বালিকাকে গান গাইতে দেখে বারণ করেননি। শুধু তা-ই নয়, যখন আবু বকর রা. তাদের বাঁধা দিতে চাইলেন তখন তিনি আবু বকরকে নিষেধ করলেন।

অপর একটি রেওয়ায়েতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে আবু বকর প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।

অন্য একটি রেওয়ায়েতে আছে- ইহুদিরা যাতে বুঝতে পারে, আমাদের ধর্মেও আনন্দ উৎসবের সুযোগ আছে। আর নিশ্চয় আমি উদার ও ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শ নিয়ে প্রেরিত হয়েছি।

 

৩. স্ত্রীর প্রতি সদয় আচরণ এবং তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে আনার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কেননা নারী জাতিকে নরম হৃদয় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তার প্রকৃতিগত স্বভাবের প্রতি কেউ সাড়া দিলে সে সহজেই তার দিকে ঝুকে পড়ে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের ভালোবেসে কাছে টানার উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। তার ঘর ছিল মুহাব্বত, ভালোবাসা, অনুগ্রহ ও পরস্পর শ্রদ্ধাবোধের উজ্জল নমুনা। আয়েশা রা. এর বর্ণনা, (আমার চোয়াল নবীর চোয়ালের সাথে মিশে গেল) দ্বারা স্ত্রীর প্রতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতটুকু আন্তরিকতা ছিল তা প্রকাশ পাচ্ছে, যা ঈদ উপলক্ষে বাস্তবায়িত হয়েছে।

 

৪. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুউচ্চ মর্যাদা, তার ব্যক্তিত্ব ও সুমহান দায়িত্ববোধ থাকা সত্ত্বেও তিনি আয়েশা রা. এর মনে তৃপ্তিদানের জন্য দাড়িয়ে থাকার মাঝে পিতা-মাতা, ভাই-বন্ধু ও স্বামীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। স্বামীগণ স্ত্রীদের আর পিতা-মাতা সন্তানদের মনোবাসনা পূরণ করার ব্যাপারে যদি এগিয়ে না আসে তাহলে স্ত্রী ও সন্তানদের মনে এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা তাকে মানসিক ও সামাজিক ভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে।

 

৫. খেলা-ধুলায় ব্যস্ত হওয়ার সময় অবশ্যই শরীয়তের সীমারেখার ভিতর থাকতে হবে। কোন গুনাহে লিপ্ত হয়ে অথবা আল্লাহর বিধান নষ্ট করে কখনও খেলাধুলা করা যাবে না। আয়েশা রা. এর বক্তব্য বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন : আমি হাবশীদের খেলা দেখার সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আড়াল করে ছিলেন। বর্ণনা থেকে বুঝা গেল যে মেয়ে দুটো গাইতেছিল তারাও ছিল নাবালেগা। তাই উপযুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদের গাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া গান গাওয়া তাদের পেশা ছিল না। তারা শুধু কবিতা আবৃতির মাধ্যমে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছিল যা শরীয়ত বহির্ভূত ছিল না।

ইসলামে ঈদ কোন ব্যক্তি কেন্দ্রীক আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়। তাই কিছু মানুষের আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে এর হক আদায় হবে না। বরং ঈদ হলো সমগ্র মুসলিম জাতির আনন্দ। শরীয়ত বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। সবচেয়ে কাছের মানুষ পিতা-মাতা থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সকলে মিলে আনন্দ উপভোগ করবে। এটাই শরীয়তের দাবি। ঈদুল আজহার দিন কুরবানির ব্যবস্থা তারই একটি নমুনা। পৃথিবীতে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন রীতি আদর্শ ফকির মিসকিনদের জন্য এমন ব্যাপকভাবে খাবার দাবারের আয়োজন করতে সক্ষম হয়নি।

 

তাই তো মুসলমানদের মধ্য থেকে মহান দানশীল ব্যক্তিবর্গ মানুষের প্রয়োজন মিটানোর ব্যাপারে খুবই গুরুত্ব দিতেন। ঈদ হলো আনন্দ, দয়া, ভালোবাসা ও মিল মুহাব্বতের আদান প্রদানের নাম। ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে, ঐ সকল মহামানবগণের আনন্দ পরিপূর্ণ হত না যতক্ষণ না তারা তাদের চার পাশের ফকির ও অভাবী মানুষের প্রয়োজন মেটাতে না পারতেন। তাই তারা গরীব-দুঃখীকে খাবার খাওয়াতেন, তাদের মাঝে পোশাক বিতরণ করতেন এবং তাদের পাশে এসে দাড়াতেন।

সবচেয়ে বড় কথা হলো অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দেয়া ও তাদের ইসলামের হাকীকত সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য ঈদ একটি বড় ধরণের মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কালামে এর প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।

আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে ঐ সকল লোকের সাথে ভাল ব্যবহার করতে ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে নিষেধ করেন না যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়নি। সূরা মুমতাহিনাহ : ৮

ইসলামে ঈদ একটি সুউচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিপূর্ণ প্রতীক। যা দেহ ও মনের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। মাহে রমজান ও হজের মাসসমূহের ইবাদত বন্দেগীর বাহক হিসাবে ঈদের আগমন ঘটে। ঐ সকল মাসের সব কয়টি ইবাদতই রূহের খোরাক যোগায়।

এরশাদ হচ্ছে :

তুমি বল: আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, এ নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। সূরা ইউনুস: ৫৮

আর শরীরের প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে খেলা-ধুলা ও আনন্দ ফুর্তি ইসলামে বৈধ করা হয়েছে। আর এ কারণেই ঈদের দিনগুলোতে সিয়াম সাধনা হারাম করা হয়েছে। কেননা রোজা রেখে খানা-পিনা ছেড়ে দিয়ে ঈদ উদযাপন করা আদৌ সম্ভব নয়। সাহাবী আনাস রা. এর বর্ণনায় এর ইঙ্গিত বহন করে- তিনি বলেন :

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখলেন ইহুদিরা দুটি দিন খেলা-ধুলা ও আনন্দ ফুর্তি করে। তখন তিনি বললেন: আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এর চেয়েও উত্তম দুটি দিন নির্ধারণ করেছেন, তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। আবু দাউদ, নাসায়ী

ইবনে জারির রা. দ্বিতীয় হিজরীতে সংঘটিত ঘটনাবলির মাঝে ঈদের নামাজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম এ বছরই মানুষদেরকে নিয়ে ঈদগাহে গমন করলেন এবং ঈদের নামাজ আদায় করেন, আর এটিই ছিল প্রথম ঈদের নামাজ।

আর এভাবেই মুসলিম উম্মাহ পরিপূর্ণ নেয়ামত কামেল শরীয়ত নিয়ে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে –

তোমার নিকট যে হক এসেছে তা বাদ দিয়ে তুমি তাদের অনুসরণ করো না, কেননা আমি তোমাদের সকলকে শরীয়ত ও বিধান দান করেছি। সূরা মায়েদা: ৪৮

নবী জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মূহুর্তই ছিল যেন ঈদের দিন, যারা তার সাথে উঠাবসা ও চলাফেরা করতেন, এবং তাঁর শরীয়তের আলোকরশ্মি দ্বারা আলোকিত হতেন তাদের জন্য। আর এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আশে পাশে সর্বদাই বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজনের ভিড় লেগে থাকত। বৈদেশিক প্রতিনিধি দল, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন, আবাল, বৃদ্ধবণিতা এমনকি নারীরা পর্যন্ত তার নিকট শিক্ষা অর্জন করতে আসত। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অংশ বুঝে নিতেন হেদায়েত ও নেয়ামতের ভাণ্ডার থেকে।

কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য এ নেয়ামতের ধারা অবশ্যই চালু থাকবে। যে ব্যক্তি নবী আদর্শের উপর অটল থাকবে এবং তাঁর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে সেই দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হবে।

আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন তাদের মাঝে তাদের থেকেই একজন রাসূল প্রেরণের মাধ্যমে, যিনি তাদেরকে আয়াত পাঠ করে শুনান এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা ইতিপূর্বে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিল। সূরা আলে ইমরান: ১৬৪

 

ঈদের বিধিবিধান ও আদব

) তাকবীর

এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ঈদের আনন্দ প্রকাশ করা হয় অন্যদিকে আল্লাহর আনুগত্যের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তাকবীর পড়ার নিয়ম হল,

আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।

) গোসল করা, সুন্দর পোশাক পরিধান করা ও পুরুষদের জন্য সুগন্ধি মাখা

তবে অপচয় করা হারাম। অনুরূপভাবে পুরুষদের জন্য টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান ও দাঁড়ি মুণ্ডন করা হারাম। নারীদের জন্য ঈদগাহে যাওয়া বৈধ, তবে সুগন্ধি ও সৌন্দর্য প্রদর্শন পরিহার করা আবশ্যক। মুসলিম নারীর জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, সে আল্লাহর ইবাদত ও সালাতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পর পুরুষের সামনে বেহায়াপনা প্রদর্শনী ও সুগন্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হবে।

) সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া

ঈদগাহে সালাত আদায় করা সুন্নত। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে পড়েছেন। তবে বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে মসজিদে পড়া বৈধ।

) জামায়াতের সাথে ঈদের সালাত আদায় করা এবং খুতবা শোনা

ইবনে তাইমিয়া প্রমুখ গবেষক আলেমগণের মতে অগ্রাধিকার যোগ্য কথা হল, ঈদের সালাত ওয়াজিব। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন: অতএব তোমরা রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং কুরবানী কর। সূরা কাউসার: ২

সুতরাং ওজর ছাড়া তা রহিত হবে না।

পুরুষদের সাথে নারীরাও ঈদের সালাতে হাজির হবে। এমনকি ঋতুবতী ও কুমারী মেয়েরাও। তবে ঋতুবতী নারীর ঈদের সালাত থেকে বিরত থাকবে।

মহিলাদেরকে সাথে নিয়ে ঈদের নামায পড়তে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন:

কর্তব্য হল, পর্দানশীন কুমারী মেয়েরা, এমন কি ঋতুবতী মহিলারাও ঈদগাহে যাবে। তবে ঋতুবর্তী মহিলাগণ নামাযের স্থান থেকে দূরে অবস্থান করে কল্যাণময় কাজ এবং মুমিনদের দু’আতে শরীক হবে। সহিহ আল বুখারী: ৯২৭

এ সুন্নত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় আজো প্রচলিত আছে। সুতরাং যে সব এলাকায় তা চালু নেই সেসব স্থানের সচেতন আলেম সমাজ এবং নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের কর্তব্য হল, আল্লাহর রাসূলের সুন্নতকে পুনর্জীবিত করার লক্ষ্যে মহিলাদেরকেও ঈদের এই আনন্দঘন পরিবেশে অংশ গ্রহণের সুযোগ প্রদানের জন্য এগিয়ে আসা। তবে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, পর্দাহীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ইত্যাদি যাতে না ঘটে তার জন্য আগে থেকে সকলকে সচেতন ও সাবধান করা জরুরী। মহিলাগণ যখন বাড়ি থেকে বের হবে সর্বাঙ্গ কাপড় দ্বারা আবৃত করবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

যে মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করে অন্য মানুষের নিকট দিয়ে গমন করার ফলে তারা তার ঘ্রাণ পেল সে মহিলা ব্যভিচারিণী।  নাসাঈ: ৫০৩৬

) ঈদের নামাযের প্রতি যত্মশীল হওয়া

) রাস্তা পরিবর্তন করা

এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অপর রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে প্রত্যাবর্তন মুস্তাহাব।

পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন করা এবং ভিন্ন পথে ঈদগাহ থেকে ফিরে আসা সুন্নত। সহিহ আল বুখারী: ৯৩৩

) কুরবানী করা

) কুরবানীর গোস্ত ভক্ষণ করা

ঈদুল আজহার দিন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহ থেকে ফিরে আসার আগে খাবার গ্রহণ করতেন না। বরং তিনি কুরবানী করার পর তার গোস্ত খেতেন। (যাদুল মায়াদ: ১/৪৪১)

) ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা:

পরস্পরে শুভেচ্ছা বিনিময় করা সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত। কারণ সাহাবীগণ ঈদ উপলক্ষে তা করতেন। উঁনারা এই বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেন,

তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের এবং আপনার (ইবাদত-বন্দেগী) কবুল করুন।

(বায়হাকী: ২/৩১৯-সনদ হাসান)।