আল কুর’আন অধ্যয়নে তাযাক্কুর ও তাদাব্বুর

 

 

তাযাক্কুর ও তাদাব্বুর

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

কুর’আন বুঝা জানার ক্ষেত্রে দুটি শব্দ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন তাহলে কুর’আন অধ্যয়ন বা পাঠ কিভাবে করতে হবে, তা বুঝা যাবে ইন শা আল্লাহ।

এই দুটি শুব্দ হলো তাযাক্কুর تَذَكَّرَ ও তাদাব্বুরتَدَبَّرُ।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ

যেন এই লোকেরা এর আয়াতগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে এবং জ্ঞানবুদ্ধি ও বিবেক সম্পন্ন লোকেরা এ থেকে সবক গ্রহণ করে। (সাদ- :২৯)

أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا

তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনি, নাকি তাদের মনের ওপর তালা লাগানো আছে ? (মুহাম্মদ :২৪)

وَسِعَ رَبِّىۡ كُلَّ شَىۡءٍ عِلۡمًا‌ؕ اَفَلَا تَتَذَكَّرُوۡنَ

আমার রবের জ্ঞান সকল জিনিসের ওপর পরিব্যাপ্ত। এরপরও কি তোমাদের চেতনার উদয় হবে না? আল আন’আমঃ ৮০

তাদের দিল আছে, কিন্তু তার সাহায্যে তারা চিন্তা-ভাবনা করে না। তাদের চক্ষু আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখে না। তাদের শ্রবণশক্তি আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শুনতে পায়না। তারা আসলে জন্তু-জানোয়ারের মতো, বরং তা থেকেও অধিক বিভ্রান্ত। এরা চরম গাফিলতির মধ্যে নিমগ্ন। (আল আরাফ- ৭:১৭৯)

তাদাব্বুর এবং তাযাক্কুর সম্পূর্ণরূপে পৃথক নয় বা কুরআন বুঝার পারস্পরিক স্বতন্ত্র কোন প্রক্রিয়াও নয়। একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত।

ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ

“যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ পড়ল না, সে কুরআন মাজীদকে বর্জন করল।আর যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ পড়ল অথচ তা নিয়ে তাদাব্বুর করল না সেও কুরআনকে বর্জন করল।আর যে ব্যক্তি তাদাব্বুর করলো অথচ এর উপর আমল করল না সেও কুরআনকে বর্জন করল”।

যারা আল্লাহর কিতাব কোরআনুল কারীমের তিলাওয়াত বর্জন করে, তাতে গভীর চিন্তা ও অনুধাবন করে না, কোরআনের নির্দেশনা মতে বিচার ও শাসন করে না এবং তার দ্বারা সমস্যার সমাধান করে না – মোট কথা সার্বিকভাবে কোরআন বর্জন ও উপেক্ষা করে চলে তাদের ব্যাপারে সমূহ আশঙ্কা রয়েছে যে, তারা রাসূলের অভিযোগের আওতাভুক্ত হবে, যখন তিনি স্বীয় প্রতি পালকের নিকট তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোরআন উপেক্ষার অভিযোগ এনে এবং এ ব্যাপারে আক্ষেপ আফসোস করে বললেন –

وقال الرسول يا رب إن قومي اتخذوا هذا القرآن مهجورا. (الفرقان:30)

রাসূল বলবেন : হে প্রতিপালক আমার সম্প্রদায় এই কোরআনকে পরিত্যাজ্য সাব্যস্ত করেছে। (সূরা ফুরকান : ৩০)

অর্থাৎ তারা একে উপেক্ষা করে পরিত্যাগ করেছে অথচ তাদের উপর ওয়াজিব ছিল, এর বিধানের পূর্ণ আনুগত্য করা এবং তার আহ্বান গুলো গ্রহণ করা ও তার নির্দেশিত পথে চলা।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন: কোরআন উপেক্ষা ও পরিত্যাগ কয়েক ভাবে হতে পারে।

(এক) কোরআন শ্রবণ এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও মনোযোগ প্রদান বর্জন করা।

(দুই) কোরআন অনুযায়ী আমল পরিত্যাগ করা এবং তার হালাল ও হারামকে অবজ্ঞা করা। যদিও পাঠ করে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে।

(তিন) দ্বীনের মৌলিক ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে কোরআনের ফয়সালা পরিত্যাগ করা এবং এবং কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক বিরোধ নিষ্পত্তির প্রার্থনা না করা। এবং এ ধারণা পোষণ করা যে কোরআন ইয়াকীনের ফায়দা দেয় না ও তার দলিলাদি লফযী এতে কোন জ্ঞান নেই।

(চার) কোরআনের প্রতি গভীর চিন্তা, অনুধাবন ও তাকে বুঝার চেষ্টা না করা এবং এর দ্বারা বক্তার উদ্দেশ্য কি তা জানার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করা।

(পাঁচ) শারীরিক ও মানসিক যাবতীয় রোগ ব্যাধির ক্ষেত্রে কোরআনের চিকিৎসা গ্রহণ না করে এ সব ক্ষেত্রে কোরআনকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে অন্যের প্রতি ধাবিত হওয়া।

মহান আল্লাহ বলেছেন-

এর পর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট হেদায়াত আসে, তখন যে আমার বর্ণিত পথ অনুসরণ করবে, সে পথ ভ্রষ্ট ও কষ্টে পতিত হবে না (দুর্ভাগা হবে না) এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ করে উত্থিত করব। সে বলবে হে আমার পালনকর্তা, আমাকে অন্ধকরে কেন উত্থিত করলেন ? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন : এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াত সমূহ এসেছিল, তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে, তেমনকরে আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। যে স্বীয় প্রতিপালকের আয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করে না এবং সীমা-লঙ্ঘন করে, তাকে এমন প্রতিফলই দেব। আর পরকালের শাস্তি তো আরো কঠোর, অনেক স্থায়ী। (সূরা ত্ব-হা:১২৩-১২৭)

রাসূলুল্লাহ সা. বলেন –

القرآن حجة لك أوعليك. رواه مسلم.

কোরআন হয়তো তোমার পক্ষের দলিল হবে অথবা বিপক্ষে। মুসলিম।

সাহাবি ইবনে মাসঊদ রা. বলেন : –

القرآن شافع مشفع، فمن جعله أمامه قاده إلى الجنة ومن جعله خلف ظهره ساقه إلى النار.

কোরআন এমন সুপারিশকারী যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে তার সামনে রাখবে কোরআন তাকে টেনে জান্নাতে পর্যন্ত নিয়ে যাবে আর যে পিছনে রাখবে কোরআন তাকে ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।

হে মোমিনগণ ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতাগণ, তারা আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেন তা অমান্য করেন না, এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তা-ই করে। (সূরা-তাহরীম : ৬)

আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর দেখানো পথের অনুসরণ করবে, কোরআনকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করবে তার জন্যই মূলত রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের হেদায়াত ও শান্তি। সে দুনিয়াতে পথভ্রষ্ট হবে না এবং আখেরাতে দুর্ভাগা হবে না। কোরআন তার জন্য হবে পথপ্রদর্শক, হুজ্জত এবং সুপারিশকারী। পক্ষান্তরে যারা তোয়াক্কা করবে না। তারা পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে খুব কষ্ট করে, অস্বস্তি ও পেরেশানিতে।

أولئك كالأنعام بل هم أضل أولئك هم الغافلون. (الأعراف:179)

তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত। বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হল গাফেল, শৈথিল্য পরায়ণ। (সূরা আরাফ:১৭৯)

কবরে থাকবে নিদারুণ শাস্তিরত অবস্থায়। কবর তাদের জন্য হবে খুব সংকীর্ণ। পাঁজরের হাড্ডি গুলো একটি অপরের মধ্যে ঢুকে যাবে।

আর পরকালে উত্থিত হবে অন্ধ হয়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন :—

وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِهِ وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا ﴿97﴾ (الإسراء: 97)

আমি কেয়ামতের দিন তাদের সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায় এবং বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল হচ্ছে জাহান্নাম, যখনই নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য তা আরও বৃদ্ধি করে দেব। (সূরা ইসরা : ৯৭)

অন্ধ করে দেয়ার এ শাস্তি তাদের অপরাধের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কারণ তারাও পৃথিবীতে হক ও সত্য থেকে অন্ধ হয়ে থাকত।

কুরআন উপলব্ধির জন্য আল্লাহ কিছু শর্ত দিয়েছেন। যেগুলো না হলে কুরআনের উপলব্ধি সম্ভব নয়।

১। তাযাক্কুর—চিন্তা-ভাবনা করা।

২। আকল খাটানো- সহজাত(ফিতরাত) সত্য-মিথ্যার পার্থক্য উপলব্ধি।

২। ফিকর করা – চিন্তাকে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া।

৪। তাদাব্বুর করা – সর্বোচ্চ লেভেলের চিন্তা-গবেষণা করা—যা প্রজ্ঞার কাছে নিয়ে যাবে।

ইবনে কুদামা রহ. বলেছেন:

-কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক তিনটি:

ক. গুনাহে লেগে থাকা।

খ. অহংকার থাকা।

গ. প্রবৃত্তির পূজারী হওয়া।

একরাতে নবীজি সা বের হলেন। আবু বাকরকে দেখলেন নিন্মস্বরে নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। উমারকে রা দেখলেন উচ্চ আওয়াজে নামাজে তিলাওয়াত করছেন। পরে আবু বকরকে রা বললেন

-তোমাকে দেখলাম মৃদুস্বরে তিলাওয়াত করছ!

-যার উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করছি, তিনি তো আস্তে বললেও শোনেন!

-আর উমার! তোমাকে দেখলাম বেশ জোরে তিলাওয়াত করছ?

-ঘুমন্তদের জাগিয়ে দেয়ার জন্যে, শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে!

-আবু বাকর তুমি আরেকটু জোরে পড়বে! উমার তুমি আরেকটু নিচু আওয়াজে পড়বে! (তিরমিযি)

কুরআন কারীমকে সুর করে পড়া দু’প্রকার:

ক. স্বাভাবিক সুর। কৃত্রিমতা নেই। এটা প্রশংসিত।

খ. কৃত্রিম সুর। গানের মতো করে পড়া। এটা নিন্দনীয়।

উরওয়া বিন যোবায়ের বলেন:

-আমি দাদু (আসমা রা.)-এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সাহাবীগন কুরআন তিলাওয়াত শুনলে কেমন হতো তাদের অবস্থা?

-ঠিক যেমনটা কুরআন কারীম বলেছে: (تدمع عيونهم وتقشعر جلودهم) তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতো। তারা প্রকম্পিত হয়ে উঠত!

তিনি দু’টি আয়াতের দিকে ইশারা করেছিলেন:

প্রথম আয়াত: এবং রাসূলের প্রতি যে কালাম নাযিল হয়েছে তারা যখন তা শোনে, তখন তারা যেহেতু সত্য চিনে ফেলেছে, সেহেতু তাদের চোখসমূহকে দেখবে যে, তা থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে (মায়িদা: ৮৩)।

وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ

দ্বিতীয় আয়াত: আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী-এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস, যার বক্তব্যসমূহ বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। যাদের অন্তরে তাদের প্রতিপালকের ভয় আছে, তারা এর দ্বারা প্রকম্পিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে (যুমার: ২৩)।

 

তাযাক্কুর

তাযাক্কুর শব্দটি কুরআন মাজীদে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, বিভিন্ন রকম অনুবাদও করা হয়েছে।

 যেমনঃ উপদেশ গ্রহণ, উপদেশ আহরণ, স্মরণ করা, মনোযোগী হওয়া, হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করা।

অতএব, এটা এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে  কুরআনের সাধারণ পয়গম এবং শিক্ষা হৃদয়ংগম করতে পারা যায়। এ পয়গাম ব্যক্তির জন্য কি অর্থ বহন করে এবং ব্যক্তির প্রতি তার দাবী কি ব্যক্তি তা উপলব্ধি করতে পারেন। এসব  হৃদয় দিয়ে গ্রহন করা প্রয়োজন হৃদয় ও মনের উন্মুক্ত সাড়া আনার জন্য। ফলে সে তিনি যা পান সে অনুযায়ী ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগান এবং পরিশেষে কি বাণী অন্য মানুষের সামনে  উপস্থাপন করবেন তা নির্ধারিত করবেন।

তাযাক্কুর হচ্ছে সেই এক ধরনের বুঝ, যা তার প্রয়োজনীয় প্রকৃতিতেই এমন যে, সেজন্য খুব উন্নতমানের পান্ডিত্যের প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিটি শব্দের অর্থ জানতে নাও পারেন। সকল গুরুত্বপূর্ণ ও মূল শব্দের অর্থ উদ্ধার করতে হয়তো  সক্ষম নন,  প্রতিটি আয়াতের অর্থ নাও জানতে পারেন কিন্তু সাধারণ, সমগ্রিক ও বিশেষ পয়গাম, কিভাবে  জীবন যাপন করবেন তা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছভাবে ব্যক্তির জানা উচিত।

প্রকৃতপক্ষে যারা কুরআন সবচাইতে বেশী বুঝেছিলেন এবং উপকৃত হয়েছিলেন কুরআন থেকে, তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন এর প্রথম শ্রোতাগণ- তারা ছিলেন ন্যায় ব্যবসায়ী, কৃষক, মেষপালক, উষ্ট্র চালক এবং বেদুইন। তাদের হাতের নাগালের মধ্যে ছিল না কোন অভিধান বা তাফসীর গ্রন্থ আর না ছিল স্টাইল, রচনাশৈলী, ছন্দ, অলংকার শাস্ত্রের উপর গবেষণামূলক গ্রন্থাবলী। আর না তারা দর্শন, ইতিহাস, বূগোল, প্রত্নতত্ত্ব, নৃবিদ্যা অথবা সামাজিক ও ভৌতিক বিজ্ঞানের সকল জ্ঞানের অধিকারী। এতদসত্ত্বেও কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে তারা ছিলেন সবচাইতে সফল। এর কারণ হচ্ছে, তারা কুরআনের বাণীকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপন শুরু করেছিলেন। এক্ষেত্রে যারা প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেন, তাদের এমন ধরনের বুঝই হয় এবং এমন বুঝই তাদের প্রত্যেকেই পেতে পারে। কি পরিমাণে বা মাত্রায় তিনি গ্রহণ করতে পারেন তা নির্ভর করে তার উদ্যোগ এবং সামর্থ্যরে উপর। অবশ্য পান্ডিত্যের উপায়-উপকরণ এ প্রক্রিয়ায় অনেক নতুন দিক সংযোজন করে, গুরুত্ব বৃদ্ধি করে, নতুন দূরদৃষ্টি দান করে কিন্তু এসব অবশ্যই লাগবে এমন নয়।

তাযাক্কুরের অর্থ হলো কুরআন পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে যে, এটা বুঝা অতি সহজ। কুরআন প্রতিটি আন্তরিক অনুসন্ধানীর নাগালের মধ্যেই যদি তিনি শুধু উপলদ্ধি করেন যে, তিনি কি পাঠ করছেন এবং তার উপর চিন্তা ভাবনা করেন। আর তাযাক্কুর মানে কুরআন তাদের তদনুযায়ী পরিচালিত হতে আহবান জানায়, যারা শুনতে পারে, দেখতে পারে ও চিন্তা করতে পারে। এটা এই অর্থে যেঃ

আমরা এই কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছি। এ হতে উপদেশ গ্রহণের কেউ আছে কি? (আল কাসাস ৫৪:১৭)

হে নবী! আমরা এই কিতাবকে তোমার ভাষায় খুব সহজ বানিয়ে দিয়েছি। যেন এই লোকেরা নসীহত গ্রহণ করে। (আদ দুখান ৪৪:৫৮)

আমরা এই কুরআনে লোকেদের সম্মুখে নানা রকম ও নানা প্রকারের দৃষ্টান্ত ও উপমা পেশ করেছি, যাতে এদেশ হুঁশ হয়। (আয যুমার ৩৯:২৭)

إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكْرَىٰ لِمَن كَانَ لَهُ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ

এতে অত্যন্ত শিক্ষামূলক সবক রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যার দিল আছে কিংবা যে খুব লক্ষ্য দিয়ে কথা বলে। (কাফ ৫০:৩৭)

তাযাক্কুর কোন নিম্নস্তরের বুঝ নয়, এটি হচ্ছে কুরআনের মূল অপরিহার্য উদ্দেশ্য। আলো ও পথ-নির্দেশনা লাভের জন্য এবং তাযাক্কুরের মাধ্যমে নিরাময় লাভের নিমিত্ত আপনাকে সারাটি জীবন সংগ্রাম করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় আপনার ব্যক্তিগত অসংখ্য ফায়দা হাসিলের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।(সংগৃহিত- কুর’আন অধ্যয়ন সহায়িকা)

তাদাব্বুর

তাদাব্বুর (تَدَبُّر) অর্থ গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা। অনুধ্যান করা। সাধারণত কুরআন কারীমের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনাকে তাদাব্বুর বলে।দাল-বা-রা (دبر) এই তিন হরফ যোগে গঠিত শব্দ কুরআন কারীমে সাত ধরনের শব্দে সর্বমোট ৪৪ বার এসেছে।

তাদাব্বুর’ শব্দটা এসেছে ‘দুবর’ থেকে যার মানে হছে, কোন কিছুর নিচে, কোন কিছুর পেছনে।

আর ‘তাদাব্বুর’ মানে হলো যখন  কিছু শোনা হয়- এটা শুধু উপরভাগ , এই কথাটাতে কী বলা হয়েছে, এই বক্তব্যের গুরুত্ব কতখানি তা বুঝতে হলে ঐ বক্তব্যের পেছনে কী আছে এনিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এতে (কুরআনে) গভীরতা আছে, এবং এর বক্তব্য বুঝতে চাইলে নিজে এর গভীরে ডুব দিতে হবে।

“তাদাব্বুর করে করে কুরআন পড়ো। তাহলে অর্থ বুঝতে পারবে। কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদাব্বুর করো। আমলের নিয়তে পড়ো। অমনোযোগী হয়ে পড়ো না। পরিপূর্ণ সচেতনতার সাথে পড়ো। কোনও আয়াতে সন্দেহ লাগলে আলিমের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নাও।-ইবনে বায রহ.।

মুসলিম উম্মাহর যখনি দুর্দিন আসবে, তার উচিত কুরআনের সাথে তার সম্পর্কটা কেমন প্রথমে যাচাই করে নেয়া। সাধারণত উম্মাহর সমস্যা আসা শুরু হয় কুরআনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর কুরআনের তাদাব্বুর কমে গেলেই উম্মাহর উপর বিপদের ঘোর অমানিশা নেমে আসে। তখনো কিন্তু তিলাওয়াত ঠিকই চলতে থাকে। থাকে না শুধু ‘তাদাব্বুর’।

পথহারা কেউ যদি পথ পাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরআন নিয়ে বসে। তাদাব্বুরের মাধ্যমে পথের সন্ধান করে, তাহলে তার সামনে পথ খুলে যায়।

হেদায়াত চাইলে তাদাব্বুর করতেই হবে। কারণ ইলম ও হিদায়াত হলো তাদাব্বুরেরর অধীনস্থ বিষয়।

কুরআন কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বারবার তাকিদ দিয়েছেন, তার কালাম দিয়েই যেন মানুষকে দাওয়াত দেয়া হয়।

(وأَنْ أَتْلُوَا) এবং আমি যেন কুরআন তিলাওয়াত করি। নামল: ৯২

 নবীজিকে আদেশ করা হয়েছে, তিনি যেন মানুষকে তিলাওয়াত করে শোনান। দাওয়াত দেন।

(حَتّى يَسْمَعَ كَلامَ اللهِ) সে (বন্দী কাফের) আল্লাহর বাণী শোনা পর্যন্ত (আশ্রয় দেবে)। তাওবা ৬।

কাফির বন্দী হলে, তাকেও কুরআন কারীম শোনানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। যাতে তার ঈমান আনার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

تْلُ ما أُوْحِيَ إِلَيْك من الكِتابِ) (হে নবী!) ওহীর মাধ্যমে আপনার প্রতি যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তা তিলাওয়াত করুন (আনকাবূত: ৪৫)।

এসব আয়াত পড়লে বোঝা যায়, কুরআন কারীমের মাধ্যমে দাওয়াত দিলে বেশি ফলপ্রসূ হয়। এবং নিছক পাঠ নয়, বুঝে বুঝে পাঠের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

কুরআন কারীমের আলোচনা করতে গেলে তিন শ্রেণীর মানুষ বের হয়:

ক. কুরআন পাঠকে পরিত্যাগ করেছে। এদের বিরুদ্ধে নবীজি আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছেন।

খ. কুরআন কারীম তিলাওয়াত করেন। তবে তাফসীর জানে না। তাদের জীবনে কুরআন কারীমের কোনও প্রভাবও দেখা যায় না।

গ. কুরআন কারীম বোঝে। তাফসীরও বোঝে। কিন্তু তাদাব্বুর করে না।

তাদাব্বুরের জন্য যা করা দরকারঃ

১। ইখলাস ও নিয়তকে বিশুদ্ধ করা জরুরী

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ

এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই ৷এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকীদের জন্য। বাকারাঃ২

وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء

তাদেরকে কেবল এই আদেশই করা হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই জন্যে খালেস রেখে (বায়্যিনা: ৫)।

২। তাদাব্বুরের আগে নিয়ত করে নিতে হবে।

আমি যেন আল্লাহর পরিবারভুক্ত ও খাসলোক হতে পারি:

إن لله أهلين من الناس قالوا من هم يا رسول الله قال أهل القرآن هم أهل الله وخاصته

আল্লাহর পরিবারভুক্ত বিশেষ কিছু মানুষ আছে! তারা কারা? তারা আহলে কুরআন! (আহমাদ)।

কুরআন কারীম আমার জন্যে সুপারিশকারী হয়:

তোমরা কুরআন পড়ো। কারণ কুরআন কেয়ামতের দিন তার ধারকদের জন্যে সুপারিশকারী হবে (মুসলিম)।

আমি যেন আনুগত্যের উপর অবিচল থাকতে পারি:

كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ ۖ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا

(হে নবী!) আমি এরূপ করেছি এর মাধ্যমে আপনার অন্তর মজবুত রাখার জন্যে আর আমি এটা পাঠ করিয়েছি থেমে থেমে (ফুরকান ৩২)।

وَإِنَّهُ لَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ

কুরআন হলো ঈমানদারদের জন্যে হোদায়ত ও রহমত (নামল ৭৭)।

নবীজি সা.-ও বলে গেছেন। আমি তোমাদের মাঝে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। সে দু’টি আঁকড়ে ধরলে কিছুতেই বিচ্যুত হবে না:

ক. আল্লাহর কিতাব।

খ. আমার সুন্নাত

আল্লাহর যিকির দ্বারা আমি যেন প্রশান্তচিত্ত হতে পারি!

الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

এরা সেই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর যিকিরে প্রশান্তি লাভ করে। স্মরণ রেখ, কেবল আল্লাহর যিকিরই সেই জিনিস, যা দ্বারা অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয় (রা‘দ: ২৮)।

আমি যেন যাবতীয় রোগ বালাই থেকে শিফা লাভ করি।

কারণ কুরআন তো আমাদের জন্যে শি‘ফা।

হে মানুষ! তোমাদের কাছে এমন এক জিনিস এসেছে, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক উপদেশ, অন্তরের রোগ-ব্যাধির উপশম এবং মুমিনদের পক্ষে হিদায়াত ও রহমত (ইউনুস: ৫৭)।

৩। তাদাব্বুর করতে বসলে:

ক. তাদাব্বুরের সময় মূল কুরআনের পাশে তরজমা ও তাফসীর আছে এমন ‘মুসহাফ’ নিয়ে বসা।

খ. সাথে কাগজ রাখা। কোনও প্রশ্ন জাগলে সেটা টুকে রাখা। পরে জেনে নেয়ার জন্যে।

গ. এভাবে পড়তে গিয়ে যদি একপৃষ্ঠা শেষ করতে যদি দীর্ঘ সময়ও লেগে যায় বিরক্ত না হওয়া।

৪। একটা আয়াতকে বারবার আওড়ানো।

তামীম দারী রা. একটা আয়াত পড়তে পড়তে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন;

أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

যারা অসৎ কার্যাবলীতে লিপ্ত হয়েছে, তারা কি ভেবেছে আমি তাদেরকে সেই সকল লোকের সম গণ্য করব, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, ফলে তাদের জীবন ও মরণ একই রকম হয়ে যাবে? তারা যা সিদ্ধান্ত করে রেখেছে তা কতই না মন্দ (জাসিয়া: ২১)।

৫। তাদাব্বুরের আরেকটি মাধ্যম হলো শব্দের অর্থ বোঝা! তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন কারীমের অর্থ বুঝতে হবে!

وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

-বস্তুত আমি এ কুরআনে মানুষের জন্যে সব রকমের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি, যাতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। এটা আরবী কুরআন, এতে কোনও বক্রতা নেই, যাতে মানুষ তাকওয়া অবলম্বন করে (যুমার: ২৭-২৮)।

সাহাবায়ে কেরাম কোনও আয়াতের অর্থ বুঝতে না পারলে, থেমে যেতেন। না বুঝে সামনে অগ্রসর হতেন না। ইবনে যোবায়ের রা. বলেছেন, একটা আয়াত বুঝতে পারছিলাম না। নির্ঘুম রাত কেটে গেল। সকালে ইবনে আব্বাস রা. বুঝিয়ে দিয়েছেন। আয়তটি ছিল:

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ

তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই এমন যে, তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখলেও তা এভাবে যে, তাঁর সঙ্গে শরীক করে (ইউসুফ ১০৬)।

৬। তাদাব্বুরের জন্যে তারতীলের সাথে পড়া

ইবনে মাসউদ দেখে বললেন:

رتل فإنه زين القرآن

তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করো। কারণ এভাবে পড়ার মাঝেই কুরআনের সৌন্দর্য নিহিত! (বায়হাকী)।

হাফসা রা. বলেছেন: আল্লাহর রাসূল থেমে থেমে তিলাওয়াত করতেন। তার তিলাওয়াত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকতো (মুসলিম)।

৭। তাদাব্বুর করতে বসলে, নিজেকে শুনিয়ে তিলাওয়াত করা।

বেশি জোরে নয় আবার। আবার ফিসফিস করেও নয়।

আপনি নিজের নামাজ বেশি উঁচু স্বরে পড়বেন না এবং অতি নিচু স্বরেও নয়; বরং উভয়ের মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করবেন (ইসরা: ১১০)।

যার কুরআন পাঠ শুনলে মনে, সে আল্লাহকে ভয় করে করে পড়ছে, সেই সবচেয়ে সুন্দর তিলাওয়াতকারী (ইবনে মাজাহ)।

তোমরা কুরআন পড়ার সময় স্বরকে সুন্দর করো (আবু দাউদ)

কুরআন কারীমকে সুর করে পড়া দু’প্রকার:

ক. স্বাভাবিক সুর। কৃত্রিমতা নেই। এটা প্রশংসিত।

খ. কৃত্রিম সুর। গানের মতো করে পড়া। এটা নিন্দনীয়।

৮। তাদাব্বুরের জন্যে  আত্মীক গুনাহমুক্ত করে নেয়া।

অহংকার হিংসা ও অন্যান্য আত্মিক রোগ থেকে শুদ্ধ হয়ে নেয়া। কারণ এগুলো হলো মরিচা। কুরআনকে কলবে প্রবেশ করতে দেয় না। কুরআন কারীমে আছে:

سَأَصْرِفُ عَنْ آيَاتِيَ الَّذِينَ يَتَكَبَّرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ

পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে, তাদেরকে আমি আমার নিদর্শনাবলী হতে বিমুখ করে রাখব (আ‘রাফ: ১৪৬)।

মনে অহংকার থাকলে কুরআনের আলো কলবে প্রবেশ করবে না।

৯। তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন কারীমকে মুখস্থ পড়া। তাদাব্বুরের জন্যে এটা অত্যন্ত উপকারী।

একজন দেখে পড়ে তাদাব্বুর করছে, আরেকজন মুখস্থ পড়ে তাদাব্বুর করছে, দু’জনের মধ্যে তুলনাই চলে না। মুখস্থ পড়ার মানে হলো, সে এর আগেও আয়াতটা বহুবার পড়ছে। এই আয়াতের সাথে তার সম্পর্ক অনেক পুরনো। গভীর।

নিজের হিফজ থেকে মুখস্থ তাদাব্বুর করার বড় সুবিধা হলো, ইচ্ছেমতো যে কোনও সময় তাদাব্বুর করতে পারা। ইচ্ছেমতো কুরআন কারীম থেকে আয়াত বের করে আনতে পারা!

হাঁ, দেখে দেখে পড়লে সওয়াব বেশি।

প্রথমত, পড়ার ইবাদত

দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীমের দিকে তাকানোর ইবাদত।

তবে আমরা বলছি তাদাব্বুরের কথা। তিলাওয়াতের কথা নয়। তাদাব্বুর মুখস্থ করাই বেশি ফলদায়ক। তবে কথা হল, আমার যদি দেখে দেখে তাদাব্বুর করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়, তাহলে দেখে দেখে তাদাব্বুর করাই আমার জন্যে উত্তম। মুখস্থ পড়ার বাড়তি উপকার হলো, মনটা বিক্ষিপ্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ

প্রকৃতপক্ষে এ কুরআন এমন নিদর্শনাবলীর সমষ্টি, যা জ্ঞানপ্রাপ্তদের অন্তরে সুষ্পষ্ট (আনকাবূত ৪৯)।

১০। তাদাব্বুরের স্তর আছে:

ক। চিন্তা-ভাবনা ও শিক্ষাগ্রহণ। কুরআন কারীমের বহু আয়াতে এদিকে ইশারা আছে:

হয়তো তোমরা চিন্তা করবে (لعلكم تتفكرون)।

চিন্তাশীল কওমের জন্যে রয়েছে নিদর্শনাবলী (لآيات لقوم يتفكرون)।

যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা যখন তা সেভাবে তিলাওয়াত করে, যেভাবে তিলাওয়াত করা উচিত তখন তারাই তার প্রতি (প্রকৃত) ঈমান রাখে (বাকারা: ১২১)।

الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَٰئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ

যথার্থ তিলাওয়াত (حَقَّ تِلَاوَتِهِ) মানে? মুফাসসিরীনগণ বলেছেন, এর অর্থ ‘তাদাব্বুর করা ও সে অনুযায়ী আমল করা।

খ। কুরআন কারীম দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ও হৃদয় বিগলিত হওয়া।

আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও তাদাব্বুরের পর আমার কলবে কোনও প্রভাব পড়ে? আমার চিত্তের কোনও ধরনের উত্তরণ ঘটেছে? চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়েছে? মনটা নরম হয়েছে?

إن في ذلك لذكرى لمن كان له قلب أو ألقى السمع وهو شهيد

নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন ব্যক্তির জন্যে উপদেশ রয়েছে, যার আছে অন্তর কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে (ক্বাফঃ৩৭)।

আমরা উপদেশ গ্রহণ করতে হলে, তাদাব্বুর করতে হবে। কুরআন কারীমের বাণীর অর্থ উদ্ধারে গভীর অনুধ্যান করতে হবে। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কুরআন কারীম থেকে উপকৃত হওয়ার জন্যে দু’টি শর্ত:

ক. জীবন্ত উন্মুখ হৃদয়!

খ. জাগ্রত মস্তিষ্ক!

আমাকে মনে রাখতে হবে, আমি যে তেলাওয়াত করছি, তা আল্লাহ তা‘আলা  শুনছেন। ইবনে কুতাইবা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন:

-অর্থাৎ সে আল্লাহর কিতাব শ্রবণ করেছে সজাগ মনোযোগের সাথে, বোঝার সুতীব্র ইচ্ছা নিয়ে, অচেতন গাফেল হয়ে নয়। এ-আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহর কালামকে গুরুত্ব দিয়ে না শুনলে, না পড়লে এর প্রভাব অন্তরে পড়বে না।

গ। তাদাব্বুর করার সময় ভাবা, নিজের অবস্থার সাথে সালাফের অবস্থা তুলনা করে দেখা।

একটা আয়াতে কোনও গুণাবলীর কথা বর্ণিত হলে, সেটা আমার মধ্যে আছে কি না, যাচাই করে দেখবো। নিজেকে প্রশ্ন করবো: আমি কি প্রকৃত মুমিন? সূরা আনফালের শুরুতে বলা মুনিনের গুণাবলী কি আমার মধ্যে আছে?

ক. কুরআন কারীমের শব্দগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করা। এই চেষ্টার ফলে জীবনে আসে এক ইতিবাচক প্রভাব। আচরণে আসে অন্য রকম এক পরিবর্তনের ছোঁয়া।

খ. আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এই আয়াতে কী বলতে চেয়েছেন, তা বোঝার চেষ্টা করা। আগের ও পরের আয়াতগুলোর সাথে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করা।

গ. আয়াতে সুসংবাদ থাকলে মনে খুশি খুশি ভাব ফুটিয়ে তোলা। দুঃসংবাদ থাকলে মনে ভীতাবস্থা সৃষ্টি করা। পূর্বেকার জাতিসমূহের ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা।

ঘ. কুরআনের সমস্ত কথাকে মনেপ্রাণে ইয়াকীন করা। সমস্ত আদেশকে মাথা পেতে নেয়া। যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাকে মুখ বুজে মেনে নেয়া।

ঘ। সাড়াদান ও আনুগত্য! আমি যা পড়ছি, তা মানছি তো?

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

اتبعوا ما أنزل إليكم من ربكم

(হে মানুষ!) তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর (আ‘রাফ: ৩)।

ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন:

কুরআন তিলাওয়াতকালে যখনই তুমি দেখবে

হে মুমিনগণ! (يا أيها الذين آمنوا)!

তুমি পরিপূর্ণ সজাগ হয়ে যাবে। সামনে কী বিধান আসছে সেটার গ্রহণ করার জন্যে। আদেশ হলে মেনে নিবে। নিষেধ হলে বিরত থাকবে।

আর কে তার চেয়ে বড় জালেম, যাকে তার রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেয়ার পর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সেই খারাপ পরিণতির কথা ভুলে যায় যার সাজ-সরঞ্জাম সে নিজের জন্য নিজের হাতে তৈরি করেছে ? (যারা এ কর্মনীতি অবলম্বন করেছে) তাদের অন্তরের ওপর আমি আবরণ টেনে দিয়েছি, যা তাদেরকে কুরআনের কথা বুঝতে দেয় না এবং তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছি৷ তুমি তাদেরকে সৎপথের দিকে যতই আহ্বান কর না কেন তারা এ অবস্থায় কখনো সৎপথে আসবে না৷(কাহফঃ৫৭)

ঙ। তাদাব্বুরের সাথে পড়লে আমরা দেখতে পাব, সূরা কাহফে ফিতনা থেকে বাঁচার চারটা উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। দ্বীনের ফিতনা। মালের ফিতনা। ইলমের ফিতনা। রাজত্বের ফিতনা।

চ। আয়াতটাকে কোনও ভাবে সীরাতের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় কি না, দেখা। সীরাত পাঠের মাধ্যমে কুরআনের আয়াতগুলো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কুরআন বোঝার জন্যে সীরাতপাঠ অপরিহার্য।

১১। তাদাব্বুর শুরু কোথা থেকে করলে ভালো হবে?

উমার রা. বলেছেন:

-তোমরা যদি কুরআন শিখতে চাও, ‘মুফাসসাল’ সুরা থেকে শুরু করো। কারন এগুলো ছোট ও সহজ।

. মুফাসসাল সূরা হলো: সূরা ক্বফ থেকে নাস পর্যন্ত। এ-সূরাগুলো দিয়ে পাঠ শুরু করার বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে:

ক. কলবে ঈমান পোক্ত হয়। কারণ এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে উপদেশমূলক আয়াত আছে।

খ. ছোট ছোট আয়াত হওয়াতে বোঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক। এসব আয়াতে শরীয়তের বিধিবিধানও খুব একটা নেই। বেশির ভাগই জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা। নবী-রাসূলগণের ঘটনা।

গ. আল্লাহর পরিচয়মূলক আয়াত আছে। আল্লাহর প্রতি ঈমানের কথা আছে।

ঘ. রাসূলের ঈমানের কথা আছে।

১২। তাদাব্বুরের প্রতিবন্ধকতা সমুহ

ক।কুরআন তাদাব্বুরের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হলো, তাজবীদের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ!

তাজবীদের সূক্ষাতিসূক্ষ ভুল বের করার প্রয়াস চালানো। হরফের মাখরাজের দিকে অতিরিক্ত নজর দিলে হরফের অর্থ বের হবে না। এটা ঠিক, তাজবীদ অত্যন্ত জরুরী বিষয়। তাজবীদ কুরআন পাঠের অলংকার। তাজবীদ ঠিক করে পড়তে না পারলে গুনাহগার হবে। কিন্তু এটাই কুরআনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। তাজবীদ হলো মাধ্যম। তাদাব্বুরের স্তরে পৌঁছার সেতু। কুরআন পাঠের সময় শয়তানের একটা শক্তিশালী অস্ত্র হলো, সে তিলাওয়াতকারীর মনে দ্বিধা ঢুকিয়ে দেয়: হরফটা বোধ হয় সঠিকভাবে আদায় করা হয়নি! আবার শুদ্ধ করে পড়ি! হরফ শুদ্ধ করার দিকে তার মনোযোগ ফিরিয়ে, অর্থের দিক থেকে তার মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়।

ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন:

-এক জমানা আসবে, ফকীহ কম হবে ক্বারী বেশি হবে। কুরআন কারীমের হরফ মুখস্থ করা হবে, কিন্তু তার বিধি-বিধান অবহেলিত থাকবে!

খ। কুরআন দ্বারা নিছক শিফা বা আরোগ্য লাভ করার নিয়ত করা।

কিছু মানুষ কুরআন কারীমকে হোমিও-এলোপ্যাথির দোকান বানিয়ে রাখে। তারা মনে করে রোগ-বালাই থেকে শেফা দেয়ার জন্যেই কুরআন নাযিল হয়েছে। এটা ঠিক, কুরআন শারীরিক-মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সব ধরনের রোগ ভালো করার ক্ষমতা রাখে। তাই বলে আরোগ্য দান করাই কুরআনের প্রধান উদ্দেশ্য নয়।

১৩। সাহাবায়ে কেরামের কুরআনি তাদাব্বুর ছিল ভিন্নধর্মী।

 তারা কতোটা মনোযোগ দিয়ে কুরআনের তাদাব্বুর করতেন, উমার রা. এর ঘটনা তার স্বাক্ষী। তিনি বারো বছর সময় ব্যয় করে সূরা বাকারা শিখেছেন। শেষ হওয়ার পর, আনন্দে উট যবেহ করেছেন (বায়হাকী)।

আমরা তাফসীর বা তাদাব্বুরে বসলেও কত দ্রুত একেকটা সূরা শেষ হয়ে যায়। আমাদের তাদাব্বুর মানে ‘তরজমা’। বেশির চেয়ে বেশি সামান্য তাফসীর। ইবনে উমার রা. সূরা বাকারা নিয়ে আট বছর পড়ে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়টা তিনি সূরাটা শেখার পেছনে ব্যয় করেছেন (মুয়াত্তা)।

১৪। তাদাব্বুর সম্পর্কে বিভিন্ন উক্তি

কুরআন কারীমের তাদাব্বুর যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবিকাঠি। এর মাধ্যমেই সমস্ত কল্যান লাভ হয়। এর মাধ্যমেই যাবতীয় ইলম আহরিত হয়। এর মাধ্যমেই ঈমান বৃদ্ধি পায়। ঈমানী বৃক্ষের শেকড় গভীরে প্রোথিত হয়(আল্লামা সা‘দী)।

কুরআনের তাদাব্বুর করা তোমার জন্যে অপরিহার্য। কুরআন কারীমের অর্থ বোঝা পর্যন্ত তোমাকে এটা চালিয়ে যেতে হবে। কুরআন কারীম আগাগোড়া পড়তে থাকো তাদাব্বুরের সাথে। আগ্রহ নিয়ে। আমলের নিয়তে (শায়খ বায)।

যে ব্যক্তি কুরআনের তাদাব্বুর করবে এবং বেশি বেশি তিলাওয়াত করবে, সে ব্যক্তি লাভবানদের গুণাবলী কী কী তা জানতে পারবে। ক্ষতিগ্রস্তদের গুণাবলী কী কী তাও সে বিস্তারিত জানতে পারবে(ইবনে বায)।

আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি আয়াত কেন নাযিল করেছেন, সেটা শিক্ষা দিতে ভালবাসেন। তিনি চান বান্দা প্রতিটি আয়াত পড়ে পড়ে তার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করুক (হাসান বসরী)।

তুমি যদি কুরআন কারীম দ্বারা পরিপূর্ণ উপকৃত হতে চাও, তাহলে তিলাওয়াত করা বা তিলাওয়াত শোনার সময় কলবকে পুরোপুরি সুস্থির করে নাও। তোমার তিলাওয়াত তুমি নিজেই মনোযোগ দিয়ে শোন! আল্লাহর সাথে কথা বলছো এমন তটস্থ ভাব ফুটিয়ে তুলবে(ইবনুল কাইয়িম)।

সারারাত দ্রুত পড়ে কুরআন খতমকরার চেয়ে, সূরা যিলযাল ও কারি‘আ বারবার তাদাব্বুর করে করে পড়া আমার কাছে অধিক প্রিয় (ইমাম কুরতুবী)।

 

সহায়ক লিঙ্কঃ

কুর’আন অধ্যয়ন সহায়িকা

শায়েখ আতিক উল্লাহ পেইজ

http://www.nakbangla.com/%E0%A6%86%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4/