৩। “আমার রমাদান, আপণ সাথী আল কুর’আন”- ৩য় পারা

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

পারা-৩য়

মোট রুকুঃ ৭+ ৯= ১৬, সূরা সমূহঃ বাক্বারা(৩৪-৪০)রুকু,আলে ইমরান (১ম-৯ম)রুকু

সূরা বাকারাঃ ৩৪তম রুকু(২৫৪-২৫৭)আয়াত

১। মুমিনদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে-

আল্লাহ যা দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে, যেদিন বেচা-কেনা, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না, অর্থাৎ আখেরাতের ময়দানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে,যেখানে আর কোন সুযোগ নেই।

২। কাফেররাই যালেম বলে আখ্যায়িত করেছেন আল্লাহ।

৩। গুরুত্বপুর্ণ আয়াত ২৫৫ যা আয়াতুল কুরসি বলে পরিচিত। এটি মর্যাদার দিক থেকে কুরআনের সর্ববৃহৎ আয়াত। রাসূল সা এরশাদ করেছেনঃ যে লোক প্রত্যেক ফরয সালাতের পর আয়াতুল-কুরসী নিয়মিত পাঠ করে, তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের পথে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন অন্তরায় থাকে না। নাসায়ী,

অনেকেই এ সূরার আয়াতুল কুরসীতে “ইসমে আযম” আছে বলে মত দিয়েছেন।

কুরসী’র অর্থ কেউ বলেছেন, মহান আল্লাহর পা রাখার স্থান। কেউ বলেছেন, জ্ঞান। কেউ বলেছেন, শক্তি ও মাহাত্ম্য। কেউ বলেছেন, রাজত্ব এবং কেউ বলেছেন, আরশ।

এ আয়াতে মহান রব আল্লাহ জাল্লা-শানুহুর একক অস্তিত্ব, তাওহীদ ও গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসীর বলেনঃ এ আয়াতটিতে দশটি বাক্য রয়েছে। প্রতিটি বাক্যের সাথেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা রয়েছে।

৪। দ্বীনগ্রহণে কোন বল প্রয়োগ নেই।

যখন আনসাররা ইসলাম গ্রহণ করল, তখন তারা তাদের ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়া সন্তানদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতে চাইলে এই আয়াত অবতীর্ণ হল।

এ আয়াত দ্বারা যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি শুধু তাদেরকে জোর করে ইসলামে আনা যাবে না বলা হয়েছে। কারণ, মহান আল্লাহ হিদায়াত ও গুমরাহী উভয় পথই সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন।

 কিন্তু ইসলাম গ্রহনের পর হুকুম-আহকাম মানতে বাধ্য। সেখানে শুধু জোর-যবরদস্তি নয়, উপরন্তু শরীআত না মানার শাস্তিও ইসলামে নির্ধারিত।

৫। তাগূত’ শব্দটি আরবী ভাষায় সীমালংঘনকারী বা নির্ধারিত সীমা অতিক্রমকারী।

ইসলামী শরী’আতের পরিভাষায় তাগূত বলা হয় এমন প্রত্যেক ইবাদতকৃত বা অনুসৃত অথবা আনুগত্যকৃত সত্তাকে, যার ব্যাপারে ইবাদতকারী বা অনুসরণকারী অথবা আনুগত্যকারী তার বৈধ সীমা অতিক্রম করেছে আর ইবাদাতকৃত বা অনুসৃত অথবা আনুগত্যকৃত সত্তা তা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করে নিয়েছে বা সেদিকে আহবান করেছে। [ইবনুল কাইয়্যেম: ইলামুল মু’আক্কোয়ীন]

তাগূত এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে বন্দেগী ও দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভূ ও ইলাহ হবার দাবীদার সাজে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজের বন্দেগী ও দাসত্বে নিযুক্ত করে

প্রসিদ্ধ তাগুত ওলামায়ে কেরাম পাঁচ প্রকার উল্লেখ করেছেন।

(এক) শয়তান, সে হচ্ছে সকল প্রকার তাগূতের সর্দার (দুই) যে গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞানের দাবীদার যেমন, গণক, জ্যোতিষী প্রমূখ। (তিন) যে মানব রচিত বিধানে বিচার-ফয়সালা করাকে আল্লাহর বিধানের সমপর্যায়ের অথবা আল্লাহর বিধানের চেয়ে উত্তম মনে করে থাকে। (চার) যার ইবাদাত করা হয় আর সে তাতে সন্তুষ্ট। (পাঁচ) যে মানুষদেরকে নিজের ইবাদাতের দিকে আহবান করে থাকে।

নিম্নোক্ত নীতিমালার আলোকে সকল প্রকার তাগূতের পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হব।

(১) আল্লাহর রুবুবিয়্যত তথা প্রভূত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বৈশিষ্ট্যের দাবী করা।

 (২) আল্লাহর উলুহিয়াত বা আল্লাহর ইবাদাতকে নিজের জন্য সাব্যস্ত করা।

তাগুতকে অস্বীকার বলতে বুঝায় আল্লাহর অন্য কারো জন্য ইবাদাত সাব্যস্ত না করা এবং এ বিশ্বাস করা যে আল্লাহর ইবাদাত ছাড়া সকল প্রকার ইবাদাতই বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। আর যারা আল্লাহর বৈশিষ্ট্যে কোন কিছু তাদের জন্য দাবী করে, তাদেরকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং এ বিশ্বাস করা যে তাদের এ ধরণের কোন ক্ষমতা নেই।

৬। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর উপর ঈমান আনবে সে এমন এক দৃঢ়তর রজ্জু ধারন করল যা কখনো ভাঙ্গবে না(ইসলামকে যারা সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে তারা যেহেতু ধ্বংস ও প্রবঞ্চনা থেকে নিরাপদ হয়ে যায়, যে কোন শক্ত দড়ির বেষ্টনকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে পতন থেকে মুক্তি পায়।

৭। যারা ঈমান আনেঃ আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান।

  যারা কুফরী করেঃ তাগূত তাদের অভিভাবক, এরা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।

 

সূরা বাকারাঃ ৩৫তম রুকু(২৫৮-২৬০) আয়াত

১। হযরত ইবরাহীম আ এর সাথে নমরুদের কথোপকথন উল্লেখ এসেছে।

“আমার রব তিনিই যিনি জীবনদান করেন ও মৃত্যু ঘটান, সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই।

 ইবরাহীম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদয় করান, তুমি সেটাকে পশ্চিম দিক থেকে উদয় করাও তো। তারপর যে কুফরী করেছিল সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

২। এক ব্যক্তি নগরে উপনীত হয়েছিল, যা ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছিল-ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে  মানব-জাতির জন্য নিদর্শনস্বরূপ।

আল্লাহ্ বললেন, ‘তুমি কতকাল অবস্থান করলে?’ সে বলল, ‘একদিন বা একদিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি।‘ তিনি বললেন, বরং তুমি এক শত বছর অবস্থান করেছ।

যে সত্তা এই লোকটিকে এবং তার গাধাকে একশ’ বছর পর জীবিত করেছেন, এমন কি তার খাদ্য-পানিও নষ্ট হতে দেননি, সেই মহান সত্তাই কিয়ামতের দিন মানবকুলকে পুনরায় জীবিত করবেন। যিনি একশ’ বছর পর জীবিত করতে পারেন, তাঁর জন্য হাজার বছর পর জীবিত করাও কোন কষ্টকর ব্যাপার নয়।

আল্লাহর পরিচয়ঃ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ – সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’।

৩। ইবরাহীম আ আল্লাহর সাথে কথা বলেন–আমার মন যাতে প্রশান্ত হয়! মৃতকে জীবিত করে দেখতে চাইলেন।  যাতে স্থিরতা আসে; নানা প্রশ্নের জাল যেন অন্তরে বাসা বাধতে না পারে এবং মনের দৃঢ়তা যাতে বজায় থাকে। আল্লাহ্ তা’আলা তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং বিষয়টি প্রত্যক্ষ করাবার জন্য একটি অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন, যাতে মুশরিকদের যাবতীয় সন্দেহ-সংশয়ও দূর হয়ে যায়। আল্লাহ্‌ বললেন, তবে চারটি পাখি নিন এবং তাদেরকে আপনার বশীভূত করুন। তারপর সেগুলোর টুকরো অংশ এক এক পাহাড়ে স্থাপন করুন। তারপর সেগুলোকে ডাকুন, সেগুলো আপনার নিকট দৌড়ে আসবে। আর জেনে রাখুন, নিশ্চয় আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়

সূরা বাকারাঃ ৩৬তম রুকু(২৬১-২৬৬) আয়াত

১। إنْفَاق – إطْعَام – صَدَقَة (ইনফাক,ইতয়াম,সাদাকাহ)  আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সর্বপ্রকার দান-সদকা ও ব্যয়কেই বোঝায়; তা ফরয, ওয়াজিব কিংবা নফল, মুস্তাহাব যাই হোক।

إيْتَاءُ الزَّكَاة ফরয যাকাত বোঝাবার জন্য কুরআন একটি স্বতন্ত্র শব্দ

এখানে দান সাদাকা উৎসাহিত করার পর  ২৬২ থেকে ২৮৩ পর্যন্ত মোট ২১টি আয়াতে অর্থনীতি সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশ ও বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।ইসলামী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা দু’ভাগে বিভক্ত করে বর্নিত হয়েছে।

এক. প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অভাবগ্রস্ত, দীন-দুঃখীদের জন্য ব্যয় করার শিক্ষা-সাদাকাহ বলা হয়। দুই. সুদের লেন-দেনকে হারাম করে তা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ।

আল্লাহর পথ- ক) জিহাদঃ জিহাদে ব্যয়কৃত টাকা-পয়সার এই নেকী পাওয়া যায়।

খ)সমস্ত কল্যাণের পথঃ ফযীলত হবে নফল সাদাকা-খয়রাতের।

আল্লাহর পথে ব্যয় করার ফযীলতঃ উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা।আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। এদের কোন ভয় ও চিন্তা নেই।

কোন দান গ্রহনযোগ্যঃ দানের কথা বলে বেড়ায় না এবং কোন প্রকার কষ্টও দেয় না।দানের পর কষ্ট দেয়া হয় তার চেয়ে ভাল কথা ও ক্ষমা উত্তম। (উত্তম কথা সাদাকার সমতুল্য। (মুসলিম ১০০৯)

দান করে যারা কষ্ট দেয় তাদের তুলনা করা হয়েছে  লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে থাকে এবং আল্লাহ্‌ ও আখেরাতে ঈমান রাখে না।(উপমাঃমসৃণ পাথর, যার উপর কিছু মাটি থাকে,প্রবল বৃষ্টিপাত সেটাকে পরিস্কার করে রেখে দেয়।

২। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

৩। দানের উদ্দেশ্যঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আত্মার বা মনের দৃঢ়তা সৃষ্টি। (উপমা কোন উচ্চ ভূমিতে  উদ্যান, যেখানে মুষলধারে বৃষ্টি হয়, ফলে ফলমূল জন্মে দ্বিগুন। আর যদি মুষলধারে বৃষ্টি নাও হয় তবে লঘু বৃষ্টিই যথেষ্ট।

৪। লোক প্রদর্শন তথা সুনাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন কাজ করার ক্ষতিসমূহের কথা স্পষ্টভাবে জানানোর জন্য এবং তা থেকে মানুষকে দূরে রাখার জন্য এখানে (২৬৬)একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে।ইবনে আববাস এবং উমার (রা) এমন লোকদেরকেও উক্ত দৃষ্টান্তের আওতাভুক্ত মনে করেন, যারা সারা জীবন নেকী অর্জন করে এবং শেষ জীবনে শয়তানের জালে ফেঁসে গিয়ে আল্লাহর অবাধ্যতা করে সারা জীবনের নেকীকে নষ্ট করে ফেলে। (সহীহ বুখারী)

আল্লাহর পরিচয়ঃ আল্লাহ যথার্থ প্রত্যক্ষকারী

আল্লাহর নামঃ    وَاسِع সর্বব্যাপী     প্রাচুর্যময়,      عَلِیۡم   সর্বজ্ঞ।     غَنِیّ অভাবমুক্ত,  حَلِیۡمٌ পরম সহনশীল

আল্লাহর পথে ব্যয় ও দান-সদকা গ্রহণীয় হওয়ার জন্য ছয়টি শর্তঃ

 প্রথমতঃ যে ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয়, তা হালাল হতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ সুন্নাহ অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে।

তৃতীয়তঃ বিশুদ্ধ খাতে ব্যয় করতে হবে।

চতুর্থতঃ খয়রাত দিয়ে অনুগ্রহ প্রকাশ করা যাবে না।

পঞ্চমতঃ যাকে দান করা হবে,তার সাথে এমন ব্যবহার করা যাবে না, যাতে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

ষষ্টতঃ যা কিছু ব্যয় করা হবে, খাটি নিয়্যতের সাথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথেই করতে হবে – নাম-যশের জন্য নয়। অর্থাৎ ব্যয় করতে হবে ইখলাসের সাথে।

সূরা বাকারাঃ ৩৭তম রুকু(২৬৭-২৭৩) আয়াত

১। এখানে أَخْرَجْنَا শব্দ দিয়ে, ওশরী জমিতে যে ফসল উৎপন্ন হয়, তার এক-দশমাংশ দান করা ওয়াজিব(শষ্যের এক-দশমাংশ ইসলামী বিধান অনুযায়ী সরকারী তহবিলে জমা দিতে হয়)।

‘ওশর’ ও ‘খারাজ  ইসলামী শরীআতের দুটি পারিভাষিক শব্দ, উভয়টিই ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভূমির উপর আরোপিত কর।

ওশর’ শুধু কর নয়, এতে আর্থিক ইবাদাত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ; যেমন- যাকাত। এ কারণেই ওশরকে যাকাতুল-আরদ বা ‘ভূমির যাকাত’ও বলা হয়।

খারাজ শুধু করকে বোঝায়। এতে ইবাদাতের কোন দিক নেই। অমুসলিমরা ইবাদাতের যোগ্য নয়। তাই তাদের ভূমির উপর যে কর ধাৰ্য্য করা হয়, তাকে ‘খারাজ’ বলা হয়।

যাকাত ও ওশরের মধ্যে পার্থক্যঃ

১মঃ স্বর্ণ, রৌপ্য ও পণ্য সামগ্রীর উপর বছরান্তে যাকাত ওয়াজিব হয়, কিন্তু ওশর জমিতে উৎপাদনের সাথে সাথেই ওশর ওয়াজিব হয়।

 দ্বিতীয় পার্থক্যঃ জমিনে ফসল উৎপন্ন না হলে ওশর দিতে হয় না। কিন্তু পণ্য দ্রব্যে ও স্বর্ণ-রৌপ্যে মুনাফা না হলেও বছরান্তে যাকাত ফরয হবে।

২। খারাপ ও অতি নিম্নমানের জিনিস। নষ্ট হয়ে যাওয়া খারাপ জিনিসও যেন আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করা হয়

৩। একটি সৎকর্মের সওয়াব দশগুণ পাওয়া যায় এবং তা সাতশ গুণে পৌছে।বুখারী ৪১ ।আল্লাহ  তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন দানশীলদের জন্য।

কিন্তু শয়তানের কাজ হলো- সৎ পথে মাল ব্যয় করতে চাইলে শয়তান নিঃসব ও কাঙ্গাল হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। কিন্তু অন্যায় পথে ব্যয় করার সময় এই ধরনের কোন আশঙ্কা মনে আসতেই দেয় না;

৪। হেকমতের আসল অর্থ প্রত্যেক বস্তুকে যথাস্থানে স্থাপন করা। حِكمَة ‘হিকমত’এর অর্থ কেউ করেছেন, জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা/ সঠিক মত বা সিদ্ধান্ত, কুরআনের ‘নাসেখ-মানসুখ’ এর জ্ঞান এবং বিচার শক্তি। আবার কারো নিকট ‘হিকমত’ হল, কেবল সুন্নাতের জ্ঞান অথবা কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞান।

আল্লাহ যাকে ইচ্ছে হেকমত দান করেন এবং এর মাধ্যমে তাকে তো প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়;েখান থেকে  বিবেকসম্পন্নগণই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।

দুই ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা করা বৈধ। এক) যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন এবং সে তা সৎপথে ব্যয় করে। দুই) যাকে আল্লাহ হিকমত দান করেছেন যার দ্বারা সে বিচার-ফয়সালা করে এবং মানুষদেরকেও তা শিক্ষা দেয়। বুখারী

৫। نَذر ‘নযর তথা মানত বলতে বুঝায় কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোন কাজ করার শর্ত করা। যেমন, যদি আমার সন্তান হয় তাহলে আমি হজ করব বা যদি আমার ব্যবসায় সাফল্য আসে তবে আমি এত টাকা দান করব ইত্যাদি।

কিন্তু যদি কেউ মানত করে, তারপর যদি কাজটা সৎকাজ হয় তবে তা পূরণ করা ওয়াজিব। আর যদি অসৎকাজ হয় তাহলে তা পূরণ করা যাবে না।

ইবাদাত পালন করে তার অসীলায় দোআ করাই শরীআত নির্দেশিত সঠিক পন্থা।

৬। সাধারণ অবস্থায় গোপনে সাদাকাই উত্তম। তবে সাদাকা করার প্রতি মানুষকে উৎসাহ দানের  লক্ষ্য করে প্রকাশ্যেও তা করা যায়।

গোপন দান করায় বাহ্যিক উপকার না দেখে, বিষন্ন হওয়া উচিত নয়। কেননা,আল্লাহ গোনাহ মাফ করবেন।ও কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া লাভ করবে।

৭। হিদায়াতের পথে নিয়ে আসা কেবলমাত্র আল্লাহর এখতিয়ারাধীন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যা কিছু ব্যয় করবে, তার পুরাপুরি প্রতিদান আল্লাহ দিবেন।

দান করে অমুসলিম আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখাতেও নেকী পাওয়া যায়।

৮। আল্লাহ জানিয়েছেন কারা অভাবগ্রস্থ লোক দান করতে হবেঃ

ক)দ্বীনী কাজে নিয়োজিত ফলে জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করতে পারে না।

খ) ঈমানদার মিসকিন হল, অভাব-অনটন সত্ত্বেও তারা চাওয়া ও ভিক্ষা করা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করে এবং নাছোড় বান্দা হয়ে চাওয়া থেকে বিরত থাকে।

আল্লাহর নামঃ حَمِیۡدٌ প্রশংসিত, غَنِیٌّ অভাবমুক্ত, وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ  সর্বব্যাপী-প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ

 

সূরা বাকারাঃ ৩৮তম রুকু(২৭৪-২৮১) আয়াত

১। আয়াতে ঐ সকল লোকের বিরাট প্রতিদান ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে, যারা আল্লাহর পথে  রাত-দিনে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সবসময় ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর পথে ব্যয় করতে থাকে। তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য তাদের কোন বিপদাশংকা নেই এবং অতীতের ব্যাপারেও তাদের কোন চিন্তা নেই।

২। الربا (সূদ) এর আভিধানিক অর্থ হল, বাড়তি এবং বৃদ্ধি। শরীয়তে সূদ দুই প্রকার; ‘রিবাল ফায্ল(ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে) এবং ‘রিবান নাসীয়াহ (ঋণে মেয়াদের হিসাবে কোন মুনাফা নেয়া।)।

সুদখোরদের শাস্তিঃ * পাগল ও বুদ্ধিভ্রষ্ট লোকের চেহারায়(জ্বীনে ধরার মত) আত্মপ্রকাশ করবে৷ এই অবস্থা কবর থেকে উঠার সময় হবে অথবা হাশর প্রান্তরে হবে।

  • স্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি লাভ।

সুদখোরদের শাস্তির কারণ জানানো হয়েছে, (এক) সুদের মাধ্যমে হারাম খেয়েছে। (দুই) সুদকে হালাল মনে করেছে এবং যারা একে হারাম বলেছে, তাদের উত্তরে বলেছেঃ ‘ক্রয়-বিক্রয়ও তো সুদেরই অনুরূপ।

৩। সূদের অভ্যন্তরীণ ও আধ্যাত্মিক ক্ষতিসমূহ এবং সাদাকার বরকতসমূহের বিবরণঃ আল্লাহ্ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাকে বর্ধিত করেন।

৪। যারা সুদকে হারামই মনে করে না, তারা কুফরে লিপ্ত এবং যারা হারাম মনে করা সত্ত্বেও কার্যতঃ সুদ খায়, তারা গোনাহগার ও পাপাচারী। [মাআরিফুল কুরআন]

৫। আল্লাহর নিকট পুরস্কার লাভ ও চিন্তিত ভীত হবে না কারাঃ

ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, সালাত প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যাকাত দিয়েছে

৬। ঈমানয়ারদের আহবান করেছেন আল্লাহ- বকেয়া সুদ ছেড়ে দিতে ও তাকওয়া অবলম্বন করতে।

৭। ভয়ানক শাস্তি যদি সুদ থেকে সরে না আসেঃ  তোমরা যদি সুদ পরিহার না কর, তবে আল্লাহ তা’আলা ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও।

৮। সুদ হারাম হওয়ার পূর্বে যে ব্যক্তি সুদের অর্থ অর্জন করেছিল, সুদ হারাম হওয়ার পর সে যদি ভবিষ্যতের জন্য তাওবা করে নেয় এবং সুদ থেকে বিরত থাকে, তবে পূর্বেকার সঞ্চিত অর্থ শরীআতের নির্দেশ অনুযায়ী তারই অধিকারভুক্ত হয়ে গেছে

৯। আল্লাহ জানিয়েছেন- কারো উপর অত্যাচার করবে না এবং নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না।

১০। অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিকে ঋনশোধে যদি স্বচ্ছলতা পর্যন্ত তার অবকাশ দেয় অথবা  আর যদি সদকা করে দেয়া হয় তবে তা কল্যাণকর,

 রাসূল সা বলেছেন, পূর্বের যামানায় এক ব্যক্তি লোকদেরকে ঋণ দিত আর তার সন্তানদেরকে বলত যে, যখন কোন বিপদগ্রস্ত লোক আসে তখন তার কর্জ ক্ষমা করে দিও। হয়তো আল্লাহও আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। তিনি বলেনঃ অতঃপর (লোকটি মৃত্যুর পর) আল্লাহর সাক্ষাত পেল, তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। [বুখারীঃ ৩৪৮০]

১১। রাসূল সা সুদখোরকে লা’নত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ যে সুদ খায়, আর যে খাওয়ায়, আর যে লিখে এবং সুদের কর্মকাণ্ডের দুই সাক্ষী, তাদের প্রত্যেকের উপর আল্লাহর লা’নত হোক। [ইবনে মাজাহঃ ২২৭৭]

১২। ২৮১ নং আয়াতটি বলা হয় সর্বশেষ নাযিল। এরপর রাসূলুল্লাহ সা ৯ দিন জীবিত ছিলেন। ইবনে আব্বাস রা মতে রাসূলুল্লাহ সা মাত্র ৩১ দিন জীবিত ছিলেন। [ইবনে কাসীর] আর তোমরা সেই দিনের তাকওয়া অবলম্বন কর যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তারপর প্রত্যেককে সে যা অর্জন করেছে তা পুরোপুরি প্রদান করা হবে। আর তাদের যুলুম করা হবে না।

 

সূরা বাকারাঃ ৩৯তম রুকু(২৮২-২৮৩) আয়াত

ক। এই রুকুতে ঋনের বা লেন-দেনের যা চুক্তিনামা বলা হয় তার বিধান জানিয়ে দেয়া হয়েছেঃ

১ম নীতি: ধার-কর্জের লেনদেনে দলীল-দস্তাবেজ লিপিবদ্ধ করা উচিত ।

২য় নীতি : ধার-কর্জের ব্যাপারে মেয়াদ অবশ্যই নির্দিষ্ট করতে হবে। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার-কর্জের লেন-দেন জায়েয নয়। যার দায়িত্বে দেনা, সে লেখাবে। ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ অথবা দুর্বল শিশু কিংবা পাগল হয়, তাহলে তার অভিভাবক ইনসাফের সাথে লিখিয়ে নেওয়া, যাতে ঋণদাতার কোন ক্ষতি না হয়।

৩য়। লেখক নিরপেক্ষ হতে হবে – যাতে কারো মনে সন্দেহ-সংশয় না থাকে।

৪। লেখককে ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে

৫। লেখককে আল্লাহ তা’আলা এ লেখার বিদ্যা দান করেছেন। এর কৃতজ্ঞতায়, সে লিখতে অস্বীকার করবে না।

৬। দলীলের লেখাকেই যথেষ্ট মনে করবে না; বরং এতে সাক্ষ্যও রাখবে

সাক্ষ্য-বিধির জরুরী নীতিঃ

(১) সাক্ষী দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা হওয়া জরুরী।

(২) সাক্ষী মুসলিম হতে হবে। (مِنْ رِجَالِكُمْ) শব্দে এদিকেই নির্দেশ করা হয়েছে।

(৩) সাক্ষী নির্ভরযোগ্য আদিল’ (বিশ্বস্ত) হতে হবে, যার কথার উপর আস্থা রাখা যায়। ফাসেক ও ফাজের (অর্থাৎ পাপাচারী) হলে চলবে না। (مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ) বাক্যে এ নির্দেশ রয়েছে।

খ) আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ এবং আল্লাহ শিক্ষা দিবেন। আর আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সবিশেষ জ্ঞানী।

গ) সফর অবস্থায় বন্ধক রাখা জায়েয জানা যায়। অনুরূপভাবে মুকীম বা অবস্থানকালেও বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহণ করা জায়েয। নবী করীম (সাঃ)ও তাঁর লোহার বর্মটি একজন ইয়াহুদীর কাছে বন্ধক রেখেছিলেন। (বুখারী ২২০০নং,মুসলিম)

ঘ) সাক্ষ্য গোপন করা কাবীরা গুনাহ। সাক্ষ্য দিতে না চাওয়া এবং সাক্ষ্যে সত্য ঘটনা প্রকাশে বিরত থাকা উভয়টিই সত্য গোপন করার আওতায় পড়ে।

সূরা বাকারাঃ ৪০তম রুকু( ২৮৪-২৮৬) আয়াত

অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ আয়াত সমূহঃ

২৮৪ আয়াত নাযিল হলে পর সাহাবায়ে কেরাম বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। তাঁরা রসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে আরজি পেশ করেন, হে আল্লাহর রসূল! নামায-রোযা এবং যাকাত ও জিহাদ ইত্যাদি যে সমস্ত আমল করার নির্দেশ আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা আমরা করছি। কারণ, এ কাজগুলো আমাদের সামর্থ্যের বাইরে নয়। কিন্তু অন্তরে যেসব খেয়াল ও কুমন্ত্রণার সৃষ্টি হয় তার উপর তো আমাদের কোন এখতিয়ার নেই। সেগুলো তো মানুষের শক্তির বাইরের জিনিস। অথচ মহান আল্লাহ তারও হিসাব নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। নবী করীম (সাঃ) বললেন, ‘আপাতত তোমরা বল, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম।’

سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ٭۫ غُفۡرَانَکَ رَبَّنَا وَ اِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ

আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব। আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল। ২৮৫

এরপর সাহাবাদের শোনার ও মানার উদ্দীপনা দেখে মহান আল্লাহ উক্ত আয়াতকে

لا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا} আয়াত দ্বারা মানসুখ (রহিত) করে দিলেন। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল ক্বাদীর) বুখারী-মুসলিম এবং অন্যান্য সুনান গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসটিও এর সমর্থন করে, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের অন্তরে উদীয়মান খেয়ালের কোন বিচার করবেন না, যে পর্যন্ত না তা কাজে পরিণত করবে অথবা মুখে উচ্চারণ করবে।(বুখারী ২৫২৮-মুসলিম ১২৭নং)

রাসূল সা বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন মুমিনকে আল্লাহ্ তা’আলার নিকটবর্তী করা হবে এবং আল্লাহ তাকে এক এক করে সব গোনাহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করবেনঃ এ গোনাহটি কি তোমার জানা আছে? মুমিন স্বীকার করবে। আল্লাহ্ তাআলা বলবেনঃ আমি দুনিয়াতেও তোমার গোনাহ জনসমক্ষে প্রকাশ করিনি, আজও তা ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর নেক কাজের আমলনামা তার হাতে অর্পণ করা হবে। পক্ষান্তরে কাফের ও মুনাফেকদের পাপকাজসমূহ প্রকাশ্যে বর্ণনা করা হবে। [বুখারীঃ ২৪৪১, মুসলিমঃ ২৭৬৮]

আল্লাহ সর্বময় ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। শাস্তি দেয়ার ও মাফ করার পূর্ণ ইখতিয়ার আল্লাহর রয়েছে

২৮৫ ও ২৮৬ আয়াতের ব্যপারে জানা যায়ঃ

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি সূরা বাক্বারার শেষের দু’টি আয়াত রাতে পড়ে নেয়, তার জন্য এই আয়াত দু’টিই যথেষ্ট হয়ে যায়।’’ (বুখারী, ইবনে কাসীর) অর্থাৎ, এই আমলের কারণে মহান আল্লাহ তার হেফাযত করবেন।

নবী করীম (সাঃ) মিরাজের রাতে যে তিনটি জিনিস পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল, সূরা বাক্বারার শেষের এই দু’টি আয়াত। (সহীহ মুসলিম)

এই সূরার শেষের আয়াত দু’টি রসূল (সাঃ)-কে আরশের নীচের একটি ভান্ডার থেকে দেওয়া হয় এবং এই আয়াত কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়, অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। (আহমদ, নাসায়ী,

মুমিনদের জন্য বলা হয়েছে—-

প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর,ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ এবং রাসূলগণের উপর। তাঁর রাসূলগনের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। তারা বলেঃ আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব। আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল।

আল্লাহর রহমত, তাঁর দয়া এবং তাঁর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তিনি মানুষকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না।

সে ভাল যা উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই, আর মন্দ যা কামাই করে তার প্রতিফল তার উপরই বার্তায়।

তারপর আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদেরকে একটি বিশেষ দো’আ শিক্ষা দিয়েছেন।

ভুল-ভ্রান্তিবশতঃ কোন কাজ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি

পূর্ববর্তী উম্মতদের মত শাস্তিও যেন এ উম্মতের উপর না আসে, তার জন্য বিশেষভাবে দো’আ।

رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذۡنَاۤ اِنۡ نَّسِیۡنَاۤ اَوۡ اَخۡطَاۡنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تَحۡمِلۡ عَلَیۡنَاۤ اِصۡرًا کَمَا حَمَلۡتَهٗ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تُحَمِّلۡنَا مَا لَا طَاقَۃَ لَنَا بِهٖ ۚ وَ اعۡفُ عَنَّا ٝ وَ اغۡفِرۡ لَنَا ٝ وَ ارۡحَمۡنَا ٝ اَنۡتَ مَوۡلٰىنَا فَانۡصُرۡنَا عَلَی الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۲۸۶﴾

হে আমাদের রব! যদি আমরা বিস্মৃৎ হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের উপর তেমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না যার সামর্থ আমাদের নেই। আর আপনি আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। ২৮৬

সুরা আল বাকারা সমাপ্ত

আলে ইমরান (১ম-৯ম)রুকু

আলে ইমরান- ১ম রুকু (১-৯) আয়াত

১। এ আয়াতে তাওহীদের ইতিহাসভিত্তিক প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।

 রাসূলুল্লাহ সা বলেছেনঃ দু’টি আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তা’আলার ইসমে আযম রয়েছে, এক, (وَإِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَٰنُ الرَّحِيمُ) দুই, সূরা আলে ইমরানের প্রথম দু’ আয়াত’। [তিরমিযীঃ ৩৪৭৮]

حَيٌّ এবং قَيُّومٌ মহান আল্লাহর বিশেষ গুণ। ‘হায়্যুন অর্থ তিনি চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু ও ধ্বংস নেই। ‘ক্বায়্যুম অর্থ, তিনি নিখিল বিশ্বের ধারক, সংরক্ষণকারী এবং পর্যবেক্ষক। বিশ্বের সব কিছুই তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।

২। এই কুরআন পূর্বতন সকল নবী-রাসূল ও যাবতীয় কিতাবের সত্যয়নকারী। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

৩। অবশ্যই তাওরাত এবং ইঞ্জীল সব সব সময়ে মানুষের হিদায়াতের উৎস ছিল। কিন্তু পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার পর এ দুটি গ্রন্থ রহিত হয়ে গেছে, তা থেকে হিদায়াত লাভের আর কোন উপায় নেই। আয়াতে ফুরকান বলে পবিত্র কুরআনকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মাদ সা উপর তা নাযিল করে এর মাধ্যমে হক ও বাতিলের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

৪। আল্লাহর পরিচয়ঃ  * তিনি চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু ও ধ্বংস নেই। ‘ক্বায়্যুম অর্থ, তিনি নিখিল বিশ্বের ধারক, সংরক্ষণকারী এবং পর্যবেক্ষক।

  • আল্লাহ, আসমান ও যমীনের কোন কিছুই তার কাছে গোপন থাকে না।
  • রব তার বান্দাদেরকে মায়ের গর্ভে যেভাবে ইচ্ছা গঠন করতে পারেন।

৫। কুরআনুল কারীমে দুই প্রকার আয়াত রয়েছে। এক প্রকারকে মুহকামাত তথা সুস্পষ্ট আয়াত এবং অপর প্রকারকে মুতাশাবিহাত তথা অস্পষ্ট আয়াত বলা হয়।

মুহকামাতঃ আল্লাহ্ তা’আলা ‘উম্মুল কিতাব আখ্যা দিয়েছেন। এর অর্থ এই যে, এসব আয়াতই সমগ্র শিক্ষার মূল ভিত্তি।

রাসূলুল্লাহ সা এ আয়াতখানি তিলাওয়াত করে বললেন, “যখন তোমরা তাদেরকে দেখবে যারা এ সমস্ত (মুতাশাবিহ) আয়াতের পিছনে দৌড়াচ্ছে, তখন বুঝে নিবে যে, আল্লাহ এ সমস্ত লোকের কথাই পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তখন তাদের থেকে সাবধান থাকবে।” [বুখারী ৪৫৪৭; মুসলিম: ২৬৬৫]

৬। আল্লাহ দু’আ শিখিয়ে দিয়েছেন—

 رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوۡبَنَا بَعۡدَ اِذۡ هَدَیۡتَنَا وَ هَبۡ لَنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ رَحۡمَۃً ۚ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡوَهَّابُ

হে আমাদের রব সরল পথ দেয়ার পর আপনি আমাদের অন্তরসমূহকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করবেন না। আর আপনার কাছ থেকে আমাদেরকে করুণা দান করুন, নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা। ৮ নং

হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি সমস্ত মানুষকে একদিন একত্রে সমবেত করবেন এতে কোন সন্দেহ নেই; নিশ্চয় আল্লাহ ওয়াদা খেলাফ করেন না।

আল্লাহর নামঃ لۡعَزِیۡز প্রবল পরাক্রমশালী, الۡحَکِیۡمُ প্রজ্ঞাময়।

 

আলে ইমরান-  ২য় রুকু (১০-২০) আয়াত

১। মহান আল্লাহ এ আয়াতে কাফেরদের সম্পর্কে জানিয়ে দিচ্ছেন যে,

তারা জাহান্নামের ইন্ধন হবে। দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তাদের কোন উপকার দিবে না এবং আল্লাহর কঠোর শাস্তি ও কঠিন পাকড়াও থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হবে না।

ফিরআউনী সম্প্রদায় ও পূর্ববর্তীদের  ন্যায়, আল্লাহর আয়াতগুলোতে মিথ্যারোপ করেছিল, ফলে আল্লাহ্‌ তাদের পাপের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেছিলেন।

২। কাফেররা পরাজিত হবে।(এখানে ইহুদীদের কথা বলা হয়েছে। বানু ক্বাইনুক্বা’ ও বানু নাযীরকে দেশ থেকে বহিষ্কার এবং বানু ক্বুরায়যাকে হত্যা করা হয়েছিল।খায়বার বিজয়ের পর সমস্ত ইয়াহুদীদের উপর জিযিয়া-কর আরোপ করা হয়েছিল। (ফাতহুল ক্বাদীর)

৩। বদর যুদ্ধের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এখানেও আল্লাহ বলেছেন নিদর্শন রয়েছে। এ যুদ্ধ হিজরতের দ্বিতীয় বছরে মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। কয়েক দিক দিয়ে এটি ছিল বড়ই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। প্রথমতঃ এটি ছিল প্রথম যুদ্ধ। দ্বিতীয়তঃ পূর্বে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ছিল এই যুদ্ধ। কাফেরদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। তাদের কাছে সাতশ উট ও একশ’ অশ্ব ছিল। মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিনশ’র কিছু বেশী। তাদের কাছে সর্বমোট সত্তরটি উট, দুটি অশ্ব, ছ’টি লৌহবর্ম এবং আটটি তরবারী ছিল।

তারা তাদেরকে চোখের দেখায় দেখছিল তাদের দ্বিগুণ। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয়ই এতে অস্তদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।

৪। আল্লাহ তা’আলা মানুষের মনে এসব বস্তুর (নারী, সন্তান, সোনারূপার স্তুপ, বাছাই করা ঘোড়া, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের) প্রতি আসক্তি স্বভাবগতভাবেই আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া যে, কে এগুলোর আকর্ষণে মত্ত হয়ে আখেরাতকে ভুলে যায় এবং কে এসবের আসল স্বরূপ ও ধ্বংসশীল হওয়ার বিষয় অবগত হয়ে শুধু যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অর্জনে সচেষ্ট হয় ও আখেরাতের কল্যাণ আহরণের লক্ষ্যে তার সুচারু ব্যবহার করে।

আল্লাহ জানিয়েছেন- সব ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহর নিকটেই উত্তম আশ্রয়স্থল রয়েছে।

৫। আল্লাহ ঈমানদারদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, উল্লিখিত পার্থিব জিনিসেই তোমরা নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলো না, – তোমরা আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করো। এই আল্লাহভীরুতার গুণ সৃষ্টি হয়ে গেলে, নিশ্চিতভাবে  দ্বীন ও দুনিয়ার সমূহ কল্যাণ দ্বারা নিজেদের ঝুলি ভরে নিবে। পবিত্রা সঙ্গিনীগণঃ অর্থাৎ, তারা পার্থিব নোংরামী, হায়েয-নিফাস এবং অন্যান্য অপবিত্রতা থেকে পবিত্রা এবং নির্মলচরিত্রা হবে

এই ঈমানদাররা এইভাবে বলে—

رَبَّنَاۤ اِنَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوۡبَنَا وَ قِنَا عَذَابَ النَّارِ

হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমরা ঈমান এনেছি; কাজেই আপনি আমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন। ১৬নং

তাদের গুনাবলী আল্লাহ জানিয়েছেন- তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থী।

৬। পৃথিবীতে ইলাহের স্বত্ব দাবী করার অধিকার ও যোগ্যতা কারও নেই। তিনি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কোন হক্ক ইলাহ নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করা যুলুম ও অন্যায়।

ফিরিশতাগণ এবং জ্ঞানিগণও তাঁর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেন। এতে জ্ঞানী ব্যক্তিদের বড়ই ফযীলত ও মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। কেননা মহান আল্লাহ স্বীয় ফিরিশতাদের পাশাপাশি তাঁদেরকে উল্লেখ করেছেন। তবে জ্ঞানী বলতে তাঁরা, যাঁরা কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে ধন্য হয়েছেন। (ফাতহুল ক্বাদীর)

৭। আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। এটা পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ, তার ফেরেশতা এবং জ্ঞানীদের সাক্ষ্যের বিষয়। অর্থাৎ তারা এ সাক্ষ্যও দিচ্ছেন যে, আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।

৮। কিতাবধারীরা (ইহুদি নাসারা)কেবলমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ তাদের নিকট জ্ঞান আসার মতানৈক্য ঘটিয়েছিল। কেবল হিংসা-বিদ্বেষ এবং শত্রুতার কারণে ছিল। অর্থাৎ, তারা সত্যকে জেনে ও চিনেছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও কেবল দুনিয়ার খেয়ালী স্বার্থের পিছনে পড়ে ভ্রান্তমূলক কথার উপরে কায়েম থাকত এবং সেটাকেই দ্বীন বুঝানোর চেষ্টা করত।

৯। যদি কিতাবধারীরা রাসূল সা এর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় তবে বলুন, আমি ইসলামকে কবুল করেছি এবং আমার অনুসারিগণও। এর মাধ্যমে অপরাপর ধর্মের অনুসারীরা মুসলিমদের ব্যাপারে হতাশ হয়ে যাবে যে, তাদেরকে আবার বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই।

তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনার(রাসূলের) কর্তব্য শুধু প্রচার করা।

‘নিরক্ষর’ বলতে আরবের মুশরিকদের বুঝানো হয়েছে। তারা আহলে কিতাবদের তুলনায় সাধারণভাবে নিরক্ষর ছিল।

আল্লাহর পরিচয়ঃ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর।

       بَصِیۡرٌۢ بِالۡعِبَادِ  বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা

আলে ইমরান-  ৩য় রুকু (২১-৩০) আয়াত

 

১। মহান আল্লাহ জানিয়েছেন কারা কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে, যাদের কার্যাবলী দুনিয়া ও আখেরাতে নিস্ফল হয়েছে এবং তাদের কোন সাহায্যকারী নেইঃ

 যারা আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহে কুফরী করে, অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা করে এবং মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে।

২। আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদীরা। তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল যাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা হয়, তাদেরকে আল্লাহর নবীর প্রতিও আহবান জানানো হয়েছিল যাতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্যজনিত বিষয়ে তিনি ফয়সালা করে দেন। তারা সে কিতাব ও নবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

৩। মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারনে তাদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা কখনোও জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আর যদি জাহান্নামে প্রবেশ করেও তাহলে তা হবে কেবল কয়েক দিনের জন্য। আর এই মিথ্যা উদ্ভাবন ও অমূলক ধারণাই তাদেরকে প্রবঞ্চনা ও ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখেছে।

৪। আল্লাহ ওদের ব্যপারে বলেছেন, আখেরাতে একত্র করবেন, প্রত্যেকেই তার কৃত কাজের ফল ভোগ করবে। কারো উপর কোন প্রকার যুলুম করা হবে না।

৫। আল্লাহর পরিচয়ঃ

২৬,২৭ নং আয়াতে রয়েছে মহান আল্লাহর সীমাহীন শক্তি ও তাঁর মহা কুদরতের প্রকাশ। হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান ও কেড়ে নেয়া যাকে ইচ্ছা  সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা  হীন করেন। কল্যাণ আল্লাহরই হাতে।

 রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে প্রবিষ্ট করান; মৃত থেকে জীবন্তের, আবার জীবন্ত থেকে মৃতের আবির্ভাব ঘটান। আর যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযক দান করেন।

মুআ’য (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার অভিযোগ করলে তিনি তাকে বললেন, তুমি [اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ] আয়াতটি পাঠ করে এই দু’আটি করো,

‘এটা এমন একটি দু’আ যে, তোমার উপর উহুদ পাহাড় সমানও যদি ঋণ থাকে, মহান আল্লাহ সে ঋণকেও তোমার জন্য আদায় করার ব্যবস্থা করে দিবেন।’’

(মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ ১০/১৮৬ হাদীসের বর্ণনাকারীরা সবাই নির্ভরযোগ্য)

৬। আউলিয়া ওলীর বহুবচন। আর ওলী এমন বন্ধুকে বলা হয়, যার সাথে থাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক। যেমন, মহান আল্লাহ নিজেকে ঈমানদারদের ওলী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ঈমানদারদের পারস্পরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক থাকে। তারা আপোসে একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এখানে মহান আল্লাহ মু’মিনদেরকে কাফেরদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কারণ, কাফেররা আল্লাহর শত্রু এবং মু’মিনদেরও। অবশ্য (পার্থিব) প্রয়োজন ও সুবিধার দাবীতে তাদের সাথে সন্ধি ও চুক্তি হতে পারে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনও। অনুরূপ যে কাফের মুসলিমদের সাথে শত্রুতা রাখে না, তার সাথে উত্তম ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা বৈধ।

কাফের দেশে অবস্থানের সময় যদি কোন সময় তাদের (কাফেরদের) সাথে বন্ধুত্বের প্রকাশ করা ব্যতীত তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে মৌখিকভাবে বন্ধুত্বের প্রকাশ করতে পারবে।

৭। অন্তরে যা আছে তা যদি  গোপন করে বা ব্যক্ত করে, আল্লাহ তা অবগত আছে্।

৮। আখেরাতে নিজেদের পাপ ও পূন্যের আমলনামা দেখে ,সেদিন সে কামনা করবে, যদি তার ও ওর (দুষ্কর্মের) মধ্যে বহু দূর ব্যবধান হতো!

৯।বস্তুতঃ আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে  সাবধান করছেন।কারন আল্লাহ দাসদের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহশীল।

আলে ইমরান-   ৪র্থ রুকু (৩১-৪১) আয়াত

১। এখানে আল্লাহর ভালোবাসার দাবী যারা করে তাদের বলা হয়েছে-

 তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ্‌ অত্যান্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। কেবল মৌখিক দাবী এবং মনগড়া তরীকায় আল্লাহর ভালবাসা এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না। এ সব লাভ করার পথ তো একটাই। আর তা হল, শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর ঈমান আনা এবং তাঁর অনুসরণ করা।

২। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা ফরয। আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্যের মধ্যে তারতম্য করা যাবে না। আল্লাহর নির্দেশ যেমন মানতে হবে, তেমনি রাসূলের নির্দেশও মানতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, “আমি যেন কাউকে এ রকম না দেখতে পাই যে, সে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে, তখন তার কাছে আমি যে সমস্ত আদেশ-নিষেধ দিয়েছি সে সমস্ত আদেশ-নিষেধের কোন কিছু এসে পড়ল, তখন সে বললঃ আমরা জানি না, আমরা আল্লাহর কিতাবে যা পেয়েছি তার অনুসরণ করেছি।” [আবু দাউদ ৪৬০৫; তিরমিযী: ২৬৬৩;

৩। আদম, নূহ, ইব্রাহীমের বংশধর ইমরানের বংশধরকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপর মনোনীত করেছেন। তারা একে অপরের বংশধর।

ইমরান বলতে মারইয়াম ‘আলাইহাস সালামের পিতাকে বুঝানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মূসা আলাইহিস সালাম এর পিতার নামও ইমরান ছিল। [মুসলিম: ১৬৫]

দ্বীনের ব্যাপারে একে অপরের সহযোগী ও সাহায্যকারী।

৪। মরিয়াম আ এর জীবন আলোচনা এসেছে। মরিয়াম আ এর মা ইমরানের স্ত্রী তার গর্ভে যা কিছু আছে তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দিয়ে দেয়ার মনস্থ করেছিলেন। কাজেই আপনি আমার নিকট থেকে তা কবুল করুন, নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

  1. কন্যা সন্তান হয়, নাম রাখেন মারিয়াম, দু’আ করেন যেন শয়তান স্পর্শ না করে।

জন্মের দিনই নাম রাখা জায়েয।

‘যখন কোন সন্তান জন্ম নেয়, তখন শয়তান তাকে স্পর্শ করে, ফলে সে চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালা শয়তানের এই স্পর্শ থেকে মারয়্যাম (আ) এবং তাঁর পুত্র ঈসা (আঃ)-কে রক্ষা করেছেন।’’ (বুখারী ৩৪৩১, মুসলিম ২৩৬৬নং)

যাকারিয়া (আঃ)ছিলেন মারয়্যাম (আ)-এর খালু এবং সেই সময়কার পয়গম্বরও। তাই সর্বোত্তম অভিভাবক ও তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার জন্য তিনিই ছিলেন উপযুক্ত।

৬।মিহরাব’ বলতে ছোট একটি ঘর যেখানে মারয়্যাম (আ) থাকতেন। ‘রিযক’ (খাদ্য-সামগ্রী) বলতে ফলমূল। প্রথমতঃ এই ফলগুলো হত অসময়ের। গ্রীষেমর ফল শীতে এবং শীতের ফল গ্রীষেমর মৌসুমে মরিয়াম আ এর ঘরে বিদ্যমান থাকত।যাকারিয়া আ এর প্রশ্নের উত্তরে(মারইয়াম) বলতেন, তা আল্লাহর নিকট হতে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছে অপরিমিত রিযক দান করেন।

অস্বাভাবিক অলৌকিক কার্যকলাপকে মু’জিযা ও কারামত বলা হয়।যা আল্লাহর হুকুমে যথাক্রমে নবী ও অলীদের কাছে হয়ে থাকে।

৭। নিঃসন্তান বৃদ্ধ যাকারিয়া আ দু’আ করলেন-

رَبِّ هَبۡ لِیۡ مِنۡ لَّدُنۡکَ ذُرِّیَّۃً طَیِّبَۃً ۚ اِنَّکَ سَمِیۡعُ الدُّعَآءِ

হে আমার রব! আমাকে আপনি আপনার নিকট থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। ৩৮ নং

সন্তান হওয়ার জন্য দোআ করা রাসূলগণের ও নেককারদের সুন্নাত।

৮।আল্লাহ যাকারিয়া আ এর জন্য সন্তান ইয়াহইয়ার আ সুসংবাদ দিচ্ছেন, পরিচয় তুলে ধরেছেন যে, এক কালেমাকে সত্যায়নকারী (ইসা আ এর), নেতা, ভোগ আসক্তিমুক্ত এবং পূণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত একজন নবী।

৯। যাকারিয়্যা আ এর স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন, আল্লাহ জানান-আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।

যাকারিয়্যা আ বললেন,হে আমার রব! আমাকে একটি নিদর্শন দিন। তখন  নিদর্শন এই যে, তিন দিন ইঙ্গিত ছাড়া কথা বলবেন না আর আপনার রবকে অধিক স্মরণ করুন এবং সন্ধ্যায় ও প্রভাতে তার পবিত্রতা-মহিমা ঘোষণা করুন।

আলে ইমরান-  ৫ম রুকু (৪২-৫৪) আয়াত

১। আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ বলেছিল, হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে মনোনীত করেছেন এবং পবিত্র করেছেন আর বিশ্বজগতের নারীগণের উপর আপনাকে মনোনীত করেছেন। রবের অনুগত এবং সিজদা করতে আর রুককারীদের সাথে রুকু করতে নির্দেশ দেন।

“সৃষ্টিকুলের মহিলাদের মধ্যে শুধু উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মারইয়াম বিনতে ইমরান, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ ও ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া।” [তিরমিযী: ৩৮৭৮;

২। মারইয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব  কে গ্রহণ করবে,তারা কলম ফেলে লটারী করে  সেটা নির্ধারণ করছিলেন, যাকারিয়্যা আ এর নাম এসেছে বার বার। এই গায়েবের খবর আল্লাহ রাসূল সা কে জানিয়েছেন।

৩। ঈসা (আঃ)-কে ‘কালিমাতুল্লাহ’(আল্লাহর কালেমা) বলা হয়েছে যে, তাঁর জন্ম আল্লাহর অলৌকিক শক্তির প্রকাশ স্বরূপ, মানুষ সৃষ্টির নিয়ম-বহির্ভূত বিনা পিতায় মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতে ‘কুন’ কালেমা (বাণী) দ্বারা হয়েছে।

مَسِيْحٌ (মাসীহ) مَسَحَ ধাতু থেকে গঠিত। খুব বেশী যমীনে ভ্রমণকারীকে বলা হয় مَسَحَ الأَرْضَ । অথবা এর অর্থ হল, হাত বুলিয়ে দেওয়া।

ঈসা আ এর নাম আল্লাহই দিয়েছেন- তার নাম মসীহ, মারইয়াম তনয় ঈসা, তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হবেন।

দোলনায় ও বয়োঃপ্রাপ্ত অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলবেন। এবং তিনি হবেন পূণ্যবানদের একজন।

৪। কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি মরিয়াম আ বলেন, (আল্লাহ) বললেন, ‘এভাবেই’, আল্লাহ যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘হও ফলে তা হয়ে যায়। (আল্লাহ) তাকে শিক্ষা দেবেন লিখন, প্রজ্ঞা, তওরাত ও ইঞ্জীল।

৫। বনী ইসরাঈলের জন্য রাসূলরূপে প্রেরিত ইসা আ এর মুযেজা তুলে ধরা হয়েছে। নিদর্শন রয়েছে মুমিনদের জন্য। তিনি তাওরাতের সত্যায়নকারীরূপে এবং যা হারাম ছিল তার কিছু হালাল করে দিতে, রবের পক্ষ থেকে নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছেন। কাজেই আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং আমার আনুগত্য কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব, কাজেই তোমরা তারই ইবাদাত কর। এটাই সরল পথ।

৬। حَوَارِيُّوْنَ (হাওয়ারিয়্যুন) حَوَارِي (হাওয়ারী) শব্দের বহুবচন। যার অর্থ হল, সাহায্যকারী (শিষ্য)। যেমন, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক নবীর একজন বিশেষ সাহায্যকারী ছিল। আমার বিশেষ সাহায্যকারী হল যুবায়ের। (বুখারী ২৮৪৭, মুসলিম ২৪১৫নং)

ঈসা আলাইহিস সালামের খাঁটি ভক্তদের উপাধি ছিল হাওয়ারী- তাদের আন্তরিকতা ও মনের স্বচ্ছতার কারণে অথবা যেহেতু তারা সাদা পোষাক পরিধান করতেন।

গভীর ষড়যন্ত্র এবং সন্দেহজনক আচরণ যার ভিত্তিই ছিল কুফরী তথা মাসীহ (আঃ)-এর রিসালাতকে অস্বীকার করার উপর। তখন ঈসা আ আল্লাহর পথে সাহায্যকারী কে হবে আহবান করেন। তারা বললো, আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহতে ঈমান এনেছি। আর আপনি সাক্ষী থাকুন যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।

৭। দু’আঃ رَبَّنَاۤ اٰمَنَّا بِمَاۤ اَنۡزَلۡتَ وَ اتَّبَعۡنَا الرَّسُوۡلَ فَاکۡتُبۡنَا مَعَ الشّٰهِدِیۡنَ

হে আমাদের রব! আপনি যা নাযিল করেছেন তার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এ রাসূলের অনুসরণ করেছি কাজেই আমাদেরকে সাক্ষ্যদানকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন। ৫৩ নং

৮। তারা ষড়যন্ত্র করল এবং আল্লাহও কৌশল প্রয়োগ করলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী।

আরবী ভাষায় ‘মাকর’ শব্দের অর্থ সুরক্ষা ও গোপন কৌশল। উত্তম লক্ষ্য অর্জনের জন্য মকর ভাল এবং মন্দ লক্ষ্য অর্জনের জন্য হলে তা মন্দও হতে পারে।

ঈসা (আঃ)-এর যামানায় শাম (সিরিয়া) অঞ্চল রোমক শাসনের অন্তর্গত ছিল। এখানে রোমকদের পক্ষ থেকে যাকে শাসক নির্বাচিত করা হয়েছিল সে কাফের ছিল। ইয়াহুদীরা ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে এই শাসকের কান ভারী করল।

আল্লাহর পরিচয়ঃ  خَيْرُ المَاكِرِيْنَ (সর্বোত্তম কৌশলী)

আলে ইমরান- ৬ষ্ঠ রুকু (৫৫-৬৩) আয়াত

১। মূল শব্দ হচ্ছে, মুতাওয়াফ্ফীকা ( مُتَوَفِّيكَ ) মূল তাওয়াফ্ফা (توفى) শব্দের আসল মানে হচ্ছেঃ নেয়া ও আদায় করা বা পুরোপুরি কিছু নেওয়া৷ “প্রাণবায়ু বরে করে নেয়া” হচ্ছে এর গৌণ ও পরোক্ষ অর্থ, মূল আভিধানিক অর্থ নয়৷ এখানে এ শব্দটি ইংরেজী To Recall এর অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে৷ এর অর্থ হয়, কোন পদাধিকারীকে তার পদ থেকে ফিরিয়ে ডেকে নেয়া৷ হে ঈসা! আমি তোমাকে ইয়াহুদীদের চক্রান্ত থেকে পরিপূর্ণভাবে আমার কাছে আসমানে উঠিয়ে নিব।

“তারা ঈসাকে হত্যা করেনি, শূলীতেও চড়ায়নি। কিন্তু আল্লাহর কৌশলে তারা সাদৃশ্যের ধাধায় পতিত হয়।” [সূরা আন-নিসাঃ ১৫৭]

২। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইয়াহুদীদের বিপক্ষে ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে পাঁচটি অঙ্গীকার করেছেনঃ

সর্বপ্রথম অঙ্গীকার এই যে, তার মৃত্যু ইয়াহুদীদের হাতে হত্যার মাধ্যমে হবে না; বরং প্রতিশ্রুত সময়ে স্বাভাবিক পস্থায় হবে। প্রতিশ্রুত সময়টি কেয়ামতের নিকটতম যামানায় আসবে। তখন ঈসা আলাইহিস সালাম আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। বিভিন্ন সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীসে এর বিবরণ রয়েছে।

দ্বিতীয় অঙ্গীকার ছিল যে, ঈসা আলাইহিস সালামকে আপাততঃ উর্ধ্ব জগতে তুলে নেয়া হবে। সাথে সাথে এ অঙ্গীকার পূর্ণ করা হয়।

তৃতীয় অঙ্গীকার ছিল শক্ৰদের অপবাদ থেকে মুক্ত করা। এ অঙ্গীকার এভাবে পূর্ণ হয়েছে যে, শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করে ইয়াহুদীদের যাবতীয় অপবাদ দূর করে দেন।

চতুর্থ অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীর বিপক্ষে আপনার অনুসারীদের কেয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী রাখা হবে। ঈসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতে বিশ্বাস করা ও স্বীকারোক্তি করা। মুসলিমরাও ঈসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতে বিশ্বাসী।

পঞ্চম অঙ্গীকার এই যে, কেয়ামতের দিন সব ধর্মীয় মতবিরোধের মীমাংসা করা হবে। সময় এলে এ অঙ্গীকারও পূর্ণ হবে।

৩। যারা কুফরী করেছে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে এবং তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।

৪। যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের প্রতিফল পুরোপুরিভাবে প্রদান করবেন। আর আল্লাহ্‌ যালেমদের পছন্দ করেন না।আল্লাহ জানাচ্ছেন  আয়াতসমূহ ও হেকমতপূর্ণ বাণী থেকে।

৫। নিশ্চয় আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্তসদৃশ। তিনি তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন; তারপর তাকে বলেছিলেন, ‘হও ফলে তিনি হয়ে যান।

৬। ৯ম হিজরীতে নাজরান থেকে খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধিদল নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে এসে তারা যে ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে অতিরঞ্জনমূলক আকীদা রাখত, সে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হয়।

আল্লাহ্ তা’আলা মহানবী সা কে মুবাহালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুবাহালা হলো, যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আল্লাহর লানতের অধিকারী হয়। মূলত: লা’নত অর্থ আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া মানেই আল্লাহর ক্রোধে পড়া।

আল্লাহর পরিচয়ঃ  আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন হক ইলাহ নেই। তিনি তো পরম পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

আলে ইমরান- ৭ম রুকু (৬৪-৭১) আয়াত

১। মুবাহালার পরও যদি এরা ইমান না আনে অর্থাৎ, ঈসা সম্বন্ধে সত্য ইতিহাসকে অস্বীকার করে), তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত।

ইবন আব্বাস বলেন, “যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুবাহালাহ করতে চেয়েছিল তারা যদি তা করত তবে তারা ফিরে গিয়ে কোন সম্পদ-পরিবার খুজে পেত না। [তিরমিযী: ৩৩৪৫, মুসনাদে আহমাদ ১/২৪৮]

২। দ্বীনের প্রতি আমন্ত্রণ জানানোর একটি মূলনীতি জানা যায়। তা এই যে, ভিন্ন মতাবলম্বী কোন দলকে দ্বীনের প্রতি আমন্ত্রণ জানাতে হলে প্রথমে তাকে শুধু এমন বিষয়ের প্রতিই আহবান জানানো উচিত, যে বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হতে পারে।

হে আহলে কিতাবগণ! এস সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না করি, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া একে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রোম সম্রাটকে ইসলামের দাওয়াত দেন, তখন এমন বিষয়ের প্রতি আহবান জানান, যাতে উভয়েই একমত ছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদ।

৩। ইবরাহীম (আঃ)-এর ব্যাপারে বিতর্কের অর্থ হল, ইয়াহুদী এবং খ্রিষ্টান উভয় জাতিই দাবী করত যে, তিনি তাদের ধর্মাবলম্বি ছিলেন। অথচ তাওরাত যার উপর ইয়াহুদীরা ঈমান রাখতো এবং ইঞ্জীল যেটাকে খ্রিষ্টানরা মানতো, এই উভয় গ্রন্থ ইবরাহীম (আঃ)-এর শত সহস্র বছর পর অবতীর্ণ হয়েছে।

৪।যে বিষয়ে সামান্য জ্ঞান আছে ও যে বিষয়ে কোন জ্ঞান নাই, সে বিষয়ে তর্ক না করা। আল্লাহই জানেন সবকিছু।

 ইবরাহীম আ এর পরিচয়ঃ [حَنِيْفًا مُّسْلِمًا]  (একনিষ্ঠ মুসলিম) অর্থাৎ, শিরক থেকে বিমুখ হয়ে কেবল এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী।

৫। ইবরাহীম আএর ঘনিষ্ঠতম যারা তার অনুসরণ করেছে এবং এ নবী ও যারা ঈমান এনেছে; আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘নবীদের মধ্য থেকে প্রত্যেক নবীর কিছু বন্ধু হয়, তাঁদের মধ্য থেকে আমার বন্ধু হল আমার পিতা এবং আমার মহান প্রতিপালকের খলীল (অতীব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইবরাহীম (আঃ))। অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন। (তিরমিযী ২৯৯৫নং)

৬। ঈমানদারদের প্রতি ইয়াহুদীরা যে হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করত এবং যার কারণে তারা মুসলিমদেরকে ভ্রষ্ট করতে চাইত।কিন্ত মূলত তারাই ভ্রষ্টপথে চলছে।

৭। ইয়াহুদীদের দু’টি অতি বড় অপরাধ উল্লেখ করে তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দান করা হচ্ছে। প্রথম অপরাধ হল, ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে মিশ্রিত করণ; যাতে মানুষের কাছে সত্য ও মিথ্যা পরিষ্কার না হয়। দ্বিতীয় অপরাধ হল, সত্যকে গোপন করা।

আলে ইমরান- ৮ম রুকু (৭২-৮০) আয়াত

১। এখানে কিতাবীরা পরস্পরকে বলে যে তোমরা কখনও কোন মুসলিমকে বিশ্বাস করে তোমাদের গোপন মনের কথা বলে দিও না। এতে তারা সাবধান হয়ে যাবে। [তাফসীরে ইবন কাসীর] আল্লাহ জানিয়েছেন-

বলুন, নিশ্চয় আল্লাহর নির্দেশিত পথই একমাত্র পথ। নিশ্চয় অনুগ্রহ আল্লাহ্‌র হাতে, তিনি যাকে ইচ্ছে তা প্রদান করেন। আর আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।

তিনি স্বীয় অনুগ্রহের জন্য যাকে ইচ্ছে একান্ত করে বেছে নেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।

২। আমানতে বিশ্বস্তদের প্রশংসা করা হয়েছে। আয়াতে ‘কিছু সংখ্যক লোক’ বলে  ঐসব আহলে-কিতাবকে বুঝানো হয়ে থাকে, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

أُمِّيِيْنَ (নিরক্ষর-অশিক্ষিত) বলতে আরবের মুশরিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। বিশ্বাসঘাতক ইয়াহুদীরা দাবী করত যে, এরা যেহেতু মুশরিক তাই তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করা বৈধ, এতে কোন গুনাহ নেই।

আর তারা জেনে-বুঝে আল্লাহর উপর মিথ্যা বলে।

৩। আল্লাহর ভালোবাসা কে পাবে- মুত্তাকী-কেউ যদি তার অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।

৪। দুই শ্রেণীর লোক উল্লেখ এসেছে। যাদের সাথে মহান আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য হবে কঠিন শাস্তি।

 এক শ্রেণীর লোক এমন যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের কসমের কোন পরোয়া না করে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের খাতিরে নবী করীম (সাঃ)-এর উপর ঈমান আনেনি। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক হল এমন যারা মিথ্যা কসম খেয়ে নিজেদের মাল বিক্রি করে অথবা কারো মাল আত্মসাৎ করে।

৫। ইয়াহুদীদের সেই লোকদের কথা তুলে ধরা হয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাবের (তাওরাতের) মধ্যে কেবল হেরফের ও পরিবর্তন সাধনই করেনি, বরং আরো দু’টি অপরাধ করেছে। তার একটি হল, বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে এবং এ থেকে তারা সাধারণের মধ্যে বাস্তব পরিপন্থী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়টি হল, তারা তাদের মনগড়া কথাগুলোকে আল্লাহর কথা বলে চালিয়ে দেয়।

৬। খ্রিস্টানরা ঈসা (আঃ)-কে প্রভু বানিয়ে রেখেছে। অথচ তিনি হলেন একজন মানুষ। তাঁকে কিতাব, হিকমত এবং নবুঅত দানে ধন্য করা হয়েছিল। আর এ দাবী কেউ করতে পারে না যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমার পূজারী ও দাস হয়ে যাও, বরং তিনি তো এ কথাই বলেন যে, তোমরা আল্লাহ ওয়ালা হয়ে যাও(রব্বানী)।

রব্বানী’ শব্দের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন মত এসেছে। ইবনে আব্বাস থেকে এক বর্ণনায় এর অর্থ এসেছে, حُكَماَء عُلَمَاء حُلَمَاء অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান, জ্ঞানী ও সহিষ্ণু হওয়া।

নবী, ফিরিশতা অথবা অন্য কাউকে আল্লাহর গুণাবলীর অধিকারী বিশ্বাস করানো কুফরী।

আল্লাহর নামঃ الۡفَضۡلِ অনুগ্রহশীল    لۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ মহা অনুগ্রহশীল

আলে ইমরান- ৯ম রুকু (৮১-৯১) আয়াত

১। প্রত্যেক নবীর কাছ থেকে এই অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে যে, তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর নবুঅতকালে যদি অন্য নবীর আবির্ভাব ঘটে, তাহলে এই নবাগত নবীর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর সহযোগিতা করা অত্যাবশ্যক হবে।

আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি; তারপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যায়নকারীরূপে যখন একজন রাসূল আসবে- তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এর উপর আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল, “আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।

২। এর পর যারা মুখ ফিরিয়ে নেবে, তারাই হবে ফাসেক (সত্যত্যাগী)। এখানে ‘ফাসে্ক’এর অর্থঃ কাফের। কেননা, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবূওয়াতের অস্বীকৃতি কেবল ‘ফিসক্ব’ নয়, বরং একেবারে কুফরী।

৩। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে সবকিছুই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আর তার দিকেই তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। এ প্রকার আত্মসমর্পনই আল্লাহ্ তা’আলা তার বান্দার কাছে আশা করেন। এর মধ্যেই রয়েছে সওয়াব ও মুক্তি।

৪। আল্লাহ জানাচ্ছেন এইভাবে বলার জন্যঃ বলুন, আমরা আল্লাহতে ও আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণের প্রতি যা নাযিল হয়েছিল এবং যা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের রবের পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়েছিল তাতে ঈমান এনেছি, আমরা তাদের কারও মধ্যে কোন তারতম্য করি না। আর আমরা তারই কাছে আত্মসমর্পণকারী।

যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত।

৫। আল্লাহ সীমালংঘনকারিদের হিদায়াত দেন না। বিশ্বাসের পর ও রসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্যদান করার পর এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর সত্য প্রত্যাখ্যান করে, তাদের সীমালংঘনকারী বলা হয়েছে এখানে।

 যাদের প্রতিদান হলো, তাদের উপর আল্লাহর, ফেরেশতাগণের এবং সকল মানুষের লা’নত।জাহান্নামে স্থায়ী হবে, শাস্তি শিথিল হবে না এবং বিরামও দেয়া হবে না

ঈমান আনার পর কুফরী করেছে তারপর তারা কুফরীতে বেড়ে গিয়েছে তাদের তওবা কখনো কবুল করা হবে না। আর তারাই পথ ভ্রষ্ট।

৬। যারা এর পরে তাওবাহ করেছে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নিয়েছে, তারা ক্ষমা পাবে। তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৭। কাফেররূপে মৃত্যু ঘটেছে তাদের কারো কাছ থেকে যমীনভরা সোনা বিনিময়স্বরূপ প্রদান করলেও তা কখনো কবুল করা হবে না। এরাই তারা, যাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে;তাদের  কোন সাহায্যকারী নেই।

রাসূলুল্লাহ সা বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন কাফেরদেরকে উপস্থিত করে বলা হবেঃ যদি তোমার নিকট পৃথিবীর সমান পরিমান স্বর্ণ থাকে, তাহলে কি তুমি এর বিনিময়ে এ শাস্তি থেকে মুক্তি কামনা করবে? তখন তারা বলবেঃ হ্যাঁ, তাকে বলা হবে যে, তোমার নিকট এর চেয়েও সহজ জিনিস চাওয়া হয়েছিল … আমার সাথে আর কাউকে শরীক না করতে কিন্তু তুমি তা মানতে রাজি হওনি। [বুখারীঃ ৬৫৩৮]

 

power point presentation #rd Para—–

৩য় পারা বাকারা(৩৪-৪০), ইমরান(১-৯)

 

৩য় পারা সমাপ্ত

আলহামদুলিল্লাহ

(তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বয়ান, ইবন কাসীর থেকে নোট করা)