৪।আমার রমাদান, আপণ সাথী আল কুর’আন- ৪র্থ পারা

কুরআন মাজীদঃ ৪র্থ পারা

মোট রুকুঃ ১০+৪= ১৪রুকু

সূরা সমূহঃ আলে ইমরানঃ (১০-২০) রুকু, আন নিসাঃ (১-৪) রুকু

 

power point presentation——–

৪র্থ পারাঃআলে ইমরানঃ (১০-২০) রুকু নিসা(১-৪)

 

সূরা আলে ইমরানঃ ১০ম রুকু (৯২-১০১) আয়াত

১। আমরা যা ভালবাসি তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত  কখনো সওয়াব অর্জন করতে পারবো না।আল্লাহ সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। আর আমরা যা কিছু ব্যয় করি, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।

যখন এই আয়াত নাযিল হয়, তখন আবূ ত্বালহা আনসারী (রাঃ) –যিনি মদীনার বিশিষ্ট সাহাবীদের একজন — নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! বাইরুহা বাগানটি হল আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু। সেটাকে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সাদাকা করছি। রসূল (সাঃ) বললেন, ‘‘সে তো বড়ই উপকারী সম্পদ। আমার মত হল, ওটাকে তুমি তোমার আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দাও।’’ তাই রসূল (সাঃ)-এর পরামর্শ অনুযায়ী সেটাকে তিনি স্বীয় আত্মীয়-স্বজন এবং চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। (মুসনাদ আহমাদ) এইভাবে আরো অনেক সাহাবী তাঁদের প্রিয় জিনিস আল্লাহর পথে ব্যয় করেছেন।

২। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা বলেনঃ ইয়াকুব আ এর ‘ইরকুন নাসা’ নামক রোগ ছিল। এজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, যদি তিনি এ রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন তাহলে তিনি উটের গোশত ভক্ষণ ত্যাগ করবেন। আয়াতে এ ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/২৯২]

ইয়াহুদীরা আপত্তি করল যে, আপনারা উটের গোশত খান, দুধ পান করেন। অথচ এগুলো ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রতি হারাম ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেনঃ ভুল কথা, এগুলো তার প্রতি হালাল ছিল।

যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে তারাই যালেম।আল্লাহ সত্য বলেছেন কাজেই তোমরা একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের মিল্লাত অনুসরণ কর, আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।

৩। ইয়াহুদীদের দ্বিতীয় অভিযোগের উত্তর। তারা বলত, বায়তুল মাকদিস তো প্রথম ইবাদত-খানা, মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তার সাথীরা নিজেদের ক্বিবলা কেন পরিবর্তন করে নিলো? এর উত্তরে বলা হল, তোমাদের এই দাবীও ভুল। প্রথম যে ঘর আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মিত হয়, তা হল সেই ঘর, যা মক্কায় রয়েছে।

আল্লাহ জানিয়েছেন-নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায়, বরকতময় ও সৃষ্টিজগতের দিশারী হিসাবে।

আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সা কে একবার জিজ্ঞেস করেন যে, জগতের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? উত্তর হলোঃ মসজিদুল হারাম। আবারো প্রশ্ন করা হলোঃ এরপর কোনটি? উত্তর হলোঃ মসজিদে বায়তুল-মুকাদ্দাস। আবার জিজ্ঞাসা করলেনঃ এই দুটি মসজিদ নির্মাণের মাঝখানে কতদিনের ব্যবধান ছিল? উত্তর হলোঃ চল্লিশ বৎসর। [বুখারীঃ ৩৩৬৬, মুসলিমঃ ৫২০]

৪।কা’বা গৃহের তিনটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। প্রথমতঃ আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলীর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন,হচ্ছে মাকামে ইবরাহীম। দ্বিতীয়তঃ যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ ও বিপদমুক্ত হয়ে যায়; তাকে হত্যা করা বৈধ নয়। তৃতীয়তঃ সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য এতে হজ্জ পালন করা ফরয; যদি এ গৃহ পর্যন্ত পৌছার শক্তি ও সামর্থ্য থাকে।

৫।ইবনে আব্বাস বলেন, আয়াতে কুফর বলতে বোঝানো হয়েছে এমন ব্যক্তির কাজকে, যে হজ করাকে নেককাজ হিসেবে নিল না আর হজ ত্যাগ করাকে গোনাহের কাজ মনে করল না।আয়াতে স্পষ্টভাবে ঘোষণা, আল্লাহ্ তা’আলা তার সৃষ্টির কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নয়। যদি সমস্ত লোকই কাফের হয়ে যায় তবুও এতে তার রাজত্বে সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে না

৬। আহলে কিতাবদের সম্বোধন করে জানাচ্ছেন, কেনো কুফরি করছে, আর ঈমানদারদের বাধা দান করছে অথচ নিজ কিতাবে এই রাসূল  সম্পর্কে জানে।

৭। আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে সাবধান করছেন যে, তারা যেন আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদী ও নাসারাদের আনুগত্য না করে। কেননা তারা মুমিনদেরকে আল্লাহ তা’আলা যে নবী ও কিতাবের নেয়ামত প্রদান করেছেন সেটার হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে।তাদের অনুসরণ করলে তারা মুমিনদেরকে কাফের বানিয়ে ছাড়বে।(বাকারা-১০৯ আয়াত থেকে জানা যায়)

একটি ঘটনা জানা যায়-আনসারের দু’টি গোত্র আউস এবং খাযরাজ এক মজলিসে এক সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করছিল। ইত্যবসরে শাস বিন ক্বাইস ইয়াহুদী তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের পারস্পরিক এই সৌহার্দ্য দেখে জ্বলে উঠল। যারা একে অপরের কঠোর শত্রু ছিল, তারা আজ ইসলামের বর্কতে দুধে চিনির মত পরস্পর অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে!এরপর বুয়াস যুদ্ধের কথা স্মরন করিয়ে দিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা চালালো। রাসূল সা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন।

৮। আল্লাহ জানাচ্ছেন কুফরী হওয়া কিভাবে সম্ভব হতে পারে? তাদের কাছে তো আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহ দিন রাত্রি নাযিল হচ্ছেই। তাছাড়া তাদের সাথে আছেন আল্লাহর নবী যিনি  তেলাওয়াত করে শোনাচ্ছেন এবং তাদের কাছে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। এমতাবস্থায় তাদের পক্ষ থেকে কুফরী হওয়া আশ্চর্যজনক নয় কি?

সূরা আলে ইমরানঃ ১১তম রুকু (১০২-১০৯) আয়াত

১। আয়াতে মুমিনদের  আল্লাহর তাকওয়া অর্জনের হক্ক আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাকওয়ার ঐ স্তর অর্জন কর, যা তাকওয়ার হক। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, রবী, কাতাদাহ ও হাসান রাহিমাহুমুল্লাহ বলেন, তাকওয়ার হক হল, প্রত্যেক কাজে আল্লাহর আনুগত্য করা, আনুগত্যের বিপরীতে কোন কাজ না করা, আল্লাহকে সর্বদা স্মরণে রাখা- কখনো বিস্মৃত না হওয়া এবং সর্বদা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা- অকৃতজ্ঞ না হওয়া। [ইবন কাসীর] আয়াতের শেষে মুসলিম না হয়ে যেন কারও মৃত্যু না হয় সেটার উপর জোর দেয়া হয়েছে। পূর্ণ ইসলামই প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া।

২। মুমিনের জন্য বলা হয়েছে- দুই মূল নীতির মধ্যে মুক্তিও রয়েছে  এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে ও থাকতে পারে।দু’টি মূল নীতি থেকে যদি  বিচ্যুত হয়ে পড়ে, তাহলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে  বিভক্ত হয়ে যাবে।

মূলনীতি দুটি হলো- ১।তাকওয়া অর্জন.২।সকলে সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রশি(আল কুর’আন)শক্ত করে ধারন করবে।

সাহাবায়ে রা দের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলের আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হল, কুরআন এবং হাদীসে রসূল (সাঃ)।

৩। আল্লাহর নি’আমতের স্মরন করিয়ে দিচ্ছেন যা তিনি দিয়েছেন-

*  হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। * তিনি অগ্নিগর্তের দ্বারপ্রান্ত থেকে রক্ষা করেছেন।

*  তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার।

৪। এখানে বলা হয়েছে তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা সফলকাম হবে, আবার (১১০) আয়াতে  শ্রেষ্ঠ জাতির (যাদের মনব কল্যানে সৃষ্টি) প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ হয়েছে-সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ  থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এবং ঈমান আনা।

‘মারুফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিচিত সৎকর্ম যা সাধারণ্যে পরিচিত। আমর অর্থ নির্দেশ করা বা কমান্ড করা অর্থাৎ আমর বিল মারুফ অর্থ ভালো কাজের নির্দেশ করা। নাহি শব্দের অর্থ নিষেধ করা বা বাধা প্রদান করা। মুনকার অর্থ খারাপ বা মন্দকাজ। অতএব নাহি আনিল মুনকার অর্থ হচ্ছে মন্দ কাজে বাধা প্রদান বা মন্দ কাজ করতে নিষেধ করা।

যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, অবশ্যই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। নতুবা অচিরেই আল্লাহ তোমাদের উপর তার পক্ষ থেকে শাস্তি নাযিল করবেন। তারপর তোমরা অবশ্যই তার কাছে দোআ করবে, কিন্তু তোমাদের দোআ কবুল করা হবে না। [তিরমিযীঃ ২১৬৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৯১]

হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, যখন লোকেরা কোন অন্যায় কাজ হতে দেখে অথচ তা পরিবর্তন করে না, সত্বর তাদের সকলের উপর আল্লাহ তাঁর শাস্তি ব্যাপকভাবে নামিয়ে দেন।ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪২।

আমর বিল মা‘রূফ ও নাহী ‘আনিল মুনকার-এর গুরুদায়িত্ব সকল মুসলিমের উপর ন্যস্ত। যা তারা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দূরদর্শিতার সাথে পালন করবেন। নাহী ‘আনিল মুনকার ব্যতীত আমর বিল মা‘রূফ যথার্থভাবে কার্যকর হয় না। যেভাবে করনীয়ঃ

(১) মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিরোধ করা : হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪-৩৫)

(২) প্রজ্ঞাপূর্ণ আচরণ ও সুন্দর উপদেশ দেওয়া : নাহল ১৬/১২৫)

৩। দূরদর্শিতার সাথে একাকী বা সংঘবদ্ধভাবে আদেশ বা নিষেধ করা : ইউসুফ ১২/১০৮

৪। আল্লাহর সন্তুষ্টির (৪) লক্ষ্যে স্থির থাকা : শো‘আরা ২৬/১০৯

৫। যথাযোগ্য ইলমের অধিকারী হওয়াঃ ফাত্বির ৩৫/২৮

৬।  সর্বদা মধ্যপন্থী হওয়া : বাক্বারাহ ২/১৪৩

৭। সহজ পথ বেছে নেওয়া : বাক্বারাহ ২/১৮৫

৮। বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করাঃ আহক্বাফ ৪৬/৩৫

৯। আক্বীদার সঠিক অবস্থানে রুপান্তরকে অগ্রাধিকার দেওয়া

১০। সমাজ সংস্কারে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাঃ (নূহ ৭১/৫)

৫। স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়েছে ইহুদি খৃস্টানরা। মুমিনদের নিষেধ করেছেন আল্লাহ যেনো তারা এমন না করে। কারন তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

রাসূলুল্লাহ সা বলেনঃ দুই কিতাবী সম্প্রদায় তাদের দ্বীনের মধ্যে বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে। আর এ উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেক দলই জাহান্নামে যাবে কেবলমাত্র একটি দল ব্যতীত। আর তারা হল আল-জামাআতের অনুসারী। আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু দল বেরুবে যাদেরকে কুপ্রবৃত্তি এমনভাবে তাড়িয়ে বেড়াবে, যেমন পাগলা কুকুরে কামড়ানো ব্যক্তিকে সর্বদা কুকুর তাড়িয়ে বেড়ায়। [আবু দাউদঃ ৪৫৯৭, মুসনাদে আহমাদঃ ৪/১০২]

৬। আখেরাতের ময়দানে দুটি গ্রুপ দেখা যাবে, ক) যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে(আল্লাহর অনুগ্রহে স্থায়ী থাকবে) খ) মুখ কালো হবে। ইবনে আববাস (রা) এ থেকে আহলে-সুন্নাত এবং আহলে-বিদআতকে বুঝিয়েছেন। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল ক্বাদীর)

৭। আল্লাহর পরিচয়ঃ কারো উপর যুলুম করবেন না। আসমানে যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই এবং আল্লাহর কাছেই সব কিছু প্রত্যাবর্তিত হবে।

সূরা আলে ইমরানঃ ১২তম রুকু (১১০-১২০) আয়াত

১। তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে।

রাসূলুল্লাহ সা বলেছেনঃ তোমরা সত্তরটি জাতিকে পূর্ণ করবে, তন্মধ্যে তোমরাই হলে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম এবং সবচেয়ে বেশী সম্মানিত। তিরমিযীঃ ৩০০১,

“জান্নাতীদের কাতার হবে একশ’ বিশটি। তন্মধ্যে আশিটি কাতার হবে এই উম্মতের।” তিরমিযীঃ ২৫৪৬, এ উম্মত হবে জান্নাতীদের অর্ধেক। [বুখারীঃ ৬৫২৮, মুসলিমঃ ২২১]

এ উম্মত সবার আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিমঃ ৮৫৫, ইবনে মাজাহঃ ১০৮৩]

২। ইহুদিরা/খৃস্টানরা( أَذًى কষ্ট দেওয়া) মৌখিকভাবে মিথ্যা অপবাদ রটানো দ্বারা মুসলমানদের সাময়িকভাবে  কষ্ট দেয়। তবে যুদ্ধের ময়দানে মুসলিমদের পরাজিত করতে পারবে না।

ক্রুসেড যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা  বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করে নেয়। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আয়্যূবী ৯০ বছর পর পুনরায় তা ফিরিয়ে আনেন। বর্তমানে মুসলিমদের ঈমানী দুর্বলতার ফল স্বরূপ এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের মিলিত চক্রান্ত ও প্রচেষ্টায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস আবারও মুসলিমদের হাতছাড়া হয়েছে। তবে অতি সত্বর এমন সময় আসবে যে, অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে ইন শা আল্লাহ।

৩। অবাধ্যতা ও সীমালংঘনের ফলে আল্লাহর গযবের ফল স্বরূপ ইয়াহুদীদের লাঞ্ছনা ও দরিদ্রতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে,তবে সাময়িকভাবে বাঁচার দু’টি উপায় বলা হয়েছে। এক হল, তাদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ, হয় তারা ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা ইসলামী দেশে কর বা ট্যাক্স দিয়ে আশ্রিত হয়ে থাকা পছন্দ করবে।

দ্বিতীয় হল, তারা মানুষের আশ্রয় লাভ করবে। এর দু’টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, (ক) ইসলামী দেশের সরকার নয়, বরং কোন সাধারণ মুসলিম তাদের আশ্রয় দেবে (খ) তারা বড় কোন অমুসলিম শক্তির সহায়তা লাভ করবে। কারণ, ‘নাস’ (মানুষ) সাধারণ শব্দ যা মুসলিম ও অমুসলিম সকলকেই শামিল করে।

৪। ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদের কিছু গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, প্রথমত: তারা হকের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে, কোন কিছুই তাদেরকে হক পথ থেকে টলাতে পারে না। দ্বিতীয়ত: তারা রাতের বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে। তৃতীয়ত: তারা সালাত আদায় করে। চতুর্থত: তারা আল্লাহর উপর পূর্ণ ঈমান রাখে, পঞ্চমত: তারা সৎকাজের আদেশ দেয়, ষষ্টত; তারা অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে।

৫। কল্যান পূন্যের কাজের ফল আল্লাহ দিবেন, মুত্তাকীদের সম্পর্কে আল্লাহ সব জানেন।

৬। কুফরী যারা করে তাদের সম্পদ ও সন্তান সন্তুতি কাজে আসবে না, জাহান্নামে স্থায়ী হবে। দুনিয়ার জীবনে তাদের অর্থ ব্যয়ের উদাহরন দিয়েছেন সেই প্রচন্ড ঠান্ডা অথবা গরম প্রবল ঝড়ো হাওয়ার মত, যা সবুজ-শ্যামল শস্যক্ষেতকে ধ্বংস করে দেয়। তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করে থাকে।

৭। হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ মিত্ররূপে গ্রহণ করো না। بطانة শব্দের অর্থ অভিভাবক, বন্ধু, বিশ্বস্ত, রহস্যবিদ।

ইয়াহুদী হোক কিংবা নাসারা, কপট বিশ্বাসী মুনাফেক হোক কিংবা মুশরেক- সত্যিকার হিতাকাঙ্খী নয়। তারা সর্বদাই মুসলিমদের বোকা বানিয়ে ক্ষতি সাধনে ব্যাপৃত এবং ধর্মীয় ও পার্থিব অনিষ্ট সাধনে সচেষ্ট থাকে। এরা কষ্টে থাক এবং কোন না কোন উপায়ে দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি হোক, এটাই হলো তাদের কাম্য।

মুসলমানরা (বন্ধু ভেবে) তাদেরকে ভালবাসে;কিন্তু তারা  ভালবাসে না। আর মুসলিম সমস্ত কিতাবে বিশ্বাস করে, (কিন্তু তারা কুর’আনে বিশ্বাস করে না)।

মুসলিমের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর অমঙ্গল হলে তারা আনন্দিত হয়।

৮। আল্লাহ ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র এর ক্ষতি থেকে রক্ষার দুটি উপাদান জানিয়েছেনঃ   ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকী হও

আল্লাহর পরিচয়ঃ  অন্তরে যা রয়েছে, সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।

সূরা আলে ইমরানঃ ১৩তম রুকু (১২১-১২৯) আয়াত

১। এটা হল উহুদ যুদ্ধের ঘটনা, যা ৬ই শাওয়াল হিজরী ৩য় সনে সংঘটিত হয়েছিল। তিন হাজার কাফের উহুদ পাহাড়ের নিকটে যুদ্ধের তাঁবু খাটিয়েছে, ১হাজার মুসলিম সেনাবাহিনী নিয়ে রওয়ানা হয়ে শ্বাউত স্থান থেকে ৩০০ জন মুনাফিকের সর্দারের সাথে ফিরে যায়, বাকী থাকে ৭০০জন।প্রত্যুষে বের হয়ে যুদ্ধের জন্য মুমিনগণকে ঘাঁটিতে বিন্যস্ত করছিলেন;

২।  দুই দল হলো আউস গোত্রের বনী হারেসা এবং খাযরাজ গোত্রের বনী সালমা। এরা উভয়ই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দেখাদেখি দুর্বলতা প্রদর্শন করেছিল। আল্লাহ উভয়ের অভিভাবক ছিলেন, আর আল্লাহর উপরই যেন মুমিনগণ নির্ভর করে এই আয়াত দিয়ে সাহস সঞ্চার হয়। সংখ্যাধিক্য ও সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার পর ভরসা একমাত্র আল্লাহ পাকের উপরই করা দরকার।

যুদ্ধ শুরু হলে সেনাপতি উমর রা এর কাছে আরো লোক চেয়ে পত্র পাঠান, প্রতিউত্তরে উমর রা বলেন- আমি তোমাদেরকে এমন একজনের সন্ধান দেব যিনি সবচেয়ে বেশী সাহায্য করতে পারেন, যাঁর সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত, তিনি হচ্ছেন, আল্লাহ তা’আলা। সুতরাং তোমরা তার কাছেই সাহায্য চাও।– এরপর আমরা যুদ্ধ করলাম এবং যুদ্ধে জয়লাভ করলাম মুসনাদে আহমাদ ১/৪৯;

৩। বদর যুদ্ধের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হচ্ছে-যাতে মুসলিমরা পুরোপুরি তাওয়াক্কুলের পরিচয় দিয়েছিল এবং আল্লাহ তা’আলা তাদের সাহায্য করে সাফল্য দান করেছিলেন। অথচ তারা সংখ্যায় ছিলে অতি নগণ্য

এরপর ৩হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য যথেষ্ট নয় কি বলে ফেরেশতা প্রেরণের উদ্দেশ্য তাদের দ্বারা যুদ্ধ জয় করানো ছিল না; বরং উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীকে সান্তনা প্রদান করা, তাদের মনোবল দৃঢ় করা এবং বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া। কিছু কিছু কাজের মাধ্যমে ফেরেশতাগণ মুসলিমদের আশ্বস্ত করছিলেন যে, তারাও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছেন। প্রকৃতপক্ষে তাদের কাজ ছিল মুসলিমদের মনোবল অটুট রাখা এবং সান্ত্বনা দেয়া। পুরো যুদ্ধটাই ফেরেশতাদের দ্বারা করানো উদ্দেশ্য ছিল না।

সূরা আল-আনফালের আয়াতে এক হাজার(মুসলিম তিনশত তের জন আর শত্রু সংখ্যা এক হাজার)-, সূরা আলে-ইমরানে প্রথমে তিন হাজার(শক্রদের সংখ্যা মুসলিমদের তিনগুণ বেশী ছিল। এ সংবাদে মুসলিমদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিলে তিন হাজার ফেরেশতা প্রেরণের ওয়াদা ) এবং পরে পাঁচ হাজার ফেরেশতা প্রেরণের ওয়াদা করা হয়েছে। তবে শর্ত ছিল দুটিঃ (এক) মুসলিমগণ ধৈর্য ও আল্লাহভীতির উচ্চস্তরে পৌছলে, (দুই) শক্ররা আকস্মিক আক্রমন চালালে।

আর এটা তো আল্লাহ  শুধু সুসংবাদ ও  আত্মিক প্রশান্তির জন্য করেছেন। আর সাহায্য তো শুধু পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর কাছ থেকেই হয়।

আল্লাহ তা’আলা আয়াতে বলেন যে, তিনি তার বান্দাদেরকে সাহায্য করবেন দু’টি কারণের কোন একটি কারণে। এক. তিনি হত্যা, বন্দী, গণীমত, শহর বিজয় ইত্যাদির মাধ্যমে কাফেরদের এক শক্তি ও ভিত্তি ভেঙে দেবেন; ফলে মুমিনরা শক্তিশালী হবে ও কাফেররা দুর্বল হবে।

দুই. কাফেররা মুসলিমদের উপর জয়ী হওয়ার জন্য আশা করবে এবং প্রচেষ্টা চালাবে, কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা মুসলিমদেরকে বিজয়ী করবেন ফলে তারা লাঞ্ছিত ও নিরাশ হয়ে ফিরে যাবে।

৪। এরপর উহুদ যুদ্ধের কথা এসছে। ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সা এর সম্মুখস্থ উপর ও নীচের চারটি দাঁতের মধ্যে থেকে নীচের পাটির ডান দিকের একটি দাত পড়ে গিয়েছিল এবং মুখমণ্ডল আহত হয়ে পড়েছিল। এতে দুঃখিত হয়ে তিনি এ বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেনঃ “যারা নিজেদের নবীর সাথে এমন দুর্ব্যবহার করে, তারা কেমন করে সাফল্য অর্জন করবে? অথচ নবী তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করেন।” এরই প্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। [বুখারী, মুসলিমঃ ১৭৯১] এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু থেকে উঠার পর কাফেরদের উপর বদ দোআ করতেন, কিন্তু এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি তা ত্যাগ করেন৷ [বুখারীঃ ৪৫৬০, ৪০৬৯, ৪০৭০ মুসলিমঃ ৬৭৫]

আল্লাহর পরিচয়ঃ  আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

আসমানে ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই তিনি যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছে শাস্তি দেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

সূরা আলে ইমরানঃ ১৪তম রুকু (১৩০-১৪৩) আয়াত

১। হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

যেহেতু উহুদ যুদ্ধে পরাজয় রসূল (সাঃ)-এর অবাধ্যতা এবং পার্থিব সম্পদের প্রতি লোভের কারণে হয়েছিল, তাই দুনিয়ার লোভনীয় জিনিসের মধ্যে সর্বাধিক মারাত্মক সূদ থেকে নিষেধ এবং আল্লাহর আনুগত্য করার তাকীদ করা হচ্ছে।

(আমর ইবনে আকইয়াশের জাহেলী যুগের কিছু সুদের কারবার ছিল সে তা উসুল করা জন্য ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত ছিল। তার ঘটনা উল্লেখ)

সেই সময় সূদ খাওয়ার যে পরিবেশ ও ধরন ছিল, তাই প্রকাশ ও বর্ণনা করা হয়েছে। জাহেলিয়াতে সূদের সাধারণ প্রচলন এই ছিল যে, ঋণ পরিশোধ করার সময় এসে যাওয়ার পর তা পরিশোধ করা সম্ভব না হলে, তার (পরিশোধের) সময় বৃদ্ধি করার সাথে সাথে সূদও বর্ধিত হতে থাকত;

২। কাফেরদের জন্য প্রস্তুত আগুন থেকে বাঁচার আহবান করেছেন আল্লাহ।

৩। আয়াতে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঃ (এক) আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্যের সাথে রাসূলের আনুগত্যেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।(দুই) আল্লাহ্ তা’আলা মকবুল ও নিষ্ঠাবান পরহেযগার বান্দার গুণাবলী ও লক্ষণাদি (শুধু মৌখিক দাবীকে বলা হয় না,) দ্বারাই আনুগত্যকারীর পরিচয় হয়।

৪। ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতামুলকভাবে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্যের পর এটি দ্বিতীয় নির্দেশ। মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা। ক্ষমা বলে এমন সৎকর্ম বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর ক্ষমার কারণ হয়ে থাকে। জান্নাত লাভ করা আল্লাহর ক্ষমা ছাড়া সম্ভব নয়।

মুত্তাকীদের গুনাবলী—-(যারা ক্ষমা ও জান্নাত পাবে তাদের সৎ কাজের ফলে)

  • যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালবাসেন;
  • আর যারা কোন অশ্লীল কাজ বা যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। জেনে-বুঝে তারা তা পুনরায় করতে থাকে না।

সূরা আলে ইমরানঃ ১৫তম রুকু (১৪৪-১৪৮) আয়াত

১। মুহাম্মাদ একজন রসূল বৈ অন্য কিছুই নয়।’ অর্থাৎ, রিসালাতের গুণে গুণান্বিত হওয়াই তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য। তিনি মানব গুণের ঊর্ধ্বে নন এবং এমনও নন যে, তিনি আল্লাহর গুণের কোন কিছু প্রাপ্ত হয়েছেন ফলে তাঁকে মৃত্যু গ্রাস করবে না।

উহুদের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কারণসমূহের মধ্যে একটি কারণ এও ছিল যে, কাফেররা রটিয়ে দিয়েছিল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করে দেওয়া হয়েছে। মুসলিমদের কাছে এ খবর পৌঁছলে, তাঁদের অনেকের মনোবল দমে যায় এবং তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে এই আয়াত অবতীর্ণ করে বলা হয় যে, কাফেরদের হাতে নবী করীম (সাঃ)-এর হত্যা হওয়া এবং তাঁর উপর মৃত্যু আসা কোন নতুন কথা নয়।

আর কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না;

যারা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে দৃঢ়পদ থেকে আল্লাহর অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতার বাস্তব নমুনা পেশ করেছে। আর আল্লাহ্‌ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন।

২।আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু সেটার মেয়াদ সুনির্ধারিত। দুর্বল ও ভীতু লোকদের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য বলা হচ্ছে যে, মৃত্যু তো তার নির্দিষ্ট সময়ে আসবেই। অতএব পালিয়ে যাওয়ার ও ভীরুতা দেখানোর লাভ কি?

কেবল দুনিয়া চাইলে তা হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু আখেরাতে কিছুই পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে যারা আখেরাত কামনা করে, তারা তো আখেরাতের নিয়ামত পাবেই, সেই সাথে তাদেরকে মহান আল্লাহ দুনিয়াও দান করেন।

বহু নবী ছিলেন, তাদের সাথে বিরাট সংখ্যক (ঈমান ও আমলে সালেহর উপর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত) লোক যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি, দুর্বল হয়নি এবং নত হয়নি। তারা এইভাবে বলতো-

رَبَّنَا اغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوۡبَنَا وَ اِسۡرَافَنَا فِیۡۤ اَمۡرِنَا وَ ثَبِّتۡ اَقۡدَامَنَا وَ انۡصُرۡنَا عَلَی الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِیۡنَ

হে আমাদের রব! আমাদের পাপ এবং আমাদের কাজের সীমালংঘন আপনি ক্ষমা করুন, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।

আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন। আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার এবং আখেরাতের উত্তম পুরস্কার দান করেন। আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালবাসেন।

৩। উহুদ যুদ্ধের পরাজয়ের সুযোগ গ্রহণ করে কোন কোন কাফের অথবা মুনাফিক মুসলিমদেরকে পরামর্শ দিচ্ছিল যে, তোমরা পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে এস। সুতরাং মুসলিমদেরকে বলা হল যে, কাফেরদের আনুগত্য করা হল ধ্বংস ও অনিষ্টের কারণ।

সূরা আলে ইমরানঃ ১৬তম রুকু (১৪৯-১৫৫) আয়াত

 

১। সফলতা তো আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে এবং তাঁর চেয়ে উত্তম কোন সাহায্যকারী নেই। আল্লাহই তো তোমাদের অভিভাবক এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।

আল্লাহর পরিচয়ঃ  مَوۡلٰىکُمۡ           خَیۡرُ النّٰصِرِیۡنَ

২। মুসলিমদের পরাজয় দেখে কোন কোন কাফেরের অন্তরে এই খেয়াল জন্মালো যে, মুসলিমদেরকে একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়ার এটা অতি উত্তম সুযোগ। ঠিক এই মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরে মুসলিমদের ভয় ঢুকিয়ে দিলেন। ফলে তারা নিজেদের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সাহস করতে পারেনি। (ফাতহুল ক্বাদীর)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমাকে একমাসে অতিক্রম করার মত রাস্তার দূরত্ব থেকে কাফেরদের মনে ভয় ঢুকিয়ে সাহায্য করা হয়েছে।” বুখারীঃ ৩৩৫, রসূল (সাঃ)-এর ভয় স্থায়ীভাবে শত্রুর অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছিল। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর উম্মত অর্থাৎ, মুসলিমদের ভয়ও মুশরিকদের অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছে এবং তার কারণ হল, তাদের শিরক।

৩। আয়াতে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতির অর্থ হল, বিজয় ও সাহায্যের সেই সাধারণ প্রতিশ্রুতি, যা মুসলিমদের সাথে রসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে করা হয়েছিল। এমন কি কিছু আয়াত তো পূর্বে মক্কাতেই নাযিল হয়েছিল। আর এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী (উহুদ) যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমরা জয়যুক্তই ছিলেন। [اِذْ تَحُسُّوْنَهُمْ باِذْنِهِ] (যখন তোমরা তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশক্রমে হত্যা করছিলে।) এই আয়াতে তারই প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

মতভেদ সৃষ্টি করেছিলে এবং অবাধ্য হয়েছিলে বলতে, ৫০ জন তীরন্দাজের মধ্যে আপোসে মতভেদ সৃষ্টি হওয়াকে বুঝানো হয়েছে; যাতে তাঁরা সফলতা ও বিজয় দেখার পর লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর এরই কারণে কাফেররা পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিল।

তোমাদের কিছু সংখ্যক দুনিয়া চাচ্ছিল এবং কিছু সংখ্যক চাচ্ছিল আখেরাত।

বিজয় দান করার পর পুনরায় পরাজয় দিয়ে তোমাদেরকে ঐ কাফেরদের উপর থেকে সরিয়ে দিলেন কেবল তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের কর্মে ত্রুটি ও অবহেলা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁদেরকে যে মর্যাদা-সম্মান দান করেছেন, সে কথাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে আর ভুল না করেন। তাই মহান আল্লাহ তাঁদের ভুলের কথা উল্লেখ করে তাঁদের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন।

উহুদ যুদ্ধের ময়দানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে  কাফেরদের একাধারে হঠাৎ আক্রমণের ফলে মুসলিমদের মধ্যে যে ছত্রভঙ্গ অবস্থা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং তাঁদের অনেকেই যে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যান।

আল্লাহ জানিয়েছেন-দুঃখের পর দুঃখ যাতে মুমিনদের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার শক্তি এবং দৃঢ়সংকল্প ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়।

— প্রথম ‘গাম্ম’ (দুঃখ)এর অর্থ, গনীমতের মাল এবং কাফেরদের উপর বিজয় লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ‘গাম্ম (দুঃখ)। আর দ্বিতীয় ‘গাম্ম’(দুঃখ)এর অর্থ, মুসলিমদের শহীদ ও আহত হওয়ার ‘গাম্ম (দুঃখ) এবং নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশের বিরোধিতা ও তাঁর শহীদ হওয়ার মিথ্যা খবর থেকে সৃষ্ট দুঃখ।

৪। চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির পর আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের উপর পুনরায় অনুগ্রহ করলেন এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধের ময়দানে অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁদের উপর তন্দ্রার ভাব সৃষ্টি করে দিলেন। আর এই তন্দ্রা (ঢুল) ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে প্রশান্তি এবং সাহায্যের দলীল। আবূ ত্বালহা (রাঃ) বলেন, আমিও তাঁদের একজন, যাঁদের উপর উহুদের দিন তন্দ্রার ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। এমন কি আমার তরবারি কয়েকবার আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, আর আমি ধরে নিয়েছিলাম। (সহীহ বুখারী).

৫।মুনাফিকরা এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে তারা কেবল নিজেদের প্রাণ নিয়েই চিন্তিত ছিল। তারা ভাবতো নবী করীম (সাঃ)-এর সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই মিথ্যা। আল্লাহর সহযোগিতা থেকেই বঞ্চিত ইত্যাদি। এখানে না আসলে মারা পড়তাম না।

আল্লাহ জানিয়েছেন-যেভাবেই হোক না কেন, মৃত্যু তো আসবেই এবং তা সেই স্থানেই আসবে, যেখানে আল্লাহর পক্ষ হতে লিখে দেওয়া হয়েছে। যদি তোমরা নিজেদের বাড়িতে অবস্থান কর, আর তোমাদের মৃত্যু কোন যুদ্ধের ময়দানে লিখা থাকে, তাহলে আল্লাহ কর্তৃক এই ফায়সালা তোমাদেরকে সেখানেই টেনে নিয়ে যাবে।

৬। জিহাদের বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে এটাও একটি কৌশল যে, এতে মু’মিন ও মুনাফিকের প্রকৃত রূপ বিকশিত হয়ে সামনে চলে আসে; ফলে সাধারণ মানুষও তাদেরকে দেখে ও চিনে নিতে পারে।

৭। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের দ্বারা যে ভুল-ত্রুটি ঘটেছিল, তার কারণ ছিল তাঁদের পূর্বের কিছু দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে শয়তান এই দিন তাদের পদস্খলন ঘটাতে সফলকাম হয়েছিল। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের এত বড় পদস্খলন ও অপরাধ মার্জনা করে তাদের প্রতি দয়া ও করুণাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন এবং তাদের (رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ) অর্থাৎ “তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট” [সূরা আত-তাওবাহঃ ১০০, সূরা আল-মুজাদালাহঃ ২২]

সূরা আলে ইমরানঃ ১৭তম রুকু (১৫৬-১৭১) আয়াত

১। আল্লাহ ঈমানদারদেরকে সেই বিভ্রান্তিকর আকীদা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিচ্ছেন, যা কাফের ও মুনাফিকরা পোষণ করত। কারণ, এই বিশ্বাসই হল ভীরুতার মূল কারণ। পক্ষান্তরে যখন এই বিশ্বাস জান্মাবে যে, জীবন ও মরণ আল্লাহর হাতে এবং মৃত্যুর একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, তখন মানুষের মধ্যে সাহসিকতা এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার উৎসাহ সৃষ্টি হবে। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভিতরে অবস্থান কর তবুও।’’ (সূরা নিসা ৭৮ আয়াত) কাজেই এই অনুতাপ থেকে মুসলিমরাই রক্ষা পেতে পারে। কারণ, তাদের আকীদা সঠিক ও শুদ্ধ।

তাই এমন মৃত্যু যদি ভাগ্যে জুটে, যে মৃত্যুর পর মানুষ আল্লাহর ক্ষমা ও তাঁর দয়া লাভের যোগ্য হয়ে যায়, তবে এটা হবে তার জন্য পার্থিব সেই সমূহ ধন-সম্পদ থেকেও উত্তম, যা মানুষ সারা জীবন উপার্জন করে থাকে।

২। মহান নৈতিকতার অধিকারী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর আল্লাহর কৃত অনুগ্রহসমূহের একটি অনুগ্রহঃ, তোমার মধ্যে যে কোমলতা ও নম্রতা তা আল্লাহর রহমতেরই ফল। আর দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য তো এই কোমলতার প্রয়োজন অনেক। তুমি যদি কোমল ও নরম না হয়ে কঠিন হৃদয়ের মালিক হতে, তাহলে মানুষ তোমার কাছে না এসে আরো দূরে সরে যেত। কাজেই তুমি মানুষের সাথে ব্যবহারে ক্ষমা ব্যবহার করতে থাক।

মুসলিমদের মনস্তষ্টির জন্য পরামর্শ করে নিবেন। এই আয়াত দ্বারা পরামর্শ করার গুরুত্ব, তার উপকারিতা এবং তার প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতা প্রমাণিত হয়। পরামর্শ করার পর যে মতের উপর তোমার সংকল্প সৃষ্টি হবে, আল্লাহর উপর ভরসা করে তা কার্যকরী করবে।

এই আয়াতে সমাজ সংস্কারক ও দ্বীন-প্রচারকদের জন্য কয়েকটি বিষয়কে অপরিহার্য বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রথমতঃ আচার-ব্যবহার ও কথা-বার্তায় রূঢ়তা পরিহার করা। দ্বিতীয়তঃ সাধারণ লোকদের দ্বারা কোন ভুলভ্রান্তি হয়ে গেলে কিংবা কষ্টদায়ক কোন বিষয় সংঘটিত হলে সে জন্য প্রতিশোধমুলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ক্ষমা প্রদর্শন করা এবং সদয় ব্যবহার করা। তৃতীয়তঃ তাদের পদস্খলন ও ভুলভ্রান্তির কারণে তাদের কল্যাণ কামনা থেকে বিরত না থাকা। তাদের জন্য দোআ-প্রার্থনা করতে থাকা এবং বাহ্যিক আচার আচরণে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার পরিহার না করা।

৩। আল্লাহ্‌ সাহায্য করলে মুসলিমের উপর জয়ী হবার কেউ থাকবে না। আর তিনি ত সাহায্য না করলে, তিনি ছাড়া কে এমন আছে, যে  সাহায্য করবে? সুতরাং মুমিনগণ আল্লাহর উপরই নির্ভর করুক।

৪। কোন নবী ‘গলুল (অন্যায়ভাবে কোন বস্তু গোপন) করবে, এটা অসম্ভব। কেউ অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করলে, যা সে অন্যায়ভাবে গোপন করবে কেয়ামতের দিন সে তা সাথে নিয়ে আসবে। তারপর প্রত্যেককে, যা সে অর্জন করেছে তা পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হবে। তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না।

যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, সে কি তার মত হতে পারে, যে আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হয়েছে এবং যার বাসস্থান জাহান্নাম? আল্লাহর নিকট তারা বিভিন্ন স্তরের; তারা যা করে আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

৫। নবীর মানুষ হওয়া এবং মানব-জাতিভুক্ত হওয়াকে মহান আল্লাহ একটি অনুগ্রহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, প্রথমতঃ তিনি তাঁর জাতির স্থানীয় ভাষায় আল্লাহর পায়গাম পৌঁছাতে পারবেন যা বুঝা প্রত্যেক মানুষের জন্য সহজ হবে। দ্বিতীয়তঃ একই জাতিভুক্ত হওয়ার কারণে মানুষ তাঁর ঘনিষ্ঠ হবে এবং তাঁর কাছ ঘেঁসবে। তৃতীয়তঃ মানুষের জন্য মানুষ হওয়াটাই সব দিক দিয়ে সমীচীন।

আয়াতে নবী প্রেরণের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে। যথা, (ক) আয়াতের তেলাওয়াত ও আবৃত্তি, (খ) পবিত্র ও পরিশুদ্ধকরণ, (গ) এবং কিতাব ও হিকমতের কথা শিক্ষা দেওয়া।

৬। কোন খারাপের সম্পর্ক আল্লাহর দিকে করা জায়েয নেই। আল্লাহ তা’আলার দিকে সব সময় ভাল ফলাফলের সম্পর্ক করতে হয়। খারাপ ফলের বাহ্যিক কারণ সৃষ্ট জীব। খারাপ তাদেরই অর্জন করা।

মুসীবত আসলো (ওহুদের যুদ্ধে) তখন তোমরা বললে, “এটা কোত্থেকে আসলো? তোমাদের নিজেদেরই সেই ভুলের কারণে যা তোমরা রসূল (সাঃ)-এর পাহাড়ের ঘাঁটি ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তা ত্যাগ করার মাধ্যমে করেছিলে।

৭। এসব যা কিছু হয়েছে, সবই আল্লাহর ইচ্ছা ও সমর্থনে হয়েছে। মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহর ইচ্ছা বা অনুমতি দু’প্রকার। এক. ইযনে শারয়ী বা শরীআতগত অনুমোদন বা ইচ্ছা। এ অনুমোদনের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির সম্পর্ক রয়েছে।

দুই. ইযনে কাওনী বা প্রকৃতিগত অনুমোদন বা ইচ্ছা। এ অনুমোদনের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই। তবে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। যেমন এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর অনুমোদন বা ইচ্ছা।

কে তোমাদের মধ্যে প্রকৃত মুমিন এটা জানার জন্যই ঘটনা। আগামীতে রসূল (সাঃ)-এর আনুগত্যের প্রতি যথাযথ যত্ন নাও। এ ছাড়া এর আরো একটি উদ্দেশ্য হল, মু’মিন ও মুনাফিকদেরকে একে অপর থেকে পৃথক করা হল।

মুনাফিকদের চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে- যুদ্ধ ত্যাগ করার যে কারণ মৌখিকভাবে তারা প্রকাশ করেছে, সেটা প্রকৃত কারণ নয়, বরং তাদের অন্তরে লুক্কায়িত যে কারণ ছিল তা হল, প্রথমতঃ আমাদের পৃথক হওয়ায় মুসলিমদের অন্তরে দুর্বলতার সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়তঃ কাফেরদের লাভ হবে। অর্থাৎ, আসল উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম, মুসলিম এবং নবী করীম (সাঃ)-এর ক্ষতি করা।

মুনাফিকদের কথা ‘তারা আমাদের কথা মত চললে নিহত হতো না’ এর প্রতিবাদ করে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘‘যদি তোমরা তোমাদের কথায় সত্যবাদী হও, তাহলে নিজেদের উপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে দাও তো দেখি।

৮। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত

উহুদ যুদ্ধের শহীদগণ মহান আল্লাহর নিকট আরজি পেশ করলেন যে, আমাদের যে মুসলিম ভাইরা দুনিয়াতে জীবিত আছেন, তাঁদেরকে আমাদের অবস্থাসমূহ এবং আমাদের এই সুখেভরা জীবন সম্পর্কে কেউ অবহিত করানোর আছে কি? যাতে তাঁরা যেন যুদ্ধ ও জিহাদ করা থেকে বিমুখ না হয়। আল্লাহ তাআলা বললেন, ‘‘আমি তোমাদের এ কথা তাঁদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। এই প্রসঙ্গেই মহান আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করলেন। (মুসনাদ আহমাদ ১/৩৬৫-৩৬৬,

তারা আনন্দ প্রকাশ করে আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য এবং এজন্য যে আল্লাহ মুমিনদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।

সূরা আলে ইমরানঃ ১৮তম রুকু (১৭২-১৮০) আয়াত

১। মদীনায় পৌঁছে নবী করীম (সাঃ)ও তাদের (কাফেরদের) পুনরায় পাল্টা আক্রমণের আশঙ্কা বোধ করলেন। তাই তিনি সাহাবাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত করলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যদিও নিজেদের নিহত ও আহতদের কারণে বড়ই মর্মাহত ও দুঃখিত ছিলেন, তবুও নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশ মত যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন(যখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সৎকাজ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে)

মুসলিমদের এই দল যখন মদীনা থেকে ৮ মাইল দূরে অবস্থিত ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে পৌঁছল, তখন মুশরিকরা ভয় পেয়ে গেল। কাজেই তাদের ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটল এবং মদীনার উপর আক্রমণ করার পরিবর্তে মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করল।

২। যখন সাহাবায়ে কিরাম মদিনা থেকে আবার হামরাউল আসাদ নামক স্থানে গিয়ে পৌছালেন, আবু সুফিয়ান নিজের সাথে আরও সৈন্য সংগ্রহ করে পুনরায় মদীনা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আহত-দুর্বল সাহাবায়ে কেরাম এই ভীতিজনক সংবাদ শুনে সমস্বরে বলে উঠলেন, আমরা তা জানি না ‘আল্লাহ আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম সাহায্যকারী’৷ حَسۡبُنَا اللّٰهُ وَ نِعۡمَ الۡوَکِیۡلُ

৩। সাহাবায়ে কেরামের জেহাদের জন্য রওয়ানা হওয়া এবং হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকীল বলার উপকারিতা, ফলশ্রুতি ও বরকত বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে- “এরা আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ নিয়ে ফিরে এল।

প্রথম নেয়ামত হলো এই যে, কাফেরদের মনে ভীতি সঞ্চার করে দিলেন, এতে তারা পালিয়ে গেল। ফলে তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে নিরাপদ রইলেন। দ্বিতীয় নেয়ামত এই যে, হামরাউল আসাদের বাজারে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সুযোগ হয়েছিল তৃতীয় নেয়ামতটি হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ যা সমস্ত নেয়ামতের ঊর্ধ্বে এবং যা এই জেহাদে তাদেরকে বিশেষ ভঙ্গিতে দেয়া হয়েছে।

৪। শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়; কাজেই যদি তোমরা মুমিন হও তবে তাদেরকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর।

৫। কেউ যেন এমন কোন সন্দেহ না করে যেআল্লাহ্ তা’আলা কাফেরদিগকে অবকাশ, দীর্ঘায়ু, স্বাস্থ্য-সামর্থ্য ও আরাম-আয়েশের উপকরণ এ জন্যই দিয়েছেন, যাতে তারা নিজেদের অপরাধ প্রবণতায় অধিকতর এগিয়ে যায়, তাহলে তো কাফেররা নির্দোষ। কারণ, আয়াতের উদ্দেশ্য হল এই যে, কাফেরদের সামান্য কয়েক দিনের এ অবকাশ ও ভোগ বিলাসে যেন মুসলিমরা পেরেশান না হয়

“কাফেরদের ধন-সম্পদ এবং ভোগ-বিলাস তাদের জন্য গৌরবের বস্তু নয়; এগুলো আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আযাবেরই একটি কিস্তি যা আখেরাতে তাদের আযাব বৃদ্ধির কারণ হবে।” [সূরা আত-তাওবাহ ৫৫]

যারা ঈমানের বিনিময়ে কুফরী ক্রয় করেছে তারা কখনো আল্লাহ্‌র কোন ক্ষতি করতে পারবে না এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। কাফেরগণ যেন কিছুতেই মনে না করে যে, আমরা অবকাশ দেই তাদের মঙ্গলের জন্য: আমরা অবকাশ দিয়ে থাকি যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়। আর তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।

অন্যত্র– “আর যারা আমাদের নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে আমরা তাদেরকে এমনভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারবে না। আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি; আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ”। (সূরা আল-আরাফ, ১৮২-১৮৩]

(সূরা আল-আরাফঃ ৯৪-৯৫ , মু’মিনূনঃ ৫৫-৫৬ আল-আনআমঃ ৪২-৪৪ সূরা আল-কালাম: ৪৪-৪৫])

৬। মহান আল্লাহ পরীক্ষার কষ্টিপাথরে ঘষে নেন, যাতে তাঁর প্রকৃত বন্ধু কে তা পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তাঁর শত্রু লাঞ্ছিত হয়। আর ধৈর্যশীল মু’মিন মুনাফিক থেকে পৃথক হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা উহুদের দিন ঈমানদারদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন।

গায়েব সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করা আল্লাহর নিয়ম নয়; তবে আল্লাহ তার রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন

তোমরা ঈমান আনলে ও তাকওয়া অবলম্বন করে চললে তোমাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে।

৭। আয়াতে এমন কৃপণের কথা বলা হচ্ছে, যে আল্লাহর দেওয়া সম্পদ তাঁর রাস্তায় ব্যয় করে না। এমন কি সেই মালের ওয়াজেব যাকাতও আদায় করে না। ‘‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ধন-মাল দান করেছেন, কিন্তু সে ব্যক্তি তার সেই ধন-মালের যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তা (আযাবের) জন্য তার সমস্ত ধন-মালকে একটি মাথায় টাক পড়া (অতিরিক্ত বিষাক্ত) সাপের আকৃতি দান করা হবে; যার চোখের উপর দু’টি কালো দাগ থাকবে। সেই সাপকে বেড়ির মত তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর সে তার উভয় কশে ধারণ (দংশন) করে বলবে, ‘আমি তোমার মাল, আমি তোমার সেই সঞ্চিত ধনভান্ডার।(বুখারী ১৪০৩নং)

আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চরম স্বত্বাধিকার কেবল আল্লাহরই। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবহিত।

সূরা আলে ইমরানঃ ১৯তম রুকু (১৮১-১৮৯) আয়াত

১।আয়াতে ইয়াহুদীদের একটি কঠিন ঔদ্ধত্যের ব্যাপারে সতর্কীকরণ ও শাস্তির বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, যখন মহান আল্লাহ ঈমানদারদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার উৎসাহ দান করে বললেন যে, [مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا ] ‘‘কে আছে এমন, যে ঋণ দেবে আল্লাহকে উত্তম ঋণ।(সূরা বাক্বারাহ ২৪৫, সূরা হাদীদ ১১) তখন ইয়াহুদীরা বলল, তোমার প্রতিপালক এমন অভাবগ্রস্ত যে, স্বীয় বান্দাদের কাছ থেকে ঋণ চাচ্ছেন? এই কথারই ভিত্তিতে মহান আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন। (ইবনে কাসীর)

আল্লাহর শানে বেআদবীমূলক উক্তি এবং তাদের (পূর্বপুরুষদের) অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা  যাবতীয় পাপ আল্লাহর নিকট লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই পাপের কারণেই তারা জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। এ হচ্ছে তাদের কৃতকর্মের ফল এবং এটা এ কারণে যে, আল্লাহ বান্দাদের প্রতি মোটেই যালেম নন।

২। ইয়াহুদীদের আর একটি কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হচ্ছে যে, মহান আল্লাহ আমাদের নিকট থেকে এই প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন যে, তোমরা কেবল সেই রসূলকেই বিশ্বাস করবে, যাঁর দু’আর ফলে আসমান থেকে আগুন এসে কুরবানী ও সাদাকাকে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

আমার পূর্বে অনেক রসূল স্পষ্ট নিদর্শনসহ এবং তোমরা যা বলছ, তা সহ তোমাদের নিকট এসেছিল; যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তাহলে কেন তাদেরকে হত্যা করেছিলে?

নবী করীম (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে যে, তুমি ইয়াহুদীদের অসার কাট-হুজ্জতির কারণে দুঃখিত হবে না। কারণ, এই ধরনের আচরণ তারা যে কেবল তোমার সাথেই করছে তা নয়, বরং তোমার পূর্বে আগত নবীদের সাথেও এই ধরনের আচরণ করা হয়েছে।

৩। আয়াতে কয়েকটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। প্রথমতঃ মৃত্যু এমন ধ্রুব সত্য বিষয় যে, তা থেকে নিষ্কৃতির কোন পথ নেই। দ্বিতীয়তঃ দুনিয়াতে ভাল-মন্দ যে যা-ই করুক না কেন, তাকে তার পরিপূর্ণ প্রতিদান পরকালে দেওয়া হবে। তৃতীয়তঃ প্রকৃত সফলতা সেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যে দুনিয়াতে থাকাকালীন স্বীয় প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করে নিয়েছে এবং যার ফল স্বরূপ তাকে জাহান্নাম থেকে দূর করে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। চতুর্থতঃ পার্থিব জীবন হল ধোঁকার সম্পদ। এই ধোঁকা থেকে যে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে, সেই হবে ভাগ্যবান। আর যে এই ধোঁকার জালে ফেঁসে যাবে, সেই হবে ব্যর্থ ও হতভাগা।

৪। ঈমানদারদেরকে তাদের ঈমান অনুযায়ী পরীক্ষা করার কথা আলোচিত হয়েছে।

তোমাদেরকে অবশ্যই তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবনে পরীক্ষা করা হবে। তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের এবং মুশরিকদের কাছ থেকে তোমরা অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে নিশ্চয়ই তা হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ।

বুখারীতে বর্নিত একটি ঘটনা এসেছে এই আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতঃ উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গাধায় চড়ে আমাকে পেছনে বসিয়ে সা’দ ইবনে উবাদাকে দেখতে গিয়েছিলেন।পথিমধ্যে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের বৈঠকখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদেরকে ইসলাম কবুল করার দাওয়াতও দিলেন। ফলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বেআদবীমূলক বাক্যও ব্যবহার করল। সেখানে কিছু মুসলিমও ছিলেন। তাঁরা তাদের বিপরীত রসূল (সাঃ)-এর প্রশংসা করলেন। তাদের উভয়ের মধ্যে ঝগড়া বেধে যাওয়ার উপক্রম হলে তিনি তাদেরকে থামালেন। অতঃপর তিনি সা’দ (রাঃ)-এর কাছে পৌঁছে তাঁকে এ ঘটনা শুনান।

৫। আহলে-কিতাবদেরকে তিরস্কার করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে মহান আল্লাহ এই অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তাঁর কিতাবে (তাওরাত ও ইঞ্জীলে) যে কথাগুলো লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং শেষ নবীর যে গুণাবলী  উল্লিখিত হয়েছে, সেগুলো  মানুষের কাছে বর্ণনা করবে ও  কিছুই গোপন করবে না। কিন্তু তারা সামান্য পার্থিব স্বার্থের কারণে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলে।

মুনাফিকদের চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সা এর যুগে কিছু মুনাফেক তার সাথে যুদ্ধে যাওয়া থেকে পিছপা হত। এতে তারা নিজেদের মধ্যে আনন্দবোধ করত। তারপর যখন রাসূল ফিরে আসতেন, তখন তার কাছে ওযর পেশ করত এবং অন্যান্যভাবে নিজেদের প্রশংসা শুনতে চাইত। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [বুখারীঃ ৪৫৬৭; মুসলিমঃ ২৭৭৭]

আল্লাহর পরিচয়ঃ আসমান ও যমীনের সার্বভৌম মালিকানা একমাত্র আল্লাহরই; আর আল্লাহ্ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

সূরা আলে ইমরানঃ ২০তম রুকু (১৯০-২০০) আয়াত

হাদীসে বর্ণিত যে, ১৯০নং আয়াত থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো নবী করীম (সাঃ) যখন রাতে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার জন্য উঠতেন, তখন পড়তেন এবং তারপর ওযূ করতেন। (বুখারী ৪৫৬৯-মুসলিম ২৫৬নং)

নিশ্চয় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানী লোকেদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। বিশাল এই পৃথিবীর সুনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলা ও সুব্যবস্থা –যাতে সামান্য পরিমাণও কোন বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না– অবশ্যই তার পিছনে এমন কোন সত্তা আছে যে তা সূক্ষ্ণভাবে পরিচালনা করছে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর সে সত্তা হল আল্লাহর সত্তা। বিস্ময়কর এই সৃষ্টি এবং আল্লাহর মহা কুদরত দেখেও যে ব্যক্তি মহান স্রষ্টার পরিচয় লাভ করতে পারে না, সে প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানীই নয়।

যাঁরা সব সময় আল্লাহর যিকর করেন ও তাঁকে স্মরণে রাখেন এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টি ও তার রহস্য ও যুক্তিসমূহ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করেন, তাঁরা বিশ্বস্রষ্টার মহত্ত্ব ও মহাশক্তি, তাঁর জ্ঞান ও এখতিয়ার এবং তাঁর রহমত ও প্রতিপালকত্ব সম্পর্কে সঠিক পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হন। ফলে আপনা-আপনিই তাঁদের মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসে যে, বিশ্বের প্রতিপালক এই বিশাল পৃথিবীকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি; বরং এর উদ্দেশ্য হল বান্দাদেরকে পরীক্ষা করা। যে বান্দা পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করতে পারবে, সে লাভ করবে চিরস্থায়ী জান্নাতের নিয়ামত। আর যে পরীক্ষায় ব্যর্থ হবে, তার জন্য হবে জাহান্নামের আযাব। এই জন্যই তাঁরা (জ্ঞানীজন) জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার দু’আও করে থাকেন। পরের তিনটি আয়াতে ক্ষমা প্রার্থনা এবং কিয়ামতের দিনের লাঞ্ছনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার দু’আ রয়েছে।

একটি হাদীসের শেষাংশঃ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কাঁদছেন অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? এ রাতে আমার উপর একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যে ব্যক্তি তা তেলাওয়াত করল এবং চিন্তা-গবেষণা করল না, তার ধ্বংস অনিবার্য। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। সহীহ [ইবনে হিব্বানঃ ৬২০]

رَبَّنَاۤ اِنَّکَ مَنۡ تُدۡخِلِ النَّارَ فَقَدۡ اَخۡزَیۡتَهٗ ؕ وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ اَنۡصَارٍ

হে আমাদের রব। আপনি কাউকেও আগুনে নিক্ষেপ করলে তাকে তো আপনি নিশ্চয়ই হেয় করলেন এবং যালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই।১৯২

رَبَّنَاۤ اِنَّنَا سَمِعۡنَا مُنَادِیًا یُّنَادِیۡ لِلۡاِیۡمَانِ اَنۡ اٰمِنُوۡا بِرَبِّکُمۡ فَاٰمَنَّا ٭ۖ رَبَّنَا فَاغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوۡبَنَا وَ کَفِّرۡ عَنَّا سَیِّاٰتِنَا وَ تَوَفَّنَا مَعَ الۡاَبۡرَارِ

– হে আমাদের রব, আমরা এক আহবায়ককে ঈমানের দিকে আহ্বান করতে শুনেছি, ‘তোমরা তোমাদের রবের উপর ঈমান আন’। কাজেই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পাপরাশি ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দ কাজগুলো দূরীভূত করুন এবং আমাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের সহগামী করে মৃত্যু দিন ১৯৩

رَبَّنَا وَ اٰتِنَا مَا وَعَدۡتَّنَا عَلٰی رُسُلِکَ وَ لَا تُخۡزِنَا یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اِنَّکَ لَا تُخۡلِفُ الۡمِیۡعَادَ

হে আমাদের রব! আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে যা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমাদেরকে দান করুন এবং কেয়ামতের দিন আমাদেরকে হেয় করবেন না। নিশ্চয় আপনি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।১৯৪

মহান আল্লাহ তাদের দু’আ কবুল করলেন বা তাদের ডাকে সাড়া দিলেন –এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

প্রত্যেক নেকীর যে প্রতিদান একজন পুরুষ পাবে, সেই নেকী যদি কোন মহিলা করে, তাহলে সেও অনুরূপ প্রতিদান পাবে।

উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা মহিলাদের হিজরত সম্পর্কে কোন কিছু বলেন না কেন? তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩০০]

আল্লাহর হকের বেলায় যে সমস্ত ক্রটি গাফলতী ও পাপ হয়ে থাকবে তা হিজরত ও শাহাদাতের মাধ্যমে মাফ হয়ে যাবে। উত্তম পুরস্কার আল্লাহরই কাছে রয়েছে।

  • যারা কুফরী করেছে, দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন কিছুতেই আপনাকে বিভ্রান্ত না করে।

দুনিয়ার ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের অধিকারী কাফেররা এই আযাবে পতিত হবে।

মহান আল্লাহ বলছেন, এগুলো আসলে কিছু দিনের জন্য ক্ষণস্থায়ী লাভের সামগ্রী। এ ব্যাপারে ঈমানদারদেরকে ধোঁকায় পতিত না হয়ে শেষ পরিণামের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। আর সেই পরিণাম হল, ঈমান থেকে বঞ্চিত হলে জাহান্নামের চিরস্থায়ী আযাব।

  • যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। এ হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আতিথেয়তা; আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা সৎকর্মপরায়ণদের জন্য উত্তম।
  • আয়াতে আহলে-কিতাবের সেই দলের কথা বলা হয়েছে, যে দল রসূল (সাঃ)-এর রিসালাতের উপর ঈমান এনে ধন্য হয়েছে। তাঁদের ঈমান এবং ঈমানী গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তাঁদেরকে এমন সব আহলে-কিতাব থেকে পৃথক করে দিলেন,

আল্লাহর প্রতি বিনয়াবত, ঈমান আনা। স্বল্পমূল্যে বা দুনিয়ার স্বার্থে আয়াত বা ইমানকে বিক্রি করে দেয় না।

  • হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, ধৈর্যে প্রতিযোগিতা কর এবং সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক, আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اصۡبِرُوۡا وَ صَابِرُوۡا وَ رَابِطُوۡا ۟ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

সর্বশেষ আয়াতে  মুসলিমগণকে চারটি বিষয়ে নসীহত করা হয়েছে- (১) সবর, (২) মুসাবারাহ (৩) মুরাবাতা ও (৪) তাকওয়া, যা এ তিনের সাথে অপরিহার্যভাবে যুক্ত

সবর’ এর শাব্দিক অর্থ বিরত রাখা ও বাধা দেয়া। আর কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় এর অর্থ নফসকে তার প্রকৃতি বিরুদ্ধ বিষয়ের উপর জমিয়ে রাখা। এর তিনটি প্রকার রয়েছে- (এক) সবর আলাত্ত্বা’আত। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা ও তার রাসূল যে সমস্ত কাজের হুকুম করেছেন, সেগুলোর অনুবর্তিতা মনের উপর যত কঠিনই হোক না কেন তাতে মনকে স্থির রাখা। (দুই) সবর আনিল মা’আসী অর্থাৎ যে সমস্ত বিষয়ে আল্লাহ্ ও তার রাসূল নিষেধ করেছেন, সেগুলো মনের জন্য যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, যত স্বাদেরই হোক না কেন, তা থেকে মনকে বিরত রাখা। (তিন) সবর আলাল-মাসায়েব অর্থাৎ বিপদাপদ ও কষ্টের বেলায় সবর করা, ধৈর্য ধারণ করা, অধৈর্য না হওয়া এবং দুঃখ-কষ্ট ও সুখ-শান্তিকে আল্লাহরই পক্ষ থেকে আগত মনে করে মন-মস্তিস্ককে সেজন্য অধৈর্য করে না তোলা। [ইবনুল কাইয়্যেম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়ায়িশ শাফী; মাদারিজুস সালেকীন]

মুসাবারাহ শব্দটি সবর থেকেই গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ, শক্রর মোকাবিলা করতে গিয়ে দৃঢ়তা অবলম্বন করা। অথবা পরস্পর ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করা।

মুরাবাতাহ অর্থ হলো, ঘোড়াকে বাধা এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

সমাপ্ত

 

সূরা আন নিসাঃ (১-৪) রুকু

রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, “যে কেউ প্রথম সাতটি সূরা গ্রহণ করবে সে আলেম হিসেবে গণ্য হবে”। [মুসনাদে আহমাদ: ৬/৮৫, ৬/৯৬]

 আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “যে সূরা আলে ইমরান পড়বে সে অমুখাপেক্ষী হবে, আর সূরা আন-নিসা হচ্ছে সৌন্দর্যপূর্ণ।” [সুনান দারেমীঃ ৩৩৯৫]

(মদীনায় অবতীর্ণ) ‘নিসা’র অর্থ মহিলাগণ। এই সূরায় মহিলাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ হয়েছে। আর এরই কারণে এই সূরাকে ‘সূরা নিসা’ বলা হয়েছে।

সূরা আন নিসাঃ ১ম রুকু(১-১০) আয়াত

১.সূরার শুরুতে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যের অধিকার সংক্রান্ত বিধান জারি করা হয়েছে। যেমন- অনাথ ইয়াতীমের অধিকার, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার ও স্ত্রীদের অধিকার ইত্যাদি।

সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, কারো নিজ বংশের ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে এবং আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক অধিকার আদায় হওয়া নির্ভর করে সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার উপর। এসব অধিকার তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। কোন চুক্তির মাধ্যমেও তা নির্ধারণ করা দুষ্কর। সুতরাং এসব অধিকার আদায়ের জন্য আল্লাহ-ভীতি এবং আখেরাতের ভয় ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন উত্তম উপায় নেই। আর একেই বলা হয়েছে তাকওয়া।

এই তাকওয়া দেশের প্রচলিত আইন ও প্রশাসনিক শক্তির চেয়ে অনেক বড়। তাই আলোচ্য সূরাটিও তাকওয়ার বিধান দিয়ে শুরু হয়েছে। সম্ভবতঃ এ কারণেই রাসূল সা বিয়ের খোতবায় এ আয়াতটি পাঠ করতেন। বিয়ের খোতবায় এ আয়াতটি পাঠ করা সুন্নাত। তাকওয়ার হুকুমের সাথে আল্লাহর  ‘রব’ শব্দটি ব্যবহার করার মধ্যেও একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। অর্থাৎ এমন এক সত্তার বিরুদ্ধাচারণ করা কি করে সম্ভব হতে পারে, যিনি সমগ্র সৃষ্টিলোকের লালন-পালনের যিম্মাদার এবং যার রুবুবিয়্যাত বা পালন-নীতির দৃষ্টান্ত সৃষ্টির প্রতিটি স্তরে স্তরে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত।

একটি প্রাণ’ বলতে মানবকুলের পিতা আদম (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। আর خَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا  এতে مِنْهَا থেকে উক্ত প্রাণ অর্থাৎ, আদম (আঃ)-কেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আদম (আঃ) থেকেই তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেন।

যার নাম উচ্চারণ করে একে অন্যের থেকে অধিকার দাবী কর এবং যার নামে শপথ করে অন্যের কাছ থেকে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে থাক সে মহান সত্ত্বার তাকওয়া অবলম্বন করা ও আত্মীয়তার সম্পর্কে – তা পিতার দিক থেকেই হোক, অথবা মায়ের দিক থেকেই হোক – তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থেকে আদায়ের যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করার নির্দেশনা।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বুঝানোর জন্য ‘আরহাম’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, যা মূলতঃ একটি বহুবচনবোধক শব্দ। এর একবচন হচ্ছে রাহেম। যার অর্থ জরায়ু বা গর্ভাশয়। জন্মসূত্রেই মূলতঃ মানুষ পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক সম্পর্কের বুনিয়াদকে ইসলামী পরিভাষায় ‘সেলায়ে-রাহমী বলা হয়। এতে কোন রকম বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হলে তাকে বলা হয় ‘কেত্বয়ে-রাহমী।

’ কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করলে সদকার সওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু কোন নিকট আত্মীয়কে সাহায্য করলে একই সঙ্গে সদকা এবং আত্মীয়তার হক আদায়ের দ্বৈত পূণ্য লাভ করা যায় ৷ [বুখারীঃ ১৪৬৬, মুসলিমঃ ১০০০]

যে ব্যক্তি তার রিযিকের প্রাচুর্য এবং দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশা করে, তার উচিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। [বুখারীঃ ২০৬৭;

আল্লাহ তোমাদের অন্তরের ইচ্ছার কথাও ভালভাবে অবগত রয়েছেন। কিন্তু যদি লোক লজ্জার ভয়ে অথবা সমাজ ও পরিবেশের চাপে পড়ে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সুব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহর কাছে এর কোন মূল্য নেই।নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।

২। আরবী ‘ইয়াতীম’শব্দটির অর্থ হচ্ছে- নিঃসঙ্গ। একটি ঝিনুকের মধ্যে যদি একটিমাত্র মুক্তা জন্ম নেয়, তখন একে ‘দুররাতুন-ইয়াতীমাতুন বা ‘নিঃসঙ্গ মুক্তা’ বলা হয়ে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় যে শিশু-সন্তানের পিতা ইন্তেকাল করে, তাকে ইয়াতীম বলা হয়।মহানবী সা বলেছেন, বালেগ হওয়ার পর আর কেউ ইয়াতীম থাকে না। [আবু দাউদঃ ২৮৭৩]

এখানে বলা হয়েছে ইয়াতীমদেরকে তোমরা তাদের ধন-সম্পদ সমর্পণ করো এবং ভালোর সাথে মন্দ বদল করো না আর তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না; নিশ্চয় এটা মহাপাপ।

পিতৃহীন, অনাথ বা ইয়াতীম যখন সাবালক হয়ে যাবে এবং ভাল-মন্দ বুঝতে শিখবে, তখন তাকে তার ধন-সম্পদ বুঝিয়ে (ফিরিয়ে) দাও।সম্পদ প্রত্যার্পণ করার জন্য দুটি শর্ত দিয়েছে। এক, ইয়াতীম বালেগ হতে হবে, দুই ভাল-মন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

৩।আয়াতে ইয়াতীম মেয়েদের বৈবাহিক জীবনের যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সাধারণ আইন-কানুনের মত তা শুধু প্রশাসনের উপর ন্যস্ত করার পরিবর্তে জনসাধারণের মধ্যে আল্লাহ-ভীতির অনুভূতি জাগ্রত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যদি ইনসাফ করতে পারবে না বলে মনে কর, তাহলে ইয়াতীম মেয়েদেরকে বিয়ে করবে না; বরং সে ক্ষেত্রে অন্য মেয়েদেরকেই বিয়ে করে নেবে।

পবিত্র কুরআনে চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায় বিচার করতে না পার, তাহলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর কর।

যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি এদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে। [আবু দাউদঃ ২১৩৩, তিরমিযীঃ ১১৪১,

৪।স্বামীর প্রতি নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, স্ত্রীর মাহর তাকেই পরিশোধ কর; অন্যকে নয় এবং মনের সন্তোষের সাথে প্রদান কর; অতঃপর সস্তুষ্ট চিত্তে তারা মাহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে স্বামী তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করতে পারে।

৫। এমন সবার হাতেই সম্পদ অর্পন করা যাবে না যাদের হাতে পড়ে ধন-সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে। এতে ইয়াতীম শিশু বা নিজের সন্তানের কোন পার্থক্য নেই।

৬। শিশুরা বিশেষ প্রকৃতি ও জ্ঞানবুদ্ধির বিকাশের মাপকাঠিতে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। (এক) বলেগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়, (দুই) বালেগ হওয়ার পরবর্তী সময়, (তিন) বালেগ হওয়ার আগেই জ্ঞান-বুদ্ধির যথেষ্ট বিকাশ। ইয়াতীম শিশুর অভিভাবকগণকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন তারা শিশুর লেখাপড়া ও জীবন গঠনের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অতঃপর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিষয়বুদ্ধির বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ছোট ছোট কাজ কারবার ও লেন-দেনের দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের পরীক্ষা করতে থাকেন।

তারা বড় হয়ে যাবে বলে অপচয় করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল না। যে অভাবমুক্ত সে যেন নিবৃত্ত থাকে এবং যে বিত্তহীন সে যেন সংযত পরিমাণে ভোগ করে।সম্পদ ফিরিয়ে দিবে তখন সাক্ষী রেখো। আর হিসেব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট।

৭। পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, সেটা অল্পই হোক বা বেশীই হোক, এক নির্ধারিত অংশ।এ আয়াতে কি পরিমাণ অংশ তারা পাবে তা বর্ণনা করা হয়নি।

৮। সাহায্যের অধিকারী আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা মীরাসের অংশীদার নয়, তাদেরকেও বণ্টনের সময় কিছু দিয়ে দিও বা অসিয়তের মাধ্যমে দাও।। আর তাদের সাথে কথা বল স্নেহ ও ভালবাসাজড়িত কণ্ঠে।

৯।নসীহত করা হচ্ছে যে, তাদের তত্ত্বাবধানে যে ইয়াতীমরা রয়েছে, তাদের সাথে যেন তারা ঐরূপ সুন্দর ব্যবহার করে, যেরূপ সে পছন্দ করে তার মৃত্যুর পর তার সন্তানদের সাথে করা হোক।

১০।নিশ্চয় যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তো তাদের পেটে আগুনই খাচ্ছে; তারা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার কর। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কি? রাসূল বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, জাদু, অন্যায়ভাবে কোন প্রাণ সংহার করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করা, যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করা এবং মুমিনা পবিত্ৰা নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া। [বুখারী: ২৭৬৬

আল্লাহর নামঃ   – পর্যবেক্ষন       رَقِیۡبًا

সূরা আন নিসাঃ ২য় রুকু(১১-১৪) আয়াত

১। ইসলাম-পূর্বকালে আরব ও অনারব জাতিসমূহের মধ্যে দুর্বল শ্রেণী, ইয়াতীম বালক-বালিকা ও অবলা নারী চিরকালই যুলুম-নির্যাতনের স্বীকার ছিল। ইসলামই সর্বপ্রথম তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করে। এরপর সব অধিকার সংরক্ষণেরও চমৎকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

২): এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান; কিন্তু শুধু কন্যা দুইয়ের বেশী থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দু’ভাগ, আর মাত্র এক কন্য থাকলে তার জন্য অর্ধেক।

তার সন্তান থাকলে তার পিতা-মাতা প্রত্যেকের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ; সে নিঃসন্তান হলে এবং পিতা-মাতাই উত্তরাধিকারী হলে তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ; তার ভাই-বোন থাকলে মাতার জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ; এ সবই সে যা ওসিয়াত করে তা দেয়ার এবং ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে উপকারে কে তোমাদের নিকটতর তা তোমরা জান না। এ বিধান আল্লাহর;

৩। * স্ত্রী মারা গেলে স্বামী কি পাবেঃ  তোমাদের স্ত্রীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক তোমাদের জন্য, যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে এবং তাদের সন্তান থাকলে তোমাদের জন্য তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ; ওসিয়ত পালন এবং ঋন পরিশোধের পর।

স্বামী মারা গেলে স্ত্রী কি পাবেঃ তোমাদের সন্তান না থাকলে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ, আর তোমাদের সন্তান থাকলে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ; তোমরা যা ওসিয়াত করবে তা দেয়ার পর এবং ঋণ পরিশোধের পর।

كَلالَة এর অর্থ হল, এমন মৃত যার না পিতা আছে, না পুত্রঃ  ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যে মৃত ব্যক্তির ঊর্ধ্বতন ও অধঃস্তন কেউ নেই, সে-ই কালালাহ। [তাবারী

আর যদি কোন পুরুষ অথবা নারীর ‘কালালাহ বা পিতা-মাতা ও সন্তানহীন উত্তরাধিকারী হয়, আর থাকে তার এক বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন, তবে প্রত্যেকের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ। তারা এর বেশী হলে সবাই সমান অংশীদার হবে তিন ভাগের এক ভাগে; এটা যা ওসিয়াত করা হয় তা দেয়ার পর এবং ঋণ পরিশোধের পর, কারো ক্ষতি না করে। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল।

৪। এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেউ আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; তারা সেখানে স্থায়ী হবে আর এটাই হলো মহাসাফল্য।

৫। আর কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তার নির্ধারিত সীমা লংঘন করলে তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে

আল্লাহর পরিচয়ঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

সূরা আন নিসাঃ ৩য় রুকু(১৫-২২) আয়াত

১। এটা হল ব্যভিচারী নারীর এমন শাস্তি যা ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন ব্যভিচারের কোন শাস্তি নির্দিষ্ট ছিল না, তখন সাময়িকভাবে এই শাস্তি কার্যকরী ছিল।

তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচার করে তাদের বিরুদ্ধে চারজন পুরুষ সাক্ষী যদি  সাক্ষ্য দেয় তবে তাদেরকে ঘরে অবরুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু হয় বা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন ব্যবস্থা করেন।

এ শর্তটি খুবই কঠোর। দৈবাৎ ও কদাচিৎ তা পাওয়া যেতে পারে। এ শর্ত আরোপের কারণ, যাতে স্ত্রীর স্বামী, তার জননী অথবা অন্য স্ত্রী অথবা ভাই-বোন ব্যক্তিগত জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে অহেতুক অপবাদ আরোপ করার সুযোগ না পায় অথবা অন্য অমঙ্গলকামী লোকেরা শক্রতাবশতঃ অপবাদ আরোপ করতে সাহসী না হয়।

এখানে যে ব্যবস্থার ওয়াদা করেছেন সূরা আন-নূরে আল্লাহ্ তা’আলা সে ব্যবস্থা করেছেন। তিনি অবিবাহিতদের জন্য বেত্রাঘাত এবং বিবাহিতদের জন্য পাথরের আঘাতে নিহত করা দ্বারা এ আয়াতকে রহিত করেছেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন হাদীসে সুস্পষ্টভাবে তার নির্দেশ এসেছে।(- মুসলিমঃ ১৬৯০, আবু দাউদঃ ৪৪১৫, তিরমিযীঃ ১৪৩৪, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩১৮)

তারা তাওবাহ করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় তবে তাদের থেকে বিরত থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম তাওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু।

২। অজ্ঞাতসারে এবং না জেনে-শুনে গোনাহ করলে তাওবা কবুল হবে এবং জ্ঞাতসারে জেনে-শুনে গোনাহ করলে তাওবা কবুল হবে না। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম এ আয়াতের যে তাফসীর করেছেন তা এই যে, এখানে আয়াতের بِجَهَالَةٍ অর্থ এই নয় যে, সে গোনাহর কাজটি যে গোনাহ, তা জানে না কিংবা গোনাহর ইচ্ছা নেই; বরং অর্থ এই যে, গোনাহর অশুভ পরিণাম ও আখেরাতের আযাবের ব্যাপারে গাফেল বা অসতর্কতাই তার গোনাহর কাজ করার কারণ; যদিও গোনাহটি যে গোনাহ, তা সে জানে এবং তার ইচ্ছাও করে। তাই جهالة শব্দটি এখানে নির্বুদ্ধিতা ও বোকামির অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

তাড়াতাড়ি তাওবাহ করা শর্তের অর্থ হলো দুটি- (এক) মৃত্যুর বড় শ্বাস বের না হওয়ার আগ পর্যন্ত করা। [তিরমিযীঃ ৩৫৩৭, ইবন মাজাহঃ ৪২৫৩] (দুই) সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত করা। [ সূরা আল-আনআমঃ ১৫৮]

৩। দুই ব্যক্তির তাওবা কবুল হবে না ও কষ্টদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছেঃ

ক) আজীবন মন্দ কাজ করে  মৃত্যুর সময় কৃত তওবা গৃহীত হয় না

খ) কাফের ব্যক্তি

৪। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ইসলামপূর্বযুগে কোন লোক মারা গেলে তার অভিভাবকরা তার স্ত্রীর অধিকারী হয়ে যেত। সে ইচ্ছে করলে তাকে বিয়ে করত অথবা অন্যের নিকট বিয়ে দিয়ে দিত। তখন এ আয়াতটি নাযিল হয় ৷ [বুখারী ৪৫৭৯] স্বামীর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র নিজেও পিতার মৃত্যুর পর তাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারতো

  • ইমানদারদের সম্বোধন করে আল্লাহ জানিয়েছেন- হে ঈমানদারগণ! যবরদস্তি করে নারীদের উত্তরাধিকার হওয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে কিছু আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রেখো না।
  • যে মহিলা স্বামীর অবাধ্য সে মহিলা থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য পুরুষটি তাকে দেয়া সম্পদ ফেরৎ নিতে পারবে।
  • অশ্লীলতা ও অবাধ্যতা ব্যতীত অন্য কোন এমন দোষ যদি স্ত্রীর মধ্যে থাকে, যে দোষের কারণে স্বামী তাকে অপছন্দ করে, তাহলে সে যেন তাড়াহুড়া করে তাকে তালাক না দেয়, বরং সে যেন ধৈর্য ও সহ্যের পথ অবলম্বন করে। হতে পারে এতে মহান আল্লাহ তার জন্য অজস্র কল্যাণ দান করবেন। অর্থাৎ, সৎ সন্তানাদি দান করবেন কিংবা তার কারণে আল্লাহ তাআলা তার ব্যবসা বা কাজে বরকত দান করা সহ আরো অনেক কিছু দেবেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন- তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।

কোন মু’মিন পুরুষ যেন কোন মু’মিন নারীকে ঘৃণা না করে। তার কোন একটি অভ্যাস তার কাছে খারাপ লাগলেও অপরটি ভাল লাগবে। (মুসলিম ১৪৬৯নং)

৫। স্বামী নিজ ইচ্ছায় তালাক দিলে স্ত্রীর কাছ থেকে মোহর ফেরৎ নিতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। قِنْطَارٌ বলা হয় ধন-ভান্ডার এবং প্রচুর সম্পদকে। অর্থাৎ, মোহর যতটা পরিমাণই হোক না কেন তা ফেরৎ নিতে পারবে না। যদি এ রকম কর, তাহলে তা যুলুম এবং প্রকাশ্য পাপ হবে। কাতাদা বলেন, দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বা পাকাপোক্ত অঙ্গীকার বলে বিয়ে বুঝানো হয়েছে। কারণ বিয়ের সময় মাহর দেয়া এবং স্ত্রীকে সঠিকভাবে পরিচালনা কিংবা সুন্দরভাবে বিদায় করার অঙ্গীকার করার মত চুক্তি সংঘটিত হয়ে থাকে।

৬। জাহেলিয়াত যুগে পিতার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে পুত্ররা বিনাদ্বিধায় বিয়ে করে নিত। [দেখুনঃ বুখারীঃ ৪৫৭৯] এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এই নির্লজ্জ অশ্লীল, মারাত্মক ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট পন্থার কাজটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন এবং একে ‘আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ বলে অভিহিত করেছেন।

সূরা আন নিসাঃ ৪র্থ রুকু(২৩-২৫) আয়াত

১। আলোচ্য আয়াতসমূহে যাদের সাথে বিয়ে হারাম, এমন নারীদের বিবরণ দেয়া হয়েছে। তারা দুই ভাগে বিভক্তঃ

এক. ঐ সমস্ত হারাম নারী কোন অবস্থাতেই হালাল হয় না, তাদেরকে ‘মুহাররামাতে আবাদীয়্যা’ বা ‘চিরতরে হারাম মহিলা’ বলা হয়।

এ জাতীয় মহিলা তিন শ্রেণীরঃ (১) বংশগত হারাম নারী, (২) দুধের কারণে হারাম নারী এবং (৩) শ্বশুর সম্পর্কের কারণে হারাম নারী চিরতরে হারাম।

দুই. কোন কোন নারী চিরতরে হারাম নয়, কোন কোন অবস্থায় তারা হালালও হয়ে যায়। তাদেরকে ‘মুহাররামাতে মুআক্কাতাহ’ বা সাময়িক কারণে হারাম বলা হয়। এরা আবার দু’ শ্রেণীতে বিভক্তঃ

(ক) পরস্ত্রী সে যতক্ষণ পর্যন্ত পরের স্ত্রী থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম। কিন্তু যখনই অপরের স্ত্রী হওয়া থেকে মুক্ত হবে তখনই সে হালাল হয়ে যাবে।

(খ) কোন কোন মহিলা শুধুমাত্র অন্যের সাথে একসাথে বিবাহ করা হারাম। যেমন, দুই বোনকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে রাখা। খালা ও বোনঝিকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে রাখা।

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুধ পানের সময়টুকু যেন ঐ সময়েই সংঘটিত হয় যখন সন্তানের দুধ ছাড়া আর কোন খাবার দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ হতো না। [বুখারী ৫১০২; মুসলিম: ১৪৫৫]

তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, মেয়ে, বোন, ফুফু খালা, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে, দুধমা, দুধবোন, শাশুড়ী ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সংগত হয়েছ তার আগের স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত মেয়ে, যারা তোমাদের অভিভাবকত্ব আছে, তবে যদি তাদের সাথে সঙ্গত না হয়ে থাক, তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই। আর তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত ছেলের স্ত্রী ও দুই বোনকে একত্র করা, আগে যা হয়েছে, হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

২। অধিকারভুক্ত দাসী বলতে ঐ সমস্ত নারীদেরকে বুঝায়, যারা কাফের ছিল। মুসলিমগণ যুদ্ধে তাদের পুরুষদের পরাজিত করে তাদেরকে নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসে, তখন তাদেরকে মুসলিমদের জন্য বিয়ে ছাড়াই হালাল করা হয়েছে। তবে যুদ্ধ-বন্দিনী দাসীদের সাথে সংগম করার ব্যাপারে কিছু নিয়মনীতি রয়েছে।

কুরআন ও হাদীসে যে মহিলাদের সাথে বিবাহ করা হারাম বলে ঘোষিত হয়েছে, তাদেরকে ছাড়া অন্য মহিলাদেরকে বিবাহ করা জায়েয চারটি শর্তের ভিত্তিতে। (ক) তলব করতে হবে। অর্থাৎ, উভয় পক্ষের মধ্যে ইজাব ও কবুল (প্রস্তাব ও গ্রহণ) হতে হবে (এক পক্ষ প্রস্তাব দিবে এবং অপর পক্ষ কবুল করবে)। (খ) দেনমোহর আদায় করতে হবে। (গ) তাকে সব সময়ের জন্য বিবাহ বন্ধনে রাখা উদ্দেশ্য হবে, কেবল কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করাই লক্ষ্য হবে না। (যেমন, ব্যভিচারে অথবা শীয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত মুতআ’ তথা কেবল যৌনক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে কয়েক দিন বা কয়েক ঘণ্টার জন্য সাময়িকভাবে চুক্তিবিবাহ হয়ে থাকে)। (ঘ) গোপন প্রেমের মাধ্যমে যেন না হয়, বরং সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিবাহ হবে। এই চারটি শর্ত আলোচ্য আয়াত থেকেই সংগৃহীত।

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার যুদ্ধের কালে মুত’আ বিয়ে ও গৃহপালিত গাধার গোস্ত হারাম করেছেন। [বুখারী ৫১১৫, ৫৫২৩; আরও দেখুন বুখারীঃ ৪২১৬, মুসলিমঃ ১৪০৬, ১৪০৭]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মাহর নির্ধারণের পর কোন বিষয়ে পরস্পর রাযী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, ধার্যকৃত পূর্ণ মাহর প্রদান করে স্ত্রীকে তার মাহরের ব্যাপারে পূর্ণ অধিকার প্রদান করা। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ]

৩। যার স্বাধীন নারীদেরকে বিয়ে করার শক্তি-সামর্থ্য নেই কিংবা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেই, সে ঈমানদার দাসীদেরকে বিয়ে করতে পারে। কোন অবস্থাতেই কাফের দাসীদেরকে বিয়ে করা জায়েয নেই। যদিও তারা কিতাবী হয়। [তাবারী; আদওয়াউল বায়ান] ক্রীতদাসীদের মালিক বা মনিবই তাদের ওলী ও অভিভাবক। কাজেই মনিবের অনুমতি ব্যতীত তার বিবাহ হতে পারে না। অনুরূপ ক্রীতদাসও তার মালিকের অনুমতি ছাড়া কোথাও বিয়ে করতে পারে না।

  • এই ক্রীতদাসীদেরকে বিবাহ করার অনুমতি কেবল তাদের জন্য রয়েছে, যারা নিজেদের যৌবনের যৌন উত্তেজনা আয়ত্তে রাখার শক্তি রাখে না এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে।
  • মুক্ত নারীর শাস্তির কথা এখানে বলা হয় নি। অন্যত্র বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্যভিচারিনী মহিলা ও ব্যভিচার পুরুষের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করা [সূরা আন-নূর: ২] সে হিসেবে এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, ব্যভিচারিনী দাসীর শাস্তি হবে পঞ্চাশ বেত্রাঘাত। কিন্তু ব্যভিচারী দাসের ব্যাপারটি ভিন্ন কোন আয়াতে আসে নি। তাই ব্যাভিচারিনী দাসীর শাস্তি যেভাবে অর্ধেক হয়েছে সেভাবে ব্যভিচারী দাসের ক্ষেত্রেও তেমনি অর্ধেক শাস্তি হবে; কারণ দাসত্বের দিক থেকে উভয়েই সমান। এটাও এক প্রকার কিয়াস। [আদওয়াউল বায়ান] দাস-দাসীরা বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত হোক তাদের কোন রজম তথা প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুদণ্ড বা দেশান্তর নেই।
  • দাসী বিয়ে করার চেয়ে ধৈর্যধারণ করা উত্তম। যাতে করে আল্লাহ্ তাআলা যখন তাকে সামর্থ দিবে, তখন যেন স্বাধীনা নারী বিয়ে করতে পারে। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ]

৪র্থ পারা সমাপ্ত

আলহামদুলিল্লাহ

(তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বয়ান, ইবন কাসীর থেকে নোট করা)