আমাদের সমাজে পূর্ব থেকেই গল্প ও সুর দিয়ে ওয়াজ নসীহত করার প্রচলন ছিল, এর মাধ্যমে শ্রোতাকে আকর্ষন করাটাই যেনো উদ্দেশ্য, কারন যদি রাসূল স.এর সুন্নাহের আলোকে দাওয়াত হতো তাহলে রাসূল স.এর বক্তব্যের ধরনে এই সুরের কথা জানা যায় নি। দিনে দিনে এই আকর্ষন দিয়ে ওয়াজকারী প্রসিদ্ধলাভের জন্য অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে(বাইবেল তালমূদ বা বানানো কিসসা)গল্প তুলে ধরতেও কার্পন্য করেনি। এর ফলে সমাজে সঠিক ঘটনা ও তার শিক্ষা পর্দার আড়ালে থেকে যায় এবং রুপকথার মত গল্প নিয়েই মানুষের আলাপচারিতা চলে।ফলে এর মাধ্যমে সাময়িক আবেগ কাজ করে ঠিকই কিন্তু জীবনের চলার পথের পরিবর্তন সঠিকভাবে হয় না বললেই চলে। যেমন হযরত ইউসুফ আ.কে নিয়ে কাহিনী….
আমাদের মূল ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে যতটা পারদর্শী হওয়া দরকার তা না হয়ে দেখা যায় অধিকাংশ সময় ঘটনা কবে কখন ও কোথায় হয়েছিল তা নিয়ে সময় মেধা দিয়ে গুরুত্ব প্রদান করে থাকি। অথচ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এটা করতে যেয়ে ঘটনার অন্তরালে কারন ও এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে করনীয় কি তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করা হয়। শয়তান এটাই চায় যে মানুষ গল্পের মধ্যে ঘটনার রুপ নিয়ে আলোচনায় মেতে থাকুক আর আহাজারি বা বাহবা দিতে থাকুক, মূল শিক্ষা নিয়ে যেন চিন্তা না করে ও জীবনের সংশোধনের আমল না করে। মহান আল্লাহ আমাদের বুদ্ধি দৃষ্টি ও চিন্তার অন্তর জানালা খুলে দিন ও সঠিক শিক্ষা নিয়ে আমল করার তাওফিক দান করুন।
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে যা কুর’আনে বর্ণিত আছে, তবে নির্দিষ্ট তারিখ বা সংখ্যা বা অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার শেষ অধ্যায় সম্পর্কেও নিরব রয়েছে। মহান আল্লাহ ঘটনার যতটুকুঅ বিশ্লেষন দরকার ব্যক্তির জ্ঞানের চোখ খুলার জন্য ও জীবনে শিক্ষা নিয়ে আমল করার জন্য ততটুকু জানিয়ে দিয়েছেন। তাই আমরাও যেন শিক্ষা নিতে পারি সেইভাবেই জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।
রজব মাসে আমাদের সমাজে শবে-মেরাজ নিয়ে বেশ আলোচিত একটি বিষয়। যদিও এই ঘটনাটি রজব মাসেই হয়েছিল- তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। মিরাজ রাসূল স.এর জীবনের কোন সময়ে হয়েছিল তা নিয়ে অনেকগুলো মত পাওয়া যায়।
১. নবুয়তের প্রথম বৎসর।
২. নবুয়তের পঞ্চম বৎসর—ইমাম নববী ও কুরতুবী এ মতটি গ্রহণ করেছেন।
৩. রজবের ২৭ তারিখ নবুয়তের দশম বৎসর।
৪. হিজরতের ১৬ মাস আগে, অর্থাৎ নবুয়তের ১২ম বৎসর, রমজানে।
৫. হিজরতের এক বৎসর দুই মাস আগে, অর্থাৎ নবুয়তের ১৩ম বৎসর, মহররমে।
৬. হিজরতের এক বৎসর আগে, অর্থাৎ নবুয়তের ১৩ বৎসর, রবিউল আউয়ালে।
প্রথম তিনটি অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ, খাদিজা নবুয়তের দশম বৎসর রমজান মাসে ইন্তেকাল করেন। এদিকে সবার নিকট স্বীকৃত, তার মৃত্যুর পর নামাজ ফরজ হয়। সে হিসেবে রজবের ২৭ তারিখে মেরাজ হতে পারে না। অন্য বর্ণনার স্বপক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য কোন দলিল নেই। যতটা বুঝে আসে, ইসরা ও মেরাজ অনেক পরে সংঘটিত হয়েছে। (রহিকুল মাখতুম পৃ : ১৬০)
ইসলামের এমন অনেক বিষয় আছে যার দিন তারিখ না জানলেও আমাদের জীবনের কোন সমস্যা হবে না, সেই রকম একটি বিষয় হলো মিরাজের দিন, তাই সাহাবা রা.ও এই তারিখ সংরক্ষনের প্রয়োজন বোধ করেন নি। কিন্তু মিরাজের ঘটনা ও এর অন্তর্নিহিত মর্যাদা গুরুত্ব ও শিক্ষা জানা আমাদের প্রত্যেকের প্রয়োজন। তাই প্রচলিত রজব মাসের ২৭ তারিখকে মি’রাজ হিসেবে নির্দিষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। এই দিনকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদাত বা দু’আ রাসূল স. থেকে জানা যায়না এবং সাহাবা তাবেয়ী আযমাঈনদের জীবনেও দেখা যায় না।
ইসরা মিরাজের ঘটনা রাসূল স.এর জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ইসরা শব্দটির অর্থ রাতের সফর। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাতের একাংশে মক্কার হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এর এলাকায় যে সফর করানো হয়েছে সেটাকে ইসরা বলা হয়।
আর মি‘রাজ হচ্ছে, উপরে আরোহন। আল্লাহ তাঁর হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভূমি থেকে আকাশে আরোহণ করিয়ে প্রথম আকাশ থেকে শুরু করে সপ্তাকাশ ভেদ করে সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে তাঁর নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। সেটাকেই মি‘রাজ বলা হয়।
ইসরা পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইসরা বা বনী ইসরাঈল এর ১ম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
“পবিত্র ও মহান সে সত্ত্বা যিনি তাঁর বান্দাকে সফর করিয়েছেন রাতের একাংশে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসার দিকে, যার চতুস্পার্শকে তিনি করেছেন বরকতময়। যাতে তিনি তাকে দেখাতে পারেন তাঁর নিদর্শনসমূহ। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। [আল-ইসরা:১]
আর মি‘রাজের দলীল হচ্ছে, অন্য আয়াত যেখানে বলা হয়েছে,
পুনরায় আর একবার সে তাকে সিদরাতুল মুনতাহার কাছে দেখেছে। যার সন্নিকটেই জান্নাতুল মা’ওয়া অবস্থিত। সে সময় সিদরাকে আচ্ছাদিত করছিলো এক আচ্ছাদনকারী জিনিস। দৃষ্টি ঝলসেও যায়নি কিংবা সীমা অতিক্রমও করেনি। সে তার রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ দেখেছে। সূরা আন নাজম:১৩-১৮
রাসূল স.এর জীবনে মিরাজের ঘটনার পূর্বের অবস্থা একটু সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই তাহলে বুঝা সম্ভব এর প্রয়োজনীয়তা।
নবুওয়তের দশম বৎসরে একের পর এক বিপদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে ধরে। রাসূলের চাচা আবু তালেব মারা যান; যিনি কাফের হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সার্বক্ষনিক নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতেন। তার জীবদ্দশায় কেউ তার কোন ক্ষতি করতে চাইলেও সক্ষম হত না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কাফেররা অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠে।
এর কিছুদিন পর নবুয়তের দশম বর্ষেই রামাদান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহাও মারা যান। যিনি শুধু রাসূলের স্ত্রীই ছিলেন না; বরং তার দাওয়াতের প্রধান সহযোগীও ছিলেন। তার সমস্ত সম্পত্তি রাসূলের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তার উপর প্রথম ঈমান এনেছিলেন। এ পথে যত কষ্ট হয়েছে সবই সহ্য করেছেন।পাশে থেকে সব সময় সহযোগীতা সান্তনা উৎসাহদান করে গিয়েছিলেন।
তাদের মৃত্যুর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসহায় বোধ করলেন। তিনি বিভিন্ন গোত্রপতিদের কাছে নিজেকে পেশ করে বললেন, “কে আমাকে আশ্রয় দিবে যাতে আমি আমার রবের কথা প্রচার করতে পারি?” কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না।
এমতাবস্থায় তিনি তায়েফ গেলেন। সেখানে তায়েফের সর্দারদের কাছে তিনি একই কথা ব্যক্ত করলেন। তাদের কেউ তার কথায় কর্ণপাতই করল না। উপরন্তু তারা দুষ্ট শিশুদের তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। তারা তাকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে দিল।
পরবর্তীতে আল্লাহর রাসূল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে, মক্কায় তাকে ফিরে যেতে হবে এবং নতুন উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে, এ সময় হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি কি করে মক্কায় যাবেন, মক্কার অধিবাসীরা তো আপনাকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে, তিনি বললেন, হে যায়েদ, তুমি যে অবস্থা দেখছ, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় আল্লাহ তায়ালা বের করে দেবেন, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তার দ্বীনকে সাহায্য এবং তার নবীকে জয়যুক্ত করবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাখলা থেকে রওয়ানা হয়ে মক্কার অদূরে হেরা গুহায় অবস্থান করলেন, সেখান থেকে খাজায়া গোত্রের একজন লোকের মাধ্যমে আখনাস ইবনে শোরাইককে এ পয়গাম পাঠালেন যে, আখনাস যেন তাকে আশ্রয় দেন, আখনাস একথা বলে অক্ষমতা প্রকাশ করল যে, আমি তো মিত্রপক্ষ, মিত্রপক্ষ তো কাউকে আশ্রয় দেয়ার মত দায়িত্ব নিতে পারে না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর সোহায়েল ইবনে আমরের কাছেও একই পয়গাম পাঠালেন কিন্তু সেই লোকও এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করলো যে, বনু আমরের দেয়া আশ্রয় বনু কাব এর ওপর প্রযোজ্য নয়, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোতয়াম ইবনে আদীর কাছে পয়গাম পাঠালেন মোতয়াম বললেন হ্যাঁ, আমি রাজি আছি এরপর তিনি অস্ত্র সজ্জিত হয়ে নিজের সন্তান এবং গোত্রের লোকদের ডেকে একত্রিত করলেন সবাই একত্রিত হওয়ার পর বললেন, তোমরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে কাবাঘরের সামনে যাও, কারণ আমি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশ্রয় দিয়েছি, এরপর মোতয়াম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খবর পাঠালেন যে আপনি মক্কার ভেতরে আসুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর পাওয়ার পর যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন মোতয়াম ইবনে আদী তার সওয়ারীর ওপর দাড়িয়ে ঘোষণা করলেন যে, কোরাইশের লোকেরা শোন আমি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশ্রয় দিয়েছি কেউ যেন এরপর তাকে বিরক্ত না করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজরে আসওয়াদ চুম্বন এবং দুরাকাত নামায আদায় করলেন নামায আদায়ের পর তিনি নিজের ঘরে ফিরে গেলেন এ সময় মোতয়াম ইবনে আদী এবং তার সন্তানেরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরে রাখল, আল্লাহর রাসূল ঘরে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তারা তার সঙ্গে ছিল।
বলা হয়ে থাকে যে, এ সময় আবু জেহেল মোতয়াকে জিজ্ঞাসা করছিল, তুমি শুধু তাকে আশ্রয় দিয়েছ, না তার অনুসারী অর্থাৎ মুসলমান ও হয়ে গেছ? মোতয়াম বললেন, আমি শুধু আশ্রয় দিয়েছি।
এতে আবু জেহেল বলল, তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছ আমরাও তাকে দিলাম (তায়েফ সফরের এ ঘটনার বিবরণসমূহ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪২৯-৪২২, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৬-৪৭, রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৭১-৭৪, তারীখে ইসলাম নযীরাবাদী, ১ম খন্ড, পৃ. ১২৩-১২৪)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোতয়াম ইবনে আদীর এ উপকার কখনো ভোলেননি, বদরের যুদ্ধের পর মক্কার কাফেররা বন্ধী হয়ে আসার পর কয়েকজন বন্দীর মুক্তির সুপারিশ নিয়ে মোতয়ামের পুত্র হযরত হোবায়ব (রা, )রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হলেন তিনি বলেছিলেন, মোতায়ম ইবনে আদী যদি আজকে বেচে থাকতো এবং আমার কাছে এসব দুর্গন্ধময় লোকদের ব্যাপারে সুপারিশ করতো, তবে তাদের খাতিরে আমি এদের সবাইকে মুক্ত করে দিতাম (সহীহ বোখারী ৩য় খন্ড, পৃ.৫৭৩)।
মহান আল্লাহ্ তাকে সম্মানিত করতে চাইলেন। তিনি তাকে ইসরা ও মি‘রাজের মত বিরল সম্মানে সম্মানিত করলেন। দুনিয়ায় মানুষ যখন রাসূল স.কে অসম্মানিত করে কষ্ট নির্যাতন করে ত্যাগ করেছে, প্রিয় ব্যক্তিদের পর পর চলে যাওয়াতে যে মানসিক কষ্টে পড়েছিলেন রাসূল স., ঠিক সেই সময় মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স. কাছে নিয়ে যেয়ে সম্মানিত ও অন্তরে স্বস্থি এনে দেন। সুবহানাল্লাহ
মি’রাজের প্রয়োজনীয়তাঃ
মহান আল্লাহই জানিয়ে দিয়েছেন এর উদ্দেশ্য, আমরা তাকে বড় বড় কিছু নিদর্শন দেখানোর ইচ্ছা করছি। রাসূল স. যেন সেই নিদর্শন লাভে উম্মতের কাছে এমন বর্ণনা দিতে পারেন যেন উম্মতের কাছেও মনে হবে যে চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছে। ঈমানের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করা সহজ হবে। ইসলামের প্রধানতম স্তম্ভ নামাজ ফরজ করা হয় সেই রাতে। তাছাড়া রাতে রাসুলকে (সা.) স্বচক্ষে এমন কিছু বিষয় দেখানো হয়, যা একটি আদর্শিক সমাজ গঠনে পরবর্তী জীবনে কাজে লাগে। রিসালাত ও নবুয়তের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত বান্দাদের ব্যাপারে এটাই মহান আল্লার নীতি ও বিধান। যেমনটি হয়েছে ইবরাহিম আ., মূসা আ. ও অন্যান্য নবি-রাসূলদের ব্যাপারে। যেন তাদের চাক্ষুষ ইমান লাভ হয়, আল্লাহর রাস্তায় যে কোন ত্যাগ, কুরবানি অম্লান বদনে পেশ করতে পারেন।
সেই রাতে নবীদের ইমাম বানিয়ে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর (সা.)কে শ্রেষ্ঠত্বের বাস্তব উদাহরণ স্থাপন করেন। শুধু নবীকেই শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি, এই নবীর উম্মতদেরও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয় শবে মেরাজে। এজন্য মেরাজের শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো প্রত্যেক মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব।
মি’রাজের ঘটনার বর্ননা কয়েকভাবে জানা যায়, মুসলিম শরীফ ও ইবনে কাসীর থেকে সূরা বনী ইসরাইল তাফসীর পড়লে জানতে পারবেন।
রাসূল সা.-এর সহধর্মিণী উম্মে হানী বলেন, ইসরার শুভরাত্রিতে রাসূল সা. আমার ঘরে, আমার কাছে, এশার নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন, আমরাও তার সাথে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে ফজরের কিছুক্ষণ আগে আমাদের তিনি জাগ্রত করেন, নামাজ পড়েন, আমরাও তার সাথে নামাজ আদায় করি। অতঃপর তিনি বলেন—উম্মি হানি, তুমি লক্ষ্য করেছ, এখানেই আমরা একসাথে এশার নামাজ পড়েছি, এরপর আমি বায়তুল মাকদিস গিয়েছি, সেখান থেকে ফিরে এসে এই মাত্র তোমাদের সাথে ফজর নামাজ আদায় করলাম, যা লক্ষ্য করছ। হাসান রহ.-এর বর্ণনায় আছে, রাসূল সা. বলেন, আমি হিজরে—হাতিম ; কাবার বহিরংশ, একে হিজরে ইসমাইলও বলা হয়—ঘুমিয়ে ছিলাম। এমতাবস্থায় জিবরিল আ. আসেন, আমাকে পায়ে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন, আমি উঠে বসি, কিন্তু কাউকে না দেখে পুনরায় শুয়ে পড়ি। তৃতীয় বার সে আমার বাহু ধরে, আমি তার সাথে দাঁড়িয়ে যাই। অতঃপর আমাকে মসজিদের দরজার কাছে নিয়ে আসে, সেখানে লক্ষ্য করি, অদ্ভুত আকৃতির একটি প্রাণী, যাকে গাধাও বলা যায় না আবার তা ঘোড়ার মতও না। উরুতে বিশাল আকার দুটি পাখা, যার মাধ্যমে সে পায়ে আঘাত করে। চোখের দৃষ্টিসীমার প্রান্তে গিয়ে তার সম্মুখ পা দুটি মাটি স্পর্শ করে। এর নাম বোরাক। আগের যুগের নবিগণ এর উপরেই আরোহণ করতেন। আমাকে তার উপর আরোহণ করাল। জিবরিল আমিনের সাহচর্যে আমি আসমান-জমিনের বিচিত্র নিদর্শন দেখতে দেখতে বায়তুল মাকদিসে পৌঁছি। সেখানে অবতরণ করে জিবরিল দরজার আংটার সাথে বোরাক বাঁধেন, আমি লক্ষ্য করি, ইবরাহিম, মুসা ও ইসা আ.দের সাথে আরো অনেক নবিগণ একত্রিত হয়েছেন সেখানে। মুসা আ. এর আকৃতি একটি উপমাযোগ্য দেহের ন্যায়। শানুয়া বংশের পুরুষদের মত অনেকটা। কোঁকড়ানো চুল, হালকা গড়ন, লম্বা শরীর। ইসা আ. এর আকৃতি মাঝারি গড়ন, ঝুলন্ত সোজা চুল, চেহারা সৌন্দর্য তিলকে ভর্তি। মনে হচ্ছিল তিনি গোসলখানা হতে বের হয়েছেন, পানি টপকাচ্ছে মাথা হতে, অথচ কোন পানি টপকাচ্ছিল না। প্রায় উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফির মত। ইবরাহিমের আকৃতি আমার মত, আমি-ই তার সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। অত:পর আমার সামনে দুটি পেয়ালা : একটি মদের অপরটি দুধের, পেশ করা হয়। আমাকে বলা হল : যেটা ইচ্ছে পান করেন, আমি দুধের পেয়ালা হাতে নেই এবং পান করি। আমাকে বলা হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যদি আপনি মদের পেয়ালা হাতে নিতেন, পান করতেন, আপনার উম্মত গোমরাহ হয়ে যেত। অপর একটি বর্ণনায় পানির তৃতীয় আরেকটি পেয়ালার উল্লেখও পাওয়া যায়। (দ্র : ইবনে হিশাম, বোখারি, মুসলিম)
অতঃপর তিনি প্রথম আসমানে আরোহণ করেন, রাসূলের জন্য দরজা খুলতে বলা হয়, দরজা খুলে দেয়া হয়। সেখানে আদম আ. এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। তার ডান পাশে জান্নাতিদের রুহ এবং বাম পাশে জাহান্নামিদের রুহ প্রত্যক্ষ করেন।
অতঃপর দ্বিতীয় আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইয়াহইয়া ইবনে জাকারিয়া ও তার খালাতো ভাই ইসা ইবনে মারইয়ামের সাথে সাক্ষাৎ হয়।
অত:পর তৃতীয় আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইউসূফ আ. এর সাথে সাক্ষাৎ হয়।
অতঃপর চতুর্থ আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইদরিস আ. এর সাথে সাক্ষাৎ হয়।
অতঃপর পঞ্চম আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে মূসা আ. এর ভাই হারুন ইবনে ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ হয়।
অত:পর ষষ্ঠ আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে মূসা ইবনে ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ হয়। রাসূল তার থেকে বিদায় নিলে তিনি কেঁদে ফেলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, কি জন্য কাঁদেন ? তিনি বলেন, এ জন্য কাঁদি, আমার পরে একজন যুবক প্রেরণ করা হয়েছে, তার উম্মত আমার উম্মতের চে’ বেশি জান্নাতে প্রবেশ করবে।
অতঃপর সপ্তম আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইবরাহিম আ. এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। সকলেই তাকে অভিবাদন, স্বাগত, অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন, তার নবুওয়তের স্বীকারোক্তি প্রদান করেন।
অতঃপর সর্বশেষ সীমা : সিদরাতুল মুন্তাহায় পৌঁছেন, যার ফল হাজার শহরের কলসির ন্যায়, পাতা হাতির কানের মত, যা স্বর্ণের পতঙ্গ, আলোকোজ্জ্বল, বিচিত্র রং বেষ্টিত। যে সৌন্দর্য বর্ণনা করার সাধ্য কারো নেই।
অতঃপর বায়তুল মামুরে আরোহণ করেন, যেখানে প্রতি দিন সত্তুর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে, যাদের কেউই কিয়ামতের পূর্বে পুনরায় প্রবেশ করার সুযোগ পাবে না। অতঃপর জান্নাতে প্রবেশ করেন, যার ভেতর স্বর্ণের রশি, কস্তুরীর মাটি প্রত্যক্ষ করেন।
অতঃপর আরো উপরে উঠে কলমের আওয়াজ শুনতে পান। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী হন, ধনুক বা তার চে’ কম দূরত্বের ব্যবধানে। অতঃপর তার প্রতি, যা ইচ্ছে ছিল, ওহি করেন। পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। ফেরার পথে মূসা আ. এর পরামর্শে পুনরায় আল্লাহর দরবারে পুনঃ পুনঃ গিয়ে শেষাবধি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসেন। দূরে এসে একটি ঘোষণা শুনতে পান- আমার ধার্যকৃত নিশ্চিত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছি, আমার বান্দার জন্য সহজ করে দিয়েছি। (দ্র : যাদুল মায়াদ ২ : ৪৭ ও ৪৮, রাহিকুল মাখতুম: পৃ: ১৬০, ইবনে হিশাম:১/২৪২-২৪৬)
কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত, এ সফরের প্রাক্কালে তার বক্ষ মোবারক যমযমের পানি দ্বারা বিধৌত করে নূর ও প্রজ্ঞায় পূর্ণ করা হয়।
এ সফরে আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটে : সিদরাতুল মুনতাহার নিকট চারটি নহর প্রবাহিত হতে দেখেন। দুটি দৃশ্য, যা নীল ও ফুরাত নদীর উৎস ; দুটি অদৃশ্য, যা জান্নাতে প্রবাহিত হচ্ছে। নীল ও ফুরাত নদীর অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন—এ দুটি অঞ্চলে ইসলামের অবস্থান দৃঢ় ও শক্ত হবে।
জাহান্নামের ফেরেশতা প্রত্যক্ষ করেন : সে হাসে না। তার চেহারায় কোন সৌহার্দ্য বা কোমলতা নেই। তদ্রুপ, জান্নাত-জাহান্নামও প্রত্যক্ষ করেন।
এতিমদের সম্পদ ভক্ষণকারীদের প্রত্যক্ষ করেন : উটের ঠোঁটের ন্যায় বিশাল চোয়াল বিশিষ্ট, যাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, পরক্ষণই যা পিছনের রাস্তা দিয়ে বের হচ্ছে।
সুদখোরদের দেখেন : বিশাল ভুড়ি বিশিষ্ট, যার কারণে তারা নড়াচড়া করতে পারছিল না, ফেরআউনের বংশধর তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, আর দলিত করছে।
যিনাকারদের দেখেন : তাদের সামনে ভাল-সুস্বাদু গোস্ত বিদ্যমান, অথচ তারা দুর্গন্ধময়, গোস্ত খাচ্ছে।
আরো কিছু বর্ননা হাদীসে পাওয়া যায়।
জাহান্নামের কিছু চিত্র ও জান্নাতের কিছু নমুনা রাসূল স.কে দেখানো হয়। জান্নাত জাহান্নাম যে মানুষের শেষ পরিনতি, এই সত্যকে যে ধারন করতে পারে, তার দুনিয়ার জীবন কুর’আনের আলোকে রাসূল স.এর দেখানো পথে চলা সহজ হয়ে যায়। আমরাতো প্রতিনিয়ত বাস্তব সত্য মৃত্যু ও কবরে শায়িত হওয়াকে দেখছি, তাহলে কেনো সত্যের পথে নিজেকে সঁপে দিতে দেরী হবে? মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন।
হযরত আবদুল্লাহ (রা.) হাতে বর্ণিত হাদিসে আছে,
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মেরাজের রাতে আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার পর আল্লাহ পাক আমাকে তিনটি
বিশেষ উপহার প্রদান করেছেন
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ,
২. সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত,
৩. যে মুসলিম আল্লাহর সাথে শরীক করবেনা তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে (সহীহ মুসলিম)
মিরাজ থেকে আমাদের জীবনের জন্য যে শিক্ষা রাসূল স. বয়ে এনেছেন—
– রাসূল স. কে যখন দুনিয়ার মানুষেরা অসম্মান করে আঘাত করেছিল তখনই বিশ্ব জাহানের মালিক তাঁর বান্দাকে কাছে নিয়ে সম্মানিত করে আস্বস্থ করে সাহস জুগিয়ে দিয়েছেন। আকাশের সকল বাসিন্দারাই রাসূল স.কে সম্মান করেছে। উম্মতে মুহাম্মদী হয়ে আমাদের জীবনেও কখনো কোন অবস্থাতেই হতাশ বা অস্থির না হয়ে রাসূল স.এর জীবনের শিক্ষাকে সামনে রেখে শান্তি ও সাহস আনা প্রয়োজন, নির্ভরতা আনা দরকার প্রতিপালকের উপর। তাহলে মহান আল্লাহই সকল অবস্থায় সম্মানের সাথেই সহজ সমাধান করে দিবেন।
– মহান আল্লাহ রাতকেই বেছে নিয়েছিলেন কারন এই সময়টি হলো যখন প্রকৃতি শান্ত থাকে। কাজে মন বসে। ইবাদতে একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা অর্জিত হয়।
– সেখানে যাওয়ার পর আল্লাহ তা’আলা তিনটি জিনিষ রাসূল স.কে দেন। সহিহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদ হাদীস থেকে জানা যায় যা ইবনে কাসীর বর্ননা করেছেন।
১। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত
২। সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত
৩। তাওহীদবাদীদের সমস্ত পাপের ক্ষমা
– সালাত এমন একটি নির্দেশনা যা মহান আল্লাহ কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তাঁর প্রতিনিধি রাসূল স. কে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই সালাতের ব্যপারে প্রত্যেকেরই আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
– রাসূল স.মেরাজ থেকে এসেই সত্য এই ঘটনাকে সকলের সামনে সাহসের সাথেই বর্ননা করেছেন, এখান থেকেও শিক্ষা যে সত্যকে লুকিয়ে না রেখে দূর্বল না হয়ে ভয় না পেয়ে প্রকাশ করা বা জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন।
– কারা ঈমানদার ও কারা বেঈমান বা দুর্বল ইমানের অধিকারী সেটা এই ঘটনার পরে রাসূল স.এর কথাকে কে বিশ্বাস করে তা দিয়ে পরিস্কার হয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহ বলেন,
“আর আমরা আপনাকে যে দৃশ্য দেখিয়েছিলাম, তা তো কেবল মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই”। [সূরা আল-ইসরা: ৬০]
কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীন ইসলামকে কায়েম করার যে মিশনে নেমেছেন তাতে শক্ত খাঁটি ইমানদারদের প্রয়োজন হবে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঈমানের দৃঢ়তা এখানে প্রকাশ পেল। তিনি নির্দ্বিধায় সেটার উপর ঈমান এনেছিলেন। সিদ্দিক উপাধী লাভ করেন এই ঘটনার পর।
মি’রাজের সেই রাতের ভ্রমনে রাসূল স. মক্কা হতে একটি কাফেলা যেতে, আরেকটি কাফেলা আসতে দেখেন। তাদের একটি হারানো উটের সন্ধান দেন। তাদের ঢাকনা আবৃত একটি পাত্র হতে পানি পান করেন, অতঃপর তা ঢেকে রাখেন। যা ইসরা ও মেরাজের সুস্পষ্ট, বাহ্যিক দলিল প্রমাণিত হয়। (যাদুল মায়াদ, ইবনে হিশাম, রহিকুল মাখতুম পৃ: ১৬১)
সকালে যখন তিনি(রাসূল স.) এ ঘটনার বিবরণ দেন, চারদিক হতে অলীক ও মিথ্যার অপবাদ আসতে থাকে, সকলে বায়তুল মাকদিসের অবকাঠামো জানতে চান। আল্লাহ তার সামনে বায়তুল মাকদিসের চিত্র তুলে ধরেন, তিনি সবিস্তারে এক- একটি করে বর্ণনা প্রদান করেন, যা প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য কারো ছিল না।
জাবের রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা- কে তিনি বলতে শুনেন, যখন কুরাইশগণ আমাকে মিথ্যারোপ করল, আমি হিজরে দণ্ডায়মান হই, আল্লাহ আমার জন্য বায়তুল মাকদিসের চিত্র তুলে ধরেন, আমি দেখে দেখে তাদের জিজ্ঞাসিত তথ্য জানিয়ে দেই। (বোখারি হা.৪৭১০, মুসলিম হা.১৭০) পথে সাক্ষাৎপ্রাপ্ত কাফেলার সংবাদও দেন, তাদের আসার নির্ভুল তারিখও বলেন, তাদের হারানো উটের সন্ধান দানের কথাও বলেন, যার সত্যাসত্য প্রমাণও তারা পেয়েছে। তবুও তাদের বিরোধিতা আর প্রত্যাখ্যান-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। (দ্র : যাদুল মায়াদ, বোখারি, মুসলিম, ইবনে হিশাম) চতুর্মুখি বিরোধিতা সত্ত্বেও আবু বকর রা. নির্দ্বিধায় সত্যারোপ করে সিদ্দিক উপাধি প্রাপ্ত হন। (ইবনে হিশাম)
মিরাজের এই ঘটনার কিছুসময়ের ব্যবধানে হিজরত সম্পন্ন হয়। আর মদীনার নতুন ভূখণ্ডে যেন ব্যক্তিজীবন পারিবারিক জীবন তথা সামাজিক জীবনে শান্তি সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকে যা ইসলামের শিক্ষা, সেই কারনে বনী ইসরাইল সূরার পরবর্তী কিছু আয়াতে এই নির্দেশনামূলক মূলনীতি জানিয়ে দেন মহান প্রতিপালক। (আয়াত ২৩-৩৯)
১। আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করো না । তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে।
২। তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।
৩। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।
৪। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভালই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তবে তিনি তওবাকারীদের জন্যে ক্ষমাশীল।
৫। আত্নীয়-স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না।নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।
৬। এবং তোমার পালনকর্তার করুণার প্রত্যাশায় অপেক্ষামান থাকাকালে যদি কোন সময় তাদেরকে বিমুখ করতে হয়, তখন তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বল।
৭। তুমি একেবারে ব্যয়-কুষ্ঠ হয়োনা এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃতি, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে। নিশ্চয় তোমার পালকর্তা যাকে ইচ্ছা অধিক জীবনোপকরণ দান করেন এবং তিনিই তা সংকুচিতও করে দেন। তিনিই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত,-সব কিছু দেখছেন।
৮। দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ।
৯। আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।
১০। সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন; কিন্তু ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি। অতএব, সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।
১১। আর, এতিমের মালের কাছেও যেয়ো না, একমাত্র তার কল্যাণ আকাংখা ছাড়া; সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যৌবনে পদার্পন করা পর্যন্ত এবং অঙ্গীকার পূর্ন কর। নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
১২। মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপালায় ওজন করবে। এটা উত্তম; এর পরিণাম শুভ।
১৩। যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।
১৪। পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ পৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।
এ সবের মধ্যে যেগুলো মন্দকাজ, সেগুলো তোমার পালনকর্তার কাছেও অপছন্দনীয়। এটা ঐ হিকমতের অন্তর্ভূক্ত, যা আপনার পালনকর্তা আপনাকে ওহী মারফত দান করেছেন। আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করবেন না। তাহলে অভিযুক্ত ও আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবেন। সূরা বনী ইসরাইলঃ২৩-২৯
আজ আমাদের জন্য এই নীতিমালাগুলো খুবই প্রয়োজন। ব্যক্তি ও পরিবারের মাঝে চলুন এই নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটাই, তাহলে একটি সুন্দর পবিত্র সমাজ উপহার পাবে আমাদের পরবর্তী জেনারেশন। মহান আল্লাহ আমাদের কথা ও কাজের মিল রেখে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার ঈমান অদম্য শক্তি সাহস ও সবর দিন।
(আর রাহীকূল মাখতুম ও নেট থেকে সংগ্রহ করা কিছু তথ্য।)