নবী রাসূলদের প্রতি ঈমান-১

নবী ও রাসূল দু’টি শব্দের অর্থই বার্তাবাহক। তারা সকলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বাণী প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

‘রাসূল’ তিনি, যাঁর নিকটে প্রকাশ্যভাবে জিব্রীলকে আ কে আসমানী কিতাব দিয়ে পাঠিয়ে আল্লাহ রিসালাত প্রদান করেছেন।

পক্ষান্তরে ‘নবী’ তিনি, যার নিকটে আল্লাহ কোন খবর পাঠিয়েছেন ইলহাম অথবা স্বপ্নের মাধ্যমে (যেমন ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট পাঠিয়েছিলেন)। অতএব প্রত্যেক রাসূলই নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসূল নন। মাহদাভী (المهدوى) বলেন, এটাই সঠিক।

কাযী ইয়ায বলেন, বিদ্বানগণের বিরাট অংশ এ মতকেই সঠিক বলেন যে, প্রত্যেক রাসূলই নবী। কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসূল নন। তিনি আবু যর গেফারী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ থেকে দলীল নিয়েছেন যে, ১ লাখ ২৪ হাযার পয়গাম্বরের মধ্যে ৩১৫ জনের বিরাট সংখ্যা ছিলেন ‘রাসূল’ (তাফসীর কুরতুবী; আহমাদ হা/২২৩৪২; মিশকাত হা/৫৭৩৮; ছহীহাহ হা/২৬৬৮)। সম্ভবতঃ এ কারণেই মুহাম্মাদ (সা)-কে কুরআনে ‘শেষনবী’ বলা হয়েছে (আহযাব ৩৩/৪০), শেষ রাসূল নয়। হাদীছেও তিনি বলেছেন, আমি শেষনবী, আমার পরে কোন নবী নেই’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫২; মিশকাত হা/৫৪০৬)। কেননা নবী ব্যতীত কেউ রাসূল হ’তে পারেন না।

রাসূলগণের সংখ্যা তিন শত দশের কিছু বেশি প্রমাণিত হয়েছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন রাসূলগণের সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি বলেন,

«ثلاثمائة وخمس عشرة جماً وغفيراً»

“তিনশত পনের জনের বিরাট এক দল।” (হাকিম)

আর নবীদের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। আল্লাহ তাদের কারোও কথা তাঁর কিতাবে আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন, আর কারোও কথা বর্ণনা করেন নি।

আল্লাহ তাঁর কিতাবে পঁচিশ জন নবী ও রাসূলের নাম উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আর এমন কতক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের ইতিবৃত্ত আমরা আপনাকে বর্ণনা করেছি ইতোপূর্বে এবং এমন কতক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের বৃত্তান্ত আপনার কাছে বর্ণনা করি নি।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৪

তিনি আরো বলেন,

“এটি ছিল আমার যুক্তি, যা আমরা ইবরাহীমকে তাঁর সম্প্রদায়ের বিপক্ষে প্রদান করেছিলাম। আমরা যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় সমুন্নত করি। আপনার পালনকর্তা প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী। আমরা তাঁকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকূব। প্রত্যেককেই আমরা পথ-প্রদর্শন করেছি এবং পূর্বে আমি নূহকে পথ-প্রদর্শন করেছি- তাঁর সন্তানদের মধ্যে দাউদ, সোলায়মান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারুনকে। এমনিভাবে আমরা সৎকর্মীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। আরও যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকে। তারা সবাই পূণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর ইসমাঈল, ঈসা, ইউনুস, লূতকে প্রত্যেককেই আমরা সারা বিশ্বের ওপর গৌরবান্বিত করেছি। আরো তাদের কিছু সংখ্যক পিতৃপুরুষ, সন্তান-সন্ততি ও ভ্রাতাদেরকে, আমরা তাদেরকে মনোনীত করেছি এবং সরল পথ প্রদর্শন করেছি।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৮৩-৮৭]

আল্লাহ নবীদের কাউকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدۡ فَضَّلۡنَا بَعۡضَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ عَلَىٰ بَعۡضٖۖ﴾ [الاسراء: ٥٥]

“অবশ্যই আমরা নবীদেরকে কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৫]

এবং আল্লাহ রাসূলদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿تِلۡكَ ٱلرُّسُلُ فَضَّلۡنَا بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۘ﴾ [البقرة: ٢٥٣]

“এ রাসূলগণ আমরা তাদের কাউকে কারো ওপর মর্যাদা দান করেছি।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৩]

রাসূলগণের মধ্যে যারা উলুল-আযম তথা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন তারা সর্ব উত্তম। তারা হলেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَٱصۡبِرۡ كَمَا صَبَرَ أُوْلُواْ ٱلۡعَزۡمِ مِنَ ٱلرُّسُلِ﴾ [الاحقاف: ٣٥]

“অতএব আপনি ধৈর্য ধরুন, যেমন উলুল আযম (উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন) রাসূলগণ ধৈর্য ধরেছেন।” [সূরা আল-আহক্বাফ, আয়াত: ৩৫]

﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِيثَٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٖ وَإِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّيثَٰقًا غَلِيظٗا ٧﴾ [الاحزاب: ٧]

“যখন আমরা নবীগণের কাছ থেকে, আপনার কাছ থেকে এবং নূহ, ইবরাহীম মূসা ও মারিইয়ামের পুত্র ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম, আরো অঙ্গীকার নিলাম তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী, মুত্তাকীদের ইমাম, আদম সন্তানের সরদার। নবীরা যখন একত্রিত হবেন তখন তিনি তাদের ইমাম। যখন তারা কোনো জায়গা থেকে প্রতিনিধি দল হিসাবে আগমন করেন তখন তিনি তাদের প্রবক্তা। তিনি মাকামে মাহমুদের (প্রশংসিত স্থানের) মালিক, যে স্থানকে নিয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেই ঈর্ষা করবে।

 

অবতরণ স্থান, হাউয ও হামদ বা প্রশংসার ঝাণ্ডার মালিক। শেষ দিবসে সমস্ত সৃষ্টি জীবের সুপারিশকারী, জান্নাতের ওয়াসীলা নামক স্থা্ন ও মর্যাদার মালিক। আল্লাহ তাকে তাঁর দীনের সর্বোত্তম শরী‘আত বিধি-বিধান দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর উম্মাতকে সর্বোত্তম উম্মতরূপে এই পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণের জন্য পাঠানো হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মাতের জন্য বহু মর্যাদা ও উত্তম বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। যা তাদের পূর্ববর্তীদের থেকে স্বতন্ত্র। সৃষ্টির দিক দিয়ে তারা সর্বশেষ উম্মত আর পুনরুত্থানে তারা সর্বপ্রথম উম্মত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«فضلت على الأنبياء بست».

“আমি ছয়টি বৈশিষ্ট্যে সকল নবীদের ওপর প্রাধান্য পেয়েছি।” (সহীহ মুসলিম)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

“আমি কিয়ামত দিবসে আদম সন্তানের সর্দার, আমারই হাতে হামদের পতাকা থাকবে। এটা কোনো গর্বের বিষয় নয়। কিয়ামত দিবসে আদম ছাড়া সকলেই আমার পতাকার অধীনে থাকবে।” (তিরমিযী ও আহমদ)

মর্যাদার দিক দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে যিনি তিনি হলেন ইবরাহীম খালীলুর রহমান। সুতরাং (আল্লাহর) দু’বন্ধু -মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উলুল আযমদের সর্বশ্রেষ্ঠ। অতঃপর তিনজন (নূহ, মূসা ও ঈসা) সর্বশ্রেষ্ঠ (অন্য সব নবীদের চেয়ে)।

নবীদের মু‘জিযা:

আল্লাহ তাঁর রাসূলদের সহযোগিতা করেছেন বড় বড় নিদর্শন ও উজ্জ্বল মু‘জিযার (অলৌকিক শক্তির) দ্বারা। যাতে হুজ্জাত (পক্ষে-বিপক্ষে প্রমাণ) প্রতিষ্ঠিত হয় অথবা প্রয়োজন পূরণ হয়।

যেমন, কুরআনুল কারীম, চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া, লাঠি ভয়ানক সাপে পরিণত হওয়া, ইত্যাদি।

অতঃপর মু‘জিযা (স্বাভাবিক নীতি ভঙ্গকারী-অলৌকিক শক্তি) নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের দালীল, আর কারামাহ্ (অলীদের জন্যও অলৌকিক শক্তি) নবুওয়াতের সত্যতা সাক্ষ্যকারী প্রমাণস্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আমরা আমাদের রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি।” [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২৫]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“প্রত্যেক নবীই নিদর্শন বা মু‘জিযাপ্রাপ্ত হয়েছেন, যে মু‘জিযার মত কিছু দেখে মানুষ ঈমান এনেছে। আর আমি যা প্রাপ্ত হয়েছি তা সেই অহী যা আমার নিকট (আল্লাহ) অবতীর্ণ করেছেন। ফলে আমি আশাবাদী যে, কিয়ামত দিবসে তাদের চেয়ে আমার অনুসারী বেশি হবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

নবী রাসূলদের প্রেরনের উদ্দেশ্য কি ও তাঁদের কাজ কি কিঃ

প্রথমত:

বান্দাদেরকে বান্দার ইবাদত করা থেকে মুক্ত করে বান্দার প্রতিপালকের (আল্লাহর) ইবাদতে নিয়ে যাওয়া এবং সৃষ্টিজীবের দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করে স্বীয় রবের (আল্লাহর) স্বাধীন ইবাদতের পথ দেখানো।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আর অবশ্যই আমরা প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগূতকে (আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করা হয় তাদেরকে) বর্জন কর।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]

দ্বিতীয়ত:

যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ সৃষ্টিজীব সৃষ্টি করেছেন, সে উদ্দেশ্যের সাথে (মানুষকে) পরিচয় করানো।

আর সে উদ্দেশ্য হলো তাঁর একত্ববাদ বিশ্বাস ও ইবাদত করা। তা একমাত্র রাসূলগণের মাধ্যমে জানা যায়। যাদেরকে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টজীব থেকে মনোনয়ন করেছেন এবং সকলের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন।

যে মহান উদ্দেশ্য ও মহা পরীক্ষার জন্য মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা হচ্ছে- তাওহীদ বা নিরংকুশভাবে এক আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ প্রদান করা। আল্লাহ নিজেই মানুষ সৃষ্টির এ উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “আমি জিন্ন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র এ কারণে যে, তারা আমারই ‘ইবাদাত করবে।”[সূরা যারিয়াত, আয়াত: ৫৬]

“যিনি করেছেন মরণ ও জীবন যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কোন্‌ ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি মহা শক্তিধর, অতি ক্ষমাশীল।”[সূরা আল-মুল্‌ক, আয়াত: ২]

তারা এমন ছিলেন, যাদেরকে আল্লাহ পথ-প্রদর্শন করেছিলেন, অতএব আপনিও তাদের পথ অনুসরণ করুন।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯০]

তৃতীয়ত:

রাসূলগণকে প্রেরণের মাধ্যমে মানুষের ওপর  (পক্ষ-বিপক্ষের দলীল) প্রতিষ্ঠিত করা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মতো কোনো অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে, আর আল্লাহ পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৫]

চতুর্থত:

কিছু গায়েবী বিষয়ের বিষয় বর্ণনা করা, যা মানুষ তাদের জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে না।

যেমন, আল্লাহর নামসমূহ ও তাঁর গুণসমূহ এবং ফিরিশতাদের ও শেষ দিবস সম্পর্কে জানা ইত্যাদি। গায়েব সম্পর্কে জানার উপায় হলো অহীর জ্ঞান যা মহান আল্লাহ তাঁর প্রেরিত রাসূলদের মাধ্যমেই জানা যায়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

আপনি বলুন! আমি তোমাদের এ কথা বলি না যে আমার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার রয়েছে, আর আমি অদৃশ্যের কোনো জ্ঞানও রাখি না। আমি তোমাদের এ কথাও বলি না যে আমি একজন ফেরেশতা। আমার কাছে যা কিছু ওহিরূপে পাঠানো হয়, আমি শুধু তারই অনুসরণ করে থাকি। আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমমানের? সুতরাং তোমরা কেন চিন্তাভাবনা করো না?’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৫০)

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুহাম্মদ তুমি ঘোষণা দিয়ে দাও—আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ছাড়া আমার নিজের ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে আমার কোনো অধিকার নেই, আমি যদি অদৃশ্য তত্ত্ব ও খবর জানতাম, তবে আমি অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারতাম আর কোনো অমঙ্গল ও অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদবাহী।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮৮)

পঞ্চমত:

যাতে রাসূলরা অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ হয়; কেননা আল্লাহ তাদেরকে উত্তম চরিত্রে পূর্ণ করেছেন এবং তাদেরকে সংশয় ও প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে মুক্ত রেখেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তারা এমন ছিলেন, যাদেরকে আল্লাহ পথ-প্রদর্শন করেছিলেন, অতএব আপনিও তাদের পথ অনুসরণ করুন।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯০]

তিনি আরো বলেন,

﴿لَقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِيهِمۡ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الممتحنة: ٦]

“তোমাদের জন্য রাসূলদের মধ্যে উত্তম আদর্শ-রয়েছে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]

ষষ্ঠত:  

আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রকরণ এবং আত্মবিনষ্টকারী থেকে সর্তক-সাবধান করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তিনিই সে সত্তা, যিনি নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত।” [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق».

“আমি উত্তম আদর্শ পরিপূর্ণ করার জন্যেই প্রেরিত হয়েছি।” (আহমদ ও হাকেম)

রাসূলগণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে, যেমন:

(ক) শরী‘আত প্রচার করা, মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তিনি ব্যতীত অন্যের ইবাদত থেকে মুক্ত হওয়ার আহবান করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তাঁরা (নবীগণ) আল্লাহর রিসালাত প্রচার করতেন ও তাঁকে ভয় করতেন। তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করতেন না। হিসাব গ্রহণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৯]

(খ) দীনের অবতীর্ণ বিধান বর্ণনা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আপনার কাছে আমরা উপদেশ ভাণ্ডার (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি। যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐ সব বিষয় বিবৃত করেন, যেগুলো তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৪৪]

(গ) উম্মাতকে কল্যাণের পথ প্রদর্শণ ও অকল্যাণ থেকে সতর্ক সাবধান করা এবং তাদেরকে পূণ্যের সুসংবাদ ও তাদেরকে শাস্তির ভীতি-প্রদর্শন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿رُّسُلٗا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ﴾ [النساء: ١٦٥]

“সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৫]

(ঘ) মানুষকে কথায় ও কাজে সুন্দর চরিত্র ও উত্তম আদর্শবান করে তোলা।

“তিনিই সে সত্তা, যিনি নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত।” [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ২]

(ঙ) আল্লাহর শরী‘আত বান্দাদের মাঝে প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ণ করা।

রাসূল (সা.)কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ আল্লাহ স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন

‘তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত এবং দীনে হক দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ দীনকে অন্য দীনের ওপরে বিজয়ী করে দেন: মুশরিকদের নিকট তা যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।’  (সূরা তাওবা : ৩৩)।

(চ) রাসূলগণের স্বীয় উম্মাতের পক্ষ থেকে শেষ দিবসে এ সাক্ষ্য দেওয়া যে তারা তাদের নিকট স্পষ্টভাবে দীনের দাওয়াত পৌঁছায়েছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আর তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে, যখন আমি প্রতিটি উম্মাতের মধ্য থেকে সাক্ষী উপস্থাপন করব এবং আপনাকে তাদের ওপর সাক্ষী উপস্থাপন করব।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪১]

 ঈমানের শর্তই হলো সকল রাসূলকে বিশ্বাস করতে হবে।

প্রত্যেক রাসূলই তাঁর পূর্ববর্তী রাসূল আগমণের সুসংবাদ দিতেন এবং পরবর্তী রাসূল পূর্ববতী রাসূলের সত্যায়ন করতেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদীয় বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীকে তাদের রবের পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে, তৎসমূদয়ের ওপর। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩৬]

আর যে ব্যক্তি কোনো রাসূলকে মিথ্যা জানল, সে যেন অস্বীকার করল যা সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল এবং যে ব্যক্তি তাঁর (রাসূলের) অবাধ্য হলো, সে মূলতঃ তাঁর অবাধ্য হলো যিনি তাকে আনুগত্যের আদেশ করেছেন। (অর্থাৎ আল্লাহর)।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অস্বীকার করি এবং এরাই মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য অস্বীকারকারী। আর যারা সত্য অস্বীকারকারী তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি অপমানজনক শাস্তি।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৫০-১৫১

ইসলামই সকল নবীদের দ্বীন:

ইসলাম সকল নবী ও রাসূলগণের দ্বীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 

﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ﴾

“নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহনযোগ্য দ্বীন বা ধর্ম একমাত্র ইসলাম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯]

তাঁরা সকলেই এক আল্লাহর ইবাদত করার দিকে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত বর্জন করার আহবান জানাতেন। যদি ও তাদের শরী‘আত ও বিধি-বিধান ভিন্ন রকম ছিল, কিন্তু তারা সকলেই মূলনীতিতে একমত ছিলন, তা হলো তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«الأنبياء إخوة لعلات»

“নবীরা একে অপরে বৈমাত্রেয় ভাই ছিলেন।” (সহীহ বুখারী)

রাসূলগণ মানুষ, তারা গায়েব জানেন না:

ইলমে গাইব জানা আল্লাহর বৈশিষ্ট্য, নবীগণের গুণ নয়। কারণ তারা অন্যান্য মানুষের মত মানুষ। তারা পানাহার করেন, বৈবাহিকসূত্রে আবদ্ধ হন, নিদ্রা যান, অসুস্থ হন ও ক্লান্ত হন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,আপনার পূর্বে যত রাসূল প্রেরণ করেছি, তারা সবাই খাদ্য গ্রহণ করত এবং হাটে বাজারে চলা ফেরা করত।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২০]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

“আপনার পূর্বে আমরা অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দিয়েছি।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ৩৮]

হে মুহাম্মাদ! বলো, আমি তো একজন মানুষ তোমাদেরই মতো, আমার প্রতি অহী করা হয় এ মর্মে যে, এক আল্লাহ তোমাদের ইলাহ, কাজেই যে তার রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী তার সৎকাজ করা উচিত এবং বন্দেগীর ক্ষেত্রে নিজের রবের সাথে কাউকে শরীক করা উচিত নয়৷(কাহাফঃ১১০

তাদেরকে ও চিন্তা, দুঃখ আনন্দ ও কর্ম প্রেরণা স্পর্শ করে যেমন- সাধারণ মানুষকে পেয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে তাঁর দীন প্রচার করার জন্য মনোনয়ন করেছেন। আল্লাহ তাদেরকে (রাসূলদেরকে ইলমে গায়েব হতে) যা অবগত করান তা ব্যতীত কোনো ইলমে গায়েব জানেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 

﴿عَٰلِمُ ٱلۡغَيۡبِ فَلَا يُظۡهِرُ عَلَىٰ غَيۡبِهِۦٓ أَحَدًا ٢٦ إِلَّا مَنِ ٱرۡتَضَىٰ مِن رَّسُولٖ فَإِنَّهُۥ يَسۡلُكُ مِنۢ بَيۡنِ يَدَيۡهِ وَمِنۡ خَلۡفِهِۦ رَصَدٗا ٢٧﴾ [الجن: ٢٦، ٢٧]

“তিনি গায়েবের জ্ঞানী, পরন্তু তিনি গায়েবের বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না। তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তখন তিনি তার অগ্রেও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ২৬-২৭]

রাসূলগণ মা‘সূম বা নিস্পাপ:

ইসমাত (العصمة) শব্দটি ‘আসামা’ (عَصَمَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ নিষেধ করা, সংরক্ষণ করা বা হেফাযত করা (prevent, guard, protect)। ইসলামী পরিভাষায় ‘ইসমাত’ বলতে বুঝানো হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তিকে পাপ বা ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষণ করা। সাধারণত একে অভ্রান্ততা, নিষ্কলঙ্কত্ব, পাপাক্ষমতা বা নিষ্পাপত্ব (infallibility, impeccability; sinlessness) বলা হয়। ইসমাতুল আম্বিয়া অর্থ নবীগণের অভ্রান্ততা বা নিষ্পাপত্ব।

এ বিষয়ে ইমাম আযম (রাহ) বললেন: ‘‘নবীগণ সকলেই সগীরা গোনাহ, কবীরা গোনাহ, কুফর ও অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র ও বিমুক্ত ছিলেন। তবে কখনো কখনো সামান্য পদস্খলন ও ভুলত্রুটি তাঁদের ঘটেছে।’’

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রিসালাত প্রদান ও প্রচার করার জন্য তাঁর সৃষ্টজীব থেকে উত্তম লোকদেরকে নির্বাচন করেছেন। যারা সৃষ্টিগত ও চরিত্রগত দিক থেকে পরিপূর্ণ, আল্লাহ তাদেরকে কবীরা গুনাহ থেকে নিরাপদে রেখেছেন। সকল ত্রুটি থেকে তাদেরকে মুক্ত করেছেন। যাতে তারা আল্লাহর অহী স্বীয় উম্মাতের নিকট পৌঁছাতে সক্ষম হন।

আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রিসালাত প্রচারের ব্যাপারে যে সংবাদ দিয়েছেন, তাতে তারা যে মা‘সূম তা সর্বজনস্বীকৃত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“হে রাসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতি পালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন,তবে আপনি তাঁর রিসালাত কিছুই পৌঁছালেন না, আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে নিরাপদে রাখবেন।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৬৭]

তিনি আরো বলেন,

“তাঁরা (নবীগণ) আল্লাহর রিসালাত প্রচার করতেন ও তাঁকে ভয় করতেন, তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করতেন না।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৯]

তিনি আরো বলেন,

“যাতে আল্লাহ তা‘আলা জেনে নেন যে, রাসূলগণ তাদের পালনকর্তার রিসালাত পৌঁছিয়েছেন কিনা। রাসূলগণের কাছে যা আছে, তা তাঁর জ্ঞান-গোচর। তিনি সব কিছুর সংখ্যার হিসাব রাখেন।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ২৮]

এরা নবীগণের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ প্রদান করেছেন, তারা আদমের ও যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশোদ্ভুত, ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশোদ্ভুত ও যাদেরকে আমি পথ-নির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম। সূরা মারইয়াম: ৫৮ আয়াত

এবং যখন তাদের কারো পক্ষ থেকে এমন কোনো ছোট পাপ কর্ম প্রকাশিত হয় যা তাবলীগের (দীন প্রচারের) সাথে সম্পৃক্ত নয়, তখন তা তাদের নিকট বর্ণনা করা হলে তারা আল্লাহর কাছে তাওবাহ ও তাঁর দিকে এমনভাবে ধাবমান যেন এ পাপ তাদের কাছ থেকে প্রকাশ পায় নি, ফলে তারা তাদের পূর্বের মর্যাদার চেয়ে আরো উচ্চ মর্যাদা লাভ করবেন। তা এ জন্য যে, আল্লাহ তাঁর নবীদেরকে পূর্ণ সৎ চরিত্রে ও ভাল গুণে বিশেষিত করেছেন। এবং তাদের মান-মর্যাদা সুউচ্চ অবস্থান ক্ষুন্ন হয় এমন সকল জিনিস থেকে তাদেরকে পবিত্র রেখেছেন।

মিশকাত শরীফে ﺍَﻟْﻮَﺳْﻮَﺳَﺔُ

অধ্যায়ে বর্ণিত আছে প্রত্যেক মানুষের সাথে একজন শয়তান অবস্থান করে যার নাম কারীণ। প্রিয় নবী বলেন,”আমার কারীন মুসলমান হয়ে গেছে।”

 

 

সংগৃহিত