দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত পরিশ্রম ও আন্তরিকতা ভালোবাসা নিয়ে উম্মতের আখেরাতের মুক্তির চিন্তায় পেরেশান ছিলেন যা দীর্ঘ ২৩ বছরের অক্লান্ত রিসালাতের দায়িত্ব পালন ও ৬৩ বছরের জীবনের বিভিন্ন সময়ের ভূমিকা থেকে উপলব্ধি করা যায়। সেই রাসূলের সা উম্মত হয়ে আমাদের কি করা প্রয়োজন নিজেই একটু অন্তরের জানালা খুলে দেখি ও সংশোধন হয়ে বাস্তব আমলের নমুনা রাখতে সচেষ্ট হই।
ইমাম আহমদ রহ. বর্ণিত হাদীসে এসেছে, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা
করেছেন, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“আমার দৃষ্টান্ত ও তোমাদের দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তির মত, যে আগুন জ্বালালো,
তারপর যখন আগুনের আশ-পাশ আলোকিত হল,তখন কীট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড় যেগুলো আগুনের মধ্যে ঝাপ দেয়, তাতে তারা পড়তে আরম্ভ করল। আর লোকটি তাদের বাধা দিল, কিন্তু তারা তাকে পরাভূত করে তাতেই ঝাঁপ দিচ্ছিল। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার দৃষ্টান্ত এ লোকটির মতই; আমি
তোমাদের কোমর ধরে তোমাদের আগুন থেকে দূরে সরাচ্ছি, বলতে থাকছি, আগুন!
আগুন! তা থেকে দূরে থাক, কিন্তু তোমরা আমাকে পরাভূত করে তাতেই ঝাঁপ দিচ্ছ।
(বুখারি, রিকাক অধ্যায়, হাদিস: ৬১১৮,মুসলিম, ফাযায়েল অধ্যায়, হাদিস: ২২৪৪,
তিরমিযী, আমসাল অধ্যায়, হাদিস: ২৮৭৪,আহমদ, হাদিস: ৩১২/২)
শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ এর লেখাঃ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইত্তেবা (অনুসরণ) করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত বিধান (শরিয়ত) অনুযায়ী ইবাদত পালন করবে। মাখলুকের মনমত অথবা নতুন কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে আল্লাহর ইবাদত করবে না। এটাই হলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইত্তেবা বা অনুসরণের মর্মার্থ।
সুতরাং.১।একনিষ্ঠতা,.২। বিশ্বস্ততা বা অকপটতা এবং ৩। ইত্তেবায়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ তিনটি উবুদিয়্যাহ্ বা আল্লাহর দাসত্বের অনিবার্য উপসর্গ। এ তিনটির সাথে যা কিছু সাংঘর্ষিক সেগুলো ‘মানুষের দাসত্ব’।
১। রিয়া বা লৌকিকতা ‘মানুষের দাসত্ব’।
২। শির্ক ‘মানুষের দাসত্ব’।
৩। আল্লাহ্র নির্দেশ ত্যাগ করে, আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করা ‘মানুষের দাসত্ব’।
এভাবে যে ব্যক্তি তার খেয়ালখুশিকে আল্লাহ্র আনুগত্যের উপরে প্রাধান্য দেবে সে আল্লাহর দাসত্বের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে এবং সরল পথ (সিরাতুল মুস্তাকীম) থেকে ছিটকে পড়বে।
তাইতো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “দিনার ও দিরহামের পূজারি ধবংস হোক। ধবংস হোক কারুকাজের পোশাক ও মখমলের বিলাসী। যদি তাকে কিছু দেওয়া হয় সে সন্তুষ্ট থাকে; আর না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। সে মুখ থুবড়ে পড়ুক অথবা মাথা থুবড়ে পড়ুক। সে কাটা বিদ্ধ হলে কেউ তা তুলতে না পারুক।”
“আল্লাহ্র দাসত্ব” ভালোবাসা, ভয়, আশা ইত্যাদিকে শামিল করে। সুতরাং বান্দা তার রবকে ভালোবাসবে, তাঁর শাস্তিকে ভয় করবে, তাঁর সওয়াব ও করুণার প্রত্যাশায় থাকবে। এই তিনটি আল্লাহর দাসত্বের মৌলিক উপাদান। (শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ)
*সহীহ হাদীস ও বিশ্বনবী (সা.) এর সীরাত পাঠের একজন ণ্যূনতম পাঠকও জানেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর লিখিত দাওয়াতের মধ্যে শুধু এতটুকুই থাকতো- “মুসলমান হয়ে যাও, নিরাপদে থাকবে।” আর মৌখিক দাওয়াতের শব্দটিও এমন হতো “তোমরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়, বিজয়ী হয়ে যাবে।” (বুখারী
ইত্তেবায়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
ইত্তেবার অর্থ:
আভিধানিক অর্থে ইত্তেবা অর্থ হল; কারো পদচিহ্ন দেখে দেখে চলা। এ শব্দটি অনুসরণ, অনুকরণ, মান্যকরণ, আদর্শ জ্ঞান করণ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
শরিয়তের পরিভাষায় ইত্তেবা:
দ্বীনের সকল বিষয় তথা ‘আক্বিদা-বিশ্বাস, কথা, কাজ, গ্রহণ- বর্জন সহ সর্বক্ষেত্রে রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণ করাকে ইত্তেবা বলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজটি যেভাবে করেছেন সেটি ঠিক সেভাবে করাই হল রাসূলের ইত্তেবা বা অনুসরণ। রাসূলের ইত্তেবা ছাড়া কোন ইবাদত শুদ্ধ হয় না।
কেবল হাদিস বা সূন্নাহের অধ্যয়নের মাধ্যমে রাসূলের ইত্তেবা সম্পর্কে জানা যাবে।
“আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এ গুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর”। সূরা আনআম, আয়াত: ১৫৩
ইমাম কুরতবী রহ. বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত যাতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূলের ইত্তেবা করার আদেশ দিয়েছেন এবং তার পথের ইত্তেবা ছাড়া অন্য সব পথ পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর আয়াতে সীরাতে মুস্তাকীম-এর অর্থ হল, আল্লাহর পথ যে পথের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে আহ্বান করেছেন। আর তা হল রাসূলের ইত্তেবা ও তার সুন্নাতের অনুসরণ।তাফসীরে কুরতবী, ১৩৭/৭
“অতএব যারা তার নির্দেশের বিরোধিতা করে, তারা যেন তাদের উপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক্আযাব পৌঁছার ভয় করে”। [সুরা নূর – ৬৩]
আল্লামা ইবনুল আরাবী রহ. যুবাইর ইবনে বুকার হতে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মালেক ইবনে আনাস রা. এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ আমি কোথা থেকে ইহরাম বাঁধব? তিনি বললেন, জুল হুলাইফা হতে- যেখান থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম বেঁধেছেন। তখন লোকটি বলল, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মসজিদ থেকে এহরাম বাঁধতে চাই। তিনি বললেন, না, তুমি তা করো না। লোকটি বলল, আমি মসজিদের পাশে রাসূলের কবরের নিকট থেকে এহরাম বাঁধব। তিনি বললেন, না তুমি তা করো না, আমি ভয় করছি তুমি কোন ফিতনায় আক্রান্ত হবে। লোকটি বলল, কিসের ফিতনা। তখন তিনি বললেন, এর চেয়ে বড় ফিতনা আর কি হতে পারে যে, তুমি মনে করছ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অধিক ফযিলত লাভ করবে, যা তিনি লাভ করতে পারেননি।
ইত্তেবায়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গুরুত্ব:
নবী আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইত্তেবা তথা অনুসরণ ইসলামের অন্যতম মূল ভিত্তি।
“রাসূল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক”। সূরা হাশর, আয়াত: ৩
“যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে প্রকারান্তরে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হল, আমি আপনাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রেরণ করিনি”। সূরা নিসা, আয়াত: ৮০
“তিনটি জিনিষ যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের সাধ গ্রহণ করবে।
এক- আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তার নিকট দুনিয়ার সব কিছু হতে প্রিয় হওয়া।
দুই- কোন মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।
তিন- ঈমান আনার পর কুফরিতে ফিরে যাওয়াতে এমন অপছন্দ করবে, যেমন আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে”। বুখারি: ১৬
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতটি যেভাবে করেছেন সেভাবে আদায় করতে হবে এবং তার মধ্যে কোন প্রকার বিকৃতি বা কমবেশ করা চলবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি প্রসিদ্ধ হাদিসে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেন। হাদিস দ্বয়ে তিনি ইবাদত যেভাবে করেছেন সেভাবে করার নির্দেশ দেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
এটি পূর্ণ হাদিসের একটি অংশ মাত্র। পুরো হাদিসটি ইমাম বুখারি রহ. স্বীয় কিতাব সহীহ আল বুখারিতে আবু কালাবাহ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, মালেক বিন হুয়াইরাস রা. হাদিস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
“আমরা একে অপরের কাছাকাছি ও সম পর্যায়ের কতক লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে বিশ দিন অবস্থান করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও মেহেরবান। তারপর যখন তিনি অনুভব করলেন আমরা আমাদের পরিবারের নিকট যেতে চাই তখন তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা আমাদের বাড়ীতে কাদের রেখে আসছি? আমরা তাদের বিষয়গুলো বললে, তিনি আমাদের বলেন, তোমরা তোমাদের বাড়িতে ফিরে যাও, তাদের মধ্যে তোমরা অবস্থান কর, তাদের তোমরা দীন শেখাও, ভালো কাজের আদেশ দাও। বর্ণনাকারী বলেন, এ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় আদেশ করেন তার সবগুলো আমার স্মরণ নাই। আর তোমরা সালাত আদায় কর, যেভাবে তুমি আমাকে সালাত আদায় করতে দেখছ। যখন সালাতের সময় হয়, তোমাদের মধ্য হতে একজন আযান দেবে, আর তোমাদের মধ্যে বয়স্ক ব্যক্তি ইমামতি করবে”। ] বুখারি, হাদিস: ২৫২
বিশুদ্ধ হাদিসটি উপরে উল্লেখিত মূলনীতি-ইবাদতের ক্ষেত্রে আসল হল রাসূলের ইত্তেবা- কে আরও স্পষ্ট করেন। অর্থাৎ, সালাত আদায়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পুরোপুরি ইত্তেবা করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সালাত আদায় করেছেন, সেভাবে সালাত আদায় করতে হবে। তার মধ্যে কোন প্রকার কমবেশ করা যাবে না।
দ্বিতীয় হাদিস: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী-তিনি বলেন, (خذوا عني مناسككم) “তোমরা আমার থেকে হজের আহকামগুলো শিখে নাও”। মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনু মাযা।
ছয়টি বিষয়ে ইত্তেবা জরুরি:
আমলের ক্ষেত্রে ইত্তেবা সহীহ হওয়া ও আমলটি শরীয়ত অনুযায়ী হওয়ার জন্য ছয়টি বিষয়ে এক ও অভিন্ন হতে হবে।
এক- ইবাদতের কারণটি শরিয়ত অনুযায়ী ও অনুমোদিত হতে হবে।
সুতরাং, যদি কোন মানুষ এমন একটি কারণ দেখিয়ে ইবাদত করে যে কারণটি শরিয়ত অনুমোদন করেনি তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যাত হবে। যেমন কিছু মানুষ রজব মাসের সাতাশ তারিখ রাতে সালাত আদায় ও ইবাদত বন্দেগী করে থাকে। তাদের যুক্তি হল, এ রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এ রাতেই ফরয করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে অনেক বিদআত থেকে বাঁচা যাবে। কারণ, আমরা এ ধরনের অনেক ইবাদতকে শরীয়ত মনে করি। কিন্তু বাস্তবে তা শরিয়ত নয় বরং বিদআত।
দুই: ইবাদতের ধরনটি শরিয়ত অনুমোদিত হতে হবে।
যদি কোন ব্যক্তি কোন একটি ইবাদত আল্লাহর জন্য করে থাকে কিন্তু তার ধরনটি শরিয়ত অনুমোদন করেনি। তাহলে সে ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমন, এক ব্যক্তি ঘোড়া কুরবানি করল, এ লোকের কুরবানি সহীহ হবে না। কারণ, লোকটি কুরবানির পশুর ধরনের মধ্যে শরিয়তের বিরোধিতা করছে। কারণ, শরিয়ত কুরবানি করার জন্য চতুষ্পদ জন্তু হতে কেবল গরু, ছাগল উটকেই নির্ধারিত করেছেন।
তিন- পরিমাণ:
পরিমাণ শরিয়ত অনুমোদিত হবে।
যদি কোন মানুষ পরিমাণ বাড়ায় বা কমায় তাহলে তার ইবাদত শুদ্ধ হবে না। যেমন, যদি কোন মানুষ জোহরের সালাত চার রাকাতের জায়গায় পাঁচ রাকাত আদায় করে, তাহলে তার সালাত শুদ্ধ হবে না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের সালাত কখনো পাঁচ রাকাত আদায় করেননি।
চার- পদ্ধতি:
পদ্ধতি শরিয়ত অনুমোদিত হতে হবে। যেমন, যদি কোন ব্যক্তি ওজু করার সময় হাত ধোয়ার পূর্বে পা ধুয়ে ফেলে তাহলে সেও সূন্নাতের বিরোধিতা করল। তার ওজু ঠিক হবে না। কারণ, লোকটি ওজু করার পদ্ধতিতে ভুল করেছেন এবং শরিয়তের বিরোধিতা করেছে।
পাঁচ- সময়:
সময়টি শরিয়ত অনুযায়ী হতে হবে।
যদি কোন ইবাদত শরিয়ত নির্ধারিত সময়ে না করে নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে করে তাহলে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না এবং ইবাদত সঠিক হবে না। যেমন, কোন ব্যক্তি জিল হজ মাসের প্রথমে কুরবানি করে ফেলল বা ঈদের সালাতের পূর্বে কুরবানি করল, তাহলে তার কুরবানি সহীহ হবে না।
ছয়-স্থান:
ইবাদতের স্থানটি শরিয়ত অনুমোদিত হবে।
যদি স্থানটি শরিয়ত সম্মত না হয়, তবে ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে না। যেমন- শরিয়ত অনুযায়ী ইতিকাফ করার স্থান হল, মসজিদ। যদি কোন ব্যক্তি মসজিদের বাইরে ইতেকাফ করে তার ইতেকাফ করা শুদ্ধ হবে না।
“তোমরা ইতেকাফ কারী, তাওয়াফকারী ও রুকু- সেজদাকারীদের জন্য আল্লাহর ঘরকে পবিত্র কর”। [সূরা বাকারা, আয়াত: ১২৫]
শুধুমাত্র মানুষের বিবেকের মানদন্ডে ভাল কাজ হ’লেই তা ভাল কাজ হিসাবে গণ্য হবে না। বরং কোন কাজ ভাল কাজ হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে।
১. কাজটি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীছ অনুযায়ী হওয়া
২. কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা রাসূল (সা) ও ছাহাবায়ে কেরামের বুঝ অনুযায়ী হওয়া
৩. বিদ‘আত মুক্ত হওয়া।
আর কুরআন ও সহীহ হাদীছ পরিপন্থী কোন আমল ইসলামী শরী‘আতের মানদন্ডে ভাল কাজ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالاً، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِيْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا-
‘আপনি বলে দিন, আমরা কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দেব? দুনিয়ার জীবনে যাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ভাবে যে, তারা সুন্দর আমল করে যাচ্ছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা একজন ভাল আমলকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারী বলে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা তা মানুষের দৃষ্টিতে ভাল আমল হিসাবে বিবেচিত হ’লেও ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে ভাল আমল নয়।
যেমনঃ আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিন জনের একটি দল রাসূল (সা)-এর স্ত্রীদের বাড়ীতে আসল। তারা (রাসূল (সা)-এর) ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। (রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীরা) যখন তাদেরকে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে সংবাদ দিলেন তখন তারা এটিকে কম মনে করল। অতঃপর বলল, রাসূল (সা) কোথায় আর আমরা কোথায়। তাঁর পূর্বের ও পরের সকল পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনজনের একজন বলল, আমি প্রত্যহ সারা রাত জেগে সালাত আদায় করব। অপর ব্যক্তি বলল, আমি প্রতিদিন সিয়াম পালন করব, কখনো ছিয়াম ত্যাগ করব না। অপর ব্যক্তি বলল, আমি কোন নারীর নিকটবর্তী হব না এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব না। অতঃপর রাসূল (সা) তাদের নিকট আসলেন এবং বললেন, তোমরাই কি তারা, যারা এরূপ এরূপ মন্তব্য করেছ? সাবধান! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের চাইতে আল্লাহকে বেশী ভয় করি এবং আমি সবচেয়ে বেশী পরহেযগার। কিন্তু আমি রাত্রের কিছু অংশে (নফল) সালাত আদায় করি এবং কিছু অংশ ঘুমাই। কোন কোন দিন (নফল) সিয়াম পালন করি এবং কোন কোন দিন সিয়াম ত্যাগ করি। আর আমি বিবাহ করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হ’তে বিমুখ হবে (সুন্নাত পরিপন্থী আমল করবে) সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।
বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫, ‘কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
সাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,অচিরেই অমুসলিম সম্প্রদায়গুলো পরস্পর পরস্পরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানাবে যেভাবে খাবারের বরতনের দিকে আহারকারীদেরকে আহবান করা হয়। তখন কেউ বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেদিন কি আমরা সংখ্যায় কম হবো’? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না, তোমরা তখন সংখ্যায় বেশিই হবে। কিন্তু সেদিন তোমরা হবে বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া খরকুটোর মতো। তোমাদের শত্র“দের অন্তর থেকে তোমাদের ভয় উঠিয়ে নেয়া হবে এবং তোমাদের অন্তরে ঢেলে দেয়া হবে ‘ওয়াহান’। একজন জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওয়াহান কী জিনিস? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, ‘ওয়াহান হলো, দুনিয়াকে মহব্বত করা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা’ (আহমদ, আবু দাউদ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
( وَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَىْ اخْتِلَافاً كَثِيْراً فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ )
‘আর তোমাদের কেউ বেঁচে থাকলে সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হবে আমার সুন্নত এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত অনুসরণ করা। তোমরা এ সুন্নতকে খুব মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে থাকো এবং সমস্ত বিদআত থেকে বিরত থাকো। কেননা প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা’ (আবু দাউদ, তিরমিযী)
কেমন ছিলো সাহাবাদের আনুগত্যের নমুনাঃ
*বিশ্বনবী (সা.) এর হুবহু আনুগত্যের প্রয়োজনে হযরত উমার (রা.) সমস্ত কর্মকান্ডের ফাঁকে পালাক্রমে মহানবী (সা.) এর দরবারে হাজির হয়ে দ্বীনের বিভিন্ন বিধান আয়ত্ব করে সে অনুযায়ী আমল করতেন।
روى البخاري ومسلم عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه وأرضاه قال: كنت أنا وجار لي من الأنصار في بني أمية بن زيد- هذا الجار هو عتبان بن مالك- وكنا نتناوب النزول على رسول الله صلى الله عليه وسلم، ينزل يوما، وأنزل يوما، فإذا نزلت جئت بخبر ذلك اليوم من الوحي، وإذا نزل فعل مثل ذلك.
“হযরত উমার (রা.) বলেন, আমি এবং আমার এক আনসারী বন্ধু- ইতবান ইবন মালেক (রা.)- পরস্পর পালাক্রমে বিশ্বনবীজির (সা.) দরবারে দ্বীন শিক্ষতে উপস্থিত হতাম। আমি একদিন যেতাম, তিনি অন্য একদিন যেতেন, আমি যেদিন উপস্থিত হতাম সেদিনকার অহী ও দ্বীনের বিধান আয়ত্ব করে প্রতিবেশীকে জানাতাম। আর তিনিও যেদিন হাজির হতেন সেদিনের অহীর বিধানাবলী আয়ত্ব করে আমাকে জানাতেন।” (বুখারী ও মুসলিম ঃ ১/২৮)
*মহানবী (সা.) এর আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে আসহাবে রাসূল (সা.) সীমাহীন ভদ্রতা, নম্রতা ও সর্তকতা অবলম্বন করতেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের সম্মুখে অশেষ আদব ভক্তি ও আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। একটি হাদীসে বর্ণিত আছে- হযরত উসামা ইবনে শরীফ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন নবী করীম (সা.)এর দরবারে উপস্থিত হলাম। হুজুরের চতুর্দিকে সাহাবায়ে কেরাম পরিবেষ্টন করে আছেন। মনে হচ্ছিলো, যেনো তাঁদের মাথায় পাখি বসা রয়েছে। (অর্থাৎ কোনো নড়াচড়া নেই)। (আবু দাউদ ঃ ২/১২৮)
#প্রিয় নবীজির (সা.) কোনো আমল বা কাজ দেখার সাথে সাথেই সাহাবীগণ হুবহু তা করা আরম্ভ করতেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলকে সাওমে বেসাল (লাগাতার রোজা) রাখতে দেখে রোজা রাখতে আরম্ভ করলেন। তখন রাসূল সাওমে বেসাল রাখতে নিষেধ করলে একজন সাহাবা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো সাওমে বেসাল রাখছেন। তখন তিনি এরশাদ করলেন-তোমরা কী আমার মতো? আমাকে তো আমার মহান রব খাওয়ান ও পান করান। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত-১৭৫ পৃষ্ঠা)
*হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) সহ কতিপয় সাহাবী রাসূল (সা.) এর খুটিনাটি সকল আমলকেই অনুসরণ করতেন মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায়।
وَعَنْ مُجَاهِدٍ قَالَ :كُنَّامَعَ ابْنِ عُمَرَ رَحِمَهُ اللَّهُ فِيْ سَفَرٍ فَمَرَّ بِمَكَانٍ فَحَادَ عَنْهُ، فَسُئِلَ لِمَ فَعَلْتَ ذلِكَ؟ قَالَ : رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَ هَذَا فَفَعَلْتُ ‘মুজাহিদ রহ. বলেন, ‘আমরা একদা এক সফরে ইবনে উমর (রা.) এর সঙ্গে ছিলাম। চলতে চলতে একস্থানে গিয়ে তিনি রাস্তা ছেড়ে অন্য দিকে গেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কেন আপনি এমনটি করলেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি রাসূল (সা.)কে এভাবে করতে দেখেছি”। (সুনান সহীহ)
হযরত উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, স্বর্ণ হারাম হওয়ার পূর্বে মহানবী (সা.) স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করছিলেন, তা দেখে সাহাবায়ে কেরাম স্বর্ণের আংটি ব্যবহার শুরু করলেন। যখন স্বর্ণ হারাম হলো তখন তিনি তা ছুড়ে ফেললেন সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরামও স্বর্ণের আংটি ব্যবহার বন্ধ করে দিলেন। (বুখারী ঃ ২/২৫৬)
লেখকঃ জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের | সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী লেখা থেকে অধিকাংশ সংগৃহিত অংশবিশেষ