আয়াতুস সাকীনা কি?

আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

সাকীনা سَكِيْنَةٌ আরবী ভাষায় স্থিরতা, প্রশান্তি ও দৃঢ় চিত্ততাকে বুঝায় ৷

যেকোন নাজুক মুহূর্তে রসূলের সা  নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শন সম্পর্কে, ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে এবং নিজেদের আদর্শিক কর্ম-তৎপরতার ন্যায় ও সত্য হওয়া সম্পর্কে মুসলমানদের মনে যে পূর্ণ আস্থা ও প্রশান্তি ছিল তা সরাসরি আল্লাহর মেহেরবানী ৷ এ কারণে তারা ধীর স্থীর মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে যাই ঘটুক না কেন তা সবই শিরধার্য ৷ এ কারণে সাহাবা রা. ভয়-ভীতি , অস্থিরতা, উস্কানী এবং নৈরাশ্য সবকিছু থেকে মুক্ত ছিলেন ৷ এর কল্যাণেই তাঁদের  পূর্ণ শৃংখলা ও সংযম বজায় ছিল ৷ এটাই সেই প্রশান্তি যা আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের মনে নাযিল করেছিলেন ৷

সাকীনা পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো মহান রবের উপরপূর্ণ ঈমান,আস্থা,নির্ভরশীলতা রাখা।

সাহাবা আযমাইন রা.দের জীবনে যত পরীক্ষা এসেছে তার প্রত্যেকটিতে নিষ্ঠা , তাকওয়া ও আনুগত্যের নীতির ওপর দৃঢ়পদ থেকেছেন ৷  ঈমান কোন স্থির, জড় ও অপরিবর্তনীয় অবস্থার নাম নয় ৷ বরং ঈমানের  হ্রাস বৃদ্ধি ও ওঠানামা আছে। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মুমিনদের জীবনের পদে পদে এমন সব পরীক্ষা আসে, যখন তাকে এ সিদ্ধান্তকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যে, আল্লাহর দীনের জন্য সে  জাল -মাল আবেগ-অনুভূতি, আশা -আকাংখা, সময়, আরাম আয়েশ এবং স্বার্থ কুরবানী করতে প্রস্তুত আছে কিনা! যদি মুমিন প্রস্তুত থাকে তখনই সাকীনা নাযিল হয় ও সাথে সাথে ঈমানও বেড়ে যায়।

আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায়   এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে৷ সূরা আনফালঃ২

যারা সত্য-সঠিক পথ অবলস্বন করে আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে উন্নতি দান করেন এবং স্থায়িত্বলাভকারী সৎজাগুলোই তোমার রবের প্রতিদান ও পরিণামের দিক দিয়ে ভালো৷  সূরা মরিয়মঃ৭৬

যখন কোন নতুন সূরা নাযিল হয় তখন তাদের কেউ কেউ (ঠাট্রা করে মুসলমানদের ) জিজ্ঞেস করে, বলো, এর ফলে তোমাদের কার ঈমান বেড়ে গেছে? (এর জবাব হচ্ছে) যারা ঈমান এনেছে (প্রত্যেকটি অবতীর্ণ সুরা) যথার্থই ঈমান বাড়িয়েই দিয়েছে এবং তারা এর ফলে আনন্দিত৷ তবে যাদের অন্তরে (মুনাফিকী) রোগ বাসা বেঁধেছিল তাদের পূর্ব কলুষতার ওপর (প্রত্যেকটি নতুন সূরা) আরো একটি কলুষতা বাড়িয়ে দিয়েছে   এবং তারা মৃত্যু পর্যন্ত কুফরীতে লিপ্ত রয়েছে৷  সূরা তাওবাঃ১২৪-১২৬

কুর’আনের চিকিৎসা অনেক উন্নত। মহান আল্লাহর বানীতে উচ্চতম সম্মোহনী সাইকোথেরাপী পাওয়া যায়, যদি কোন অস্থির ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে তা পাঠ করে। যুগে যুগে সাহাবা রা. থেকে শুরু করে তাবে-তাবেয়ীন ও আলেম ব্যক্তিদের জীবনের অনেক ঘটনাই আমাদের তা শিখিয়ে দিয়ে যায়। আমরা অনেকেই সমাজের বাকপটু ব্যক্তিদের কথায় মুগ্ধ হয়ে তাকে অনুসরন করতে উদ্যত হয়ে যাই  অথচ যা সত্য সুন্দরের শান্তির দিকে নিয়ে যায় সেই দিক পানে কতজন যাই? 

ইবনুল কাইয়্যিমের বর্ননা-

চারিদিকের পরিস্থিতি যখন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যেতো তখন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ “আয়াতুস সাকীনাহ” তিলাওয়াত করতেন। আমি তার কাছ থেকে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনেছি। তিনি সেইবার বেশ অসুস্থ ছিলেন। এই নাজুক মুহুর্তেও তার শত্রূরুপ কিছু নাপাক আত্মারা তার ক্ষতি করতে পিছু হটেনি। সেই মুহুর্তের বর্ণনা সাধারন মানুষের জন্যে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিলোনা। তিনি(শাইখুল ইসলাম) বলেন, আমি যখন এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করলাম, তখন আশেপাশের লোকদের “আয়াতুস সাকীনাহ” গুলো তিলাওয়াত করতে বললাম। ফলশ্রুতিতে আমি আমার জটিলতা থেকে মুক্তি পেলাম। আমার অনুভূতি এমন হয়ে গেলো যে, আমার জীবনে যেন কোনো সমস্যাই নেই। এক অদ্ভত পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করলাম। আমি নিজেও তা আমলের চেষ্টা করেছি। অন্তর যখন সংকুচিত হয়ে আসে তখন এই “আয়াতুস সাকীনাহ” গুলো পড়তে থাকি। আর আয়াতগুলো ও তার জাদুকরী প্রভাব ফেলে। ফলে আমি অন্তরে প্রশান্তির ছোঁয়া পেতাম।

[কথাগুলো ইবনুল কাইয়্যিমের (মাদারিজুস সালিকীন, ২/৫০২) থেকে নেওয়া। এক ইংলিশ আর্টিকেল থেকে অনূদিত।]

সেই আয়াতগুলোতে কি আছে দেখা যাক—–

﴿وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَن يَأْتِيَكُمُ التَّابُوتُ فِيهِ سَكِينَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِّمَّا تَرَكَ آلُ مُوسَىٰ وَآلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلَائِكَةُ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾

এই সংগে তাদের নবী তাদের একথাও জানিয়ে দিলঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বাদশাহ নিযুক্ত করার আলামত হচ্ছে এই যে, তার আমলে সেই সিন্ধুকটি তোমরা ফিরিয়ে পাবে, যার মধ্যে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির সামগ্রী, যার মধ্যে রয়েছে মূসার পরিবারের ও হারুনের পরিবারের পরিত্যক্ত বরকতপূর্ণ জিনিসপত্র এবং যাকে এখন ফেরেশতারা বহন করে ফিরছে ৷  যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো তাহলে এটি তোমাদের জন্য অনেক বড় নিশানী ৷ সূরা বাকারাঃ ২৪৮

﴿ثُمَّ أَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنزَلَ جُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا وَعَذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ وَذَٰلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ﴾

তারপর আল্লাহ তার প্রশান্তি নাযিল করেন তাঁর রসূলের ওপর ও মুমিনদের ওপর এবং সেনাদল নামান যাদেরকে তোমরা চোখে দেখতে পাচ্ছিলে না৷ এবং সত্য অস্বীকারকারীদের শাস্তি দেন৷ কারণ যারা সত্য অস্বীকার করে এটাই তাদের প্রতিফল৷ সূরা তাওবাঃ২৬

﴿إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا ۖ فَأَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَىٰ ۗ وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾

তোমরা যদি নবীকে সাহায্য না কর, তাহলে কোন পরোয়া নেই৷ আল্লাহ তাকে এমন সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফেররা তাকে বের করে দিয়েছিল, যখন সে ছিল মাত্র দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় জন, যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন৷ সে সময় আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তার ওপর মানসিক প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন সেনাদল পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করেন, যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বক্তব্যকে নীচু করে দেন৷ আর আল্লাহর কথা তো সমুন্নত আছেই৷আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়৷  সূরা তাওবাঃ ৪০

﴿هُوَ الَّذِي أَنزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَّعَ إِيمَانِهِمْ ۗ وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا﴾

তিনিই তো সে সত্তা যিনি মুমিনদের মনে প্রশান্তি নাযিল করেছেন  যাতে তারা নিজেদের ঈমান আরো বাড়িয়ে নেয়৷ আসমান ও যমীনের সমস্ত বাহিনী আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন৷ তিনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী৷ সূরা ফাতহঃ ৪

﴿لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا﴾

আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নিচে তোমরা কাছে বাইয়াত করছিলো৷ তিনি তাদের মনের অবস্থা জানতেন৷ তাই তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করেছেন,  পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে আশু বিজয় দান করেছেন৷ সূরা ফাতহঃ ১৮

﴿إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوَىٰ وَكَانُوا أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا ۚ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا﴾

এ কারণেই যখন ঐ সব কাফেররা তাদের মনে জাহেলী সংকীর্ণতার স্থান দিল তখন আল্লাহ তাঁর রসূল ও ঈমানদারদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন  এবং তাদেরকে তাকওয়ার নীতির ওপর সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখলেন৷ তারাই এ জন্য বেশী উপযুক্ত ও হকদার ছিল৷ আল্লাহ সব জিনিস সম্পর্কেই পরিজ্ঞাত৷ সূরা ফাতহঃ ২৬

 

https://archive.org/details/AyatSakinaalGhamdi