বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
কুর’আন মাজীদঃ ৬ষ্ঠ পারা
মোট রুকুঃ ১৫রুকু
সূরা সমূহঃ আন নিসাঃ (২২-২৪) রুকু,মায়িদাঃ (১-১১) রুকু
power point presentation——–
৬ষ্ঠ পারা, নিসা(২২-২৪) মায়িদা(১-১১) রুকু
আন নিসাঃ ২২তম রুকু (১৫৩-১৬২) আয়াত
১। কিতাবীগণ রাসূল সা এর কাছে আকাশ থেকে কিতাব আনার দাবী করে, আল্লাহ জানাচ্ছেন যে কিতাবীরা পূর্বেও মূসা আ এর কাছে আরো বড় দাবী করেছিলো, আল্লাহকে দেখার জন্য। তাদের সীমালংঘনের কারণে তাদেরকে বজ্র পাকড়াও করেছিলেন আল্লাহ। তাদের এ দাবী নিছক শত্রুতা, হঠকারিতা ও হঠধর্মিতার উপর ভিত্তি করে ছিল। স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও তারা বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল;এরপরও আল্লাহ তা ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং মূসাকে আ স্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করেছেন।
২। সুস্পষ্ট ফরমান’ বলতে হযরত মূসা আ কে কাঠের তখতির ওপর লেখা বিধানকে বুঝানো হয়েছে৷ আর ‘প্রতিশ্রুতি’ বলতে সেই জোরদার শপথ যা তূর পাহাড়ের পাদদেশে বনী ইসরাঈলদের প্রতিনিধিদের থেকে নেয়া হয়েছিল।(আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের মাথার উপরে তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদের যে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তা মযবুতভাবে ধারণ কর এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা স্মরণে রাখ, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/৬৩)
রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, বনী ইসরাঈলকে বলা হয়েছিল যে, তোমরা (প্রস্তাবিত শহরে) সিজদারত অবস্থায় প্রবেশ কর এবং বল, (হে আল্লাহ!) আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। তারা তা পরিবর্তন (সিজদারত অবস্থায় প্রবেশ না করে) নিতম্বের উপর ভর করে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন এর পরিবর্তে যবের দানা চাই বলতে বলতে প্রবেশ করল। [বুখারীঃ ৩৪০৩]
শনিবারে সীমালংঘন করো না; এবং আমরা তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম।
৩। আল্লাহ তাদের ইহুদীদের অভিশপ্ত করেছেন বা শাস্তি দিয়েছেন কারন- অঙ্গীকার ভঙ্গ, আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার ও অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করার জন্য। আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত’ তাদের এই উক্তির কারনেও।
যখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে পয়গাম্বরা এসে তাদের বুঝাবার চেষ্টা করেছেন তখনই তারা তাদের এই একই জবাব দিয়েছেন: তোমরা যে কোন যুক্তি-প্রমাণ, যে কোন নিদর্শন আনো না কেন আমরা তোমাদের কোন কথায় প্রভাবিত হবো না৷ এ পর্যন্ত আমরা যা কিছু মেনে এসেছি ও যা কিছু করে এসেছি এখনো তাই মানবো ও তাই করে যেতে থাকবো৷মহান আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন।
তারা মারইয়ামকে ব্যভিচারের অপবাদ দিতে ক্রটি করে নি। আল্লাহ বলেন, “তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল; তারা বলল, ‘হে মারইয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত জিনিস নিয়ে এসেছ’। [সূরা মারইয়াম: ২৭] এখানে অঘটন বলতে তারা ব্যভিচারের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছিল।
আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াহুদীরা ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করতে বা শূলে চড়াতে (ক্রুসবিদ্ধ করতে) কোনটিতেই সফল হয়নি যেমনটি তাঁদের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও অভিপ্রায় ছিল।
ঈসা (আঃ) ইয়াহুদীদের হত্যা করার চক্রান্তের কথা জানতে পারলেন, তখন তাঁর ভক্ত ও সহচরবৃন্দ যাদের সংখ্যা ১২ অথবা ১৭ ছিল, বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আমার স্থানে নিহত হুতে প্রস্তুত আছ? যাকে আল্লাহ তা’আলা আমার মত আকার-আকৃতি দান করবেন। তাঁদের মধ্যে একজন যুবক প্রস্তুত হয়ে গেলেন। সুতরাং ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর নির্দেশে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হল। ইয়াহুদীরা এসে ঐ যুবককে নিয়ে গেল এবং ক্রুসবিদ্ধ করল, যাঁকে মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-এর মত আকৃতি দান করেছিলেন। আর ইয়াহুদীদের ধারণা হল যে, তারা ঈসাকেই ক্রুসবিদ্ধ করতে কৃতকার্য ও সক্ষম হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর, ইবনে কাসীর) তাদের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়; একদল বলে, ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে। অন্য একদল বলে, ক্রুসবিদ্ধ ব্যক্তি ঈসা নয়; বরং অন্য কোন ব্যক্তি।
বরং আল্লাহ তাকে তার নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। এটা বুখারী মুসলিম হাদীসের আলোকেও জানা যায়।
৪। আয়াতের দুটি ব্যখ্যা এসেছে- ক) প্রত্যেক খ্রিষ্টানই নিজ অন্তিম মুহূর্তে ঈসা (আঃ)-এর নবুঅতের সত্যতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। কিন্তু সেই মুহূর্তের ঈমান তাদের আদৌ কোন উপকারে আসবে না।খ) দ্বিতীয় ব্যাখ্যা যা সালাফ ও বহু মুফাসসির কর্তৃক সমর্থিত যখন তিনি দ্বিতীয়বার দুনিয়াতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করার পর, ইসলামের প্রচার ও প্রসার কাজে মগ্ন হবেন এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে, তাদেরকে নিধন ও নিশ্চিহ্ন করবেন, সর্বত্র ইসলামের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হবে। অবশিষ্ট আহলে কিতাবরা ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর প্রতি যথাযথ ঈমান আনবে।
আবু হুরায়রা রা বলেন, রাসূল সা বলেছেনঃ ঈসা ইবন মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে অবশ্যই অবতরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে কতল করবেন, শুকর নিধন করবেন এবং ক্রুশকে চুরমার করবেন। তখন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করা হবে। আবু হুরায়রা রা আরো বলেন – তোমরা ইচ্ছা করলে এখানে কুরআনুল কারীমের এ আয়াত পাঠ করতে পার যাতে বলা হয়েছেঃ “আহলে কিতাবদের মধ্যে কেউ অবশিষ্ট থাকবে না, বরং ওরা তার মৃত্যুর পূর্বে অবশ্যই তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। [বুখারীঃ ৩৪৪৮] আবু হুরায়রা রা বলেনঃ এর অর্থ ঈসা আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুর পূর্বে। এ বাক্যটি তিনি তিনবার উচ্চারণ করেন। অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেনঃ তখন তোমাদের কেমন লাগবে? যখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম তোমাদের মাঝে আগমন করবেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে ইমাম হবেন। [বুখারীঃ ৩৪৪৯]
আখেরাতে ঈসা আ সাক্ষ্য দিবেন তাঁর প্রথম জীবন সম্পর্কিত হবে, যেমন আল্লাহ্ সূরা মায়েদায় উল্লেখ করেছেন, {وَكُنتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَّا دُمْتُ فِيهِمْ} অর্থাৎ, যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের ক্রিয়াকলাপের সাক্ষী।
৫।ইসলামী শরীআতে কোন কোন দ্রব্য পানাহার করা হারাম ঘোষিত হয়েছে,তা শারিরিক বা আধ্যাত্মিক ক্ষতিকর হওয়ার কারণে।
ইহুদীদের অপরাধ ও অপকর্মের কারণে শাস্তি স্বরূপ বহু বৈধ জিনিসকে অবৈধ করে দিয়েছিলেন। আর তা হলো- সূদ গ্রহণের কারণে,(তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল) এবং অন্যায়ভাবে মানুষের ধন-সম্পদ গ্রাস করার কারণে।
৬। ইহুদীদের মধ্যে যারা জ্ঞানে মজবুত তারা ও মুমিনগণ কুর’আন ও পূর্ববর্তী কিতাবেও ঈমান আনে। আর সালাত প্রতিষ্ঠাকারী, যাকাত প্রদানকারী এবং আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনয়নকারী, তাদেরকে অচিরেই আল্লাহ মহা পুরস্কার দিবেন
আন নিসাঃ ২৩তম রুকু (১৬৩-১৭১) আয়াত
১। আয়াতে বলা হয়েছে যে, পূর্ববতী নবীগণের প্রতি যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিল হয়েছিল, মুহাম্মাদ সা এর প্রতিও তেমনি আল্লাহ্ তা’আলা ওহী নাযিল করেছেন। অতএব, পূর্ববর্তী নবীগণকে যারা মান্য করে, তারা মুহাম্মাদ সা-কেও মান্য করতে বাধ্য।
এখানে পূর্ববর্তী নবীদের পরিচয় তুলে ধরেছেন-ওহী প্রেরণ শেষ নবী সা, নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের,আর ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণ, ঈসা, আইউব, ইউনুস, হারূন ও সুলাইমানের নিকট করা হয়েছিলো এবং দাউদকে প্রদান করেছিলাম যাবূর।
২। আল্লাহ কিছু নবী ও রাসূলদের পরিচয় জানিয়েছেন আবার অনেকের বিষয়ে জানান নি।
যে সকল নবী ও রসূলগণের নাম ও তাঁদের ঘটনাবলী কুরআন কারীমে বর্ণিত হয়েছে ,তাঁদের সংখ্যা ২৪ অথবা ২৫ যথাঃ (১) আদম (আঃ) (২) ইদরীস (আঃ) (৩) নূহ (আঃ) (৪) হূদ (আঃ) (৫) সালেহ (আঃ) (৬) ইবরাহীম (আঃ) (৭) লূত (আঃ) (৮) ইসমাঈল (আঃ) (৯) ইসহাক (আঃ) (১০) ইয়াক্বূব (আঃ) (১১) ইউসুফ (আঃ) (১২) আইউব (আঃ) (১৩) শুআইব (আঃ) (১৪) মূসা (আঃ) (১৫) হারূন (আঃ) (১৬) ইউনুস (আঃ) (১৭) দাউদ (আঃ) (১৮) সুলাইমান (আঃ) (১৯) ইলয়্যাস (আঃ) (২০) আল-য়্যাসা’ (আঃ) (২১) যাকারিয়া (আঃ) (২২) ইয়াহইয়া (আঃ) (২৩) ঈসা (আঃ) (২৪) যুল কিফল (আঃ) (অধিকাংশ মুফাসসিরগণের নিকটে) (২৫) মুহাম্মাদ (সাঃ)।
আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা এক লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, যাদের মধ্যে স্বতন্ত্র শরীআতের অধিকারী রাসূলের সংখ্যা ছিল তিনশ’ তের জন। [সহীহ ইবন হিব্বানঃ ৩৬১]
পথভ্রষ্ট লোকেরা যাতে এহেন অজুহাত পেশ করতে বা বাহানার আশ্রয় নিতে না পারে, তজ্জন্য আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট নিদর্শনসহ নবীগণকে প্রেরণ করেছেন এবং তারা সর্বস্ব উৎসর্গ করে সত্য পথ প্রদর্শন করেছেন।
যদি আমি ওদেরকে তার পূর্বে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম তাহলে ওরা বলত, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের নিকট একজন রসূল প্রেরণ করলে না কেন? করলে আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার পূর্বেই তোমার নিদর্শন মেনে নিতাম। (সূরা ত্বা-হা ১৩৪ আয়াত)
৩। এ আয়াতে কুরআনের সত্যতার উপর সাক্ষাদানের পাশাপাশি কুরআন যার উপর নাযিল হয়েছে তার সত্যতার উপরও সাক্ষ্য প্রদান হয়ে গেছে। আল্লাহ ও ফেরেশতারা সাক্ষ্য দিচ্ছেন। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। وَ کَفٰی بِاللّٰهِ شَهِیۡدًا
৪। যারা অবিশ্বাস করেছে ও আল্লাহর পথে বাধা দিয়েছে, তারা ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট। নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে ও যুলুম করেছে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোন পথও দেখাবেন না, জাহান্নামের পথ ছাড়া; সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে এবং এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।
৫। সকল সাধারন মানুষকেই আহবান করে আল্লাহ জানাচ্ছেন অবশ্যই রাসূল তোমাদের রবের কাছ থেকে সত্য নিয়ে এসেছেন সুতরাং তোমরা ঈমান আন, এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, আর যদি তোমরা কুফরী কর তবে আসমানসমূহ ও যমীনে যা আছে সব আল্লাহরই এবং আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ বলেন; হে আমার বান্দা সকল! তোমাদের আদি ও অন্ত সমস্ত মানুষ ও জ্বিন যদি একটি এমন মানুষের অন্তরের মত হয়ে যায়, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ ভীরু, তাহলে তাতে আমার সাম্রাজ্যে কোন বৃদ্ধি লাভ হবে না। আর তোমাদের আদি ও অন্ত সমস্ত মানুষ ও জ্বিন যদি একটি এমন মানুষের অন্তরের মত হয়ে যায়, যে তোমাদের মধ্যে সব থেকে বড় অবাধ্য, তাহলে তাতে আমার সাম্রাজ্যে কোন হ্রাস বা ঘাটতি হবে না। হে আমার বান্দা সকল! তোমরা সকলেই যদি একটি ময়দানে একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে আমার নিকট চাও এবং প্রত্যেক মানুষকে যদি তার কামনা মোতাবেক দান করি, তাহলে তা আমার ভান্ডার ঐ পরিমাণ হ্রাস পাবে, একটি সূচ সাগরে ডুবানোর পর তার ডগায় লেগে যে পরিমাণ সাগরের পানি হ্রাস পায়। (সহীহ মুসলিমঃ
৬। غُلُوْ (অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি) শব্দের তাৎপর্য হল, কোন বস্তুকে তার নির্ধারিত সীমা থেকে বাড়িয়ে দেওয়া।
নাসারারা ঈসা ‘আলাইহিস্ সালাম-কে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। তাকে স্বয়ং আল্লাহ, আল্লাহর পুত্র অথবা তিনের এক আল্লাহ বানিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে ইয়াহুদীরা তাকে অমান্য ও প্রত্যাখ্যান করার দিক দিয়ে বাড়াবাড়ি পথ অবলম্বন করেছে। তারা ঈসা আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহর নবী হিসেবে স্বীকার করেনি। বরং তার মাতা মারইয়াম ‘আ-এর উপর মারাত্মক অপবাদ আরোপ করেছে এবং তার নিন্দাবাদ করেছে। দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবড়ি ও সীমালংঘনের কারণে ইয়াহুদী ও নাসারাদের গোমরাহী ও ধ্বংস হওয়ার শোচনীয় পরিণতি বারবার প্রত্যক্ষ হয়েছে। তাই রাসূল সা তার প্রিয় উম্মতকে এ ব্যাপারে সংযত থাকার জন্য সতর্ক করেছেন।
খ্রিষ্টানরা বিভিন্ন ফির্কায় বিভক্ত ছিল। কোন ফির্কা ঈসা (আঃ)-কে স্বয়ং আল্লাহ বলে বিশ্বাস করে, কোন ফির্কা তাঁকে আল্লাহর অংশীদার মনে করে, আবার কোন ফির্কা তাঁকে আল্লাহর পুত্র মনে করে। তারপর যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী।
রাসূল সা বলেছেন, “তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে এমন অতিরঞ্জিত করো না, যেমন নাসারারা ঈসা ইবন মারইয়াম আ-এর ব্যাপারে করেছে। স্মরণ রাখবে যে, আমি আল্লাহর বান্দা। অতএব, আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল বলবে।” [বুখারীঃ ৩৪৪৫]
ঈসা আ কে كلمة الله (আল্লাহর বাণী বা শব্দ)এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, كن (হও) শব্দ। যার দ্বারা আল্লাহর নির্দেশে বিনা পিতায় ঈসা (আঃ) জন্মলাভ করেন। মহান আল্লাহ এ শব্দটি জিবরীল (আঃ)-এর মাধ্যমে মারয়্যাম (‘আলাইহাস্ সালাম)এর কাছে পৌঁঁছে দিয়েছিলেন। روح الله এর অর্থ হচ্ছে, সেই ‘ফুঁক’ যা আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল (আঃ)মারয়্যাম আ এর কাছে ফুঁকেছিলেন, সুতরাং ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর কালেমা (বাণী); (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
আল্লাহর পরিচয়ঃ কর্মবিধায়করূপে আল্লাহই যথেষ্ট (وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَکِیۡلًا)
আন নিসাঃ ২৪তম রুকু (১৭২-১৭৬) আয়াত
১। ঈসা আ স্বয়ং এবং আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভকারী ফিরিশতাগণ কখনো আল্লাহর বান্দারূপে পরিচিত হতে লজ্জা বা অপমান বোধ করেন না। কারণ, আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামী করা, তার ইবাদাত-বন্দেগী করা, আদেশ-নিষেধ পালন করা অতি মর্যাদা, গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ জানাচ্ছেন- যারা তাঁর দাসত্ব (ইবাদত) করতে উন্নাসিকতা প্রদর্শন করে ও অহংকার করে, তিনি তাদের সকলকে অচিরেই তাঁর নিকট একত্র করবেন। তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তি দেবেন। আর আল্লাহ্ ছাড়া তাদের জন্য তারা কোন অভিভাবক ও সহায় পাবে না।
২। যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদেরকে পূর্ণ করে দিবেন তাদের পুরস্কার এবং নিজ অনুগ্রহে আরো বেশী দেবেন
৩। برهان বলা হয় এমন অকাট্য ও স্পষ্ট প্রমাণকে যার পর আর কোন আপত্তি থাকার অবকাশ নেই এবং এমন অকাট্য প্রমাণ যার দ্বারা সন্দেহ নিরসন হয়। অকাট্য দলীল-প্রমাণ
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা বলেন, রাসূল সা এর মহান ব্যক্তিত্বের জন্য ‘বুরহান’ শব্দ প্রয়োগ করার তাৎপর্য, তার বরকতময় সত্তা, অনুপম চরিত্র মাধুর্য, অপূর্ব মু’জিযাসমূহ, তার প্রতি বিস্ময়কর কিতাব আল-কুরআন নাযিল হওয়া ইত্যাদি তার রেসালাতের অকাট্য দলীল ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যার পরে আর কোন সাক্ষ্য প্রমাণের আবশ্যক হয় না। অতএব, তার মহান ব্যক্তিত্বই তার সত্যতার অকাট্য প্রমাণ।
আয়াতে نور (নূর) শব্দ দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, সূরা আল-মায়েদার ১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, (قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ) অর্থাৎ তোমাদের কাছে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এক উজ্জ্বল আলো তথা এক প্রকৃষ্ট কিতাব অর্থাৎ আল-কুরআন এসেছে। আবার নুর অর্থ রাসূল সা এবং আল-কুরআনও হতে পারে। তখন এর অর্থ হবে, হেদায়াতের নূর।
৪। যারা আল্লাহতে ঈমান এনে তাকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করেছে তাদেরকে আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের মধ্যে দাখিল করবেন এবং সরল পথে তার দিকে পরিচালিত করবেন।
৫। জাবের ইবন আবদুল্লাহ বলেন, আমি অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ সা ওয়া সাল্লাম আমাকে দেখতে আসলেন। তিনি অজু করে আমার উপর পানি ছিটিয়ে দিলে আমার হুশ আসে। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মীরাস কারা পাবে? আমার তো ‘কালালাহ’ ছাড়া আর কোন ওয়ারিশ নেই। তখন ফারায়েযের আয়াত নাযিল হয়। [বুখারী: ১৯৪; মুসলিম: ১৬১৬]
(কালালা) পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্বন্ধে আল্লাহ ব্যবস্থা জানাচ্ছেন, তোমরা পথভ্রষ্ট হবে এ আশংকায় আল্লাহ্ তোমাদেরকে পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছেন এবং আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।
যদি ‘কালালাহ’ ব্যক্তির দুই অথবা দুই-এর অধিক বোন থাকে, তাহলে তারা সমস্ত মালের দুই তৃতীয়াংশের উত্তরাধিকারিণী হবে। কালালাহ’ ব্যক্তির ওয়ারিসগণ যদি পুরুষ ও মহিলা উভয়ই হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ‘এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের সমান’ নিয়ম অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন হবে।
–
সূরা নিসা সমাপ্ত।
সুরা আলা মায়িদাঃ (১-১১) রুকু
মায়েদা শব্দের অর্থঃ খাবারপূর্ণ পাত্র।
হোদাইবিয়ার সন্ধির পর ৬ হিজরীর শেষের দিকে অথবা ৭ হিজরীর প্রথম দিকে এ সূরাটি নাযিল হয়।
জুবায়ের ইবনে নুফায়ের থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একবার হজ্জের পর আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে উপস্থিত হলে তিনি বললেনঃ জুবায়ের, তুমি কি সূরা মায়েদাহ পাঠ কর? তিনি আরয করলেন, জী-হ্যাঁ, পাঠ করি। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এটি কুরআনুল কারীমের সর্বশেষ সূরা। এতে হালাল ও হারামের যেসব বিধি-বিধান বর্ণিত আছে, তা অটল। এগুলো রহিত হওয়ার নয়। কাজেই এগুলোর প্রতি বিশেষ যত্নবান থেকো। [দেখুনঃ মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩১১]
সূরা আল-মায়েদাহ সর্বসম্মত মতে মাদানী সূরা। মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের মধ্যেও এটি শেষ দিকের সূরা। এমনকি, কেউ কেউ একে কুরআন মজীদের সর্বশেষ সূরাও বলেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ও আসমা বিনতে ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে, সূরা আল-মায়েদাহ যে সময় নাযিল হয়, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে ‘আদ্ববা’ নামীয় উষ্ট্রীর পিঠে সওয়ার ছিলেন। সাধারণতঃ ওহী অবতরণের সময় যেরূপ অসাধারণ ওজন ও বোঝা অনুভূত হতো, তখনও যথারীতি তা অনুভূত হয়েছিল। এমনকি ওজনের চাপে উষ্ট্রী অক্ষম হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচে নেমে আসেন। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/৪৫৫]
সূরা মায়েদার কিয়দংশ হোদায়বিয়ার সফরে, কিয়দংশ মক্কা বিজয়ের সফরে এবং কিয়দংশ বিদায় হজ্জের সফরে নাযিল হয়।
তিনটি বড় বড় বিষয় এ সূরাটির অন্তরভুক্তঃ
একঃ মুসলমানদের ধর্মীয়, তামাদ্দুনিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আরো কিছু বিধি নির্দেশ।
দুইঃ মুসলমানদেরকে উপদেশ প্রদান । এখন মুসলমানরা একটি শাসক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে যাওয়ায় তাদের হাতে ছিল শাসন শক্তি
তিনঃ ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে উপদেশ প্রদান। এ সময় ইহুদীদের শক্তি খর্ব হয়ে গেছে। উত্তর আরবের প্রায় সমস্ত ইহুদী জনপদ মুসলমানদের পদানত।
সুরা আলা মায়িদাঃ ১ম রুকু (১-৫) আয়াত
১।আয়াতে মুমিনগণকে ওয়াদা-অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণেই সূরা মায়েদার অপর নাম ‘সূরা উকুদ’ তথা ওয়াদা- অঙ্গীকারের সূরা।
عُقُودٌ শব্দটি عقد শব্দের বহুবচন। এর শাব্দিক অর্থ বাঁধা, আবদ্ধ করা। চুক্তিতে যেহেতু দুই ব্যক্তি অথবা দুই দল আবদ্ধ হয়, এজন্য এটাকেও عقد বলা হয়েছে। এভাবে عقود এর অর্থ হয়- عهود অর্থাৎ চুক্তি ও অঙ্গীকার।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের কাছ থেকে ঈমান ও ইবাদত সম্পর্কিত যে সব অঙ্গীকার নিয়েছেন অথবা আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাদের কাছ থেকে স্বীয় নাযিলকৃত বিধি-বিধান হালাল ও হারাম সম্পর্কিত যেসব অঙ্গীকার নিয়েছেন, আয়াতে সেগুলোকেই বুঝানো হয়েছে।
আয়াতে বর্ণিত أنعام শব্দটি نعم এর বহুবচন। এর অর্থ পালিত পশু। ‘বাহীমা” বলতে প্রত্যেক বিচরণশীল চতুষ্পদ জন্তু বুঝানো হয়৷
ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম হওয়ার অর্থ স্বাভাবিক অবস্থায় হালাল হওয়া। [সা’দী]
আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছেমত যে কোন হুকুম দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। কোন বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য আল্লাহর অনুমোদন ও অননুমোদন ছাড়া আর দ্বিতীয় ভিত্তির আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। তারপরও সেগুলোতে অনেক হেকমত নিহিত থাকে। যেমন তোমাদেরকে তিনি অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ, এতে রয়েছে তোমাদের স্বার্থ। আর এর বিপরীত হলে, তোমাদের স্বার্থহানী হবে।
২। যেসব অনুভূত ও প্রত্যক্ষ ক্রিয়াকর্মকে সাধারণের পরিভাষায় মুসলিম হওয়ার চিহ্নরূপে গণ্য করা হয়, সেগুলোকে شَعَائِرُ الإسلام তথা ‘ইসলামের নিদর্শনাবলী’ বলা হয়। যেমন, সালাত, আযান, হজ, দাড়ী ইত্যাদি। অনুরূপভাবে সাফা, মারওয়া, হাদঈ ও কুরবানীর জন্তু ইত্যাদিও [আত-তাফসীরুস সহীহ] আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অবমাননা করো না।
আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অবমাননা হচ্ছে, প্রথমতঃ এসব বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে চলা। দ্বিতীয়তঃ এসব বিধি-বিধানকে অসম্পূর্ণভাবে পালন করা এবং তৃতীয়তঃ নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া। আয়াতে এ তিন প্রকার অবমাননাকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
هَدْيٌ হাদ্ঈ ঐ পশুকে বলা হয়, যাকে কুরবানী দেওয়ার জন্য হাজীগণ সঙ্গে করে হারামে নিয়ে যেতেন। বিশেষতঃ যেসব জন্তুকে গলায় কুরবানীর চিহ্নস্বরূপ কিছু পরানো হয়েছে, সেগুলোর অবমাননা করো না।
- পবিত্র মাসসমূহে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে এগুলোর অবমাননা করো না। [আত-তাফসীরুস সহীহ] পবিত্র মাস হচ্ছে জিলকদ, জিলহজ, মুহাররাম ও রজব।
- মুশরিকরা তোমাদেরকে ৬ষ্ঠ হিজরীতে মসজিদে হারামে যেতে বাধা প্রদান করেছিল। কিন্তু তাদের বাধাদানের কারণে তোমরা তাদের সাথে সীমালংঘনমূলক ও অন্যায় আচরণ করবে না। শত্রুদের সাথেও ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতা অবলম্বনের সবক ও শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
- নেককাজ ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, বির বা সৎকাজ হচ্ছে, সচ্চরিত্রতা। আর পাপ হচ্ছে, যা তোমার অন্তরে উদিত হয় অথচ তুমি চাও না যে, মানুষ সেটা জানুক। [মুসলিম: ২৫৫৩]
আয়াতে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তি সৎকর্ম ও আল্লাহর ভয়কে আসল মাপকাঠি করেছে, এর বিপরীতে পাপ ও অত্যাচার উৎপীড়নকে কঠোর অপরাধ গণ্য করেছে এবং এতে সাহায্য-সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছে
৩। আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি জিনিস হারাম করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
১। মৃত জিনিস। ২। প্রবাহিত রক্ত’৩। শুকরের গোস্ত(দেহ, চর্বিসহ)৪। ঐ জন্তু যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। যদি যবেহ্ করার সময়ও অন্যের নাম নেয়া হয়,৫। ঐ জন্তু যাকে গলাটিপে হত্যা অথবা নিজেই কোন জাল ইত্যাদিতে আবদ্ধ অবস্থায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে গেছে।৬। ঐ জন্তু, যা লাঠি অথবা পাথর ইত্যাদির প্রচন্ড আঘাতে নিহত হয়।৭। ঐ জন্তু, যা কোন পাহাড়, টিলা, উঁচু দালানের উপর থেকে অথবা কুপে পড়ে মরে যায়।৮। ঐ জন্তু, যা কোন সংঘর্ষে নিহত হয়।৯। ঐ জন্তু, যেটি কোন হিংস্র জন্তুর কামড়ে মরে যায় ( এসব জন্তুর মধ্যে কোনটিকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার পর যবেহ করতে পারলে হালাল হয়ে যাবে। এ ব্যতিক্রম প্রথমোক্ত চার প্রকার জন্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না।)
১০। ঐ জন্তু হারাম, যাকে নুছুবের উপর যবেহ্ করা হয়। নুছুব ঐ প্রস্তর বা বেদীকে বলা হয় ১১। ‘ইস্তেকসাম বিল আযলাম’। যার অর্থ তীরের দ্বারা বন্টণকৃত বস্তু। أزْلَامٌ শব্দটি زَلَمٌ এর বহুবচন। এর অর্থ ঐ তীর, যা জাহেলিয়াত যুগে ভাগ্য পরীক্ষার জন্যে নির্ধারত ছিল
দুই প্রকার মৃতকে এ বিধানের বাইরে রেখেছেন, একটি মৃত মাছ ও অপরটি মৃত টিড্ডী। [মুসনাদে আহমদঃ ২/৯৭, ইবন মাজাহঃ ৩৩১৪]
৪। অদ্য কাফেররা তোমাদের দ্বীনকে পরাভূত করার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে। কাজেই তোমরা তাদেরকে আর ভয় করো না। তবে আল্লাহকে ভয় কর। এ আয়াতাংশ যখন নাযিল হয়, তখন মক্কা এবং প্রায় সমগ্র আরব মুসলিমদের করতলগত ছিল
৫। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সা মাত্র একাশি দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন। কেননা, দশম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ তারিখে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং একাদশ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে রাসূলে কারিম সা ওফাত পান। আরাফার দিন, সর্বোত্তম দিন, শুক্রবারে। এর শ্রেষ্ঠত্বও সর্বজনবিদিত। স্থানটি হচ্ছে ময়দানে-আরাফাত।
আল্লাহ জানিয়েছেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।
দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেবার অর্থই হচ্ছে এর মধ্যে জীবনের সমস্ত প্রশ্নের নীতিগত ও বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায়। হেদায়াত ও পথনির্দেশ লাভের জন্য বাইরে যাবার প্রয়োজন নাই। এ শরীআত সম্পূর্ণরূপে সত্য ও ইনসাফপূর্ণ। পরে কোন শরীআত নেই।
৬। শরীয়তের একটি মূলনীতি হল, প্রত্যেক হালাল জিনিস পবিত্র ও উপাদেয়। আর প্রত্যেক হারাম জিনিস নোংরা ও অপবিত্র। আয়াতে বর্ণিত طيبات শব্দের তিনটি অর্থ হয়ে থাকে এক. যাবতীয় রুচিসম্পন্ন। দুই. যাবতীয় হালালকৃত। তিন. যাবতীয় যবাইকৃত প্রাণী। কারণ, যবাই করার কারণে সেগুলোতে পরিচ্ছন্নতা এসেছে। [ফাতহুল কাদীর]
৭। শিক্ষিত শিকারী জন্তুর শিকার করা পশু-পাখী দুটি শর্ত সাপেক্ষে খাওয়া হালাল বা বৈধ।
(ক) শিকারে প্রেরণ করার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে।
(খ) শিকারী পশু শিকার করা জিনিস (পশু বা পাখী) মালিকের জন্য রেখে দিবে,নিজে তা ভক্ষণ করবে না। যদিও সে শিকারকৃত পশু বা পাখীকে মেরে ফেলেছে, তবুও তা খাওয়া হালাল এই শর্তে যে, সে যেন শিকারের ব্যাপারে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয় এবং তাকে প্রেরণ করার সময় তার সাথে অন্য কোন পশু শরীক না থাকে। সহীহ বুখারী
প্রথম শর্তঃ কুকুর অথবা বাজ শিক্ষাপ্রাপ্ত হতে হবে।
দ্বিতীয় শর্তঃ মালিক নিজ ইচ্ছায় কুকুরকে অথবা বাজকে শিকারের পেছনে প্রেরণ করবেন। কুকুর অথবা বাজ যেন স্বেচ্ছায় শিকারের পেছনে দৌড়ে শিকার না করে।
তৃতীয় শর্তঃ শিকার জন্তু নিজে শিকারকে খাবে না; বরং মালিকের কাছে নিয়ে আসবে
চতুর্থ শর্তঃ শিকারী কুকুর অথবা বাজকে শিকারের দিকে প্রেরণ করার সময় বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে।
উপরে বর্ণিত চারটি শর্ত পূর্ণ হলে শিকার হাতে পৌঁছার পূর্বেই যদি মরে যায়, তবুও তা হালাল হবে; যবেহ্ করার প্রয়োজন হবে না। আর যদি জীবিত অবস্থায় হাতে আসে, তবে যবেহ্ ব্যতীত হালাল হবে না।
৮। মূলতঃ কুরআনের পরিভাষায় ইহুদী ও নাসারা জাতিই আহলে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত। যারা তাওরাত ও ইঞ্জলের প্রতি বিশ্বাসী। [ইবন কাসীর]
কাফেরদের মধ্য থেকে আহলে কিতাব ইয়াহুদী ও নাসারাদের যবেহ করা জন্তু হালাল হওয়ার কারণ হচ্ছে, আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে জন্তু যবেহ করাকে তারাও বিশ্বাসগতভাবে জরুরী মনে করে। এ ছাড়া মৃত জন্তুকেও তার হারাম মনে করে। [ইবন কাসীর]
যদি তারা আল্লাহর নাম না নিয়েই কোন প্রাণী যবেহ করে অথবা তার ওপর আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নাম নেয়, তাহলে তা খাওয়া আমাদের জন্য জায়েয নয়৷ অনুরূপভাবে যদি তাদের দস্তরখানে মদ, শূকরের গোশ্ত বা অন্য কিছু হারাম খাদ্য পরিবেশিত হয়, তাহলে আমরা তাদের সাথে আহারে শরীক হতে পারি না৷
ইয়াহুদী ও নাসারা মহিলাদের বিয়ে করার ক্ষেত্রে একটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তা হলো, তাদেরকে অবশ্যই মুহসানাহ বা সংরক্ষিত মহিলা হতে হবে। সুতরাং তাদের মধ্যে যারা সংরক্ষিত বা নিজের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারিনী নয়, তারা এর ব্যতিক্রম। [সা’দী]
যারা ঈমানের সাথে কুফরী (অস্বীকার) করে, তাদের আমল নষ্ট হয়ে যায়। এখানে সতর্ক করা উদ্দেশ্য যে, এমন মহিলাকে বিবাহ করার ফলে যদি ঈমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে খুবই ক্ষতির (সম্পদ) ক্রয় করা হবে। ঈমান বাঁচানো ফরয কর্তব্য। একটি অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মের জন্য ফরয কর্মকে বিপদ ও ক্ষতির সম্মুখীন করা যেতে পারে না।
সুরা আলা মায়িদাঃ ২য় রুকু (৬-১১) আয়াত
১। অযুর পদ্ধতি জানানো হয়েছে- হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও।
কুলি করা ও নাক পরিস্কার করাও মুখমণ্ডল ধোয়ার অন্তর্ভুক্ত। কান যেহেতু মাথার একটি অংশ, তাই মাথা মাসেহ করার মধ্যে কানের ভেতরের ও বাইরের উভয় অংশও শামিল হয়ে যায়। অযু শুরু করার আগে দু’হাত ধুয়ে নেয়া উচিত। কারণ, যে হাত দিয়ে অযু করা হচ্ছে, তা পূর্ব থেকেই পবিত্র থাকার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোপরি অযু করার সময় ধারাবাহিকতা রক্ষা ও অঙ্গসমূহ ধোয়ার মধ্যে বিলম্ব না করা উচিত।
আমার উম্মতদেরকে কেয়ামতের দিন তাদেরকে ‘গুররান-মুহাজ্জালীন’ বলে ডাকা হবে। (অর্থাৎ ওযুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো উজ্জ্বল অবস্থায় উপস্থিত হবে) কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার উজ্জ্বলতাকে বৃদ্ধি করতে সক্ষম, সে যেন তা (বৃদ্ধি) করে। [বুখারী: ১৩৬]
২। এখানে জানাবত ঐ অপবিত্রতাকে বুঝানো হয়েছে, যা স্বপ্নদোষ অথবা স্ত্রী সহবাস (বা যৌনতৃপ্তির সাথে বীর্যপাতের) কারনে হয়।
এ ছাড়া অপবিত্রতা- মহিলাদের মাসিক ও (প্রসবোত্তর) নিফাস।
পবিত্রতা অর্জনের জন্য গোসল করা জরুরী। গোসলের পানি না পাওয়া গেলে তায়াম্মুম করা বিধেয়;(তায়াম্মুমে মুখমন্ডল ও হাত মাসেহ করার কথা এসেছে)
৩। আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা করতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তার নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।
৪। ঈমান আনার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সা এর আদেশ-নিষেধ পালনের যে অঙ্গীকার স্বতঃই এসে যায়, তা-ই উদ্দেশ্য। [ইবন কাসীর, সা’দী, মুয়াসসার]
আল্লাহ জানাচ্ছেন- স্মরণ কর, তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামত এবং যে অঙ্গীকারে তিনি তোমাদেরকে আবদ্ধ করেছিলেন তা; যখন তোমরা বলেছিলে, ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।
৫। সাধারণতঃ দুটি কারণ মানুষকে ন্যায় ও সুবিচারে বাধা-প্রদান এবং অন্যায় ও অবিচারে প্ররোচিত করে। (এক) নিজের অথবা বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। (দুই) কোন ব্যক্তির প্রতি শক্রতা ও মনোমালিন্য। সূরা আন-নিসার আয়াতে প্রথমোক্ত কারণের উপর ভিত্তি করে সুবিচারের আদেশ দেয়া হয়েছে আর সূরা আল-মায়েদার আলোচ্য আয়াতে শেষোক্ত কারণ হিসেবে বক্তব্য রাখা হয়েছে।
বড় হাদিসের শেষ অংশ-
‘আল্লাহকে ভয় কর এবং সন্তানদের মাঝে সমদৃষ্টিসম্পন্ন সুবিচার কর।’’ তিনি আরো বললেন, ‘‘আমি যুলুমের (অন্যায়ের) সাক্ষী হতে পারব না।’’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম / কিতাবুল হিবা বা দানপত্র নামক অধ্যায়)
৬। আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার এর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে। যারা কুফরী করে এবং আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।
৭। আয়াতের শানে নুযুল বা অবতীর্ণের কারণ সম্পর্কে কুরআনের ভাষ্যকারগণ বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আয়াতে রাসূলুল্লাহ সা ও মুসলিমদের অদৃশ্য হেফাযতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নেয়ামত লাভ করার জন্য তাকওয়া ও আল্লাহর উপর নির্ভর করা জরুরী। যে কোন জাতি অথবা ব্যক্তি যে কোন সময় বা কোন স্থানে এ দুটি গুণ অবলম্বন করবে, আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এভাবে হেফাযত ও সংরক্ষণ করা হবে।
একটি ঘটনা- একজন বেদুঈনের ঘটনা, কোন এক সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় রসূল (সাঃ) কোন এক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং তরবারিটিকে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। (সুযোগ বুঝে) ঐ বেদুঈন (তাঁর দিকে ধাবিত হয়ে) তরবারিটি হস্তগত করে ফেলল। অতঃপর তাঁর দিকে তরবারি উঁচিয়ে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার কবল থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে?’ রসূল (সাঃ) নিশ্চিন্তে উত্তর দিলেন; ‘আল্লাহ।’ (অর্থাৎ আল্লাহ রক্ষা করবেন।) শুধু এতটুকু কথা বলতে যত দেরী, (অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে) তার হাত থেকে তরবারিটি পড়ে গেল।
সুরা আলা মায়িদাঃ ৩য় রুকু (১২-১৯) আয়াত
১। আয়াতে পরোক্ষভাবে মুসলিমদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, তোমরা যেন বানী ইস্রাঈলের ন্যায় অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ শুরু করে না দাও।
ঐ সময়কার ঘটনা, যখন মূসা (আঃ) দুর্দান্ত জাতি আমালেকাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি নিজ জাতির বারটি গোত্রের জন্য একজন করে দলপতি নির্বাচন করেন। যাতে তারা তাদের স্বগোত্রের লোকদেরকে যুদ্ধের জন্য পূর্ণরূপে প্রস্ত্তত করে, তাদের নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্বও পালন করে এবং তাদের অন্যান্য ব্যাপারেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করে। আল্লাহ বলেছিলেন, নিশ্চয় আমি তোমাদের সংগে আছি; তোমরা যদি সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও, আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন, তাদেরকে সম্মান-সহযোগিতা কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে আমি তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতসমূহে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এর পরও কেউ কুফরী করলে সে অবশ্যই সরল পথ হারাবে।
২। বানী-ইস্রাঈল তা ভঙ্গ করে, যার ফলে তারা (এক)আল্লাহর অভিশাপের শিকার হয়। (দুই) তাদের হৃদয় কঠোর করে দেওয়া হয়। যার কারণে তাদের হৃদয় প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হয় এবং নবীগণের উপদেশবাণী তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। (তিন) আল্লাহর বাণীকে তারা হেরফের ও পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তন দুই ধরনের ছিল, কখনও শব্দের পরিবর্তন, আবার কখনও অর্থের পরিবর্তন। (৪) তাদেরকে দেয়া কিতাবের অংশ অনেকাংশ হারিয়ে ফেলে বা ভুলে যায়।(৫) সবসময় খেয়ানতে লিপ্ত থাকবে।
অল্প সংখ্যক ঈমান এনেছিল।আল্লাহ জানাচ্ছেন- কাজেই তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং উপেক্ষা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মুহসিনদের ভালবাসেন।
৩। نصارى (নাসারা) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে نصرة ‘নুসরাহ’ থেকে। যার অর্থ হচ্ছে, সাহায্য করা। এরাও ইয়াহুদীদের মতই আহলে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত। এদের নিকট থেকেও আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা ঐ অঙ্গীকারের কোন পরোয়া করেনি। আল্লাহ্ তা’আলা নাসারাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের সাজা বর্ণনা করে বলেছেন যে, তাদের পরস্পরের মধ্যে বিভেদ, বিদ্বেষ ও শক্রতা সঞ্চারিত করে দেয়া হয়েছে- যা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
৪। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের মধ্যে যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করেছে, রসূল (সাঃ) তা উদঘাটন করেছেন এবং যা তারা গোপন করেছিল, তা তিনি প্রকাশ করে দিয়েছেন।
আয়াতে আল্লাহ তাআলা ‘নূর ও কিতাবুন মুবীন’ (জ্যোতি ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ) একই সাথে উল্লেখ করেছেন এবং এই দুইয়েরই উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন কারীম। وَ সংযোজক অব্যয়টি অর্থের ভিন্নতা বুঝাতে ব্যবহূত হয়েছে।আল্লাহ জানাচ্ছেন- যারা আল্লাহর সস্তুষ্টির অনুসরণ করে, এ দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং তাদেরকে নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর তাদেরকে সরল পথের দিশা দেন।
৫। নাসারাদের একদলের বিশ্বাস ছিল যে, ঈসা মসীহ হুবহু আল্লাহ। কিন্তু আয়াতে যে যুক্তি দ্বারা বিষয়টির খণ্ডন করা হয়েছে, তাতে নাসারাদের সব দলের একত্ববাদ বিরোধী ভ্রান্ত বিশ্বাসেরই খণ্ডন হয়ে যায়, আল্লাহ তা’আলা বলছেন যে, যদি তিনি ঈসা ও তার মা মারইয়ামকে মারতে ইচ্ছা করেন, তবে কি এমন কেউ আছে যে তাদেরকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারে? আল্লাহ তাআলা নিজ অসীম ক্ষমতা ও পূর্ণ সার্বভৌমত্বের কথা বর্ণনা করেছেন। জানাচ্ছেন- তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন এবং আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
৬। ইয়াহুদীরা উযায়ের (আঃ)-কে এবং খ্রিষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র বলে’ এবং তারা নিজেদেরকেও ‘আল্লাহর পুত্র ও তাঁর প্রিয়পাত্র’ বলে দাবী করে। যদি সত্যি-সত্যিই তোমারা আল্লাহর প্রিয়বান্দা হতে তবে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিতেন না। অথচ তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, তোমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা নও। যাকে ইচ্ছে তিনি ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছে তিনি শাস্তি দেন(২)। আর আসমানসমূহ ও যমীন এবং এ দুয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই, এবং প্রত্যাবর্তন তারই দিকে।
৭। ঈসা (আঃ) ও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মাঝে প্রায় ৫৭০ অথবা ৬০০ বছরের মত যে ব্যবধান, এই ব্যবধান কালকে ‘ফাতরাহ’ فترة (দুই জন প্রেরিত রসূলের মধ্যবর্তী সময়-কাল) বলে। আহলে কিতাবদেরকে বলা হচ্ছে যে, এই ব্যবধান-কালের পর আমি সর্বশেষ রসূল মুহাম্মাদকে প্রেরণ করলাম। এবার তো তোমরা এ কথা বলার সুযোগ পাবে না যে, আমাদের নিকট কোন সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী নবী ও রসূল আসেননি। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, আমি ইবন মারইয়ামের সবচেয়ে নিকটতম মানুষ। নবীরা বৈমাত্রেয় ভাই, আমার ও তাঁর মাঝে কোন নবী নেই। [মুসলিম: ২৩৬৫; অনুরূপ বুখারী ৩৪৪২]
সুরা আলা মায়িদাঃ ৪র্থ রুকু (২০-২৬) আয়াত
১। আলোচ্য আয়াতসমূহে বনী-ইসরাঈলের একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতকে স্মরণ কর।
তিনটি নেয়ামতের কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ঈমানী নেয়ামত; অর্থাৎ তার সম্প্রদায়ে অব্যাহতভাবে বহু নবী প্রেরণ। এর চাইতে বড় সম্মান আর কিছু হতে পারে না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, ইসরাইল বংশীয়দেরকে নবীরা শাসন করতেন। যখনই কোন নবী মারা যেত, তখনই অন্য নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। [বুখারী ৩৪৫৫; মুসলিম: ১৮৪২]
দ্বিতীয় নেয়ামতটি হচ্ছে পার্থিব ও বাহ্যিক। অর্থাৎ তাদেরকে রাজ্য দান। আজ আল্লাহ্ তাআলা ফিরআউন ও তার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে বনী-ইসরাঈলকে তার রাজ্যের অধিপতি করে দিয়েছেন।অথবা, এখানে রাজ্যদান বলতে রাজার হাল বোঝানো হয়েছে। ইবন আব্বাস রা থেকে বর্ণিত, তারা বাড়ী, নারী ও দাস-দাসী নিয়ে জীবন যাপন করত বলেই তাদেরকে রাজা বলা হয়েছে। [ইবন কাসীর] তৃতীয় নেয়ামত বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার নেয়ামতের সমষ্টি। বলা হয়েছেঃ তোমাদেরকে এমনসব নেয়ামত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের আর কাউকে দেননি। আভ্যন্তরীণ সম্মান, নবুওয়াত এবং রেসালাতও এর অন্তর্ভুক্ত।
সৃষ্টিকুলের ঐসব লোককে বোঝানো হয়েছে, যারা মূসা আলাইহিস সালামের আমলে বিদ্যমান ছিল। তখন সমগ্র বিশ্বের কেউ ঐসব নেয়ামত পায়নি, যা বনী-ইসরাঈল পেয়েছিল।
২। বানী ইসরাঈলের প্রধান পুরুষ ইয়াকুব (আঃ)-এর বাসস্থান ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম)। কিন্তু তাঁর পুত্র ইউসুফ (আঃ) মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর তাঁরা সকলেই মিসরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। পরিশেষে মূসা (আঃ) ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তিলাভের জন্য গোপনভাবে রাতারাতি বানী ইস্রাঈলকে নিয়ে মিসর থেকে চলে আসেন। কিন্তু সে সময় বায়তুল মুকাদ্দাসে আমালেকাদের শাসন ছিল, যারা এক বীর-বাহাদুর গোত্র রূপে পরিচিত ছিল। যখন মূসা (আঃ) পুনরায় বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করলেন তখন তার জন্য ক্ষমতাসীন আমালেকাদের বিরুদ্ধে জিহাদ জরুরী ছিল। সুতরাং মূসা (আঃ) নিজ গোত্রকে ঐ পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করার নির্দেশ দিলেন এবং সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্যের সুসংবাদও শুনালেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বানী ইস্রাঈল আমালেকাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হল না। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
তারা পূর্বের জবাবেরই আরও বিশ্রী ভঙ্গিতে পুনরাবৃত্তি করে বললঃ “আপনি ও আপনার আল্লাহ উভয়ে গিয়েই যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব”। কথাটি অত্যন্ত বিশ্রী ও পীড়াদায়ক
মূসা (আঃ)-এর জাতির মধ্যে কেবল এই দুই ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার ছিলেন, যাঁদের আল্লাহর শক্তি ও সাহায্যের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। তারা বলল, তোমরা তাদের মুকাবেলা করে দরজায় প্রবেশ কর, প্রবেশ করলেই তোমরা জয়ী হবে এবং আল্লাহ্র উপরই তোমরা নির্ভর কর যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু এ সত্ত্বেও বানী ইস্রাঈল হীনতর কাপুরুষতা, বেআদবী, অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ প্রকাশ করে
মুসা আ দু’আ করলেন- رَبِّ اِنِّیۡ لَاۤ اَمۡلِکُ اِلَّا نَفۡسِیۡ وَ اَخِیۡ فَافۡرُقۡ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَ الۡقَوۡمِ الۡفٰسِقِیۡنَ
হে আমার রব! আমি ও আমার ভাই ছাড়া আর কারো উপর আমার অধিকার নেই, সুতরাং আপনি আমাদের ও ফাসিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দিন।
৩। সে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করার অধিকার তারা চল্লিশ বছরের জন্য হারিয়েছে। কারণ তারা অবাধ্যতা করেছিল। এটা ছিল তাদের জন্য নির্ধারিত দুনিয়ার শাস্তি।
এই ভূ-পৃষ্ঠকে ময়দানে ‘তীহ’ বলা হয়। (‘তীহ’ গোলক-ধাঁধার ময়দানকে বলে।) এই ময়দানে চল্লিশ বছর পর্যন্ত এই জাতি নিজেদের বিদ্রোহের ও জিহাদ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করার কারণে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আল্লাহ মুসা আ কে জানান-আপনি ফাসিক সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করবেন না। তাদের প্রতি নাযিলকৃত শাস্তির জন্য দুঃখবোধ, আফসোস না করার নির্দেশ দিলেন।
সুরা আলা মায়িদাঃ ৫ম রুকু (২৭-৩৪) আয়াত
১। আদমের দু’ছেলের কাহিনী আপনি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনান।যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল অতঃপর একজন থেকে কবুল করা হল এবং অন্যজনের কবুল করা হল না। সে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। অন্যজন বলল, আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকীদের পক্ষ হতে কবুল করেন।
(ঘটনাঃ তবে এটা প্রসিদ্ধ আছে যে, (দুনিয়ার) প্রাথমিক অবস্থায় আদম ও হাওয়া (আলাইহিমাস সালাম)-এর মিলনের ফলে একই সময় (যমজ) একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করত। দ্বিতীয় গর্ভেও অনুরূপ একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করত। তখন একটি গর্ভের ছেলে-মেয়ের সাথে আর একটি গর্ভের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। হাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিল না। কিন্তু ক্বাবীলের যমজ বোনটি সুন্দরী ছিল। আর তখনকার রীতি-নীতি অনুসারে হাবীলের বিবাহ ক্বাবীলের যমজ বোনের সাথে আর ক্বাবীলের বিবাহ হাবীলের যমজ বোনের সাথে হওয়ার কথা। কিন্তু ক্বাবীল হাবীলের বোনের পরিবর্তে নিজের যমজ বোনকে বিবাহ করতে চাইল; কারণ সে সুন্দরী ছিল। তখন আদম (আঃ) ক্বাবীলকে বুঝালেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বুঝল না। পরিশেষে আদম (আঃ) উভয়কেই আল্লাহর নামে কুরবানী পেশ করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন যে, যার কুরবানী কবুল হবে, ক্বাবীলের যমজ বোনের সাথে তার বিবাহ দিয়ে দেওয়া হবে। কুরবানী পেশ করা হলে হাবীলের কুরবানী কবুল হল; অর্থাৎ আসমান থেকে আগুন এসে (হাবীলের) কুরবানীকে জ্বালিয়ে ফেলল; যা ছিল (সে যুগের) কুরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন। কিছু মুফাসসিরগণের মতে তারা উভয়েই নিজ নিজ নযর আল্লাহর দরবারে পেশ করল। হাবীল একটি মোটাতাজা দুম্বা বা মেষ কুরবানী করল। আর ক্বাবীল গমের কিছু শিষ কুরবানীর জন্য পেশ করল। ফলে হাবীলের কুরবানী কবুল হল। আর তা দেখে ক্বাবীল হিংসায় ফেটে পড়ল।)
(কাবিল বলে হাবিলকে হত্যা করার কথা)
এই নযর বা কুরবানী কি উদ্দেশ্যে পেশ করা হয়েছিল? এ ব্যাপারে বিশুদ্ধভাবে কিছু বর্ণিত হয়নি।
২। আদম আ এর ছেলে (হাবিল) বলেন-
আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি তোমার হাত প্রসারিত করলেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি তোমার প্রতি আমার হাত প্রসারিত করব না; নিশ্চয় আমি সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহকে ভয় করি। নিশ্চয় আমি চাই তুমি আমার ও তোমার পাপ নিয়ে ফিরে যাও ফলে তুমি আগুনের অধিবাসী হও এবং এটা যালিমদের প্রতিদান।
অতঃপর তার নফস তাকে তার ভাই হত্যায় বশ করল। ফলে সে তাকে হত্যা করল; এভাবে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হল।
আবু বাকরাহ রা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা কে বলতে শুনেছি, যখন দু’জন মুসলিম তাদের হাতিয়ার নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হবে, তখন তাদের দু’জনই জাহান্নামে যাবে। বলা হল, এতে হত্যাকারীর ব্যাপারটি তো বোঝা গেল, কিন্তু যাকে হত্যা করা হয়েছে তার ব্যাপারটি কেমন? তখন রাসূলুল্লাহ সা বললেন, সেও তো তার সাথীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। [বুখারী: ৭০৮৩; মুসলিম: ২৮৮৮]
রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, তার খুনের বোঝা আদম (আঃ)-এর ঐ প্রথম সন্তানের উপরেই পতিত হয়। কেননা সে-ই সর্বপ্রথম ভূ-পৃষ্ঠে অন্যায়ভাবে রক্ত বইয়েছিল।” (বুখারী ও মুসলিম)
৩। ইবন আব্বাস রা বলেন, একটি কাক আরেকটি মৃত কাকের নিকট এসে তার উপর মাটি দিতে দিতে সেটাকে ঢেকে দিল। এটা দেখে যে তার ভাইকে হত্যা করেছে সে বলতে লাগল, হায়! আমি কি এ কাকের মতও হতে পারলাম না। [তাবারী]
৪। বনী ইসরাঈলের উপর এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা বা যমীনে ধ্বংসাত্মক কাজ করার কারণ ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে, সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।
আল্লাহর নিকট মানুষের রক্তের গুরুত্ব ও মর্যাদা কত! আর এই নীতি শুধু বানী ইস্রাঈলদের জন্য ছিল না; বরং ইসলামী মূলনীতি মোতাবেক এই নীতি চিরস্থায়ী সকলের জন্য।
“যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক মা’বূদ নাই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তার রক্ত তিনটি কারণ ব্যতীত প্রবাহিত করা অবৈধ। জীবনের বদলে জীবন (হত্যার বদলে কেসাস)। একজন বিবাহিত ব্যক্তি যদি অবৈধ যৌন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং ঐ ব্যক্তি যে ইসলাম ত্যাগ করে এবং মুসলিম জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। [বুখারীঃ ৬৮৭৮]
৫। উক্ত আয়াত অবতীর্ণের কারণ এই যে, উকল বা উরাইনা গোত্রের কিছু লোক মুসলমান হয়ে মদীনায় আগমন করে এবং মদীনার আবহাওয়া তাদের স্বাস্থ্যের প্রতিকূল হয়। হাদীসে এসেছে, একদল লোক মদীনায় আসল, তারা মদীনার আবহাওয়া সহ্য করতে পারল না। রাসূলুল্লাহ সা তাদেরকে সাদকার উট যেখানে থাকে সেখানে অবস্থানের অনুমতি দিলেন। যাতে তারা উটের দুধ ও প্রস্রাব পান করতে পারে। কিন্তু তারা রাখালকে হত্যা করল এবং উটগুলোকে নিয়ে চলে যেতে লাগল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পিছু ধাওয়া করতে নির্দেশ দিলেন। পরে তারা ধৃত হলো। তখন তাদের হাত-পা কেটে দেয়া হলো, চোখ উপড়ে ফেলা হলো, এবং তাদেরকে মদীনার কালো পাথর বিশিষ্ট এলাকায় ফেলে রাখা হলো। [বুখারী: ১৫০১; মুসলিম: ১৬৭১] সহীহ বুখারীতে এই শব্দ সহ বর্ণিত হয়েছে যে, তারা চুরিও করেছিল, হত্যাও করেছিল, ঈমান আনার পর কুফরীও করেছিল, আর আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছিল।
ইসলামী শরীআতে অপরাধের শাস্তিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেঃ হুদূদ, কিসাস ও তা’যীরাত। তন্মধ্যে যেসব অপরাধের শাস্তি কুরআন ও সুন্নাহ নির্ধারণ করে দিয়েছে তা হচ্ছে, হুদুদ ও কিসাস। পক্ষান্তরে যেসব অপরাধের কোন শাস্তি কুরআন ও সুন্নাহ নির্ধারণ করেনি; বরং বিচারকদের অভিমতের উপর ন্যস্ত করেছে, সেসব শাস্তিকে শরীআতের পরিভাষায় ‘তাযিরাত’ তথা দণ্ড বলা হয়।
যেসব অপরাধের শাস্তিকে আল্লাহর হক হিসাবে নির্ধারণ করে জারি করেছে, সেসব শাস্তিকে ‘হুদুদ’ বলা হয় এবং যেসব শাস্তিকে বান্দার হক হিসেবে জারি করেছে, সেগুলোকে ‘কিসাস’ বলা হয়।
হুদূদকে আল্লাহর হক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করলেও তা ক্ষমা হবে না। হুদূদের বেলায় কোন বিচারকই সামান্যতম পরিবর্তন, লঘু অথবা কঠোর করার অধিকারী নয়। স্থান ও কাল ভেদেও এতে কোন পার্থক্য হয় না
শরীআতে হুদুদ মাত্র পাঁচটিঃ ডাকাতি, চুরি, ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ- এ চারটির শাস্তি কুরআনে বর্ণিত রয়েছে। পঞ্চমটি মদ্যপানের হদ। এটি বিভিন্ন হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত।
হুদুদ জাতীয় শাস্তি যেমন কোন শাসক ও বিচারক ক্ষমা করতে পারে না, তেমনি তাওবা করলেও ক্ষমা হয়ে যায় না। তবে খাঁটি তাওবা দ্বারা আখেরাতের গোনাহ মাফ হতে অব্যাহতি লাভ হতে পারে। তন্মধ্যে শুধু ডাকাতির শাস্তির বেলায় একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। ডাকাত যদি গ্রেফতারীর পূর্বে তাওবা করে এবং তার আচারআচরণের দ্বারাও তাওবার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়, তবে সে হদ থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু গ্রেফতারীর পর তাওবা ধর্তব্য নয়। অন্যান্য হুদুদ তাওবা দ্বারাও মাফ হয় না, হোক সে তাওবা গ্রেফতারীর পূর্বে অথবা পরে। [ইবন কাসীর অনুরূপ বর্ণনা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন]
সুরা আলা মায়িদাঃ ৬ষ্ঠ রুকু (৩৫-৪৩) আয়াত
১। হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তার নৈকট্য অন্বেষণ কর আর তাঁর পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।
আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ কর। (الْوَسِيلَةَ) শব্দটি وسل ধাতু থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ সংযোগ স্থাপন করা। পূর্ববর্তী মনীষী, সাহাবী ও তাবেয়ীগণ ইবাদাত, নৈকট্য, ঈমান সৎকর্ম দ্বারা আয়াতে উল্লেখিত وسيلة শব্দের তাফসীর করেছেন।
ওসীলা শব্দের আভিধানিক ব্যাখ্যা এবং সাহাবী ও তাবেয়ীগণের তাফসীর থেকে জানা গেল যে, যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ হয়, তাই অসীলা। পক্ষান্তরে শরীআতের পরিভাষায় তাওয়াসসুলের অর্থ হল – আল্লাহ যা বৈধ করেছেন তা পালন করে এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা ও জান্নাতে পৌঁছা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জান্নাতের একটি উচ্চ স্তরের নাম ‘ওসীলা’। এর ঊর্ধ্বে কোন স্তর নেই। তোমরা আল্লাহর কাছে দোআ কর যেন তিনি এ স্তরটি আমাকে দান করেন। [মুসনাদে আহমাদঃ ১১৩৭৪ আবু সাঈদ আল-খুদরী হতে]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যখন মুয়াযযিন আযান দেয়, তখন মুয়াযযিন যা বলে, তোমরাও তাই বল। এরপর দুরূদ পাঠ কর এবং আমার জন্য ওসীলার দোআ কর’। [মুসলিমঃ ৩৮৪]
ওসীলা শব্দটি কুরআন কারীমে দুটি স্থানে এসেছেঃ সূরা আল-মায়েদার ৩৫ নং আয়াত এবং সূরা আল-ইসরার ৫৭ নং আয়াত। আয়াতদ্বয়ে ওসীলার অর্থ হলঃ আল্লাহকে সন্তুষ্টকারী কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন।
অসীলার প্রকারভেদঃ অসীলা দু প্রকারঃ শরীআতসম্মত অসীলা ও নিষিদ্ধ.
২। নিশ্চয় যারা কুফর করেছে, কিয়ামতের দিন শাস্তি থেকে মুক্তির জন্য পণস্বরূপ যমীনে যা কিছু আছে যদি সেগুলোর সবটাই তাদের থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণও থাকে, তবুও তাদের কাছ থেকে সেসব গৃহীত হবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। তারা আগুন থেকে বের হতে চাইবে কিন্তু তারা সেখান থেকে বের হবার নয় এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।জাহান্নামের একটি লোককে জাহান্নাম থেকে বের করে আল্লাহর সামনে হাযির করা হবে। তারপর আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তুমি তোমার বাসস্থান কেমন পেয়েছ?’ সে উত্তরে বলবে; ‘অত্যন্ত খারাপ জায়গা।’ তারপর আল্লাহ আবার বলবেন, ‘তুমি কি এর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পৃথিবী পূর্ণ স্বর্ণ প্রদানে সম্মত আছ?’ সে উত্তরে বলবে, ‘হ্যাঁ।’ তারপর আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তো তোমার নিকট পৃথিবীতে এর চেয়েও বহু কম চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি সেটাও দাওনি বা পরোয়া করনি।’ অতঃপর পুনরায় তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।(মুসলিম, কিয়ামত অধ্যায় ও বুখারী রিক্বাক ও আম্বিয়া অধ্যায়
৩। চুরির শাস্তি হচ্ছে, ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত কর্তন করা। তবে কতটুকু চুরি করলে সেটা করা হবে এবং কিভাবে চুরি করলে এ শাস্তি প্রয়োগ করা হবে, এর বিস্তারিত আলোচনা ফিকহ এর কিতাবসমূহ থেকে জেনে নিতে হবে।
চুরি করার পর তাওবাহ করলে, বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার গোনাহ মাফ হবে। কিন্তু বিচারকের কাছে চুরি যদি প্রমাণিত হয়, তবে তাকে তার শাস্তি পেতেই হবে। এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই।
আল্লাহর পরিচয়ঃ নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আসমানসমূহ ও যমীনের সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই? যাকে ইচ্ছে তিনি শাস্তি দেন আর যাকে ইচ্ছে তিনি ক্ষমা করেন এবং আল্লাহ্ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
৪। মুনাফিকরা মুখে ঈমানের কথা বললেও অন্তরে ঈমানের কোন অস্তিত্ব নেই। তারা মিথ্যা শুনতে অভ্যস্ত।
কাফের ও মুশরিকদের ঈমান গ্রহণ না করা এবং সঠিক পথ অবলম্বন না করার ফলে নবী (সাঃ) যে অস্থিরতা ও আক্ষেপের শিকার হয়েছিলেন, তার জন্য আল্লাহ নিজ নবীকে অধিক চিন্তা না করার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে এ ব্যাপারে তিনি সান্ত্বনা পান যে এই লোকদের ব্যাপারে তিনি আল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসিত হবেন না।
ইহুদিদের কতগুলো ত্রুটি বা বদ অভ্যাস উল্লেখ করে তিরস্কার করা হয়েছে।
- তারা মিথ্যা ও ভ্রান্ত কথাবার্তা শোনাতে অভ্যস্ত।
- দ্বীনী বিষয় জিজ্ঞেস করতে এসেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বিষয় জানার জন্যেও আসে নি। বরং ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের গুপ্তচর, যারা অহংকারবশতঃ আপনার কাছে আসেনি। তাদের বাসনা অনুযায়ী আপনার মত জেনে এরা তাদেরকে বলে দিতে চায়। এরপর মানা না মানা সম্পর্কে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।
- তারা আল্লাহর কালামকে যথার্থ পরিবেশ থেকে সরিয়ে ভুল অর্থ করত এবং আল্লাহর নির্দেশকে বিকৃত করত। এ বিকৃতি ছিল দ্বিবিধঃ তাওরাতের ভাষায় কিছু হেরফের করা এবং ভাষা ঠিক রেখে তদস্থলে অযৌক্তিক ব্যাখ্যা ও পরিবর্তন করা
- ইয়াহুদীরা কখনো স্বজন-প্রীতির বশবর্তী হয়ে এবং কখনো নাম-যশ ও অর্থের লোভে ফতোয়াপ্রার্থীদের মনমত ফতোয়া তৈরী করে দিত।
রাসূল সা কে বলা হচ্ছে-ইচ্ছা করলে তাদের মোকাদ্দামার ফয়সালা করুন, নতুবা নির্লিপ্ত থাকুন। পরে বলা হয়েছে, যদি আপনি ফয়সালাই করতে চান, তবে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার সহকারে ফয়সালা করুন। অর্থাৎ নিজ শরীআত অনুযায়ী ফয়সালা করুন। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবী হওয়ার পর পূর্ববর্তী সমস্ত শরীআত রহিত হয়ে গেছে। কুরআনে যেসব আইন বহাল রাখা হয়েছে, সেগুলো অবশ্য রহিত হয়নি। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।
৫। سماعون শব্দের অর্থ হচ্ছে; অধিক শ্রবণকারী। আর এ কারণেই এর দুটি অর্থ হতে পারে (ক) গোয়েন্দাগিরি বা গুপ্তচরবৃত্তির জন্য শ্রবণ করা অথবা (খ) অন্যের কথা মান্য ও গ্রহণ করার জন্য শ্রবণ করা।
ইহুদীদের খারাপ অভ্যাস উৎকোচ গ্রহণ। তারা ‘সুহত’ খাওয়ায় অভ্যস্ত। ‘সুহত’ এর অর্থ করেছেন, হারাম খাওয়া।
আল্লাহ্ তা’আলা ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতার প্রতি অভিসম্পাত করেন এবং ঐ ব্যক্তির প্রতিও, যে উভয়ের মধ্যে দালালী বা মধ্যস্থতা করে। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৪/১১৫, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৭৯]
৬। আল্লাহ জানাচ্ছেন ইহুদীদের ব্যপারে- তাদের কাছে রয়েছে তাওরাত যাতে রয়েছে আল্লাহর বিধান। তা সত্বেও তারা এরপর মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তারা মুমিন নয়।
সুরা আলা মায়িদাঃ ৭ম রুকু (৪৪-৫০) আয়াত
১। আয়াতে নবীদের প্রতিনিধিবর্গকে দুই ভাগে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ভাগ ‘রব্বানী’গণ এবং দ্বিতীয় ভাগ ‘আহবার’। তন্মধ্যে ‘রব্বানী’ শব্দটির অর্থ নিয়ে কয়েকটি মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহওয়ালা বা আল্লাহভক্ত। তবে বিজ্ঞ আলেমদের মতে, শব্দটি رُبّانُ السَّفِيْنَةَ বা জাহাজের নাবিক ও কর্ণধার অর্থে। [মাজমু ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়া]
আহবার শব্দটি ‘হিবর’ বা ‘হাবর’ এর বহুবচন। ইয়াহুদীদের বাক পদ্ধতিতে আলেমকে حبر বলা হত। কাতাদা বলেন, রব্বানী হচ্ছে ফকীহগণ। আর আহবার হচ্ছে, আলেমগণ। ইবন যায়দ বলেন, রাব্বানী হচ্ছেন শাসকগণ, আর আহবার হচ্ছে আলেমগণ। [তাবারী] রাব্বানী ঐ সমস্ত জ্ঞানীদেরকে বলা হয়, যারা বড় কোন ইলম দেয়ার পূর্বে ছোট ইলম প্রদান করে, উম্মতকে প্রস্তুত করে নেন। [ফাতহুল কাদীর]
তারা এর সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছিল। [জালালাইন] অথবা, তারা এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে বলে সাক্ষ্য দিচ্ছিল। [কুরতুবী] তাদেরকে তাওরাতের সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় কর। আর আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য ক্রয় করো না। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফের।
২। আমি ইয়াহুদীদের জন্য তাওরাতের এ বিধান নাযিল করেছিলাম যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং বিশেষ জখমেরও বিনিময় আছে।” এ উম্মতের জন্যও কিসাসের উক্ত বিধান পুরোপুরি প্রযোজ্য।
আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই যালিম।
৩।তাওরাত তার যুগে সঠিক বা হক ছিল এবং তারপর ইঞ্জীলও তার যুগে সঠিক ও হক ছিল। ইঞ্জীল অবতীর্ণ হওয়ার পর তাওরাতের উপর আমল বৈধ ছিল না। অতঃপর যখন কুরআন অবতীর্ণ হল, তখন ইঞ্জীল রহিত হয়ে গেল; তার উপর আমল করা বৈধ নয়। বলা বাহুল্য, একমাত্র বিধান ও (ইহ-পরকালে) মানুষের মুক্তির উপায় কুরআনই। কুরআনের উপর ঈমান ও আমল ব্যতীত মুক্তি লাভ সম্ভব নয়।
ঈসা (আঃ)-এর নবুঅত কালে আহলে ইঞ্জীলদেরকে এই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল-তদনুসারে হুকুম দেয়। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই ফাসেক।
৪। কুর’আন নাযযিল করেছেন যা অন্যান্য কিতাবের সত্যায়নকারীও। এই কুর’আনের বিধান অনুযায়ী ফয়সালা/বিচার করার নির্দেশ। কিতাবীদের খেয়াল খুশির অনুসরন না করা। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমরা একটা করে শরীয়ত ও স্পষ্টপথ নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে এক উম্মত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। কাজেই সৎকাজে তোমরা প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহ্র দিকেই তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছিলে, সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন।
৫। আল্লাহ তার রাসূল সা কে সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন-তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না এবং তাদের ব্যাপারে সতর্ক হোন, যাতে আল্লাহ্ আপনার প্রতি যা নাযিল করেছেন তারা এর কোন কিছু হতে আপনাকে বিচ্যুত না করে।যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তাদেরকে কেবল তাদের কোন কোন পাপের জন্য শাস্তি দিতে চান। আর নিশ্চয় মানুষের মধ্যে অনেকেই তো ফাসেক।
আল্লাহ আরো জানাচ্ছেন-তারা জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে? আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর?
রাসূল সা বলেছেনঃ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছে তিনজন। যে ব্যক্তি হারাম শরীফের মধ্যে অন্যায় কাজ করে, যে ব্যক্তি মুসলিম হওয়া সত্বেও জাহেলী যুগের রীতি-নীতি অনুসন্ধান করে এবং যে ব্যক্তি কোন অধিকার ব্যতীত কারো রক্তপাত দাবী করে। [বুখারীঃ ৬৮৮২]
সুরা আলা মায়িদাঃ ৮ম রুকু (৫১-৫৬) আয়াত
১। এখানে ইয়াহুদ ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা তারা ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কথাও ঘোষণা করা হয়েছে যে, তারা তদেরই দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। আল্লাহ জানিয়েছেন- হে বিশ্বাসীগণ! ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।
২। এখানে যাদের অন্তরে অসুখ রয়েছে বলে মুনাফিকদের বুঝানো হয়েছে। তারা ইয়াহুদীদের সাথে গোপন শলা-পরামর্শ ও তাদের খাতির করে কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করে, মনে করে – মুসলিমরা পরাজিত হলে তার ফলে হয়তো আমাদেরকেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু যদি ইয়াহুদীদের সাথে মিত্রতা-বন্ধুত্ব থাকে, তাহলে সেই সময়ে আমাদের বড়ই উপকার হবে।
৩। মক্কা বিজয় বা আল্লাহর ফয়সালা দেখে মুনাফিকরা তখন ইয়াহুদীদের সাথে তাদের যে গোপন আতাত, ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও তাদের বিরুদ্ধাচারণ ও এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপের জন্য লজ্জিত হবে।
যখন মুনাফেকদের মুখোশ উন্মোচিত হবে এবং তাদের বন্ধুত্বের দাবী ও শপথের স্বরূপ ফুটে উঠবে, তখন মুসলিমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলবে, এরাই কি আমাদের সাথে আল্লাহর নামে কঠোর শপথ করে বন্ধুত্বের দাবী করত?
৪। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা বলেন, এ আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠোর হুশিয়ারী দেয়া হচ্ছে যে, যারাই আল্লাহর পথ ও তাঁর দ্বীন থেকে পিছু ফিরে যাবে, তারা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ্ তাআলা তার দ্বীনের জন্য নতুন কোন জাতিকে এগিয়ে আনবেন। [তাবারী] যাদের চারটি স্পষ্ট গুণ বর্ণনা করা হয়েছে; (ক) আল্লাহর প্রতি ভালবাসা রাখা ও তাঁর ভালবাসার পাত্রতে পরিণত হওয়া। (খ) ঈমানদারদের প্রতি কোমল ও বিনম্র এবং কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর হওয়া। (গ) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। এবং (ঘ) আল্লাহর ব্যাপারে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে পরোয়া না করা। সাহাবায়ে কেরামগণ (রাঃ) এই সমস্ত গুণের অধিকারী ছিলেন। যার কারণে আল্লাহ তাঁদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে মহা সৌভাগ্যবান বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর দুনিয়াতেই তিনি তাঁদের প্রতি সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন।
আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাময়।
৫।আল্লাহ জানাচ্ছেন- তোমাদের বন্ধু তো কেবল আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনগণ- যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং তারা বিনীত। যে আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তবে নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী। পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে সবাই প্রত্যক্ষ করে নিয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম সবার উপর জয়ী হয়েছেন। এটি মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় সুসংবাদ।
আয়াতে মুসলিমদের গভীর বন্ধুত্ব ও বিশেষ বন্ধুত্ব যাদের সাথে হতে পারে, তাদের গুণাগুণ বর্ণনা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, প্রথমতঃ তারা পূর্ণ আদব ও শর্তাদিসহ নিয়মিত সালাত আদায় করে। দ্বিতীয়তঃ স্বীয় অর্থ-সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করে। তৃতীয়তঃ তারা বিনম্র ও বিনয়ী স্বীয় সৎকর্মের জন্য গর্বিত নয়, তারা মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করে। [সা’দী]
সুরা আলা মায়িদাঃ ৯ম রুকু (৫৭-৬৬) আয়াত
১। হে ঈমানদারগণ, তোমরা তাদেরকে সাথী অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যারা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও খেলা মনে করে। এরা দুই দলে বিভক্ত এক. আহলে কিতাব সম্প্রদায়। দুই. মুশরিক সম্প্রদায়। তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শত্রু, সেহেতু তাদের সাথে মু’মিনদের বন্ধুত্ব হতে পারে না।
২। আযানের আওয়াজ শুনে তা নকল করতে থাকে ৷ ঠাট্টা-তামাশা ও বিদ্রূপ করার জন্য তার শব্দ বদল ও বিকৃত করে এবং তা নিয়ে টিটকারী দেয় ও ভেংচি কাটে ৷ তাদের এ কাজগুলো নিছক মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার ফল ৷ আল্লাহ ইবাদাতের জন্য আহবান জানানো হলে তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করাকে কোন বিবেকবান ব্যক্তি পছন্দ করতে পারেন না।
৩। আল্লাহ জানাচ্ছেন- হে কিতাবীরা! একমাত্র এ কারণেই তো তোমরা আমাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে, আমরা আল্লাহ্ ও আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং যা আগে নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান এনেছি। আর নিশ্চয় তোমাদের অধিকাংশ ফাসেক।
৪। (আল্লাহর নিকট) অধিক নিকৃষ্ট ও পথভ্রষ্ট এবং ঘৃণার পাত্র ও তিরস্কারযোগ্য লোক কারাঃ এরা তারাই, যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের উপর তিনি রাগান্বিত হয়েছেন, আর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে বানর ও শূকরে পরিণত করেছেন এবং যারা তাগূত (গায়রুল্লাহ)এর পূজা করেছে।
৫। মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা নবী (সাঃ)-এর নিকট কুফরী অবস্থায় উপস্থিত হয় এবং কুফরী অবস্থাতেই প্রস্থান করে, আর নবী (সাঃ)-এর সাহচর্য, তাঁর নসীহত ও উপদেশ কোন কিছুই তাদের উপর প্রভাবশীল হয় না। কেননা তাদের হৃদয় কুফরীর কলুষতায় পরিপূর্ণ, পাপে, সীমালংঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে তৎপর। তারা যা করে, নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট!
৬। কোন কোন মুফাসসির বলেন, রব্বানী বলে নাসারাদের আলেম সম্প্রদায়, আর আহবার বলে ইয়াহুদীদের আলেমদের উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। “সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ” করার কর্তব্যটি ত্যাগ করে ইয়াহুদীদের এসব মাশায়েখ ও আলেম অত্যন্ত বদভ্যাসে লিপ্ত হয়েছে।
এরা যা করছে নিশ্চয়ই তা কতই না নিকৃষ্ট। রাসূলুল্লাহ সা বলেনঃ কোন জাতির মধ্যে যখন কোন পাপ কাজ করা হয় অথচ কোন লোক তা নিষেধ করে না, তখন তাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব প্রেরণের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে যায়। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৩৬৩]
৭। আরবী প্রবাদ অনুযায়ী কারোর হাত বাঁধা থাকার অর্থ হচ্ছে সে কৃপণ ৷ দান-খয়রাত করার ব্যাপারে তার হাত নিষ্ক্রীয় ৷ কাজেই ইহুদীদের একথার অর্থ এ নয় যে, সত্যিই আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে ৷ বরং এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ কৃপণ।
আল্লাহ তাআলা যখন নিজের রাস্তায় খরচ করার জন্য উৎসাহিত করলেন এবং এটাকে তিনি ‘উত্তম ঋণদান’ বলে অভিহিত করলেন,তখন ওরা এই কথা বলে। আয়াতে বলা হয়েছে যে, হাত তো তাদেরই বাঁধা হবে এবং তাদের প্রতি অভিসম্পাত হবে, যার ফলে আখেরাতে আযাব এবং দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও অবমাননা ভোগ করতে হবে। আল্লাহ্ তা’আলার হাত সব সময়ই উন্মুক্ত রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সা বলেনঃ আল্লাহর ডান হাত পরিপূর্ণ। খরচ করে তা কমানো যায় না। রাত-দিন সবাইকে তিনি দিচ্ছেন। তোমরা কি দেখনা আসমান-যমীনের সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি তিনি সবাইকে যা দিচ্ছেন, তাতে তার ডান হাতে যা আছে তার একটুও কমেনি। আর তার আরশ রয়েছে পানির উপর। তার অপর হাতে রয়েছে গ্রহণ করা। উন্নতি এবং অবনতি তারই হাতে। [বুখারীঃ ৭৪১৯, মুসলিমঃ ৯৯৩] আল্লাহ্ তা’আলা মুসলিমদেরকে তাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তাদের বিভিন্ন দলের মধ্যে ঘোর মতানৈক্য সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। ফলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে সাহসী হয় না এবং তাদের কোন চক্রান্তও সফল হয় না।
আল্লাহ জানাচ্ছেন- কিতাবীরা ঈমান এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে তাদের পাপসমূহ অবশ্যই মুছে সুখময় জান্নাতে প্রবেশ করাতেন।
৮। যদি ইয়াহুদীরা আজও তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনুল কারীমের নির্দেশাবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে,প্রতিষ্ঠিত থাকতো হকের উপর, তবে তারা আখেরাতে প্রতিশ্রুত নেয়ামতরাজির যোগ্য হবে এবং দুনিয়াতেও তাদের সামনে রিযকের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। উপর-নীচ সবদিক থেকে তাদের উপর রিযক বর্ষিত হবে।
ইয়াহুদীদের যেসব বক্রতা ও কুকর্ম বর্ণনা করা হয়েছে, তা সমস্ত ইয়াহুদীদের অবস্থা নয়; বরং তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি দল সৎপথের অনুসারীও রয়েছে,যারা পূর্বে ইয়াহুদী অথবা নাসারা ছিল, এরপর কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সা এর প্রতি ঈমান এনেছে।
সুরা আলা মায়িদাঃ ১০ম রুকু (৬৭-৭৭) আয়াত
১। এখানে দ্বীন প্রচারের আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ জানাচ্ছেন- হে রাসূল! আপনার রবের কাছ থেকে আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা প্রচার করুন; যদি না করেন তবে তো আপনি তার বার্তা প্রচার করলেন না। আর আল্লাহ আপনাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।
আদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, যা কিছু তোমার উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে কম-বেশী (সংযোজন-বিয়োজন) না করে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া না করে, তুমি মানুষের নিকট পৌঁছে দাও। সুতরাং তিনি এমনটিই করেছিলেন।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এই ধারণা পোষণ করে যে, নবী (সাঃ) কিছু জিনিস গোপন রেখেছেন, (প্রকাশ বা প্রচার করেননি), সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে মিথ্যাবাদী। (বুখারী ৪৮৫৫নং) একদা আলী (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হল যে, আপনাদের নিকট কুরআন ব্যতীত অহীর মাধ্যমে অবতীর্ণকৃত কোন জিনিস আছে কি? উত্তরে তিনি কসম করে বললেন, না। তবে কুরআন উপলব্ধি করার জ্ঞান, আল্লাহ যাকে দান করেন। (বুখারী)
বিদায় হজ্জের সময় এক লক্ষ অথবা এক লক্ষ চল্লিশ হাজার সাহাবার সামনে মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন, ‘‘তোমরা আমার ব্যাপারে কি বলবে?’’ তাঁরা সকলেই বলেছিলেন যে,‘আমরা সাক্ষ্য দেব যে, (আপনার উপর যে গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তা) পৌঁছে দিয়েছেন, (আমানত) আদায় করে দিয়েছেন এবং (উম্মতের জন্য) হিতাকাঙ্ক্ষা ও নসীহত করেছেন।’ মহানবী (সাঃ) আসমানের দিকে আঙ্গুল তুলে ইঙ্গিত করে তিনবার বললেন, ‘‘হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি?’’ অথবা তিনি তিনবার বললেন, ‘‘আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।’’ (মুসলিম) অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার বাণী পৌঁছে দিয়েছি। তুমি সাক্ষী থাকো, তুমি সাক্ষী থাকো, তুমি সাক্ষী থাকো।
২। হে ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়! তোমরা দ্বীনের কোন অংশেই নেই। কেননা, কুরআনের উপরও তোমাদের ঈমান নেই, নবীর উপরও নেই। অনুরূপভাবে, তোমরা তোমাদের নবী, কিতাব, শরীআত কিছুই অনুসরণ করনি। সুতরাং তোমরা কোন হকের উপর নও, কোন ভিত্তিকেও আকড়িয়ে থাকতে পারনি। সুতরাং তোমরা কোন কিছুরই মালিক হবে না। যদি তোমরা শরীআতের নির্দেশাবলী পালন না কর, তবে তোমরা কিছুই নও।
৩। আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা চারটি সম্প্রদায়কে ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানিয়ে এর কারণে আখেরাতে মুক্তির ওয়াদা করেছেন,তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না
প্রথম সম্প্রদায় হচ্ছে (الَّذِينَ آمَنُوا) অর্থাৎ মুসলিম। দ্বিতীয়তঃ (وَالَّذِينَ هَادُوا) অর্থাৎ ইয়াহুদী। তৃতীয়তঃ نَصَارَىٰ; অর্থাৎ নাসারা, যারা ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারী বলে দাবী করে থাকে। চতুর্থতঃ সাবেউন । সাবেয়ীন সম্পর্কে চিহ্নিতকরণের ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। মুজাহিদ বলেন, সাবেয়ীরা হচ্ছে, নাসারা ও মাজুসীদের মাঝামাঝি এক সম্প্রদায়, যাদের কোন দ্বীন নেই। অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, তারা ইয়াহুদী ও মাজুসীদের মাঝামাঝি এক সম্প্রদায়। সাঈদ ইবন জুবাইর বলেন, তারা ইয়াহুদী ও নাসারাদের মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে।
কাতাদাহ বলেন, তারা ফেরেশতাদের পূজা করে থাকে এবং আমাদের কিবলা ব্যতীত বর্তমানে তাদের অধিকাংশই ইরাকে বসবাস করে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা বলেন, তাদের মধ্যে দু’টি দল রয়েছে। একটি মুশরিক, অপরটি একত্ববাদের অনুসারী। [মাজমূ’ ফাতাওয়া]অন্যদিকে সালাত আদায় করে থাকে। আর তারা যাবুর পাঠ করে থাকে।
৪।বনী ইসরাইলদের কথা বলা হয়েছে- যখনি কোন রাসূল তাদের কাছে এমন কিছু আনে যা তাদের মনঃপূত নয়, তখনি তারা রাসূলগণের কারও উপর মিথ্যারোপ করেছে এবং অপর কাউকে হত্যা করেছে। তারা ধারণা করেছিল যে, তাদের কর্মে কোন শাস্তি সন্নিবিষ্ট নেই। কিন্তু উল্লিখিত আল্লাহর নিয়ম মোতাবেক এই শাস্তি সন্নিবিষ্ট ছিল যে, তারা সত্য দর্শনের ব্যাপারে অধিক অন্ধ এবং সত্য শ্রবণ করার ব্যাপারে অধিক বধির হয়ে গেল। আর তওবা করার পর পুনরায় সেই কর্মেই লিপ্ত হল, তাই তাদের শাস্তিও দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্ত হল।
৫। আহলে কিতাবদের ভ্রষ্টতার কথা পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এ আয়াতে তাদের ঐ ফির্কার কুফরীর কথা প্রকাশ পেয়েছে, যারা মাসীহ (ঈসা (আঃ))-কে স্বয়ং আল্লাহ বলে।
৬। আয়াতে খ্রিষ্টানদের দ্বিতীয় ফির্কা, যারা তিন ঈশ্বরের দাবীদার ছিল, খ্রিষ্টানরা ঈসা (আঃ) ও তাঁর মাতা মারয়্যাম (‘আ)-কে উপাস্য হিসাবে গণ্য করে। আর আল্লাহ তৃতীয় উপাস্য বা মা’বুদ। যাকে তারা ‘তিনের তৃতীয়’ বলে আখ্যায়ন করে। তাদের প্রথম বিশ্বাসের মতই আল্লাহ এ বিশ্বাসকেও কুফরী বলে মন্তব্য করেছেন।
৭। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তবে কি তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে না ও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু
৮। মরিয়ম আ ছিলেন صديقة শব্দের অর্থ; মু’মিন ও অলী। অর্থাৎ, তিনিও ঈসা (আঃ)-এর উপর ঈমান আনয়নকারী এবং তাঁকে সত্যজ্ঞানকারীদের একজন ছিলেন। ঈসা (আঃ) এবং মারয়্যাম (‘আ) আল্লাহ বা উপাস্য ছিলেন না; বরং তাঁরা উভয়ে মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। যেহেতু পানাহার করা মানুষের দৈহিক চাহিদা ও প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে গণ্য।
৯। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত কর যার কোন ক্ষমতা নেই তোমাদের ক্ষতি বা উপকার করার? আর আল্লাহ তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
১০। সত্যের অনুসরণ করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম করো না। যাঁর সম্মান প্রদর্শন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করে তাঁকে আল্লাহর আসনে অধিষ্ঠিত করো না। যেমন ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে তোমরা করেছ।
সুরা আলা মায়িদাঃ ১১তম রুকু (৭৮-৮৬) আয়াত
১। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, বনী ইসরাঈলরা ইঞ্জীলে ঈসা আলাইহিস সালামের মুখে লা’নত প্রাপ্ত হয়েছিল। আর যাবূরে দাউদ আলাইহিস সালামের মুখে লা’নত প্রাপ্ত হয়েছিল। [তাবারী]
আল্লাহর অভিশাপের হেতু। (ক) অবাধ্যতা; অর্থাৎ, ওয়াজেব কর্ম ত্যাগ করে এবং হারাম কর্ম সম্পাদন করে তারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিল। (খ) সীমালঙ্ঘন; অর্থাৎ, অতিরঞ্জন ও বিদআত রচনা করে তারা সীমালংঘন করেছিল।গ। এর উপর (অভিশাপের) অতিরিক্ত কারণ হল, তারা একে অপরকে মন্দ কর্ম হতে বাধা প্রদান করত না, যা স্বস্থানে একটা বড় অপরাধ।
কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ফল এই যে, আল্লাহ তাদের উপর অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত হয়েছেন। আর এই অসন্তুষ্টির পরিণাম হচ্ছে, জাহান্নামের চিরস্থায়ী শাস্তি। ভাবার্থ এই যে, যার মধ্যে প্রকৃতার্থে ঈমান আছে, সে কষ্মিনকালেও কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করবে না।
২। ইয়াহুদীদের মধ্যে একগুঁয়েমি, হঠকারিতা, হক থেকে বিমুখতা, দাম্ভিকতা ও গর্ব এবং জ্ঞানী ও ঈমানদারদের অবজ্ঞা করার প্রবণতা ব্যাপক প্রচলিত। আর এ জন্যেই নবীগণকে হত্যা ও তাঁদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়।
رهبان এর ভাবার্থ; সৎ, আবেদ, সংসার-বিরাগী বা নির্জনবাসী আর قسيسين এর ভাবার্থ; পন্ডিত। অর্থাৎ, এই খ্রিষ্টানদের মধ্যে জ্ঞান ও বিনয় আছে। আর এই জন্যই ইয়াহুদীদের মত তাদের হঠকারিতা ও দাম্ভিকতা ছিল না।
আল্লাহ ইহুদীদের থেকে খৃষ্টানদের নম্র বলেছেন। এই কারণে ইয়াহুদীদের তুলনায় খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের নিকটতর। খ্রিষ্টানদের এই প্রশংসা ইয়াহুদীদের মোকাবেলায় করা হয়েছে। নচেৎ ইসলাম-বিদ্বেষের অভ্যাস কম-বেশী তাদের মধ্যেও আছে।
৩। আলোচ্য আয়াতসমূহে মুসলিমদের সাথে শক্রতা ও বন্ধুত্বের মাপকাঠিতে ঐসব আহলে কিতাবের কথা আলোচনা করা হয়েছে, যারা সত্যানুরাগ ও আল্লাহভীতির কারণে মুসলিমদের প্রতি হিংসা ও শক্রতা পোষণ করত না। আল্লাহ জানাচ্ছেন- রাসূলের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা যখন তারা শুনে, তখন তারা যে সত্য করে তার জন্য আপনি তাদের চোখ অশ্রু বিগলিত দেখবেন। তারা বলে, হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি; কাজেই আপনি আমাদেরকে সাক্ষ্যবহদের তালিকাভুক্ত করুন।
৪। হাবশা নামক স্থানে, যেখানে মুসলিমগণ মক্কী জীবনে দুইবার হিজরত করেছিলেন, যেখানে আসহামা নাজাশীর শাসন ছিল। এটি খ্রিষ্টান-রাষ্ট্র বলে পরিচিত ছিল। এই আয়াত হাবশায় অবস্থানরত খ্রিষ্টানদের শানেই অবতীর্ণ হয়
নাজাশীর ও মুসলমানদের হিজরতের ঘটনা।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন নবী করীম (সাঃ) নাজাশী বাদশাহর মৃত্যুর সংবাদ পেলেন, তখন তিনি সাহাবা কেরাম (রাঃ)-কে বললেন, হাবশাতে তোমাদের ভাই নাজাশীর ইন্তেকাল হয়েছে, তাঁর জানাযার নামায আদায় কর। সুতরাং নবী করীম (সাঃ) মুসাল্লায় তাঁর গায়েবী জানাযার নামায আদায় করলেন। (বুখারী, মুসলিম)
৫। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তাদের এ কথার জন্য আল্লাহ তাদের পুরস্কার নির্দিষ্ট করেছেন জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; তারা সেখানে স্থায়ী হবে। আর এটা মুহসিনদের পুরস্কার। যারা কুফরী করেছে ও আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছে, তারাই জাহান্নামবাসী।
আলহামদুলিল্লাহ
৬ষ্ঠ পারা সমাপ্ত