৫।আমার রমাদান, আপণ সাথী আল কুর’আন- ৫ম পারা

 

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
কুরআন মাজীদঃ ৫ম পারা

মোট রুকুঃ  ১৬রুকু

সূরা সমূহঃ আন নিসাঃ (৫-২১) রুকু

 

 

power point presentation——–

৫ম পারাঃ আন নিসাঃ (৫-২১) রুকু

 

সূরা আন নিসাঃ ৫ম রুকু(২৬-৩৩)আয়াত

১। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের মা ও কন্যাদের হারাম হওয়ার ব্যাপারটি বিস্তারিত বর্ণনা করতে চান। আর এটাও জানিয়ে দিতে চান যে, এটা পূর্বে কখনও হালাল ছিল না। সব শরীআতেই মা ও মেয়ে হারাম ছিল। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

যারা ব্যভিচার বা অন্য মতাদর্শে বিশ্বাসী যেমন, ইয়াহুদী অথবা নাসারা, তারা চায় মুসলিমরাও যেন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, প্রবৃত্তি-পুজারী হোক। [তাবারী]

আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দিতে ও হালকা ও সহজ বিধান দিতে চান।

২। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল। তার মাঝে কাম-বাসনার উপাদানও নিহিত রয়েছে। যদি তাকে নারীদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকার আদেশ দেয়া হত, তবে সে আনুগত্য করতে অক্ষম হয়ে পড়ত। আর তাই স্বাধীন নারীদেরকে বিয়ে করার শক্তি না থাকার ক্ষেত্রে বাদীদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দান করেছেন। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সুবিচারের শর্তে একাধিক বিয়ে করার অনুমতিও দিয়েছেন।

৩। মুমিনদের আদেশ দেয়া হয়েছে-

ক) পরস্পরের মধ্যে অন্যায় পন্থায় একের সম্পদ অন্যের ভোগ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। নিজস্ব সম্পদও অন্যায় পথে ব্যয় করা কিংবা অপব্যয় করা নিষিদ্ধ।

খ) ব্যবসা পরস্পরের সন্তুষ্টি সহকারে হালাল পথে করার কথা এসেছে।

‘‘ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ততক্ষণ পর্যন্ত (ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে) এখতিয়ার থাকে, যতক্ষণ না তারা একে অপর থেকে পৃথক হয় (বুখারী, মুসলিম) তবে- পৃথক হওয়ার পরও এ সুযোগ তাদের জন্য থাকবে-যারা খেয়ার বা সুযোগের অধিকার দেয়ার শর্তে সওদা করবে।” [বুখারী: ২১০৭]

গ) যেসব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্তাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পন্থায় সম্পদ অর্জন করা হারাম ও বাতিল পন্থা। ব্যবসা আল্লাহর রিযক ও হালালকৃত বিষয়, তবে শর্ত হচ্ছে, এটাকে সত্যবাদিতা ও সততার সাথে পরিচালনা করতে হবে।

ঘ) নিজেদের হত্যা করোনা—আত্মহত্যা বা অন্য মুসলিমকে হত্যা বা বড় গুনাহ করা।

রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে বলে যে, আমি অন্য কোন ধর্মের উপর। তাহলে সে ঐ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বনী আদম যার মালিক নয় এমন মানত গ্রহণযোগ্য নয়। যে কেউ দুনিয়াতে নিজেকে কোন কিছু দিয়ে হত্যা করবে, এটা দিয়েই তাকে কেয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে। যে কোন মুমিনকে লা’নত করল সে যেন তাকে হত্যা করল। অনুরূপভাবে যে কেউ কোন মুমিনকে কুফরীর অপবাদ দিল, সেও যেন তাকে হত্যা করল। [বুখারীঃ ৬০৪৭, মুসলিমঃ ১৭৬]

৪। জেনে-শুনে সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ কাজ করবে। তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন।

৫। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তোমাদের ছোট পাপগুলো ক্ষমা করা হবে এবং সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করানো হবে যদি কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকে।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা বলেনঃ এমন প্রত্যেক গোনাহ যার পরিণতিতে কুরআন ও হাদীসে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে অথবা আল্লাহর গযবের কথা এসেছে, অথবা লানতের কথা অথবা আযাবের কথা এসেছে, তাই কবীরা গোনাহ। কবীরা গোনাহর সংখ্যা অনেক। কেউ কেউ তা সাতশ’ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন। [তাবারী, ইবন আবী হাতেম]

৬। উম্মে সালামা (রাঃ)  আরজি পেশ করলেন যে, পুরুষরা জিহাদে অংশ গ্রহণ করে শাহাদাত লাভে ধন্য হন, কিন্তু আমরা মহিলারা এই ফযীলতপূর্ণ কাজ থেকে বঞ্চিতা। আমাদের মীরাসও পুরুষদের অর্ধেক। এই কথার ভিত্তিতে এই আয়াত নাযিল হয়। (মুসনাদ আহমাদ ৬/৩২২)

আল্লাহ জানাচ্ছেন- যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। আর আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।

আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ঐ সমস্ত গুণ-বৈশিষ্টের ক্ষেত্রেই অন্যের সাথে প্রতিযেগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন, যেগুলো মানুষের সাধ্যায়ত্ত, যেগুলো চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে মানুষ অর্জন করতে পারে।

নারী-পুরুষের মধ্যে কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা এবং শক্তিমত্তার যে ব্যবধান, তা হল মহাশক্তিমান আল্লাহর এমন অটল ফায়সালা, যা কেবল কামনা করলেই পরিবর্তন হয়ে যায় না। তবে তাঁর অনুগ্রহে শ্রম ও উপার্জনের যে ঘাটতি, তা দূর হয়ে যেতে পারে।

৭। প্রত্যেক নারী-পুরুষের ত্যক্ত সম্পদের ওয়ারেস হবে তার পিতা-মাতা এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয়রা।

ইবন আব্বাস রা বলেনঃ মুহাজেররা যখন মদীনায় হিজরত করে আসত, তখন আনসারদের নিকটাত্মীয়দের বাদ দিয়ে যাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন মুহাজেররা তাদের ওয়ারিস হত। তারপর যখন আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়, তখন তা রহিত হয়ে যায়। [বুখারীঃ ২২৯২, ৪৫৮০, ৬৭৪৭]

‘আর যাদের সাথে তোমরা অংগীকারাবদ্ধ তাদেরকে তাদের অংশ দেবে’ এ আয়াত নাযিল হয়, তখন কেউ কেউ অপর কারও সাথে বংশীয় কোন সম্পর্ক না থাকা সত্বেও চুক্তিবদ্ধ হতো, এর ফলে একে অপরের ওয়ারিশ হতো। তারপর যখন আল্লাহর বাণী ‘আর আত্মীয়রা আল্লাহর বিধানে একে অন্যের চেয়ে বেশী হকদার’ [সূরা আল-আনফাল: ৭৫; আল-আহযাব: ৬] এ আয়াত নাযিল হয়, তখন তাও রহিত হয়ে যায়। [মুস্তাদরাকে হাকিম ৪/৩৪৬; তাবারী]

আল্লাহর পরিচয়ঃ আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু। আল্লাহ সর্বকিছুর সম্যক দ্রষ্টা।

সূরা আন নিসাঃ ৬ষ্ঠ রুকু(৩৪-৪২)আয়াত

১। আয়াতে পুরুষদের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বশীলতার দু’টি কারণ বলা হয়েছে। ১ম হল, আল্লাহ প্রদত্তঃ যেমন, পুরুষোচিত শক্তি ও সাহস এবং মেধাগত যোগ্যতা সৃষ্টিগতভাবেই নারীর তুলনায় অনেক বেশী। ২য় টি হল সব-উপার্জিতঃ এই দায়িত্ব শরীয়ত পুরুষের উপর চাপিয়েছে।

২। পূন্যবতি নারীর গুনাবলী আল্লাহ জানিয়েছেন-

ক) তার স্বামীর যা আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন তার আনুগত্য করা।

খ) স্বামীর ধন ও নিজেদের ইজ্জত রক্ষাকারিণী;

সবচেয়ে উত্তম নারী হল ঐ স্ত্রী যার দিকে তুমি তাকালে তোমাকে সে খুশী করে। তাকে নির্দেশ দিলে আনুগত্য করে। তুমি তার থেকে অনুপস্থিত থাকলে সে তার নিজেকে এবং তোমার সম্পদকে হেফাযত করে। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/২৫১, ৪৩২, ৪৩৮, মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/১৬১]

৩। সেসব স্ত্রীলোক, স্বামীদের আনুগত্য করে না কিংবা যারা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। আল্লাহ তা’আলা সংশোধনের জন্য পুরুষদেরকে যথাক্রমে তিনটি উপায় বাতলে দিয়েছেন।

প্রথম পর্যায়ঃ নরমভাবে তাদের বোঝাবে। যদি তাতেও বিরত না হয়

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ সাময়িকভাবে তার সংসর্গ থেকে পৃথক হতে হবে। বুদ্ধিমতী মহিলার জন্য এটা বড় সতর্কতার বিষয়। যাতে এই পৃথকতার দরুন সে স্বামীর অসন্তুষ্টি উপলব্ধি করে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে পারে।

৩য় পর্যায়ঃ  তাতেও সংশোধন না হয়, তবে মৃদুভাবে মারবে, তিরস্কার করবে। আর তার সীমা হল এই যে, শরীরে যেন সে মারধরের প্রতিক্রিয়া কিংবা যখম না হয়। কিন্তু এই পর্যায়ের শাস্তি দানকেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেননি, বরং তিনি বলেছেনঃ ভাল লোক এমন করে না। [ইবন হিব্বানঃ ৯/৪৯৯, নং ৪১৮৯, আবু দাউদঃ ২১৪৬, ইবন মাজাহঃ ১৯৮৫]

যদি এ তিনটি ব্যবস্থার ফলে তারা তোমাদের কথা মানতে আরম্ভ করে, তবে তোমরাও আর বাড়াবাড়ি করো না এবং দোষ খোঁজাখুঁজি করো না, বরং কিছু সহনশীলতা অবলম্বন কর।

৪। উল্লিখিত তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও যদি কোন ফল না হয়, তাহলে চতুর্থ ব্যবস্থাপনার উল্লেখ এসেছে। সরকার, উভয় পক্ষের মুরুব্বী-অভিভাবক অথবা মুসলিমদের কোন শক্তিশালী সংস্থা তাদের (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে আপোষ করিয়ে দেয়ার জন্য দু’জন সালিস নির্ধারণ করে দেবেন। একজন স্বামীর পরিবার থেকে এবং একজন স্ত্রীর পরিবার থেকে।

যদি তারা উভয়ে নিষ্পত্তির ইচ্ছা রাখে, তাহলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে দেবেন।

সালিস অর্থে حكم (হাকাম) শব্দ প্রয়োগ করে কুরআন নির্বাচিত সালিসদ্বয়ের প্রয়োজনীয় গুণ-বৈশিষ্টের বিষয়টিও নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, এতদুভয়ের মধ্যেই বিবাদ মীমাংসা করার গুণ থাকতে হবে। এ গুণটি সে ব্যক্তির মধ্যেই থাকতে পারে, যিনি বিজ্ঞও হবেন এবং তৎসঙ্গে বিশ্বস্ত ও দ্বীনদারও হবেন।

৫। আল্লাহ আদেশ দিচ্ছেন—

তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর ও কোন কিছুকে তার শরীক করো না;

সদ্ব্যবহার করার কথা বলেছেন- পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্থ, নিকট প্রতিবেশী, দুর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি।

সেগুলোর ব্যাপারে সে সমস্ত লোকই শৈথিল্য প্রদর্শন করে যাদের মন-মানসিকতায় আত্মগর্ব, অহমিকা, তাকাব্বুর(অহংকার) ও দাম্ভিকতা বিদ্যমান।

৬। আল্লাহ কাদের পছন্দ করেন নাঃ

  • নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।
  • যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তা গোপন করে। بخل বা কাপণ্য শব্দটি সাধারণ ও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে অর্থ-সম্পদ, জ্ঞান ও অধিকার সংক্রান্ত সমস্ত কার্পণ্যই অন্তর্ভুক্ত।
  • যারা মানুষকে দেখাবার জন্য  তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে
  • এবং আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনে না। আর শয়তান কারো সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কত মন্দ!

৭। আল্লাহ জানাচ্ছেন যে, তারা আল্লাহ ও আখেরাতে ইমান এনে দান করলে কি ক্ষতি হতো তাদের!

৮। আখেরাতের অবস্থা সম্পর্কে জানাচ্ছেন-

  • আল্লাহ অণু পরিমাণও যুলুম করেন না। আর কোন পূণ্য কাজ হলে আল্লাহ সেটাকে বহুগুণ বর্ধিত করেন এবং আল্লাহ তার কাছ থেকে মহাপুরস্কার প্রদান করেন।

আল্লাহ বলেন, “আর কেয়ামতের দিনে আমরা ন্যায়বিচারের দাড়িপাল্লা স্থাপন করব, সুতরাং কারো প্রতি কোন যুলুম করা হবে না।” [সূরা আল-আম্বিয়া: ৪৭]

সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বের হবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখান যায়, কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে সে তা দেখবে, আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকাজ করলে সে তাও দেখবে। [সূরা আয-যালযালাহ: ৬-৮]

  • যখন হাশরের ময়দানে প্রত্যেক উম্মতের নবীগণকে নিজ নিজ উম্মতের পাপ-পুণ্য ও সৎ-অসৎ আমলের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করা হবে এবং যখন রাসূল সা নিজের উম্মতের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। একদা রসূল (সাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কাছ থেকে কুরআন শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি কুরআন শুনাতে শুনাতে যখন এই আয়াতে এসে পৌঁছলেন, তখন রসূল (সাঃ) বললেন, থামো, যথেষ্ট হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি দেখলাম তাঁর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। (সহীহ বুখারী)
  • হাশরের মাঠে কাফেরদের দূরাবস্থাঃ এরা কিয়ামতের দিন কামনা করবে যে, হায়! আমরা যদি ভূমির সাথে মিশে যেতাম, এখানকার জিজ্ঞাসাবাদ ও হিসাব-নিকাশ থেকে যদি অব্যাহতি লাভ করতে পারতাম।
  • তারা আল্লাহ হতে কোন কথাই গোপন করতে পারবে না। তাদের হাত-পা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বীকার করবে, নবীরাসূলগণ সাক্ষ্য দান করবেন এবং আমলনামাসমূহেও সবকিছু বিধৃত থাকবে

আল্লাহর  নামঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ,   عَلِیۡمً     সবিশেষ অবহিত خَبِیۡر

সূরা আন নিসাঃ ৭ম রুকু(৪৩-৫০)আয়াত

১। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামী শরীআতকে একটি বৈশিষ্ট্য এই দান করেছেন যে, এর প্রতিটি বিধি-বিধানকে তিনি সরল ও সহজ করেছেন।এখানে যে নির্দেশ ছিল ঐ সময়ে, যখন মদ হারাম হওয়ার কথা তখনো নাযিল হয়নি। মুমিনদের বলা হয় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়ো না।যার মর্ম ছিল এই যে, সালাতের সময় সালাতের প্রতি মনোনিবেশ করা ফরয। এতে মুসলিমগণ উপলব্ধি করলেন যে, এটা এমন এক মন্দ বস্তু যা মানুষকে সালাতে বাধা দান করে। এটা হল মদের ব্যাপারে দ্বিতীয় নির্দেশ যা শর্ত-সাপেক্ষ।)সূরা আল-মায়েদার আয়াতে মদের অপবিত্রতা ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ নাযিল হল।(১মঃ বাক্বারাহর (২১৯ নং) ২য়ঃ (নিসা ৪৩) ৩য়ঃআল-মায়িদাহঃ ৯০-৯১)।

আলী রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ মদ হারাম হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে এক আনসার দাওয়াত দিল। দাওয়াত শেষে আব্দুর রহমান ইবন আউফ এগিয়ে গিয়ে মাগরিবের সালাতের ইমামতি করলেন। তিনি সূরা আল-কাফেরুন তেলাওয়াত করতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেললেন। ফলে এ আয়াত নাযিল হয় যাতে মদ খাওয়ার পর বিবেকের সুস্থতা না ফেরা পর্যন্ত সালাত আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে।  আবু দাউদঃ ৩৬৭১; তিরমিযী: ৩০২৬

২। আয়াতে অপবিত্র অবস্থাতেও নামায পড়া নিষেধ। কারণ, নামাযের জন্য পবিত্রতা অত্যাবশ্যক। অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য গোসলের বিধানের কথা এসেছে।

অপবিত্র অবস্থায় তোমরা মসজিদে বসো না, তবে মসজিদ হয়ে কোথাও যাওয়ার দরকার হলে যেতে পার। কোন কোন সাহাবীর ঘর এমন ছিল যে, সেখানে মসজিদের সীমানা হয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁদের কোন উপায় ছিল না। আর এই কারণেই মসজিদ-সীমানার ভিতর হয়ে অতিক্রম করে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

৩। তায়াম্মুমের বিধান নাযিল হয়।

আয়েশা রা থেকে বর্ণিত, এক সফরে তিনি তার বোন আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে একটি হার ধার করে নিয়েছিলেন। তিনি সেটা হারিয়ে ফেলেন।—-( বুখারীঃ ৩৩৬, মুসলিমঃ ৩৬৭

এ সহজ ব্যবস্থাটি একমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদীকেই দান করা হয়েছে।

যাদের জন্য তায়াম্মুম বিধেয়(পানি না পাওয়া গেলে) (ক) অসুস্থ ব্যক্তি বলতে এমন রোগীকে বুঝানো হয়েছে, যে ওযু করলে ক্ষতি অথবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা করে। (খ) সফর বা মুসাফির সাধারণ শব্দ তাতে সফর লম্বা হোক বা সংক্ষিপ্ত(গ) পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন পূরণকারী এবং (ঘ) স্ত্রীর সাথে সহবাসকারী।

‘‘পানি না পাওয়া গেলে যমীনের মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। (মুসলিম ৫২২নং)

তায়াম্মুম কিভাবে করবেঃ আল্লাহ জানিয়েছেন-فَامۡسَحُوۡا بِوُجُوۡهِکُمۡ وَ اَیۡدِیۡکُمۡ

“মাসেহ কর তোমরা তোমাদের চেহারা ও হাত”

তায়াম্মুমের নিয়ত করে, বিসমিল্লাহ বলে উভয় হাত মাটিতে মারবে। অতঃপর তাতে ফুঁ দিয়ে মুখমন্ডল ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত উপরিভাগ মাসাহ করবে।

৪। আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইয়াহুদী নাসররা নিজেরা পথভ্রষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঈমানদারদেরকেও পথভ্রষ্ট করতে চায়

৫। আল্লাহ তোমাদের শত্রুদেরকে ভালভাবে জানেন। আর অভিভাবকত্বে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সাহায্যেও আল্লাহই যথেষ্ট।(کَفٰی بِاللّٰهِ وَلِیًّا ٭۫ وَّ کَفٰی بِاللّٰهِ نَصِیۡرًا)

৬। ইয়াহুদীদের বহু ধৃষ্টতার মধ্যে এটাও ছিল যে, তারা ‘আমরা শুনলাম’ বলার সাথে সাথেই বলতো,‘অমান্য করলাম।’ অর্থাৎ, আমরা তোমার আনুগত্য করব না। এটা মনে মনে বলত অথবা নিজেদের সঙ্গী-সাথীদেরকে বলত বা অতি বড় অভদ্রতা ও বাহাদুরী দেখিয়ে সামনা-সামনিই বলে দিত। অনুরূপ غَيْرَ مُسْمَعٍ অর্থাৎ, তোমার কথা যেন শোনা না হয়, বদ্দুআ করে এ রকম বলত। অর্থাৎ, তোমার কথা যেন গৃহীত না হয়।

আল্লাহ জানাচ্ছেন- তারা যদি বলত, শুনলাম ও মান্য করলাম এবং শুনুন ও আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন, তবে তা তাদের জন্য ভাল ও সঙ্গত হত।

তাদের অবিশ্বাসীর জন্য আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন। তাদের মধ্যে ঈমান আনয়নকারী লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য হবে।

৭।রাসূল সা দাওয়াত দিয়ে বলেন, হে ইয়াহুদীরা তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং ঈমান আন। আল্লাহর শপথ, তোমরা জান যে, আমি যা নিয়ে এসেছি তা বাস্তবিকই হক। তখন তারা বলল, মুহাম্মাদ আমরা তা জানি না। তারা যা জানত তা অস্বীকার করল এবং কুফরতে বহাল রইলো। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন,( তোমরা ঈমান আন, আমরা মুখমণ্ডলগুলোকে বিকৃত করে তারপর সেগুলোকে পিছনের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার আগে অথবা আসহাবুস সাবতকে যেরূপ লা’নত করেছিলাম সেরূপ তাদেরকে লা’নত করার আগে। আর আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হয়েই থাকে।)

‘আসহাবুস সাবত’ অর্থ শনিবারের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ। তারা আল্লাহর নির্দেশকে হীলা-বাহানা করে অমান্য করেছিল। তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বানরে রুপান্তরিত করেছিলেন। [ সূরা আল-বাকারাহ: ৬৫]

৮। আয়াতে আল্লাহ তা’আলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে যেসব বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, যে কোন সৃষ্ট বস্তুর ব্যাপারে তেমন কোন বিশ্বাস পোষণ করাই হল শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন সৃষ্ট বস্তুকে ইবাদাত কিংবা মহব্বত ও সম্মান প্রদর্শনে আল্লাহর সমতুল্য মনে করাই শির্ক। আল্লাহর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না

যুলুম ও অবিচার তিন প্রকার। এক প্রকার(শির্ক) যুলুম যা আল্লাহ্ তাআলা কখনো ক্ষমা করবেন না। দ্বিতীয় প্রকার(আল্লাহর হকে ক্রটি করা) যুলুম যা মাফ হতে পারে। আর তৃতীয় প্রকার(বান্দার হক বিনষ্ট করা) যুলুমের প্রতিশোধ আল্লাহ তা’আলা না নিয়ে ছাড়বেন না। [ইবন কাসীর]

৯। ইয়াহুদীরা নিজ মুখেই নিজেদের বড়াই ও প্রশংসা করত।মূলত: আত্মপ্রশংসা এবং নিজেকে ক্রটিমুক্ত মনে করা বৈধ নয়।নিষিদ্ধতার কয়েকটি কারণ রয়েছে-

  • আত্মপ্রশংসার কারণ হয়ে থাকে অহমিকা বা আত্মগর্ব। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর প্রশংসা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, তা হচ্ছে জবাই করা।ইবন মাজাহঃ ৩৭৪৩
  • দ্বিতীয়তঃ শেষ পরিণতি সম্পর্কে শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই অবগত যে, তা পবিত্রতা কিংবা পরহেযগারীর মধ্যেই হবে কিনা। কাজেই নিজে নিজেকে পবিত্র বলে আখ্যায়িত করা তাকওয়ার পরিপন্থি।

তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে পাপমুক্ত বলে বর্ণনা করো না। কারণ, একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন, তোমাদের মধ্যে কে পবিত্র। অতঃপর বাররাহ(পাপমুক্ত) নামটি পাল্টিয়ে তিনি যয়নব রেখে দিলেন। বুখারীঃ ৫৮৩৯,

  • সে নিজেকে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত বলে যা মিথ্যা
  • মানুষ জানে না তার কৃত আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হচ্ছে কিনা।

একে অপরের প্রশংসা করা বিশেষ করে আত্মপ্রশংসা করার দাবী জায়েয নয়। ‘‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। আল্লাহই ভাল জানেন তোমাদের মধ্যে আল্লাহভীরু কে?’’ সূরা নাজমঃ ৩২

রসূল (সাঃ) এক ব্যক্তিকে অপরজনের মুখোমুখি প্রশংসা করতে দেখলে বললেন, হায় হায়! তুমি তোমার সঙ্গীর গর্দান কেটে ফেললে।তিনি বলেন,‘তোমাদের মধ্যে যদি কাউকে একান্তই তার সঙ্গীর প্রশংসা করতে হয়, তাহলে সে যেন বলে, আমি ওকে এইরূপ মনে করি। আর আল্লাহর জ্ঞানের উপর কারো প্রশংসা করি না।(বুখারী ২৬৬২নং)

কনুই –  مِرْفَقٌ (ج) مَرَافِقُ   হাত –  يَدٌ (ج) أَيْدٍ

আল্লাহর নামঃ   ক্ষমাশীল-   عَفُوًّ   – غَفُوۡرً- পাপ মোচনকারী

সূরা আন নিসাঃ ৮ম রুকু(৫১-৫৯)আয়াত

১। ইহুদীরা কিতাবধারী হওয়া সত্ত্বেও ‘জিব্‌ত (শয়তান, মূর্তি, গণক অথবা যাদুকর) এবং ‘তাগূত’(মিথ্যা উপাস্য)-এর উপর বিশ্বাস রাখে এবং মক্কার কাফেরদেরকে মুসলিমদের চেয়ে বেশী হিদায়াতপ্রাপ্ত মনে করে।

আল্লাহ এদেরকে লা’নত করেছেন এবং আল্লাহ যাকে লা’নত করেন আপনি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবেন না।লা’নত ও অভিসম্পাত এর অর্থ হল, আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরে সরে পড়া- চরম অপমান, অপদস্থতা।

২। আল্লাহর রাজ্যে ইহুদীদের কোন অংশ নেই। এতে তাদের কোন অংশ থাকলে এই ইয়াহুদীরা এত কৃপণ কেন যে, তারা মানুষকে বিশেষ করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে একটি ‘নাক্বীর’ পরিমাণও কিছু দেয় না। আর نَقِيْرٌ (নাক্বীর) বলা হয় খেজুরের আঁটির পিঠের বিন্দুকে। (ইবনে কাসীর)

৩। আয়াতে ইয়াহুদীদের হিংসার কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলুল্লাহ সা কে যে জ্ঞানৈশ্বর্য ও শান-শওকত দান করেছিলেন, তা দেখে ইয়াহুদীরা হিংসার অনলে জ্বলে মরত। মহান আল্লাহ বানী-ইসরাঈলদেরকে বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্য থেকে (সর্বশেষ) নবী কেন বানালেন?

আলেমগণ বলেন, হাসাদ বা ঈর্ষা হচ্ছে, অন্যের প্রাপ্ত নেয়ামতের অপসারণ কামনা করা। যা হারাম ও নিন্দনীয়। আল্লাহ জানিয়েছেন-ইবরাহীমের বংশধরকেও কিতাব ও হিকমত দিয়েছিলাম এবং আমরা তাদেরকে বিশাল রাজ্য করেছিলাম।

৪। কিছু ইহুদী ঈমান এনেছিলো। যারা আনে নি তাদের জন্য জাহান্নাম।

৫। আল্লাহ জানিয়েছেন-যারা আমাদের আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে অবশ্যই তাদেরকে আমরা আগুনে পোড়াব; যখনই তাদের চামড়া পুড়ে পাকা দগ্ধ হবে তখনই তার স্থলে নতুন চামড়া বদলে দেব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করে।

৬। কাফেরদের বিপরীত ঈমানদারদের জন্য যারা আমলে সালেহ করে তাদের জন্য জান্নাতে নিরবচ্ছিন্ন যে নিয়ামত হবে এই আয়াতে তার আলোচনা করা হচ্ছে।

৭। চিরস্নিগ্ধ ঘন এবং পবিত্র ছায়া বলতে পরিপূর্ণ আরামকে বুঝানো হয়েছে। ‘জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ আছে এর ছায়ায় যদি কোন আরোহণকারী ভ্রমণ করতে চায় তাহলে একশত বছর ভ্রমণ করতে পারবে। তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াত পড়তে পার “আর সম্প্রসারিত ছায়া।” [সূরা আল ওয়াকিয়াঃ ৩০, বুখারীঃ ৩২৫২] তারা চিরস্থায়ী হবে।

৮। প্রথম আয়াতটি নাযিল হওয়ার একটি বিশেষ ঘটনা রয়েছে। উসমান বিন ত্বালহা (রাঃ)-এর ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তিনি বংশগতভাবেই কা’বা শরীফের তত্ত্বাবধায়ক এবং তার চাবি-রক্ষক ছিলেন। তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর রসূল (সাঃ) কা’বা শরীফে উপস্থিত হয়ে তওয়াফ ইত্যাদি সেরে নিয়ে উসমান বিন ত্বালহা (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। অতঃপর তাঁর হাতে কা’বা শরীফের চাবি হস্তান্তর করে বললেন, এগুলো তোমার চাবি। আজকের দিন হল, অঙ্গীকার পূরণ ও পুণ্যের দিন। ইবনে কাসীর

যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমান নেই। আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিয়মানুবর্তিতা নেই, তার দ্বীন নেই’। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১৩৫]

মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট।

ইসলামের কয়েকটি মৌলিক নীতির আলোচনাও এসে গেছে। প্রথমতঃ প্রকৃত হুকুম ও নির্দেশ দানের মালিক আল্লাহ তা’আলা। পৃথিবীর শাসকবর্গ তার আজ্ঞাবহ।

দ্বিতীয়তঃ সরকারী পদসমূহ অধিবাসীদের অধিকার নয়, যা জনসংখ্যার হারে বন্টন করা যেতে পারে; বরং এগুলো হল আল্লাহ প্রদত্ত আমানত, যা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দায়িত্বের পক্ষে যোগ্য ও যথার্থ লোককেই দেয়া যেতে পারে।

তৃতীয়তঃ পৃথিবীতে মানুষের যে শাসন, তা শুধুমাত্র একজন প্রতিনিধি ও আমানতদার হিসেবেই হতে পারে। দেশের আইন প্রণয়নে সে সমস্ত নীতিমালার অনুসরণে বাধ্য থাকবে যা একক ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে বাতলে দেয়া হয়েছে। চতুর্থতঃ তাদের নিকট যখন কোন মোকদ্দমা আসবে, তখন বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা এমনকি দ্বীন ও মতবাদের পার্থক্য না করে সঠিক ও ন্যায়সংগত মীমাংসা করে দেয়া শাসন কর্তৃপক্ষের উপর ফরয।

৯।  ঈমাদারদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের(উলিল আমর)।

‘উলুল আমর’ আভিধানিক অর্থে সে সমস্ত লোককে বলা হয়, যাদের হাতে কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে। সে কারণেই ইবন আব্বাস রা, মুজাহিদ ও হাসান বসরী র প্রমূখ মুফাসসিরগণ ওলামা ও ফোকাহা সম্প্রদায়কে ‘উলুল আমর’ সাব্যস্ত করেছেন। তারাই হচ্ছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নায়েব বা প্রতিনিধি ৷ তাদের হাতেই দ্বীনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত।

মুফাসসিরীনের আবু হোরায়রা রা প্রমূখ সাহাবায়ে কেরাম বলেছেন যে, ‘উলুল আমর এর অর্থ হচ্ছে সে সমস্ত লোক, যাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। ইমাম সুদ্দী এ মত পোষণ করেন। তাফসীরে ইবন কাসীরে  এ শব্দটির দ্বারা (ওলামা ও শাসক) উভয় শ্রেণীকেই বোঝায়।

প্রকৃত বিষয় হলো এই যে, হুকুম চলার দুটি প্রেক্ষিত রয়েছে। (এক) জবরদস্তিমূলক। এটা শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠী বা সরকার দ্বারাই সম্ভব হতে পারে। (দুই) বিশ্বাস ও আস্থার দরুন হুকুম মান্য করা। আর সেটা ফকীহগণই অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং যা সর্বযুগে মুসলিমদের অবস্থার দ্বারা প্রতিভাত হয়।

أَلاَ لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ‘‘জেনে রাখো, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান তাঁরই কাজ।’’ (আরাফঃ ৫৪) [اِنِ الْحُكْمُ إلاَّ للهِ] ‘‘বিধান দেওয়ার অধিকার শুধু আল্লাহরই।’’ (ইউসুফঃ ৪০)

‘যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। (নিসাঃ ৮০)

আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই।(মুসলিম ১৮৪০নং)

((إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي المَعْرُوْفِ)) ‘‘আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে। (বুখারী ৭১৪৫)

আলেম-উলামা,আমীর ও শাসকের আনুগত্য করা জরুরী হলেও তা একেবারে শর্তহীনভাবে নয়, বরং তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের শর্তসাপেক্ষ।

১০। কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।

আল্লাহর পরিচয়ঃ  নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা

সূরা আন নিসাঃ ৯ম রুকু(৬০-৭০)আয়াত

১। যারা ঈমানের দাবী করে অথচ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বা বিচারের সমাধান পেতে তাগূতের কাছে যায়(আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন), শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।

আয়াতের নির্দেশ ব্যাপক; এতে এমন সব লোক শামিল, যারা কিতাব ও সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের ফায়সালার জন্য এ দু’টিকে বাদ দিয়ে অন্য কারো শরণাপন্ন হয়। মু’মিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই যে, যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম।(সূরা নূরঃ ৫১)

২। (তাগুদের কাছে যাওয়ার ফলে) যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের কোন মুসীবত হবে? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করে আপনার কাছে এসে বলবে, আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ছাড়া অন্য কিছু চাইনি।

৩। এরাই(যারা তাগুদের কাছ থেকে ফিরে এসে বলে) তো তারা, যাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদেরকে উপেক্ষা কর, তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদেরকে তাদের সম্বন্ধে মর্মস্পর্শী কথা বল।

এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, উপেক্ষা, ক্ষমা, ওয়ায-নসীহত এবং হৃদয়স্পর্শী উত্তম কথা দ্বারা শত্রুদের ষড়যন্ত্রসমূহকে ব্যর্থ করার প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত।

৪। ৬১-৬৪ নং আয়াত পর্যন্ত মুনাফিকদের উদ্দেশ্যে হেদায়াত দেয়া হয়েছে।

এখানে বলা হল যে, হে নবী! তারা তোমার কাছে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তুমিও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। এটা এই জন্য যে, তারা বিবাদের ফায়সালা গ্রহণের জন্য অন্যের শরণাপন্ন হয়ে রসূল (সাঃ)-এর অসম্মান করেছিল। এটা দূর করার জন্য তাঁর কাছে আসার তাকীদ করা হয়।

এ আয়াতটি মুনাফিকদের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং রাসূলের জীবদ্দশায়ই তার পক্ষে তাদের কথা শোনা ও তাদের জন্য দো’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্ভব। রাসূলের মৃত্যুর পর তার কবরের কাছে এসে এ আয়াত তেলাওয়াত করে রাসূলের কাছে দোআ করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও শির্ক।

৫।  আপনার রবের শপথ তারা মুমিন হবে না যতক্ষন পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।

আয়াতের অর্থ হল, রসূল (সাঃ)-এর কোন কথা অথবা কোন ফায়সালার ব্যাপারে বিরোধিতা করা তো দূরের কথা সে ব্যাপারে অন্তরে কোন ‘কিন্তু’ রাখাও ঈমানের পরিপন্থী

এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সঠিক কারণ হল, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের বলেন, আনসারী এক ব্যক্তির সাথে খেজুর গাছে পানি দেয়া নিয়ে তার ঝগড়া হয়। আনসারী বলল, পানির পথ পরিস্কার করে দাও যাতে তা আমার জমির উপর যায়। যুবায়ের তা দিতে অস্বীকার করলে তারা উভয়ে রাসূলুল্লাহ সা এর কাছে শালিসের জন্য আসলেন। রাসূল সা সব শুনে বললেনঃ যুবায়ের তুমি তোমার জমিতে পানি দেয়ার পর তোমার পড়শীর জমিতে পানি দিয়ে দিও। লোকটি তা শুনে বলল, আপনার ফুফাত ভাই তো তাই। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা এর চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করল এবং তিনি বললেন, যুবায়ের তুমি তোমার জমিতে পানি দেয়ার পর তা দেয়াল পর্যন্ত আটকে রাখ। যুবায়ের বলেন, আল্লাহর শপথ, আমার মনে হয় এ আয়াতটি এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাযিল হয়েছে। [বুখারীঃ ২৩৫৯, ২৩৬০, মুসলিমঃ ২৩৫৭]

৬। আল্লাহর নির্দেশ  যা করতে তাদেরকে নসীহত করা হচ্ছে, তা পালন করলে, তা তাদের জন্য উত্তম এবং (দ্বীনে) সুদৃঢ় থাকার মাধ্যম সাব্যস্ত হবে। আল্লাহর কাছ থেকে মহা পুরস্কার পাবে এবং সরল পথে পরিচালিত করবেন।

৭। কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সিদ্দীক (সত্যনিষ্ঠ), শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ যাদের প্রতি আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ করেছেন- তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী! এখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করার প্রতিদানের কথা বলা হচ্ছে।

(المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ) “মানুষ তার সাথে থাকবে, যাকে সে ভালোবাসে।” (বুখারী ৬১৬৮, মুসলিম ২৬৪১নং) আনাস (রাঃ) বলেন, রসূল (সাঃ)-এর এই কথা শুনে সাহাবাগণ যত আনন্দিত হয়েছিলেন এত আনন্দিত আর কখনও হন নি। কারণ, তাঁরা জান্নাতেও রসূল (সাঃ)-এর সঙ্গ লাভ চাইতেন।

কোন কোন সাহাবী তো বিশেষভাবে রসূল (সাঃ)-এর সাথে জান্নাতে থাকার দরখাস্ত করেছিলেন। (أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِي الجَنَّةِ) আর এর জন্য রসূল (সাঃ) তাদেরকে বেশী বেশী নফল নামায পড়ার তাকীদ করেছিলেন। (فَأَعِنِّي عَلى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُوْدِ) ‘‘তুমি বেশী বেশী সিজদা করে আমার সাহায্য কর। (মুসলিম ৪৮৯নং)

রাসূল সা-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হল যে, সে লোকটির মর্যাদা কেমন হবে, যে লোক কোন গোষ্ঠীর ভালবাসা পোষণ করে, কিন্তু আমলের বেলায় এ দলের নির্ধারিত মান পর্যন্ত পৌছতে পারেনি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ প্রতিটি লোকই যার সাথে তার ভালবাসা, তার সাথে থাকবে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, পৃথিবীতে কোন কিছুতেই আমি এতটা আনন্দিত হইনি যতটা এ হাদীসের কারণে আনন্দিত হয়েছি। কারণ, এ হাদীসে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, রাসূল সা সাথে যাদের গভীর ভালবাসা রয়েছে তারা হাশরের মাঠেও তার সাথেই থাকবেন। [বুখারীঃ ৬১৬৭, মুসলিমঃ ২৬৩৯]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ “জান্নাতবাসীরা নিজেদের জানালা দিয়ে উপরের শ্রেণীর লোকদেরকে তেমনিভাবে দেখতে পাবে, যেমন পৃথিবীতে তোমরা সূদুর দিগন্তে নক্ষত্রকে দেখ। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কি শুধু নবী-রাসূলগণ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ অবশ্যই না, এমন কিছু লোক যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং নবী-রাসূলদের সত্যায়ন করেছে।” [বুখারীঃ ৩২৫৬, মুসলিমঃ ২৮৩১]

আল্লাহর অনুগ্রহ। সর্বজ্ঞ হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।

সূরা আন নিসাঃ ১০ম রুকু(৭১-৭৬)আয়াত

১। হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন কর; তারপর হয় দলে দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হও অথবা একসঙ্গে অগ্রসর হও।

আয়াতের প্রথমাংশে জিহাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং আয়াতের দ্বিতীয় অংশে জিহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এমন এক সময় নাযিল হয়েছিল যখন ওহোদ যুদ্ধের পরাজয়ের পর মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল এবং বিপদ আপদ চতুর্দিক থেকে মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলেছিল৷ সে সময় প্রায় প্রতিদিনই নানান ধরনের দুঃসংবাদ আসতো৷ উমুক গোত্র বিরূপ হয়ে গেছে৷ মুসলমানদের সাথে এক নাগাড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল৷ তাদের প্রচারকদেরকে দীন প্রচারের উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিয়ে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করা হতো৷ মদীনার বাইরে তাদের জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না৷ এ অবস্থায় এসব বিপদের ঢেউয়ের আঘাতে যাতে ইসলামের তরী ডুবে না যায় সেজন্য মুসলমানদের সতর্কতামূলক প্রস্তুতি রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সুশৃংখল নিয়ম বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যখন জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে, তখন একা একা বাহির হবেনা, বরং ছোট ছোট দলে বাহির হবে কিংবা (সম্মিলিত) বড় সৈন্যদল নিয়ে বাহির হবে।

২। মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছে-  এর জিহাদের ব্যপারে গড়িমসি করবেই। অতঃপর তোমাদের কোন মুসীবত হলে সে বলবে, তাদের সঙ্গে না থাকায় আল্লাহ্ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।

পক্ষান্তরে যখন মুসলিমদের কোন বিজয়ের কথা শুনত, তখন তারা বোল পাল্টিয়ে ফেলত যাতে করে যুদ্ধলন্দ সম্পদে ভাগ বসাতে পারে। যদিও মুসলিমদের বিজয় তাদের মনের জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। [আদওয়াউল বায়ান]

৩। আল্লাহ জানাচ্ছেন–যারা দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাত ক্রয় করে তারা যেন আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে; এবং যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, অতঃপর নিহত অথবা বিজয়ী হয়, তাহলে আমি তাকে মহান প্রতিদান প্রদান করব।

আল্লাহর পথে লড়াই করা দুনিয়ার লাভ ও দুনিয়ার স্বার্থ পূজারী লোকদের কাজ নয়৷ এটা এমন এক ধরনের লোকের কাজ যারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করে। যারা আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে এবং নিজেদের পার্থিব প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির সমস্ত সম্ভাবনা ও সব ধরনের পার্থিব স্বার্থ একমাত্র আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়৷

ইবনে কাসীর – মু’মিনের তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত, যারা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবনকে ক্রয় করে। অর্থাৎ, যারা দুনিয়ার সামান্য মালের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে দিয়েছে। এ থেকে মুনাফিক এবং কাফেরদেরকে বুঝানো হয়েছে।

৪। আল্লাহ মুমিনদের বলছেন- তোমাদের কি হল যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে? মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেন যাতে তারা জিহাদের মাধ্যমে সেই নিপীড়িতদেরকে কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন।

মুমিনরা আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে দুটি বিষয়ে দোআ করেছিলেন। একটি হলো এই যে, এই (মক্কা) নগরী থেকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করুন এবং দ্বিতীয়টি হলো, কোন সহায় বা সাহায্যকারী পাঠান। আল্লাহ তাদের দুটি প্রার্থনাই কবুল করে নিয়েছিলেন।

হিজরতের পর সেখানে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট মুসলিমগণ – বিশেষ করে বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলা এবং ছোট শিশুরা কাফেরদের যুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দু’আ করতেন।

প্রথম প্রকার হল, আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা, প্রচার-প্রসার এবং তাকে জয়যুক্ত করার জন্য জিহাদ করা।

জিহাদের দ্বিতীয় প্রকারঃ আলেমগণ বলেছেন, মুসলিমরা যদি এই ধরনের যুলুম-অত্যাচারের শিকার হয় এবং কাফেরদের বেষ্টনে অবরুদ্ধ থাকে, তাহলে তাদেরকে কাফেরদের যুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জিহাদ করা অন্য মুসলিমদের উপর ফরয হয়ে যায়।

৫। কাফের এবং মু’মিন উভয়েরই যুদ্ধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু উভয়ের যুদ্ধের লক্ষ্যের মধ্যে বিরাট তফাৎ। মু’মিন তো জিহাদ করে আল্লাহর জন্য, কেবল দুনিয়ার স্বার্থে অথবা রাজ্য জয়ের প্রবৃত্তি নিয়ে নয়। পক্ষান্তরে কাফেরের লক্ষ্য হয় কেবল এই দুনিয়ার স্বার্থ অর্জন।

মু’মিনদেরকে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে যে, ‘তাগূতী’ বা শয়তানী স্বার্থ অর্জনের জন্য যে চক্রান্ত করা হয়, তা হয় একান্ত দুর্বল। তাদের বাহ্যিক উপকরণাদির প্রাচুর্য এবং সংখ্যাধিক্যকে ভয় করো না। তোমাদের ঈমানী শক্তি এবং জিহাদের উদ্যমের সামনে শয়তানের এই দুর্বল চক্রান্ত টিকবে না।

সূরা আন নিসাঃ ১১তম রুকু(৭৭-৮৭)আয়াত

১। মক্কায় মুসলিমদের সংখ্যা ও যুদ্ধসামগ্রীর স্বল্পতার কারণে যুদ্ধ করার মত যোগ্যতা ছিল না। দু’টি বিষয়ে তাকীদ করা হয়। প্রথমঃ কাফেরদের অত্যাচারমূলক আচরণকে ধৈর্য ও হিম্মতের সাথে সহ্য করা ও তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করা। দ্বিতীয়টি হল নামায, যাকাত অন্যান্য ইসলামী নির্দেশাবলীর উপর আমল করা যাতে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর আল্লাহর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজরতের পর মদীনায় যখন মুসলিমদের সম্মিলিত শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাঁদেরকে জিহাদ করার অনুমতি দেওয়া হয়। আর এই অনুমতি পাওয়ার পর কেউ কেউ দুর্বলতা ও উদ্যমহীনতা প্রকাশ করে। তারা কিছুদিনের অবকাশ’ বলে মৃত্যু পর্যন্ত সময় চাচ্ছিল। অর্থাৎ তারা যেন বলছে যে, তাদের মৃত্যু হয়ে গেলে তারপর এ আয়াত নাযিল হওয়ার দরকার ছিল। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

২। আল্লাহ জানাচ্ছেন- পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে তাকওয়া অবলম্বন করে তার জন্য আখেরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।

দুনিয়ার নেয়ামতের তুলনায় আখেরাতের নেয়ামতসমূহকে উত্তম বলার কয়েকটি কারণ রয়েছে:

ক) দুনিয়ার নেয়ামত অল্প এবং আখেরাতের নেয়ামত অধিক।

খ) দুনিয়ার নেয়ামত ক্ষণস্থায়ী এবং আখেরাতের নেয়ামত অনন্ত-অফুরন্ত।

গ) দুনিয়ার নেয়ামতসমূহের সাথে নানা রকম অস্থিরতাও রয়েছে, কিন্তু আখেরাতের নেয়ামত এ সমস্ত জঞ্জালমুক্ত।

ঘ) দুনিয়ার নেয়ামত লাভ অনিশ্চিত, কিন্তু আখেরাতের নেয়ামত প্রত্যেক মুত্তাকী ব্যক্তির জন্য একান্ত নিশ্চিত। [তাফসীরে কাবীর]

৩। দুর্বল মুসলিমদেরকে বা মুনাফিকদের বুঝানো হচ্ছে যে, প্রথমতঃ যে দুনিয়ার জন্য তোমরা অবকাশ কামনা করছ,তা ধ্বংসশীল এবং তার ভোগ-সামগ্রী ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহর আনুগত্য না করলে চিরস্থায়ী আখেরাতে শাস্তি পেতে হবে। দ্বিতীয়তঃ জিহাদ কর আর না কর, মৃত্যু নির্ধারিত সময়েই আসবে; যদিও তোমরা কোন সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর তবুও। অতএব জিহাদ থেকে পশ্চাৎপদ হওয়ার লাভ কি?

ইবন আব্বাস রা বলেন, এখানে কল্যাণ দ্বারা বদরের যুদ্ধে বিজয় ও গনীমত লাভ  অকল্যাণ দ্বারা ওহুদের যুদ্ধে যে বিপদ সংঘটিত হয়েছিল, তা বোঝানো হয়েছে।

কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ হতে। কিন্তু এরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির স্বল্পতা এবং মূর্খতা ও যুলুম-অত্যাচারের আধিক্যের কারণে তা বোঝে না।

৪। আয়াতে ‘হাসানাহ’-এর দ্বারা নেয়ামতকে বোঝানো হয়েছে। মানুষ যা লাভ করছে তা একান্তই রবের অনুগ্রহের ফল। তাঁর নিয়ামত ও অনুদান এত বেশী যে, কোন মানুষের ইবাদত-আনুগত্য তার তুলনায় কিছুই নয়। রসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘‘জান্নাতে যে-ই যাবে, সে আল্লাহর রহমতে যাবে (অর্থাৎ, নিজের আমলের বিনিময়ে নয়)।’’ জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনিও কি আল্লাহর রহমত ব্যতীত জান্নাতে যেতে পারবেন না?’ তিনি (সাঃ) বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না তাঁর রহমতের আঁচল আমাকে আবৃত করে নেবে।’’ (বুখারী ৫৬৭৩নং)

অকল্যাণ ও অনিষ্ট যদিও আল্লাহর পক্ষ হতেই আসে যেমন كُلٌّ مِنْ عِنْدِ اللهِ বাক্যের দ্বারা তা পরিষ্কার, কিন্তু যেহেতু এই অকল্যাণ কোন পাপের শাস্তি অথবা তার বদলা হয়, তাই বলা হল, এটা তোমাদের পক্ষ হতে। অর্থাৎ, এটা তোমাদের ভুল, অবহেলা এবং পাপের ফল। যেমন, অন্যত্র বলেছেন, [وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ] ‘‘তোমাদের যেসব বিপদ-আপদ আপতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’’ (শূরাঃ ৩০)

৫। আপনাকে আমরা মানুষের জন্য রাসূলরূপে পাঠিয়েছি(৩); আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহানবী সা কে সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য রাসূল বানিয়ে পাঠানো হয়েছে।

৬। আল্লাহ জানিয়েছেন- রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে আপনাকে তো আমরা তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাই নি। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, আমার উম্মতের সকল লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু যে অস্বীকার করেছে (সে জান্নাতবাসী হতে পারবে না)। জিজ্ঞাসা করা হলঃ কে অস্বীকার করেছে, হে রাসূল! উত্তরে বললেনঃ যে আমার অনুসরণ করল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করল না, সে অস্বীকার করল। [বুখারীঃ ৭২৮০]

৭। মুনাফিকদের কথা উল্লেখ – মুনাফিকরা রাসূলের সা মজলিসে যে কথা প্রকাশ করে, রাতে তার বিপরীত কথা বলে এবং ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। রাসূল সা কে তাদের ব্যাপারে বিমুখতা অবলম্বন  এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখার কথা আল্লাহ জানিয়ে বলছেন- আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা করুন; আর কাজ উদ্ধারের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।

৮। আল্লাহ আল কুর’আন একটি নিদর্শন এ ব্যপারে জানাচ্ছেন-  তারা কুরআনকে গভীরভাবে অনুধাবন( یَتَدَبَّرُوۡنَ) করে না? যদি তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট হতে আসত, তবে তারা এতে অনেক অসঙ্গতি পেত।

পবিত্র কুরআনে কোন একটি বিষয়েও অসংগতি নেই। অতএব, এটা একান্তভাবেই আল্লাহর কালাম

৯। ভিত্তিহীন অতিরঞ্জিত আশংকার খবর এসে মদিনায় পৌঁছতো৷ এর ফলে হঠাৎ মদীনা ও তার আশেপাশে ভীতি ছড়িয়ে পড়তো ৷ কখনো ধূর্ত শত্রু কোন যথার্থ বিপদকে গোপন করার জন্য সন্তোষজনক খবর পাঠাতো এবং তা শুনে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্ত ও গাফেল হয়ে পড়তো। এই ধরনের খবর শুনে; তাতে তা শান্তির (জয়ের) হোক অথবা ভয়ের (পরাজয়ের) হোক তা সাধারণের মাঝে প্রচার না করে রসূল (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছে দাও কিংবা জ্ঞানী ও তত্ত্বানুসন্ধানীদের কাছে পৌঁছে দাও;

আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কোন শ্রুত কথা যাচাই, অনুসন্ধান ব্যতিরেকে বর্ণনা করা উচিত নয়। কোন লোকের পক্ষে মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোন রকম যাচাই না করেই সমস্ত শ্রুত কথা প্রচার করে। [মুসলিম: ৫]

আয়াতে দু’রকম লোকের নিকট খবর প্রত্যাবর্তন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের একজন হলেন রাসূল সা এবং অপরজন হচ্ছেন, ‘উলুল আমর’।

আল্লাহ জানাচ্ছেন–তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও রহমত না থাকত তবে তোমাদের অল্প সংখ্যক ছাড়া সকলে শয়তানের অনুসরণ করত।

১০। আয়াতের প্রথম বাক্যে রাসূল সা-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “আপনি একাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ুন; কেউ আপনার সাথে থাক বা নাই থাক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বাক্যে  বলা হয়েছে যে, অন্যান্য মুসলিমদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দানের কাজটিও পরিহার করবেন না। যদি তারা যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ না হয়, তবে আপনার দায়িত্ব পালিত হয়ে গেল; তাদের কর্মের জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে না।

কিসে উদ্বুদ্ধ করা হবে, তা এ আয়াতে বলা হয় নি। অন্য আয়াতে এসেছে, আর আপনি মুমিনদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করুন। [সূরা আল-আনফাল: ৬৫]

আশা করা যায় আল্লাহ কাফেরদের যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং তাদেরকে ভীত ও পরাজিত করে দেবেন। আর আপনাকে একাই জয়ী করবেন”

১১। শাফা’আত অর্থাৎ সুপারিশকে ভাল ও মন্দ দু’ভাগে বিভক্ত করে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ভালো সুপারিশ করবে, সে সওয়াবের অংশ পাবে এবং যে ব্যক্তি মন্দ সুপারিশ করবে, সে আযাবের অংশ পাবে।

আল্লাহ জানাচ্ছেন- কেউ কোন ভাল কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে এবং কেউ কোন মন্দ কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন সৎকাজে অপরকে উদ্বুদ্ধ করে, সেও ততটুকু সওয়াব পায়, যতটুকু সৎকর্মী পায়।” [মুসলিমঃ ১৮৯৩]

১২। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর নজর রাখেন(وَ کَانَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ مُّقِیۡتًا

আল্লাহর নামঃ مُّقِیۡتًا আভিধানিক দিক দিয়ে مُقِيْتٌ শব্দের অর্থ তিনটিঃ (১) শক্তিশালী, সংরক্ষক ও ক্ষমতাবান, (২) উপস্থিত ও দর্শক এবং (৩) রুযী বন্টনকারী। উল্লেখিত বাক্যে তিনটি অর্থই প্রযোজ্য।

প্রথম অর্থ- আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। যে কাজ করে এবং যে সুপারিশ করে তাদেরকে প্রতিদান কিংবা শাস্তিদান তার পক্ষে কঠিন নয়।

দ্বিতীয় অর্থ- আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক বস্তুর পরিদর্শক। কে কোন নিয়তে সুপারিশ করে; আল্লাহর ওয়াস্তে মুসলিম ভাইয়ের সাহায্যার্থে করে, না ঘুষ হিসেবে তার কাছ থেকে কোন মতলব হাসিলের উদ্দেশ্যে করে, তিনি সে সবই জানেন। তৃতীয় অর্থ রিযিক ও রুযী বন্টনের কাজে আল্লাহ স্বয়ং যিম্মাদার।

যার জন্য যতটুকু লিখে দিয়েছেন, সে ততটুকু অবশ্যই পাবে। কারো সুপারিশে তিনি প্রভাবিত হবেন না; বরং যাকে যতটুকু ইচ্ছা দেবেন। তবে সুপারিশকারী ব্যক্তি মাঝখান থেকে সওয়াব পেয়ে যাবে।

আল্লাহ তা’আলা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য অব্যাহত রাখেন, যতক্ষণ সে কোন মুসলিম ভাইয়ের সাহায্যে ব্যাপৃত থাকে। তোমরা সুপারিশ কর, সওয়াব পাবে। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় পয়গম্বরের মাধ্যমে যে ফয়সালা করেন তাতে সন্তুষ্ট থাক। [মুসলিমঃ ২৬২৭]

১৩। আয়াতে সালাম ও তার প্রতিউত্তরে উত্তম ভাবে দেয়ার কথা এসেছে।

মূলত: ‘আস-সালাম’ শব্দটি আল্লাহ্ তা’আলার উত্তম নামসমূহের অন্যতম। যার অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তার আধার। বান্দা যখন এ কথা বলে তখন সে তার ভাইয়ের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও হেফাযত কামনা করে। সে হিসেবে আস-সালামু আলাইকুম এর অর্থ, আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের সংরক্ষক।

সালামের উৎপত্তি সম্পর্কে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা যখন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন তখন তার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তা’আলা তাকে সৃষ্টি করে বললেন, যাও, ফেরেশতাদের অবস্থানরত দলকে সালাম করো এবং মন দিয়ে শুনবে, তারা তোমার সালামের কি জবাব দেয়।

এটাই হবে তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালাম। সুতরাং আদম ‘আলাইহিস সালাম গিয়ে বললেনঃ আসসালামু আলাইকুম। ফেরেশতাগণ জবাব দিলেন- ওয়া আলাইকুমুসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। ফেরেশতাগণ ওয়া রাহমাতুল্লাহ বৃদ্ধি করলেন। তারপর যারা জন্নাতে যাবে তারা প্রত্যেকেই আদম ‘আলাইহিস সালাম-এর আকৃতি বিশিষ্ট হবে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের উচ্চতা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েই আসছে। [বুখারীঃ ৬২২৭]

ইসলামী সালামে বিরাট অর্থগত ব্যাপ্তি রয়েছে। যথা, (১) এটি আল্লাহর একটি নাম। তাছাড়া এতে রয়েছে আল্লাহ তা’আলার যিকর, (২) আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়া, (৩) মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা ও সম্প্রীতি প্রকাশ, ৪) মুসলিম ভাইয়ের জন্য সর্বোত্তম দোআ এবং (৫) মুসলিম ভাইয়ের সাথে এ চুক্তি যে, আমার হাত ও মুখ দ্বারা আপনার কোন কষ্ট হবে না।

কেবল ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললে দশটি নেকী হয়, ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ যোগ করলে বিশটি নেকী হয় এবং ‘ওয়া বারাকাতুহু’ পর্যন্ত বললে ত্রিশটি নেকী হয়। (মুসনাদ আহমাদ ৪/৪৩৯-৪৪০) মনে রাখা দরকার যে, এই নির্দেশ কেবল মুসলিমদের জন্য। ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রে প্রথমতঃ তাদেরকে প্রথমে সালাম দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়তঃ তারা সালাম দিলে কোন কিছু বৃদ্ধি না করে কেবল, ‘ওয়া আলাইকুম’ বলে উত্তর দিতে হবে। (বুখারী-মুসলিম)

১৪। মানুষ এবং ইসলামী অধিকার; যথা সালাম ও সালামের জবাব ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা’আলা এগুলোরও হিসাব নেবেন।

১৫। আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোন প্রকৃত ইলাহ নেই; অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর আল্লাহ্‌র চেয়ে বেশী সত্যবাদী কে?

আল্লাহর পরিচয়ঃ আল্লাহ শক্তিতে প্রবলতর ও শাস্তিদানে কঠোরতর।

সূরা আন নিসাঃ ১২তম রুকু(৮৮-৯১)আয়াত

১। অত্র আয়াতে মুনাফিকদের সম্বন্ধে সাহাবাদের দুই মতামত উল্লেখ হয়েছে।

যায়েদ ইবন সাবেত রা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা যখন ওহুদের যুদ্ধে বের হলেন তখন তার সাথীদের মধ্য থেকে কিছু লোক ফিরে চলে আসলেন। তাদের ব্যাপারে সাহাবাগণ দ্বিমত পোষণ করলেন। কেউ বললেন হত্যা করব, কেউ বললেন হত্যা করব না। তখন এ আয়াত নাযিল হয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এই মদীনা নগরী কিছু মানুষকে দেশান্তর করে যেমনিভাবে আগুন দূর করে লোহার ময়লাকে। [বুখারীঃ ১৮৮৪, ৪০৫০, ৪৫৮৯, মুসলিমঃ ১৩৮৪, ২৭৭৬]

আল্লাহ জানাচ্ছেন-  আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তোমরা কি তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও? আর আল্লাহ কাউকেও পথভ্রষ্ট করলে আপনি তার জন্য কখনো কোন পথ পাবেন না।

كَسَبُوا (কৃতকর্ম) বলতে রসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা এবং জিহাদ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করা। أَرْكَسَهُمْ (বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন বা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন) কুফরী ও ভ্রষ্টতা দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন অথবা তার কারণে ধ্বংস করে দিয়েছেন।

২।এখানে মুনাফিক ও কাফেররা, তাদের মতো মুমিনদের কুফরিতে আসার ইচ্ছে করে। হিজরত দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়- (ক) দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করা, যতদিন তাওবা কবুল হওয়ার সময় থাকবে, ততদিন হিজরত বাকী থাকবে। [আবু দাউদঃ ২৪৭৯](খ) পাপ কাজ বর্জন করা। ঐ ব্যক্তি মুহাজির, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় বর্জন করে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৯৯]

হিজরত (দ্বীনের জন্য স্বদেশত্যাগ) করলে প্রমাণিত হয় যে, এখন সে নিষ্ঠাবান মুসলিমে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা বৈধ নতুবা নয়।

৩। ৮৮ থেকে ৯১ আয়াতসমূহে তিনটি দলের কথা বর্ণিত হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে দুটি বিধান উল্লেখিত হয়েছে।

  • মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফের জাতিদের সাথে যেসব মুনাফিক মুসলমান সম্পর্ক রাখে এবংইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও শত্রুতামূলক কার্যকলাপে কার্যত অংশগ্রহণ করে, তাদের সম্পর্কে নির্দেশনা- সেখানেই গ্রেফতার করে হত্যা কর এবং তাদের মধ্য হতে কাউকেও বন্ধু ও সহায়রূপে গ্রহণ করো না।
  • যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে দুই শ্রেণীর মানুষ এই নির্দেশ থেকে স্বতন্ত্র। একঃ এমন লোক যার সম্পর্ক এমন জাতির সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি হয়ে আছে অথবা এমন লোক যে তাদের আশ্রয়ে যাদের সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি হয়ে আছে। দুইঃ এমন লোক  না তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করতে পছন্দ করে, না তোমাদের বিরুদ্ধে। তাদেরকে যুদ্ধ করা থেকে বিরত রাখাটা আল্লাহরই অনুগ্রহের ব্যাপার।

৪। এখানে তিন দল লোকের কথা উল্লেখিত হয়েছেঃ

  • এক. (সাধারণ কাফেরদের মত)-মুসলিম হওয়ার জন্য যে সময় হিজরত করা শর্ত সাব্যস্ত হয়, সে সময় সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা হিজরত না করে কিংবা হিজরত করার পর দারুল ইসলাম ত্যাগ করে দারুল হারবে চলে যায়।
  • দুই.( হত্যা ও ধরপাকড়ের আওতা বহির্ভূত) যারা স্বয়ং মুসলিমদের সাথে ‘যুদ্ধ নয় চুক্তি করে কিংবা এরূপ চুক্তিকারীদের সাথে চুক্তি করে।
  • তিন. (প্রথম দলের অনুরূপ শাস্তির যোগ্য।)যারা সাময়িকভাবে বিপদ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তিচুক্তি করে অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহবান জানানো হলে তাতে অংশগ্রহণ করে এবং চুক্তিতে কায়েম না থাকে।

কতিপয় মুশরিক মক্কা থেকে মদীনায় আগমন করে এবং প্রকাশ করে যে, তারা মুসলিম; হিজরত করে মদীনায় এসেছে। কিছুদিন পর তারা দ্বীনত্যাগী হয়ে যায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পণ্যদ্রব্য আনার অজুহাত পেশ করে পুনরায় মক্কা চলে যায়। এরপর তারা আর ফিরে আসেনি। এদের সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দেয়। কেউ কেউ বলল এরা কাফের, আর কেউ কেউ বলল এরা মুমিন। আল্লাহ্ তা’আলা ৮৮ ও ৮৯ নং আয়াতে এদের কাফের হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং এদেরকে হত্যা করার বিধান দিয়েছেন

সূরা আন নিসাঃ ১৩ম রুকু(৯২-৯৬)আয়াত

১। একজন মু’মিনের অপর মু’মিনকে হত্যা করা নিষেধ ও হারাম।

এখানে ভুলক্রমে হত্যা হয়ে গেলে তার জরিমানা কি, তা বলা হচ্ছে। দু’টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে, কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) ও ক্ষমা স্বরূপ। আর তা হল, একজন মুসলিম ক্রীতদাস স্বাধীন করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বান্দাদের অধিকার স্বরূপ। আর তা হল, ‘দিয়াত’ রক্তপণ আদায় করা। নিহত ব্যক্তির রক্তের বিনিময় স্বরূপ যে জিনিস তার (নিহতের) উত্তরাধিকারীদেরকে দেওয়া হয়, তাকে ‘দিয়াত’ (রক্তপণ) বলা হয়। এর পরিমাণ হাদীস অনুযায়ী ১০০টি উট অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য সোনা, রূপা বা দেশে প্রচলিত মুদ্রা। ক্ষমা করে দেওয়াকে সাদাকা বলে আখ্যায়িত করার উদ্দেশ্য হল, ক্ষমা করার প্রতি উৎসাহিত করা।

২।আল্লাহ জানাচ্ছেন- যদি সে তোমাদের শত্রু পক্ষের লোক হয় এবং বিশ্বাসী হয়, তবে এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়। আর যদি সে এমন এক সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, যার সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ, তবে তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ এবং এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়।  কেউ যদি (উক্ত দাস) না পায় (বা মুক্ত করার সামর্থ্য না রাখে), তাহলে সে একাদিক্রমে দু’মাস রোযা রাখবে। তওবার (সংশোধনের) জন্য এ আল্লাহর বিধান। বস্তুতঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

৩। ইচ্ছাকৃত হত্যা করার শাস্তি বলা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত মুমিনকে হত্যার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।

এখানে ঐ লোককে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যে ইসলামকে ভালভাবে জানল, শরীআতকে বুঝল, তারপর কোন মুমিনকে হত্যা করল- তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। [বুখারীঃ ৩৮৫৫

হত্যা তিন প্রকারেরঃ (ক) ভুলক্রমে হত্যা (যা পূর্বের আয়াতে উল্লেখ হয়েছে)। (খ) প্রায় ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা; (এমন জিনিস দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা, যা দিয়ে সাধারণতঃ হত্যা করা যায় না।) যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (গ) ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা। অর্থাৎ, হত্যা করার ইচ্ছা ও নিয়ত করে হত্যা করা এবং এর জন্য সেই অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় যা দিয়ে বাস্তবিকই হত্যা করা হয়। যেমন, তরবারী, খঞ্জর ইত্যাদি

আবু বাকরাহ রা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, যখন দু মুসলিম তাদের অস্ত্র নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ব্যক্তি ও হত্যাকৃত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী।

আবু বাকরাহ বলেন, আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর ব্যাপারটা তো স্পষ্ট, কিন্তু হত্যাকৃত ব্যক্তির কি অপরাধ? তিনি জবাব দিলেন যে, সে তার সাথীকে হত্যা করার লালস করছিল। [বুখারীঃ ৬৮৭৫, মুসলিমঃ ২৮৮৮]

কেয়ামতের দিন প্রথম বিচার অনুষ্ঠিত হবে মানুষের রক্তক্ষরণ তথা হত্যার ব্যাপারে। [বুখারীঃ ৬৮৬৪, মুসলিমঃ ১৬৭৮]

৪। আয়াতের এ বাক্যে একটি সাধারণ নির্দেশঃ মুসলিমরা কোন কাজ সত্যাসত্য যাচাই না করে শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করবে না। বলা হচ্ছে- তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর কর, তখন সত্যাসত্য অনুসন্ধান করে সব কাজ করো।

যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিমরূপে পরিচয় দেয়, কালেমা পাঠ করে কিংবা অন্য কোন ইসলামী বৈশিষ্ট্য যথা আযান, সালাত ইত্যাদিতে যোগদান করে, তাকে মুসলিম মনে করা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। সে আন্তরিকভাবে মুসলিম হয়েছে না কোন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, একথা প্রমাণ করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

কিছু সাহাবী কোন অঞ্চলে গিয়েছিলেন। সেখানে এক রাখাল ছাগল চরাচ্ছিল। মুসলিমদেরকে দেখে রাখাল সালাম করল। সাহাবাদের কেউ কেউ মনে করলেন যে, (সে একজন কাফের শত্রু।) সে স্বীয় প্রাণের ভয়ে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিচ্ছে। সুতরাং তাঁরা সত্যতা যাচাই না করেই তাকে হত্যা করে দেন এবং তার ছাগলগুলো (গনীমতের মাল স্বরূপ) নিয়ে রসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী, তিরমিযী তাফসীর সূরাতুননিসা)

৫।  এমন এক সময় ছিল যখন মুসলিমরাও কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলে। যুলুম নির্যাতনের ভয়ে ইসলামের কথা বাধ্য হয়ে গোপন রাখতো। এখন আল্লাহর অনুগ্রহে তোমরা সামাজিক জীবন-যাপনের সুবিধা ভোগ করছ। কাফেরদের মুকাবেলায় ইসলামের ঝাণ্ডা বুলন্দ করার যোগ্যতা লাভ করেছ। কাজেই যেসব মুসলিম এখনো প্রথম অবস্থায় আছে তাদের ব্যাপারে কোমল ব্যবহার ও সুবিধা দানের নীতি অবলম্বন না করলে তোমাদেরকে যে অনুগ্রহ করা হয়েছে, তার প্রতি যথার্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে না।

৬। জান ও মাল সহ জিহাদে অংশ গ্রহণকারীরা বৈশিষ্ট্য লাভের অধিকারী হবে।

যারা সঙ্গত ওজরের কারণে বাড়ীতে অবস্থান করে, তারাও মুজাহিদদের মত নেকীতে সমান সমান শরীক থাকবে। কারণ, (حَبَسَهُمُ العُذْرُ) ‘‘ওজরই তাদের পথে বাধা হয়েছে। (সহীহ বুখারী, জিহাদ অধ্যায়ঃ)

আর জিহাদে যারা অংশগ্রহণ করতে পারে না, তারা এই বৈশিষ্ট্য লাভ থেকে বঞ্চিত হলেও মহান আল্লাহ উভয়কেই উত্তম প্রতিদান দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

এসব আল্লাহর কাছ থেকে মর্যাদা, ক্ষমা ও দয়া; আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

বারা ইবন আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যখন নাযিল হল “মুমিনদের মধ্যে যারা ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়” তখন আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো অন্ধ। তখন নাযিল হল “যারা অক্ষম নয়”-এ অংশটুকু। [বুখারীঃ ২৮৩১, ৪৫৯৩, মুসলিমঃ ১৮৯৮]

আবু সাঈদ খুদরী রা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, হে আবু সাঈদ! যে আল্লাহকে রব হিসাবে মেনে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে এবং মুহাম্মাদ সা কে নবী হিসাবে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট তার জন্য জান্নাত অবধারিত। আবু সাঈদ এটা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে আবার বলুন। রাসূল তাই করলেন। তারপর বললেনঃ “আরো কিছু কাজ রয়েছে, যার দ্বারা জান্নাতে বান্দার মর্যাদা উন্নত করা হয়, দু’স্তরের মাঝখানের দূরত্ব আসমান ও যমীনের মাঝখানের দূরত্বের মত। তিনি বললেন, সেটা কি? হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল বললেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। [মুসলিমঃ ১৮৮৪]

সূরা আন নিসাঃ ১৪তম রুকু(৯৭-১০০)আয়াত

১। আয়াত এমন সব লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যারা মক্কায় ও তার আশেপাশে বসবাস করত। তারা মুসলিম তো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অঞ্চল ও গোত্র ছেড়ে হিজরত করেনি। অথচ মুসলিম শক্তিকে একই স্থানে কেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যে হিজরত করার উপর মুসলিমদের জন্য অতিশয় তাকীদী নির্দেশ জারী করা হয়েছিল। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তাদের প্রাণগ্রহণের সময় ফিরিশতাগণ বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম: তারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে? এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম, আর তা কত মন্দ আবাস!

হিজরতের নির্দেশ থেকে সেই সব পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদেরকে স্বতন্ত্র করা হচ্ছে, যারা ছিল হিজরতের উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত এবং পথের ব্যাপারে অজ্ঞ।

আল্লাহ অচিরেই তাদের পাপ মোচন করবেন, কারণ আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল।

হিজরত সম্পর্কিত আয়াতসমূহে তিন রকমের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। (এক) হিজরতের ফযীলত(বাকারাহঃ ২১৮, আত-তাওবাহঃ ২০ (দুই) হিজরতের দুনিয়া ও আখেরাতের বরকত (সূরা নাহলঃ ৪১) (তিন) সামর্থ্য থাকা সত্বেও দারুল-কুফর থেকে হিজরত না করার কারণে শাস্তিবাণী।

যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও রাসূলের নিয়তে নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে পথেই মৃত্যুবরণ করে তার সওয়াব আল্লাহর যিম্মায় সাব্যস্ত হয়ে যায়”। [সূরা আন-নিসাঃ ১০০]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হিজরত পূর্বকৃত সব গোনাহকে নিঃশেষ করে দেয়। [মুসলিম: ১২১; সহীহ ইবন খুযাইমাহ ২৫১৫]

এমন কাফের দেশ থেকে হিজরত করা ফরয, যেখানে ইসলামের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী আমল করা কঠিন হয় এবং যেখানে থাকা কুফরী ও কাফেরদের উৎসাহ লাভের কারণ হয়।

২। হিজরত বাধ্যতামূলক হওয়ার সংবাদ পেয়ে অনেক সাহাবী মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করতে বের হওয়ার পর পথিমধ্যেই বিভিন্ন কারণে মারা যান। এতে কাফেররা তাদেরকে বিভিন্নভাবে উপহাস করতে আরম্ভ করল। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন, যাতে বলা হয়েছে যে, কেউ খাঁটি নিয়তে আল্লাহর পথে হিজরত করতে বের হলেই তার পক্ষ থেকে হিজরত ধরে নেয়া হবে। আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু

সূরা আন নিসাঃ ১৫তম রুকু(১০১-১০৪)আয়াত

১। কসর সালাতের নির্দেশনা এসেছে। সফরে থাকাকালীন নামায কসর (চার রাকআত বিশিষ্ট নামাযগুলো দু’রাকআত করে পড়ার) অনুমতি দেওয়া হয়েছে। إِنْ خِفْتُمْ ‘‘যদি তোমাদের ভয় হয়—’’ অধিকাংশ অবস্থার দিকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে।

কসরও শরীআতেরই নির্দেশ। এ নির্দেশ পালনে গোনাহ হয় না; বরং সওয়াব পাওয়া যায়। ইয়া’লা ইবন উমাইয়্যা বলেন, আমি উমর ইবনুল খাত্তাবকে এ আয়াতে বর্ণিত ‘যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফেররা তোমাদের জন্য ফিতনা সৃষ্টি করবে’ এটা উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করলাম যে, এখন তো মানুষ নিরাপদ হয়েছে তারপরও সালাতের কসর পড়ার কারণ কি? তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি যেটাতে আশ্চর্য হয়েছ, আমিও সেটাতে আশ্চর্যবোধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “এটা একটি সদকা যেটি আল্লাহ তোমাদের উপর সদকা করেছেন, সুতরাং তোমরা আল্লাহর সদকা গ্রহণ কর।” [মুসলিম: ৬৮৬

সফরের দূরত্ব এবং কত দিন পর্যন্ত কসর করা যেতে পারে এ ব্যাপারে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। ইমাম শওকানী যে হাদীসে তিন ফারসাখ (অর্থাৎ, ৯ ক্রোশ, এক ক্রোশ সমান প্রায় দুই মাইল)এর কথা বর্ণিত হয়েছে সেটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। (নাইনুল আওতার ৩/২২০) অনুরূপ অনেক সত্যানুসন্ধানী আলেমগণ এ কথাকে অত্যাবশ্যক বলেছেন যে, সফর করাকালীন কোন একই স্থানে তিন অথবা চার দিনের বেশী যেন অবস্থানের নিয়ত না হয়। তিন অথবা চার দিনের বেশী অবস্থানের নিয়ত হলে, নামায কসর করার অনুমতি থাকবে না।

২। আয়াতে ‘স্বালাতুল খাউফ’ভয়ের সালাত পড়ার অনুমতি বরং নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যখন মুসলিম ও কাফেরদের সৈন্য একে অপরের সাথে যুদ্ধের জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াবে এবং ক্ষণেকের অন্যমনস্কতা মুসলিমদের কঠিন বিপদের কারণ হতে পারে, এ রকম অবস্থায় যদি নামাযের সময় হয়ে যায়, তাহলে ‘স্বালাতুল খাউফ পড়ার নির্দেশ আছে।

আয়াতে উভয় দলের এক এক রাকাআত পড়ার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় রাকাআতের নিয়ম হাদীসে উল্লেখিত রয়েছে যে, রাসূল সা দুরাকাআতের পর সালাম ফিরিয়েছেন। [ বুখারী: ৯৪২: মুসলিম: ৩০৫, ৩০৬; তিরমিযী: ৩০৩৫; আবু দাউদ: ১২৪২]

৩। এ নামাযকে যেহেতু কমিয়ে হালকা করে দেওয়া হয়েছে তাই এই ঘাটতি পূরণের জন্য বলা হচ্ছে যে, দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর যিকর করতে থেকো।

ভয় ও যুদ্ধ-অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটলে, নামাযকে তার পূর্বের নিয়মে পড়বে যেভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় পড়া হয়।

আল্লাহ জানাচ্ছেন- নিশ্চয় নামাযকে বিশ্বাসীদের জন্য নির্ধারিত সময়ে অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে।

৪। আয়াতের আলোকে কাফেররা বাতিলের জন্য যে পরিমান কষ্ট স্বীকার করছে ঈমানদাররা যদি হকের জন্য অন্তত এতটুকু কষ্টও বরদাশ্‌ত করতে না পারে তাহলে তা হবে সত্যিই বিস্ময়কর৷ অথচ কাফেরদের সামনে কেবল দুনিয়া ও তার ক্ষণস্থায়ী স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নেই৷ বিপরীতপক্ষে ঈমানদাররা আকাশ ও পৃথিবীর প্রভু পরওয়ারিদগারের সন্তুষ্টি, নৈকট্য ও তাঁর চিরন্তন পুরস্কার লাভের আকাংখা পোষণ করে আসছে৷ আহত তো তোমরাও হও এবং ওরাও হয়, কিন্তু তোমাদের সমূহ আঘাতের পরিবর্তে আল্লাহর নিকট নেকী পাওয়ার আশা আছে

আল্লাহর পরিচয়ঃ  বস্তুতঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

সূরা আন নিসাঃ ১৬তম রুকু(১০৫-১১২)আয়াত

১। সূরা আন-নিসার ১০৫ থেকে ১১৩ নং আয়াত এক বিশেষ ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ঘটনাটি হচ্ছে, হিজরতের প্রাথমিক যুগে সাধারণ মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাদের সাধারণ খাদ্য ছিল যবের আট কিংবা খেজুর কিংবা গমের আটা। রিফা’আ ইবন যায়েদ রা এ ধরনের কিছু গমের আটা সংগ্রহ করে একটি বস্তায় রেখে এর মধ্যে কিছু অস্ত্র-শস্ত্রও রেখে একটি ছোট কক্ষে সংরক্ষিত রেখেছিলেন। মদীনাতে তখন বনু উবাইরাক গোত্রের বিশর, বশীর ও মুবাশশির নামীয় তিন লোক বিশেষ কারণে খ্যাতি লাভ করেছিল। তন্মধ্যে বশীর ছিল প্রকৃতই মুনাফিক। রাসূলুল্লাহ সা এর নামে বদনামী করে কবিতা রচনা করে অন্যের নামে চালিয়ে দিত। সেই বশীর সিধ কেটে রিফা’আ ইবন যায়েদের সে বস্তা বের করে নেয়। সকালে রিফা’আ রাদিয়াল্লাহু আনহু ব্যাপারটি তার ভ্রাতুষ্পপুত্র কাতাদার কাছে বিবৃত করলেন। বনু উবায়রাক বললো, সম্ভবত এটা লবীদ ইবন সাহলের কীর্তি।

লবীদ ইবন সাহল তা শুনে অত্যন্ত ক্রোধাম্বিত হলেন এবং তরবার কোষমুক্ত করে বললেন, আমার উপর অপবাদ চাপানো হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পন্থায় কাতাদা ও রিফা’আ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার প্রবল ধারণা জন্মেছিল যে, এটি বনী উবাইরাকের কীর্তি।

বনু উবায়রাক সংবাদ পেয়ে রাসুল সা এর কাছে এসে রিফা’আ ও কাতাদার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, শরীআতসম্মত প্রমাণ ছাড়াই তারা আমাদের নামে চুরির অপবাদ আরোপ করছে। আপনি তাদেরকে বারণ করুন। রাসূলুল্লাহ সা তাই করলেন। কিন্তু বেশীদিন অতিবাহিত না হতেই এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। যার মাধ্যমে সমস্ত ঘটনা রাসূলুল্লাহ সা এর সামনে তুলে ধরা হয়।

প্রথমে আয়াতে বলা হয়েছে, আমরা তো আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করতে পারেন এবং বিশ্বাসঘাতকদের অর্থাৎ বনী উবাইরাক এর সমর্থনে তর্ক করবেন না। আর আপনি ধারণার বশবর্তী হয়ে সাহাবী কাতাদা ইবন নুমানকে যা বলা হয়েছে সে জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হোন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আল্লাহ বিশ্বাস ভংগকারী পাপীকে পছন্দ করেন না। তারা মানুষ থেকে গোপন করতে চায় কিন্তু আল্লাহর থেকে গোপন করে না, অথচ তিনি তাদের সংগেই আছেন রাতে যখন তারা, তিনি যা পছন্দ করেন না- এমন বিষয়ে পরামর্শ করে এবং তারা যা করে তা সর্বতোভাবে আল্লাহর জানা রয়েছে।

২। তারপর আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলকে উদ্দেশ্য করে নাযিল করলেন, আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তাদের একদল আপনাকে পথভ্রষ্ট করতে বদ্ধপরিকর ছিল।

এদিক বিশর মুনাফেকী অবস্থা ধরা পড়ে যাওয়ার কারণে মক্কায় সুলাফা বিনতে সাদ ইবন সুমাইয়া নামীয় এক মহিলার কাছে গিয়ে সরাসরি মুর্তাদ হয়ে গেল। তখন ১১৫ নং আয়াত নাযিল হলো, যাতে হক প্রকাশিত হওয়ার পরে রাসূলের বিরুদ্ধাচারণের কারণে কঠিন শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। [তিরমিযী: ৩০৩৬; মুস্তাদরাকে হাকিম ৪/৩৮৫]

৩। আল্লাহর কাছে তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠকে ভালবাসেন না। এরা মানুষকে লজ্জা করে (মানুষের দৃষ্টি থেকে গোপনীয়তা অবলম্বন করে), কিন্তু আল্লাহকে লজ্জা করে না (তাঁর দৃষ্টি থেকে গোপনীয়তা অবলম্বন করতে পারে না) অথচ তিনি তাদের সঙ্গে থাকেন, পার্থিব জীবনে তাদের স্বপক্ষে বিতর্ক করেছ; কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে কে তাদের স্বপক্ষে কথা বলবে অথবা কে তাদের উকিল হবে?

আল্লাহ জানাচ্ছেন- কেউ কোন মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি যুলুম করে পরে আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহকে সে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে।

৪। তাওবার জন্য মোটামুটি তিনটি বিষয় জরুরীঃ (ক) অতীত গোনাহর জন্য অনুতপ্ত হওয়া, (খ) উপস্থিত গোনাহ অবিলম্বে ত্যাগ করা এবং (কগ) ভবিষ্যতে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে দৃঢ়সংকল্প হওয়া। তাছাড়া বান্দাহর হকের সাথে যেসব গোনাহর সম্পর্ক, সেগুলো বান্দাহর কাছ থেকেই মাফ করিয়ে নেয়া কিংবা হক পরিশোধ করে দেয়া তাওবার অন্যতম শর্ত।

৫। কেউ পাপ কাজ করলে সে ওটা তার নিজের ক্ষতির জন্যই করে আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

“কোন বোঝা বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না।” (বানী ইসরাঈলঃ ১৫) অর্থাৎ, কিয়ামতে কেউ কারো দায়িত্ব গ্রহণ করবে না।

৬। যে লোক নিজে পাপ করে এবং অপর নিরপরাধ ব্যক্তিকে সেজন্য অভিযুক্ত করে, সে নিজ গোনাহকে দ্বিগুণ ও অত্যন্ত কঠোর করে দেয় এবং নির্মম শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়। একে তো নিজের আসল গোনাহর শাস্তি, দ্বিতীয়তঃ অপবাদের কঠোর শাস্তি।

যেমন উবাইরিক গোত্রের লোকেরা নিজেরা চুরি করে অপরের উপর চুরির অপবাদ চাপিয়ে দিয়েছিল। এ ধমক সকলের জন্য ব্যাপক;

সূরা আন নিসাঃ ১৭তম রুকু(১১৩-১১৫)আয়াত

১। মহান আল্লাহ এখানে তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগ্রহের কথা স্মরন করিয়ে দিচ্ছেন।

আল্লাহ তাআলার বিশেষ হিফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, যা তিনি কেবল নবীদের জন্য প্রয়োগ করেছেন

আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।

আয়াতে ‘কিতাব’-এর সাথে ‘হেকমত’ শব্দটি উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও শিক্ষার নাম যে হেকমত তাও আল্লাহ্ তা’আলারই নাযিলকৃত।

আলেমগণ বলেন, ওহী দুই প্রকারঃ (১) مَتْلُوّ যা তিলাওয়াত করা হয় এবং (২) غَيْرُ مَتْلُوّ যা তিলাওয়াত করা হয় না। প্রথম প্রকার ওহী কুরআনকে বলা হয়, যার অর্থ ও শব্দাবলী উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। দ্বিতীয় প্রকার ওহী হাদীস বা সুন্নাহ। এর শব্দাবলী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং মৰ্ম আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে।

২। (গুপ্ত পরামর্শ) বলতে মুনাফিকদের সেই কথা-বার্তাকে বুঝানো হয়েছে, যা তারা আপোসে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অথবা একে অপরের বিরুদ্ধে বলাবলি করত। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় সাদকাহ, সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের; আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আশায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমরা মহা পুরস্কার দেব।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব না এমন কাজ যা সিয়াম, সালাত ও সদকা থেকেও উত্তম? তারা বললঃ অবশ্যই। রাসূল বললেনঃ মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়া। কেননা, মানুষের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া গর্দান কাটার সমান। [তিরমিযীঃ ২৫০৯]

সে ব্যক্তি মিথ্যুক নয়, যে মানুষের মাঝে মীমাংসা করার জন্য ভাল কথার প্রচার করে অথবা ভাল কথা বলে বেড়ায়।” (বুখারী ২৬৯২-মুসলিম ২৬০৫)

৩। হিদায়াতের পথ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর রসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা এবং মু’মিনদের পথ ত্যাগ করে অন্য পথের অনুসরণ করা ইসলাম থেকে খারিজ গণ্য হয় এবং এ ব্যাপারেই জাহান্নামের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

আয়াত থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা বের হয়। এক. আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতাকারী জাহান্নামী। দুই. কোন ব্যাপারে হক তথা রাসূলুল্লাহ সা এর সুন্নাত প্রকাশিত হওয়ার পর সেটার বিরোধিতা করাও জাহান্নামীদের কাজ। তিন. এ উম্মতের ইজমা বা কোন বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছার পর সেটার বিরোধিতা করা অবৈধ। কারণ, তারা পথভ্রষ্টতায় একমত হবে না। মুমিনদের মত ও পথের বিপরীতে চলার কোন সুযোগ নেই।

‘‘মহান আল্লাহ আমার উম্মতকে ভ্রষ্টতার উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না এবং জামাআতের উপর থাকে আল্লাহর হাত। (সহীহ তিরমিযী, আলবানী ১৭৫৯নং)

সূরা আন নিসাঃ ১৮তম রুকু(১১৬-১২৬)আয়াত

১। আল্লাহ তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না; আর তার থেকে ছোট যাবতীয় গোনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন, আর যে কেউ আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করে সে ভীষণভাবে পথ ভ্রষ্ট হয়।

إِنَاثٌ (নারী) বলতে হয় সেই মূর্তি বা দেবী যাদের নাম ছিল স্ত্রীবাচক। যেমন, উয্যা, মানাত, নায়েলা ইত্যাদি। অথবা এ থেকে ফিরিশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, আরবের মুশরিকরা ফিরিশতাদেরকে আল্লাহর বেটী গণ্য করত এবং তাদের ইবাদত করত। মূর্তি, ফিরিশতা বা অন্য কোন সত্তার ইবাদত করার মানেই হল প্রকৃতার্থে শয়তানের ইবাদত করা।

২। মহান আল্লাহ, শয়তানের কাজের ধরন বা ষড়যন্ত্রের ধরন জানিয়ে বলেছেন- এ সকল লোকের বাসস্থান জাহান্নাম। তা হতে তারা নিষ্কৃতির উপায় পাবে না।

  • আল্লাহ তাকে (শয়তানকে) অভিসম্পাত করেছেন এবং সে (শয়তান) বলেছে, ‘আমি তোমার দাসদের এক নির্দিষ্ট অংশকে (নিজের দলে) গ্রহণ করবই।

অর্থাৎ তাদের সময়, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা,শক্তি ও যোগ্যতা এবং তাদের সন্তান ও ধন-সম্পদ থেকে নিজের একটি অংশ নিয়ে নেবো৷ তাদের এমনভাবে প্ররোচিত করবো যার ফলে তারা এ সবের একটি বিরাট অংশ আমার পথে ব্যয় করবে৷

  • মিথ্যা বাসনা হল এমন আশা-আকাঙ্ক্ষা, যা মানুষের মনে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও তার হস্তক্ষেপ দ্বারা সৃষ্টি হয় এবং মানুষের ভ্রষ্টতার কারণ হয়।
  • আয়াতে বর্ণিত, خَلْقَ اللَّهِ অর্থ আল্লাহর সৃষ্টি। এর আরেক অর্থ, ‘আল্লাহর দ্বীন’ যা ইবন আব্বাস রা থেকে বর্ণিত হয়েছে। [তাবারী] সুতরাং দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার জন্যও শয়তান কিছু লোককে নিয়োজিত করবে।

আল্লাহ্ তা’আলার লা’নত করেছেন সে সমস্ত মহিলাদের উপর যারা শরীর কেটে উল্কি আঁকে এবং যারা এ অংকনের কাজ করে, আরো লা’নত করেছেন যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ভ্রু কাটে এবং যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দাঁত কাটে। আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে। [বুখারীঃ ৪৮৮৬]

  • সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ছলনা মাত্র।

৩। যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য জান্নাত যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আর কে আছে আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী?

৪। তোমাদের খেয়াল-খুশী ও কিতাবীদের খেয়াল-খুশী অনুসারে কাজ হবে না; কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে পাবে এবং আল্লাহ ছাড়া তার জন্য সে কোন অভিভাবক ও সহায় পাবে না।

আলোচ্য আয়াতে মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, শুধু দাবী ও বাসনায় লিপ্ত হয়ো না; বরং কাজের চিন্তা কর। কেননা, তোমরা অমুক নবী কিংবা গ্রন্থের অনুসারী শুধু এ বিষয় দ্বারাই তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। বরং এ গ্রন্থের প্রতি বিশুদ্ধ ঈমান এবং তদনুযায়ী সৎকার্য সম্পাদনের মধ্যেই প্রকৃত সাফল্য নিহিত রয়েছে।

এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ “যে কেউ কোন অসৎকাজ করবে, সে জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হবে”। আয়াতটি যখন নাযিল হল, তখন আমরা খুব দুঃখিত ও চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বললামঃ এ আয়াতটি তো কোন কিছুই ছাড়েনি। সামান্য মন্দ কাজ হলেও তার সাজা দেয়া হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ চিন্তা করো না, সাধ্যমত কাজ করে যাও।

কেননা, (উল্লেখিত শাস্তি যে জাহান্নামই হবে, তা জরুরী নয়) তোমরা দুনিয়াতে যে কোন কষ্ট বা বিপদাপদে পড়, তাতে তোমাদের গোনাহর কাফফারা এবং মন্দ কাজের শাস্তি হয়ে থাকে। এমনকি যদি কারো পায়ে কাটা ফুটে, তাও গোনাহর কাফফারা বৈ নয়।’ [মুসলিমঃ ২৫৭৪]

৫। আর পুরুষ বা নারীর মধ্যে কেউ মুমিন অবস্থায় সৎকাজ করলে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।

৬। সফলতার একটি মান-নির্ণায়ক এবং আদর্শ পেশ করা হচ্ছে। মান-নির্ণায়ক হল, নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা, সৎকাজে নিরত থাকা এবং ইবরাহীমী ধর্মের অনুসরণ করা।

আর আদর্শ ইবরাহীম (আঃ); যাঁকে আল্লাহ তাআলা নিজের খলীল বানিয়ে ছিলেন। খলীলের অর্থ হল, যার অন্তরে মহান আল্লাহর ভালোবাসা এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, তাতে আর কারো জন্য স্থান থাকে না।

আল্লাহর পরিচয়ঃ আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই এবং সবকিছুকে আল্লাহ পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।

সূরা আন নিসাঃ ১৯তম রুকু(১২৭-১৩৪)আয়াত

১। উরওয়া ইবন যুবাইর বলেন, তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তখনকার সময় কারও কারও তত্ত্বাবধানে ইয়াতীম মেয়েরা থাকতো। তারা সে সব ইয়াতীম মেয়েদেরকে মাহর না দিয়েই বিয়ে করতে চাইতো। তখন এ সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো নাযিল হয়। কিন্তু এর বাইরেও কিছু ইয়াতিম থাকতো যাদের সম্পদ ও সৌন্দর্য ছিল না। তারা তাদেরকে বিয়ে করতে চাইতো না। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [মুসলিম: ৩০১৮]

যাতে ছেলেদের সাথে মেয়েদেরকেও অংশীদার নিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ জাহেলী যুগে কেবল ছেলেদেরকেই অংশীদার মনে করা হত। আর ছোট অসহায় শিশুরা এবং মহিলারা মীরাস থেকে বঞ্চিত হত। শরীয়ত তাদের সকলকে অংশীদার বানিয়েছে।

আল্লাহর কিতাবের এ নির্দেশ- ইয়াতীমদের সাথে ন্যায়পরায়ণতাপূর্ণ আচরণ করো। ইয়াতীম মেয়ে সুশ্রী হোক অথবা কুশ্রী হোক, উভয় অবস্থাতে তাদের সাথে সুবিচার করো।

২। স্ত্রী যদি তার প্রাপ্য অধিকার (মোহর অথবা ভরণ-পোষণ বা নিজের পালা থেকে) কিছু ত্যাগ করে স্বামীর সাথে মীমাংসা, সন্ধি ও আপোস করে নেয়, তাহলে তাতে স্বামী-স্ত্রীর কারোর কোন গুনাহ নেই। কেননা, (ত্বালাকের পথ গ্রহণ না করে) আপোস করাই উত্তম। সকল মু’মিনদের মাতা সাওদা (রাঃ) বার্ধক্যে পৌঁছে গেলে তিনি তাঁর পালা আয়েশা (রাঃ) কে দান করে দিয়েছিলেন এবং এটাকে রসূল (সাঃ) গ্রহণও করে নিয়েছিলেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম, বিবাহ অধ্যায়)

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ এ আয়াতটি এমন মহিলা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যে কোন পুরুষের কাছে ছিল কিন্তু তার সন্তান-সন্ততি হওয়ার সম্ভাবনা পেরিয়ে গেছে। ফলে সে তাকে তালাক দিয়ে আরেকটি বিয়ে করতে চাইল। তখন সে মহিলা বলল, আমাকে তালাক দিও না, আমাকে রাত্রির ভাগ দিও না। [বুখারীঃ ৪৬০১, আবু দাউদঃ ২১৩৫]

আল্লাহ জানাচ্ছেন– মানুষের অন্তরসমূহে লোভজনিত কৃপণতা বিদ্যমান। আর যদি তোমরা সৎকর্মপরায়ণ হও ও মুত্তাকী হও, তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার খবর রাখেন।

৩।আন্তরিক এই ভালোবাসা যদি বাহ্যিক অধিকারসমূহে সমতা বজায় রাখার পথে বাধা না হয়, তাহলে তা আল্লাহর নিকট পাকড়াও যোগ্য হবে না। যেমন নবী করীম (সাঃ) এর অতি উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। নবী করীম (সাঃ)-এরও তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা (রাযীআল্লাহু আনহা)র প্রতি সব চেয়ে বেশী ভালোবাসা ছিল।

তবে শরীআত নির্ধারিত অধিকার যেমন, রাত্রী যাপন, সহবাস, খোরপোষ ইত্যাদির ব্যাপারে ‘আদল’ অবশ্যই করা যায় এবং করতে হবে। সেটা না করতে পারলে তাকে একটি বিয়েই করতে হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার দু’জন স্ত্রী আছে তারপর সে একজনের প্রতি বেশী ঝুঁকে গেল, কেয়ামতের দিন সে এমনভাবে আসবে যেন তার একপাশ্ব বাঁকা হয়ে আছে। [আবু দাউদঃ ২১৩৩]

৪। আর যদি তারা পরস্পর পৃথক হয়ে যায় তবে আল্লাহ তার প্রাচুর্য দ্বারা প্রত্যেককে অভাবমুক্ত করবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাময়।

কুরআনুল কারীম উভয় পক্ষকে একদিকে স্বীয় অভাব অভিযোগ দূর করা ও ন্যায্য অধিকার লাভ করার আইনতঃ অধিকার দিয়েছে। অপরদিকে ত্যাগ, ধৈর্য, সংযম ও উন্নত চরিত্র আয়ত্ব করার উপদেশ দিয়েছে। এখানে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, বিবাহ বিচ্ছেদ হতে যথাসাধ্য বিরত থাকা কর্তব্য। বরং উভয় পক্ষেই কিছু কিছু ত্যাগ স্বীকার করে সমঝোতায় আসা বাঞ্ছনীয়। তারপরও যদি বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তবে জীবন সম্পর্কে হতাশ হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ প্রত্যেককেই তাঁর রহমতে স্থান দিবেন।

৫। আসমান ও জমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ তা’আলার। এখানে এই উক্তিটির তিনবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। প্রথমবার বোঝানো হয়েছে, আল্লাহর সচ্ছলতা, প্রাচুর্য ও তার দরবারে অভাবহীনতা। দ্বিতীয়বার বোঝানো হয়েছে যে, কারো অবাধ্যতায় আল্লাহ তা’আলার কোনই ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না। তৃতীয়বার আল্লাহ্ তা’আলার অপার রহমত ও সহায়তার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তোমরা যদি আল্লাহভীতি ও আনুগত্য কর, তবে তিনি তোমাদের সব কাজে সহযোগিতা করবেন, এবং অনায়াসে তা সু-সম্পন্ন করে দেবেন।

৬। হে মানুষ! তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে অপসারিত করতে ও অপরকে আনতে পারেন; আর আল্লাহ্ তা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম।

আল্লাহ তাআলার পূর্ণ পরাক্রমশালিতার বিকাশ। অন্যত্র বলেছেন, [وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ] (محمد: 38) অর্থাৎ, যদি তোমরা বিমুখ হও তাহলে তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন; অতঃপর তারা তোমাদের মত হবে না। (সূরা মুহাম্মাদঃ ৩৮)( সূরা আল-আনআমঃ ১৩৩]

“তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে অপসৃত করতে পারেন এবং এক নূতন সৃষ্টি নিয়ে আসতে পারেন। আর এটা আল্লাহর পক্ষে কঠিন নয়।” [সূরা ইবরাহীম ১৯; সূরা ফাতির: ১৬]

৭। দুনিয়ার পুরস্কার চাইলেই তাকে তা দেয়া হবে। মূলত: অন্য আয়াতে সেটাকে শর্তযুক্ত করে বলা হয়েছে যে, “যে দুনিয়া চায়, তাকে আমি দুনিয়াতে যা ইচ্ছা করি যতটুকু ইচ্ছা করি প্রদান করি।” [সূরা আল-ইসরা: ১৮] সুতরাং দুনিয়া চাইলেই পাবে, তা কিন্তু নয়। যাকে যতটুকু দেয়ার ইচ্ছা আল্লাহর হবে, ততটুকুই সে পাবে। এর বাইরে নয়।

সূরা আন নিসাঃ ২০তম রুকু(১৩৫-১৪১)আয়াত

১। আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারকে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করার এবং ন্যায় অনুযায়ী সাক্ষ্য দেওয়ার প্রতি তাকীদ করছেন, যদিও তার কারণে তাকে অথবা তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে ক্ষতির শিকার হতে হয় তবুও। কেননা, সব কিছুর উপর সত্যের থাকে কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য।

কোন ধনবানের ধন এবং কোন দরিদ্রের দরিদ্রতার ভয় যেন তোমাদেরকে সত্য কথা বলার পথে বাধা না দেয়। বরং আল্লাহ এদের তুলনায় তোমাদের অনেক কাছে এবং তাঁর সন্তুষ্টি সবার ঊর্ধ্বে। আল্লাহ জানাচ্ছেন- তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল বা পাশ কাটিয়ে যাও তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।

২। বিশ্বাসীদেরকে বিশ্বাস করা ও ঈমানদারদেরকে ঈমান আনার প্রতি তাকীদ করার মাধ্যমে ঈমানকে পরিপূর্ণ করার এবং তার উপর সুদৃঢ় ও অবিচল থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কুফরী করার দুটি অর্থ হয়। (এক) সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অস্বীকার করা। (দুই) মুখে মেনে নেয়া কিন্তু মনে মনে অস্বীকার করা। অথবা নিজের মনের ভাবের মাধ্যমে একথা প্রমাণ করা যে, সে যে জিনিষটি মেনে নেয়ার দাবী করছে আসলে সেটিকে মানে না। এখানে কুফর শব্দটি দুটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

৩। নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও পরে কুফরী করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরী করে, তারপর তাদের কুফরী প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোন পথ দেখাবেন না।

এখানে মুনাফিক বা ইহুদিদের কথা বলা হয়েছে। মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দিন যে, তাদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে।

৪। কাফের ও মুশরিকদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য স্থাপন করাকে নিষিদ্ধ করে এ ধরণের আচরণে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। তারা মুনাফিক ও কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে সম্মান কামনা করত। অথচ এটা হল লাঞ্ছনা ও অপমানের পথ, ইজ্জত ও সম্মানের পথ নয়।

বলা হয়েছেঃ “তারা কি ওদের কাছে গিয়ে ইজ্জত-সম্মান লাভ করতে চায়? তবে ইজ্জত-সম্মানতো সম্পূর্ণভাবে আল্লাহরই মালিকানাধীন।”

কেউ সম্মান চাইলে জেনে রেখো, সমস্ত সম্মান আল্লাহরই জন্য। (সূরা ফাত্বিরঃ ১০) তিনি আরো বলেন, সম্মান তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের জন্যই, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না। (সূরা মুনাফিকুনঃ ৮

৫। নিষেধ করা সত্ত্বেও যদি তোমরা এমন মজলিসে বস, যেখানে আল্লাহর আয়াতের সাথে ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করা হয় এবং তার যদি কোন প্রতিবাদ না কর, তাহলে তোমরাও তাদের মত পাপে সমান সমান শরীক হবে।  ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন এমন দাওয়াতে শরীক না হয়, যেখানে মদ পরিবেশন করা হয়।(মুসনাদ আহমাদ ১/২০।

বাতিলপন্থীদের মজলিশে উপস্থিত ও তার হুকুম কয়েক প্রকার। প্রথমতঃ তাদের কুফরী চিন্তাধারার প্রতি সম্মতি ও সন্তুষ্টি সহকারে যোগদান করা। এটা মারাত্মক অপরাধ ও কুফরী। দ্বিতীয়তঃ গৃহিত আলোচনা চলাকালে বিনা প্রয়োজনে অপছন্দ সহকারে উপবেশন করা। এটা অত্যন্ত অন্যায় ও ফাসেকী। তৃতীয়তঃ পার্থিব প্রয়োজনবশতঃ বিরক্তি সহকারে বসা জায়েয। চতুর্থতঃ জোর-জবরদস্তির কারণে বাধ্য হয়ে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বসা ক্ষমার যোগ্য। পঞ্চমতঃ তাদের সৎপথে আনয়নের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হওয়া সওয়াবের কাজ।

মহান আল্লাহ সাবধান করে দিয়েছেন- নয়তো তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফের সবাইকে আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন।

৬। প্রত্যেক যুগের মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। মৌখিক স্বীকারোক্তি ও ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে নামমাত্র প্রবেশের মাধ্যমে মুসলিম হিসাবে যতটুকু স্বার্থ ভোগ করা যায় তা তারা ভোগ করে। আবার অন্যদিকে কাফের হিসাবে যে স্বার্থটুকু ভোগ করা সম্ভব তা ভোগ করার জন্য তারা কাফেরদের সাথে যোগ দেয়। তাদেরকে বলেঃ আমরা মোটেই গোড়া বা প্রতিক্রিয়াশীল অথবা মৌলবাদী-বিদ্বেষপরায়ণ মুসলিম নই। মুসলিমদের সাথে আমাদের নামের সম্পর্ক আছে কিন্তু আমাদের মানসিক ঝোঁক, আগ্রহ ও বিশ্বস্ততা রয়েছে তোমাদের প্রতি। চিন্তা-ভাবনা, আচার-ব্যবহার, রুচি-প্রকৃতি ইত্যাদি সবদিক দিয়ে তোমাদের সাথে আমাদের গভীর মিল। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরীর সংঘর্ষে আমরা তোমাদের পক্ষই অবলম্বন করব।

আল্লাহ জানাচ্ছেন– আল্লাহ কেয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।

বিজয় দান করবেন না। এর বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, (ক) মুসলিমদের এ জয় কিয়ামতের দিন লাভ হবে। (খ) হুজ্জত ও প্রমাণাদির দিক দিয়ে কাফেররা মুসলিমদের উপর জয়লাভ করতে পারবে না। (গ) কাফেরদের এমন বিজয় আসবে না, যাতে মুসলিমদের রাজ্য ও প্রতিপত্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তাদেরকে মুদ্রিত ভুল শব্দের মত বিশ্বের মানচিত্র থেকে মিটিয়ে দেওয়া হবে। একটি সহীহ হাদীস থেকেও এই অর্থের সমর্থন পাওয়া যায়। (ঘ) যতদিন পর্যন্ত মুসলিমরা নিজেদের দ্বীন অনুযায়ী আমল করবে, বাতিলের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে, ততদিন পর্যন্ত কাফেররা তাদের উপর জয়লাভ করতে পারবে না।

সূরা আন নিসাঃ ২১তম রুকু(১৪২-১৫২)আয়াত

১। মুনাফিকদের চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে—

  • নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে বস্তুতঃ তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন। আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।

আয়াতে মুনাফিকদের তিনটি খারাপ গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। এক. তারা তাদের সালাতে অলসতা করে। দুই. তারা সালাতে প্রদর্শনেচ্ছা সহকারে দাঁড়ায়। তিন. তারা খুব কমই আল্লাহর যিকর করে।

নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘‘এটা মুনাফিকের নামায, এটা মুনাফিকের নামায, এটা মুনাফিকের নামায। সে বসে বসে সূর্যের অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে যখন সূর্য শয়তানের দু’টি শিঙের মধ্যবর্তী স্থানে (অস্ত যাওয়ার কাছাকাছি সময়ে) পৌঁছে, তখন (তড়িঘড়ি) উঠে চারটি ঠোকর মেরে নেয়। (সহীহ মুসলিম,

  • কাফেরদের কাছে গিয়ে ওদের সাথে এবং মুসলিমদের কাছে এসে এদের সাথে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক থাকার কথা প্রকাশ করে। মুনাফিকের উদাহরণ হচ্ছে, ঐ ছাগীর ন্যায়, যে দুই পাঠা ছাগলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। (প্রবৃত্তির তাড়নায়) কখনও এটার কাছে যায়, কখনও অপরটির কাছে যায়। [মুসলিম: ২৭৮৪]
  • মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতমস্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য আপনি কখনো কোন সহায় পাবেন না। এ আয়াতে বর্ণিত ‘দারকুল আসফাল’ বা নিম্নতম স্তর কি এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা বলেন, সেটা হবে বদ্ধ সিন্ধুক। আবু হুরায়রা রা বলেন, ‘দারকুল আসফাল’ হচ্ছে, এমন কিছু ঘর যেগুলোর দরজা বন্ধ করা আছে। আর সেগুলোকে উপর ও নিচ থেকে প্রজ্জলিত করা হবে

২।ঈমানদারদের আহবান করে বলছেন- হে মুমিনগণ! মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি নিজেদের উপর আল্লাহর প্রকাশ্য অভিযোগ কায়েম করতে চাও। অর্থাৎ তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দলীল কায়েম করছ; যাতে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন। (অর্থাৎ, আল্লাহর অবাধ্যতা এবং তাঁর নির্দেশ অমান্য করার কারণে।)

৩। মুনাফিকদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এই চারটি কর্মের প্রতি ঐকান্তিকতার সাথে যত্নবান হবে, সে জাহান্নামে যাওয়ার পরিবর্তে ঈমানদারদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

যারা তাওবাহ করে, নিজেদেরকে সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের দ্বীনকে একনিষ্ট করে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনদেরকে আল্লাহ অবশ্যই মহাপুরস্কার দেবেন।

৪। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা করার অর্থ হল, তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী অন্যায়-অনাচার থেকে বিরত থাকা এবং নেক আমলের প্রতি যত্ন নেওয়া। এটাই হল আল্লাহর নিয়ামতের কার্যতঃ কৃতজ্ঞতা। আর ঈমান (বিশ্বাস) বলতে আল্লাহর তাওহীদ (একত্ব), তাঁর রুবূবিয়্যাত (প্রতিপালকত্ব) এবং শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রিসালাত এবং অন্যান্য দ্বীনী বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।

এ তিনটি কাজের সমবেত রূপই হচ্ছে শোকর।

প্রথমতঃ অনুগ্রহকে অনুগ্রহকারীর অবদান বলে স্বীকার করা। অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে অনুগ্রহকারীর সাথে আর কাউকে অংশীদার না করা।

দ্বিতীয়তঃ অনুগ্রহকারীর প্রতি ভালবাসা, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের অনুভূতি নিজের হৃদয়ে ভরপুর থাকা এবং অনুগ্রহকারীর বিরোধীদের প্রতি এ প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র ভালবাসা, আন্তরিকতা, আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার সম্পর্ক না থাকা।

তৃতীয়তঃ অনুগ্রহকারীর আনুগত্য করা, তার হুকুম মেনে চলা, তার নেয়ামগুলোকে তার মর্জির বাইরে ব্যবহার না করা।

৫। কারো মধ্যে যদি কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তাকে নির্জনে বুঝাতে বলা হয়েছে। কিন্তু যদি ধর্মীয় কোন কল্যাণ থাকে, তাহলে প্রকাশ্যে সমালোচনা করায় কোন অসুবিধা নেই। যালেমের যুলুমের কথা জনসমক্ষে বর্ণনা করার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। যালেমের যুলুমের কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করার মাঝে কয়েকটি মঙ্গল নিহিত আছে।আল্লাহ জানাচ্ছেন- মন্দ কথা প্রকাশ করাকে আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার উপর যুলুম করা হয়েছে তার কথা স্বতন্ত্র। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

৬। আয়াতে মুসলমানদের একটি অত্যন্ত উন্নত পর্যায়ের নৈতিক শিক্ষা দান করা হয়েছে৷ একদিকে ন্যায়সঙ্গত প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার প্রদান করে ইনসাফ ও ন্যায়নীতিকে সমুন্নত রাখা হয়েছে, অপরদিকে উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে ক্ষমা বা মার্জনা করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি সম্পর্কে কুরআনুল কারীমের অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছেঃ “তোমার ও অন্য যে ব্যক্তির মধ্যে দুশমনী ছিল, এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি আন্তরিক বন্ধু হয়ে যাবে।” [সূরা ফুসসিলাতঃ ৩৪]

তোমরা সৎকাজ প্রকাশ্যে করলে বা গোপনে করলে কিংবা দোষ ক্ষমা করলে তবে আল্লাহও দোষ মোচনকারী, ক্ষমতাবান।

৭। আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদ ও নাসারা সম্প্রদায়। কারণ, তাদের মধ্যে ইয়াহুদীরা তাওরাত ও মূসার উপর ঈমান আনে কিন্তু ইঞ্জীল ও ঈসার উপর ঈমান আনে না। আর নাসারারা ইঞ্জীল ও ঈসার উপর ঈমান আনে কিন্তু কুরআন ও মুহাম্মাদ সা এর উপর ঈমান আনে না। এভাবে এ দু’টি সম্প্রদায় ইয়াহুদী ও নাসারা হয়েছে। অথচ এ দুটি মতই বিদ’আত বা নব উদ্ভাবিত। যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়।

তারাই প্রকৃত কাফির। আর আমরা প্রস্তুত রেখেছি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।

ইসলাম একদিকে মুসলিমদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও পরমসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে যেমন উদার ও অবারিত দ্বার, অপরদিকে স্বীয় সীমারেখা সংরক্ষণের ব্যাপারে অতি সতর্ক, সজাগ ও কঠোর। ইসলাম অমুসলিমদের প্রতি উদারতার সাথে সাথে কুফর ও কু-প্রথার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিম ও অমুসলিমরা দুটি পৃথক জাতি এবং মুসলিমদের জাতীয় প্রতীক ও স্বাতন্ত্র্য সযত্নে সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। শুধু ইবাদাতের ক্ষেত্রেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখলে চলবে না, বরং সামাজিকতার ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে। এ কথা কুরআন ও হাদীসে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।

“আর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে (চিনে রাখুন যে) তারা আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট। অতএব, আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহ তা’আলাই তাদের মোকাবেলায় যথেষ্ট এবং তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন।” [সূরা আল বাকারাহঃ ১৩৭]

৫ম পারা সমাপ্ত

আলহামদুলিল্লাহ