Power point presentation
প্রানবন্ত সালাতঃ ৫ (সালাতে খুশু খুযু অর্জনের উপায়-২য় ভাগ)
«اَللهم أَصْلِحْ لِي دِينِيَ الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِي، وَأَصْلِحْ لِي دُنْيَايَ الَّتي فِيهَا مَعَاشِي، وَأَصْلِحْ لِي آخِرتِيَ الَّتي فِيهَا مَعَادِي، وَاجْعَلِ الحَيَاةَ زِيَادَةً لِي فِي كُلِّ خَيْرٍ، وَاجْعَلِ المَوتَ رَاحَةً لِي مِنْ كُلِّ شَرٍّ
‘আল্লা-হুম্মা আস্বলিহ লী দ্বীনিইয়াল্লাযী হুয়া ইসমাতু আমরী, ওয়া আস্বলিহ লী দুনইয়া ইয়াল্লাতী ফীহা মাআ-শী, ওয়া আস্বলিহ লী আ-খিরাতি ইয়াল্লাতী ফীহা মাআ-দী। ওয়াজআললিল হায়া-তা যিয়া-দাতাল লী ফী কুল্লি খাইর্। ওয়াজআললিল মাউতা রা-হাতাল লী মিন কুলি শার্র্।’
হে আল্লাহ! তুমি আমার দ্বীনকে শুধরে দাও, যা আমার সকল কর্মের হিফাযতকারী। আমার পার্থিব জীবনকে শুধরে দাও, যাতে আমার জীবিকা রয়েছে। আমার পরকালকে শুধরে দাও, যাতে আমার প্রত্যাবর্তন হবে। আমার জন্য হায়াতকে প্রত্যেক কল্যাণে বৃদ্ধি কর এবং মৃত্যুকে প্রত্যেক অকল্যাণ থেকে আরামদায়ক কর। সহিহ মুসলিম ২৭২০
১১। শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করা।
এর ফজিলত ও একাগ্রতা সৃষ্টিতে এর ভূমিকা কত বেশি তা তো জানেই না, উল্টো একে ছেড়ে দিয়েছে একেবারে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”লোহার তুলনায় এর আঘাত শয়তানের উপর অধিক কষ্টদায়ক।”
رواه الإمام أحمد (২/১১৯) بسند حسن كما في صفة الصلاة ص : ১৫৯.
কারণ, এর দ্বারা বান্দার মনে আল্লাহর একত্ব ও ইখলাসের কথা স্মরণ হয়। যা শয়তানের উপর বড়ই পিড়াদায়ক। الفتح الرباني للساعاتي (৪/১৫).
এজন্যই আমরা লক্ষ্য করি, সাহাবায়ে কেরাম রা. এর জন্য একে অপরকে উপদেশ দিতেন, নিজেরাও এ ব্যাপারে যত্নবান থাকতেন। অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আজ আমাদের কাছে অবহেলা ও অমনোযোগের শিকার। হাদিসে এসেছে, ”সাহাবায়ে কেরাম এ জন্য একে অপরকে নাড়া দিতেন, সতর্ক করতেন। অর্থাৎ আঙ্গুলের ইশারার জন্য।”
رواه ابن أبي شيبة بسند حسن كما في صفة الصلاة ص: ১৪১، المصنف ( ১০/৩৮১ رقم ৯৭৩২) ط. الدار السلفية، الهند.
আঙ্গুলের ইশারায় সুন্নত হলো, তাশাহুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আঙ্গুল কেবলার দিকে উঠিয়ে রাখা।
সালাতুর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রন্থে রয়েছেঃ তাশাহহুদের বৈঠকের সময় বাম হাতের আঙ্গুলগুলো বাম হাঁটুর প্রান্ত বরাবর কিবলামুখী ও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে এবং ডান হাত ৫৩-এর ন্যায় মুষ্টিবদ্ধ থাকবে এবং শাহাদাত অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করবে- (মুসলিম, মিশকাত হা/৯০৬, ৯০৭)। সালাম ফিরানোর আগ পর্যন্ত ইশারা করতে থাকবে- (মুসলিম, মিশকাত হা/৯০৭-৯০৮, আবূ দাউদ, নাসাঈ, দারিমী)। ইশারার সময় আঙ্গুল সামান্য হেলিয়ে উঁচু রাখা যায়- (নাসাঈ হা/১২৭৫)। একটানা নাড়াতে গেলে এমন দ্রুত নাড়ানো উচিত নয়, যা পাশের মুসল্লীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়- (মুত্তাঃ মিশকাত হা/৭৫৭, মিরআত ১/৬৬৯)। ‘আশহাদু’ বলার সময় আঙ্গুল উঠাবে ও ‘ইল্লাল্লা-হু’ বলার সময় আঙ্গুল নামাবে’ বলে যে কথা চালু আছে তার কোন ভিত্তি নেই- (তাহক্বীক্ব মিশকাত অনুঃ ‘তাশাহহুদ’ হা/৯০৬, টিকা নং ২)। মুসল্লীর নযর ইশারা বরাবর থাকবে। তার বাইরে যাবে না- (আহমাদ, আবূ দাউদ, মিশকাত হা/৯১১, ৯১২, ৯১৭)।
তাশাহুদে আঙ্গুল নড়ানোর সঠিক পদ্ধতি
▪▪▪▪▪▪▪▪▪
প্রশ্ন: তাশাহুদে বসে আঙ্গুল নাড়ানোর পদ্ধতি কয়টি ও কী কী? এ বিষয়ে নানা ধরণের কথা শুনা যায়। আশা করি এ বিষয়ে সঠিক নিয়মটি বিস্তারিত জানাবেন।
উত্তর
নামযে তাশাহ্হুদে তর্জনী আঙ্গুলী ইশারা করা একটি সুপ্রমাণিত সুন্নত যে ব্যাপারে কোন মত বিরোধ নাই। কিন্তু আঙ্গুল নাড়ানোর ব্যাপারে যথেষ্ট মত বিরোধ রয়েছে। যেমন, আদৌ আঙ্গুলী নাড়াতে হবে কি না বা হলে তার পদ্ধতি কী ইত্যাদি ব্যাপারে।
যাহোক, যারা বলেন, তাশাহ্হুদে তর্জনী আঙ্গুল নাড়ানো সুন্নত। তারা নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন:
প্রখ্যাত সাহাবী ওয়েব ইবন হুজুর (রা:) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে নামায পড়তে আমি যেন দেখতে পাচ্ছি। অত:পর তিনি তাঁর নামায পড়ার পদ্ধতি বর্ণনা করলেন। আর তাশাহ্হুদে বসার পদ্ধতি সম্পর্কে বললেন:
ثُمَّ قَبَضَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ فَحَلَّقَ حَلْقَةً ثُمَّ رَفَعَ أُصْبُعَهُ فَرَأَيْتُهُ يُحَرِّكُهَا يَدْعُو بِهَا ثُمَّ جِئْتُ بَعْدَ ذَلِكَ فِى زَمَانٍ فِيهِ بَرْدٌ فَرَأَيْتُ النَّاسَ عَلَيْهِمُ الثِّيَابُ تُحَرَّكُ أَيْدِيهِمْ مِنْ تَحْتِ الثِّيَابِ مِنَ الْبَرْدِ.
“অত:পর তিনি হাতের আগুলগুলো ধরে গোলাকার তৈরি করলেন। তারপর আঙ্গুল উঠালেন এবং দেখলাম- তিনি আঙ্গুল নাড়াচ্ছেন আর দুয়া করছেন। তারপর পরবর্তীতে ঠাণ্ডা কালীন সময় এসে দেখলাম লোকজন ঠাণ্ডার কারণে কাপড়ের নীচ থেকে তাদের আঙ্গুল নাড়াচ্ছেন।” (মুসনাদ আহমাদ, নাসাঈ, দারেমী প্রমূখ। আল্লামা আলবানী (রহ:) বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।)
উক্ত হাদীসে শুধু দুয়া করার সময় অর্থাৎ তাশাহ্হুদে দুয়ার শব্দগুলো উচ্চারণের সময় আঙ্গুল নাড়ানোর বিষয়টি ফুটে উঠেছে। পুরো তাশাহ্হুদে নয়।
*আল্লামা উছাইমীন (রাহ:) কে প্রশ্ন করা হয়েছে, তাশাহুদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তর্জনী আঙ্গুল নড়ানোর বিধান কি?*
তিনি উত্তরে যা বলেছেন তা হল নিম্নোরূপ:
তর্জনী আঙ্গুল নাড়ানো শুধুমাত্র দু’আর সময় হবে। পূরা তাশাহুদে নয়। যেমনটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছেঃ “তিনি উহা নাড়াতেন ও দু’আ করতেন।” এর কারণ হচ্ছেঃ দু’আ আল্লাহর কাছেই করা হয়। আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আসমানে আছেন। তাই তাঁকে আহবান করার সময় উপরে আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করবে। আল্লাহ্ বলেন,
أَأَمِنتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمْ الأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ، أَمْ أَمِنتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ
“তোমরা কি নিরাপদে আছ সেই সত্বা থেকে যিনি আসমানে আছেন যে, তিনি তোমাদেরকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিবেন না? তখন আকস্মিকভাবে যমীন থরথর করে কাঁপতে থাকবে। অথবা নাকি তোমরা নিরাপদ আছ সেই সত্বার ব্যাপারে যিনি আসমানের অধিপতি তোমাদের উপর কঙ্করবর্ষী ঝঞ্ঝা প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে, আমার সকর্ত করণ কিরূপ ছিল।” (সূরা মুলকঃ ১৬-১৭)
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
أَلَا تَأْمَنُونِي وَأَنَا أَمِينُ مَنْ فِي السَّمَاءِ
“তোমারা কি আমাকে আমানতদার মনে করো না? অথচ আমি যিনি আসমানে আছেন তার আমানতদার।” সুতরাং আল্লাহ্ আসমানে তথা সবকিছুর উপরে আছেন।
যখন আপনি দু’আ করবেন উপরের দিকে ইঙ্গিত করবেন। একারণে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জে খুতবা প্রদান করে বললেন, “আমি কি পৌঁছিয়েছি?” তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। তিনি আসমানের দিকে আঙ্গুল উঠালেন এবং লোকদের দিকে আঙ্গুলটিকে ঘুরাতে থাকলেন বললেন, “হে আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থেকো। হে আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থেকো। হে আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থেকো।”
এদ্বারা প্রমাণিত হয় আল্লাহ্ তা’আলা সকল বস্তুর উপরে অবস্থান করেন। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ও সুপ্রমাণিত ফিতরাতী ভাবে, বিবেক যুক্তি ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এই ভিত্তিতে যখনই আপনি আল্লাহ্ তা’আলাকে ডাকবেন তাঁর কাছে দু’আ করবেন, তখনই আসমানের দিকে তর্জনী আঙ্গুল দ্বারা ইঙ্গিত করবেন এবং তা নাড়াবেন। আর অন্য অবস্থায় তা স্থীর রাখবেন।
এখন আমরা অনুসন্ধান করি তাশাহুদে দু’আর স্থানগুলোঃ
১) আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
২) আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিছ্ ছালিহীন।
৩) আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলি মুহাম্মাদ
৪) আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ
৫) আঊযুবিল্লাহি মিন আযাবি জাহান্নাম
৬) ওয়া মিন আযাবিল ক্বাবরি।
৭) ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহ্ইয়া ওয়াল মামাত।
৮) ওয়ামিন ফিতনাতল মাসীহিদ্দাজ্জাল।
এই আটটি স্থানে আঙ্গুল নাড়াবে এবং তা আকশের দিকে উত্থিত করবে। এগুলো ছাড়া অন্য কোন দু’আ পাঠ করলেও আঙ্গুল উপরে উঠাবে। কেননা দু’আ করলেই আঙ্গুল উপরে উঠাবে।
উল্লেখ্য যে, আঙ্গুল না নাড়ানোর ব্যাপারেও একটি হাদীসে পাওয়া যায়। কিন্তু তা অনেক মুহাদ্দিসের মতে সহীহ নয়। হাদীসটি হল:
كان يشير بأصبعه إذا دعا ولا يحركها
“তিনি দুয়ার সময় আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন কিন্তু নাড়াতেন না।” (আবু দাউদ ও নাসাঈ) অনেক মুহাদ্দিস “নাড়াতেন না” কথাটিকে শায হওয়ার কারণে দূর্বল হাদীসের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়েম যাদুল মায়াদে এ অংশটুকুকে দূর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। (যাদুল মায়াদ ১/২৩৮)
আল্লামা আলবানী বলেন: মুহাম্মাদ বিন আজলানের বর্ণনাটি শায। (আর শায হাদীস দূর্বলের অন্তর্ভূক্ত) (দেখুন: সহীহ ওয়া যঈফ আবী দাউদ, সহীহ ওয়া যঈফ নাসাঈ ও তামামুল মিন্নাহ)
[আল্লামা উসাইমীন রহ. এর ফতোয়টি নেয়া হয়েছে, ফতোয়া আরকানুল ইসলাম গ্রন্থ থেকে] আল্লাহ সব চেয়ে ভাল জানেন।
➖➖➖➖➖➖
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
১২। সালাতের ভেতর সব সময় একই সূরা ও একই দোয়া না পড়ে, বিভিন্ন সূরা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া-দরূদ পড়া।
এর দ্বারা নতুন নতুন অর্থ ও ভাবের সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, এ আমল সে ব্যক্তিই করতে পারে, যার বিভিন্ন সূরা ও অনেক দোয়া মুখস্থ আছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এমননি করতেন। তিনি কোনো একটি সূরা বা কোনো একটি দোয়া বার বার এক জায়গায় পড়েননি। যেমন তাকবিরে তাহরিমার পরে নিম্নোক্ত দোয়াগুলো থেকে একেক সময় একেকটা পড়তেন।
ছানা’কে দু’আ ইসতিফতাহ্ও বলা হয়। ছানা কয়েক প্রকারের আছে। যে সালাতই হোক, এর শুরুতে শুধু ১ম রাকআতে যেকোন একটি ছানা পড়বে। একই সালাতে একাধিক ছানা পড়া সহীহ বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি।
ক). তাকবিরে তাহরিমায় তিনি বলতেন:
»اللَّهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اللَّهُمَّ نَقِّنِي مِنْ خَطَايَايَ كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، اللَّهُمَّ اغْسِلْنِي مِنْ خَطَايَايَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ» .
“হে আল্লাহ, তুমি আমার ও আমার পাপসমূহের মাঝে দূরত্ব তৈরি কর যেরূপ দূরত্ব তৈরি করেছ পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে। হে আল্লাহ, আমার পাপসমূহ থেকে আমাকে পবিত্র কর, যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার করা হয়। হে আল্লাহ, আমার পাপসমূহ থেকে আমাকে পানি, বরফ ও শিশির দ্বারা ধৌত কর।”
(খ). উক্ত দো’আর পরিবর্তে কখনো বলতেন:
«وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِي، وَنُسُكِي، وَمَحْيَايَ، وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ».
“আমি আমার চেহারাকে একান্তভাবে সেই সত্ত্বা অভিমুখী করেছি, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার সালাত, কুরবানি, বেচে থাকা ও মৃত্যু দোজাহানের রব আল্লাহর জন্যে। তার কোনো শরীক নেই, আর তারই আমি আদিষ্ট হয়েছে এবং আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।”
(গ). আবার কখনো বলতেন:
«سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعالَى جَدُّكَ وَلا إِلَهَ غَيْرُكَ».
“হে আল্লাহ, আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করি, আপনার প্রশংসা দ্বারাই আপনার প্রশংসা করি। আপনার নাম বরকতময়, আপনার মর্যাদা অতি উচ্চ এবং আপনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই।”
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ সকল দোয়া অনুসন্ধান করে বলেন,
১. সবচে’ উত্তম জিকির হলো যেগুলোতে শুধু আল্লাহর প্রসংশা ও গুণ-র্কীতন রয়েছে।
২. এর পর যেগুলোতে বান্দার ইবাদত-আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
৩. এর পর যেগুলোতে দোয়া-প্রার্থনা রয়েছে।
সবচে’ উত্তম জিকির যেমন,
سبحانك اللهم وبحمدك، وتبارت اسمك، وتعالى جدك، ولاإله غيرك.
এবং দোয়া,
الله أكبر كبيرا، والحمد لله كثيرا، وسبحان الله بكرة وأصيلا.
এ দুটি দোয়ার মাঝে প্রথমটির ফজিলত বেশী। কারণ, এতে আছে, কোরআনের পর সবচে’ মর্যদাশীল কলিমা, سبحانك اللهم وبحمدك এবং কোরআনের শব্দ وتبارت اسمك، وتعالى جدك এ জন্যই অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম এর মাধ্যমে সালাত আরাম্ভ করতেন।
ওমর রা. এ দোয়া জোরে জোরে পড়তেন এবং মানুষদের শিক্ষা দিতেন। এর পর দ্বিতীয় প্রকার দোয়া যেমন, وجهت وجهي للذي فطر السموات…. এতে আনুগত্যের বর্হিপ্রকাশও রয়েছে, দোয়াও রয়েছে। প্রথম প্রকার দোয়া শেষে এ দোয়াটি পড়লে মূলত দোয়ার তিন প্রকারই পড়া হবে। তৃতীয় প্রকার দোয়া যেমন, اللهم باعد بيني وبين خطاباي… ইত্যাদি। (মাজমুউল ফতওয়া : ২২/৩৯৪-৩৯৫)
অতঃপর চুপে চুপে পড়বে ‘বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।’ উল্লেখ্য, ছানা ও আউযুবিল্লাহ পড়বে কেবল সালাতের প্রথম রাকআতে।
এরপর চুপে চুপে পড়বে, ‘পরম করুণাময় অত্যন্ত দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। রাসূলুল্লাহ (স.) প্রতি রাক’আতেই বিসমিল্লাহসহ সূরা ফাতিহা পড়তেন।
সালাতের ভেতর সূরা তেলাওয়াত করার সময়ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সূরা পড়তেন। ফজর সালাতে সাধারণত পড়তেন, তেওয়ালে মুফাস্সল : ওয়াকিয়া, তুর, ক্বাফ। কেসারে মুফাস্সল : তাকওয়ীর, জিলজাল, সূরা নাস ও ফালাক। সূরা রুম, ইয়াসিন, এবং সাফ্ফাতও পড়েছেন। জুমার দিন ফজর সালাতে পড়তেন, সূরা সেজদাহ ও সূরা দাহর।
যোহর সালাতে এক এক রাকাতে ত্রিশ আয়াত পরিমাণ পড়তেন। সূরায়ে তারেক, বুরূজ এবং লাইলও পড়েছেন।
আছর সালাতে এক এক রাকাতে পনের আয়াত পরিমাণ পর্যন্ত পড়তেন। সূরা তারেক, বুরূজ এবং সূরা লাইলও পড়েছেন।
মাগরিব সালাতে কেসারে মুফাস্সল : সূরা ত্বীন পড়তেন। আবার সূরা মুহাম্মদ, তুর ও মুরসালাত ইত্যাদিও পড়েছেন।
এশার সালাতে আওসাতে মুফাস্সল : সূরা শামস, ইনশেকাক পড়তেন। মুয়াজ রা.-কে এশার সালাতে সূরায়ে আ’লা, কালাম এবং সূরায়ে লাইল পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাতের সালাতে লম্বা লম্বা সূরা পড়তেন। দুই’শ একশ পঞ্চাশ আয়াত পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনো এরচে’ কমও পড়েছেন।
১৩. সালাতে তিলাওয়াতের সাজদাহ পাঠ করে সাজদাহ করা।
আল্লাহ তা’আলা নবীদের গুণাবলি বর্ণনায় বলেন,
﴿إِذَا تُتۡلَىٰ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُ ٱلرَّحۡمَٰنِ خَرُّواْۤ سُجَّدٗاۤ وَبُكِيّٗا۩﴾ [مريم: ٥٨]
“যখন তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তখন তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় সাজদাতে লুটিয়ে পড়ে।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৮
ইবন কাসীর রহ. বলেন, “সকল আলিম বলেছেন, উক্ত আয়াত পাঠ করে সাজদাহ করা নবীদের সুন্নত।”
দ্বিতীয়ত, সালাতে সাজদার আয়াত পাঠ করে সাজদাহ করলে একাগ্রতা তৈরি হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন
﴿وَيَخِرُّونَ لِلۡأَذۡقَانِ يَبۡكُونَ وَيَزِيدُهُمۡ خُشُوعٗا۩ ١٠٩﴾ [الاسراء: ١٠٩]
“তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে।” [সূরা আল-ইসরা: ১০৯]
সাজদার আয়াত তিলাওয়াত করে সাজদাহ করা একাগ্রতা অর্জনের জন্যে সহায়ক, অধিকন্তু তিলাওয়াতের সাজদার কারণে শয়তান তুচ্ছ ও লাঞ্ছিত সাব্যস্ত হয়, ফলে মুসল্লিকে কেন্দ্র করে তার ষড়যন্ত্রগুলো নষ্ট হয়ে যায়, যেমন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إذا قرأ ابن آدم السجدة، اعتزل الشيطان يبكي، يقول: يا ويله، أمر بالسجود فسجد، فله الجنة، وأمرت بالسجود فعصيت، فلي النار».
“বনু আদম যখন সাজদার আয়াত তিলাওয়াত করে তখন শয়তান কাঁদতে কাঁদতে প্রস্থান করে, আর বলে, ওহে ধ্বংস! সাজদার নির্দেশ পেয়ে সে সাজদাহ করছে, ফলে তার জন্যে জান্নাত। আর আমাকে সাজদাহ’র আদেশ করা হয়েছিল আমি তার অমান্য করেছি, ফলে আমার জন্যে জাহান্নাম।” সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৩।
১৪. আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা
শয়তান আমাদের শত্রু, তার শত্রুতার একটি অংশ হচ্ছে মুসল্লিকে কুমন্ত্রণা দেওয়া, যেন তার খুশু চলে যায় ও তার সালাত সন্দেহ যুক্ত হয়। বস্তুত, যে কেউ যিকির বা ইবাদতে মগ্ন হয় তার ভেতর সংশয় আসবেই, তবে তার কাজ হচ্ছে একাগ্রতায় স্থির থাকা ও ধৈর্য ধরা এবং ইবাদতে অটল থাকা, অস্থির হয়ে ছেড়ে না দেওয়া। কারণ স্থির থাকলে শয়তানের ষড়যন্ত্র ধীরেধীরে দুর্বল ও দূরীভূত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন: إِنَّ كَيۡدَ ٱلشَّيۡطَٰنِ كَانَ ضَعِيفًا ٧٦ ﴾ [النساء: ٧٦]
“নিশ্চয় শয়তানের ষড়যন্ত্র দুর্বল।” [সূরা আন-নিসা: ৭৬]
বান্দা যখন অন্তর দিয়ে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করে তখন বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা এসে তাকে হানা দেয়। কারণ, শয়তান ডাকাতের ন্যায়, বান্দা যখন আল্লাহর রাস্তায় চলার ইচ্ছা করে তখন সে তার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়।
কতক সালাফকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানেরা বলে আমাদের ওয়াসওয়াসা আসে না। তিনি বললেন: সত্য বলেছে, কারণ শয়তান নষ্ট ঘর দিয়ে কী করবে?” ইমাম ইবন তাইমিয়ার ফাতওয়া সংকলন ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’: ২২/৬০৮।
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “ঈমান যার ভেতর আছে শয়তান তাকেই ওয়াসওয়াসা দেয়। তার একটি উদাহরণ, তিনটি ঘর রয়েছে, একটি বাদশাহর ঘর, যেখানে তার অর্থ, মূল্যবান জিনিস-পত্র ও মণিমুক্তা রয়েছে। আরেকটি তার প্রজার ঘর, যেখানে প্রজার অর্থ, মূল্যবান জিনিস-পত্র ও মণিমুক্তা রয়েছে, তবে বাদশাহর ঘরের ন্যায় মণিমুক্তা ও মূল্যবান জিনিস-পত্র তাতে নেই। আরেকটি ঘর খালি, যেখানে কিছুই নেই। ইত্যবসরে চোর এসেছে চুরি করতে, সে কোন্ ঘরে চুরি করবে?” ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব’: পৃ.৪৩।
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. অন্যত্র বলেন, “বান্দা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন শয়তান হিংসার আগুনে ছটফট করে। কারণ, সে আল্লাহর নৈকট্যপূর্ণ ইবাদত ও তার মহান দরবারে দাঁড়িয়েছে, যা শয়তানের গোস্বার উত্তেজক ও তার জন্যে কঠিন পীড়াদায়ক। তাই সে বান্দার ইবাদত নষ্ট করতে প্রাণপণ চেষ্টা ও সবটুকু সাধ্য ব্যয় করে, তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেয় এবং অন্যমনস্ক করার মেহনত করে। তার উপর নিজের অশ্ব ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেন সে সালাতে অবহেলা করে এবং এক পর্যায়ে তা ছেড়ে দেয়।
যদি শয়তান এতে পরাস্ত হয় এবং বান্দা তাকে অবজ্ঞা করে ইবাদতে মগ্ন থাকে, তাহলে আল্লাহর দুশমন ধীরে-ধীরে অগ্রসর হয় এবং বান্দা ও তার নফসে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে। তারপর বান্দা ও তার অন্তরের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এমন কিছু, যা সালাতে প্রবেশ করার পূর্বে তার স্মৃতিতেই ছিল না। কখনো এমন হয়, মুসল্লি যে জিনিস বা প্রয়োজন ভুলে একেবারে নিরাশ হয়ে গিয়েছে তাও তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেন তার অন্তর সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং তাকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে সমর্থ হয়।
শয়তানের এরূপ নিরন্তর চেষ্টার কারণে মুসল্লি নিজের অজান্তেই এক সময় বিনা খুশুতে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, ফলে সে তার সুদৃষ্টি, সম্মান ও নৈকট্য থেকে বঞ্চিত হয়, যা লাভ করে উপস্থিত অন্তর নিয়ে সালাত আদায়কারী।
ফলশ্রুতিতে মুসল্লি পাপ ও গুনাহের যে বোঝা নিয়ে সালাতে দাঁড়িয়েছিল তা নিয়েই সালাত শেষ করে, তার পাপের বোঝা আর হালকা হয় না। কারণ, সালাত দ্বারা তার পাপের বোঝাই হালকা হয় যে নিজের মন ও শরীরসহ সালাতে দাঁড়ায় এবং পূর্ণ একাগ্রতা ও হকসহ তা আদায় করে।” ইবনিল কাইয়্যেম প্রণীত ‘আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব’:: পৃ.৩৬।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নের হাদিসে শয়তানের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ ও তার ওয়াসওয়াসা দূর করার জন্যে একটি পদ্ধতি বলেছেন, সাহাবী আবুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, শয়তান আমার ও আমার সালাতের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় এবং আমার তিলাওয়াতে সন্দেহ সৃষ্টি করে। তিনি বললেন,
«ذاك شيطان يُقال له خنزب فإذا أحسسته فتعوّذ بالله منه واتفل على يسارك ثلاثا. قال: ففعلت ذلك فأذهبه الله عني».
“সে এক প্রকার শয়তান, তাকে খানযাব বলা হয়। যখন তুমি তাকে অনুভব কর আল্লাহর কাছে তার থেকে আশ্রয় চাও এবং তোমার বাম পাশে তিনবার থুতু নিক্ষেপ কর। আবুল-আস বলেন, আমি তাই করেছি, ফলে আল্লাহ তাকে আমার থেকে দূর করে দিয়েছেন।” সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২০৩।
মুসল্লিকে কেন্দ্র করে শয়তানের আরেকটি ষড়যন্ত্র ও তার প্রতিকার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إن أحدكم إذا قام يصلي جاء الشيطان فلبس عليه -يعني خلط عليه صلاته وشككه فيها- حتى لا يدري كم صلى. فإذا وجد ذلك أحدكم فليسجد سجدتين وهو جالس».
“তোমাদের কেউ যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন শয়তান এসে তার ভেতর সন্দেহ সৃষ্টি করে (অর্থাৎ বিভিন্ন কল্পনায় লিপ্ত করে তাকে সন্দিহান করে), ফলে সে কত রাকাত পড়েছে বলতে পারে না। তোমাদের কেউ যখন এরূপ অনুভব করে তখন বসাবস্থায় দু’টি সাজদাহ করবে।সহীহ বুখারি, ফরয ও নফল সালাতে সাহু করার পরিচ্ছেদ।
তাকবীর ও দু’আ পাঠের পর রসূলুল্লাহ (সঃ) প্রথমে আল্লাহর কাছে নিম্নরুপ বাক্যে আশ্রয় চাইতেন—
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم»
অথবা বলবে:
«أعوذ بالله السميع العليم من الشيطان الرجيم، من همزه، ونفخه، ونفثه».
আউযুবিল্লাহীস সামীয়ীল আলীমি মিনাশ শাইতোয়ানির রাযীমী মীন হামযিহী ওয়া নাফাখিহী ওয়া নাফাসিহ
“আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে পানাহ চাই, তার আছর থেকে, তার অহঙ্কার থেকে ও তার খারাপ অনুভূতি থেকে”। আহমদ: ৩/৫০, আবু দাউদ:৭৭৫, তিরমিযি: ২৪২।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয়তানের আরেকটি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বলেন:
«إذا كان أحدكم في الصلاة فوجد حركة في دبره أحدث أو لم يحدث، فأشكل عليه، فلا ينصرف حتى يسمع صوتًا أو يجد ريحًا».
“তোমাদের কেউ যখন সালাতে থাকে, তারপর গুহ্যদ্বারে হরকত অনুভব করে সন্দিহান হয় ওযু আছে না টুটে গেছে, সে যতক্ষণ না শব্দ শুনবে কিংবা গন্ধ শুঁকবে ততক্ষণ সালাত ছাড়বে না।”সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৮৯।
শয়তানের ষড়যন্ত্র আরো অদ্ভুত। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, যে সালাতে থাকলে সন্দেহ হয় বায়ু ত্যাগ করেছে, যদিও সে বায়ু ত্যাগ করে নি। তিনি বললেন:
«إن الشيطان يأتي أحدكم وهو في صلاته حتى يفتح مقعدته فيخيل إليه أنه أحدث ولم يُحدث، فإذا وجد أحدكم ذلك فلا ينصرفن حتى يسمع صوت ذلك بأذنه أو يجد ريح ذلك بأنفه».“তোমাদের কেউ যখন সালাতে থাকে তখন তার কাছে শয়তান এসে তার পায়ুপথ উন্মুক্ত করে তাকে সন্দিহান করে যে, সে বায়ু ত্যাগ করেছে যদিও সে বায়ু ত্যাগ করে নি। তোমাদের কেউ যখন এটা অনুভব করবে যতক্ষণ না সে ঐ শব্দ কানে শুনবে কিংবা ঐ গন্ধ নাকে শুঁকবে সালাত ছাড়বে না।”
ইমাম তাবরানি সংকলিত ‘মুজামুল কাবির’: খ.১১, পৃ.২২২, হাদীস নং ১১৫৫৬। হায়সামি ‘আল-মাজমা’: ১/২৪২ গ্রন্থে বলেছেন, হাদীসটি যারা বর্ণনা করেছেন তাদের সবার থেকেই সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে।
১৫। রাসূল সা, সাহাবা রা ও কবুলকৃত বান্দাদের দ্বীনের সালাতের অবস্থা পর্যলোচনা করা।
আলি রা. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, ”সালাতের সময় হলে আঁতকে উঠতেন, চেহারা ফেকাশে হয়ে যেত। কেউ জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি হয়েছে? বললেন, আমানতের সময় ঘনিয়ে আসছে, যে আমানত আসমান-জমিনের সামনে পেশ করা হলে, তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অপারগতা প্রকাশ করে। আর আমি তা গ্রহণ করি”।
সাহাবি সা’দ ইবনু মুয়াজ রা. বলেন, আমার ভেতর তিনটি স্বভাব আছে, যদি সর্বদা এগুলো বিদ্যমান থাকতো, তাহলে আমিই আমি হতাম। সালাতে দাড়ালে আমার অন্তর এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জবান থেকে কোনো জিনিস শুনলে বিন্দু মাত্র আমার অন্তরে সন্দেহের সৃষ্টি হয় না। জানাযার সালাতে আমি অন্তরে যা বলছি এবং মৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে যা বলা হচ্ছে এ ছাড়া অন্য কিছুর ভাবনা উদ্রেক হয় না। الفتاوى لابن تيمية (২২/৬০৫).
”সালাতে দাড়ালে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.- এর অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোতে কম্পন সৃষ্টি হত, যার ফলে ডান-বামে কাত হয়ে যেতেন।”
১৬। একাগ্রতার বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত সম্পর্কে জানা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যে ব্যক্তি সালাতের সময় হলে সুন্দরভাবে ওজু করে এবং সুন্দরভাবে রুকু-সেজদা ও একাগ্রতাসহ সালাত আদায় করে, তার এ সালাত পূর্বের সকল গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কবিরা গুনায় লিপ্ত না হয়। আর এ সুযোগ জীবন ভর।( সহিহ মুসলিম : ১/২০৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إن العبد إذا قام يصلي أُتي بذنوبه كلها فوضعت على رأسه وعاتقيه فكلما ركع أو سجد تساقطت عنه».
“বান্দা যখন সালাত পড়তে দাঁড়ায় তখন তার সকল পাপ এনে তার মাথা ও কাঁধের উপর রাখা হয়। তারপর যখন রুকু বা সাজদাহ করে তার পাপগুলো একেক করে ঝরে পড়ে।”ইমাম বায়হাকি সংকলিত ‘আস-সুনানুল কুবরা’: ৩/১০, দেখুন সহীহ আল-জামি।
মুনাওয়ি রহ. বলেন, “হাদীসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যখন মুসল্লি একটি রুকন ভালোভাবে সম্পন্ন করে তখন তার গুনাহের একটি অংশ ঝরে পড়ে। যখন সালাত শেষ হয় তখন তার গুনাহও শেষ হয়। এ ফযীলত কেবল সে সালাতের জন্যেই, যা সকল শর্ত ও রুকনসহ একাগ্রচিত্তে সম্পন্ন করা হয়। কারণ, হাদিসে উল্লিখিত দু’টি শব্দ ‘আবদ’ ও ‘কিয়াম’ আল্লাহর সামনে বিনয় ও একাগ্রচিত্তে দাঁড়ানোকে দাবি করে।”ইমাম বায়হাকি সংকলিত ‘আস-সুনানুল কুবরা’: ৩/১০; ইমাম মুনাভি প্রণীত ‘জামি সাগিরে’র ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফয়যুল কাদির’: ২/৩৬৮।
ইবনুল কাইয়্যেম রহ.-এর কথাগুলো স্মরণ করা যে, “সালাত আদায়কারী যখন একাগ্রচিত্তে সালাত শেষ করে তখন সে নিজেকে ভারমুক্ত অনুভব করে, যেন তার ওপর থেকে বোঝা নামানো হয়েছে, ফলে সে কাজে-কর্মে তৃপ্তি, প্রশান্তি ও ফুরফুরে মেজাজ উপলব্ধি করে। আর আক্ষেপ করে, যদি সালাতেই থাকতাম! কারণ, সালাত তার চোখের শীতলতা, রূহের সজীবতা, অন্তরের জান্নাত ও পার্থিব জগতে শান্তির নিরাপদ স্থান। যতক্ষণ না পুনরায় সালাতে প্রবেশ করে নিজেকে জেলখানা ও সংকীর্ণ স্থানে বন্দী ভাবে। বস্তুত, এরূপ মুসল্লিই সালাতের দ্বারা প্রশান্তি অর্জন করে, ফলে সে সালাত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। আল্লাহকে মহব্বতকারীরা বলেন: আমরা সালাতে স্বস্তি পাই, তাই সালাত আদায় করি, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, «يا بلال أرحنا بالصلاة» ‘হে বেলাল, সালাতের দ্বারা আমাদের স্বস্তি দাও।’ তিনি বলেন নি, সালাত থেকে স্বস্তি দাও। তিনি আরো বলেছেন, «جعلت قرة عيني بالصلاة» ‘আমার চোখের শীতলতা করা হয়েছে সালাতে।’ অতএব, যার চোখের শীতলতা সালাতে, সে কীভাবে সালাত ছাড়া শান্তি পায় এবং কীভাবে সালাত ছাড়া থাকতে পারে?” ইবনুল কাইয়্যেম প্রণীত ‘আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব’: ৩৭।
১৭। সালাতের ভেতর দোয়ার স্থানে খুব দোয়া করা। বিশেষ করে সেজদার ভেতর।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তার সামনে বিনয়ীভাব, বান্দার একাগ্রতা ও খুশু বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত: দোয়া হচ্ছে ইবাদত, বান্দা যার জন্য আদিষ্ট। ইরশাদ হচ্ছে ”তোমাদের প্রভুকে আস্তে এবং ক্রন্দন রত অবস্থায় ডাকো।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ” যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না, আল্লাহর তার প্রতি অসুন্তুষ্ট।” رواه الترمذي كتاب الدعوات (১/৪২৬) وحسنه في صحيح الترمذي (২৬৮৬).
সালাতের বিভিন্ন স্থানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বিভিন্ন দোয়া প্রমাণিত আছে। যেমন, সেজদা, দুই সেজদার মাঝখানে, তাশাহুদের পরে। তবে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো সেজদা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”সেজদাতে বান্দা আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হয়ে যায়। তোমরা এতে বেশি বেশি দোয়া কর।” ( সহিহ মুসলিম : ২১৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ”তোমরা সেজদাতে খুব দোয়া কর। এ দোয়াই কবুল হওয়ার ব্যাপারে বেশি আশা করা যায়। ” ( সহিহ মুসলিম : ২০৭)
সেজদায় পঠিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতক দোয়া :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাজদায় অনেক দো’আ করতেন, কয়েকটি দো’আ নিম্নরূপ:
«اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي كُلَّهُ دِقَّهُ وَجِلَّهُ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ سِرَّهُ وَعَلانِيَتَهُ».
“হে আল্লাহ, আমার ছোট ও বড়, প্রথম ও শেষের, গোপন ও প্রকাশ্যের সকল পাপ মাফ কর।সহীহ মুসলিম, ২১৬।
«اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي مَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ».
“হে আল্লাহ, আমি যা আড়াল করেছি এবং যা প্রকাশ করেছি সব তুমি ক্ষমা কর।”
ইমাম নাসাঈ সংকলিত ‘আল-মুজতাবা’, হাদীস নং ২/৫৬৯; সহীহ নাসাঈ, হাদীস নং ১০৬৭।
আর তাশাহহুদ শেষে তিনি যেসব দো’আ পড়তেন, তার ভেতর কয়েকটি নিম্নরূপ:
«إذا فرغ أحدكم من التشهد فليستعذ بالله من أربع؛ من عذاب جهنم، ومن عذاب القبر، ومن فتنة المحيا والممات، ومن شر المسيح الدجال»
“যখন তোমাদের কেউ তাশাহহুদ থেকে অবসর হবে, তখন আল্লাহর নিকট চারটি বস্তু থেকে পানাহ চাইবে: জাহান্নামের শাস্তি, কবরের আযাব, জীবন-মৃত্যুর ফিতনা ও মাসিহ দাজ্জালের অনিষ্ট।” কখনো তিনি বলতেন,
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ، وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أَعْمَلْ».
“হে আল্লাহ, আমি যা করেছি এবং যা করি নি তার অনিষ্ট থেকে তোমার নিকট পানাহ চাই।” কখনো তিনি বলতেন
«اللَّهُمَّ حَاسِبْنِي حِسَابَاً يَسِيرَاً».
“হে আল্লাহ, আমার হিসেব সহজ কর।” তাশাহহুদ শেষে তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলতে শিখিয়েছেন,
«اللَّهُمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ. فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ».
“হে আল্লাহ, আমি আমার নফসের উপর অনেক জুলম করেছি, আর আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না, অতএব আপনি আমাকে আপনার পক্ষ থেকে অনেক ক্ষমা করুন এবং আমাকে রহম করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক সাহাবীকে তাশাহহুদ শেষে বলতে শুনলেন,
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ يَا أَللَّهُ بِأَنَّكَ الْوَاحِدُ الْأَحَدُ الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ ، أَنْ تَغْفِرَ لِي ذُنُوبِي إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ»
“হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ, আপনি নিশ্চয় এক, একক ও অমুখাপেক্ষী। যিনি জন্ম দেননি এবং যাকে জন্ম দেওয়া হয় নি এবং কেউ তার সমকক্ষ নয়। আপনি আমার পাপসমূহ ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি অতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”
তারপর তাকে লক্ষ্য করে বললেন, সে ক্ষমা প্রাপ্ত হয়েছে, সে ক্ষমা প্রাপ্ত হয়েছে।
অপর ব্যক্তিকে তিনি তাশাহহুদ শেষে বলতে শুনলেন,
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ وَحْدَكَ لاَ شَرِيكَ لك الْمَنَّانُ يا بَدِيعَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ، يَا ذَا الْجَلالِ وَالإِكْرَامِ، يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ، إِنِّي أَسْأَلُكَ الْجَنَّةَ وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ النَّارِ».
“হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি যে, আপনার জন্যেই সকল প্রশংসা। আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনি এক, আপনার কোনো শরীক নেই। আপনি অনুগ্রহকারী, হে আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা। হে মর্যাদার অধিকারী ও সম্মানিত। হে চিরঞ্জীব ও চির প্রতিষ্ঠিত, আমি আপনার নিকট জান্নাত চাই ও জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।”
তারপর তিনি সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা জান সে কীসের মাধ্যমে দো’আ করেছে? তারা বলল, আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। তিনি বললেন:
«والذي نفسي بيده لقد سأل الله باسمه الأعظم الذي إذا دُعي به أجاب وإذا سُئل به أعطى».
“সে সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার নফস, সে ইসমে-আযম অর্থাৎ আল্লাহর মহান নামের উসিলায় দো’আ করেছে, যে নামের উসিলায় দো’আ করলে তিনি সারা দেন, আর প্রার্থনা করলে প্রার্থিত বস্তু প্রদান করেন।”
নাসিরুদ্দিন আলবানি রহ. ‘সিফাতুস সালাত’ গ্রন্থে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশাহহুদ ও সালামের মধ্যবর্তী সর্বশেষ বলতেন:
«اللهم اغفرلي ما قدمت وما أخرت، وما أسررت وما أعلنت، وما أسرفت، وما أنت أعلم به مني، أنت المقدم وأنت المؤخر، لا إله إلا أنت».
“হে আল্লাহ, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, যা আগে প্রেরণ করেছি ও যা পরে প্রেরণ করেছি এবং যা গোপন করেছি ও যা প্রকাশ করেছি। আর যা আপনি আমার চেয়েও বেশি জানেন। আপনি প্রথম এবং আপনি সর্বশেষ। আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।”
বিশেষ জ্ঞাতব্য: এ দো’আ ও বইটিতে উল্লিখিত অন্যান্য দো’আর সূত্র ও বিস্তারিত তথ্য জানার জন্যে নাসিরুদ্দিন আলবানি রহ. রচিত ‘সিফাতুস সালাত’ গ্রন্থটি দেখুন।
যেসব মুসল্লি ইমামের পেছনে তাশাহহুদ শেষে চুপচাপ বসে থাকেন, তারা এসব দো’আ মুখস্থ করে তখন পড়তে পারেন। বস্তুত, সালাতের বিভিন্ন জায়গায় পঠনীয় একাধিক দো’আ যারা জানেন না ইমামে পেছনে তাদের চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কিছু করার থাকে না। এ সময় শয়তান ওয়াসওয়াসা দিতে বেশি সমর্থ হয়, তাই তাশাহহুদ শেষে পড়ার জন্যে বেশ বিশুদ্ধ কিছু দো’আ মুখস্থ রাখা বাঞ্ছনীয়।
১৮. সালামের পর মাসনুন দো’আসমূহ মনোযোগ দিয়ে পড়া।
মাসনুন দো’আর ফলে অন্তরের একাগ্রতা, সালাতের বরকত ও তার ফায়দা দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়। জ্ঞাতব্য যে, পূর্বের ইবাদতের সুরক্ষা ও তার হিফাজতের স্বার্থে পরবর্তী ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া জরুরি। এ সূত্রে সালাতের পরবর্তী ইবাদত মাসনুন দো’আ ও যিকর। লক্ষ্য করুন, যিকিরসমূহের প্রথমে আছে তিনবার ইস্তেগফার। তার অর্থ হচ্ছে, মুসল্লি তার রবের নিকট সালাতের ত্রুটি ও তাতে খুশুর ঘাটতি পুষিয়ে নিতে রবের নিকট ক্ষমা চাইছে। অনুরূপভাবে বেশিবার নফল সালাত আদায় করার বিষয়টিও তেমন। কারণ, নফল সালাত দ্বারা ফরয সালাতের রুকনের ত্রুটি ও তার খুশুর ঘাটতির প্রতিকার করা হবে।
এ পর্যন্ত আমরা খুশু ও একাগ্রতার সহায়ক করণীয় উপায় নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার আমরা তার প্রতিবন্ধক বর্জনীয় উপকরণ নিয়ে আলোচনা করব।
১। «أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ» (তিনবার) (আস্তাগফিরুল্লা-হ) (তিনবার) “আমি আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
২। «اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ، وَمِنْكَ السَّلاَمُ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ».
(আল্লা-হুম্মা আনতাস্ সালা-মু ওয়া মিনকাস্ সালা-মু তাবা-রক্তা ইয়া যালজালা-লি ওয়াল-ইকরা-ম)।
“হে আল্লাহ! আপনি শান্তিময়। আপনার নিকট থেকেই শান্তি বর্ষিত হয়। আপনি বরকতময়, হে মহিমাময় ও সম্মানের অধিকারী” মুসলিম ১/৪১৪, নং ৫৯১।
اللهم أعني على ذكرك وشكرك وحسن عبادتك
৩। উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, আ‘ইন্নী ‘আলা- যিকরিকা ওয়া শুকরিকা ওয়া হুসনি ‘ইবা-দাতিকা।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি আমাকে আপনার যিকর করতে, শুকর করতে এবং আপনার ইবাদত সুনদরভাবে করতে তাওফীক ও ক্ষমতা প্রদান করুন।”
মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার হাত ধরে বলেন, মু’আয, আমি তোমাকে ভালবাসি। … মু’আয, আমি তোমাকে ওসীয়ত করছি, প্রত্যেক সালাতের পরে এই দু‘আটি বলা কখনো বাদ দিবে না। হাদিসটি সহীহ। সুনানু আবী দাউদ ২/৮৬, নং ১৫২২, মুসতাদরাক হাকিম ১/৪০৭, ৬৭৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫/৩৬৪-৩৬৫, আত-তারগীব ২/৪৫০-৪৫১।
৪। لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ [তিনবার]،
اللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الجَدُّ».
(লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মূলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাই’ইন ক্বাদীর। [তিন বার] আল্লা-হুম্মা লা মানি‘আ লিমা আ‘তাইতা, ওয়ালা মু‘তিয়া লিমা মানা‘তা, ওয়ালা ইয়ানফা‘উ যালজাদ্দি মিনকাল জাদ্দু)। “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর, আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (তিনবার)
হে আল্লাহ, আপনি যা প্রদান করেছেন তা বন্ধ করার কেউ নেই, আর আপনি যা রুদ্ধ করেছেন তা প্রদান করার কেউ নেই। আর কোনো ক্ষমতা-প্রতিপত্তির অধিকারীর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি আপনার কাছে কোনো উপকারে আসবে না।” বুখারী ১/২২৫, নং ৮৪৪
৪। لَا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، وَلاَ نَعْبُدُ إِلاَّ إِيَّاهُ, لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ، لَا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الكَافِرُونَ».
(লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাই’ইন ক্বাদীর। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়ালা না‘বুদু ইল্লা ইয়্যাহু। লাহুন নি‘মাতু ওয়া লাহুল ফাদলু, ওয়া লাহুসসানাউল হাসান। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিসীনা লাহুদ-দীন ওয়া লাও কারিহাল কাফিরূন)। “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর, আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎকাজ করার) কোনো শক্তি নেই। আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, আমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করি, নেয়ামতসমূহ তাঁরই, যাবতীয় অনুগ্রহও তাঁর এবং উত্তম প্রশংসা তাঁরই। আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, আমরা তাঁর দেয়া দ্বীনকে একনিষ্ঠভাবে মান্য করি, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে”। মুসলিম ১/৪১৫, নং ৫৯৪।
৫। «سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ» (৩৩ বার)
« لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ».
(সুবহা-নাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লা-হু আকবার) (৩৩বার)
(লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লি শাই’ইন কাদীর)।
“আল্লাহ কতই না পবিত্র-মহান। সকল প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। আল্লাহ সবচেয়ে বড়।” (৩৩ বার)
“একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।” মুসলিম, ১/৪১৮, নং ৫৯৭
৬। প্রত্যেক সালাতের পর একবার, সূরা ইখলাস, সূরা আল-ফালাক ও সূরা আন-নাস। সহীহুত তিরমিযী,
৭। আয়াতুল কুরসী। প্রত্যেক সালাতের পর একবার। নাসাঈ, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ, নং ১০০
৮। (সালাতের পরের দু‘আ-১০০ বার)
اللهم اغفر لي وتب علي إنك أنت التواب الرحيم – التواب الغفور
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাগফির লী, ওয়াতুব্ ‘আলাইয়্যা, ইন্নাকা আন্তাত তাওয়া-বুর রাহীম (অন্য বর্ণনায়: [তাওয়াবুল গাফূর])।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল করুণাময় (অন্য বর্ণনায়: তাওবা কবুলকারী ক্ষমাশীল)।”
একজন আনসারী সাহাবী বলেনঃ (سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول في دبر الصلاة) “আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সালাতের পরে এই দু’আ বলতে শুনেছি ১০০ বার।”
এই হাদীসের দ্বিতীয় বর্ণনায় বলা হয়েছে:
صلى رسول الله صلى الله عليه وسلم الضحي (ركعتي الضحي) ثم قال …
“রাসূলুল্লাহ (সা.) দোহার বা চাশতের [দুই রাক’আত] সালাত আদায় করেন। এরপর এই দু‘আ ১০০ বার পাঠ করেন।
দুটি বর্ণনাই সহীহ। প্রথম বর্ণনা অনুসারে সকল সালাতের পরেই এই দু‘আ মাসনূন বলে গণ্য হবে। তবে অন্তত ‘সালাতুদ দোহার’ পরে এই দু‘আটি ১০০ বার পাঠ করার বিষয়ে সকল যাকিরের মনোযোগী হওয়া উচিত। বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ ১/২১৭, সহীহুল আদাবিল মুফরাদ, পৃ. ২৩০-২৩২, নং ৪৮১/৬১৮, ৪৮২/৬১৯,
দ্বিতীয়ত, একাগ্রতা বিনষ্টকারী উপকরণসমূহ
১। সালাতের স্থান হতে সে সকল জিনিস দূরীভূত করা, যা সালাতের একাগ্রতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
আয়েশা রা. কিরাম তথা কারুকার্য খচিত কিংবা রঙ্গিন এক জাতীয় পর্দার কাপড় দ্বারা ঘরের পার্শ্ব ঢেকে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এগুলো আমার কাছ থেকে হটাও। কারণ, সালাতের ভেতর এগুলো আমার সামনে বার বার ভেসে উঠে। (বোখারি, ফতহুল বারি :১০/৩৯১)
আরেকটি হাদিসে আছে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত পড়ার জন্যে কা’বায় প্রবেশ করেন, সেখানে তিনি ভেড়ার দু’টি শিং দেখতে পান, সালাত শেষ করে উসমান আল-হাজাবিকে বলেন,
তোমাকে শিং দুটি আচ্ছাদিত করার হুকুম দিতে ভুলে গিয়ে ছিলাম। কাবা ঘরে এমন কোনো জিনিস থাকা উচিত নয়, যা নামাজির একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়।” أخرجه أبوداود (২০৩০) وهو في صحيح الجامع (২৫০৪).
নামাজি ব্যক্তির উচিত, মানুষের চলাচলের রাস্তা, শোরগোল এবং হইচই-এর স্থান, আলাপ চারিতায়রত ব্যক্তিদের পার্শ্ব এবং গান-বাজনার স্থান পরিহার করা। এবং সম্ভব হলে প্রচন্ড গরম ও কনকনে শীতের স্থান এড়িয়ে সালাত পড়া। কারণ, এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহর সালাত ঠান্ডা আবহাওয়ায় পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ”প্রচন্ড গরম নামাজি ব্যক্তির একাগ্রতা ও খুশুতে প্রভাব ফেলে। ফলে সে অপ্রসন্ন ও অনীহাভাব নিয়ে ইবাদত আদায় করে। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত দেরিতে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে গরম পড়ে যায় আর নামাজির অন্তরের উপস্থিতি হয়। তবেই সালাতের উদ্দেশ্য তথা খুশু ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জিত হবে। )الوابل الصيب ط. دار البيان ص : ২২. (
২। সালাতের একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন কারুকার্য খচিত, লেখা ও ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত, রঙ্গিন ও ছবিযুক্ত কাপড় পরিধান না করা।
আয়েশা রা. বলেন, ”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কার্পেটে সালাত আদায় করার সময় তার কারুর্যের প্রতি নজর পড়ে। সালাত শেষ করে বলেন, এ কার্পেটটি আবু জাহাম ইবনে হুজায়ফার নিকট নিয়ে যাও, আমার জন্য একটি আনজাবিয়া তথা কারুকার্যহীন কাপড় নিয়ে আস। এ কার্পেটটি সালাতের ভেতর আমাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছে।”(সহিহ মুসলিম : ১/৩৯১ হাদিস নং ৫৫৬)
এ থেকেই কারুকার্য খচিত কাপড় বিশেষ করে প্রাণীর ছবিযুক্ত কাপড় পরিহার করার আবশ্যকতা প্রতীয়মান হয়।
৩। খাবারের চাহিদা নিয়ে সালাত না পড়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”খানার উপস্থিতিতে কোনো সালাত নেই।” ( সহিহ মুসলিম : ৫৬০)
সুতরাং যখন খানা তৈরী হয়ে যায় এবং সামনে উপস্থিত করা হয়, তখন আগে খানা খেয়ে নেয়া। কারণ, এমতাবস্থায় সালাতে একাগ্রতা আসে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যখন রাতের খাবার উপস্থিত হয়ে যায়, তখন মাগরিবের আগে খানা খেয়ে নাও। তাড়াহুড়ো করো না। অন্য বর্ণনায় আছে, যখন খানা সামনে চলে আসে আর সালাতেরও সময় হয়ে যায়, তখন আগে খানা খেয়ে নাও। খানা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করো না।”
)متفق عليه، البخاري كتاب الأذان، باب إذا حضر الطعام وأقيمت الصلاة، وفي مسلم رقم (৫৭৫، ৫৫৯).(
৪। পেশাব পায়খানার বেগ চেপে রেখে সালাত না পড়া।
কারণ, পেশাব পায়খানার বেগ থাকলে সালাতে একাগ্রতা আসবে না। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন, কেউ পেশাব চেপে রেখে সালাত পড়বে না।”
رواه ابن ماجه في سننه رقم (৬১৭) وهو في صحيح الجامع رقم (৬৮৩২).
যদি সালাতের কিছু অংশ ছুটেও যায়, তবুও প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে নেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমাদের কারো বাথরুমের প্রয়োজন মুহূর্তে সালাতের সময় হয়ে গেলে আগে বাথরুম সেরে নিবে।” (আবু দাউদ : ৮৮, সহিহ আল-জামে : ২৯৯)
বরং সালাতের মাঝখানেও পেশাব-পায়খানার বেগ হলে, সালাত ছেড়ে আগে প্রয়োজন সেরে নিবে। অত:পর অজু করে সালাত পড়বে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”খানার উপস্থিতে কোনো সালাত নেই, তদ্রুপ বাথরুম চেপে রেখেও কোন সালাত নেই।”[৮] ( সহিহ মুসলিম : ৫৬০)
কারণ, এর দ্বারা সালাতের একাগ্রতা দূরীভূত হয়ে যায়। স্মর্তব্য বাতকর্ম চেপে রাখাও এর অর্ন্তভুক্ত।
৫ : ঘুমের চাপ নিয়ে সালাত না পড়া।
আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমাদের কারো সালাতে তন্দ্রাভাব হলে ঘুমিয়ে নাও। যাতে যা বল তা বুঝতে পার।” (সহিহ মুসলিম : ৫৬০)
অর্থাৎ শুয়ে পড় যাতে ঘুম চলে যায়। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, ”যখন তোমাদের কারো সালাতে তন্দ্রাচ্ছন্নভাব হবে সুয়ে পড়বে। যাতে ঘুম চলে যায়। কারণ, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এস্তেগফার করার সময় হয়তো নিজেকে অভিসম্পাত করে বসবে।” ( সহিহ বোখারি : ২০৯)
এ অবস্থা সাধারণত তাহাজ্জুদের সালাতে হয়। তখন দোয়া কবুলের সময় বদ দোয়াও হয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, ফরজ সালাতও এর অর্ন্তভুক্ত, যদি সময় বাকি থাকার নিশ্চয়তা থাকে।
فتح الباري، شرح كتاب الوضوء، باب الوضوء من النوم.
৬। আলাপচারিতায় রত ব্যক্তি কিংবা ঘুমন্ত ব্যক্তিদের পেছনে সালাত পড়বে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমরা কেউ ঘুমন্ত ব্যক্তি কিংবা আলাপচারিতায় রত ব্যক্তির পেছনে সালাত পড়বে না।”رواه أبو داود رقم (৬৯৪) وهو في صحيح الجامع رقم (৩৭৫) وقال: حديث حسن.
কারণ, আলাপচারিতায় রত ব্যক্তি তার কথপোকথনের দ্বারা নামাজির সালাতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবে। আর ঘুমন্ত ব্যক্তি হতে এমন কিছু প্রকাশ পেতে পারে, যার দ্বারা তার সালাতের একাগ্রতা নষ্ট হবে।
ইমাম খাত্তাবি রহ. বলেন, ”কথপোকথনে মশগুল ব্যক্তিদের পিছনে সালাত পড়া ইমাম শাফি রহ. ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. মাকরূহ বলেছেন। কারণ, তাদের কথপোকথন নামাজি ব্যক্তির সালাতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবে।” (আওনুল মাবুদ : ২/৩৮৮)
তবে, ঘুমন্ত ব্যক্তির পিছনে সালাত না পড়ার দলিলগুলোকে অনেক ওলামায়ে কেরাম দুর্বল বলেছেন।
منهم أبوداود في سننه كتاب الصلاة، تفريع أبواب الوتر : باب الدعاء، وابن حجر في فتح الباري شرح باب الصلاة خلف النائم، كتاب الصلاة.
ইমাম বোখারি রহ. তার সহিহ বোখারিতে একটি অধ্যায় কায়েম করেছেন, ‘বাবুস সালাতি খালফান্নায়েম’ তথা ঘুমন্ত ব্যক্তির পিছনে সালাত পড়ার অধ্যায় নামে। সেখানে তিনি আয়েশা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেন, ”রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত পড়তেন, আর আমি তার সামনে বিছানায় বরাবর শুয়ে থাকতাম।” صحيح البخاري، كتاب الصلاة.
ইমাম মালেক, মুজাহেদ, তাউস রহ. প্রমুখ ঘুমন্ত ব্যক্তির পিছনে সালাত পড়াকে মাকরূহ বলেছেন। কারণ, ঘুমন্ত ব্যক্তি হতে এমন কিছু প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা নামাজিকে অন্যমনস্ক করে দিতে পারে। فتح الباري، كتاب الصلاة.
৭। সেজদার জায়গা হতে ধুলো-বালি কিংবা পাথর কুচি হটাতে ব্যস্ত না হয়ে যাওয়া।
বোখারি রহ. মুআইকিব রা. হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদার জায়গা হতে ধুলো বালি হটানো ব্যক্তিকে বলেছেন, ”যদি তোমার একান্ত প্রয়োজন হয়, তাহলে একবার।” (ফতহুল বারি : ৩/৭৯)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ”সালাত রত অবস্থায় সেজদার জায়গা মুছবে না। একান্ত প্রয়োজন হলে একবার।” رواه أبو داود رقم (৯৪৬) وهو في صحيح الجامع رقم (৭৪৫২).
এর কারণ হলো সালাতের একাগ্রতা বজায় রাখা, যাতে এর ভেতর অন্য কোনো কাজ প্রাধান্য না পায়। বরং সবচে’ উত্তম হলো সালাতের পূর্বেই সেজদার স্থান পরিস্কার করে নেয়া।
সালাতের ভেতর কপাল কিংবা নাক মোছাও এর অর্ন্তভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটির উপর, পানির উপর সেজদা করেছেন। সালাত শেষে তার লক্ষণও দেখা গেছে। তিনি প্রত্যেকবার উঠাবসায় মাটি-পানি কিছুই পরিস্কার করেননি। সালাতের একাগ্রতা এসব জিনিস ভুলিয়ে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন-ই ”সালাতের কঠিন ব্যস্ততা রয়েছে।” (বোখারি : ফতহুল বারি : ৩/৭২)
মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাতে আছে, সাহাবি আবু দারদার বলেন, ”আরবের নিকট সর্বাধিক প্রিয় সম্পদ, লাল উটের বিনিময়েও আমি সেজদার জায়গা হতে ধুলো বালি মোছা পছন্দ করি না।” ইয়াজ রহ. বলেন, ”আকাবেরগণ সালাত থেকে ফারেগ হওয়ার আগে কপাল মুছা মাকরূহ বলেছেন।” (ফতহুল বারি : ৩/৭৯)
৮। সূরা-কেরাত উচ্চস্বরে পড়ে অন্যদের সালাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করা।
মুসল্লিদের নিজ সালাতের প্রতি যেমন যত্নবান থাকা জরুরি, তদ্রুপ অন্যদের সালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে এমন কাজ করাও নিষিদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”স্মরণ রেখ! তোমরা সকলেই আল্লাহর সাথে কথপোকথন কর। অতএব কেউ কাউকে কষ্ট দিবে না। অপরের চেয়ে উচ্চ আওয়াজেও পড়বে না।” অপর এক বর্ণনাতে আছে, ”একে অপরের চেয়ে জোর কন্ঠে তেলাওয়াত করবে না।” (ইমাম আহমদ : ২/৩৬, সহিহ আল-জামে : ১৯৫১)
একটি বর্ণনাতে আছে, ”এ হুকুমটি সালাতে।” (আবু দাউদ : ২/৮৩, সহিহ আল-জামে : ৭৫২)
৯। সালাতে এদিক সেদিক না তাকানো।
আবু জর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ” (নামাজি) বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত এদিক সেদিক না তাকায়, আল্লাহ তার প্রতি মনোনিবেশন করে থাকেন। যখন এদিক সেদিক তাকায় আল্লাহ দৃষ্টি হটিয়ে নেন।” (আবু দাউদ : ৯০৯, হাদিসটি সহিহ)
সালাতের ভেতর ইলতেফাত তথা এদিক সেদিক তাকানো দু’ধরণের : অন্তরের ইলতেফাত, চোখের ইলতেফাত। উভয় ইলতেফাত নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এলতেফাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ”এ হলো কেড়ে নেয়া, এর মাধ্যমে শয়তান বান্দার সালাতের সাওয়াব কেড়ে নেয়।” رواه البخاري، كتاب الأذان، باب: الالتفات في الصلاة.
এলতেফাতের একটি উদাহরণ : কোনো ব্যক্তিকে বাদশাহ ডেকে এনে সামনে রেখে কথপোকথন করছে আর সে বাদশাহকে এড়িয়ে ডান-বামে তাকাচ্ছে। যার কারণে সে বাদশাহর কোনো কথাই বুঝতে পারেনি। কারণ, তার অন্তর এখানে উপস্থিত ছিল না। আপনার কি ধারণা- বাদশাহ এ ব্যক্তিকে কি করবে? কমপক্ষে স্বীয় দরবার হতে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে না?-অবশ্যই দিবে। এর বিপরীতে যে ব্যক্তি সর্বাঙ্গীন একাগ্রতা নিয়ে আল্লাহর সমীপে দন্ডায়মান। আল্লাহর প্রতিটি বাক্যে সে ধ্যান দিচ্ছে, তার বড়ত্ব ও মহব্বতে অন্তর ভরে আছে, ডানে-বামে তাকাতে লজ্জাবোধ করছে। এ দুজনের সালাতের ভেতর পার্থক্যের তুলনায় হাস্সান ইবনে আতিয়ার উক্তিই প্রযোজ্য। তিনি বলেন, একই সাথে দু’জন ব্যক্তি সালাত পড়ে, অথচ দু’জনের সালাতের মাঝখানে আসমান-জমিন র্পাথক্য। একজন আল্লাহর প্রতি মনোযোগী, অপরজন অন্যমনস্ক। الوابل الصيب، ص: ৩৬ ط. دار البيان.
তবে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ডান-বামে তাকানো কোনো দোষের নয়: ইমাম আবু দাউদ রহ. সাহাবি হানজালিয়া রা. হতে বর্ণনা করেন, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইন যুদ্ধের প্রাক্কালে সাহাবি আনাস বিন আবু মারসাদ আল-গানাবিকে পাহারাদারির জন্য গিরিপথে নিয়োজিত করেছিলেন, ভোরে ফজরের দু’রাকাত সুন্নত পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, আবু মারসিদের কোনো খবর আছে কি? তারা বলল, না-আমরা কোনো খবর পায়নি। একামত দেয়া হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত পড়াতে পড়াতে পাহাড়ের গিরিপথের পানে তাকাতে ছিলেন।” ( একটি দীর্ঘ হাদিসের সংক্ষিপ্ত রূপ : আবু দাউদ : ২১৪০)
প্রয়োজনের স্বার্থে এলতেফাতের আরো উদাহরণ : ”উমামা বিনতে আবিল আসকে সালাতে কোলে তুলে নেওয়া। আয়েশা রা.-কে দরজা খুলে দেয়া। শেখানোর উদ্দেশ্যে মিম্বারে চড়ে সালাত পড়া আবার নেমে যাওয়া। সূর্য গ্রহণের সালাতের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে হটে আসা। সালাতে বিঘ্নতা সৃষ্টির সময় শয়তানের গলা চেপে ধরা। সালাতের ভেতর সাপ মারার নির্দেশ প্রদান করা। সালাতের সামনে দিয়ে চলন্ত ব্যক্তিকে বাধা প্রদান করা, প্রয়োজনে তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। সালাতের ভেতর নারীদের হাতে হাত মারা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইশারা করা। এ ধরনের আরো কিছু কাজ আছে যা প্রয়োজনে করা হলে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। তবে এগুলোই প্রয়োজন ব্যতীত করা হলে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক বলে বিচেচিত হবে।” (মাজমুউল ফাতাওয়া : ২২/৫৫৯)
১০। আকাশের দিকে চোখ তুলে না তাকানো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমরা কেউ সালাতের মধ্যে আসমানের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। দৃষ্টি হরণ করে নেয়া হতে পারে।” (আহমদ : ১৫০৯৮, ২১৪৭৮, নাসায়ী : ১১৮১, সহিহ আল-জামে : ৭৬২)
অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”মানুষের কি হলো ?-তারা কেন সালাতে আসমানের দিকে দৃষ্টি দেয় ? আরেকটি বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দোয়ার সময় আসমানের দিকে দৃষ্টি দিতে নিষেধ করেছেন।” (সহিহ মুসলিম : ৪২৯)
আরো কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ”তোমরা হয়তো এ থেকে বিরত থাকবে, অন্যথায় তোমাদের দৃষ্টি ছিনিয়ে নেয়া হবে।”
رواه البخاري في صحيحه كتاب الأذان، باب رفع البصر إلى السماء في الصلاة، وراه الإمام أحمد (৫/২৫৮)
১১। সালাতে সম্মুখ পানে থুতু নিক্ষেপ না করা।
এটি আল্লাহর সাথে আদব এবং সালাতের একাগ্রতা উভয়ের বিপরীত।
”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”তোমাদের কেউ সালাতের সময় সামনের দিকে থুতু নিক্ষেপ করবে না। কারণ, সালাতের সময় আল্লাহ তাআলা তার সামনে বিদ্যমান থাকেন।” (সহিহ বোখারি : ৩৯৭)
তিনি আরো বলেন, ”তোমাদের কেউ সালাতে দাড়িয়ে সামনের দিকে থুতু নিক্ষেপ করবে না। কারণ সে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর সাথে কথপোকথনে লিপ্ত থাকে। ডান দিকেও না, সেদিকে ফেরেশতা থাকে। বরং বাম দিকে কিংবা পায়ের নিচে নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দিবে।” ( সহিহ বোখারি : ১৪১৬/৫১২)
বোখারির আরেকটি হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”যে সালাতে দাড়ায় সে মূলত: আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। আল্লাহ কেবলা এবং তার মাঝখানেই থাকেন। সুতরাং কেবলার দিকে কেউ থুতু নিক্ষেপ করবে না। করলে বাম দিকে অথবা পায়ের নিচে।” ( সহিহ বোখারি : ১৪১৭/৫১৩)
বর্তমান সময়ে যেহেতু সব মসজিদই মোজাইক, টাইলস কিংবা কার্পেডিং করা থাকে, তাই প্রয়োজন হলে সাথে রুমাল রাখবে এবং তাতে থুতু রেখে পকেটে ভরে রাখবে।
১২। হাই তোলা যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”সালাতে কারো হাই আসলে, যথাসম্ভব প্রতিরোধ করবে। কারণ, (হাইর মাধ্যমে) শয়তান ভেতরে প্রবেশ করে।” ( সহিহ মুসলিম : ৪/২২৯৩)
যার মাধ্যমে সে একাগ্রতা ভঙ্গের সুযোগ আরো বেশী পায়। আর নামাজির হাই তোলা দেখে তার খুশি হওয়া তো আছেই।
প্রশ্ন: নামাজ রত অবস্থায় হাঁচি আসলে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ আর হাই আসলে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বা ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম’ পাঠ করা জায়েয কি?
উত্তর:
নামাজ রত অবস্থায় হাঁচি আসলে অধিক বিশুদ্ধ মতে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ পাঠ করা জায়েজ আছে।
এ ব্যাপারে হাদিস হল:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا عَطَسَ أَحَدُكُمْ فَلْيَقُلْ: الحَمْدُ لِلَّهِ
“তোমাদের কেউ হাঁচি দিলে সে যেন আলহামদুলিল্লাহ বলে।”
[সহিহুল বুখারী, হাদিস নং-৬২২৪]
এখানে সাধারণভাবে যে কোনো সময় হাঁচি আসলে ‘আল হামদু লিল্লাহ’ পাঠ করার কথা বলা হয়েছে। তবে বিশেষভাবে সালাত রত অবস্থায় আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করার কথা নিম্নোক্ত হাদিসদ্বারা প্রমাণিত:
রিফাআ ইবনে রাফি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন: আমি একবার রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে সালাত আদায় করছিলাম। তখন আমার হাঁচি এলো। আমি বললাম,
الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ مُبَارَكًا عَلَيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى
“আল্লাহর জন্য পবিত্র ও বরকতময় অনেক অনেক প্রশংসা-যেভাবে প্রশংসা করলে আমাদের প্রতিপালক পছন্দ করবেন এবং সন্তুষ্ট হবেন।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষে ফিরে বললেন: সালাতে কে কথা বলছিল?
কিন্তু কেউ উত্তর দিলেন না।
দ্বিতীয়বার তিনি বললেন, সালাতে কে কথা বলছিল? কিন্তু কেউ উত্তর দিলেন না।
পরে তৃতীয়বার তিনি বললেন, সালাতে কে কথা বলছিল?
তখন রিফাআ ইবনু রাফি ইবনু আফরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কথা বলছিলাম।
তিনি বললেন, কী বলছিলে?
তিনি বললেন, আমি বলছিলামঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ مُبَارَكًا عَلَيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ
“সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, ত্রিশেরও অধিক ফেরেশতা দৌড়ে এসেছেন কে আগে এর সওয়াব উঠিয়ে নিতে পারন।” [সহিহ আবু দাউদ, হা/ ৭৪৭, মিশকাত ৯৯২, তিরমিজী হাদিস, হা/ ৪০৪ [আল মাদানী প্রকাশনী])
এই বিষয়ে আনাস, ওয়াইল ইবনু হুজর ও আমির ইবনু রাবীআ রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে।
ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী রাহ. বলেন, এই হাদীসটি নফল সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
[সুনান তিরমিজী) / অধ্যায়ঃ ২/ সালাত, পরিচ্ছদ: সালাতে হাঁচি আসলে করণীয়]
তবে মুহাক্কিক আলমগণ বলেন, যে কোনো সালাতেই হাঁচি আসলে আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করা যাবে-চাই তা ফরয, সুন্নত বা নফল যাই হোক না কেন। এ পক্ষেই মত ব্যক্ত করেছেন, অধিকাংশ সাহাবী, তাবেঈ এবং ইমাম মালেক, শাফেঈ, আহমদ প্রমুখ ইমামগণ।
তবে তা চুপি স্বরে অথবা এমনভাবে পড়া উচিৎ যে, সে যেন নিজের কানে শুনতে পায়। কিন্তু জামাআতে সালাত পড়ার সময় এতটা উঁচু আওয়াজে বলবে না যে, অন্যান্য মুসল্লিদের সালাতে ব্যাঘাত ঘটে।
তবে সালাতরত অবস্থায় হাঁচির জবাব দেওয়া জায়েয নেই। এ ব্যাপারে আলেমদের কোনো দ্বিমত নেই।
ইমাম নববী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন:
“সালাত রত অবস্থায় কেউ হাঁচির জবাব দিলে তার সালাত ভঙ্গ হয়ে যাবে।”
হাই উঠলে কি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা…‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম’ পাঠ করা মুস্তাহাব?
হাই উঠলে করণীয় হল, মুখে হাত দিয়ে হাই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা। অন্যথায় মুখগহ্বর দিয়ে শয়তান ভিতরে প্রবেশ করে। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا تَثَاوَبَ أَحَدُكُمْ فَلْيُمْسِكْ بِيَدِهِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَدْخُلُ ”
“যদি তোমাদের কেউ হাই তোলে তবে সে যেন তাঁর মুখের উপর হাত রেখে তাকে প্রতিহত করে। কেননা এ সময় শয়তান (মুখ দিয়ে) প্রবেশ করে।”
[সহীহ মুসলিম, হা/৭২২২, অন্য বর্ণনায় এসেছে, হাই প্রতিরোধ না করলে শয়তান হাসে।]
কিন্তু এ সময় “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” অথবা “আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজিম” পাঠ করা সম্পর্কে কোনো হাদিস আছে বলে জানা নেই-সালাতের মধ্যে হোক অথবা বাইরে হোক।
সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তারা উত্তর দেন:
“لا نعلم ما يدل على شرعية الاستعاذة عند التثاؤب لا في الصلاة ولا في خارجها”
“আমরা এমন কিছু জানি না, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাই উঠলে আউযুবিল্লাহ পাঠ করা শরিয়ত সম্মত-সালাতের মধ্যে হোক অথবা সালাতের বাইরে হোক।” [ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৬/৩৮৩]
আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল মাদানি
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, KSA
১৩। কোমরে হাত রেখে না দাঁড়ানো।
সাহাবি আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের ভেতর কোমরে হাত রেখে দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন।”
رواه أبوداود رقم (৯৪৭)، والحديث في صحيح البخاري كتاب العمل في الصلاة، باب الخصر في الصلاة.
জিয়াদ ইবনু সবিহ আল-হানাফি বলেন, ”আমি ইবনে ওমরের পাশে কোমরে হাত রেখে সালাত পড়লে তিনি আমার হাতে আঘাত করেন। সালাত শেষ করে বলেন, সালাতের ভেতর এভাবে কোমরে হাত বেধে দাড়াও?-অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি নিষেধ করেছেন।”
رواه الإمام أحمد (২/১০৬) وغيره، وصححه الحافظ العراقي في تخريج الإحياء، انظر: الإرواء (২/৯৪).
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে সরাসরি শ্রুত আরেকটি হাদিসে আছে, ”মাজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে জাহান্নামিরা স্বস্তির নিশ্বাস নিবে। আল্লাহ তোমার কাছে এর থেকে পানাহ চাই”
رواه البيهقي عن أبي هريرة مرفوعا. قال العراقي: ظاهرإسناده الصحة.
১৪। সালাতের ভেতর কাপড় ঝুলিয়ে না রাখা।
”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের ভেতর কাপড় ঝুলিয়ে রাখতে নিষেধ করেছেন, মুখ বন্ধ রাখতেও।”
رواه أبوداود رقم (৬৪৩) وهو في صحيح الجامع (৬৮৮৩) وقال: حديث حسن.
খাত্তাবি বলেছেন, ”সাদ্ল তথা কাপড় ঝুলানোর অর্থ হলো, শরীর থেকে মাটি পর্যন্ত কাপড় ঝুলিয়ে রাখা।” (আউনুল মাবুদ : ২/৩৪৭)
মিরকাত গ্রন্থে আছে, ”সাদ্ল তথা সালাতে কাপড় ঝুলানো সর্বাবস্থায় নিষেধ। কারণ, এগুলো অহংকারের আলামত- যা সালাতের ভেতর আরো নিন্দনীয়। নেহায়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন, সাদ্ল এর আকৃতি হলো, কাপড়ের দু’আচল দ্বারা পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষদেশ আবৃত করে আচলদ্বয় ডান কাঁধ ও বাম কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে নিক্ষেপ করা। রুকু-সেজদার জন্য এর ভেতর থেকে হাত বের করা। কেউ কেউ বলেছেন, এমনটি ইহুদিরা করত। অনেকে বলেছেন, সাদ্ল হলো, মাথা অথবা কাঁধের উপর কাপড় রেখে বক্ষদেশ কিংবা বাহুদ্বয়ের উপর দিয়ে দু’আচল নিচে ছেড়ে দেয়া। যার কারণে সম্পূর্ণ সালাত-ই শেষ হয় কাপড় দুরস্ত করতে করতে। এ অর্থহীন নড়াচড়াই সালাতের একাগ্রতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর বিপরীতে কাপড় বাধা থাকলে এ সমস্যাটি হয় না। বর্তমান যুগে কিছু কাপড় লক্ষ্য করা যায় (যেমন মরক্কোর আবাকাবা, এশিয়ার চাদর-শাল, সৌদিদের রুমাল) এমনভাবে তৈরি ও পরিধান করা হয়, যা দুরস্ত করতে করতে সালাত শেষ হয়ে যায়। এগুলো পরিত্যহ্য। অথবা এমনভাবে পরিধান করা যাতে সালাতে কোনো ধরনের সমস্যার সৃষ্টি না হয়। মুখ ঢাকার কারণ সর্ম্পকে ওলামাগণ বলেছেন, এর কারণে ভাল করে কেরাত পড়া কিংবা পরিপূর্ণভাবে সেজদা আদায় করা যায় না। তাই মুখ ঢাকাও নিষেধ।” (মিরকাতুল মাফাতিহ : ২/২৩৬)
১৫। আল্লাহ তাআলা বনি আদমকে সুন্দর আকৃতি ও সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। তাই এদের চাল-চলন ও উঠা-বসায় জীব-জানোয়ারের আকৃতি ও সাদৃশ্য ধারন করা দোষনীয়। বিশেষ করে সালাতের ভেতর।
এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক কিংবা অপছন্দনীয় হালাত হতে নিষেধ করেছেন। বর্ণিত আছে, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের ভেতর তিনটি জিনিস হতে নিষেধ করেছেন : কাকের মত ঠোকর, চতুষ্পদ জানোয়ারের ন্যায় বসা ও উটের ন্যায় একই জায়গা নির্দারণ করা।” (আহমদ : ৩/৪২৮)
এর অর্থ হলো : ”মসজিদের কোনো একটি অংশ সালাতের জন্য নির্দারণ করে নেয়া, অন্য কোথাও না বসা। যেমন উটের অভ্যাস।”الفتح الرباني (৪/৯১).
আরেকটি বর্ণনায় আছে, ”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোরগের মত ঠোকর, কুকরের মত বসা এবং শিয়ালের ন্যায় এদিক সেদিক তাকাতে নিষেধ করেছেন।”
رواه الإمام أحمد (২/৩১১) وهو في صحيح الترغيب رقم (৫৫৬).
যেমন কুকুর দু’পা বিছিয়ে, দু’হাত দাড় করে নিতম্বের উপর বসে, তদ্রুপ বসতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ দু’সেজদার মাঝখানে নামাজির পায়ের গোড়ালি দাড় করে তার উপর নিতম্ব রেখে উভয় হাত দিয়ে হাটু চেপে ধরে সামনের দিকে ঝুকে বসা।”
هذا تفسير الفقهاء، وأهل اللغة فالإقعاء عندهم أن يلصق الرجل أليتيه بالأرض وينصب ساقيه ويتساند إلى ظهره وفي الحديث (أنه صلى الله عليه وسلم أكل مقعيا)، مختار الصحاح، المادة : ق-ع- ا، للشيخ زين الدين محمد بن أبي بكر عبد الله القادر الرازي.
খুশু সালাতের প্রাণ, আর সালাত মহান আল্লাহর অন্যতম ইবাদত, খুশু বিহীন সালাত প্রাণহীন দেহের মত। সুতরাং আমাদের সালাতকে অর্থবহ ও মহান আল্লাহর দরবারে গ্রহনযোগ্য করতে হলে খুশু সহ সালাত আদায়ের বিকল্প নাই।
খুশুর বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। আল্লাহর তাওফিক ছাড়া কারো পক্ষেই পুঙ্খানুপুঙ্খ খুশু অর্জন করা সম্ভবপর নয়। আবার খুশু থেকে বঞ্চিত হওয়াও বড় দুর্ভাগ্য। এ জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
«اللهم إني أعوذ بك من قلب لا يخشع».
“হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে এমন অন্তর থেকে পানাহ চাই, যে ভীত হয় না (খুশু অর্জন করে না)। তিরমিযী, ৫/৪৮৫, হাদীস নং ৩৪৮২, সহীহ তিরমিযী, ২৭৬৯।