আমাদের জীবনে অনেক সময় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সমস্যা হয় যে কোনটি করলে ভালো হবে? কোন কাজ করবো কি করবো না ইত্যাদি। অবশ্য এই বিষয়টি ফরয ওয়াজিব কাজ করা বা হারাম নাজায়েয কাজ না করার ক্ষেত্রে হবে না। কারন ফরয ওয়াজিব কাজ করতেই হবে এবং হারাম নাজায়েয কাজ থেকে দূরে থাকতেই হবে। ইসতেখারা শুধু মুবাহ বা জায়েজ কাজ করা না করা আর মোস্তাহাব বা উত্তম—দ্বি-অবকাশমুখী কাজের মাঝে কোনটি করবে তা নির্ণয়ের জন্য হয়ে থাকে।
ইসতেখারা নামাজ ও দু’আ সমন্বয়। সৌভাগ্যবান সে যে ইসতেখারা করে আর হতভাগা সে যে ইসতেখারা করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
আদম সন্তানের সৌভাগ্যের বিষয়সমূহ থেকে একটি হল ইসতেখারা করা ও আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা। আর মানুষের দুর্ভাগ্য হল ইসতেখারা না করা ও আল্লাহর ফয়সালার উপর অসন্তুষ্ট থাকা। আহমাদঃ ১৩৬৭
ইস্তেখারার উপকারীতা বা প্রয়োজনীয়তাঃ
ইসতেখারা শরিয়ত স্বীকৃত একটি এবাদত। এ আমল সে করবে যে শরিয়ত অনুমোদিত কোন মুবাহ বা হালাল কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে।—অথবা যে দ্বি-অবকাশমুখী মোস্তাহাবের উত্তমটি নির্ণয়ের ইচ্ছা করে। কেননা দ্বি-অবকাশমুখী মোস্তাহাব এবং ওয়াজিব কাজ আদায়ে হারাম ও মাকরূহ কাজ পরিহারে ইসতেখারা হয় না। হ্যা যদি কোন মাকরূহ পরিহার করাতে অপূরণীয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে সে মাকরূহ ছাড়া না ছাড়ার ব্যাপারে ইসতেখারা হতে পারে। যে সব কাজে ইসতেখারা হয় তন্মধ্যে—যেমন সফর, চাকুরি, বিয়ে ঘর বা দোকান ভাড়া ইত্যাদি।
উম্মতের প্রতি রাসূলের অগাধ ভালোবাসা ও দয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ এই যে, তিনি উম্মতকে শিক্ষা দিলেন প্রত্যেক কাজের ভাল-মন্দ আল্লাহ তাআলা থেকে চেয়ে নাও এবং সম্পর্ক আল্লাহর সাথে রাখ।
ইসতেখারার দু’আ এ শিক্ষা দেয় যে, কোন মানুষ তার ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তথা নির্ভুল পদক্ষেপ, সুউচ্চ জ্ঞান বৃদ্ধি, অর্থ সম্পদ, বংশ-মর্যাদা ও আধিপত্যের দ্বারা মন্দ কাজ থেকে বেঁচে গেলে ভাল-কাজ করার ক্ষমতা রাখে না। বরং মহান আল্লাহ যাকে চান সেই শুধু ভাল কাজ করতে পারে ও মন্দ কাজ থেকে বাঁচতে পারে। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لا حول و لا قوة إلا بالله বেহেশতের গুপ্ত ধনসমূহের একটি ধন।
ইসতেখারা সর্ব কাজের সফলতার সর্বোত্তম উপায়। কেননা, এতে নম্রতা ও বিনয়ের সাথে মহান আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের আকাঙ্ক্ষা ও অভাবনীয় শাস্তি থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানানো হয়। যেহেতু তিনিই সর্ব কাজের অধিকারী, তাই তিনিই জানেন, প্রতিটি কাজের পরিণাম ফল কী হবে। তাই মানুষ ইসতেখারার মাধ্যমে তারই শরণাপন্ন হয়, যাতে সফলতার দিক নির্দেশনা পায়। মহান আল্লাহ বলেছেন –
ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً
“তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে ও সংগোপনে।” [ সূরা আরাফ : ৫৫ ]
ইসতেখারার নামাজ কমপক্ষে দুই রাকাত এবং তা নফল। হ্যাঁ, যদি তাহিয়্যাতুল মসজিদের সাথে সাথে (যা মসজিদের প্রবেশের পর পর পড়া হয়) ইসতেখারার নিয়ত করলে এক সাথে উভয়টা আদায় হয়ে যাবে।
হাদিসের বাহ্যিক দৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে যে ইসতেখারার দু’আ নামাজের পরে হবে। কিন্তু কিছু সংখ্যক ওলামা বলেছেন নামাজের মধ্যেও হতে পারে। যেমন সেজদারত অবস্থায় ও শেষ বৈঠকে তাশাহুদ ও দরুদ শরীফের পর। হাদিসের বর্ণনায় বুঝা যাচ্ছে যে আগে নামাজ অত:পর দোয়া। তার কারণ, ইসতেখারা করার অর্থই হল ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের কল্যাণ চেয়ে নেওয়া। আর আল্লাহর রহমতের দরজা খোলার জন্য নামাজতুল্য কোন এবাদত নেই। কেননা নামাজই একমাত্র এবাদত যাতে অনেক এবাদতের সমষ্টি রয়েছে। আল্লাহর প্রশংসা তার বড়ত্ব ও মহত্ত্ব ও সর্ব শ্রেণির লোকের সর্বাবস্থায় মুখাপেক্ষীর উজ্জ্বল প্রমাণ।
যে ব্যক্তি ইসতেখারা করবে সে অবশ্যই দু’আর মাঝে তার প্রত্যাশিত বিষয় উল্লেখ করবে।
বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন, ইসতেখারা করার পর তার মন যে দিকে ধাবিত হবে সে দিকেই যাবে। আর যদি কোন দিকে ধাবিত না হয় তা হলে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন দিক নির্দেশনা না পাবে, বা কোন দিকে মন ধাবিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসতেখারা করতে থাকবে।
এই ইস্তেখারার হাদীস নির্দেশনায় আল্লাহর দুটি সিফাত বা গুণ প্রমাণিত হল। এক : এলেম বা জ্ঞানের সিফাত। দুই : কুদরত বা ক্ষমতার সিফাত। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হল যে, আল্লাহর নাম বা গুণের উসিলায় দু’আ করা শরিয়ত স্বীকৃত।
জাবের রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে কোন কাজ করার পূর্বে ইসতেখারার নির্দেশ দিতেন। তাই ইসতেখারার দু’আ এরূপ গুরুত্ব দিয়ে মুখস্থ করাতেন যেরূপ গুরুত্ব দিয়ে মুখস্থ করাতেন কুরআনের সূরা।
ইসতেখারার নিয়ম এই যে, প্রথমে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে দোয়া পাঠ করবে—যার অর্থ: হে আল্লাহ ! আমি আপনার ইলমের মাধ্যমে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের মাধ্যমে আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি। এবং আপনার মহা অনুগ্রহ কামনা করছি। কেননা আপনি শক্তিধর, আমি শক্তিহীন, আপনি জ্ঞানবান, আমি জ্ঞানহীন। এবং আপনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী। হে আল্লাহ ! এই কাজটি (এখানে উদ্দিষ্ট কাজ বা বিষয়টি উল্লেখ করবে) আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দ্বীন, আমার জীবিকা এবং আমার পরিণতির ক্ষেত্রে অথবা ইহলোক ও পরলোকে কল্যাণকর হয়, তবে তাতে আমাকে সামর্থ্য দিন। পক্ষান্তরে এই কাজটি আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দ্বীন, জীবিকা, ও পরিণতির দিক দিয়ে অথবা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিকর হয়, তবে আপনি তা আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং আমাকেও তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং কল্যাণ যেখানেই থাকুক, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। অত:পর তাতেই আমাকে পরিতুষ্ট রাখুন। (অত:পর সে তার প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে।) [ সহীহ বুখারী ]
ইসতেখারার দু”আ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ
فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ
اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ
وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ ارْضِنِي بِهِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী-আস্তাখিরুকা বি-ইলমিকা ওয়া আস্তাকদিরুকা বি-কুদরাতিকা ওয়াআসআলুকা মিনফাদলিকাল আযীম, ফা-ইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু, ওয়া তা’লামু ওয়ালা আ’লামু ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ূব। আল্লাহুম্মা ইনকুন্তা তা’লামু আন্না “হাযাল আমরা” (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে) খাইরুল্লি ফী- দ্বীনী ওয়া মা’আশী ওয়া আক্বিবাতি আমরী (অথবা বলবে: আ’ জিলি আমরি ওয়া আজিলিহি) ফাকদিরহু লী, ওয়া-য়াসসিরহু লী, সুম্মা বা-রিকলী ফীহি, ওয়া ইন কুনতা তা’লামু আন্না হাযাল আমরা (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে) শাররুল্লী ফী দীনী ওয়া মা’আশী ওয়াআকী¡বাতি আমরী (অথবা বলবে: আ জিলি আমরী ওয়া আজিলীহি) ফাসরিফহু আন্নী ওয়াসরীফনী আনহু ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাইসু কানা সুম্মা আরদিনী বিহী। (এর পর নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে)
: হে আল্লাহ! আমি আপনার জ্ঞানের দ্বারা আমার উদ্দিষ্ট কাজের মঙ্গলামঙ্গল জানতে চাই এবং আপনার ক্ষমতা বলে আমি কাজে সক্ষম হতে চাই। আর আমি আপনার মহান অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। কারণ, আপনি ক্ষমতাবান আর আমার কোন ক্ষমতা নেই এবং আপনি জানেন আর আমি জানি না। আপনিই গায়িব সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। হে আল্লাহ! যদি আপনার জ্ঞানে এ কাজটিকে আমার দ্বীনের ব্যাপারে, আমার জীবন ধারণে ও পরিণামে- রাবী বলেন, কিংবা তিনি বলেছেন- আমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিক দিয়ে মঙ্গলজনক বলে জানেন তাহলে তা আমার জন্য নির্ধারিত করে দিন। আর যদি আমার এ কাজটি আমার দ্বীনের ব্যাপারে, জীবন ধারণে ও পরিণামে- রাবী বলেন, কিংবা তিনি বলেছেন- দুনিয়ায় আমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিক দিয়ে আপনি আমার জন্য অমঙ্গলজনক মনে করেন, তবে আপনি তা আমা হতে ফিরিয়ে নিন। আমাকেও তা হতে ফিরিয়ে রাখুন। আর যেখানেই হোক, আমার জন্য মঙ্গলজনক কাজ নির্ধারিত করে দিন। তারপর আমাকে আপনার নির্ধারিত কাজের প্রতি তৃপ্ত রাখুন। রাবী বলেন, সে যেন এ সময় তার প্রয়োজনের নির্দিষ্ট বিষয়ের কথা উল্লেখ করে।(আধুনিক প্রকাশনী- ৫৯৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৮২৭)