আজ একটি বিষয় তুলে ধরছি যা সমাজে ও পরিবারে অশান্তির অন্যতম একটি কারন। প্রতিটি ব্যক্তি আজ যেন অস্থির অবস্থায় দিন যাপন করছে, প্রত্যেকেরই জীবনের আজ যেন উচ্চাকাঙ্কখার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে রেখেছে ফলে অন্য কিছু চিন্তা বা দেখার সময় নেই, দুনিয়ার চাওয়া পাওয়ার মাঝেই যেন সব, আখেরাতের দিনে ফিরে যেতেই হবে এ যেন মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।আর এই অবস্থায় যদি কেউ ভাষার অপপ্রয়োগে কথা বলে থাকে তখনই যেন আগুনের মাঝে আরেকটু তেল ঢেলে দেয়ার মত কাজ করে থাকে। হ্যা আমি ভাষার সঠিক ও সুন্দর ব্যবহার সম্পর্কে না জানা, অভ্যস্থ না হওয়ার ফলে যে অশান্তি পরিবেশে বিরাজ করে তার দিকে ইংগিত করছি। পিতা মাতার ও সন্তানের, স্বা্মী স্ত্রীর সাথে, প্রতিবেশীর সাথে, আত্মীয়দের সাথে, রাস্তা ঘাটে পথিকের সাথে, অফিস আদালাত বা শিক্ষাংগনে এক কথায় মানুষের সাথে মানুষের যে ভাবে ভাষার প্রয়োগের কথা ছিল তা না হওয়াতেই আজ অশান্তির নেক কারনের মাঝে অন্যতম বড় কারন।
শুধুমাত্র ভাষার সুন্দর প্রয়োগের মাধ্যমে অনেক অশান্ত পরিবেশকে যেমন শান্ত করা যায় আবার এর অপপ্রয়োগের কারনে আরো দূর্বিসহ করা যায়। আর তাই হাদীসে এসেছে-
সাহল ইবন সা’দ (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, “কেউ যদি আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারে যে, তার দু’চোয়ালের মাঝখানের অঙ্গ (জিহবা) এবং দু’পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ (গুপ্তাঙ্গ) সম্পর্কে (যে সে সেগুলো সুরক্ষিত রাখবে), আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হতে পারি ৷” (সহীহ আল-বুখারী)
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, “বস্তুত আল্লাহর বান্দা কোন কথা বলবে যখন এর ফলাফল নিয়ে সে চিন্তা করবে না এবং এর পরিণতিতে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, যার দূরত্ব হচেছ পূর্বদিক ও পশ্চিমদিকের মধ্যবর্তী দূরত্বেরও অধিক ৷” (সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম)
ইসলাম ব্যক্তির সম্মান রক্ষন করার সাথে সাথে পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রীয় পরিবেশকে শান্ত নিরাপদ রাখার ব্যবস্থাও দিয়েছেন। আর এর জন্য ভাষার সঠিক প্রয়োগ অন্যতম। সকলেই যেন যার যার অবস্থানে এই ব্যপারে সচেতন থাকে সেই জন্য মহান আল্লাহ জানিয়েছেন—
“মানুষ যে কথাই উচচারণ করে, তার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে ৷” (সূরা কাফ:১৮)
“অবশ্যই তোমার প্রতিপালক সতর্ক দৃষ্টি রাখেন ৷” (সূরা আল-ফজর:১৪)
প্রত্যেক ব্যক্তি, যে তার কার্যসমূহের জন্য দায়িত্বশীল, তাকে অবশ্যই নিজের জিহ্বাকে সব ধরনের বক্তব্য বা কথা থেকে রক্ষা করা উচিত, কেবলমাত্র সে সমস্ত কথা ছাড়া যেগুলোর মধ্যে কোন মঙ্গল রয়েছে ৷ ফলে যে পরিস্থিতিতে কথা বলা বা না বলা উভয় অবস্থাই মঙ্গলজনক, সেক্ষেত্রে চুপ করে থাকাই হচ্ছে সুন্নাহ ৷
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে কেউ আল্লাহ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে, হয় সে ভাল কথা বলুক বা চুপ থাকুক ৷” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)
মহান আল্লাহই এই ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন-
‘পরম করুণাময়, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’
(সূরা আর-রহমান:১-৪)
আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে। (সূরা আর-রূম, আয়াত : ২২)
যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মাঝে নিজস্ব ভাষাতেই নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন মহান আল্লাহ যেন জাতির লোকেরা নির্দেশাবলী বুঝতে পারে সহজেই।
‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার কওমের ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়, (সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ০৪)
নিজের ভাষায় সুন্দর করে যেমন আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটবে তা অন্য ভাষা দিয়ে সম্ভব নয়।আবার ভাষার সঠিক উপযোগী সুন্দর ব্যবহার দিয়ে সকলের সাথে সুন্দর সম্পর্ক ও পরিবেশ সুন্দর রাখা যায়। প্রতিটি পরিবারেই তাই সন্তানকে সুন্দর করা কথা বলা ও ভাষার সঠিক ব্যবহারের প্রশিক্ষন দেয়া প্রয়োজন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ স.কেও শিশুকালে ভাষার দিক থেকে প্রসিদ্ধ আরবের তৎকালীন সা‘দ ইবন বকর গোত্রে থেকে প্রশিক্ষন লাভে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী লোকটিই ভাষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি নিজে আরবদের মধ্যে সবচে শুদ্ধভাষী ব্যক্তি ছিলেন।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুকাল থেকেই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন। তিনি জীবনে একটি মিথ্যা বাক্যও উচ্চারণ করেন নি। বচনে, আচরণে, পোশাকে, আখলাকে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ থাকাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর ভাষা ছিল শুদ্ধ এবং উচ্চারণ ছিল সুস্পষ্ট। তিনি দ্রুত বাক্য বলতেন না। তাঁর প্রতিটি বাক্যই শুধু নয়, প্রতিটি অক্ষরও অন্যরা বুঝতে পারতেন। তাঁর ভাষণ পদ্ধতি এমন ছিল যে, যত বড় মাহফিল হতো, তাঁর স্বর তত উচ্চ হতো। যার ফলে বিদায় হজে আরাফার ময়দানে (মাইক ছাড়া) লাখ লাখ মানুষের তাঁর ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় নি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই বলেছেন,
«إِنَّ مِنَ البَيَانِ لَسِحْرًا»
“নিশ্চয় ভাষাশৈলিতে জাদু রয়েছে”। [বুখারী, ৫১৪৬] অর্থাৎ ভাষার যে জাদুকরি প্রভাব রয়েছে তা অনস্বীকার্য।
তাই মানুষকে আল্লাহর সব নেয়ামতের সঙ্গে ভাষার নেয়ামতেরও যথার্থ মূল্যায়ন করা উচিত। ভাষার নেয়ামতের কদর করা মানে অশুদ্ধ শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ না করা, মিথ্যা বাক্য ব্যবহার না করা, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা, মাতৃভাষায় সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ করা এবং ভাষার অপপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা।
তাই করনীয়-
- মহান আল্লাহর দেয়া নি’আমত ভাষার যথার্থ মূল্যায়ন ও শুকরিয়া জ্ঞাপন।
- মাতৃভাষার শুদ্ধ ও সুস্পষ্ট উচ্চারন করা
- মাতৃভাষার চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের পথ উন্মুক্তকরন
- মিথ্যা ও অশালিন বাক্য ব্যবহার না করা
- ভাষার অপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা
হিরার চেয়ে দামী ভাষার প্রয়োগে আত্মনিয়োগ করি
সুন্দর সুখী আদর্শ সমাজ গড়ি।
সুফিয়ান ইবন আবদিল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বল্লেন: “হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে এমন একটি বিষয় সম্পর্কে বলুন যার উপর আমি দৃঢ় থাকতে পারি ৷” তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বল: “আমি আল্লাহতে বিশ্বাসী, এবং তারপর এর উপর দৃঢ় থেকো ৷” আমি বললাম: “হে আল্লাহর রাসূল (সা.), আমার জন্য আমি কোন বিষয়কে বা পরিস্থিতিকে সবচেয়ে ভয় করব ?” তখন তিনি (সা.) তার জিহবাকে ধরলেন এবং বললেন, “এইটি ৷” (৪:২৪১৩ হাসান, সহীহ আত-তিরমিযী, ইবন মাজাহ, আহমদ)
তাই আমাদের প্রশিক্ষন হোক জিহবার সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রন, ভাষার উপযুক্ত ব্যবহার যা আমলনামার কল্যানের পাল্লা বা নেকীর পাল্লাকেই ভারী করে দেবে। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।