মানুষের সর্বোত্তম আমল হল নিরর্থক কাজ বর্জন করা। অতএব যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে ব্যস্ত রইল এবং দুনিয়ার কাজে তার পূর্ণ সময় ব্যয় করল এবং অধিক হারে মুবাহ কাজ করল- এই মুবাহ কাজ দ্বারা আল্লাহর আনুগত্য করার সাহায্য চাওয়া ছাড়া – সে তার জন্য গুনাহের উপকরণ সমূহ উন্মুক্ত করে দিল। সহীহ জামে আত তিরমিযী
তবে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমূহ-ই হল গুনাহের দরজা ।
ইবনুল কাইয়ুম বলেন, যে ব্যক্তি চতুষ্টয়কে সংরক্ষণ করল সে তার দ্বীনকে নিরাপদ করল সে গুলো হল:-
- মুহূর্ত ও সময়
- ক্ষতিকারক বস্তু সমূহ
- বাকশক্তি এবং
- পদক্ষেপ সমূহ।
অতএব, এই চারটি দরজায় নিজের পাহারাদার নিযুক্ত করা উচিত। মানুষের কাছে অধিকাংশ গুনাহ এই চারটি পথেই প্রবেশ করে থাকে।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
‘জেনে রেখো! শরীরের মধ্যে এমন এক টুকরা গোশত রয়েছে, যা সুস্থ থাকলে সারা শরীরই সুস্থ থাকে, আর এটা অসুস্থ হয়ে গেলে সারা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়। জেনে রেখো, আর এটাই হ’ল ক্বলব’।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
‘ক্বলব সকল কিছুর মূল। যেমনিভাবে আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ক্বলব হ’ল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাদশা আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হ’ল তার সেনাবাহিনী। বাদশা ভাল হ’লে তার সেনাবাহিনী ভাল হয়। আর সেনাবাহিনী তখনই খারাপ হবে যখন বাদশা খারাপ হয়ে যাবে’।
মহান আল্লাহ বলেছেন-
‘ক্বিয়ামতের দিন কোন অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি কারো কোন উপকারে আসবে না। একমাত্র সে ব্যক্তি মুক্তি পাবে, যে সুস্থ্য ক্বলব নিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছবে’। সূরা আশ শু‘আরা ৮৮-৮৯।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
‘চাটাই বুননের মত এক এক করে ফিতনা মানুষের ক্বলবে আসতে থাকে। যে ক্বলবে তা গেঁথে যায় তাতে একটি করে কালো দাগ পড়ে। আর যে ক্বলব তা প্রত্যাখ্যান করে তাতে একটি করে শুভ্রোজ্জ্বল চিহ্ন পড়ে। এমনি করে দু’টি ক্বলব দু’ধরনের হয়ে যায়। একটি উল্টানো কালো কলসির ন্যায় হয়ে যায়। প্রবৃত্তি তার মধ্যে যা গেঁথে দেয় তা ব্যতীত ভালমন্দ কিছুই চিনে না। আর অপরটি শ্বেত পাথরের ন্যায়; আসমান ও যমীনের স্থায়িত্ব যতদিন ততদিন কোন ফিতনা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।
আমরা নিজেদের ক্বলবের কাছে প্রশ্ন রাখি, নিজেদের সব কাজ কি শুধুমাত্র একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসূল স. এর দেখানো পথে করছি কি না??
মুহাম্মদ সা. এর মূল দায়িত্ব ছিল ইসলাম প্রচার। তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই – মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা। সাধারণ মানুষের জন্য যখন পেশাটা নেশা হয়ে যায় তখন তার দিন-রাত থাকেনা। কিন্তু প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ সা. দেখিয়ে গিয়েছেন কি ভাবে ভারসাম্য আনতে হয়। তাঁর তাই দিন এবং রাত ছিল এবং আলাদা আলাদা ভাবেই ছিল। তিনি ইশার সলাতের পর কথা বলতে অপছন্দ করতেন। যার কাজই ছিল মানুষকে ডাকা সেই তিনিই তখন ওয়াজ করতেননা, ঘুমিয়ে পড়তেন। ইশার পর তিনি সমাজ থেকে মুখ ফিরাতেন পরিবারের দিকে, নিজের দিকে। শেষরাতে উঠে আল্লাহকে ডাকতেন। তিনি বুঝেছিলেন মানুষকে ডাকা তাঁর দায়িত্ব; আর আল্লাহকে ডাকা তাঁর সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। আমাদের অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদাত করা। মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা সে ইবাদাতের অংশ। কিন্তু শুধু অন্য মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবো সেজন্য আমাদের সৃষ্টি করা হয়নি। পৃথিবীতে যত মানুষ যত ধরনের আদর্শ প্রচার করে গিয়েছেন, তাদের সবার উদ্দেশ্য অন্যদেরকে নিজেদের মত ও পথের অনুসারী করে তোলা। কিন্তু একজন মুসলিম নিজের দলে ভেড়ানোর জন্য মানুষকে ডাকেনা। সে মানুষকে ডাকে মহান আল্লাহর নির্দেশিত মতের অনুসারী হতে কারণ আল্লাহ তাকে আদেশ দিয়েছেন ।
প্রত্যেকটা মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে। শুধুমাত্র তারাই বেঁচে গেছে যারা নিচের চারটা কাজ করতে পেরেছে
প্রথম কাজঃ ঈমান আনা।
দ্বিতীয় কাজঃ সৎ কাজ করা – আল্লাহ এবং তাঁর রসুল সৎ কাজ হিসেবে যা ঠিক করেছেন সেগুলো, নিজের মন যেগুলোকে সৎ কাজ হিসেবে ঠিক করে সেগুলো নয়।
তৃতীয় কাজঃ ইসলামের পথে দাওয়াত দেয়া, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার সাথে।
৪র্থ কাজঃ অন্যদের ধৈর্যের প্রতি আহবান জানানো – প্রথম তিনটি কাজ করতে গেলে যে বিপদ আসবে সে সময় আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য্য ধরা
এবার নিজ অন্তরকে প্রশ্ন করে দেখি—আমরা রাসূলের স. উম্মত হয়ে হাউযে কাউসারের পানি পান করার উপযুক্ত হতে কোন পথে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি ??
মহান আল্লাহই তাঁর রাসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছিলেন এবং একে অন্যান্য সকল মতবাদের উপর বিজয়ী করেই তাঁর উম্মতকে সাক্ষী রেখে, দায়িত্ব হস্তান্তর করেই মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন।
মহান আল্লাহ তাঁর আলোকে (ইসলাম) প্রজ্বলিত করবেনই , যতই বাতিল শক্তি তা নেভাতে চাক না কেন। (সূরা তওবা ৩২-৩৩ এর আলোকে)
রাসূল(সঃ) ইসলামকে প্রজ্বলিত করতে চারটি ধাপে কাজ করেছেন।
১ম। কুরআন (আয়াত) পরে শুনিয়েছেন,
২য়। যারা গ্রহন করতে চেয়েছেন তাদের জীবনকে সেই কুরআনের আলোকে পরিশুদ্ধ করেছেন
৩য়। হিকমাত ও প্রজ্ঞা শিখিয়েছেন
৪র্থ। অহীর জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছেন।
আরেকটি প্রশ্ন অন্তরকে করি, আমরা কি নিজ জীবনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি যা নফস ও সমাজের অন্য মত বা চাওয়া পাওয়ার উপরে?
ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন রকমের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অংগনে আমাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রাখবো তবে তার পূর্বে প্রথমে নিজেকে যাচাই করি। কারন আমাদের প্রত্যেকের দেহ থেকে যখন রুহ বের হয়ে যাবে তখন সেই মুহুর্ত থেকে পরিচয় হয়ে যাবে লাশ বা মুর্দা এবং তাড়াতাড়ি কবরে শুইয়ে দিয়ে আসার জন্য পরিবার সমাজ ব্যস্ত হয়ে যাবে-এটাই বাস্তবতা। কিন্তু সাথে কি যাবে? একটু ভাবার অবকাশ দিলাম।
রাসূল(সঃ) আমাদের আদর্শ। বর্তমান সমাজের সাথে তুলনা করে নিজেকে ভালোর কাতারে নিয়ে আসার মধ্যে সাময়িক পরিতৃপ্তি আসতে পারে কিন্তু মহান আল্লাহর খাতায় রাসূলের উম্মত হিসেবে নাম উঠেছে কিনা তা প্রশ্নের অবতারনা করে। আজ আমরা নানা ভাবে ইসলাম প্রচারের কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু সত্যিকারের একজন আমলদার দাঈ পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। । আজ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকেই নিজেদের জীবন ভারসাম্যহীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাছেন।
রাসূল(সঃ) বলেছেন-“আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ইবনু আদম! তুমি নিজেকে আমার ইবাদাতের জন্য মুক্ত করে দাও, আমি তোমাদের বক্ষকে ঐশ্বর্য ও অভাবহীনতা দিয়ে পূর্ণ করে দিবো। তোমার দারিদ্র ও অভাব দূর করে দিবো। আর যদি তা না করো তবে আমি তোমার অন্তরকে ব্যস্ততা দ্বারা পূর্ণ করবো এবং তোমার দারিদ্র দূর করবো না। জামে আত তিরমিযী
রাসূল(সঃ) এর দেখানো মূল নির্দেশনা উপেক্ষা করে কোনদিন সমাজতো দূরে নিজের জীবনেও ইসলাম কায়েম হবে না। রাসূল স. মহান রবের নির্ধারিত পথেই ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন, অন্য কোন ছল চাতুরীর পদ্ধতির কাছে মাথা নত করেননি।
আজ অনেক ক্ষেত্রে ঈমানদারদের শয়তান ভালো কাজ করতে বাধা দেয় না কারণ সে জানে ঈমানদার ব্যক্তি ভালো কাজ করবে কিন্তু সেই কাজটাকে কিভাবে আল্লাহর কাছে বাতিল করানো যায় সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। ভালো কাজ মহান রবের কাছে গ্রহন যোগ্যতার জন্য অবশ্যই দুটি শর্ত লাগবে ( শুধু মাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং রাসূল স.এর দেখানো পদ্ধতি) যা ছাড়া ভালো কাজ কবরে/আখেরাতে কোন কাজে আসবে না। এর মাধ্যমে দুনিয়াতে একটু বাহ বাহ বা তৃপ্তি পেতে পারে।
হে ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় করো৷ আর প্রত্যেককেই যেন লক্ষ রাখে, সে আগামীকালের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে ৷ আল্লাহকে ভয় করতে থাক ৷ আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই তোমাদের সেই সব কাজ সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করে থাক ৷তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন৷তারাই ফাসেক৷ সূরা হাশর ১৮-১৯
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন–
আর যে ব্যক্তি কোন সৎকাজ করবে, সে পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন, তবে যদি সে মুমিন হয় , তাহলে এই ধরনের লোকেরাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের এক অণুপরিমাণ অধিকারও হরণ করা হবে না ৷সেই ব্যক্তির চাইতে ভালো আর কার জীবনধারা হতে পারে, যে আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছে, সৎনীতি অবলম্বন করেছে এবং একনিষ্ট হয়ে ইবরাহীমের পদ্ধতি অনুসরণ করেছে ? সেই ইবরাহীমের পদ্ধতি যাকে আল্লাহ নিজের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিলেন।
সূরা নিসা: ১২৪-১২৫
আবূ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
‘আমাদের সামনে রাসূলুল্লাহ সা. আবির্ভুত হলেন, তখন আমরা দারিদ্র এবং এ নিয়ে আমাদের শংকা নিয়ে আলাপ করছিলাম। তিনি বললেন, ‘তোমরা দারিদ্রকে ভয় পাচ্ছো? শপথ সেই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের ওপর প্রবলভাবে দুনিয়াকে ঢেলে দেওয়া হবে এমনকি তোমাদের কারও অন্তর কেবল শুধু সেদিকেই ঝুঁকবে। আল্লাহর শপথ, ‘আমি তোমাদের রেখে যাচ্ছি পরিষ্কার সাদা সমতলে, যার দিন তার রাত্রির মতই।’
আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যিই আমাদের পরিষ্কার সাদা সমতলে রেখে যান, যার দিন তার রাত্রির মতই। ইবন মাজা : ০৬
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘আমি তোমাদের রেখে যাচ্ছি পরিষ্কার সাদা সমতলে, যার দিন তার রাত্রির মতই। তা থেকে কেউ বিচ্যুত হবে না; একমাত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া। অতএব আমার পরে যে বেঁচে থাকবে, অনেক বেশি মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নতের এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাদের আঁকড়ে ধরবে। মাড়ির দাঁত দিয়ে তা আকড়ে থাকবে।’ ইবন মাজা : ৪৩; মুসনাদ আহমদ : ১৭১৮২
কুরআনের আয়াত ও হাদীসকে যদি আজ সামনে রেখে নিজের অন্তরকে প্রশ্ন করে খুঁজে দেখি , আমাদের অবস্থান কী এবং কোথায়?
বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের আরো সচেতন হয়ে চলা প্রয়োজন যেন আমাদের ইবাদাতগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়। আজ রাসূলের স. অনুসরনকে বাদ দিয়ে আধুনিকতার, প্রযুক্তির উন্নয়নের কথার দোহাই দিয়ে অনেক শরীয়ত বিরোধী নিয়ম বানিয়ে ভালো কাজের সাথে সংমিশ্রন করে আমল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অথচ অনেকেই বুঝতে পারছেন না। মহান আল্লাহ আমাদের উলিল আলবাব বা জ্ঞানবান বলে বলেছেন যে, তারা শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে মহান রবের সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে। মানুষের মাঝে চিন্তা করে ভালো মন্দ বুঝার অবকাশ মহান আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের অন্তর দৃষ্টি খুলে দিন আমীন।
কতগুলো বাস্তব উদাহরন দিয়ে এই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। এখানে সকলকে এক কাতারে ফেলে পর্যালোচনা করা হয়নি। শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তির যারা অবচেতন মনে বা ইচ্ছায় না বুঝে বা জেনে বুঝেই ভুল করে যাচ্ছেন তবে তারা আবার মহান রবের কাছে জান্নাতের প্রত্যাশী তাদের জন্য সংশোধনের